গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি নিয়ে দুটি সমস্যা

ব্রায়ান ডোনিগার


[করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে জৈব-রাজনীতি নিয়ে উঠা বিতর্কে পানাজিওটিস সোটিরিস ও কারস্টেন শুবার্ট গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির প্রস্তাব তোলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় জৈব-রাজনীতি প্যারাডাইমের সীমাবদ্ধতাকে উতরানোর লক্ষ্যে। সোটিরিসের জৈব-রাজনীতি পাঠের সমস্যা এবং তাঁর গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির প্রস্তাবের সঙ্কট দেখিয়ে ব্রায়ান ডোনিগারের ‘Two Problems with Democratic Biopolitics’ শীর্ষক একটি লেখা গত ২৮শে এপ্রিলে ছাপা হয়েছে Critical Legal Thinking ওয়েবসাইটে। ব্রায়ান ডোনিগার New School for Social Research বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসী রাজনৈতিক দর্শন পড়ান। ব্রায়ান ডোনিগারের এই লেখাটির অনুবাদ করেছেন সজীব সাখাওয়াত। সজীব সাখাওয়াত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]


কোভিড-১৯ মিশেল ফুকোর জৈব-রাজনীতি ধারণাকে একটা নতুন আগ্রহের দিকে ধাবিত করেছে। তবে এইটা এও উন্মোচন করেছে যে এই ধারণাটা ব্যাপকভাবে ভুল বোঝা হয়। অনেক অনেক ভাষ্যকার জৈব-রাজনীতির একটা বিস্তৃত সংজ্ঞায়নের ওপর নির্ভর করে আছেন যেটা জৈব-রাজনীতিকে ‘স্বাস্থ্যের রাজনীতি’ অথবা ‘জীবনের রাজনীতি’ হিসেবে দেখে। প্যানাজিওটিস সোটিরিসের ‘গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি কি আদৌ সম্ভব?’ শীর্ষক সমসাময়িক প্রবন্ধটা এই সমস্যার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সোটিরিস “জৈব-রাজনীতি” এবং “গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির” যে সংজ্ঞা দিয়েছেন আমরা দুটোকেই খারিজ করব। এই দুটো সংজ্ঞাকে এবার দেখা যাকঃ

  • সোটিরিস ‘জৈব-রাজনীতি’কে রাজনৈতিক অনুশীলনের এমন একটা গুচ্ছ মনে করেন যেটা ‘জনগণের স্বাস্থ্য (এবং উৎপাদনশীলতা) নিশ্চিত করে”। তিনি এই বিস্তৃত সংজ্ঞায় নির্ভর করেন তার কারণ তিনি জৈব-রাজনীতি টার্মটা দিয়ে বিশাল পরিসরে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত রাজনৈতিক অনুশীলনগুলোকে ব্যাখ্যা করতে চান। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন, কোভিডের সময়ে সামাজিক দূরত্ব, এইচআইভির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং বদ্ধ জনসমাগমমূলক স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করা এ সব বিচিত্র অনুশীলন জৈব-রাজনীতির অংশ।

  • যখন সোটিরিস ‘গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি’র কথা বলেন, তখন তিনি বুঝাতে চান যে জৈব-রাজনৈতিক অনুশীলনগুলো “জ্ঞান এবং বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া” দ্বারা অনুমোদিত হয়। এই সংজ্ঞায়ন ধারণা দেয় যে, গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতিকে এখনও সঠিকভাবে অনুধাবন করা হয়নি। সর্বোপরি, যদি গণতান্ত্রিক জৈব রাজনীতির অস্তিত্ব ইতোমধ্যেই থেকে থাকে, তাহলে এটা সম্ভব কি অসম্ভব এই প্রশ্ন নগণ্য হয়ে যায়। সংক্ষেপেঃ যখন যৌক্তিক এবং সামগ্রিক সিদ্ধান্ত তৈরি প্রক্রিয়া জৈব-রাজনীতিকে বৈধতা দেয়, তখনই গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি ঘটে এবং এই মুহুর্তে গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির অস্তিত্ব নাই।


সোটিরিসের সংজ্ঞাকে আমরা দুইটা কারণে খারিজ করব। প্রথমত, সোটিরিস ফুকোর চর্চিত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত দুইটি ভিন্ন রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলেছেনঃ জৈব-রাজনীতি এবং শরীরবিদ্যক-রাজনীতিসোটিরিসের সংজ্ঞাকে আমরা দুইটা কারণে খারিজ করব। প্রথমত, সোটিরিস ফুকোর চর্চিত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত দুইটি ভিন্ন রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলেছেনঃ জৈব-রাজনীতি এবং শরীরবিদ্যক-রাজনীতি[i]। দ্বিতীয়ত, আমরা যদি সোটিরিসের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটাকে ব্যবহার করি তাহলে বলতে হবে গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি ইতোমধ্যেই অনুধাবিত হয়েছে। জৈব-রাজনীতির জন্ম বইতে ফুকো কিভাবে মুক্ত, যৌক্তিক এবং সামগ্রিক সিদ্ধান্ত তৈরির মাধ্যমে জৈব-রাজনীতি বৈধতা পায় তার একটা সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক পাঠ প্রদান করেন। তাছাড়া, গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি সোটিরিস যতটা দেখানোর চেষ্টা করেন তার চেয়েও বেশি হিংস্র এবং ক্ষয়কারক। এইখানে আমার যোগ বা অবদানকে দুইটা ভাগে ভাগ করা যায়, যেখানে প্রত্যেকটা ভাগ এই সমস্যাগুলোর একেকটিকে সম্প্রসারিত করে।


শরীরবিদ্যক-রাজনীতি থেকে জৈব-রাজনীতির পৃথকীকরণ


নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, জনগণ’ তে ফুকো জৈব-রাজনীতির যে সংজ্ঞা দেন সেটা শরীরবিদ্যক-রাজনীতির বিপরীতাত্মক।


শরীরবিদ্যক-রাজনীতি হলো ‘মানবদেহের রাজনীতি’ (পৃ-২৪৩)। তার মানে এই নয় যে শরীরবিদ্যক-রাজনীতি জনগণের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সকল রাজনৈতিক কৌশলের বিকল্প তৈরি করে, বরং এটি এমন কৌশলকে নির্দেশ করে যা সরাসরি দেহের ওপর কাজ করে। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, শরীরবিদ্যক-রাজনীতি মানবদেহকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টা করে। ফুকো যেইটাকে উল্লেখ করেছেন এভাবে যে, শৃঙ্খলা সবসময়ই ‘দেহকে লক্ষ্যবস্তু করে’(পৃ-২৪২)। আমরা যখন শৃঙ্খলবদ্ধ হই, তখন আমাদের শরীর সরাসরি আরও বেশি উৎপাদনশীলভাবে বা প্রয়োজনীয়ভাবে সরাসরি প্রভাবিত হয়। শরীরবিদ্যক-রাজনীতি ‘দেহের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে... শরীরচর্চা, ড্রিল, এবং এসবের মাধ্যমে তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে”। (পূর্বোক্ত)


শরীরবিদ্যক-রাজনীতির ভালো একটা উদাহরণ হতে পারে মানসিক প্রতিষ্ঠানগুলোর থেরাপি। থেরাপিস্টরা সকল প্রকার শরীরচর্চা এবং ড্রিলের মাধ্যমে তাঁদের রোগীদের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করে। আরেকটা ভালো উদাহরণ হতে পারে কোভিড আক্রান্ত রোগীকে রেস্পিরেটরে রাখা, যেটা আসলে তাঁদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ এবং শরীরের স্বাস্থ্যকে বৃদ্ধি করার একটি প্রচেষ্টা।


বিপরীতে, জৈব-রাজনীতি শরীরের(স্বতন্ত্রের) রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করে না বরং ‘মানব গোষ্ঠীর’ রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করে(পৃ-২৪৩)। রাজনীতির এই রূপটি শরীরবিদ্যক-রাজনীতির মতো মানুষের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সকল রাজনীতির জন্য সর্বব্যাপী টার্ম না। শরীরবিদ্যক-রাজনীতি এবং জৈব-রাজনীতির পার্থক্য হলো জৈব-রাজনীতি কোন স্বতন্ত্রকে শৃঙ্খলবদ্ধ করার কৌশল বর্ণনা করেনা, বরং এমন কৌশল বলে যা ‘গোষ্ঠী’ বা প্রজাতির স্বাস্থ্য নিশ্চয়তা দেয়। স্বতন্ত্রের অবস্থা দেখে আমরা গোটা জনসংখ্যার স্বাস্থ্য পরিমাপ করতে পারব না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, থেরাপির নিশ্চিতকৃত স্বতন্ত্রের স্বাস্থ্য কখনোই স্পষ্টভাবে গোটা প্রজাতির স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না। এইভাবে, স্বতন্ত্রকে পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে জৈব-রাজনীতি নির্ভর করে “জন্ম-মৃত্যুর অনুপাত প্রদান করে, পুনরুৎপাদনের হার, জনসংখ্যার উর্বরতা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার” উপর(পৃ-২৪৩)। এই প্রক্রিয়াগুলো পরিসংখ্যান দ্বারা সম্পূর্ণ জনসংখ্যার স্বাস্থ্য নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করে।


একটা নগর সরকার যা সীমিত সংখ্যক রেস্পিরেটর বন্টনের ক্ষেত্রে তার পৌরসভাগুলোর কোভিডে মৃত্যুর হার ব্যবহার করে। এটা জৈব-রাজনীতির একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে। এখানে মূল লক্ষ্য স্পষ্টতই স্বতন্ত্রের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা নয়। এমন কি রেস্পিরেটর কিরূপে বন্টিত হবে তার সিদ্ধান্তের কারণে বহু স্বতন্ত্রের মৃত্যু ত্বরাণ্বিত হয়। স্বতন্ত্রের শরীরকে শৃঙ্খলবদ্ধ করার বদলে জৈব-রাজনৈতিক গণনার লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণভাবে জনসংখ্যার মৃত্যুহার কমানো। এইসবের একটা ফলাফল হলো, জৈব-রাজনীতির সকল স্বতন্ত্রের জীবনে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ করার দরকার পড়ে না। জৈব-রাজনীতি যতটা ঝুঁকি নির্ণয় কিম্বা সংযত করে ততটা নজরদারি কিম্বা নিয়ন্ত্রণ করে না। অপরাধের হার কোথায় সর্বোচ্চ? রোগের হার? কোথায় সবচেয়ে বেশী ওষুধ ব্যবহারের হার? এসবগুলো জৈব-রাজনৈতিক প্রশ্ন।


এই প্রসঙ্গে, আমরা দেখতে পাই যে সোটিরিসের জৈব-রাজনীতির সংজ্ঞাটি সমস্যাপূর্ণঃ তিনি বর্তমান জৈব-রাজনৈতিক অনুশীলন এবং ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য তৈরি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি বর্তমানের যে জৈব-রাজনীতির ব্যাখ্যা দেন সেটা আসলে অনেকটা শরীরবিদ্যক-রাজনীতির মতো। উদাহরণস্বরূপ, সোটিরিস উল্টোদাবি করেন গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি থেকে ‘কর্তৃত্ববাদী জৈব-রাজনীতি’র পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে, যেটার উদাহরণ হচ্ছে চীনঃ “অনেক ভাষ্যকার পরামর্শ দেন চীন.. আসলে জৈব-রাজনীতির একটা কর্তৃত্ববাদী রূপ বাস্তবায়ন করতে পারে.. যেটা বিশাল মাত্রায় বলপ্রয়োগ, নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণমূলক গণনা এবং চীনারাষ্ট্র নিষ্পত্তির জন্য যেসকল প্রযুক্তি এনেছে তাদের সহায়তায় হয়েছে”। সোটিরিস সাধারণভাবে ভাষ্যকারদের এই দাবি মেনে নেন যে, নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণ জৈব-রাজনীতিরই উদাহরণ। এখন পর্যন্ত, যেহেতু নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণ জনগণের স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে রাজনৈতিক প্রজেক্টের অংশ, সেহেতু তারা জৈব-রাজনীতিকে তাঁর বর্ণিত টার্মে গণনা করে। যাই হোক, ‘নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণ’-এর বিশাল প্রয়োগ আসলে স্পষ্টতই শৃঙ্খলার সাথে সম্পৃক্ত এবং সেটা আসলে কোনোভাবেই জৈব-রাজনীতি নয়, বরং শরীরবিদ্যক-রাজনীতি।


সারাংশ হল, ফুকো শরীরবিদ্যক-রাজনীতির বিপরীতে জৈব-রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণে দুটি ভিন্ন ঐতিহাসিক কৌশলের মাঝে সঠিক পার্থক্য স্থাপন করার জন্য। এটা অনেকটা অস্পষ্ট সোটিরিস কেন জৈব-রাজনীতিকে আমব্রেলা টার্ম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আমাদের ততক্ষণ পর্যন্ত এই পরিবর্তিত সংজ্ঞা গ্রহণ করা উচিৎ না, যতক্ষণ এটা নিশ্চিত না হয় যে কেন এই পরিবর্তন উপকারী।


নব্য-উদারনীতিবাদ, গণতন্ত্র এবং জৈব-রাজনীতি


ফুকো মনে করতেন আমরা যদি এটা জানতে চাই যে জৈব-রাজনীতি কিভাবে ঐতিহাসিকভাবে বৈধতা পেয়েছে তবে আমাদের ‘কর্তৃত্ববাদী জৈব-রাজনীতি’ নয় বরং উদারনীতিবাদ সম্পর্কে জানতে হবে—আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, নব্য-উদারনীতিবাদ।ফুকো মনে করতেন আমরা যদি এটা জানতে চাই যে জৈব-রাজনীতি কিভাবে ঐতিহাসিকভাবে বৈধতা পেয়েছে তবে আমাদের ‘কর্তৃত্ববাদী জৈব-রাজনীতি’ নয় বরং উদারনীতিবাদ সম্পর্কে জানতে হবে—আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, নব্য-উদারনীতিবাদ। জৈব-রাজনীতির জন্ম বইতে তিনি তাঁর ব্যাখ্যাকৃত লক্ষ্যগুলোর একটিতে জৈব-রাজনীতিকে ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে নব্য-উদারনীতিবাদ পাঠের কথা বলেছেন।


কেবল তখনই আমরা জৈব-রাজনীতিকে আয়ত্ত করতে পারব যদি আমরা জানতে পারি উদারনীতিবাদ নামের এই সরকারি রেজিম(শাসনামল) আসলে কি.. আমি দ্রুত এগোব এবং সমসাময়িক জার্মান উদারনীতিবাদ সম্পর্কে কথা বলব... বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে উদারনীতি(স্বাধীনতা), আরও সঠিকভাবে যদি বলি উদারনীতিবাদ, এমন একটা শব্দ যেটা আমাদের কাছে জার্মানি থেকে আসে। (পৃ-২২)


ফুকো উদারনীতিবাদকে একটা রেজিম হিসেবে বলেন। তার কারণ তিনি মনে করেন অনেক উদারনীতিবাদী—বিশেষ করে নব্য-উদারনীতিবাদীরা—যদিওবা বাজারের উপর রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ সীমিত করতে চায়, তবুও তারা একটা তেজস্বী এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র দাবি করেন। এই দাবি প্রমাণ করার জন্য, ফুকো ধাবিত হন চ্যান্সেলর লুডভিগ এরহার্দের(Ludwig Erhard) কাজের দিকে, যিনি নব্য-উদারনীতিবাদের একজন শুরুর দিককার প্রবক্তা। এরহার্দ লিখেছেন, “আমাদের অবশ্যই অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা উচিত” (পৃ ৮০-৮১) । যেভাবেই হোক, এরহার্ড লক্ষ্য করেন একটি মুক্ত অর্থনীতি হলো রাষ্ট্রকে বৈধতা দেয়ার সর্বোত্তম পন্থা- রাষ্ট্রকে বলিষ্ঠ এবং স্থায়ীরূপে পেশ করার সর্বোত্তম উপায়। তিনি যুক্তি দেন যে মুক্ত অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ “কারণ বৈধভাবে জনগণের নাম নিয়ে কেবল একটা রাষ্ট্রই তার নাগরিকদের স্বাধীনতা এবং দায়িত্ব উভয়ই স্থাপন করতে পারে”(পৃ-৮১)। অন্যকথায় বললে, একটা উঠতি প্রতিযোগিতামূলক বাজার হচ্ছে নাগরিকদের ‘মুক্ত’ ও ‘দায়িত্বশীলতার’ প্রমাণ। এটা প্রমাণ করে যে জার্মান রাষ্ট্র বৈধ ছিল- যে এটা ‘জনগণের নামে’ কথা বলত। এরহার্দের উদারনীতিবাদের যুক্তি রাষ্ট্রের বিপক্ষে ছিল না, বরং তা রাষ্ট্রকে বৈধতা দান করে। একটা রাষ্ট্র যতই এরকম অর্থনৈতিক জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয় যেখানে জনগণ ‘স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতা’ নিয়ে ক্রিয়া করতে পারে ততই এটা নিজেকে সর্বোচ্চকরণ করতে পারে।


অবশ্যই, জার্মান নব্য-উদারনীতিবাদীরা(এবং বিশ্বের অন্য প্রান্তের প্রভাবিত নব্য-উদারনীতিবাদীরা) বিশ্বাস করতেন যে একটা মুক্ত অর্থনীতি কেবল তখনই সম্ভব যদি রাষ্ট্র তা করতে দেয়। রাষ্ট্রের সবলভাবে সমাজে আইন পাশ করা প্রয়োজন যেটা মুক্ত, সামষ্টিক, যৌক্তিক সিদ্ধান্ত তৈরির জায়গা তৈরির উত্থান করে। নব্য-উদারনীতিবাদীরা যে একটি শক্তিশালী, সক্রিয় রাষ্ট্র দাবি করে, তা প্রমাণ করার জন্য ফুকো এরপর দার্শনিক লুই রজারের( Louis Rougier) দিকে ধাবিত হন, যিনি জার্মান উদারনীতিবাদ দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং যার কাজ ‘ধ্রুপদী উদারনীতিতাবাদ এবং নব্য-উদারনীতিবাদের সন্ধিক্ষণ’ হিসেবে বর্ণনা করে(পৃ-১৬২)। ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী এবং নব্য-উদারনীতিবাদীদের সম্মেলনে ১৯৩৯ সালে একটি বক্তৃতায় রজার বিশ্লেষণ করেন একটা মুক্ত, প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরির বৈধ কাঠামো এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা তৈরির আইনের প্রয়োজনীয়তার মাধ্যমেঃ


উদারনৈতিক হওয়ার মানে এই না যে... যানবাহনকে যেকোন দিকে যেতে দেয়া। তার মতে, এর ফলাফল হবে সীমাহীন ভিড় এবং দুর্ঘটনা; এবং এটা পরিকল্পনাকারীদের (মনোভাব) নয়, যানবাহনগুলোর জন্য ব্যবহারের ঘন্টা-সময় এবং রুট ঠিক করাঃ এর মানে একটা মহাসড়ক বিধি(Highway Code) আরোপ করা। (পৃ-১৬২)


এই সাদৃশ্যানুমানে, ট্রাফিক হলো বাজারের মতো, এবং আইনী শৃঙ্খলা থেকে ট্রাফিককে আলাদা করার জন্য এখানে কোন স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক শৃঙ্খলা নেই। আইনী শৃঙ্খলা ব্যতীত , এখানে কোনো শৃঙ্খলাই নেই—আছে খালি ভিড় আর দুর্ঘটনা। বাজারের শৃঙ্খলা, ট্রাফিকের শৃঙ্খলার মতোই, এটাও একটা নির্দিষ্ট আইনী শৃঙ্খলার প্রভাব।


যাই হোক, রজারের বক্তব্য এও সুপারিশ করে যে, নব্য-উদারনীতিবাদীরা শৃঙ্খলার শরীরবিদ্যক-রাজনৈতিক কৌশলের বদলে মুক্তবাজারের একটা ভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল সমর্থন করে। রজারের তুলনাতে ‘পরিকল্পনাকারী’রা যেমন মহাসড়কগুলো কিভাবে ব্যবহৃত হবে তার একটা মডেল দেয়(যানবাহনগুলোর ব্যবহারের সময়, প্রত্যেকটা যানবাহন কোন পথ ব্যবহার করবে) তেমনিভাবে শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও এরকম একটা মডেল প্রয়োজন, কিভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি আচরণ করবে সেটার। কিন্তু এরকম একটা মডেল সম্ভবত মুক্তবাজার তৈরি করতে পারবে না—কারণ মুক্তবাজার কেবল তখনই মুক্ত যখন এর অ্যাক্টরদের আচরণে কোনরূপ বলপ্রয়োগ করা হয়না। এবং এজন্যই যদি নব্য-উদারনীতিবাদী রাষ্ট্র নিজেকে লেজিটিমাইজ করতে চায়, তবে শৃঙ্খলার সাধারণ কৌশলগুলোকে তার অন্য কিছু কৌশল দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে হবে।


যদিওবা ফুকো নিজে যেরকম আশা করেছিলেন, সেভাবে জৈব-রাজনীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ‘জৈব-রাজনীতির জন্ম’র উপসংহার টানেননি। তবুও নব্য-উদারনীতিবাদের উপর তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য এটি স্পষ্ট করে যে, তিনি মনে করেন নব্য-উদারনীতিবাদ নিরাপত্তার একটি জৈব-রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, অপরাধ শনাক্তে ফুকোর নব্য-উদারনীতিবাদী কৌশলের বিশ্লেষণ। শৃঙ্খলাবদ্ধ রাষ্ট্রের অপরাধীর বিচারকে “স্বতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধন” হিসেবে বোঝাটা নব্য-উদারনীতিবাদের ক্ষেত্রে খাটে না। আমাদের প্রত্যেককে নিয়ন্ত্রণের কৌশল, একটা স্বাস্থ্যবান বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় ‘স্বাধীনতা এবং দায়িত্বশীলতা’কে ধ্বংস করবে। বিপরীতে নব্য-উদারনীতিবাদীরা মনে করে অপরাধ এবং অপরাধীর বিচার হলো আসলে ঝুঁকির ব্যাপার। “অপরাধীকে এমন এক ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় যে কার্যে লগ্নি খাটায়, সেখান থেকে একটা লাভ আশা করে এবং যে ক্ষতির ঝুঁকিকে স্বীকার করে নেয়”। (পৃ-২৫৩)


যদি অপরাধ কোন ‘খারাপ ব্যবহার’ না হয়ে ‘ঝুঁকি’ হয়, তবে অপরাধকে মোকাবেলা করাটা আর স্বতন্ত্রকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার মধ্য পড়ে না, বরং ঝুঁকি পরিমাপের মধ্যে পড়ে। জনসংখ্যার জৈব-রাজনৈতিক গণনা—অপরাধের হার, মাদক সেবনের হার, অস্ত্র সংক্রান্ত মৃত্যুর হার, এবং আরো অনেককিছু—আসলে ব্যবহৃত হয় কোন সমাজে (উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার বর্ণবাদী সমাজ) কড়া পুলিশিকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য। এগুলো এমনকি অন্যদের মধ্যে অনস্তিত্বশীল (nonexistent) পুলিশি উপস্থিতিরও ন্যায্যতা দিতে ব্যবহৃত হবে। জৈব-রাজনৈতিক অনুশীলনের বর্ণবাদী ও হিংসাত্মক লক্ষ্য তাই আর প্রত্যেকের আচরণ নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং সেসব জনসংখ্যাকে লক্ষ্য করা যারা ‘পরিসংখ্যানগতভাবে কথা বলছে’, এবং নিজেদের, অন্যদের এবং মুক্ত বাজারকে ঝুঁকিতে ফেলছে।


আমরা যদি সোটিরিসের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা গ্রহণ করি, তাহলে নব্য-উদারনীতিবাদ গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতিকে নিযুক্ত করে যাকে সে অনুপলব্ধ সম্ভাবনা হিসেবে আচরণ করে। অর্থাৎ, গণতন্ত্র যদি সাধারণভাবে একটা মুক্ত, সামষ্টিক এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত-তৈরি প্রক্রিয়া হয়, তাহলে নব্য-উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যেই গণতান্ত্রিক বাজারের মাধ্যমে নিজেদের বৈধতা দিয়ে ফেলেছে। এটা আমার কাছে তথাকথিত ‘কর্তৃত্ববাদী জৈব-রাজনীতি’র চেয়ে বেশি ঝঞ্ঝাটপূর্ণ মনে হয়। গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির বিদ্যমানতার মানে হচ্ছে যে, একটা ‘মুক্ত এবং দায়িত্বশীল’ জনগণ প্রতিদিনই জৈব-রাজনীতিকে বৈধতা দিতে কাজ করে যাচ্ছে; এমনকি তাদের মধ্যে আমরা অনেকেই আছি যারা আপাতদৃষ্টিতে ‘বর্ণবাদ বিরোধী’ অথবা ‘সাম্যবাদী’ অথবা ‘সমাজতন্ত্রী’। আমরা প্রতিদিন মুক্তবাজারে প্রতিযোগিতা করি, আমরা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভোট দেয়া বা না’দেয়াটা বাছাই করি, এবং আমাদের পছন্দের সাথে যায় এমন ধরনের ভোগপণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে আমরা যৌক্তিকভাবে বাছাই করি। এর ফলে,

এই অনুশীলনগুলো একটি উঠতি অর্থনীতি নিশ্চিত করে। এটা নব্য-উদারনীতিবাদের যুক্তি অনুযায়ী একটা উপযুক্ত প্রমাণ যে, আমরা মুক্তভাবে, সামষ্টিকভাবে এবং যৌক্তিকভাবে শাসিত হওয়ার জন্য সম্মত হয়েছি। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত নব্য-উদারনীতিবাদকে সহ্য করব, ততক্ষণ আমাদের জৈব-রাজনীতিকেও সহ্য করতে হবে। অধিকন্তু, গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি মুক্তিদায়ী কিছু নয়, বরং এইটা পৃথিবীর জন্যে জাহান্নাম স্বরূপ।


______________

২৮শে এপ্রিল, ২০২০

অনুবাদকের টীকা


[i] শরীরবিদ্যক-রাজনীতি(anatomo-politics): ফুকো শরীরবিদ্যক-রাজনীতি আর জৈব-রাজনীতিকে আলাদা করেছেন সূক্ষ্মভাবে। তিনি শরীরবিদ্যক-রাজনীতিকে বলেছেন মানবদেহের রাজনীতি, যেটা শরীরের মধ্যে একটা যন্ত্রের মত কেন্দ্রীভূত। এটা হলো শৃঙ্খলাবদ্ধ করা, সক্ষমতার অপ্টিমাইজেশন করা এবং তার বলগুলো অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া।

সংযুক্তি


প্রথম প্রকাশঃ ২৯শে মে, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৯শে মে, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/983118498860854/