একটা দুনিয়া ধ্বংস হচ্ছে

লেভি ব্রায়ান্ট


[লেভি আর. ব্রায়ান্ট(Levi R. Bryant) আমেরিকান দার্শনিক এবং অবজেক্ট-ওরিয়েন্টেড ফিলোসফি তৎপরতার লোক। গ্রাহাম হারমানের অবজেক্ট-ওরিয়েন্টেড ফিলোসফির[i] সাথে নিজের প্রস্তাবনার ফারাক টানতে গিয়ে নিজের প্রস্তাবনাকে বলছেন অবজেক্ট-ওরিয়েন্টেড অন্টলজি। অবজেক্ট-ওরিয়েন্টেড চিন্তাচর্চার তাঁর ভাষ্য অন্টিকোলজি (onticology) নামে পরিচিত। অধিবিদ্যা সংক্রান্ত অনুসন্ধানে অন্টিকোলজি মানুষকে কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে সরিয়ে দেয়। অন্টিকোলজির প্রস্তাবনা তোলার মাধ্যমে অ্যান্টি-রিয়েলিস্টদের যে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলি সেইসবকে তিনি রিয়েলিস্ট অন্টোলজির মধ্যেই একীভূত করতে সমর্থ হন যা একই সাথে বস্তু ও সংস্কৃতি দুইয়ের ক্ষেত্রেই ন্যায্যতা স্থাপন করে। অন্টিকোলজি একটা ফ্ল্যাট অন্টোলজির প্রস্তাব করে যাতে সকল অবজেক্টকে অন্য কোন অবজেক্টে নামিয়ে না এনে সকল অবজেক্ট সমানভাবে অস্তিত্বশীল থাকে। অবজেক্টগুলির মধ্যকার গতিশীল সম্পর্কের বাইরে শাশ্বত সারবত্তার মত কোন তুরীয় সত্ত নেই। ব্রায়ান্টের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে Difference and Givenness: Deleuze’s Transcendental Empiricism and the Ontology of Immanence (নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮), The Democracy of Objects (ওপেন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১১), and Onto-Cartography: An Ontology of Machines and Media (এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৬)।


করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে লেভি ব্রায়ান্টের A World is Ending শিরোনামের একটি লেখা Identities জার্নালে গত এপ্রিলের ৩ তারিখে প্রকাশিত হয়। স্পেকুলেটিভ রিয়েলিজম ঘরানার নতুন দার্শনিক আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকের এই লেখাটি এখানে অনুবাদ করা হয়েছে।]



যতই এই বৈশ্বিক মহামারী আমার সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে আমার ততই মনে হচ্ছে যে এ বিষয়ে আমি কেবল খন্ড খন্ডেই ভাবতে পারি। ব্যাপারটা এমন যেন, কান্ট যেটাকে বলেছে আত্মচেতনার তুরীয় ঐক্য সেটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। ফর্মাল যেই “আমি চিন্তা করি” যার আমার সকল উপস্থাপনের সঙ্গ দেয়ার কথা, তা বিচ্ছিন্ন এবং তুলনার অযোগ্য উপলব্ধিতে পরিণত হয়েছে। যেই উপলব্ধির পেছনে কোন ঐক্যই নেই। ট্রান্সেন্ডেন্টাল ডিডাকশনে কান্ট বলছেন যে, অভিজ্ঞতার সম্ভাবনরা শর্তগুলি অভিজ্ঞতার বস্তুর সম্ভাবনার শর্তও। ট্রান্সেন্ডেন্টাল ডায়ালেক্টিক্সে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন যে সম্পূর্ণ বা সমগ্র হিসেবে জগতের ধারণা আমাদের অভিজ্ঞতার একটা শর্ত। যদি আমার ফর্মাল “আমি চিন্তা করি” বিনষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে তার মানে কি এও দাঁড়ায় যে, আমার জগৎও বিনষ্ট হয়ে গেছে যেহেতু এই দুইয়ের মাঝে একটা সমান্তরাল আছে? তাই আমি খন্ডে খন্ডেই লিখব এই আশা নিয়ে যে এরা আমায় কোন ঐক্য, কোন শব্দব্রহ্ম(logos) পেতে সহায়তা করবে। এই খন্ডগুলি পেছনে থেকে এরা আমায় আবার বোধগম্য করে তুলবে।


***


একটা দুনিয়া ধ্বংস হচ্ছে। আমি বলছিনা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বরং আমি বলছি একটা দুনিয়া ধ্বংস হচ্ছে। এই চিন্তা গতরাতে আমার মনে ঝিলিক দিয়ে যায়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরেই এই চিন্তা আমার অচেতনে এমন এক চেহারা নিয়ে লুকিয়ে ছিল যে নিজেকে বলার মত যথেষ্ট সাহস আমার হচ্ছিলনা।


***


চার সপ্তাহ আগে স্প্রিং ব্রেকের আগ মুহুর্তে আমি আমার শেষ ক্লাস নিয়েছি। আমি কোভিড-১৯ সম্পর্কে মোটামুটি অবগত ছিলাম কিন্তু এটা ছিল আমার কাছে বেশ বিমূর্ত এবং অবাস্তব। আমি আর আমার সংগীর মাঝে এটা ছিল একটা কৌতুকের বিষয়। আমার ধারণা আমি ভেবেছিলাম এইরকম কোন ব্যাপার এইখানে ঘটতেই পারেনা। এইসব ঘটনা সবসময়েই অন্য কোথাও ঘটে।


***


যৌবনে আমি হাইডেগারীয় ছিলাম। আমার মরহুম দাদি আমার আঠারতম জন্মদিনে বিং এন্ড টাইমের একটা কপি উপহার দিয়েছিলেন। তারও দুইবছর আগে আমার দর্শনের সাথে পরিচয় ঘটে। এইটা এমন একটা সময়ের গল্প যখন ইন্টারনেট বা বড় বইয়ের দোকান ছিলনা। আমি যে ছোট শহরতলিতে বড় হয়েছি সেখানে এরকম বইয়ের নাগাল পাওয়া ছিল বেশ কঠিন ব্যাপার। অস্তিত্ববাদ নিয়ে আমি বেশ মোহাচ্ছন্ন ছিলাম এবং বেশ কয়েক বছর ধরে আমি হাইডেগার পড়েছি। কিন্তু উনার কাজ কোথায়ই খুঁজে পেতাম না। এ যাবতকাল পর্যন্ত আমি যত উপহার পেয়েছি তার মধ্যে নিঃসন্দেহে এটাই সর্বোত্তম উপহার। আমার মনে হচ্ছিল আমি খুবই দুষ্প্রাপ্য ও চরম মূল্যবান কিছু পেয়েছি।


***


এইখানে কোভিড-১৯ আসতে পারেনা এরকম ভাবনার কথা যখন আমি বলছি আমার মনে হয় এইখান বলতে আমি ভৌগলিক পরিসরের থেকেও আরও মৌলিক কিছুর কথা বোঝাচ্ছি। আমি নিশ্চিত আমি সেটাই বুঝিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয়, “এইখানের” ধারণার পেছনে লুকিয়ে আছে উন্মুক্তের ধারণা। হাইডেগার বলেছিলেন, আমাদের দাজাইনকে (Dasein) বিশ্লেষণ করতে হবে। দাজাইনকে প্রায়ঃশই “মানব অস্তিত্ব” হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু এটা হতে পারেনা, কারণ মানুষ নিজেই দাজাইনের মধ্যে নিজেকে প্রকাশিত করে। দাজাইন হচ্ছে সেই স্পষ্টতা যার মধ্যে কোনকিছু হাজির হয় অথবা নিজেকে প্রকাশিত করে। অনেকটা আলোর আগের আলোর মত। না, দাজাইন “মানব অস্তিত্ব” নয়। এটাকে “Being-there” অথবা এমনকি “Being-here”, অথবা সোজাসাপ্টা উন্মুক্ত (The Open) হিসেবে অনুবাদ করা যায়।


***


আমি কোন হাইডেগার বিশেষজ্ঞ না। এই বিষয় নিয়ে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বিতণ্ডায় যাওয়ার আগ্রহও আমার নেই। যখন আমি উন্মুক্তের (the Open) কথা বলছি আমি বোঝাচ্ছি ঠিক যেইভাবে জগত আর আমরা নিজের আমাদের জন্য এইখানে আছি। জগতে একটা ধারাবাহিকতা আছে, একটা শব্দব্রহ্ম। আজকের দিন গতকালের মত আর আগামীকাল হবে আজকের মত। এরকম কিছু এইখানে ঘটবেনা বলা মানে জায়গার কথা বলা না। অথবা, আমরা যদি জায়গার কথাই বলি, আমরা আসলে একটা যথার্থ রকম সত্তাসম্বন্ধীয় (Ontological) জায়গার কথা বলছি। বলছি পৃথিবীর শব্দব্রহ্মের কথা। আবারও বলছি, পৃথিবী নয়, এক পৃথিবী। এরকম কিছু এইখানে ঘটেনা কারণ এইরকম কোন ঘটনা ঘটা সম্ভব না যা জগত অথবা উন্মুক্তের যে শৃঙ্খল তাকে মৌলিকভাবেই অস্বীকার করে। অন্তত, এটাই আমি সরল মনে ভেবেছিলাম।


***


[জর্জ] স্যান্টায়ানা একরকম জান্তব বিশ্বাসের কথা বলেছিলেন। এটা ছিল সংশয়বাদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রত্যুত্তর। তিনি বলেছিলেন জগতের বাস্তবতায় আমাদের একধরনের জান্তব বিশ্বাস আছে। এইটা এক অর্থে উন্মুক্তই। উন্মুক্তে বিশ্বাস করার কোন প্রয়োজন নেই। এইটা সকল বিশ্বাসের পূর্ববর্তী একটা অবস্থান। জগত সবসময়ই ইতোমধ্যে উন্মুক্ত এবং জগতের একটা ধারাবাহিকতা আছে। আমি আজকে যা করি তা করি উন্মুক্তের কারণেই। আমার জান্তব বিশ্বাস আছে যে আজ এবং গতকাল পৃথিবী যেমন ছিল আগামীকালও সেইরকমই থাকবে। আমার এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা আর আমার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড এই উন্মুক্ত বা জগতের ওপরেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।


***


হিউম আসলে ঠিক কি বলেছিলেন? তিনি অনেকটা এরকম বলেছিলেন যে তিনি আর্মচেয়ারে বসা এক সংশয়বাদী। এমন একজন যিনি দেখাতে পারবেন না যে, ভবিষ্যত অতীতের মতই হবে। অথচ, তিনি যখন বিলিয়ার্ড খেলতেন তখন তিনি পদার্থবিদ্যার সূত্রেই আস্থা রাখতেন আর তাঁর সংশয়বাদ তখনকার জন্য বন্ধ রাখতেন। উন্মুক্ত অনেকটা এইরকমই। কেউই সত্যিকার অর্থেই সংশয়বাদী না যতক্ষণ পর্যন্ত সে লেখালেখির টেবিল বাদ দিয়ে দৈনন্দিন অপরাপর কাজ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ছে।


***


কিন্তু আগামীকাল হারিয়ে গেছে এবং এটা এইজন্যে হারিয়ে গেছে যে একটা দুনিয়া ধ্বংস হচ্ছে। উন্মুক্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা বেশ আয়রনিক যে দার্শনিকদের কয়েক প্রজন্ম যারা বর্তমানের অধিবিদ্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে, এখন আমরা সবাই একটা অনন্ত বর্তমানে আটকে পড়া অবস্থায় নিজেদের আবিষ্কার করেছি। স্প্রিং ব্রেকের ক্লাসে আমার শেষদিনে যেই পৃথিবীতে আমি ছিলাম তা আমি আর কোনোভাবেই বুঝতে পারছিনা। আমাদের বাড়িতে এই সময়কে আমরা বলি “সময়ের পূর্বকাল”। আর কোন আগামীকাল নাই। আছে শুধু এই তালিকাহীন বর্তমানেরা যেখানে একটা দিন রক্তের মত ছড়িয়ে পড়ে আরেকটা দিনে। সব দিনই একরকম। আমাদের তাই একরকম আর ধারাবাহিকের মধ্যে ফারাক করতে হবে। জগত বা উন্মুক্তের ধারাবাহিকতা প্যারাডক্সের মত পরিবর্তনকে ধারণ করে। কিন্তু একইয়ের ছায়ার জগতে কোন পরিবর্তন নেই। সকল প্রকল্প মুলতবী হয়ে গেছে। এইটা একটা লিম্বো। স্পিলবার্গের সিনেমা দ্যা টার্মিনালের এয়ারপোর্টের মত।


***


আমরা সময় থেকে বের হয়ে গেছি এবং এই কারণেই আমরা অনেক উন্মুক্ত আর অনেক সময়ের মাঝে র‍্যাডিকালি আছি। সবজায়গায়ই র‍্যাডিকাল রূপান্তরের উন্মোচন ঘটছে। ভয়ংকর সব রূপান্তর। কিন্তু সময়ের হয়ে গেছে মুলতবী। আমরা প্রত্যুষে সূর্য ওঠার মত করে আগামীকাল যেন ফিরে আসে সে আশা করে আছি। কিন্তু আমরা নিশ্চিত না আগামীকাল আদৌ কখনো আসবে কিনা। আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছি যে আগামীকাল যদি ফিরেও আসে কোনদিন সেটা হবে একটা ভয়াবহ সময় যেখানে বেঁচে থাকবার আর কোন মানেই থাকবেনা। আগামী কি আবার ফিরে আসবে?


***


“সময়ের পূর্বকাল” এই অভিব্যক্তিটা কিউট হতে পারে কিন্তু দার্শনিকভাবে যথার্থ নয়। তখন সময়ের অস্তিত্ব ছিল সময়ের পূর্বকাল সেই কারণে সময়ের পূর্বকাল নয়। সেখানে ছিল উন্মুক্ত। না, আমরা সময়ের পূর্বকাল অথবা দুই দুনিয়ার মাঝখানের লিমিনাল স্পেসে বাস করছি যেখানে সময় মুলতবি হয়ে রয়েছে। এটাই সময়ের পূর্বকাল। আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে অপেক্ষা। এক দুনিয়া এককালে যেমন ছিল তার ছায়া আর ভূতে পরিণত হয়েছি আমরা। আমরা নিজেরাই একটা হারানো সময়ের ভগ্নাংশে পরিণত হয়েছি। সময় বাদে আর কিছুই না থাকার ফলে, যাদের এককালে সময় ছিল কিন্তু যারা সেই সব সময় হারিয়ে ফেলেছে তাদের অবশিষ্টাংশে পরিণত হয়েছি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কর্তব্যপরায়ণাতার সাথে পরিধেয় বস্ত্র গায়ে জড়ায়। অথচ এরপরে আমরা অপেক্ষা বৈ আর কিছুই করিনা যেহেতু আমরা হারানো সময়ের একটা টুকরা। ভূত হচ্ছে একটা জায়গার স্মৃতি যা একসময়ে এইখানে ছিল। আমরা সবাই এখন ভূত। আমরা এমন একটা দুনিয়াকে তাড়া করে ফিরি যা আমাদের মনে হয় এখনো এইখানে আছে কিন্তু সেই দুনিয়া চলে গেছে। যেই দুনিয়া এক কালে ছিল আমরা সেই দুনিয়ার প্রতিধ্বনি।


***


আমি যদি এটা বলতে পারি যে একটা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাহলে আমার নিশ্চয়ই দুনিয়া কি সে সম্পর্কে কিছু ধারণাও আছে। পরিষ্কারভাবেই দুনিয়া, পৃথিবী না এইজন্য যে পৃথিবীতে আমি হেটে বেড়াই। এটা আমার নড়াচড়ার জায়গা। হাইডেগার বলছেন যে, দুনিয়া হচ্ছে সেইসব গাঠনিক সম্পর্কের সমগ্র যা অর্থ বা দ্যোতনা তৈরী করে। উদাহরণস্বরূপ সেই বিখ্যাত হাতুরীর কথা বলা যায়।[ii] কেবলমাত্র পেরেক, শক্ত করার জন্য বোর্ড, তৈরী হওয়া ঘর, এবং পৃথিবী যা আমাদের আশ্রয় দেয় তার সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতেই এই হাতুরী অর্থবোধক হয়ে ওঠে বা অর্থ তৈরি করে। প্রকল্পের একটা গুচ্ছ যা তদারকির দিগন্তে বিষয়াদিকে একত্রিত করে তার সাপেক্ষে এই হাতুরীর অর্থ নির্মিত হয়। কিন্ডারগার্টেনে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শেখার জন্য “The Skeleton Dance” নামে একটা গান গাইতাম। গানের লাইন ছিল এরকম “the hip bone connects to the thigh bone and the thigh bone connects to the knee bone…”.জগতের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এরকমই। আমাদের প্রকল্প ও সচেতন কাজ কারবারের সাপেক্ষে জগতের সকল বস্তু একে অন্যের সাথে সম্বন্ধ স্থাপনের মাধ্যমে অর্থের একটা বুনন তৈরি করে।


***


যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কল-কব্জা কার্যকর থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মোটা দাগে এরা থাকে অদৃশ্য বা নির্জ্ঞান। জগতের সাথে আমার সচেতন কর্ম-কান্ডের তৎপরতার সাথে এটা পুরোপরি জড়াজড়ি করে থাকে। যখন আমার কল-কব্জায় কোন ভাঙন ধরে কেবল তখনি বস্তু বস্তু হিসেবে আমার সামনে হাজির হয় এবং আমি অর্থ উৎপাদনি সম্পর্কের সমগ্রতা নিয়ে সচেতন হই। বস্তু “রেডি-টু-হ্যান্ড”(সদাপ্রস্তুত দশা) থেকে “প্রেজেন্ট-অ্যাট-হ্যান্ড”(‘বিদ্যমান’ দশা) এ রূপ নেয়। জগত এখন ভেঙ্গে পড়েছে আর তাই বস্তু এখন “প্রেজেন্ট-অ্যাট-হ্যান্ড”। এইটা একটা সুযোগ।


***


যেহেতু আমাদের ওপরে হুকুম এসেছিল “ঘরে থাকো এবং নিরাপদ আশ্রয়ে থাকো”, আমাদের পরিবার যাতে সামনের দিনগুলি পার করতে পারে সেই জন্যে সপ্তাহ দুই আগে আমি বাজারে গিয়েছিলাম খাদ্য স্টক করতে। বাজারে যাওয়ার ট্রিপ এখন আপনার মরণশীলতার সাথে দেখা হওয়া। এখন জগতের সকল কিছুই “প্রেজেন্ট-অ্যাট-হ্যান্ড” অথবা ভাঙ্গা কারণ বস্তুর মধ্যকার যে সম্পর্ক নির্দেশ ও অর্থের অনবরত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদেরকে নির্জ্ঞান এবং “রেডি-টু-হ্যান্ড” রাখে তা ভেঙ্গে পড়েছে। জগতের সকল ছোট-খাট জিনিস এখন ভীতিপ্রদর্শনকারি জিনিসে পরিণত হয়েছে। আমি এখন সব দেখতে পাই। আমি যখন খাবারে হাত দেই, আমি ভাবি এর উপরে ভাইরাস আছে কিনা। আমার হাতে কি এখন ভাইরাস আছে? আমি কি গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে সেই ভাইরাসে নিয়ে এসেছি আর তা থেকে আমার দরজার সিটকিনিতে? আমি তো মুদি দ্রব্যাদি ঘরে নিয়ে আসি। ব্লিচিং পাউডার দিয়ে স্টোরের কাউন্টারগুলিকে পরিষ্কার করার দরকার পড়ে। মোড়ক খুলে ফেলবার দরকার পড়ে। মৃত্যু সবজায়গায় ঘাপটি মেরে থাকে এবং জগতের সকল নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র এখন হুমকিস্বরূপ। বাজারে যাওয়ার মত এত সাদা মাটা একটা কাজ আমি, আমার পরিবার, এবং এমন মানুষ যাদের আমি চিনিওনা সবাইকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। জগতের কিছুই আর আমরা বন্ধু নেই বরং জগতের সকল কিছুই ভাইরাসে সম্ভাব্য এজেন্ট হয়ে পড়েছে। আমরা পাঁচ থেকে চৌদ্দ দিন অপেক্ষা করি এই ভেবে যে ভাইরাস আমাকে ধরল কিনা এবং উপসর্গহীনভাবে ভাইরাস আমি শরীরে বহন করে বেড়াচ্ছি কিনা। আমরা কোনভাবেই আর [ডোনা] হারাওয়ে অথবা [আর্থার সি] ক্লার্কের সাইবর্গ অথবা প্রোস্থেটিক ইশ্বর না কারণ বস্তুর যে জগত এটাকে সম্ভব করেছিল তা ভেঙ্গে পড়েছে। দুনিয়াটা ভেঙ্গে পড়েছে।


***


বাজার থেকে ফিরে জগতের তলায় আমি পৃথিবীকে আবিষ্কার করি। আমি সবার আগে এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণভাবে পৃথিবীকে আবিষ্কার করি ভাইরাসটার মাধ্যমে। প্লেগের থাকার কথা ছিল অতীত ইতিহাসের অংশ হিসেবেই। মধ্যযুগ বা রেনেসার মত অতীতেই প্লেগের থাকার কথা। অন্তত প্রথম বিশ্বের ক্ষেত্রে যেই বিশ্ব এত বেশি বাড়তি সুবিধা উপভোগ করে, প্লেগের থাকার কথা অন্য এইখানে, অন্য দুনিয়ায়। আজকের দিনে প্লেগ আসার কথা দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠী এবং অপেক্ষাকৃত কম উন্নত মানুষের দুঃখ হয়ে। এতে কোন সন্দেহই নেই যে এটা এইসব জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করতে সক্ষম করেছে। অথচ,যেই পৃথিবীকে আমরা সংস্কৃতির মাধ্যমে পরাস্ত করে ফেলেছি বলে ভেবেছি, এই দুনিয়ার নিচে সেই পৃথবী গর্জন করে চলেছে।


***


যেসকল জিনিস আমাদের জীবনকে সম্ভব করে তোলে তাদেরকে গায়ে-পড়া মনে হচ্ছে। হয় যখন প্রয়োজন তখন অনুপস্থিত থাকার মাধ্যমে অথবা ভাইরাসের সম্ভাব্য ভয় প্রদর্শনকারী বাহক হিসেবে হাজির থাকার মাধ্যমে। আমি পৃথিবীকে দ্বিতীয়ত আবিষ্কার করি এইসব জিনিসের মাধ্যমে। সব জায়গায় টয়লেট পেপারের অনুপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। লাকাঁ আমাদের শিখিয়েছে যে উপসর্গের গড়ন ভাষার মতই। উপসর্গ কথা বলে। এটা কোন বার্তা অথবা দ্যোতকের একটা সিরিজ প্রকাশ করে। এটা একটু ক্যামন যেন যে এত কিছু থাকতে মানুষ টয়লেট পেপার মজুদ করলো। এমন যেনো একটা পর্যায়ে তারা যেই পৃথিবী জগতকে সম্ভব করে তোলে, জগতের নিচে গর্জনরত সেই পৃথিবীকে ঠাওর করেছে। যা বলার ভাষা তাদের জানা ছিলনা এমন কিছু বলার জন্য তারা এমন একটা বস্তুকে বেছে নিয়েছে যা প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ছেদবিন্দুকে চিহ্নিত করে। আমরা একটা উপসর্গের মারফতে কথা বলেছি।


***


লোকে বলে এই বৈশ্বিক মহামারি নাকি একটা কেয়ামত। এতে কোন সন্দেহ নেই যে এর মাধ্যমে তারা

বিপুল ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা সম্পন্ন একটা প্রলয়ংকারি অথবা সর্বগ্রাসী ঘটনার কথা বলছে। অনেকেই মরে যাবেন এবং দুনিয়া ব্যাপী অর্থনীতি ধ্বসে পড়ছে। কিন্তু মূল অর্থবোধকতার দিক থেকে, কেয়ামতের মানে হচ্ছে “প্রকাশ করা” অথবা “উন্মোচিত” করা। জগতের দুই ধারণাগত দিক থেকেই এই বৈশ্বিক মহামারি একটা কেয়ামত। আমি এই বৈশ্বিক মহামারিকে একটা ঘটনা হিসেবেই ভাববো, একটা ভয়ংকর ঘটনা। একই সাথে চেষ্টা করবো এই ঘটনা কি প্রকাশ বা উন্মোচিত করে তা বের করে নিয়ে আসতে। [জিল] দেল্যুজ তাঁর লজিক অফ সেন্স বইয়ে ঘটনার একটা নৈতিকতার প্রস্তাব করেন। তিনি বলছেন, যে ঘটনা আমাদের সাথে ঘটে আমাদের সেই ঘটনার যোগ্য হতে হবে। এই ঘটনাকে উনি ক্ষতের তুল্য হিসেবে বলেছেন। যদি একটা দুনিয়া ধ্বংস হতে থাকছে, যদি এটা একটা ঘটনা অথবা ক্ষত হয়, তাহলে আমাদের এই ঘটনার যোগ্য এমন ধারণা নির্মাণ করতে হবে যা আবার শুরু করাকে ও ভোরের সূর্যোদয়কে সম্ভব করে তুলবে। আমাদের সেইসকল ধারণা একত্রিত করার প্রয়াস চালাতে হবে যা নতুন দুনিয়ার জন্মের দুয়ার খুলে দিবে।


***


সেইসকল গণ্যমান্য লোক যাদের ওপরে আমরা সবাই নির্ভর করি তাদের নেটওয়ার্ক উন্মোচিত হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে আমরা সেই জম্বি মিথের সাথে বাস করেছি যে ওপরের তলার লোকজন সম্পদ তৈরি করে। অথচ, আমরা যেই না কাজ হারিয়ে এই ছায়ার জগতে নিক্ষিপ্ত হয়েছি আর আমাদের থাকতে হচ্ছে “ঘরে আর নিরাপদ আশ্রয়ে”, তখনি আমরা গোটা অর্থনীতিকে থমকে পড়তে দেখেছি। আমরা টের পাচ্ছি যে আমরা খেতে পারি কেবলমাত্র সেইসব মানুষের জন্য যারা মারাত্মক পরিবেশের মধ্যে কাজ করে। একটা দ্রুতগামী গাড়ির ইঞ্জিনের মত যারা এতদিন অদৃশ্য ছিল তারা প্রকাশিত হয়েছেন। বেঁচে থাকার মত বেতনের উপযুক্ত না বলে যাদেরকে বলা হয়েছে তারাই এখন সবকিছুর জন্য অপরিহার্য হিসেবে উন্মোচিত হয়েছেন। আমরা যদি বাস্তুসংস্থান অধ্যয়ন করতাম, তবে অনেক আগেই এটা টের পেতাম। খাদ্যশৃঙ্খলে সবার ওপরে যে খাদক, বাস্তুসংস্থানে তার গুরুত্ব সবচাইতে কম। কোটিপতিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অথচ, তারাও আমাদের কতিপয়ের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং এটা টের পেয়েছে যে পালানোর কোন জায়গা নেই, অথবা এর ভেতরে অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।


***


বাদিয়্যুঁতে যেমনটা পাওয়া যায়, নীতিবিদ্যা ও রাজনীতির সমস্যা ভিন্নতায় না, বরং কিভাবে এক তৈরি করা যায় তাতে। তিনি বলছেন সারবত্তাগত জায়গা থেকে কোন একহীন অসীম পচনশীল বহুতা বাদে আর কিছুই নেই। আমার যদি কোন যমজ ভাই থাকতো তবে একজন চায়নিজ লোকের সাথে আমার যে পরিমাণ ফারাক সেই পরিমাণ ফারাক আমার তার সাথে থাকতো। তিনি দাবি করছেন যে ভিন্নতা সত্তার খুবই তুচ্ছ একটা ফ্যাক্ট। প্রশ্ন হচ্ছে একইইয়ের একটা জায়গা তৈরি করতে আমরা কিভাবে এই ভিন্নতার মাঝে আড়াআড়ি দাগ টানতে পারি। ভাইরাস সবাইকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। এটা অন্য কোথাও হতে অস্বীকৃতি জানায়। আপনি ধনী, গরীব, আরোপিত “মধ্যবিত্ত”, কালো, সাদা, নর নাকি নাকি নারী সেই ব্যাপারে এই ভাইরাস নির্লিপ্ত। যখনি চাকরি চলে গেল আর এই অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়লো, “মধ্যবিত্ত” কোটিপতির থেকে বরং ঘরহীন মানুষের সাথেই তার সাযুজ্য বেশি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের চাকরি ছিল আর তাই ছিল বেতন আর চিকিৎসার সুযোগ, আমাদের নিরাপত্তহীনতা আর ভঙ্গুর দশা ছিল আড়ালে। যাই হোক, এটা উন্মোচিত হয়েছে যে [জ্যাক] রঁসিয়ে’র নো পার্টের যে অংশ সরকার এবং চাকরিদাতা উভয়ের সামনেই শোচনীয় দশায় থাকে সেরকমভাবেই আমরা সকলেই নো পার্টের অংশ। তার মানে আমরা সবাই নিরাপত্তাহীন ও ভঙ্গুর দশায় আছি। আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভয়ানক ও নিষ্ঠুর অবিচার, ক্ষমতার ভয়ংকর অসমতা, এবং উপস্থাপন উন্মোচিত হয়েছে এবং সবার দেখার জন্য বিছিয়ে রাখা হয়েছে। সম্ভবত এই জন্য যে যাতে করে একটা এক অথবা এক জনতা তৈরি করা যায়।

***


সংকট সবসময়েই অন্য কোথাও ছিল এবং সবসময়ে অন্য কারোর সঙ্গে ঘটেছে। সে কারনেই আমরা না, তাদের সাপেক্ষে চিন্তা করা সম্ভব হয়েছে। এই আমরা ছিল সবসময়েই ভৌগলিক, স্থানিকভাবে অবস্থিত। এমন একটা ভৌগলিক এইখান যেখানে থাকাটা ঐখানে ঐভাগ্যাহতদের মধ্যে না থাকা নিয়ে বিশেষ আরাম দেয়। এই ভাইরাসের হাত ধরে এই গ্রহ উন্মোচিত হয়েছে। এমন কোন এইখান নেই যা ঐখান থেকে আলাদা হয়। ফাকা দূরত্বে থেকে অন্য অন্য শরীরে বল প্রয়োগ করার মত ঐখান এইখানকে প্রতিধ্বনি করে এবং ঐখানের সাথে নিষ্কৃতিহীনভাবে যুক্ত থাকে। আমরা আবিষ্কার করি যে জাতি-রাষ্ট্র সবসময়েই একটা প্রতিকী কল্প-কাহিনী ছিল। আমরা এটাও আবিষ্কার করি যে সবসময়েই একটা গ্রহ ছিল। গ্রহের এই উন্মোচনের মধ্য দিয়ে একটা সত্য ভাগ্যাহতদের মধ্যে না থাকা নিয়ে বিশেষ আরাম দেয়। এই ভাইরাসের হাত ধরে এই গ্রহ উন্মোচিত হয়েছে। এমন কোন এইখান নেই যা ঐখান থেকে আলাদা হয়। ফাকা দূরত্বে থেকে অন্য অন্য শরীরে বল প্রয়োগ করার মত ঐখান এইখানকে প্রতিধ্বনি করে এবং ঐখানের সাথে নিষ্কৃতিহীনভাবে যুক্ত থাকে। আমরা আবিষ্কার করি যে জাতি-রাষ্ট্র সবসময়েই একটা প্রতিকী কল্প-কাহিনী ছিল। আমরা এটাও আবিষ্কার করি যে সবসময়েই একটা গ্রহ ছিল। গ্রহের এই উন্মোচনের মধ্য দিয়ে একটা সত্য আমরা নির্মাণ সম্ভব হয়ে ওঠে যা বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে একটা নির্মাণ সম্ভব হয়ে ওঠে যা বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে একটা তাদের এর বিরুদ্ধে দাড়িয়ে নির্মিত হয়না। আগন্তুকের মুখচ্ছবিতে নিজেদের দেখতে পারার সুযোগ এখন আমাদের আছে।


***


থ্যাচারের এই কথা তো বেশ মশহুর যে সমাজ অস্তিত্বশীল না, আছে শুধু ব্যক্তি মানুষ আর পরিবার। এটা অনেক দশক ধরে গোটা দুনিয়ার শাসন কাঠামোর দর্শন হয়ে আছে যা নিজেই একটা মারাত্মক ভাইরাস। এটাই অর্থনীতির দ্বারা সমাজকে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব করে তুলেছে। একটা ভাগাড় যেখানে কার্যকারিতা, ব্যবহারযোগ্যতা ও মুনাফারই একমাত্র দাম আছে। আমরা বেশ অনেকদিন ধরে কেয়ামত-উত্তর দুনিয়ায় বাস করছি। আমরা আছি একটা শূন্য মরুভূমিতে। এই ভাগাড়ের মূল্যবোধের নামে আমরা আমাদের মানবতার অঙ্গহানী করেছি। একটা গ্রহগত আমরা নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা সমাজ এবং অপরের সাথে আমাদের পরষ্পর নির্ভরশীলতা পুনরায় আবিষ্কার করি। সম্ভবত “অর্থনীতি” শব্দটাতে আমরা প্রাচীন ভাষা শোনা শুরু করতে পারি। সম্ভবত আমরা এই ভাগাড়ের শব্দটাকে নাজাত করতে পারি এবং স্মরণ করতে পারি যে এই শব্দটা হচ্ছে Oikos বা ঘরের (home)। আমরা এটা স্মরণ করতে পারি যে, Ecology(বাস্তুসংস্থান/প্রতিবেশ) আর Economics(অর্থনীতি) শব্দ দুইটির ধাতু একই। এই Oikos বা ঘর, এই বসবাস, ভাগাড়ের কার্যকারিতা, ব্যবহারযোগ্যতা ও মুনাফার মূল্যবোধ থেকে ভিন্ন ধরনের মূল্যবোধ দাবি করে।


***


আমরা কি একটা দুঃস্বপ্নের ভেতরে আছি, না আমরা একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর থেকে কথা বলছি? অনেকের মতই আমি স্বপ্ন দেখেছি যে আমি স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছি। সুতরাং সম্ভবত আমরা একটা দুঃস্বপ্নের ভেতরের একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছি। এই যে ঘরবন্দী হয়ে বসে আছি, সম্ভবত আমরা ভাবছি যে ঐ দুনিয়া যা আমার সামনে ছিল সেখানে আমি কি করছিলাম এবং কেনইবা আমি আমার জীবনকে ওরকমটা হতে দিয়েছি আর কেনইবা আমি এইভাবে কাজ করেছি।ব্যাপারটা এমন যেন এই ভাইরাসটা একটা অনিচ্ছাকৃত সাধারণ আঘাত হেনেছে। একটা নেতৃহীন (acephalous) সাধারণ আক্রমণ। আমি ভাবি, আমরা কি আর ফিরে যেতে পারবো? আগে যেমন করে যেতাম সেরকম করে নিশ্চিতভাবেই না।


***


অতীতের সংকটের মত করে বিজনপ্রদেশকে(wilderness) সবসময়ে দেখা হয়েছে অন্য কোনখানে। বিজনপ্রদেশকে এমন ভাবে দেখা হয়েছে যা শহর, নগর, বা সভ্যতা নয়। এই কারণে প্রকৃতি ও তার বস্তুতাকে (materiality) সংস্কৃতির অপর হিসেবে ভাবা সম্ভব হয়েছে। প্রকৃতি ছিল সংস্কৃতির তারা। এবং কার্যতই, সংস্কৃতি/প্রকৃতি, আকার/বস্তু, মন/দেহ, বুদ্ধি/ইন্দ্রিয়কে ঘিরে একটা আস্ত বাইনারি সিরিজ বিজনপ্রদেশ স্থানিকভাবে অন্যকোথাও এই চিন্তাকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে। বস্তুগত ধরণকে সবসময়েই নিম্নবর্গ এবং পতিত হিসেবে দেখা হয়েছে, যেখানে বোদ্ধিক ধরণকে সবসময়েই উচু মানের বিবেচনা করা হয়েছে। পেশাগুলিকেও উচ্চক্রমে বস্তুতার সাথে কতখানি সম্পৃক্ত তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে। যেই কাজের সাথে বস্তুতার সম্পর্ক সবচাইতে কম তার মূল্য সবচেয়ে বেশি। [সেইন্ট] অগাস্টিন, অথবা [সেইন্ট] একুইনাস ও হতে পারে যার মতে, উদাহরণস্বরূপ, চিত্রকলার থেকে সংগীত উচুমানের শিল্প কারণ সংগীত স্পিরিট অথবা বিশুদ্ধ চিন্তার অধিক নিকটবর্তী। সন্দেহাতীতভাবে, বস্তুতা নিয়ে আমাদের অস্বস্তি বস্তুতার অবাধ্যতা ও তার সাথে এটা যেরকম করে আমাদের আধিপত্য থেকে বের হয়ে যায় তার সাথে সম্পৃক্ত। যারা বস্তু নিয়ে কাজ করে তাঁরা জানে যে যেরকম করে পরিকল্পনা (form) করা হয়েছিল সেরকমটা কখনোই ঘটেনা। অ্যাডর্নো যেরকম দেখাচ্ছেন, বস্তু এমন একটা বিষয়ের ধারণা যা নিজে কোন ধারণা না। এটা সেই জিনিস যা আকারের অ্যাপোলনীয় নির্মলতা থেকে বেরিয়ে যায়। এটা তার বদলে আমাদের সসীমতা ও নশ্বরতার সাথে যুক্ত। বস্তুতে আমরা কেবল আমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার মুখোমুখিই হই না, আমরা নশ্বরতাকে বিজড়িত সত্তারূপেও দেখতে পাই । যদিও একটা প্যারাডক্সের মত, যেকোন কিছু করার ক্ষমতার শর্ত হিসেবেও এই বস্তুর মুখোমুখি আমরা হই। একটা আস্ত চিন্তা প্রকৃয়া, চিন্তার কাঠামো একটা ফ্যান্টাসি হিসেবে হাজির হয় যা আমাদের শরীর এবং বস্তর সম্পৃক্ততা থেকে পালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। পৃথিবীকে আমাদের যথেচ্ছা ব্যবহারের পেছনেও সম্ভবত এরকম কিছু একটা আছে। সম্ভবত, আমরা এত নির্মমভাবে পৃথিবীকে ব্যবহার করি শুধুমাত্র মুনাফার সীমাহীন ক্ষুধার জন্যই না, বরং আমাদের নিজেদের শরীর আর নৈতিকতার বিরুদ্ধে আমাদের চরম ক্ষোভের কারণে আমরা এমনটা করি।


***


এই ভাইরাসের সিলায় আমরা আবিষ্কার করি যে বিজনপ্রদেশ অন্য কোথাও না, বরং যা আছে তার পুরোটাই বিজনপ্রদেশ। শহর, নগর, আর সভ্যতার কেন্দ্রে আছে এক অবাধ্যতা এবং এক গর্জনরত প্রকৃতি, একটা বিজনপ্রদেশ। বিজনপ্রদেশেই শহর আর শহরেই বিজনপ্রদেশ রয়েছে। আর বিজনপ্রদেশের এই আবিষ্কারের মধ্য আমরা দিয়ে গ্রহগত এক পরষ্পর সম্পৃক্ততার মুখোমুখি দাঁড়াই। এটা বস্তুতা ও আমাদের দেহ-বিজড়িততার সাথে আমাদের সম্বন্ধ নিয়ে পুনঃভাবনা দাবি করে।


______________

৩রা এপ্রিল, ২০২০


সংযুক্তি


[i] গ্রাহাম হারমানের অবজেক্ট-ওরিয়েন্টেড ফিলোসফি নিয়ে জানতে দেখুনঃ গ্রাহাম হারমান ও অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজিঃ (উত্তর)আধুনিকতা থেকে প্রস্থান

[ii] হাইডেগারের বিখ্যাত হাতুরীর উদাহরণ এবং “ready-to-hand”, “present-at-hand” ইত্যাদি হাইডেগারীয় পরিভাষা নিয়ে বিস্তারিত ধারণা পেতে ব্রিটিশ দার্শনিক ব্রায়ান ম্যাজির টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের বাংলা অনুবাদ দেখা যেতে পারে। হুসার্ল, হাইডেগার ও আধুনিক অস্তিত্ববাদ – ১



প্রথম প্রকাশঃ ৮ই জুন, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৮ই জুন, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/376436520381889/