নীটশের ‘ফ্রান্স ভ্রমণ’ ও উত্তর-কাঠামোবাদের জেনিওলজি


... it is high time that I come again to the world as a Frenchman.

NIETZSCHE, Draft of a letter to Jean Bourdeau




উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তাধারায় যাদের চিন্তার গভীর ছাপ টের পাওয়া যায় তাঁর মধ্যে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নীটশে অন্যতম। ফুকো, দেরিদা, দেল্যুজ, সিক্সুর মত উত্তর-কাঠামোবাদী ফরাসী তাত্ত্বিকরা তাঁদের কাজে নীটশেকে ব্যবহার করেছেন নিজেদের মত করে। কখনো সরাসরি নীটশের দোহাই দিয়ে, আবার কখনো আকারে ইঙ্গিতে। উত্তর-কাঠামোবাদীদের নীটশে-পাঠ নিয়ে ‘মূল ধারা’র নীটশে-স্কলাররা কখনো কখনো আপত্তি তুলেছেন। উত্তর-কাঠামোবাদীদের নিজস্ব দার্শনিক প্রকল্পের কথা মাথায় রেখে যাচ্ছেতাই নীটশে ব্যবহারের সমালোচনাও হয়েছে। এই বিতর্ক জারী থাকার পরেও, একথা অনস্বীকার্য যে উত্তর-কাঠামোবাদী তাত্ত্বিকদের কাজে এক বা বহু নীটশে উপস্থিত।


দেরিদার দ্বিকোটিক (বাইনারি) চিন্তার সমালোচনার আবছা উপস্থিতি পাওয়া যায় নীটশের “বিরোধাত্মক চিন্তার” বিচারের মধ্যে। নীটশে ভালো/মন্দ, সত্য/মিথ্যা, সত্ত/ভবন(বিকামিং) এর মত বিরোধাত্মক হায়ারার্কিকে নৈতিকতা, দর্শন ও রিলিজিয়নের ভিত্তি হিসেবে ধরে নেয়ার সমস্যা তুলে ধরেন। দেরিদা তাঁর প্রথম দিককার কাজগুলিতে অধিবিদ্যক চিন্তার লোগোসেন্ট্রিক প্রবণতার বিনির্মাণ প্রচেষ্টায় বারেবারে ফিরে গেছেন এই নীটশের কাছে।


হাইডেগারকে মোকাবিলা করার জন্য নীটশের উপরে ভর করা ফ্রান্সে একটা ট্রেন্ডের মত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। হাইডেগার থেকে দূরত্ব তৈরীর জন্য সম্ভবত আর যে কারুর থেকে, দেরিদা নীটশের উপরে সবচাইতে বেশি নির্ভর করেছেন। দেরিদা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় এই আলোচনা করেছেন যে নীটশে হাইডেগারকে অনেকাংশে র‍্যাডিকালি ছাড়িয়ে যান।


ক্ষমতার সম্পর্কের জেনিওলজি নির্মাণকালে ক্ষমতার সাথে ইচ্ছার(Will) সম্পর্কের উপরে নীটশের যে পর্যালোচনা তার উপরে দাঁড়িয়ে মিশেল ফুকো তার তাত্ত্বিক ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তুত করেছেন। নীটশেকে ব্যবহার প্রসংগে প্রিজন টকে তিনি বলেন,

For myself, I prefer to utilize the writers I like. The only valid tribute to thought such as Nietzsche’s is precisely to use it, to deform it, to make it groan and protest. And if commentators then say that I am being faithful or unfaithful to Nietzsche, that is of absolutely no interest.


নীটশের দার্শনিক কর্ম-কান্ডই যে ফুকোর চিন্তার জমিন তৈরী করে দিয়েছে তা একাধিক জায়গায় তিনি স্বীকার করেছেন। ফুকোর কাজের যে তিনটি কালিক বিভাজন (আর্কেওলজি, জেনেওলজি, এথিক্স) করা হয় তাকে পরবর্তীকালের সংশোধন হিসেবে না পাঠ করে নীটশীয় মাত্রায় দেখা যেতে পারে। নীটশে জ্ঞানের বিভিন্ন শাঁখাকে প্রথাগত সীমার মধ্যে রাখতে নারাজ ছিলেন আর এ কারণেই নীটশের এপিস্টেমোলজি কোথায় শেষ হয় আর পলিটিক্স কোথায় শুরু হয় তার সঠিক নিশানা বের করা যায়না। ফুকো নিজেও তার কাজকে দর্শনের প্রথাগত বর্গে বিবেচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই ত্রিমাত্রিক বিভাজনের দিকে আগানো মাত্রই ফুকোর কাজে নীটশের কাজের অনুরূপ সঠিক সীমানা নির্ধারণ করা যায়না।



দেল্যুজের ম্যাট্রিক্সে ঢোকার জন্য নীটশেকে একটা রাস্তা হিসেবে পড়া যেতে পারে। নীটশের চিন্তা দেল্যুজের হাতে এসে যেই মোড় নেয় তার দিকে মনযোগ দিলেই দেল্যুজের দার্শনিক প্রকল্পে ঢোকার একটা পথ খুলে যায়। দেল্যুজ নীটশেকে পাঠ করেছেন পুরোদস্তুর অ্যান্টি-হেগেলিয়ান হিসেবে। তিনি মনে করতেন নীটশের গোটা কাজকে হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিক্সের প্রত্যুত্তর হিসেবেই দেখা যায়। দেল্যুজকে পড়তে গেলে নীটশের উইল টু পাওয়ারের ডাবল এপ্লিকেশন দেখা যায়।



বিংশ শতকে “ফরাসী তাত্ত্বিক”দের হাতে ফ্রেডরিখ নীটশের যে ইন্টারপ্রেটেশন, এক্সপেরিমেন্টেশন ও এপ্রোপ্রিয়েশন হচ্ছে তা বুঝতে গেলে সর্বাগ্রে এই জার্মান দার্শনিকের শক্ত পাঠ থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে উত্তর কাঠামোবাদী চিন্তার মোড়ক উন্মোচনে নীটশে হতে পারে দুর্দান্ত হাতিয়ার।




তথ্যসূত্রঃ এলান ডি শ্রিফটের Nietzsche’s French Legacy: A GENEALOGY OF POSTSTRUCTURALISM


পাদটীকাঃ এটি কোনো মৌলিক লেখা না। উত্তর-কাঠামোবাদের অলি-গলির সন্ধান করতে গিয়ে আমরা যেই ম্যাটেরিয়ালগুলির সন্ধান পেয়েছি তা থেকে মূলত প্যারাফ্রেইজ করে লেখা। তথ্যসূত্রে তার হদিস দেয়া আছে।



প্রথম প্রকাশঃ ২৬শে জুলাই, ২০১৮

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৬শে জুলাই, ২০১৮

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/641222903243475/