‘আমরা ধ্বংসের যুগে প্রবেশ করছি’

ফ্রাঙ্কো “বিফো” বেরার্দি






[ফ্রাঙ্কো “বিফো” বেরার্দি (Franco “Bifo” Berardi) ইতালীয় কমিউনিস্ট দার্শনিক তাত্ত্বিক। পোস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদে, গণমাধ্যম ও ইনফরমেশন টেকনোলজির ভূমিকা নিয়ে তাঁর কাজকারবার। মাত্র ১৩ বছর বয়সে, ১৯৬২ সনে ইতালীয় কমিউনিস্ট যুব ফেডারেশনের সদস্য হন। আটষট্টির মে’র বিখ্যাত [প্যারিস] ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। সেসময়ে আন্তোনীয় নেগ্রি’র সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। আন্তোনীয় নেগ্রি ছিলেন ইতালীয় অটোনোমিজমের নেতৃস্থানীয় তাত্ত্বিক। বেরার্দিও ইতালীয় অটোনমিয়া [autonomia, স্বশাসন/স্বাধীন] মুভমেন্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। অটোনমিজম (অটোনমিস্ট মার্ক্সবাদ ও অটোনোমাস মার্ক্সবাদ [autonomous marxism] নামেও পরিচিত) কর্তৃত্ববাদ-বিরোধী বামপন্থী রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন এবং তত্ত্ব। এর প্রথম আবিভার্ব ঘটে সত্তরের দশকের ইতালিতে। নব্বইয়ের দশকে এসে তিনি বিখ্যাত ফরাসী মনঃসমীক্ষণবিদ ফেলিক্স গুয়াত্তারি’র সাথে কাজ করেছেন। এই সময়ে তাঁর তাত্ত্বিক কাজ ছিল মূলত সাইকোপ্যাথোলজি, ইনফরমেশন টেকনোলজি ও পুঁজিবাদের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে। The Third Unconscious তাঁর প্রকাশিতব্য বই। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছেঃ Félix Guattari: Thought, Friendship, and Visionary Cartography(২০০৮), After the Future(২০১১), And: Phenomenology of the End(২০১৫), Futurability: The Age of Impotence and the Horizon of Possibility(২০১৭) ও The Second Coming(২০১৯)।

করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে ফ্রাঙ্কো বেরার্দি’র একটি সাক্ষাৎকার গত জুনের ২১ তারিখে el Periódico-তে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে, ২৩শে জুন, Autonomies ওয়েবপোর্টালে এই সাক্ষাতকারের ইংরেজি অনুবাদ Franco “Bifo” Berardi: “we are entering the age of extinction” প্রকাশিত হয়েছে। বেরার্দি’র এই সাক্ষাতকারটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন কাফি মোহাম্মদ তামিম। কাফি মোহাম্মদ তামিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]

“জঞ্জাল” [corpse] থেকে বের হওয়ার এটাই কী উপায় ছিলো? একটি অতিমারী?


হ্যাঁ। এটা একটি বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক মাত্রা থেকে এসেছে, মিডিয়াজগতের মাধ্যমে ছড়িয়েছে এবং মানসিক পরিমন্ডলে প্রবেশ করে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করছে। তবে “জঞ্জাল” থেকে বের হয়ে যাওয়াই যথেষ্ট নয়।


এইসব পরিষ্কারের জন্য কিছু করার আছে?


এখনি বেঁচে থাকার সেই উপায়গুলি উদ্ভাবন করার সময় যা (বিমূর্ত) আর্থিক মূল্য পুঞ্জীভবনের চাইতে জরুরতের দিকে বিশেষ সুবিধা দিবে। আমি মনে করি যে, আমরা সেই সময় ছেড়ে যাচ্ছি যখন সম্প্রসারণ সম্ভব ছিল এবং সমাজের এক অংশের কাছে কাম্য ছিল, কিন্তু আমরা ধ্বংসের যুগে প্রবেশ করছি।


দয়া করে আর কোনো খারাপ খবর না!


সম্প্রসারণের জন্য, পুঁজিবাদ ব্যাপকভাবে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানুষের স্নায়ুবিক শক্তিকে ধ্বংস করতে শুরু করেছিল। এটা ধ্বংসের ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছিল। বিষণ্নতা যখন আগ্রাসন, শত্রুতা আর শঙ্কার রাজনৈতিক পরিণতি হাজির করে, বিলুপ্তি বা ধ্বংস তখন সম্ভাব্য।


পিছনে ফেরার কোনো উপায় নেই ?


না। যদি আমরা “জঞ্জাল”-এর বাইরে থাকার ব্যবস্থা করতে না পারি, যদি আমরা বাজার, পুঁজিবাদ এবং [উর্ধ্বগতির] মনোবৈকল্যের স্বাভাবিকতায় ফিরে যেতে একমত হই। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মহামারী পরিস্থিতির এই মূহুর্তে সামাজিক অর্থনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, খোদ অন্তরঙ্গতার দিগন্তকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে হবে।


কোন পথে সুখ, উন্নতির(growth) ধারণাকে ছাড়িয়ে যাবে?


“সুখ” এবং “উন্নতি” পদগুলো বেমানান। আমি ‘সুখ’-এর মতো জটিল শব্দকে ভুলে যাওয়ার প্রস্তাব দেই। আমি কি আমার মত করে প্রশ্নটিকে সাজাতে পারি?


হ্যাঁ করুন -


প্রশ্নটি হল - কোন পথ দিয়ে সমাজ মৌলিক চাহিদার পরিতৃপ্তি অতিক্রম করবে?



আর উত্তর?


ইতোমধ্যে যা বিদ্যমান তাতেই উত্তর রয়েছে: আমাদের জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উৎপাদন ক্ষমতা, কিন্তু সবার আগ্রহের দিকে মনোনিবেশিতআসন্ন দিনগুলোতে আমরা ক্রমবর্ধমান দুর্দশা এবং বিদ্যমান সম্পদের পুনঃবন্টনের মধ্যে একটা বেছে নিতে বাধ্য হবো। যদি শোষক সংখ্যালঘুরা তাদের সুযোগসুবিধা বজায় রাখতে চায় তবে পৃথিবীর সর্বত্র গৃহযুদ্ধের ঘটনা ঘটবে। এটি এড়ানোর উপায়? সমতা!

আপনি ‘সমতা’ বলতে কি বোঝাচ্ছেন?


আমি ইস্তফা দেওয়া বোঝাচ্ছিনা, বরঞ্চ সম্পদ ও আনন্দের সংযত উপলব্ধি করাকে বোঝাচ্ছি। ‘সম্পদ’ হল জিনিসপাতি ও ঘটনার সুখানুভব, এবং সর্বোপরি, আমাদের যা কিছু আছে তাই উপভোগ করার সময়। সময়ের পুনর্দখল(re conquest) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা কিনা প্যারাডক্সিক্যালি কোভিডকে সম্ভব করে তুলেছে। আমাদের অবশ্যই নিরাপত্তা এবং ইন্দ্রিয়ানুভবকে সংযুক্ত করতে পারতে হবে।


আপনি আমাদের ‘অপরের শরীরের আনন্দ শনাক্ত করতে’ উৎসাহিত করতেন আর এখন আপনি দেখতে পাচ্ছেন -


আমি যখন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করি, তখন কল্পনা করা সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, আমরা কিভাবে অন্যের শরীরকে রাস্তায়, ক্যাফে, বিছানায় হৃদয়ঙ্গম করবো। আমরা সম্ভবত সামাজিক দূরত্ব থেকে বের হচ্ছি অন্যের শরীর, অন্যের ঠোঁটের প্রতি সহজাত ভয় নিয়ে।


যেমনটি হয়েছিলো ৮০’র দশকে এইডস-এর কারণে।


হ্যাঁ, এটা ছিল মানসিক(সাইকিক) বোমা। কিন্তু এখন সম্ভবত সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইন্দ্রিয়ানুভবের একটি শক্তিশালী আন্দোলনও হতে পারে, কারণ এখন ‘অনলাইন’ নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক সময়ের স্মৃতি হয়ে উঠতে পারে, রোগের লক্ষণ হিসেবে। এখানে আমি সত্যিকারের সাংস্কৃতিক, নান্দনিক এবং সামাজিক আন্দোলনের বীজ দেখতে পাচ্ছি।


এই মুহূর্তে সমস্ত অনূভুতি, কাজ, স্কুল আর অবসর সবকিছু ঢুকে গেছে স্ক্রিনে বা পর্দায়


স্ক্রিন বা পর্দা হচ্ছে নিরাপত্তার জায়গা, তবে এটি এনেস্থেশিয়ারও জায়গা, ইন্দ্রিয়ানুভব বিনাশেরও জায়গা। আমরা কি এমন মানবজাতি কল্পনা করতে পারি যে নিজেই শেষপর্যন্ত তার শারীরিক আবেগপ্রবণতা, চোখ, ঠোঁট ও হাতের কোমল ছোয়ার মোহনীয়তা থেকে মুক্ত করে ফেলবে?


আপনি পারবেন?


না, আমি এটা কল্পনাও করতে পারি না। আমি যদি এটা কল্পনা করি তবে এটা হবে সবচেয়ে ভয়াবহ ডিস্টোপিয়া(dystopia): আর্থিক হিসাবনিকাশের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষ ও কার্যক্ষম এক দুনিয়া, কিন্তু সেটা মৃত দুনিয়া। আমি ডুবে যেতাম।


আপনি যখন তীব্র ডুবন্ত থাকেন, বিধ্বস্ত থাকেন, আপনি তখন ছবি আঁকেন। কোন বিষয়গুলো [থিম] বারে বারে এঁকেছেন?

একটা ছবি যা আমার চিন্তায় আর আঁকায় ফিরে আসে তা হলো: পোপ ফ্রান্সিস ঈশ্বরের সাথে ভালোবাসা, শান্তি চুক্তির চিহ্ন স্বরূপ জোড়া সাদা পায়রা উড়িয়ে দিচ্ছেন। একটা কালো কাক পায়রার কাছে এসে এটাকে গোগ্রাসে গিলছে। আমি একজন নাস্তিক, কিন্তু যতবারই এই ছবিটা এঁকেছি ততবারই নিজেকে বলেছি যে, সুযোগ ভয়ঙ্কর নান্দনিক কল্পনার জন্ম দেয়।

____________

২১শে জুন, ২০২০

প্রকাশঃ ই মাঘ, ১৪২৭:::২শে জানুয়ারি, ২০২১