করোনাভাইরাস, সামাজিক দূরত্ব ও জাতপাত সমর্থকদের নতুন উৎপাত

এস. হরিকৃষ্ণাণ



[করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে পার্শ্ববর্তী ভারতরাষ্ট্রে জাতপাতের সমর্থকদের উৎপাত ফিরে এসেছে। জাতপাত ব্যবস্থায় অত্যধিক মনোযোগ, উত্তর-উপনিবেশিক তত্ত্বচর্চায় দারুণভাবে সমালোচিত হলেও ভারতরাষ্ট্রে বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ও জাতপাতপন্থীদের এই ফিরে আসা আলাপ-আলোচনার দাবি রাখে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায়ও জাতপাতের প্রসঙ্গ বিবেচনা করে ভারতরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে ‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দবন্ধটির ব্যবহারে বিরত থাকতে চান। করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে গৃহীত প্রয়োজনীয় পদক্ষেগুলো জনদৃষ্টি আকর্ষিত করতে যে চিত্রকল্প ও ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে, খোদ সেগুলোই যে অস্পৃশ্যতার “বৈজ্ঞানিক কারণ” হিসেবে হাজির করবার প্রবণতা উস্কে দিচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন এস. রাধাকৃষ্ণাণ। তিনি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনের সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে পিএইচ ডি করেছেন এবং বর্তমানে ALA নামের একটি কেরালা অধ্যয়ন ব্লগের সহ-সম্পাদক। newslaundry অনলাইন পোর্টালে গত ৩০শে মার্চে Coronavirus, social distancing, and the return of caste apologists শিরোনামে তাঁর লেখাটি প্রকাশিত হয়। লেখাটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ শাহিন। শাহিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]



গত ২৪শে মার্চ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দেন যে, করোনা ভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে ভারত লকডাউনের পথে হাঁটবে, এবং এর স্থায়ীত্ব হবে তিন সপ্তাহ। লক্ষ্য বলা হয়েছে: লোকজন যাতে একে অন্যের [শারীরিক] সংস্পর্শে না আসে। কেননা বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন যে, এই অতি সংক্রামক ভাইরাসটির ছড়ানো রোধ করার সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে “সামাজিক দূরত্ব”। মোদি তাঁর ভাষণে খুব জোরালোভাবেই বলেন যে, সামাজিক দূরত্ব তৈরী করা ছাড়া এই মহামারী থেকে “রক্ষা পাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই”।


সেদিন থেকেই সামাজিক মাধ্যমগুলো এই নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে সামাজিক দূরত্বের মাহাত্ম্য নিয়ে প্রচার-প্রচারণা-আলোচনায় মশগুল। এসব আলাপ-আলোচনা-প্রচার-প্রচারণার পেটে কিছু বস্তাপঁচা কিন্তু দুশ্চিন্তা করার মত আলাপের জন্ম হয়েছে, যেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ভারতের জনগণের সামাজিক সম্পর্কের ফাটল ধরিয়ে আসছে।


বিশেষভাবে কেরালার ইতিহাসে পাক-নাপাকের মত জালিম ধ্যান-ধারণার প্রচলন দেখা যায়। যেগুলো শুধু অস্পৃশ্যতা না, বরং দেখা ও সাক্ষাতে অশুচিতা আরোপের পর্যায়ে নিয়ে যায় [অরুন্ধতী রায়ের দ্যা গড অফ স্মল থিংস-এ কেরালার এরকম চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।-অনুবাদক]


উনিশ শতকে যখন এসব রেওয়াজের ফাটল দেখা দেয়া শুরু হল, ঠিক তখনই অন্যদিকে স্বাস্থবিধির নামে বর্বর রকমের জাত-পাতের সাফাই গাওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু একদিকে সংস্কার আন্দোলন আর অন্যদিকে বাজার প্রক্রিয়ার বাস্তবিক অসম্ভব্যতার দরুণ এরকম প্রয়াস খুব দ্রুতই হাওয়ায় মিইয়ে যায়।


আজ যখন বাজার অতিমাত্রায় বিস্তার লাভ করেছে এবং গণপর্যায়ে ধর্মতন্ত্রকে(religion) নতুনভাবে হাজির করা হয়েছে, জাতপাত তার বিচ্ছিরি চেহারা নিয়ে লোকরঞ্জনবাদী ডিসকোর্সে আবার আবির্ভূত হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে “সামাজিক দূরত্ব” ও জাতপাত নিয়ে আলাপ-আলোচনা পাঠ করা প্রয়োজন। জে. কে. অম্বিকা একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী। যার উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ফলোয়ার আছে। তিনি গত সপ্তাহে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। যেখানে তিনি সামাজিক দূরত্বের সাথে ayitham বা অস্পৃশ্যতা, স্যানিটাইজেশনের সাথে theendal বা সাক্ষাতে অশুচিতার কোনো পার্থক্য নেই বলে উল্লেখ করেন। এবং তিনি এটাও বলেন যে, কোয়ারেন্টিনের সাথে pula(শৌচ) বা এক প্রকার পাক-নাপাকির শাস্ত্রীয় প্রথা(ritual of pollution) যা মৃত্যুর মত ঘটনার পর নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য পালন করা হয়, তার কোনো পার্থক্য নেই। তিনি দাবি করেন যে, সাক্ষাতে অশুচিতা, অস্পৃশ্যতা, এবং পাক-নাপাকির প্রথাগুলো “বিজ্ঞানসম্মত” এবং সমগ্র সমাজের জন্য সেগুলো পবিত্রতা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করে। তিনি এই বলে উপসংহার টানেন যে, করোনাভাইরাসের মহামারী সামাজিক দূরত্বের যে রেখা টেনে দিয়েছে তা “সময়... তার প্রতিশোধ নিচ্ছে” সেইসব কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে, যারা হিন্দু ঐতিহ্যের দিকে পিঠ দেখিয়ে আধুনিক কেরালা গড়ায় মরিয়া হয়ে আছেন।


তিন দিনের মধ্যে ঐ পোস্টটি প্রায় তিন হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী “লাইক” দেন এবং দুই হাজারের উপরে ব্যবহারীকারীরা শেয়ার করেন। পোস্টটির এক পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেসের বিধানসভার সদস্য ভি. টি. বলরাম জানান, যারা ঐরকম দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে, তাঁরা যেন তাঁদের “সামন্তীয় রোমান্টিসিজম” অন্য কোথাও দেখায়। তিনি আরও জোর দিয়ে লিখেন, এমনকি প্রাক-আধুনিক যুগেও হাজার হাজার মানুষ মহামারীতে মারা গেছে, যাদের বেশিরভাগই “নীচু জাতের”।


কিন্তু হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব ও জাতপাতের মধ্যে “সাদৃশ্য” নির্দেশক পোস্টগুলো আসা জারি থাকে।


এরকম আলাপ-আলোচনা কেরালাকে শতবর্ষ পিছনে নিয়ে যায়, যখন প্রথম জাতপাতের সাফাই গাইতে সেটার সাথে স্বাস্থ্যবিধিকে জুড়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। বিনা দ্বিধায় বলা যায়, অস্পৃশ্যতা, সাক্ষাৎ ও দেখাদেখির অশুচিতা সামাজিক দূরত্ব-নিয়ন্ত্রণের আরোপিত হাতিয়ার এবং স্বাস্থবিধি বা স্যানিটাইজেশনের সাথে সেগুলোর খুব সামান্যই সম্পর্ক ছিল।


সাফাই গাওয়ার হেতু তালাশ


শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সামাজিক সম্পর্কগুলোর যেসব প্রাচীন নীতি-নৈতিকতা প্রশ্নাতীতভাবে রাজত্ব করে আসছিল, ঊনিশ শতক এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে কেরালায় উদিত প্রগতিবাদী চিন্তকরা সেগুলোকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। এসব চিন্তকরা হয় সমাজের সেই অংশের লোক যারা আধুনিক শিক্ষার এবং একইসাথে ইউরোপীয় আধুনিকতার দার্শনিক অনুবৃত্তির সংস্পর্শে এসেছেন, অথবা সেই দলের লোক যারা রাস্তাঘাট এবং শেষতক মন্দিরের মত স্থানগুলোতে নিজেদের জাহির করা শুরু করল যে স্থানগুলোতে পূর্বে তাঁদের গমন নিষিদ্ধ ছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন যেটির উত্থান ঘটে শ্রী নারায়ণা গুরু, আয়নকালি, পঅকায়িল আপেচান, ভেলায়দ্ধ পানিক্কার, সাহোদারন আয়োপ্পান ও অন্যান্যদের হাত ধরে।


এরই পরিপ্রেক্ষিতে, বর্ণহিন্দুদের মধ্যে একদল জাতপাত টিকিয়ে রাখার জন্য “বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা” খুঁজতে শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাঁরা তাঁদের স্বেচ্ছাচারপ্রসূত স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশ মোতাবেক এই ধারণা উৎপাদন করার অপচেষ্টা করে যে, “নীচু জাত” সমাজের নিম্নস্তরে থাকারই যোগ্য। ১৯০৯ সনে একজন তামিল ব্রাহ্মণ কর্তৃক প্রণীত Cochin Tribes and Castes Reports-এ বলা হয়, কাউকে Pulayan হিসেবে তখনই চিহ্নিত করা হয় যখন কারও “চুল বন্যের মত বড় হতে দেয়া হয় এবং মাথায় প্রকাণ্ড নোংরা জট পাকায়”। রিপোর্টটিতে আরও যোগ করা হয় যে, তাঁদের বাসস্থানে “আলো-বাতাস খুব কমই চলাচল করে এবং বাতাস সবসময়েই কম-বেশি নোংরা – দুর্গন্ধময় হয়”।


১৯১০ সনে ট্রাভানকোরের এক স্থানীয় পত্রিকা দলিত খৃষ্টান ও উচ্চবর্ণের খৃষ্টানদের জন্য আলাদা বসার জায়গার ব্যবস্থা করা নিয়ে উঠা বিতর্ক তুলে আনে তাদের রিপোর্টে। কনিপ্যয়ুর শঙ্করন নাম্বুদিরিপাদ তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেন, ঐ সময়কালে যখন কেরালায় রেস্টুরেন্ট ও কফি হাউজের চল শুরু হলো সেগুলো ব্রাহ্মণ ও অ-ব্রাহ্মণদের আলাদা করা ছিল এবং ব্রাহ্মণদের হোটেলগুলো নাম্বু থিরিস চালাতো। তামিল ব্রাহ্মণ বা স্বরস্বত ব্রাহ্মণদেরকে অন্যদের অপেক্ষা পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর হিসেবে দেখা হতো। “ব্রাহ্মণদের কফি ক্লাব থেকে অ-ব্রাহ্মণদের কফি ক্লাব আলাদা করার জন্য কোনো সাইনবোর্ডের সাহায্য প্রয়োজন ছিল না। যদিও বেশিরভাগ ব্রাহ্মণদের জায়গাগুলোতে বাইরে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে লেখা থাকতো যে, এটা ব্রাহ্মণদের জায়গা। ব্রাহ্মণদের হোটেলগুলোতে সাম্প্রতিকাল পর্যন্তও কাচের গ্লাসের বদলে একটি পাত্র এবং পিতলের, মাটির বা স্টিলের তৈরি davara ব্যবহার করা হতো।


যদিও তিনি এ বিষয়টা পরিষ্কার করেননি যে, কিসের ভিত্তিতে এ রকম পার্থক্য করা হতো। তবে চলতি ধারণা থেকে বুঝা যায়, কৌলিন্যের খাতিরে কিছু কফি হাউজকে বেশি স্বাস্থ্যকর হিসেবে গণ্য করা হতো। যে রকমটা ইতিহাসবিদ এ. আর. ভেঙ্কটাচলাপতি তাঁর In Those Days There Was No Coffee শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, দক্ষিণ ভারতের যেহেতু কফির কালচার দাঁড়িয়ে যায়, পাক-নাপাকির রীতি জারি রাখার জন্য স্টিলের davara'র প্রচলন শুরু হয়। এটা এক ধরনের ছোট পাত্র যেটার ব্যবহার গেলাসের সাথেই শুরু হয়েছিল এবং এটি গরম কফি ঠান্ডা করতে বা পান করতে ব্যবহৃত হতো।


গত শতকের বিশের দশকের শেষের দিকে সাফ-সুতরা থাকা জাত-পাতের ভেদাভেদের মাপকাঠি হিসেবে দেখানোর প্রবণতাটা বেশ কাজে দেয়, যখন কংগ্রেস হরিজনদের বাগে আনতে এই ধারণা উৎপাদন করে যে, তাঁদের পরিচ্ছনতার অজ্ঞানতাই তাঁদের নীচুজাত হওয়ার কারণ। এটা সাফ দেখা যায়, এই চেষ্টা-চিন্তা এই বিতর্ক হাজির করার জন্যই করা হয় যে, পাক-নাপাকের নিয়ম-নীতিগুলো নিতান্তই ধর্মীয় উপাদান নয় বরং এগুলো দেখা ও স্পর্শের মত শারীরিক ইন্দ্রিয়ের উপর ভিত্তি করে হাজির করা; এটা তাঁদের বাদ-দেয়ার রাজনীতির উদ্দেশ্য হাসিলে “বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখা” খোঁজার চেষ্টা।


যদিওবা ১৯৩০ এর দশকে এসব চেষ্টা-চরিত্র দুটি কারণে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। অর্থনৈতিক কারণ তার একটি ছিল। রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহন, লাইব্রেরিগুলোর মত আধুনিক জায়াগাগুলো সংরক্ষিত রেখে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। মূনাফা অর্জন করতে তাঁদেরকে বিদ্যমান সীমিত বাজার খুলে দিতে হয়; নীচুজাতের শ্রমিকদের কাজে লাগানো ছাড়া [ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো] চালানো অসম্ভব ছিল। কনিপ্যয়ুর দেখান, যে কাজ গোড়া ব্রাহ্মণরা করতে অস্বীকৃতি জানাতো সেগুলো করতে ব্রাহ্মণ-রেস্টুরেন্টগুলোর কাজের লোকের প্রয়োজন ছিল এবং এ কারণটাই বাস্তবিকভাবে মুশকিল তৈরী করে। যদিও রেস্টুরেন্টগুলোতে ও গণপরিবহনে ব্রাহ্মণ ও বাকীদের জন্য আলাদা জায়গা রাখার বন্দোবস্ত করা হয়, শেষতক সেগুলো কাজে দেয়নি।


এদিকে নারায়ণ গুরুর মত সমাজ-সংস্কারকরা সমাজের অগ্রগতির জন্য স্বাস্থ্যবিধি ও শিক্ষার উপর জোর দিতে থাকেন। শুরুর দিককার কম্যুনিস্টরা শীঘ্রই বুঝতে পারেন যে, তাঁদের [নিম্নবর্গের মানুষদের] বিশ্বাস অর্জন করতে জাত-পাতের উর্ধ্বে গিয়ে মেলামেশা করতে হবে। তাঁরা “নীচু জাতের” লোকদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া-আসা করা এবং পাক-নাপাকির মিথগুলো ভেঙে দিতে তাঁদের সাথে দানা-পানি ভাগ করে খাওয়া শুরু করেন। সামাজিক বৈষম্যের পাটাতনে শ্রেণি যখন একবার “স্বাভাবিক” পরিপূরক হিসেবে জাতপাতের জায়াগা দখল করে ফেলে, তখন এই অমীমাংসিত অসঙ্গতিকে এই ভেবে বেখবর করে রাখা হয় যে, একবার শ্রেণি-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লব সংগঠিত করলেই বাকীটা আপনা-আপনি লাইনে চলে আসবে।


সামাজিক দূরত্ব ও জাতপাত


সম্প্রতি কেরালায় গণপর্যায়ে জাত-পাতের আবার উৎপাত বেশ মনোযোগ দেয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতপাতের সাফাই হিসেবে “সামাজিক দূরত্বের” দোহাই হাজির করার চলমান অপচেষ্টার উপর নজর দেয়া জরুরী।


ন্যারেটিভটি চালু হওয়ার পেছনে এই মহামারী প্রতিরোধসংশ্লিষ্ট ব্যবহৃত ভিজ্যুয়াল চিত্রকল্প ও ভাষা ন্যুনতম হলেও কাজ করছে বলে মনে হয়। আমাদের মত সমাজে “সামাজিক দূরত্বের” মত শব্দবন্ধকে আরামসে সামাজিক ভেদাভেদের ভিত্তিতে তৈরী করা দূরত্ব হিসেবে বিকৃত করা যায়। এটা সংকীর্ণ মানসিকতার লোকদের হাতে সে সুযোগ তুলে দেয়ার ক্ষেত্র তৈরী করে, যেটার মাধ্যমে শারীরিকভাবে দূরে থেকে একসাথে কোনো ভাইরাস মোকাবেলা করা এবং বাদ-দেয়ার(exclude) প্রবণতাকে—সমাজের একটা অংশ দ্বারা আরেকটা অংশকে শোষণ করতে যেটা কাজ করে—ঐ লোকগুলো একইরেখায় নিয়ে আসে। কার্যত, এমনকি পশ্চিমেও “সামাজিক দূরত্ব” শব্দবন্ধের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার বদলে “শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক একতা” প্রতিস্থাপনের আহ্বান জানায়।


কেরালা রাজ্য সরকার ইতোমধ্যে সামাজিক দূরত্ব সম্বন্ধীয় ভাষ্যে ও ভাষায় প্রাসঙ্গিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। গত সপ্তাহে মূখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন তাঁর এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বারবার উল্লেখ করেন যে, “শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক একতা—এটাই এ সময়ে আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত”। “অভিবাসী শ্রমিকের” বদলে তাঁর “অতিথি শ্রমিক” ব্যবহার করাটাও যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে।[ইন্ডিয়ার বাংলাভাষীরা পরিযায়ী শ্রমিক বলছেন।-অনুবাদক]


করোনা ভাইরাস মহামারীর অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির হিসেব কষার জন্য এসময়টা এখনও চটজলদি বিবেচিত হবে। কিন্তু এটার জন্য সমাজকে কী মূল্য দিতে হবে তা পরিষ্কার হতে শুরু করছে। দিনমজুর, অভিবাসী শ্রমিক, টোকাই, এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী এই মহামারীর আসল ধাক্কা ঘাড়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। এসব সামাজিক ক্ষতি হ্রাসে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবিকা নিশ্চিতে কেরালার রাজ্যসরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয় বটে।


ইত্যবসরে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মনোযোগাকাঙ্খী “প্রভাবকদের” সংকীর্ণ মানসিকতার কথা-বার্তা দিয়ে জাতপাতের ঝান্ডাধারীদের আগুনে ঘি ঢালার আগেই অঙ্কুরে বিনষ্ট করা জরুরী।

____________

৩০শে মার্চ, ২০২০


প্রথম প্রকাশঃ ৫ই মে, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৫ই মে, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/4074170509276865/