অনাগত সময় প্রসঙ্গে

জর্জিও আগামবেন



[করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে Quidlibet ব্লগে ধারাবাহিকভাবে লিখে চলেছেন ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন। গত বছরের নভেম্বরের ২৩ তারিখে তাঁর Sul tempo che viene লেখাটি প্রকাশিত হয়। আগামবেনের এই লেখাটির অ্যালান ডীন (Alan Dean) কৃত ইংরেজি অনুবাদ পরদিন অর্থাৎ ২৪ শে নভেম্বরে Time Ahead (On the Coming time) শিরোনামে প্রকাশিত হয়। অ্যালান ডীন কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে আগামবেনের এই নিবন্ধটি তর্জমা করেছেন নাসরিন সুলতানা সুপ্তিসুপ্তি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী।]



আজকাল গ্রহজুড়ে যা ঘটে চলেছে তা নিশ্চিতভাবে একটি বিশ্বের অবসান। তবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে যারা এই গ্রহ শাসন করবে তারা যেভাবে এই অবসানকে— মানব সম্প্রদায়ের নতুন নতুন প্রয়োজনের সাথে মানানসই একটি বিশ্বের দিকে রূপান্তর হিসেবে ইঙ্গিত করে; কথাটি সেই অর্থে বলা হয়নি। আদতে শেষ হতে যাচ্ছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের দিন— তাদের স্বত্ব, সংবিধান এবং সংসদসমেত। আইনগত খোলস ছাড়িয়ে, গুরুত্ব সহকারে, এখানে সে বিশ্বের অবসান বোঝানো হয়েছে যে বিশ্ব—শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে যাত্রা শুরু করে, পরিণত হয় দুটি (কিংবা তিনটি) বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধগুলোর সঙ্গে চলে আসা ‘নিপীড়নমূলক কিংবা গণতান্ত্রিক’ টোটালিট্যারিয়ানিজমের মাধ্যমে।



কোন রকম বাছবিচার ছাড়াই সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত—জৈবনিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ক ভীতির মতো চরম পরিমাপ এবং পদ্ধতিগুলোকে অধিষ্ঠিত করা যদি বিশ্বের শাসনরত ক্ষমতাগুলো জরুরী মনে করে থাকে এবং এখন সেগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে শাসাতে থাকে, তাহলে তা এই কারণে যে তারা ভীত ছিল বা বলা ভালো, টিকে থাকার জন্য তাদের অন্য কোনো উপায় ছিল না। জনসাধারণ যদি এসব চরম ক্ষমতাসম্পন্ন পদক্ষেপ এবং অভূতপূর্ব বিধিনিষেধগুলো গ্রহণ করে থাকে, ন্যায্যতা ছাড়াই চলতে দেয়, তাহলে তা শুধুমাত্র মহামারীর ভয় থেকে নয় বরং সম্ভবত কিছুটা অসচেতনভাবেই, এবং তারা বুঝতে পেরেছিল যে বিশ্বে তারা বসবাস করে চলেছে তা বহাল থাকতে পারে না, কারণ এ বিশ্ব অত্যন্ত অন্যায্য এবং অমানবিক।



অবশ্য, সরকারগুলো এখন এমন একটি বিশ্বের প্রস্তুতি নিচ্ছে যেটি এর চেয়েও বেশি অমানবিক আর অন্যায্য হবে। যেকোনভাবে চারদিক থেকে পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল যে, এই পরিস্থিতি বেশী দূর চলতে পারে না, যেমনটা আমরা জানতাম। এখানে একটি ধর্মতত্ত্বীয় উপাদান রয়েছে, যেকোনো দুর্বোধ্য পূর্বাভাসে যেমন থাকে। স্বাস্থ্য প্রতিস্থাপিত করেছে পরিত্রাণকে, চিরন্তন জীবনের জায়গা নিয়েছে জৈবিক জীবন। ক্যথলিক চার্চগুলো যেখানে জাগতিক চাহিদাগুলোর সাথে দীর্ঘকাল ধরে আপোষ করে এসেছে, এই প্রতিস্থাপনের সঙ্গে সেগুলো এখন মোটামুটি প্রকাশ্যভাবে সম্মত।



স্বর্গীয় কিংবা মানবসৃষ্ট যেসব ধারণাগুলো ইতিহাসের বেলাভূমির বালিতে পড়ে থাকা একটি অবয়বের মত সময়ের নিরবচ্ছিন্ন ঢেউতে মুছে যাচ্ছে সেগুলোর জন্য স্মৃতিকাতর হয়ে পড়া কিংবা এই বিশ্বের বিদায় নিয়ে আফসোস করা উচিৎ নয় আমাদের। বরং আমাদের উচিৎ স্থিরচিত্তে এই অবয়বহীন, মূক এবং নিরাভরণ জীবনকে এবং সরকার প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যের এই ধর্মতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করা। কোন নতুন ব্যক্তি কিংবা নতুন ঈশ্বরের অপেক্ষা নয়, আমাদের উচিৎ চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকে এখনি খুঁজে বের করা একটি নম্র, সরলতর ধাঁচের জীবন—যা মোটেই মরীচিকা নয়। কারণ, এটি রয়েছে আমাদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায়; আমাদের ভেতর ও বাহির উভয়দিক থেকে আসা বিরুপ শক্তিগুলো যদি এই জীবনকে বিস্মৃতিতে আটকে রাখতে চায়, তবুও।

____________

২৩শে নভেম্বর, ২০২০

পুনশ্চ- এই লেখাটির আরেকটি বঙ্গানুবাদ করেছেন প্রীতম চক্রবর্তী। দেখুন, এখানে

প্রকাশঃ ২২শে চৈত্র, ১৪২৭:::৫ই এপ্রিল, ২০২১