উদ্ঘাটন থেকে উদ্ভাসন

ওয়েন্ডি ব্রাউন


[করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে মার্কিন রাজনীতি-তাত্ত্বিক ওয়েন্ডি ব্রাউনের “From Exposure to Manifestation” লেখাটি ২০২০ সনের ১৪ই এপ্রিলে The Los Angeles Review of Books ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছিল। দার্শনিক, রাজনীতি-তাত্ত্বিক, শিল্পী ও নানান ধারার চিন্তক-ভাবুকদের চলমান মহামারী প্রসঙ্গে অনুভব-অভিব্যক্তি, বোঝাপড়া ও প্রতিক্রিয়ার সংকলন রূপে প্রকাশিত হওয়া The Quarantine Files: Thinkers in Self-Isolation-তে ওয়েন্ডি ব্রাউনের এই নিবন্ধটিও প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধটি তর্জমা করেছেন তানভীর আকন্দ। তানভীর আকন্দ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]


ক্ষমতার প্রয়োগ ও পরাভূত হওয়া

করোনাভাইরাস বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধিবন্দোবস্তকে একাধারে সক্রিয় করে, তার তীব্রতা বৃদ্ধি করে আবার একে পরাভূতও করে। বাসস্থান, স্বাস্থ্য, জ্ঞান, সহায়তা ও ভাইরাসের প্রকোপ প্রশমিত হওয়ার পর একটি সহনীয় জীবনযাত্রার অধিকারসহ সবরকমের বৈষম্যকেই এই ভাইরাস সক্রিয় করে তুলে। পুঁজিবাদ ও জাতিরাষ্ট্রসমূহের অসভ্য ও একরোখা ক্ষমতার হাতে সাজিয়ে তোলা একটি বিশ্বের মাঝে মানুষের বিদ্যমান অসহায়ত্বকে আরও বেশি তীব্র করে তুলেছে এটি। কিন্তু তারপরও একইসাথে এই ক্ষমতাগুলোর জীবনের চেয়ে সম্পদকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার যে দৈনন্দিন প্রবণতা তাকেও এটি সাময়িকভাবে পরাভূত করছে। আকস্মিকভাবেই এই প্রবণতা তার নিজস্ব লক্ষ্যপূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। কোন সদগুণের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং মহান এক জীবাণুই একে লক্ষ্যচ্যুত করে দিয়েছে। টাকা ও ক্ষমতার মাধ্যমে অর্জন করা কতিপয় (যদিও সবগুলোই নয়) সুরক্ষা আবার ভাইরাসের কারণে বাতিলও হয়ে যায়, এটা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছে জাতির ক্ষেত্রেও তাই। যতটা বৈষম্যমূলক বিধান আর ব্যবস্থাই চালু থাকুক না কেন, বিস্তৃত প্রতিবন্ধকতা ও পুলিশ দিয়ে ঘেরাও সীমান্ত পার হয়ে যেখানে জীবাণুরা এগিয়ে চলেছে সেখানে সুরক্ষিত নয় কেউই। সংক্রমণ ঠেকাতে, এর গতিবিধি রোধ করতে, ভ্রান্তি ও মোহের শাসনকে প্রতিহত করার জন্য, সামাজিক আনুকূল্য ও অস্বীকৃতির অবসানের জন্য প্রত্যেকের প্রত্যেককে প্রয়োজন। স্থবিরতা ও সংবরণ ব্যক্তির আত্ম-সুরক্ষার কোন উপায় নয়. বরং বিশ্বব্যাপীই একটি পারস্পরিক সামাজিক চুক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। টাকা দিয়ে এর বাইরে কোন বিশেষ সুবিধা কিনে নেয়ারও উপায় নেই। সামাজিক স্তরবিন্যাসের উচ্চকোটিতে যারা বাস করে তারাও নিজেদের জন্য ঠিক ততটাই বিপজ্জনক যতটা বিপদগ্রস্থ তারা নিম্নবর্গীয় মানুষদের দ্বারা, যাদের সস্তা শ্রমের উপরই আসলে তারা টিকে আছে। সর্বত্রই ভৃত্য প্রভুকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে।


সীমান্ত ধ্বসে পড়া

সমাজ, অর্থনীতি, জ্ঞান ও রাজনীতি থেকে এই ভাইরাসকে পৃথক করা অসম্ভব। শুধুমাত্র এই কারণেই নয় যে এটি বাজার ধ্বসিয়ে দিচ্ছে, ব্যবসাপাতি বন্ধ করে দিচ্ছে এবং কাজ ও আয়ের উৎস ধ্বংস করছে। এটি কেবল টিকে থাকার দুর্বৃত্ত শেকলের কারণেই নয়। সেই দুর্বৃত্ত শেকল যার অধীনে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে বীমা কোম্পানিগুলো যা কিনা কর্মসংস্থান এবং একক পরিবারের সাথে এক সূতায় গাঁথা; কর্মজীবী পিতামাতা সন্তানপালন ও সন্তানের পুষ্টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্কুলের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে; অপব্যয়ী খরচার অর্থনীতিতে চাকরির আয় দিয়ে বাসস্থানের ভাড়া মেটাতে হচ্ছে। আর এসব কিছুই আকস্মিকভাবে ছিনিয়ে নিয়েছে জীবাণু। করোনাভাইরাস নিছক জৈবিক বা স্বাস্থ্যগত বিষয় থেকেও বেশিকিছু, কেননা যা-কিছু মানবিক অভিজ্ঞতার বিষয় এবং যা-কিছু রূপায়িত হয়েছে ক্ষমতার দ্বারা, তার সবকিছুই মানুষের দ্বারা নির্মিত হয়েছে কিন্তু সেগুলো মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই্। আর সেই ক্ষমতা একইসাথে আমাদের টিকিয়ে রাখে এবং ধ্বংসও করে, আমাদের সংযুক্ত করে আবার বিচ্ছিন্নও করে দেয়, একত্র করে আবার স্তরে স্তরে বিভক্ত করে দেয়। ভাইরাসটির গতিবিধি একইসাথে বস্তুগত ও ডিস্কার্সিভ। এটি অপরিমেয় সামাজিক সহযোগিতা ও অসাধারণ রাজনৈতিক উদ্ভাবন, দক্ষতা বা বোকামির বিষয়। বিজ্ঞান, চেতনা ও দুঃখানুভূতি এবং যুক্তির বিষয়। বিশ্ব-নির্মাণ ও মানে-উৎপাদনের (meaning-making) যে প্রেক্ষাপট তার জটিলতা ও কেন্দ্রীভবনের থেকে এই ভাইরাস ও এর কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতিকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। আঁটসাঁট ও বিচ্ছিন্ন কোন একক শাস্ত্র থেকে উদ্ভূত জ্ঞান দিয়ে একে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। জনস্বাস্থ্যের বিদ্যায়তনিক পরিসরে এটা সবসময়ে জ্ঞাত বিষয় ছিল। কিন্তু এখন এমনকি অর্থনীতিবিদদের পক্ষেও সঠিক পথে সবকিছু ফিরিয়ে আনার জন্য কোন নিখুঁত মডেল অথবা বাজারের ভেলকি হাজির করে নিজের সুসজ্জিত কক্ষে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। “বাণিজ্যিক (financial)” ও “আসল” অর্থনীতি প্রতিদিনই তাদের আন্তঃসম্পর্ককে উন্মোচন করে চলেছে, পাশাপাশি উন্মোচন করে চলেছে সে সমস্ত অবস্থার উপর তাদের নির্ভরশীলতাকেও খোদ যাদেরকে তারা রুদ্ধ করে, প্রভাবিত ও বিপদগ্রস্ত করে তুলে। বাণিজ্যিক অর্থনীতির স্থিতিশীল পাটাতন প্রকৃত অর্থনীতিতে যেই ‘বিপরীত সংক্রমণ’র ঝুঁকি তৈরি করে তার ফলে সাময়িক অর্থনৈতিক পশ্চাদপসরণ (recession) থেকে মন্দার (depression) হুমকি তৈরি হয়। ভাইরাসের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার মানে হচ্ছে একই সাথে অর্থ ও উৎপাদন, মানব ও অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য, উভয়েরই মানসিক ও শারীরিক অবস্থার রাজনৈতিক ব্যপস্থাপনা।


উন্মোচন

অনেকেই করোনা ভাইরাসকে দেখছে সীমানাবেষ্টিত জাতি, ঘর, পরিবার বা নিজের মধ্যে প্রবলভাবে গুটিয়ে যাওয়া হিসেবে। কার্যত, বিশ্বব্যাপী মেডিকেল গবেষকদের মধ্যে নজিরবিহীন এক পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্ভব ঘটিয়ে, হাজার হাজার ছোট ছোট পারস্পরিক সহযোগিতামূলক গোষ্ঠীগুলোকে উদ্ভুদ্ধ করার মাধ্যমে, ব্যাংকগুলোকে ঋণ সংগ্রহ ও দণ্ডমূলক ক্রেডিট রেটিং বাতিলে বাধ্য করে, নয়া-উদারবাদী রাষ্ট্রগুলোকে মাথাপিছু আয়ের বন্দোবস্ত করতে বাধ্য করে, কারগারগুলোকে কয়েদিদের ছেড়ে দিতে বাধ্য করে, সর্বত্রই আকড়ে ধরে রাখার বদলে ভাগ করে দেয়া, বিনিময়ের বদলে বিলিয়ে দেয়া, জনগণকে বর্জনের বদলে আশ্রয় প্রদানের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে এটি আমাদের ভেতর-বাহির উলট-পালট করে দিয়েছে। সর্বোপরি করোনাভাইরাস বিস্তৃতভাবেই বিন্যস্ত ও অপরিহার্য এক যত্নবান অর্থনীতিকেই (care economy) সামনে তুলে এনেছে। তুলে ধরেছে অনাবশ্যকভাবে অতিরিক্ত পুঁজিবাদী নিষ্কাশন ও উৎপাদনের বিশ্বাসঘাতকতা ও লুটপাটের আসল চেহারাকে। এটি মূলত স্বাস্থ্যকর্মী, খামারকর্মী, খাদ্যকর্মী, ফার্মাসিস্ট, পরিচ্ছনতাকর্মী, মুদিদোকানের কর্মচারী, ট্রাকচালক, মিস্ত্রী ও ইলেকট্রিশিয়ান, গৃহপরিচারক, অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণকর্মী, গণপরিবাহনের চালক, সমাজকর্মী, শিক্ষক এবং সবরকমের সেবাপ্রদানকারী ব্যক্তির গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। যারা মূলত নিম্নআয়ের, অবমূল্যায়িত এবং যাদের মধ্যে রয়েছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অনুপাতে অশ্বেতাঙ্গ ও নারী। অবসন্ন স্বাস্থ্যকর্মীরা যেখানে দেহকে বাঁচিয়ে রাখে, সেখানে সৃজনশীলেরা — সঙ্গীতকার, শিল্পী, কবি ও গল্পকথকেরা আত্মাকে উজ্জীবিত ও প্রশমিত করে। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখকেরা আবিষ্কার, চলার পথ এবং অজানাকে তর্জমা করে নিয়ে আসে; সুযোগ্য সাংবাদিকেরা গুজব ও ষড়যন্ত্রকে দূরে সরিয়ে রাখে, নতুন নীতিমালাগুলোকে ব্যাখ্যা করে, মৃতের সংখ্যা ও নাম প্রকাশ করে। বারিস্তা (কফিশপের কর্মী) ও বারটেন্ডারদের আমাদের মনে পড়ে অবশ্যই, মনে পড়ে পাহাড়াদার ও খেলোয়ারদের। আমরা তাদের শূন্যতা অনুভব করি। কিন্তু মহামারীপীড়িত বিশ্ব যেসব বিষয়ের অভাব একদমই বোধ করে না সেগুলো হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার, কর্পোরেট ইভেন্ট প্ল্যানার, ব্যবসায়ী, বিক্রয় ও বিপণন বিশেষজ্ঞ, বীমা ব্যপস্থাপক, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার, আইনজীবী অথবা ইনফ্লুয়েন্সার নামের সেইসব গর্ভস্রাবদের কাজকর্ম। বেশিরভাগ পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদনেরও অভাব আমরা বোধ করছি না। আমাদের দরকার অসুস্থদের জন্য ভ্যান্টিলেটর, সক্রিয় কর্মীদের জন্য পিপিই এবং বাকিদের জন্য খাবার ও আশ্রয়। আমাদের দরকার উপর থেকে নয় বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তল থেকে উঠে আসা জিনিসগুলো।


উদ্ভাসন

এইসবের সাথে সাথে আরও অনেক কিছুই এই ভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, প্রতিযোগিতা ও অন্যদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া কোনো রাজনৈতিক উন্মোচন ঘটে না। যা কিছু উন্মোচিত হয়েছে তাকে সমালোচনা ও চিত্রিত সম্ভাবনারূপে ভাষা, ছবি, রাজনীতিতে স্পষ্ট করে তুলতে হবে। ‘স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া’র যে সর্বব্যপী ব্যগ্রতা তাকে প্রতিহত ও রূপান্তরিত করে এই উন্মোচন, যখন তা ঘোষণাপত্রে লিপিবদ্ধ হয়ে আসে। আর সেই স্বাভাবিকতা হচ্ছে— যানজটময় মহাসড়ক, দূষিত বাতাস, অর্থহীন কাজ, বিশৃঙ্খল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, গাড়লের মতো খালি ভোগ করে যাওয়া, স্ফীত হয়ে উঠতে থাকা কারাগার, পরিত্যাক্ত গৃহহীন জনগোষ্ঠী, বিচ্ছিন্ন জ্ঞানচর্চা, পৃথিবীকে ধ্বংস করে চলা প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক অর্থনীতি, জাতি-শ্রেণি-লিঙ্গ এবং ভৌগলিক গোলার্ধভেদে স্তরবিন্যাস ও উঁচু-নিচু ব্যবধান এবং উচ্চ আয়ের বৈশ্বিক প্রভুদের নিজেদের সিংহাসনে ফিরে যাওয়া।

___________

১৪ই এপ্রিল, ২০২০


প্রকাশঃ ৪ঠা চৈত্র, ১৪২৭:::১৮ই মার্চ, ২০২১