মৃত্যুকে মোকাবেলাই হতে পারে স্বাধীনতা আর বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র
আজ আমরা ভীত। অতল গহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়ে চিন্তা শক্তি লুপ্ত। কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ। এক খবর হতে আরেক খবর; এভাবেই মন উড়ে উড়ে বেড়ায় মাছির মতো। খবর যেন দেখার জন্য দেখা। তারপর হঠাৎ মনে হয়, হায় হায়, এ কেন দেখলাম; এত ভয়ানক, এত মর্মান্তিক! দিনে ঘুমানো দূরে থাক, রাতেও ঘুম আসেনা। যদিওবা ভুল করে ঘুমিয়ে পড়ি, জেগে উঠি এক রাশ প্রাণহর আতঙ্ক আর হতাশা নিয়ে। পরক্ষণেই ভাবি, নাহ, এতো সত্যি নয়। নিজেকে চরম বোকা বোকা লাগে। তারপর একটু জ্বরটা মাপি, থম মেরে থাকি, আবার একই কাজ করি। এভাবেই চলতে থাকে। অক্ষমতা আর বিরক্তিতে বিষিয়ে ওঠে মন। যখন দেখি চারপাশে যা হচ্ছে বা প্রায় হচ্ছেনা—হলেও বাজে, দায়সারা আর অসৎ উপায়ে হচ্ছে; তখন অক্ষম রাগে ফুঁসতে থাকি।
শ্বাস কষ্ট নিয়ে নিঃসঙ্গ মৃত্যু চিন্তা খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়। এই যে হাজার মানুষের ভাগ্যে এই মূহুর্তে যা ঘঠছে তা ভাবতে গেলেই মাথা খারাপ হওয়ার দশা। প্রতিদিন অগণিত মৃত্যুর মিছিল। জীবিকার নেই কোন নিশ্চয়তা। মিথ্যে স্বপ্নের মায়ায় বোনা ক্লান্ত শ্রান্ত যুদ্ধের উপমা। সামাজিক বুনিয়াদ, যাপিত জীবনের অভ্যাস যা আমরা চিরন্তন ভেবে নিয়েছিলাম সব কিছু ভেঙে পড়ছে। অপনারা, আমরা সকলেই রোগের বাহক। মুখোশে মুখ ঢেকে এগিয়ে চলি, দুরত্ব বজায় রাখি।
প্রত্যেকেই আজ নিজ নিজ মৃত্যু ভেলার যাত্রী। আর নিউইয়র্কে যেন মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা। হাস্যকর [ফেসবুক] মিমে সয়লাব সর্বত্র। ক্ষণিকের হাসি ফুটে উঠে মুখে, বন্ধুদের সাথে কিছু মিম শেয়ার করি, পরক্ষণেই কিছুটা দাঁত চেঁপে নিজেদের গুটিয়ে নেই। কিছুদিন হলো মাত্র এমন হয়েছে। যোগাযোগের হুল্লোড়, কাছের কিংবা দূরের বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ ফোনালাপ সবই যেন কেমন করুণ, বিষাদময় আর গম্ভীর হয়ে পড়েছে। জানি এ এক দীর্ঘ যাত্রা; কিন্তু বুঝিকি কি এর মানে?
এই পথ কেমনে পাড়ি দেই? কিংবা, কেমনে পাড়ি দেয়া উচিৎ?
দার্শনিকদের সাথে কিন্তু এই সামাজিক দূরত্বের দীর্ঘ এবং পীড়নমূলক প্রণয় সম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে। সক্রেটিসের জেল জীবন দিয়ে শুরু। রেনে দেকার্তকে যুদ্ধের ময়দান (এই যুদ্ধটি সেই সময় ত্রিশ বছর স্থায়ী হয়েছিল) থেকে সরিয়ে এনে নেদারল্যান্ডের ছোট এক উনুন বিশিষ্ট কামরায় আটকে রাখা হয়, যা অবশ্য তাঁর নিশ্চয়তা বিষয়ক দর্শন চিন্তার পথ করে দিয়েছিল। এছাড়া আছে বোয়েথিউস, থমাস ম্যুর থেকে শুরু করে আন্তোনীয় গ্রামশি পর্যন্ত। এরা সবাই দূরত্বায়ন(isolation) ও চিন্তার সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের অংশ।
কিন্তু দর্শনের কি হাল হবে? দীর্ঘ তিন হাজার বছর ধরে এটি মানুষের জীবনের তো কোন সমাধান দিতে পারেনি। আর এর বাস্তব অকার্যকারিতা নিয়ে হাসি-তামাশাও কম হয়নি। কথা উঠতে পারে এই বিপদের সময় এইসব অবাস্তব ধ্যান-ধারণা আমাদের কিভাবে কাজে লাগবে? এই যে উদ্বেগ আর হতাশা মাখানো ধ্বসে পড়া বাস্তবতা, এই যে মৃত্যুর নাচন, এসবের মুখে দাঁড়িয়ে দর্শন কি পারে কোন আলোর পথ দেখাতে, পারে কি সামান্যতম সান্ত্বনা দিতে?
বলা যেতে পারে: দর্শন করা(philosophize) মানে কিভাবে মৃত্যু বরণ করতে হয় তা শেখা। এভাবেই ভেবেছেন ষোড়শ শতাব্দীর ফরাসি প্রাবন্ধিক মিশেল দ্য মঁতাইন(Michel de Montaigne)। প্রবন্ধ শিল্পের জন্ম দেয়া এই চিন্তাবিদ অবশ্য এই উক্তিটি ধার করেছেন সিসেরো থেকে, বিশেষ করে সিসেরো যখন সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ভাবছিলেন। মঁতাইন বলছেন যে, সক্রেটিস মৃত্যু বরণ করতে শিখেছেন শুধু চিন্তায় নয়, কথায়ও— খাদ্যগ্রহণ আর পানীয় গলধ:করণ করাতেও। যারা হয়তো এই অবসরে রান্নায় সময় দিচ্ছে কিংবা একটু বেশি পানীয়তে মশগুল তাঁদের কাছে হয়তো কথাগুলো একটু অন্য রকম শোনাবে। আসলে ব্যাপারটা আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। মঁতাইন ইতি টানছেন এক আশ্চর্য বাক্য দিয়ে। তিনি বলেন, “কীভাবে দাস হতে হয় তা আনলার্ন বা বিস্মৃত করতে শিখেছে সে, যে মরতে শিখেছে।” এ এক চমৎকার ভাবনা: দাসত্বের শৃঙ্খল মৃত্যু ভয়ের মাঝেই নিহিত। তাহলে দেখুন, আমাদের শ্বাস নেয়ার ভয়ের মাঝেই আছে আমাদের দাস বনে যাওয়ার বীজ।
উল্টো দিক থেকে চিন্তা করলে, স্বাধীনতা মানে মৃত্যুকে মেনে নেয়া— মানে মরতে যে হবেই এই ব্যাপারটা স্বীকার করে নেয়া। আপনি স্বাধীনতা অনুভব করবেন তখনই যখন আপনি বুঝতে শিখবেন প্রতিটি ঘন্টায়, প্রতিটি দিনে, পায়ে পায়ে এগিয়ে আসা অবধারিত মৃত্যু দ্বারা আপনার জীবন ঘটিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সেই যাপিত, দার্শনিক জীবনই ভালো যা মৃত্যুকে জানিয়েছে সাদর সম্ভাষণ। আমাদের অস্ত্বিত্ব সসীম। মৃত্যু অমোঘ নিয়তি। এটি অবশ্য তেমন নতুন কোন তথ্য নয়। কিন্তু দার্শনিক জীবন শুরু করা যেতে পারে নির্মোহভাবে আমাদের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে, যেমনটি টি. এস. এলিয়ট জ্যাকোবীয় নাট্যকার জন ওয়েবস্টারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, আমাদের চামড়ার নিচের মাথার খুলি দেখা উচিৎ।
তারপরেও ভয় আমাদের গ্রাস করে। এখনও মৃত্যু গহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। একটু ভাবা যাক একি আসলে ভয় না উদ্বেগ। এরিস্টটলের সময় থেকে অন্তত এটুকু শিখেছি যে, ভয় হলো পৃথিবীতে যেকোন সত্যিকারের হুমকির মুখে আমাদের প্রতিক্রিয়া। ধরা যাক, ভালুকের ব্যাপারে আমার মাঝে এক অযৌক্তিক ভয় কাজ করে। এখন যদি বাসার দরজায় এক বড় ভালুক সত্যি সত্যি হাজির হয় তাহলেতো আমি ভয়েই আধমরা হয়ে যাবো (সাথে অবশ্য বিস্মিতও হবো)। আর ভাগ্যক্রমে যদি ভালুকটা রাস্তা মাপে, ঘাম দিয়ে জ্বর সারবে বৈকি। অন্যদিকে চিন্তা করেন উদ্বেগ(anxiety) ব্যাপারটা কিন্তু কোনো ভালুক বা অন্য কোনো বস্তুর ধার ধারেনা। এটি বরং এমন এক অবস্থা যখন পৃথিবীর খুঁটিনাটি আর চোখে পড়েনা। সবকিছু অপার্থিব আর অদ্ভুত মনে হয়। এটি পাইকারিভাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মতো—মানে সবকিছুর সাথেই আছি কিন্তু কোনো কিছুর সাথে নাই এমন একটা অবস্থা। আমি এখানেই দ্বিমত করতে চাই যে, এই মূহুর্তে আমরা অনেকেই গভীর উদ্বেগের মধ্যে আছি(ভয় নয় কিন্তু)।
অদ্ভুত এই মহামারী। সর্বগ্রাসী এই ভাইরাস। দৃশ্যমান জগতের মাঝে অদৃশ্য যার চলাফেরা। কোভিড-১৯’র গঠন যেন বাস্তবতার ন্যায়—এমন এক অসুখ যা সবখানে আছে আবার কোনখানেই নেই। কিছুটা তাকে চেনা যায়, কিন্তু বধ করা যায়না। সর্বোপরি, মনে হয় যেন বেশ কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে যেন ভাইরাস সমুদ্রে ডুবে আছি। কিন্তু সম্ভবত, এই কম্পমান ভয়ের নিচে লুকিয়ে আছে গভীর উদ্বেগ—আমাদের বিলীন হয়ে যাওয়ার উদ্বেগ, আমাদের মৃত্যু অভিমুখে যাত্রার ভয়। ঠিক এটাই আমরা স্বাধীনতার শর্ত হিশেবে ধরে নিতে পারি।
আমার মনে হয় উদ্বেগ চেপে না রেখে মেনে নেয়া শ্রেয়। এর কাছ থেকে পালানো বা একে অন্য কোনো বস্তু বা কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও উচিৎ নয়। এই উদ্বেগ শুধু নিছক বিশৃঙ্খলা নয় যার পথ্য প্রয়োজন। তাই, একে ঔষধ দিয়ে অকার্যকর করে দেয়ার প্রশ্নই আসেনা। বরং একে স্বীকার করে নিতে হবে, মেপে নিতে হবে আর শান দিয়ে স্বাধীনতার বাহনে রূপান্তর করতে হবে। বলছিনা কাজটা খুব সহজ। কিন্তু এই মুল উদ্বেগের মাঝে যে বিনাশী শক্তি তাকে সাহস যোগানো এক সঞ্জীবনী শক্তিতে রূপান্তর করার চেষ্টাটুকু অন্তত আমরা করতে পারি।
প্রায়শই আমাদের অধিকাংশকে উৎসাহিত করা হয় চারপাশে যা ঘঠছে তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে এক নকল মহাকালের মাঝে বাস করতে। আমরা মনে করি, জীবন চলতে থাকবে আর মৃত্যু এমন এক ব্যাপার যা অন্যদের হয় আমাদের নয়। হাইডেগারের ভাষায় বলতে গেলে মৃত্যু হলো এক সামাজিক অস্বস্তি অথবা একেবারে বেধড়ক কিছু একটা। এই ক্ষেত্রে দর্শনের সান্ত্বনা হলো, এটি মৃত্যু চিন্তা রহিত যাপিত জীবনের মোহ ভঙ্গ ঘটায় আর পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গী আর বুক ভরা সাহস নিয়ে সাদামাটা বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। এখন এসব কিছু করতে গেলে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎসাহ নিয়ে দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন এসে পড়ে। কেননা সীমাবদ্ধতা ব্যাপারটা আপেক্ষিক। আবারও বলছি এটা শুধু আমার আপনার মৃত্যুর প্রশ্ন নয়, অন্যদেরও মৃত্যুর ব্যাপার, যাদের আমরা ভালবাসি—যারা আমাদের কাছের ও দূরের, আত্মীয় ও অনাত্মীয়।
সপ্তাহ খানেক আগে, জিওভান্নি বোকাচিও’র ‘ডেকামেরন’ , ডিফো’র ‘জার্নাল অফ দি প্লেগ ইয়ার’, কাম্যু’র ‘দি প্লেগ’ ইত্যাদি প্লেগ সাহিত্য নিয়ে বেশ রসিয়ে গালগল্প বলছিলাম। নিজেকে বেশ সমজদার লাগছিল। ভুল ভাঙলো তখন, যখন দেখি আশেপাশে সবাই ঐ নিয়েই মশগুল। সত্যি বলতে কি এসবের মাঝে যে চিন্তাবিদ আমায় বেশ টেনেছে তিনি হলেন ১৭শ শতাব্দীর ফরাসি গণিতবিদ ও ধর্মতত্ত্ববিদ ব্লেইজ প্যাসকেল(Blaise Pascal)। বিশেষ করে তাঁর “পঁসে (Pensées, ভাবনা)” নামের বইটি।