করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রমী অবস্থার স্বাভাবিকীকরণ

জর্জিও আগামবেন




[ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন চলমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিকোলা ত্রুওং(Nicolas Truong)’কে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারটি ফরাসি পত্রিকা Le Monde–এ গত ২৪ মার্চে ছাপা হয়। এটি প্রথমে স্প্যানিশ ও পরদিন স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। ইংরেজি অনুবাদটি Autonomies নামের ওয়েব পোর্টালে Giorgio Agamben: Normalising the state of exception under the Covid-19 epidemic শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারটিকে তাঁর Chiarimenti(Clarifications) শিরোনামের লেখাটির বিস্তারিত রূপ বলে ধরা যেতে পারে। ইংরেজি অনুবাদ থেকে এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন নিসর্গ নিলয়। নিসর্গ নিলয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।]




‘Il Manifesto’তে প্রকাশিত একটি লেখায় আপনি বলেছিলেন যে, বৈশ্বিক করোনা মহামারী হচ্ছে একটি ‘অনুমিত মহামারী’, এটি ‘এক পদের ফ্লু’র অধিক কিছুই নয়। বর্তমানে, বিশেষ করে ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ও এর বিস্তারের গতি আমলে নিলে আপনার পূর্বের বক্তব্যটি নিয়ে আক্ষেপ হয় কি?


আগামবেনঃ আমি ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বা ডাক্তার কোনটাই নই। আর মাসখানেক আগে প্রকাশিত আমার যে প্রবন্ধটি নিয়ে প্রশ্ন করছেন, আমি সেখানে অক্ষরে অক্ষরে ইতালির জাতীয় গবেষণাকেন্দ্রের(NRC) বক্তব্যই উদ্ধৃত করেছিলাম। তবে আমি মহামারী সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের মাঝে চলমান কোন বিতর্কে প্রবেশ করতে নারাজ। আমি বরং এই মহামারীর কারণে সৃষ্ট নৈতিক ও রাজনৈতিক পরিণাম নিয়ে আগ্রহী।


আপনি লিখেছেন, “সন্ত্রাসবাদকে নতুন করে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই—এমন মুহূর্তে মহামারীর আবিষ্কার [অঘোষিত] জরুরি অবস্থাকে সীমাহীন সময়ের জন্য প্রয়োগ করার একটি আদর্শ উছিলা তৈরি করে।” কিন্তু আপনি কীভাবে একে বলছেন ‘আবিষ্কার’? মহামারীর মতই সন্ত্রাসবাদ কি এমন নিরাপত্তা নীতির দিকে ঠেলে দেয় না, যা অগ্রহণীয় হলেও বাস্তব?


আগামবেনঃ রাজনৈতিক পরিসরে যখন কোন আবিষ্কারের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়, তখন মনে রাখতে হবে যে একে পুরোপুরি ব্যক্তিক উপায়ে বোঝার সুযোগ নেই। ইতিহাসবিদরা জানেন যে, শনাক্তযোগ্য ব্যাক্তি ছাড়াই পরিচালিত এবং কার্যকরী নৈর্বক্তিক ষড়যন্ত্র (objective conspiracy) নিয়ে আলাপের সুযোগ রয়েছে। মিশেল ফুকো আগেই বলে গেছেন, নিরাপত্তা-শাসনব্যবস্থা (security government) যে ব্যতিক্রম অবস্থা সৃষ্টি করেই কাজ করবে এমন নয়, বরং কখনও এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে তাকে উপর্যুপরি কাজে লাগিয়ে ও নিয়ন্ত্রণ করেই সেটি কাজ করে। চীনের মত একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকার একটা সমগ্র অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ন্ত্রণ করবার আদর্শ উপায় হিসেবে এই মহামারীকে বেছে নিয়েছে —এমনটা কেবল আমি একাই মনে করছি না। ইউরোপে যে আমরা চীনকে (মহামারী নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে) রোলমডেল হিসেবে আখ্যা দিচ্ছি তা আমাদের রাজনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মাত্রাকে চিনিয়ে দিচ্ছে। ভীতিই আমাদের এমন একটা অবস্থায় নিয়ে এসেছে। চীনা সরকার হঠাৎ করে একটা সুবিধাজনক সময়ে মহামারী পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘোষণা করল। আমাদের নিজেদেরকে অন্তত এটুকু জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, বিষয়টা কি অদ্ভুত ঠেকে না?


বিজ্ঞানীরা যখন বলছেন ভাইরাসের বিস্তৃতি ঠেকাতে প্রধান উপায় হল অন্তরীণ জীবনযাপন, তখন কেন আপনার কাছে জরুরি অবস্থাকে অনায্য বলে মনে হচ্ছে?


আগামবেনঃ আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে বাবেল-টাওয়ারের ভাষার বিভ্রান্তিরআগামবেনঃ আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে বাবেল-টাওয়ারের ভাষার বিভ্রান্তির[i] সাথে তুলনা করা যায়। এমন অবস্থায় প্রত্যেকে নিজ নিজ যুক্তি-বিবেচনা অনুসারে চলছে। অন্য কেউ কীভাবে ভাবছে বা কাজ করছে, তা কেউ বিবেচনায় আনছে না। ভাইরাস বিশেষজ্ঞের জন্য এটা হচ্ছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ডাক্তারের লক্ষ্য হল রোগমুক্তি সাধন, সরকারের লক্ষ্য হল নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। আমিও স্মরণ করিয়ে দিতে পারি যে, এর জন্য যেন চরম মূল্য দিতে না হয়। ইউরোপে এর থেকেও ভয়াবহ মহামারী এসেছিল, কিন্তু এমন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবার কথা কেউ ভাবেনি যেখানে (বিশেষত ইতালি আর ফ্রান্সে) বেঁচে থাকাকেই রোধ করা হচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী ইতালিতে প্রতি হাজার জন মানুষে মাত্র একজন ভাইরাসে আক্রান্ত। যদি মহামারীর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হত তবে কী করা হত— তা চিন্তার বিষয়। ভয়-ভীতি জীবনের শিক্ষক বা পরামর্শক হিসেবে তেমন সুবিধার নয়। আর আমি মনে করি না যে দেশটাকে এমন একটা ব্যাধিদায়ক জায়গায় পরিণত করা কোন সঠিক সমাধান হবে যেখানে এক মানুষ অপরের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন সে-ই সংক্রমণের উৎস।

সন্ত্রাসবাদের মুখে যেমন স্বাধীনতাকে রক্ষা করার দোহাই দিয়ে স্বাধীনতাকে দমন করা হয়েছিল, এই মুহূর্তে তেমনি জীবন রক্ষা করার কথা বলে জীবনকে স্তব্ধ করা হচ্ছে। দুই ক্ষেত্রে একই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ যুক্তির উত্থাপন দেখা যায়।


আমরা কি একটি স্থায়ী ব্যতিক্রম অবস্থার উত্থান দেখতে পাচ্ছি?


আগামবেনঃ সরকারব্যবস্থা আমাদের যে ধরনের ব্যতিক্রম অবস্থার সাথে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত করিয়েছে, মহামারীর কালে এটাই স্পষ্টত একটা স্বাভাবিক অবস্থায় পরিণত হয়েছে। একটা স্থায়ী সংকটের মাঝে বাস করতে করতে মানুষ এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে সে আর বুঝতে পারছে না— তার জীবন পুরোপুরি জৈবিক একটা অবস্থায় সংকুচিত হয়ে এসেছে। শুধু রাজনৈতিক মাত্রা নয়, এ জীবনের মানবীয় মাত্রাও হারিয়ে গেছে। যে সমাজ একটা স্থায়ী জরুরি অবস্থার মধ্যে বাস করছে তা কোনভাবেই মুক্ত সমাজ হতে পারে না। আমরা এমন এক সমাজের মধ্যে বাস করছি যেটি তথাকথিত ‘নিরাপত্তাজনিত কারণ’ দেখিয়ে স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়েছে। ফলস্বরূপ, আমরা নিরন্তর অনিরাপত্তা ও ভীতির জীবনে দণ্ডিত হয়েছি।


ঠিক কী অর্থে আমরা একটি জৈব-রাজনৈতিক সংকট পার করছি?


আগামবেনঃ আধুনিক রাজনীতি আপাদমস্তক জৈব-রাজনীতি। এখানে সর্বোচ্চ বাজি হল মানুষের জীবন। নতুন বিষয় হল, স্বাস্থ্য এখন যেকোন উপায়ে অবশ্য পালনীয় আইনী বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


কেন আপনার মতে রোগের ভয়াবহতার বদলে এর ফলে সৃষ্ট নৈতিক-রাজনৈতিক পতনটাই সমস্যাজনক?


আগামবেনঃ ভীতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে এমন কিছু বিষয় দেখিয়ে দেয় যা আমরা সচরাচর না দেখার ভান করতাম। আমাদের সমাজ এখন নাঙ্গা জীবন৩ ছাড়া আর কিছুতেই বিশ্বাস করে না। ইতালীয়’রা আক্ষরিক অর্থেই সংক্রমণের বিপদ থেকে বাঁচতে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক সম্পর্ক, কাজকর্ম, এমনকি বন্ধুত্ব, প্রেম, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস – সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। নাঙ্গা জীবন মানুষকে মোটেও কাছাকাছি নিয়ে আসে না, বরং অন্ধ করে, বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আলেসান্দ্রো মানজোনির ‘বাগদত্ত’ উপন্যাসেআগামবেনঃ ভীতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে এমন কিছু বিষয় দেখিয়ে দেয় যা আমরা সচরাচর না দেখার ভান করতাম। আমাদের সমাজ এখন নাঙ্গা জীবন৩ ছাড়া আর কিছুতেই বিশ্বাস করে না। ইতালীয়’রা আক্ষরিক অর্থেই সংক্রমণের বিপদ থেকে বাঁচতে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক সম্পর্ক, কাজকর্ম, এমনকি বন্ধুত্ব, প্রেম, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস – সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। নাঙ্গা জীবন মানুষকে মোটেও কাছাকাছি নিয়ে আসে না, বরং অন্ধ করে, বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আলেসান্দ্রো মানজোনির ‘বাগদত্ত’ উপন্যাসে[ii] প্লেগের বর্ণনায় যেমন পাই, তেমনিভাবে অপর (other) মানুষেরা সংক্রমণের মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের থেকে কমপক্ষে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, তারা যদি খুব কাছাকাছি চলে আসে তবে তাদেরকে জেলবন্দী করতে হবে। বাস্তবিকই বর্বর বিষয় হল, মৃতদের সৎকার পাবার অধিকারটুকুও নেই এবং মৃতদেহের ভাগ্যে কী ঘটছে সেটাও পরিষ্কার নয়।


আমাদের বন্ধু কিংবা প্রতিবেশী বলে কিছুরই আর অস্তিত্ব নেই। পশ্চিমের দুই আধিপত্যশীল ধর্ম – খ্রিস্টের ধর্ম (খ্রিস্টধর্ম) ও টাকার ধর্ম (পুঁজিবাদ) – উভয়েই ভয়ানক নিশ্চুপ রয়েছে। যে দেশ এই ধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তার ভেতরে মানবীয় সম্পর্কগুলোর কী ঘটে? আর কেমন সেই সমাজ, যেখানে টিকে থাকা বাদে আর সবকিছু মূল্যহীন? সমাজ এরকম একটা অনিশ্চিত বিপদের মুখোমুখি হয়ে নৈতিক-রাজনৈতিক সকল মূল্যবোধকে একসাথে (en bloc) তরলীকৃত করে ফেলেছে, এটা দেখা বেশ দুঃখজনক। আমি জানি, সবকিছু শেষ হলে আর কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব না।


মহামারীর পরের পৃথিবী কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন?


আগামবেনঃ শুধু বর্তমান নয়, এর পরে কী আসবে সেটাও আমাকে উদ্বিগ্ন করে। যুদ্ধ শেষ হবার পরেও শান্তির সময়ে যেমন কাঁটাতারের বেড়া, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির মত বিভীষিকাময় চিহ্ন রেখে যায়, এই স্বাস্থ্যজনিত সংকট শেষ হবার পরেও সরকারব্যবস্থা আমাদের নিয়ে তেমনি কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করবে—যেগুলো সে আগে কখনো সেভাবে করতে পারে নি। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চলবে; সকল ধরনের সভা-আড্ডা বন্ধ হয়ে যাবে, কোন রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সমাবেশ চলবে না—কেবল ডিজিটাল মেসেজিং চলবে, যেখানে যেখানে সম্ভব সব জায়গাতে যন্ত্র প্রতিস্থাপন করবে মানুষ-মানুষের সম্পর্ক নামক ‘সংক্রমণ’কে।


______________

২৪শে মার্চ, ২০২০


অনুবাদকের টীকা


[i] আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে বাবেল টাওয়ারের ঘটনা(যাকে অনেকে ব্যবিলনের টাওয়ারও বলে থাকেন) সুপরিচিত। বাইবেল অনুযায়ী মহাপ্লাবন শেষে নবী নূহের অনুসারীরা ডাঙায় নেমে একটি বিশাল টাওয়ার নির্মাণ করে, তাদের ইচ্ছা ছিল এই টাওয়ার এত উঁচু হবে যে এর শীর্ষভাগ স্বর্গে গিয়ে ঠেকবে। এই দেখে ঈশ্বর তাদের সবার মুখের ভাষা পরিবর্তন করে দেন। উল্লেখ্য, বাইবেল অনুযায়ী এর আগে সব মানুষ একই ভাষায় কথা বলত। ফলে টাওয়ার থেকে বের হওয়ার পরে তারা কেউ কারও কথা বুঝতে না পেরে বিভ্রান্তিতে পড়ে এবং একেকজন একেকদিকে ছড়িয়ে যায়। এই বিভ্রান্তির সাথেই আগামবেন মহামারী পরিস্থিতিতে উদ্ভুত বিভ্রান্তিকে তুলনা করেছেন।


[ii] I promessi sposi বা বাগদত্ত (১৮২৭) ইতালীয় ঔপন্যাসিক আলেসান্দ্রো মানজোনির লেখা তিন খণ্ডের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। অনেকেই বলে থাকেন, এটি ইতালীয় ভাষায় সর্বাধিক পঠিত উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম।


প্রথম প্রকাশঃ ২৩শে এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৩শে এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ shorturl.at/uUW36