১৭৪৩ সালের মে মাসে কোন এক রহস্যজনক রোগে মৃত ক্রুদের বহনকারী একটি জাহাজ কর্ফু থেকে মেসিনাতে পৌঁছাল। জাহাজ এবং কার্গোটিকে পুড়িয়ে ফেলা হল। কিন্তু এর পরপরই হাসপাতাল আর শহরের বস্তিগুলোতে একটি অদ্ভুত নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে শুরু করল এবং গ্রীষ্মকালে মহামারী আকারে জন্ম নিলো এক ভয়াবহ প্লেগ, যেটি চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে সিসিলির অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই গায়েব হয়ে গেল। এসময় রুশো প্যারিস হতে ভেনিসে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মহামারীর কারণে জেনোয়াতেই আটকে যান। কনফেশনস (১৭৮২) গ্রন্থে তিনি তাঁর কোয়ারেন্টিন পর্বের বর্ণনা করেন এভাবেঃ
মেসিনাতে তখন প্লেগের সময়। ইংরেজ নৌবাহিনী সেখানে নোঙর গেড়েছিল ও আমাকে বহনরত ফেলুকাটি পরিদর্শনের জন্য এসেছিল। আর এই পরিস্থিতির কারণে এক দীর্ঘ ও কঠিন সমুদ্রযাত্রা শেষে পৌঁছানোর পরে আমরা একুশ দিনের কোয়ারেন্টিনে সাব্যস্ত হয়েছিলাম।
যাত্রীদের জাহাজেই অথবা লাজারেতোতে থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। যদিও আমাদের বলা হয়েছিল যে, জায়গাটি তখনও বাসযোগ্য হয়নি। সবাই ফেলুকাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। অসহ্য গরম, জাহাজের সংকীর্ণতা, ভেতরে চলাফেরার অসাধ্যতা আর জাহাজভর্তি ইঁদুরের কারণে আমাকে সকল ঝুঁকিসমেত লাজারেতো'ই বেছে নিতে হল। ফলস্বরূপ আমাকে প্রায় ফাঁকা একটি বড় দোতলা ভবনে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে আমি কোন জানালা, বিছানা, টেবিল কিংবা চেয়ার তো খুঁজে পেলামই না, কোন পিঁড়ি কিংবা খড়ের আঁটিও পেলাম না। রাতে ঘুমানোর ছালা আর আমার দুটো ট্রাঙ্ক এনে দিয়ে বিরাট দরজায় মস্ত তালা ঝুলিয়ে আমাকে ভেতরে আটকানো হল। আর দেয়া হল চেম্বারে চেম্বারে কিংবা তলায় তলায় হাটার পূর্ণ স্বাধীনতা, যার সবখানেই খুঁজে পেলাম একই নিঃসঙ্গতা আর রিক্ততা।
যদিও একারণে ফেলুকার বদলে লাজারেতো বাছাই করেছি দেখে আমাকে অনুতপ্ত হতে হয়নি। ঠিক আরেক রবিনসন ক্রুসোর মতো আমি নিজেকে আসন্ন একুশ দিনের জন্য গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম যেমনটা আমার সারা জীবনই করা উচিত ছিল। প্রথমেই ফেলুকা থেকে আমার সাথে আসা ইঁদুরগুলোকে মারার বিনোদন পেলাম। সেগুলোকে সরিয়ে ফেলার সাথে সাথে কাপড়-চোপড় বদলে ফেলে আমার বেছে নেয়া চেম্বারটা সাজাতে শুরু করলাম। আমার ওয়েস্টকোট আর শার্টগুলো দিয়ে একটা ভালো তোশক বানিয়ে ফেললাম। ন্যাপকিনগুলো একসাথে সেলাই করে সেগুলো দিয়ে চাদর, চেম্বারে পরার রোব দিয়ে বিছানার চাদর আর জোব্বাটা দিয়ে একটা বালিশ বানালাম। একটা ট্রাঙ্ক সমান করে শুইয়ে দিয়ে সিট আর অন্যটা দিয়ে টেবিল বানিয়ে নিলাম। কিছু কাগজ আর একটা দোয়াত-কালি বের করে আমার সাথে থাকা এক ডজন বইগুলোকে একটি লাইব্রেরীর মতো করে সাজালাম। এককথায়, আমার সাথে থাকা জিনিসপত্রগুলোকে এত ভালোভাবে সাজালাম যে, রু ভার্দেলেতের টেনিস কোর্টে যেমন সুসজ্জিত ছিলাম এই ফাঁকা লাজারেতোতেও পর্দা আর জানালা ছাড়া ঠিক প্রায় তেমন অবস্থা পেলাম। আমার খানা পরিবেশনও কোন অংশে কম আড়ম্বরপূর্ণ ছিলনা। অস্ত্র সজ্জিত দুজন সৈন্যের প্রহরায় আমার প্রতি বেলার ভোজ পরিবেশিত হত। সিঁড়িটি ছিল আমার ভোজন কক্ষ, অবতরণস্থলটি টেবিল আর ধাপগুলো সিট। আমার খাবার পরিবেশনের সাথে সাথে একটি ছোট ঘন্টা বাজিয়ে জানানো হত যে আমি খাবার টেবিলে বসতে পারি।
ভোজ আয়োজনের মধ্যবর্তী সময়ে যখন আমি পড়া অথবা লেখা কিংবা এপার্টমেন্ট সাজানোর কাজ না করতাম, তখন আমি প্রোটেস্ট্যান্টদের কবরস্থানে হাঁটতে যেতাম যেটি আমার জন্যে উঠান হিসেবে কাজ করতো। এই জায়গা থেকে আমি বন্দরের দিকে মুখ করা একটি লণ্ঠনে উঠতাম আর সেখান থেকে জাহাজগুলোর আসা যাওয়া দেখতাম। এভাবেই আমার চৌদ্দ দিন কেটে গেল।[i]
যখন বৈশ্বিক মহামারীর কারণে পুরো মানবজাতিকে ‘ঘরে থাকুন’ বলা হল, আমার সাথে সাথেই কনফেশনস থেকে এই অংশটির কথা মনে পড়ে গেল। যখন তাঁর দুর্ভাগ্যের সঙ্গীরা সবাই একসাথে জাহাজে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো, রুশো তখন লাজারেতোতে বন্দি থাকাকেই বেছে নিলো। লাজারেতো হলো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল। ফেলুকা বা ভূমধ্যসাগরীয় জাহাজও কোয়ারেন্টিনের জন্য ব্যবহার করা হত। অবশ্যই জেনুয়াতে ভ্রমণকারীদেরই শুধু এই দুটো সুযোগ দেয়া হয়েছিল। আর রুশোর মনে হয়েছিল জাহাজ ছেড়ে নিজে নিজে ভবনটিতে থাকাই তাঁর জন্যে শ্রেয়।
এই ঘটনাটিকে অনেকে শুধুমাত্র বাছাই-করার ধারণার ভিত্তিতে পড়তে পারেনঃ আবদ্ধ থাকার সময় কোনটা করা সর্বোত্তম? অন্য মানুষের সাথে কোয়ারেন্টিনে থাকা? নাকি একা একা কোয়ারেন্টিনে থাকা? আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, আমি নিজেও এরকম একটি বিকল্প ভেবে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছি। আমার কাছে যদি এই দুটো অপশনের মধ্যে থেকে বেছে নিতে বলা হত, তাহলে আমি কী করতাম? (প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি যে, আমি বর্তমানে একা একা ক্যালিফোর্নিয়ার আরভিনে প্রায় পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছি।)
তবে এই রচনাংশে হয়তো আরও অন্তর্নিহিত কিছু আছে— সেটি হচ্ছে কোয়ারেন্টিন তখনই শুধুমাত্র সহনীয় যখন আপনি তা থেকে কোয়ারেন্টিনে থাকেন— যদি আপনি কোয়ারেন্টিনের ভেতরেই কোয়ারেন্টিনে থাকেন এবং বলতে গেলে, একই সাথে এই ‘থাকা’ থেকেও [কোয়ারেন্টিনে থাকেন]।
লাজারেতো’টি আসলে এই দ্বিগুণ কোয়ারেন্টিনের প্রতীক যেটি একই সাথে যূথবদ্ধ অন্তরণ থেকে রুশোর নিজেকে অন্তরীণ রাখার প্রয়োজনীয়তাকেও বুঝায়। অর্থাৎ এই অন্তরীত অবস্থার মধ্যেই আরেকটি একান্ত দ্বীপ তৈরি করা। কিছু লোকের সাথে একটি জাহাজে আটকে থাকা নিশ্চয়ই এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার অনুভূতির জন্ম দেয়, কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা নির্জনতা(solitude) নয় এবং বাস্তবে নির্জনতাই আবদ্ধ দশাকে সহনীয় করে তোলে। এমনকি যিনি ইতোমধ্যে একা একাই থাকছেন এটি তার ক্ষেত্রেও সত্য। আমি লক্ষ্য করেছি যে নিজের ভেতর অবগাহনের অক্ষমতা আসলে আমার জনবিচ্ছিন্নতাকে আরো দুর্বিষহ করে তুলছিল।
তাই সেই একান্ত বিন্দুটি খোঁজা যেখানে আমি স্বয়ং নিজে (My self, দুইটি শব্দে) বিরাজ করতে পারি। আমি এখানে নির্ভেজালত্বের কথা বলছি না। বলছি কেবলই আত্মার এক চূড়ান্ত নগ্নতার কথা যা নিজের ঘরে বসত বানাতে দেয়, বলছি মনস্তাত্ত্বিক সেই স্থানটিকে চিহ্নিত করে ঘরটিকে বাসযোগ্য করে তোলার কথা যাতে কিছু একটা করা সম্ভবপর হয়, আমার ক্ষেত্রে যেটি হল লেখা।
আমি খেয়াল করেছি যে লেখা তখনই সম্ভব হয়েছে যখন আমি এরকম বন্দিত্বের ভেতরে বন্দিত্বে পৌঁছেছি, স্থানের অভ্যন্তরে আরেকটি স্থান যেখানে আর কারও প্রবেশ নেই এবং যেটি একই সাথে অন্যদের সাথে আমার যোগাযোগের একটি পূর্বশর্তও বটে। যখন আমি লেখার ভেতরে ডুবে যেতে পারতাম, তখন যেন স্কাইপের কথাবার্তাও অন্যরকম হয়ে উঠত। সেগুলো প্রচ্ছন্ন একলাপেরআমি খেয়াল করেছি যে লেখা তখনই সম্ভব হয়েছে যখন আমি এরকম বন্দিত্বের ভেতরে বন্দিত্বে পৌঁছেছি, স্থানের অভ্যন্তরে আরেকটি স্থান যেখানে আর কারও প্রবেশ নেই এবং যেটি একই সাথে অন্যদের সাথে আমার যোগাযোগের একটি পূর্বশর্তও বটে। যখন আমি লেখার ভেতরে ডুবে যেতে পারতাম, তখন যেন স্কাইপের কথাবার্তাও অন্যরকম হয়ে উঠত। সেগুলো প্রচ্ছন্ন একলাপের(monologuemonologue) বদলে সংলাপ হয়ে উঠতো। লেখা সম্ভব হত যখন নির্জনতা আমাকে জনবিচ্ছিন্নতা থেকে সুরক্ষিত রাখত। অন্যদের কাছ থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন হবার পরেও তাঁর সত্তার সাথে লেগে থাকা সকল রাখ-ঢাক, কাপড়-চোপড়, পর্দা, মুখোশ আর অর্থহীন বাতচিৎ খুলে ফেলতে হবে।সামাজিক দূরত্ব দূরত্বে থেকে যাওয়া সমাজের অবশিষ্টাংশ খুলে ফেলতে কখনোই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলনা। স্থানিক-আশ্রয়কে এক চরম রবিনসন-ক্রুশো-অভিজ্ঞতা হতে হয়, এমন এক অভিজ্ঞতা যা মানুষকে শূন্য থেকে ঘর বানাতে শেখায়। নতুনভাবে শুরু করতে কিংবা স্মরণ রাখতে শেখায়।