উহানের ডায়েরী

আই শিয়াওমিং


[আই শিয়াওমিং(AI XiaomingAI Xiaoming) চীনা ডক্যুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাতা ও রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট। প্রায় দুই ডজনেরও অধিক ফিল্ম বানিয়েছেন। ১৯৯৪ সালে গুয়াংজু শহরে অবস্থিত সান ইয়াৎ-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা সাহিত্যের অধ্যাপক হন, women’s studies and literature পড়াতেন। নিউ লেফট রিভিয়্যু পত্রিকার চলতি সংখ্যায় (মার্চ-এপ্রিল, ২০২০) তাঁর Wuhan Diary লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। মূলত, ‘ম্যাটারস’ ওয়েবসাইটে অডিও-ফটোগ্রাফ-পদ্য-গদ্যে প্রকাশিত দিনলিপির একটি সিরিজ পোস্ট থেকে এই লেখাটি নেয়া হয়েছে। শিয়াওমিং-এর লেখাটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ শাহিন। শাহিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]


নিউ লেফট রিভিয়্যু প্রদত্ত ভূমিকা


গত জানুয়ারি মাসে, বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে নববর্ষ [চাঁদের উপর নির্ভর করে প্রতিবছর জানুয়ারির শেষের দিকে বা ফেব্রুয়ারীর প্রথমদিকে পালিত চীনাদের নববর্ষ]*** উদযাপন করতে নিজ শহর উহানে ফিরে আসেন ডক্যুমেন্টারি নির্মাতা এবং লিঙ্গীয়সম্পর্ক-অধ্যয়ন বিষয়ক পণ্ডিত গত জানুয়ারি মাসে, বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে নববর্ষ [চাঁদের উপর নির্ভর করে প্রতিবছর জানুয়ারির শেষের দিকে বা ফেব্রুয়ারীর প্রথমদিকে পালিত চীনাদের নববর্ষ]*** উদযাপন করতে নিজ শহর উহানে ফিরে আসেন ডক্যুমেন্টারি নির্মাতা এবং লিঙ্গীয়সম্পর্ক-অধ্যয়ন বিষয়ক পণ্ডিত আই শিয়াওমিং। করোনাভাইরাসের লকডাউন চলাকালে, তিনি অডিও-ফটোগ্রাফ-পদ্য-গদ্যে দিনলিপির একটি সিরিজ পোস্ট করেন ‘ম্যাটারস’ ওয়েবসাইটে। এছাড়াও সম্পূর্ণভাবে টেলিফোন মেসেজ দিয়ে লেখা এবং উঁচু দালানের খোপ খোপ ঘরের ছবি সম্বলিত একটি নাটকের স্ক্রিপ্টও পোস্ট করেন। এখানে আমরা তাঁর প্রথম লেখার অংশবিশেষ প্রকাশ করছি।

উহানের দিনলিপি

জানুয়ারির ১৬ তারিখে আমি গুয়াংজু থেকে উহানে ফিরে আসি। এরই মধ্যে এক ভাইরাসঘটিত জ্বর বা এরকম কিছু একটার কথা শুনতে পাই। কিন্তু সেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিই এই ভেবে যে, সময়টা যাইহোক শীতকাল এবং কোন শীতকাল-ই [উহানে] এরকম ভাইরাসঘটিত জ্বর ছাড়া কাঁটেনি। পরদিন আমাকে আমার বয়স্ক বাবার দেখাশোনার জন্য একজন নতুন লোক খুঁজতে বের হতে হয়। কেননা পুরনো যেই লোক বাবার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি তাঁর নিজ-শহরে ফিরে যাচ্ছিলেন। তাই, সেসম্পর্কে খোঁজ নিতে ১৭ ও ১৮ তারিখে আমি কয়েকবার হাসপাতালে আসা-যাওয়া করি। কিন্তু সেখানে অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়েনি। যদি ঐ-সময়ে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আঁচ করতে পারতাম, হয়তো আমি সেখানে যাওয়ার সাহসও করতাম না।


১৯শে জানুয়ারিতে, সান্ধ্যভোজের নিমন্ত্রণে বাসায় আমার এক বান্ধবী আসে। সে তখন হাংকৌ শহরে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে যা শুনেছে তা আমাকে জানায়। সে আমাকে কিছু ছবি দেখিয়ে বলে যে, কিছু স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন এবং আক্রান্ত রোগীদের ICU(Intensive Care Unit, নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র)-তে ভর্তি করা হয়েছে, যেখানে একটা জীবন বাঁচাতে দিন-প্রতি খরচ অনেক বেশি৷ তখন পর্যন্ত বিষয়টাকে আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি।জানুয়ারির ২০ তারিখে পরিস্থিতি পাল্টাতে লাগলো। যখন হঠাৎ করেই করোনাভাইরাস চারিদিক কব্জা করে ফেলে। তিন দিন পরে, শহরটাকে লকডাউন করে দেয়া হয়—অপরিমেয় বিপর্যয়ের তিনটি দিন!


উহান রেলওয়ে স্টেশনে যানবাহন সব যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। শহরের বাসিন্দারা যেন [মহামারী সম্পর্কিত] প্রতিদিনকার [সত্য-অসত্য] তথ্যের স্রোতে হাবুডাবু খাচ্ছিলেন। আচমকাই মহামারীটি ভীতিকর, বজ্রসম এবং বিভ্রান্তিকররূপে হাজির হয়। বাবার জন্যে একেবারেই প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পণ্য—যেমন: কটনবাড, গ্লিসারিন এনিমা, সংক্রামক-জীবাণুনাশক, রাবিং অ্যালকোহল[স্যানিটাইজার] ইত্যাদি—কিনতে সবার মত আমিও ফার্মেসীতে দৌঁড়ঝাপ করলাম। ডাক্তারের পরামর্শের ঔষধপত্র শুধু হাসপাতালেই পাওয়া যাচ্ছিলো। আমি কোনরকমে কয়েক বোতল জীবাণুনাশক কিনতে সমর্থ্য হই। কিন্তু রাবিং অ্যালকোহল ১০০ মিলি’র ছোট বোতলে শুধু পাওয়া যাচ্ছিলো। ৫০০ মিলি’র কোন বোতলই পাওয়া যাচ্ছিলো না। কিছু ঔষধের দোকানে মাস্ক একেবারেই শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে যারা মজুদ করে রেখেছিল, তারা সেগুলোর দাম ১২ ইউয়ান[চীনামুদ্রা] থেকে ১৬ ইউয়ানে বাড়িয়ে দেয়। এমনকি এখন একটি সাধারণ সূতির মাস্কের দাম ১৬ ইউয়ান। সার্জিক্যাল মাস্ক একদমই পাওয়া যাচ্ছিলো না। N95উহান রেলওয়ে স্টেশনে যানবাহন সব যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। শহরের বাসিন্দারা যেন [মহামারী সম্পর্কিত] প্রতিদিনকার [সত্য-অসত্য] তথ্যের স্রোতে হাবুডাবু খাচ্ছিলেন। আচমকাই মহামারীটি ভীতিকর, বজ্রসম এবং বিভ্রান্তিকররূপে হাজির হয়। বাবার জন্যে একেবারেই প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পণ্য—যেমন: কটনবাড, গ্লিসারিন এনিমা, সংক্রামক-জীবাণুনাশক, রাবিং অ্যালকোহল[স্যানিটাইজার] ইত্যাদি—কিনতে সবার মত আমিও ফার্মেসীতে দৌঁড়ঝাপ করলাম। ডাক্তারের পরামর্শের ঔষধপত্র শুধু হাসপাতালেই পাওয়া যাচ্ছিলো। আমি কোনরকমে কয়েক বোতল জীবাণুনাশক কিনতে সমর্থ্য হই। কিন্তু রাবিং অ্যালকোহল ১০০ মিলি’র ছোট বোতলে শুধু পাওয়া যাচ্ছিলো। ৫০০ মিলি’র কোন বোতলই পাওয়া যাচ্ছিলো না। কিছু ঔষধের দোকানে মাস্ক একেবারেই শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে যারা মজুদ করে রেখেছিল, তারা সেগুলোর দাম ১২ ইউয়ান[চীনামুদ্রা] থেকে ১৬ ইউয়ানে বাড়িয়ে দেয়। এমনকি এখন একটি সাধারণ সূতির মাস্কের দাম ১৬ ইউয়ান। সার্জিক্যাল মাস্ক একদমই পাওয়া যাচ্ছিলো না। N95মাস্কের মাস্কের [i] যে এত বাহারি ধরন আছে আমি তখন তা জানতে পেরেছিলাম।


জীবাণুনাশক দিয়ে পুরো ঘরদোর আমি পরিষ্কার করি। এদিকে নতুন চান্দ্রবর্ষ আসার যখন ঠিক দুইদিন বাকী, তখন কোন ধরনের লোকসমাগম ও ভোজসভার আয়োজন করা যাবে না—এমন খবর এসে আমাকে ধাক্কা দিল। গুজবগুলো ভয়াবহ শুনাতে শুরু করে। ২৩ তারিখের লকডাউন ঘোষণা থেকে ২৫ তারিখ(নতুন বছরের পয়লা দিন), বছরটা এমন অদ্ভুতভাবে শুরু হলো যে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। মহামারীটি সম্পর্কে কোন সচেতনতা ছাড়াই হাসপাতাল থেকে [বাবার] দেখাশোনা করার জন্য সেবিকা নিয়ে আসায়, সেই ঝুঁকি আমাকে ভাবাচ্ছিলো। আরও চিন্তা লাগছিল, ধরুন, সে [সেবিকা] যদি সংক্রমিত হয়ে থাকে তা হলে কিইনা বিপদে পড়তে হয়! পুরো জিনিসটাই কেমন গোলমেলে অবস্থায় ছিল।


*


জানুয়ারির ২৯ তারিখে আমি একটি স্বেচ্ছাসেবী দলে যোগ দিই। দলটি পনেরটি গাড়িতে করে ২১টি হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ছয় হাজার সেট ব্যক্তিগত সুরক্ষাসরঞ্জাম (পিপিই) পৌঁছে দেয়। সে সম্পর্কে খবরা-খবর রাখতে দলটির সমন্বয়কারী গ্রুপের প্রায় ১০ থেকে ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজর রাখছিলেন। এমনকি তাঁদের খাওয়ার সময়টায়ও নজর রাখা বাদ যায়নি। তাঁদের একজন [সমন্বয়কারী গ্রুপের] ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁর কাছে দুই হাজার সেট পিপিই ছিল। তৎক্ষণাৎ সেগুলোর অর্ডার চলে আসে এবং টাকাও পরিশোধ করে দেয়। সেইসাথে অনুদান হিসেবে আশি হাজার ইউয়ানও আসে। উহানে পিপিই গ্রহণ এবং হাসপাতালের সাথে যোগাযোগের দায়-দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবী দলটির উপরই ছিল। পিপিই গ্রহণ করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি কাউকে পাঠাতে না পারে, তাহলে স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেরাই সেগুলো পৌঁছে দিত। স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। উহানে বসবাসরত ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের চারশোরও বেশি গ্র্যাজুয়েট নিয়ে তৈরী চ্যাটগ্রুপের তিনিও এক সদস্য। নতুন বছরের আগে যখন তারা [করোনাভাইরাসের] খবরটি শুনতে পান, তারা কিছু করার জন্য উদ্যোগী হন এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেন। তারা ছয় লাখ ইউয়ানেরও বেশি অনুদান তোলেন। তখন অনেক হাসপাতাল জনগণের কাছ থেকে অনুদানের জন্য আবেদন করে আসছিল। ফুদানের সেই গ্র্যাজুয়েটরা জরুরি সরঞ্জামাদি জুটাতে তাদের চেনাজানা জায়গায় খোঁজ শুরু করেন। যখন কেউ একজন জানতে পারল যে, কাউন্টি-পর্যায়েরজানুয়ারির ২৯ তারিখে আমি একটি স্বেচ্ছাসেবী দলে যোগ দিই। দলটি পনেরটি গাড়িতে করে ২১টি হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ছয় হাজার সেট ব্যক্তিগত সুরক্ষাসরঞ্জাম (পিপিই) পৌঁছে দেয়। সে সম্পর্কে খবরা-খবর রাখতে দলটির সমন্বয়কারী গ্রুপের প্রায় ১০ থেকে ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজর রাখছিলেন। এমনকি তাঁদের খাওয়ার সময়টায়ও নজর রাখা বাদ যায়নি। তাঁদের একজন [সমন্বয়কারী গ্রুপের] ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁর কাছে দুই হাজার সেট পিপিই ছিল। তৎক্ষণাৎ সেগুলোর অর্ডার চলে আসে এবং টাকাও পরিশোধ করে দেয়। সেইসাথে অনুদান হিসেবে আশি হাজার ইউয়ানও আসে। উহানে পিপিই গ্রহণ এবং হাসপাতালের সাথে যোগাযোগের দায়-দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবী দলটির উপরই ছিল। পিপিই গ্রহণ করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি কাউকে পাঠাতে না পারে, তাহলে স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেরাই সেগুলো পৌঁছে দিত। স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। উহানে বসবাসরত ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের চারশোরও বেশি গ্র্যাজুয়েট নিয়ে তৈরী চ্যাটগ্রুপের তিনিও এক সদস্য। নতুন বছরের আগে যখন তারা [করোনাভাইরাসের] খবরটি শুনতে পান, তারা কিছু করার জন্য উদ্যোগী হন এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেন। তারা ছয় লাখ ইউয়ানেরও বেশি অনুদান তোলেন। তখন অনেক হাসপাতাল জনগণের কাছ থেকে অনুদানের জন্য আবেদন করে আসছিল। ফুদানের সেই গ্র্যাজুয়েটরা জরুরি সরঞ্জামাদি জুটাতে তাদের চেনাজানা জায়গায় খোঁজ শুরু করেন। যখন কেউ একজন জানতে পারল যে, কাউন্টি-পর্যায়ের[ii] এক সেলাইবিহীন-কাপড় বিক্রেতা তখনও পিপিই মজুদ করে রেখেছে, উহানে আসার আগেই তাঁরা গাড়ি করে গিয়ে সেগুলো নগদে কিনে ফেলে। এদিকে দাতারা যেসব হাসপাতালে অনুদান দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাতেন, অন্য স্বেচ্ছাসেবীরা সেসব হাসপাতালেই পৌঁছে দিত। ধরুন, আমি যদি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট হতাম এবং জানতে পারতাম যে সুরক্ষা সরঞ্জামের অপ্রতুলতায় আছে এমন কোন হাসপাতালের জন্যে আমার পরিচিত কোন গ্র্যাজুয়েট কাজ করছে, তাহলে আমি অনুরোধ করব যাতে আমার অনুদান ঐ-নির্দিষ্ট হাসপাতালেই যেন পৌঁছে দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবীদেরকে সুরক্ষা সরঞ্জামটি ঐ-হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হত।


আসলে আমাকে তাঁরা [স্বেচ্ছাসেবী দল] সঙ্গে নিতে চায়নি। আমি তাঁদের সাথে যোগ দিই কেননা আমি পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে চাচ্ছিলাম এবং একইসাথে আমার কিছু করার তাড়নাও বোধ হচ্ছিল। কিন্তু তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা আমাকে ‘মাফ করবেন, দাদি’ বলে পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলেন। নিজেকে গুরত্বের সাথে তুলে ধরতে আমাকে সেই শাদা গাউন[পিপিই] গায়ে জড়াতে হয়েছিল।


*


যেহেতু আমার পরিবার ও প্রতিবেশিদের প্রতিও আমার একটা দায় রয়ে যায়, সেহেতু চিত্রগ্রহণ আর সাক্ষাৎকার গ্রহণের দিকে যাওয়াটা মুশকিলের হয়ে দাঁড়াবে। যতক্ষণ না বাড়ির সীমানার বাইরে যাচ্ছি সে অব্দি আমি পিপিই পরার অপেক্ষায় থাকি। আবার দিন শেষে, সীমানায় প্রবেশের আগে সেটা খুলে রাখি। কেননা প্রতিবেশিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি না করাটাই বরং ভালো। যে-হাসপাতালে সংক্রামক-রোগের চিকিৎসা হয় এবং সেখানে আপনি গিয়েছিলেন, এই খবর যদি আপনার আশেপাশের লোকেরা জানে তাহলে আপনি ভাইরাসটি নিয়ে আসবেন ভেবে তাঁরা উদ্বিগ্ন হবে। এখন অনেক হাসপাতালই [স্বেচ্ছাসেবী] সাহায্য চেয়ে আবেদন জানাচ্ছে, কিন্তু কেউ-ই যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে কে সাড়া দিবে? যেখানে সরকার প্রত্যেককেই ঘরে থাকতে বলছে, সেখানে এই মুহূর্তে স্বেচ্ছাসেবা দেয়াটা সহজ নয়। তাছাড়া স্বেচ্ছাসেবীদের বেশিরভাগই তরুণ, তাঁদের নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থে পরিবার থেকে তাঁরা নিরুৎসাহিত হতে পারে। স্বেচ্ছাসেবীদের দলগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট এবং ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না গোছের, তাঁরা অগ্রভাগের যোদ্ধাদের কাছে হাজার-হাজার সেট সুরক্ষা-পোশাক পৌঁছে দেয়ার সামর্থ্য রাখে। জরুরি ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।


গতকাল শুনতে পেলাম, কিছু হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সরা সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাবে ওয়ার্ডগুলোতে চিকিৎসা দিতে পারছেন না। তাই আজ আমরা হাসপাতালগুলোতে পিপিই পৌঁছে দিতে চলে যাই। প্রতি বাক্সে ২৫টি করে আমরা বিশটি বাক্স, মানে মোট ৫০০টি পিপিই, পৌঁছে দিই। তাঁর মধ্যে একটি দেয়া হয় এমন একজনকে যার সুরক্ষা-পোশাক মোটেও ছিলনা। অথচ আমরা যে হাসপাতালগুলোতে গিয়েছিলাম সেগুলোতে [করোনাভাইরাসের] তীব্র উপসর্গে ভোগা রোগীদের চিকিৎসা চলছিল। আমরা একটা কমিউনিটি সেন্টারেও দুই বাক্স [পিপিই] দিয়ে আসি।


আমাদের প্রথম ডেলিভারি ছিল শহর-পর্যায়ের একটি হাসপাতালে। একজন পরিচালক পিপিই’গুলো চেক করতে বাইরে আসেন এবং গ্রহণ করেন। যখন আমরা কমিউনিটি সেন্টারে গেলাম, অভ্যর্থনায় জন্য বসা তরুণী আমাদের জানান যে, ত্রিশজনেরও বেশি কর্মী তাঁদের হাসপাতালে কাজ করছেন যারা নতুন বছরের শুরু থেকে তখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ছুটি নেননি। তাঁদের হাতে আর মাত্র পঞ্চাশটি পিপিই বাকী ছিল। আমরা আরও পঞ্চাশটি তাঁদের দিয়ে আসি। সেই তরুণী, যিনি রশিদে স্বাক্ষর করেন একখানা মাস্ক ছাড়া তাঁর কোন সুরক্ষা-পোশাক ছিলনা। তিনি জানান, সুরক্ষা-পোশাক ডাক্তার ও নার্সদের জন্য বরাদ্দ ছিল যাদের কিনা ওয়ার্ডগুলোতে কাজ করতে হত। [ব্যবহৃত] পিপিই’গুলো আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির সাহায্যে পরিষ্কার করা হবে এবং পুনরায় ব্যবহার করা হবে। এটা শুনে আমরা তব্দা খেয়ে গিয়েছিলাম।


আমাদের মজুদের অ্যালকোহল ও মাস্ক ফুরিয়ে যাবার পথে। প্রতি দিনশেষে আমার পিপিই’টা ওয়াশিং মেশিনে পরিষ্কার করি, জীবাণুনাশক স্প্রে করি এবং রেডিয়টরে শুকাতে দিই। আবার পরার আগে অ্যালকোহল স্প্রে করে নিই। আমার কাছে থাকা অ্যালকোহল ফুরিয়ে গেছে। তাই আরও দুই বোতল অ্যালকোহল(যেটা কিনা রেশনের মাধ্যমে দেয়া অনুমোদিত সর্বোচ্চ পরিমাণ) কিনতে আজ ফার্মেসীতে যেতে হয়ে হয়েছিল। আমরা নতুন পিপিই চাইতে পারিনা এবং চাইবও না। কেননা যারা হাসপাতালে কাজ করছেন, সেগুলোর জরুরত তাঁদেরও আছে। মাস্কের মজুদও শেষ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ধুলোবালি আটকাতে যে N95 মাস্ক ব্যবহার করা হয়, সেটাও দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। ফার্মেসীগুলো পুনরায় কিনে মজুদে আনা মাত্রই তড়িৎগতিতে সেগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। বাহিরে বেরোতে হলে N95 মাস্কের বাইরে ডিস্পোজেবল মাস্ক পরে বের হই। আমি আমার N95 মাস্ক বৈদ্যুতিক কেটলিতে সিদ্ধ করি এবং রেডিয়টরে শুকাই—কে জানি বলেছিল, উচ্চ তাপমাত্রায় ভাইরাসটি মারা যায়। খরচের কথাটাও চিন্তার বিষয় বৈকি। প্রতিটা N95 মাস্কের দাম পড়ে ২৫ ইউয়ান, যেটার মোট খরচ মাস শেষে দাঁড়ায় ৭৫০ ইউয়ান। এমনকি যদি ভাইরাসটি থেকে আপনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেনও, যাদের মাস্ক নেই আপনাকে তাঁদের সাথেও ওঠাবসা করতে হবে। আমি জানি, ডিস্পোজাল মাস্ক পরিষ্কার করে ব্যবহার করাটা হাস্যকর শোনায়, কিন্তু এছাড়া আর কোন উপায় নেই হাতে।


হাসপাতালগুলো নিরুপায় হয়ে সাধারণ জনগণের কাছে সাহায্য চাইতে হচ্ছে, এরকম খাদের কিনারায় যাওয়ার অবস্থা এদের কীভাবে হলো? ফাঁপা সমাজ-ব্যবস্থার ধ্বস আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। এত উচুমানের সরকারি ব্যয়ের সিলসিলা এবং প্রাচুর্যপূর্ণ বৈশ্বিক আমদানি-রপ্তানি প্রবাহ থাকার পরও এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, আমাদের হাসপাতালগুলো মাস্ক আর পিপিই-এর অপ্রতুলতায় ভুগছে এবং সাহায্যের জন্য হাত বাড়াচ্ছে। এ-বিষয়টা সত্যিই আমাকে স্তম্ভিত করে দেয়। যদি পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর, ল্যাবরেটরি অথবা ভাইরাসের কোন নিরাময় না থাকত সেটা বরং মেনে নেয়া যেত। কিন্তু কীভাবে হাসপাতালগুলো পর্যাপ্ত মাস্ক, সুরক্ষা-পোশাক আর জীবাণুনাশক নিয়ে এই মাত্রায় অপ্রস্তুত থাকে যে একটা মহামারী মোকাবেলায় তারা সমর্থ থাকেনা? আমার বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এত ঠুনকো আর দুর্বল হতে পারে! আমাদের মেডিকেল সরঞ্জামাদিও যে এত অপ্রতুল হবে সেটা চিন্তাও করিনি। এমতাবস্থায়, জনসাধারণের জীবন ও নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে?


যদি এই লকডাউন চলমান থাকে, সামনের দিনগুলোতে আরও মুশকিল দেখা দিতে পারে, কেননা জিনিসপাতি দিন দিন অপ্রতুল হতেই আছে। প্রতিদিনকার জীবন-জীবিকা রেহাই পাবেনা। তাছাড়া বয়স্কদের ঔষধপত্র যোগান দেয়াটা কঠিন হয়ে পড়বে, আর কে জানে হাসপাতালগুলো চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবে কিনা! যদি মাস্ক না পাওয়া যায় এবং সরঞ্জামাদির সুষম বণ্টন না হয়, তাহলে আসন্ন ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করাটাও কঠিন হবে বৈকি।


ঘরে পোষা বিড়ালের খাবার ফুরিয়ে গেছে আর অনলাইনে অর্ডার করা জিনিসপাতি এখনও আসেনি। আমরা এখন বড়জোড় যা করতে পারি, সেটা হলো—কোনরকম একটা ভারসাম্য বজায় রাখা।


*


সমস্যা ও সংকটগুলোকে আতঙ্ক খোদ মহামারীটি থেকেও বেশী ভয়াবহ করে তুলছে। কেননা এটার ফলে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিনতার জন্ম দিচ্ছে এবং স্বার্থপরতা উগড়ে দিচ্ছে, যেটা কিনা খুব দ্রুত এবং বিশালাকারে ছড়িয়ে পড়ছে। নীচতা, আত্মসুরক্ষা এবং প্রতিবেশীর সাথে দুশমনের মত ব্যবহার করা আমরা দেখেছি। আতঙ্কে উস্কানি পাওয়া এই বর্বর মানসিকতা [সমাজকে] মানবিকতার সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেটা খোদ ভাইরাসটি থেকেও বেশি ক্ষতিকর।


প্রথম দিককার তথ্যের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ভাইরাসটি প্রাদুর্ভাব জোরদার করে তুলেছে। এরপর অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও সেগুলো জনসাধারণের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত ছিলনা, বরং আচমকাই শাটডাউন চাপিয়ে দেয়া হলো। জনগনকে মহামারীটি সম্পর্কে পরিষ্কার করা থেকে সরে এসে সরকার মেলামেশা-হাঁটা-চলার উপর নিষেধাজ্ঞা এবং সকল গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়াসহ শহর লকডাউন করার নীতি গ্রহণ করল। যেটার সাথে ভুলভাল তথ্যের সংমিশ্রণে ভয়াবহ রকম আতঙ্কের পয়দা হলো। চরম আতঙ্ক উগ্র সামাজিক প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে দিলো। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, প্রদেশের সাথে প্রদেশের, এবং গ্রামের সাথে গ্রামের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাতারই একটি উদাহরণ। এই মানসিকতা পরে পুনঃউৎপাদিত হয়। ‘গ্রামে প্রবেশ গ্রামবাসীকে হত্যার শামিল’— এ রকম স্লোগানগুলো মহামারী মানেই মৃত্যু এবং বিচ্ছিন্নতাতেই মুক্তির মত হিস্টিরিয়াগ্রস্থ পূর্বানুমানকে আরও মজবুত করে।


গতকাল একটা নিউজে দেখতে পেলাম, একজন বাবাকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। তাঁর বড় ছেলে গতকাল একটা নিউজে দেখতে পেলাম, একজন বাবাকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। তাঁর বড় ছেলে সেরিব্রাল প্যালসি [ii] রোগে ভুগছিল এবং তাঁকে ঘরে একা ফেলা রাখা হয়। কিছুদিন পর ছেলেটি মারা যায়। ছোট ছেলেটি, [করোনা] আক্রান্ত ছিলনা, তাঁকেও তাঁর বাবা ও অন্যান্য রোগীদের সাথে আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সতের বছর বয়সী ঐ ছেলেটির মৃত্যু একটা ইশারা মাত্র, ভবিষ্যতের ট্রাজেডির একটা ধরন সম্পর্কে সতর্ক করিয়ে দেয়, যেটা এই চরম বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতিতে ঘটতে পারে। সেরিব্রাল প্যালসি রোগে ভোগা একটা বাচ্চাকে কোন বিবেকে আমরা সম্পূর্ণ একা এবং অযত্নে ফেলে রাখতে পারি? উহান শহর এবং তার অধিবাসীদের যদি একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়, আমাদের প্রত্যেকেরই ঐ ছেলেটির অবস্থা হবে। আমাদেরকে স্রেফ ফেলে দেয়া হয়েছে, জোরপূর্বক চরম হতাশাগ্রস্ত উন্মাদ সময়ের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে, যেখান থেকে উত্তরণের পথ নেই এবং কেউ হাত বাড়িয়ে দেবার নেই। তত্ত্বমেনে অবশ্যই সেরকম অবস্থা নাও আসতে পারে। কিন্তু [মৃত] ছেলেটির অসহায়ত্ব একটি সতর্কবার্তা।


[বিপদের সময়] পরিত্যাগ এবং এমনকি ঘৃণা উদ্রেকের মানসিকতার গোড়ার কার্য-কারণের সন্ধান করতে আমাদের নিজেদেরকেই প্রশ্ন করতে হবে। আমরা কীভাবে এত নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং বর্বর হয়ে উঠলাম? মনে হচ্ছে, মহামারীটার মুখোমুখি হয়ে আমরা আমাদের বিচার-বিশ্লেষণ ও চিন্তাভাবনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা আদিম, অসভ্য ও অমানবিক মানসিকতায় ফিরে যাচ্ছি। আমরা কীভাবে এই [অবক্ষয়ের] পর্যায়ে এলাম?

আমাদের ভঙ্গুর সামাজিক মনস্তত্ব, ফাঁপা সমাজ-ব্যবস্থার এবং বাক-স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিবর্জিত শাসিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেহায়াপনাকে করোনা ভাইরাস আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এটা কোনভাবেই জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরতে পারেনা। করোনাভাইরাস আমাদের সিস্টেমের সমস্যাগুলোকে নগ্নভাবে চোখের সামনে তুলে ধরছে। সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণে আমাদেরকেই পথ খুঁজে নিতে হবে।


*


উহানেই আমার জম্ম এবং এই শহরের সাথে আমি আত্মার বন্ধন অনুভব করি। কিন্তু এমনও কিছু সময় গেছে যখন আমি নিজে নিজে ভেবেছি, ‘যারা উহানকে অভিশাপ দিয়েছেন, যারা উহানের বাসিন্দাদের নিজের ঘরে যেতে দেননি, যাদের দ্বারা আমরা নিগৃহীত হয়েছি, এই মহামারী শেষে আমাদের শহরে যখন ফাগুন আসবে তখনও কিন্তু আমাদের থেকে দূরে থাকবেন এবং আর কেউই আপনাদের পাতে গরম গরম ড্রাই-নুডলস পরিবেশন করবে না’। যাইহোক, সেটা অবশ্য মজা ছিল।


‘নয় প্রদেশের মিলনস্থল’ হিসেবে খ্যাত উহানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই শহর ১৯১১ সালের বিপ্লবের প্রথম স্ফুলিঙ্গের স্বাক্ষী। চীন-জাপানের যুদ্ধের সময়কালে এ শহর একটি প্রধান অবলম্বনও ছিল। নানজিং[চীনের পূর্ব-জিয়াংজু প্রদেশের রাজধানী]-এর পতনের পর জাতীয় সরকার উহানে আশ্রয় নেন এবং এখান থেকে একটি গুরুতর বিমান যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। সব ধরনের সামরিক অপারেশনগুলো হুবেই প্রদেশের গ্রন্থাগারের নীচতলা থেকে পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে জাতীয় সরকার চংচিং যাবার অব্দি এখানে এক বছরের মত অবস্থান করে। যুদ্ধকালে বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিজীবী এখানে অনেককাল ধরে আশ্রয়ে ছিলেন। উহানের রয়েছে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এবং রয়েছে চোখ জুড়ানো ইয়াংসি নদী।


স্বেছাসেবীদের প্রত্যেকেরই উহানের প্রতি গভীর মমতা রয়েছে। আমাদের বেড়ে ওঠা এখানেই এবং আমাদের জীবনাখ্যান এই শহরের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের কেউই এই মহামারীর আক্রমণের কাছে এ-শহরের হার মেনে নিতে পারবে না। না পারবে আমাদের উপর ছুড়ে দেয়া প্রবল অপমান সহ্য করতে, যখন লোকজন বলাবলি করে, ‘তোমাদের, উহানের জনগণদের, [এই ভাইরাসজনিত ক্ষতির জন্য] মূল্য চুকানো উচিৎ’ অথবা ‘অন্যের ক্ষতি করতে তোমাদের বাইরে আসা উচিৎ হয়নি’। কিছু গণমাধ্যমের রিপোর্ট এরকমও শোনায় যে, যদি আপনি উহান হয়ে আসেন বা উহানের অধিবাসী দেখে থাকেন, তো আপনিও ‘উহান নিউমোনিয়া’ আক্রান্ত হবেন। উহানের লোকদের ধাওয়া করা বা ঘেরাও করার মত হিংসাত্মক আচরণের কথা বাদ-ই দিলাম। ভাইরাসটিকে উহানের অধিবাসীদের সমতুল্য করা একটা ফইজত এবং সেটা এ-শহরের বাসিন্দাদের মর্যাদার লঙ্ঘন।


বেশি দিন আগের কথা না, মিলিটারি গেমটির [২০১৯ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত] প্রদর্শনীতে উহান শতকোটি টাকা ব্যয় করেছে। যথেষ্ট অবকাঠোমোগত উন্নয়নও সাধিত হয়েছে। তবুও এই সত্যটি হজম করতে বেশ কষ্ট হয়, যে-শহর এরকম একটি প্রদর্শনীর জন্য এত বেশি পরিমাণে অর্থব্যয় করতে পারে, সে-শহর তার হাসপাতালগুলোকে পর্যাপ্ত পিপিই দিয়ে প্রস্তুত রাখলো না!এই বৈপরীত্য আসলেই বড্ড নির্মম।


আশার কথা এইযে, তরুণ এই স্বেচ্ছাসেবীদের কাজ দেখে আমি সত্যি অভিভূত। তাঁরা সাধারণ জনগণ, যারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। খাদের কিনারা থেকে শহরটাকে বাঁচাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য নিজেদের নিরাপত্তা উৎসর্গ করে এই তরুণরা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এসব করতে গিয়ে যৌথতার মূল্যবোধের মাধ্যমে তাঁরা নিজের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, নতুন সামাজিক শক্তির বিনির্মাণে এটি একটি সুযোগ।


______________

পহেলা ফেব্রুয়ারী, ২০২০


*** অর্থ ও ভাবপ্রকাশের সুবিধার্থে তৃতীয় বন্ধনী “[ ]” যুক্ত কথাগুলো অনুবাদকের।

অনুবাদকের টীকা


[i] N95 মাস্ক—এই মাস্ক পার্টিকুলেট লেবেলে ৯৫ শতাংশ এয়ার ফিল্টারেশন করে। ভাইরাস মোকাবিলায় N95 মাস্কের ভূমিকা সার্জিকাল মাস্ক থেকে ভালো। সাধারণত রাসায়নিক কারখানা গুলোতে এই N95 মাস্কের ব্যবহার বেশি হয়।


[ii] কাউন্টি-পর্যায়/কাউন্টি শহর—চীনের একটি প্রশাসনিক ইউনিট। কাউন্টি-পর্যায়ের শহর বা কাউন্টি শহরের হাতে লোকাল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নেই, কিন্তু বিচারিক ক্ষমতা আছে এবং দ্বিতীয় ধাপের প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে শাসিত হয়।


[iii] সেরিব্রাল প্যালসি(cerebral palsy)—সেরিব্রাল প্যালসি মস্তিষ্কে ঘটিত এক ধরনের রোগ, বিকলাঙ্গতা। মস্তিষ্ক জনিত রোগ, তবে মানসিক রোগ না। এটা মানুষের স্বাভাবিক অঙ্গবিন্যাসকে প্রভাবিত করে এবং চলাচলের ও ভারসাম্য রক্ষার সক্ষমতাকে বিনষ্ট করে। সাধারণত মস্তিষ্কের যে অংশ পেশী নিয়ন্ত্রণ করে সে অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে অথবা অস্বাভাবিক মস্তিষ্কের বিকাশের ফলে এই রোগ হয়ে থাকে। কোন কোন সময় এর ফলে সংবেদীলতা, দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পারে।


প্রথম প্রকাশঃ ২১শে মে, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২১শে মে, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/828236257930888/