করোনাভাইরাস সংক্রান্ত সত্য

ডুয়াইন রুসাল


[ডুয়াইন রুসাল(Duane Rousselle) লাকানীয় মনঃসমীক্ষক ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক। সামাজিক আন্দোলন অধ্যয়ন, লাকানীয় মনঃসমীক্ষণ, সাংস্কৃতিক সমাজবিজ্ঞান, লিঙ্গীয় সম্পর্ক অধ্যয়ন, অ্যানার্কিস্ট ও নন্দনতত্ত্ব অধ্যয়ন ইত্যাদি তাঁর গবেষণার পরিসর। বাদিয়্যু ও জিজেকের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। European Journal of Psychoanalysis-তে তাঁর The Truth about Coronavirus লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। রুসালের লেখাটি অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আবদুল্লাহ আল মামুন ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান।]


মনোঃবিশ্লেষকদের কাছে জরুরী ভিত্তিতে এক নতুন আবদার উঠা শুরু হয়েছে। আর তা আসছে সাহায্যের কাতর ভঙ্গীতে — অনেকটা এইভাবেই যে, “এই সময়ের বৈশ্বিক মহামারীর দুঃস্বপ্ন হতে আমাদের জেগে উঠতে সাহায্য করুন!” এমনকি স্লাভো জিজেকও স্বীকার করেছেন, তিনি নিজেও এমনটি ভাবছিলেন যে, বাইরে গিয়ে এই নভেল করোনা ভাইরাসের মুখোমুখি হবেন যাতে এই ক্রমবর্ধমান হুমকির দুশ্চিন্তাকে জয় করা যায়। বাস্তবের(real) সাথে টেক্কা দেয়ার এটা একটা উপায় বলা যায়, তবে টেকসই কোনো সমাধান না। হায়, দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠার কোন উপায়ই নেই। জেগে উঠা বরং স্বপ্নের নতুনভাবে বা নতুন ধরনে চালু থাকার প্রতিশ্রুতিই কেবল প্রস্তাব করতে পারে।


দুঃস্বপ্ন হল ভ্রমে প্রত্যাবর্তন; কোন কিছুকে অর্থবহ করে তোলার অসম্ভাব্যতায় ফিরে আসা—বিনাশী প্রত্যাবর্তনও বলা যায়। বিজ্ঞান(এটি বাস্তবের নিরিখে প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর) ও অতি-প্রয়োগবাদী দর্শনের আচরণ মারফত নতুন সম্ভাবনার অতিরঞ্জিত সমাধানের দুয়ার খুলে দেয়। বস্তুত, এই মুহূর্তে আমি যেখানে বসে লিখছি সেই ভারত রাষ্ট্র দ্রুতই তেমনি এক প্রয়োগবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভারতীয়রা প্রতিনিয়ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সীমানা নির্ধারণ এবং প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়ায় ব্যস্ত থাকে। এবং অনেক আগেই ম্যাক্স ওয়েবার বেশ জোর গলায় বলেছেনঃ পুনর্জন্মের ব্যাপারে ধার্মিকের যে অবস্থান তা এই সীমাহীন ভবচক্রের উপর একধরনের বিধি আরোপ জরুরী করে তোলে। আর তা হল এই জীবনের চূড়ান্ত অবসান। আমেরিকায়ও আমরা একই স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছি। এটি একুশ শতকের বাস্তবের—যা হতে ব্যাক্তিমাত্রই আশ্রয় চায় অন্ধকার ও বিশৃঙ্খল জগতের মাঝে—স্বপ্ন ।


এই জরুরত এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যখন আমরা নগ্ন এবং সত্য চাহিদার মুখোমুখি। এ সব কিছুর মাঝে, মনোঃবিশ্লেষণই ভরসা যা ব্যাক্তির বাস্তবতার সাথে মিশে যাওয়ার প্রবনতাকে বাঁধা দেয়। হয় বিজ্ঞান নয়তো মহামারী, এমন দোলাচলের পৃথিবীতে কেই-বা বাঁচতে চায়? ব্যাক্তির পক্ষে অবশ্য বেছে নেয়ার মত এখন একটি পথই আছে আর তা হল প্রয়োজনের তাগিদে প্রয়োগবাদী বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়া কিংবা এমন এক পৃথিবীতে লাফিয়ে চলে যাওয়া যেখানে প্রাচীর ব্যবস্থাপনা মারফতে নিজেকে শ্রান্ত এবং নিঃসঙ্গ করে নেয়া যায়।


হায়, দুঃস্বপ্নের দেখি শেষ নেই!


মনোঃবিশ্লেষণ এই দুই সমাধানকেই প্রত্যাখ্যান করে এবং সত্যের জন্য দুঃস্বপ্নের সাথে এক চুক্তি জারি রাখে। এটি দৈবাৎ নয় যে, বিশ্ব মনোঃবিশ্লেষণ সংস্থা দ্বারা প্রস্তাবিত ব্যবস্থাপনা বলুন কিংবা স্থানাঙ্ক বলুন কিংবা হিশেব-নিকেশ বলুন সকল কিছুর সাথে বৈশ্বিক মহামারীর ব্যাপার-স্যাপার মিলে যায়। বলে রাখা ভাল যে, বিশ্ব মনোঃবিশ্লেষণ সংস্থা বেশ কিছু বছর ধরে জরুরত, দুঃস্বপ্ন, ভয়, বাস্তবতা, কুহেলিকা ইত্যাদি ধারণার উপর কাজ করছে। আসলে এ সকল ধারণা নিয়েই আমাদের অনুভূতি শূন্য পৃথিবী এবং এ সকল ধারণাই আমাদের নতুন আবিস্কারের পথ করে দেয়।


এই পরিস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই খুঁজে নিতে হবে বাস্তবতা হতে নতুন ধরনের বিচ্ছিন্নতার(distanciation) পথ কিন্তু সামাজিক বন্ধন না হারিয়ে। সত্যি বলতে কি, মনোঃবিশ্লেষণ ব্যাবস্থাপনা আজ সরাসরি--যা নিজেই নিজের বয়ান হয়ে উঠার ভিত্তি প্রস্তর হিশেবে এবং নতুন সামাজিক বন্ধনের শৃঙ্খল হিশেবেও কাজ করবে --এক রহস্যময় ভাইরাসের মুখোমুখি ।


প্রমাণ ছাড়া ফ্রয়েডের ব্যাপারে এমন একটা কথা বলা হয়ে থাকে যে, তিনি নাকি আমেরিকা যাওয়ার পথে বলেছিলেন, “তারা বুঝতে পারছে না, আমরা তাদের জন্য মহামারী বয়ে আনছি।” কথাটা তিনি মনোঃবিশ্লেষণকে মহামারীর সমান্তরালে রেখেই বলেছিলেন। এটি ইতিমধ্যে বোঝানোর জন্যে যথেষ্ট যে, লাঁকা মনোঃবিশ্লেষণের উদ্দেশ্য হিসেবে নিরাময় বা সুস্থতার ছুতা প্রত্যাখ্যান করার সাহস ফ্রয়েড থেকেই পেয়েছিলেন।


সুতরাং খুব বিনীতভাবে বলতেই হয়, আমাদের উদ্দেশ্য জনসাধারণকে মহামারী হতে উদ্ধার করা নয়, বরং আমাদের লক্ষ্য হল এই মহামারীর মাঝে তা খতিয়ে দেখা যা আমাদের সত্যের মাঝে প্রবেশ করার পথ দেখায় – সেই সত্য যা আমাদের নির্মাণ করে, এবং আমাদের সমাজে উপযোগী করে তোলে।


বর্তমানের সত্যিকারের হুমকি কিন্তু করোনা ভাইরাস নয়, বরং বাস্তব নিজেই। বাস্তব এমন এক হুমকি যা শুধু করোনা ভাইরাসের পথ করে দেয় না, আরও পথ করে দেয় আসক্তি, নিঃসঙ্গতা, হতাশা, ভীতি ইত্যাদির মত শৃঙ্খলাবিহীন বৈশ্বিক মহামারীর। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি, হয় বাস্তবের সাথে নিজেদের খাপ-খাওয়াতে অথবা এড়িয়ে যেতে (বিভিন্ন ধরনের তথাকথিত “বায়ো-পলিটিক্সের” পদ্ধতির সাহায্যে; যেমন, তাপমাত্রা পরীক্ষা, মাস্ক বা মুখবন্ধনি, শারীরিক দূরত্ব ইত্যাদি)। সমস্যা হল, আমরা এটার উত্থানে সাহায্য করা সত্যিকারের কাঠামো বা ব্যাবস্থাপনা তাকে না চিনার মত ভুলও করে থাকি। একটা সময় ছিল যখন বিমানবন্দর এবং রেলস্টেশনগুলো দুই জায়গার সীমানা নির্ধারক হিশেবে কাজ করেছে। আর এখন তা এক ধ্বসে পড়া এক হিজিবিজি সীমানা, অথচ যা একসময় ব্যক্তিকে সমষ্টি হতে আলাদা করার ন্যায় স্নায়ুরোগী(neurosis) এবং মানসিক রোগীর(psychosis) পার্থক্য করেছে। আর এই ধ্বসে পড়া দেয়াল এমন ইঙ্গিতই বহন করে যে, শীঘ্রই আবির্ভাব হবে এমন এক দলের যারা আরও ধূর্ততার সাথে নতুন ব্যবস্থাপনা মারফত পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবে।


এই ব্যাপারে জোর দিয়ে, পুঁজিবাদ ও প্রয়োগবাদী দর্শন নিজেদেরকে আবারও এই ঝামেলার প্রতিষেধক হিশেবে তুলে ধরছে। যখন অন্যান্য বয়া্নসমূহ বলছে করোনা ভাইরাস বাধাহীন স্বৈরশাসনের ফল, তখন সমাধানের লক্ষ্যে বাস্তবের সাথে দ্রুত মিশে যাওয়া প্রয়োগবাদী বিজ্ঞান, মুক্তবাজার, এবং পক্ষপাতহীন বাধা-বিপত্তিসংক্রান্ত খ্রিষ্টীয় ধর্মনিরপেক্ষ ধারণাসমূহ স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসে। ব্যাপারটা দাড়ায় এই যে, পুঁজিবাদ [এবং বাজার যা তার প্রতিনিধিদের উৎসাহিত করে আরও যন্ত্র কিংবা ঔষধ কিংবা আরও দ্রুত প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে] হল একমাত্র সুস্থধারার বিকল্প। এই বয়ান বা ধারণা শুধু এই চিন্তারই প্রশ্রয় দেয় যে, পুঁজিবাদ এবং স্বৈরতন্ত্র, প্রয়োগবাদ এবং কর্তৃত্ত্ববাদ – এ সমস্ত কিছুই যেন এটার আপাতত দুইদিককার জবাব। কিন্তু পুঁজিবাদ যেমন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নয়, প্রয়োগবাদও তেমনি কখনোই সত্যিকারের দর্শন নয়। যদিও মার্ক্স এবং বাকুনিনসহ চরমপন্থী দার্শনিকেরা কখনও কখনও নিজ থেকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে বিকল্পের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে, তবে অনেক সময় উনারা বুঝতেই পারেননি পুঁজিবাদ রীতিমতো “বিকল্পের” জায়গা নিয়ে নিয়েছে। (কর্তৃত্ববাদ, নির্বিচারবাদ, সমাজতন্ত্র এবং অন্যান্য সকল কিছুর) বিকল্প যেন পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ নিজেকে বিকিয়ে দেয় শুধুমাত্র বাহ্যিক বিশ্বাস উৎপাদনের মাধ্যমে নয়, কিংবা এর অন্তর্গত স্বাধীনতার চেতনার দ্বারাও নয়। বরং (আমেরিকান প্রয়োগবাদী ভাষায় বলতে গেলে) এর সত্যের কাছাকাছি হওয়ার 'নগদ-মুল্য' পদ্ধতি দ্বারা। সত্য আসলে সত্য এই কারণেই যে, এটি এমন কিছু উৎপাদন করে যার পরোক্ষমূল্য আছে।পুঁজিবাদ মূলত আজ টিকে আছে, যেকোন বিস্তৃত বিশ্বাসের বিপরীতে নিজেকে প্রায়োগিক বিকল্প হিশেবে দেখিয়ে।


পুঁজিবাদের আতঙ্ক বাস্তবের মাঝেই নিহিত। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলি, বেড়ে উঠা গ্রহ বিধ্বংসী কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগই বলি, অথবা জৈবিক জটিলতাই বলি, সকল ক্ষেত্রেই আমরা দেখি বিশৃঙ্খল বাস্তবতা বারবার ফিরে আসে। ঠিক এই ব্যাপারটা মিশেল ফুকো এবং তাঁর অনুসারীরা এড়িয়ে গেছেন। বলে রাখা ভালো, এদের অনেকেই ‘ইউরোপীয়ান জার্নাল অফ সাইকো-অ্যানালাইসিসে’ তাঁদের লিখা প্রকাশ করেছেন। মূলত ' জীবের জীবন বা ন্যাংটো জীবন(bare life)' বা ‘বায়ো-পলিটিক্সে’ প্রত্যাবর্তনের ধারণা একটি সীমাবদ্ধ ধারণা, কেননা এটি এমন সব ব্যবস্থাপনা কৌশলসমূহের কথা বলে যা জুইসঁঅ(jouissance, সলিমুল্লাহ খান এর বাংলা করেছে ‘মজা মারা’)-এর নতুন প্যারাডাইমের বিপরীতে খাপ খায় না। আমাদের অবশ্যই বাস্তব মোকাবেলার উপায় হিসেবে কেবল বায়োপলিটিক্সকে দেখার প্রলোভন ঠেকাতে হবে। এই প্রলোভন মুলত বাস্তব নিয়ন্ত্রণের অবৈধ বাসনা।

এই হলো ইদানিংকালের রাজনীতির চালিকাশক্তি, এই হলো আমাদের সময়ের সত্য।

____________

২০শে মার্চ, ২০২০


প্রথম প্রকাশঃ ১লা এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১লা এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/1024804671316790/