অশুভ-ও ক্ষমতা

জঁ-লুক ন্যান্সি


[জঁ-লুক ন্যান্সি (ফরাসিতে বললে, জঁ-লুক নঁসি) প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত La Communauté désœuvrée (The Inoperative Community) ন্যান্সির অন্যতম সুপরিচিত কাজ। গোষ্ঠী বা কম্যুনিটি’র প্রশ্ন তাঁর এই কাজের বিষয়বস্তু। করোনা মহামারী ও এর সাপেক্ষে জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে জর্জিও আগামবেন ও রবার্তো এসপজিতো’র সাথে বিতর্কে জড়িয়ে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু লেখা লিখেছেন। করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে ন্যান্সি’র লেখা MAL- AND POWER গত ৪ঠা এপ্রিলে প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন Victoria Derrien এবং তা The Philosophical Salon-তে প্রকাশিত হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে ন্যান্সির এই লেখাটি ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় শিক্ষক, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান।]


মহামারী যে অশুভ তা বলতে দ্বিধা নেই। তারপরেও কেউ কেউ বলবে, অত খারাপ হয়তো এ নয়। বর্তমান যুগের কিছু রোগশোক আর যুদ্ধের বরাত দিয়ে বলা হয়, এসব আরও খারাপ। উদ্ভট যত তর্ক। এত ব্যয়, এত কষ্টের পরেও যে মৃত্যুহার, তা কিন্তু এই বিতর্ক মারফত কমছে না। আরেকদল মুখে ফেনা তুলছে এই বলে যে, সমাজের পক্ষ থেকে যে সেবা তার মধ্যেই গলদ আছে। এই সমাজ সবসময় নিজের ভালো আগে চায়। প্রয়োজনে সরকারী বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা মারফৎ মাত্রাতিরিক্ত-সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়। ভাবখানা এমন যেন এক অতি নায়ক তৈরির চেষ্টা চলছে, যার কোন কারণও নেই আবার অশুভ পরিণতিও নেই।


সন্দেহাতীতভাবে, ভাইরাসের কাঁধে ভর দিয়ে যে সকল সমাজ এবং সভ্যতাগত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসছে তার বিরোধিতা কেউ করছে না। উল্টোদিকে, কেউ এ নিয়ে কথা বলতেও ছাড়ছেনা। কিন্তু [রেনে] দেকার্ত হয়তো একে বলবে, “রেলিভেন্ট মোডে( relevant mode) কথা বলা”।


মূলত “পুঁজিবাদ” শব্দটাই বারবার সামনে আনা হচ্ছে। অবশ্য এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুনাফার উপর ভিত্তি করে গজিয়ে উঠা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনাই আজকের এই অবস্থার জন্যে দায়ী। এর জন্যে দায়ী এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক নির্ভশীলতার প্রসারকে প্রশ্রয় দেয়া; যদিও অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিসংক্রান্ত দাসত্বকে এর সাথে মিলিয়েও ফেলা ঠিক হবে না। সমস্যা হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূত তাড়ানোর জন্যে যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে। এরপর যে “পরিবেশ তত্ত্ব( ecology)” নামের মহান দেবতার আবির্ভাব হবে তা সহজে অনুমেয়।


ভুলেইতো বসেছি, এই ইবলিশের বয়স কম নয়। বিগত সাত’শ বছর ধরে এই ইবলিশই কিন্তু আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি, আধুনিক বিশ্ব নির্মাণের মূলশক্তি এবং আধুনিক বিশ্ব আকার-আকৃতি দেয়ার মূল শক্তি। অসীম বাজারমূল্য আজ নিজেই মূল্যে পরিণত হয়েছে, নিজেই আজ পরিণত হয়েছে সমাজে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। ফলাফল অসাধারণ, জন্ম নিল এক নতুন পৃথিবী। হতে পারে পৃথিবী আজ ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু আমাদের কিছুই পরিবর্তনের সুযোগ নেই। “ঠিক উল্টো” এই মন্তব্য করার লোভও হয়তো কেউ সংবরণ করতে পারবে না। বিশেষ করে এটা তখনই হয় যখন দেখা যায় এক জাতি আরেক জাতির মুখোশ নিয়ে টানাটানি করছে, যখন রাজ্য হতে ৯০০০ কি.মি. দূরে রাজা আত্মগোপন করে, যখন ভাইরাস প্রতিরোধে লোকাচারের ঘোষণা দেয়া হয়, কিংবা প্রতিষেধক হিসেবে সাধারণ হিস্টিরিয়াগ্রস্থ ঝগড়া-বিবাদের কথা বলা হয়।


সত্যি বলতে কি, এই কিংবা ঐ অকার্যকারিতা বিপদের মুখে নেই। এটাই হল গঠনমূলকভাবে বিপথে চলে যাওয়া যা বিশ্ব বহু আগে তাঁর চলার পথের সঙ্গী করে নিয়েছে। এই বিপথে যাওয়ার ব্যাপারকেই আমি বলছি “অশুভ(mal)”। ভাইরাস তো আর খারাপ জিনিস না। খারাপ হলো সমস্যার তীব্রতা, এর প্রভাব; সর্বোপরি এই নিম্নগামী দুরাবস্থা এটা বলার সম্ভাবনা তৈরী করে যে, এটি মারাত্মকভাবে “অশুভ”র উপাদানসমুহ সংঘবদ্ধ করে দেয়।



অশুভর তিন রূপঃ দুরারোগ্য ব্যাধি, দুর্ভাগ্য আর দুষ্কর্ম। অসুস্থতা অবশ্য জীবনেরই অংশ। [জীবনকে যখন এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হয় সেই হিসেবে বলতে হয়] দুর্ভাগ্য তাই যা অস্তিত্বের জন্যে হুমকি স্বরূপ। এটি আসতে পারে অসুস্থতা কিংবা (প্রাকৃতিক, সামাজিক, প্রযুক্তিগত, নৈতিক) আক্রমণ আকারে। দুষ্কর্ম (আরেকভাবে বললে অভিশাপ) বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি ইচ্ছে করে রোগ-শোক, আপদবালাই তৈরী করা। এটি ব্যক্তি কিংবা অস্তিত্বের (আপনি যে নামেই বলুননা কেন) জন্যে হুমকি।


আচ্ছা, ঠিক কতটুকু তীব্র হলে আমরা কোন সমস্যাকে ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট সমস্যা বলতে পারি? আমার মনে হয় সেই পর্যন্তই বলা যাবে, যতক্ষণ এর উপাদান আর এজেন্ট সংক্রান্ত জটিলতার সাথে সমস্যার শক্তির যোজসাজশ রয়েছে। এই মুহূর্তে বেড়ে উঠার প্রক্রিয়া তার উপর গবেষণা তা নিয়ে মন্তব্য করা অর্থহীন। বর্তমান যোগাযোগ ব্যবস্থা, ২০ বছর যাবত গবেষণা প্রজেক্ট কিংবা প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে রোগসংক্রমণের ব্যাপারেও মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নানা জাতের জটিলতার মধ্যে আছে দূষণ, বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি, কীটনাশকের বিষক্রিয়া, গাছ-কাটা, আরও আছে দুর্ভিক্ষ, উদ্ভাস্তু সমস্যা, বাসস্থানের অভাব, দারিদ্র, বেকারত্ব এবং বিভিন্ন মাপের সামাজিক এবং নৈতিক অবক্ষয়। প্রযুক্তিগত-অর্থনৈতিক উন্নয়ন এর মাঝে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এর মারফতই কিন্তু একদিকে যেমন শিল্পরাষ্ট্র, অন্যদিকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সবচাইতে বিধ্বংসী হতে শুরু করে অদ্ভূত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে। এর মারফতেই সকল ধরনের প্রতারণার সুযোগ নিচ্ছে এবং সর্বোপরি "রাজনীতি" নাম দিয়ে চূড়ান্ত শোষণে মগ্ন হচ্ছে।


শতবর্ষেরও অধিক সময় পরে, এমন এক সামগ্রিক দুর্যোগ কিন্তু অহেতুক এসে হাজির হয়নি। এটি এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যা যদিও হাজার বছরের অন্যান্য ভয়ানক এবং নিষ্ঠুর কোন কিছুর মত নয়। আজ এটাই প্রমাণিত যে, অগ্রবর্তী তার গর্ভে লুকিয়ে রাখা দুষ্কর্মের প্রকাশ করে চলেছে। অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকা ফ্রয়েড, হাইডেগার, গুন্টার এন্ডার্স ( Günther Anders), জ্যাক প্রলুল( Jacques Ellul) সহ অন্যদের সতর্কবাণী মারফত ব্যক্তির সক্ষমতা, ইচ্ছা, মানবতা সবকিছুর বিনির্মাণ ইতিমধ্যে সারা হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষই আজ মানুষের থেরাপি করে বেড়াচ্ছে। আশ্চর্য্য হওয়ার আর কি আছে, যদি মেহেদি বেলহাজ কাসেমের(Mehedi Belhaj Kacem) ন্যায় কোন দার্শনিক বলে বসে, “অশুভই হল মূল উপাদান”(যদিও কাসেমের নাম উল্লেখ করার মানে এই নয় যে তাঁর সিস্টেম শেয়ার করতেই হবে)।


অশুভ কিন্তু বহুকাল যাবত আমাদের ঐতিহ্যের অংশ—এ এমন এক ক্ষত যা ঈশ্বর কিংবা যুক্তি দ্বারা যা সারিয়ে তোলা যায় বা যার ক্ষতিপূরণ সম্ভব। যাইহোক আমাদের দিগ্ববিজয়ের যে “শুভ” তাই আজ ধ্বংসাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে আর ঠিক এই কারণেই এটি আত্মবিধ্বংসী। প্রাচুর্যই প্রাচুর্য নাশ করে, গতি দ্বারা গতির ক্ষয়। স্বাস্থ্যে হয় স্বাস্থ্যের ক্ষতি। আর বৃত্তই হয়তো শেষ পর্যন্ত দারিদ্র টেনে আনে (যদিও কোন কিছু দরিদ্রের হাতে গিয়ে পড়েনা)।



আজ এমন অবস্থায় পৌছালাম কিভাবে? নিশ্চয় এমন এক মুহূর্তকে ধরতে হবে, যখন থেকে (সীমানা, সম্পদ, শক্তি এসব) জয় করে নিয়ে নতুন পৃথিবী তৈরীতে বিভোর হলাম। এই অভিব্যক্তির আলোকে মনোনীত হওয়া শুধু আমেরিকার কথাই বলছিনা। অন্য দৃষ্টিকোণের কথা বলছি যা দিয়ে দেখলে মনে হয় এই বিশ্ব আসলেই প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের সৃষ্টি; আর এই প্রযুক্তি-বিজ্ঞান যেন এক দেবতা। অন্যভাবে বললে সর্বজ্ঞান। ইবনে রুশদের সময় হতে দর্শন জানে সর্বজ্ঞানের প্যারাডক্স কি। মনোবিশ্লেষণও জানে এর ভ্রমের মরা গিঁট সম্পর্কে। ব্যাপারটা সবসময় শক্তির নয়, সম্ভাবনার সীমা নির্দেশ করে।


আচ্ছা কিসে সীমা নির্দেশ করা হয়? সরাসরি বলতে গেলে, মৃত্যুর অমোঘ নিয়তির ব্যাপারে ভাইরাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়। এ এমন এক মৃত্যু যা কোন কারণ, কোন যুদ্ধ, কোন শক্তি দ্বারা বিচার করা যায়না, যা ক্ষুধা, রিক্ততা, বর্বরতার—হোক তা সামরিক কারণে, গণহ্যার কারণে, নিয়মনীতির কারণে—মারফত সকল মৃত্যুকে তুচ্ছ করে দেয়। শুধু জেনে রাখি, আমরা মরনশীল তবে দুর্ভাগ্যবশত নয়। বরং জীবনের ক্রীড়ার ছকে এবং জীবনের গতির ছকে।


জন্ম এবং মৃত্যুর কারণে সকল অস্তিত্ব অনন্য। এই দুইয়ের মাঝের সময়টুকুর জন্যেই এই অস্তিত্বের গুরুত্ব অসীম। মহামারীর ব্যাপারে সম্প্রতি ডেভিড গ্রোসম্যান লিখেছেন, “ভালোবাসা যেমন আমাদের মাঝে বয়ে যাওয়া সকল অস্তিত্বের ভীড় হতে একজনকে আলাদা করে চিনে নিতে উজ্জীবিত করে, তেমনই মৃত্যুও একই বোধ জাগিয়ে তোলে।”


“অশুভ” বলতে যদি আমরা চরম অসমতা ধরে নেই, তবে মৃত্যুকেই একমাত্র চরম সমতাবিধানকর্তা হিসেবে ভাবতে হবে। আমরা কিন্তু কিছু বায়বীয় অধিকারের কথা বলতে গিয়েই সমতা রক্ষা করতে পারলাম না। যাইহোক আমাদের অস্তিত্বকে অন্তত আমাদের ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ। আমাদের অস্তিত্বকে অনন্যভাবে অর্থবহ করার উপায় হল এটা জানা যে আমরা সসীম এবং আমরা বেহিসেবি রকমের শক্তিশালীও নই। নিজেদের এই জানা হোক সদর্থক, চরম, অসীম এবং এককভাবে নিঃশেষিত।


___________

৪ঠা এপ্রিল, ২০২০


ইংরেজি অনুবাদকের টীকাঃ

Throughout the text as far as possible the French term “Le Mal” has been left untranslated. The many senses of this term remain in use in English although it is rarely used as a noun. Through the prefixes “Mal” suggests the meaning of “bad”, as in maladjusted; deprived, as in malnutrition; intended evil as in mal intention; corruption or impropriety in malpractice.


প্রথম প্রকাশঃ ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/345414783199077/