In front of Freud's house. 19 Berggasse, Viennaফেসবুক পোস্টঃ ২৫শে ডিসেম্বর, ২০১৯; লিঙ্কঃ shorturl.at/aeuM0

লৌকিকজ্ঞানের তিরোধানে জ্ঞানহীন লোক / কমনসেন্সের তিরোধানে সেন্সলেস কমন

রাশীদ মাহমুদ



[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশীদ মাহমুদ আমাদের ছেড়ে গেছেন। তাঁর বেশকিছু লেখা ফেসবুকে প্রকাশিত হলে বোধিচিত্তের ফেসবুক পেইজে শেয়ার করা হয়েছিল। সেই লেখাগুলো ধারাবাহিকভাবে সাইটে তুলে রাখা হবে। গত বছরের ২৮শে মে'তে তাঁর ফেসবুক ওয়ালে এই লেখাটি পোস্ট করেন।]



করোনা ভাইরাসের মহাপ্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে লকডাউন অমান্য করা, করোনা পজিটিভ হওয়ার তথ্য গোপন করা, ঈদে বাড়ি যাওয়া, ঈদে কেনাকাটা করা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে আমরা আম জনতার কমন সেন্স নিয়ে নানা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেছি, ট্রল করেছি, ক্ষোভ ঝেড়েছি। আমরা অনেকেই এদেশের মানুষের কমনসেন্স নাই কেন বা কমন সেন্সর এই দশা কেন সেই প্রশ্ন তুলেছি।



আমিও অনেকের মতোই এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়িয়েছি। গত ২৮ মার্চ "উদোর পিন্ডি উদোর ঘাড়ে, বুধোর পিন্ডি বুধোর' শিরোনামে একটি পোস্ট লিখেছিলাম যাতে পরোক্ষভাবে এই প্রশ্নের একটি উপায় খোঁজার চেষ্টা ছিল। আজ একটু প্রত্যক্ষভাবে ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে একই প্রশ্নের ভিন্নতর উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা নিলাম।



যদিও আমি বাংলায় কমনসেন্স বলতে 'কান্ডজ্ঞান' বুঝতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, কিন্তু এই লেখায় কাণ্ডজ্ঞানের পাশাপাশি 'লৌকিকজ্ঞান' শব্দটিও কমনসেন্স বুঝাতে ব্যবহৃত হবে। কমনসেন্সের বঙ্গানুবাদ হিসেবে 'লৌকিকজ্ঞান' ব্যবহার করবার সাহস পেলাম ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহর বরাতে (গুহ ২০১৯, পৃ: ১৬৬-১৮২)। আর রণজিৎ গুহ 'লৌকিকজ্ঞান' নিয়ে বিশেষ উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) যখন যুক্তিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞানের পাশাপাশি 'দয়া' নামক মানবিক অনুভূতির অবশ্যিকতা তুলে ধরেন। রণজিৎ গুহের মতে 'দয়া' একটি অনুভূতি যা লৌকিকজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। কেন? এর উত্তরে আমাদেরকে যেতে হবে লৌকিকজ্ঞানের স্বরূপ নির্ধারণে। তাঁর মতে,

লৌকিকজ্ঞান অভিজ্ঞতা নির্ভর নয়। আর তাই এই জ্ঞান কার্যকারণ বা হেতু নির্ভর নয়। এটি একান্তই অনুভূতিনির্ভর যা সরাসরি যুক্ত মানুষের ভালো-লাগা, মন্দ-লাগার সাথে। অধ্যাপক দিলীপকুমার বিশ্বাস কমনসেন্সের অনুবাদ করেছেন 'সহজ জ্ঞান' হিসেবে (গুহ ২০১৯ পৃ: ১৬৬)। এই জ্ঞান সহজাত, চেষ্টার্জিত নয়। এই জ্ঞান আত্মস্থ যা মানুষের মানুষ হয়ে উঠবার প্রক্রিয়ার সাথেই যুক্ত।



উপরোক্ত আলোচনা বিবেচনায় নিয়ে লৌকিকজ্ঞানকে আমরা চাইলে বোধহয় লোকজ্ঞানও বলতে পারি। কারণ, 'লৌকিক' শব্দটির মানেতো 'লোক সম্বন্ধীয়'। সে অর্থে এটিকে সাধারণ জ্ঞানও বলা যায়। পন্ডিত লুইস কমনসেন্সের যে প্রথম উপাদানটির কথা বলেছেন তা হচ্ছে "এটি স্বাভাবিক মানুষের প্রাথমিক মানসপট" (লুইস:১৯৬৭)। অর্থাৎ, যে জ্ঞান যে কোন মানুষের মধ্যেই রয়েছে তাই কমনসেন্স। মানব বিবর্তনের শুরু থেকেই যুক্তিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞানের সাথে কান্ডজ্ঞান/লৌকিকজ্ঞান/সাধারণজ্ঞান পাশাপাশিই চলতে থাকে বলে অনুমান করা যায়। এদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়তোবা প্রাগৈতিহাসিক কালেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা চূড়ান্ত বিচারে লৌকিকজ্ঞানকে একেবারে বাতিল করে দেয় বলে মনে হয় না। কারণ, লিপির আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত কোনো ধরণের জ্ঞানই জমাট বাঁধতে পারেনি, প্রাতিষ্ঠানিকতার দাম্ভিক বেড়াজাল তৈরী করতে পারেনি। ফলে লৌকিকজ্ঞান সে সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মাঝে-সাঝে প্রান্তিক হয়ে উঠলেও তাকে বাতিল হবার হুমকির সম্মুখীন হতে হয়নি। আর তাই লৌকিকজ্ঞান কখনো যুক্তিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞানের সাথে এক হয়ে আবার কখনো পৃথক হয়ে হলেও নিজের মহিমা ধরে রাখতে পেরেছিলো। আর একথাও সহজে অনুমেয় যে যুক্তিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞানের ভিত্তি তৈরী হয় লৌকিকজ্ঞানের পাটাতনে দাঁড়িয়েই।



গোলোযোগটা বোধহয় একদম স্পষ্ট হয়ে উঠলো লিপির আবিষ্কারের পর। কারণ এর পর থেকেই যুক্তিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞান সর্বাংশে পুঁথিকেন্দ্রিক হয়ে উঠলো। পুঁথিকেন্দ্রিক জ্ঞানরাজ্যে যুক্তিজ্ঞানবাদী ও শাস্ত্রজ্ঞানবাদীগণ জ্ঞানের একমাত্র আধার হয়ে উঠলেন। তাদের উৎপাদিত জ্ঞানব্যবস্থাপনাই জ্ঞান আহরণের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পেতে লাগলো। আর তাদের এই জ্ঞান ব্যবস্থাপনাকে মহিমান্বিত করতে 'সহজাত' জ্ঞানের চেয়ে 'চেষ্টার্জিত' জ্ঞানের সম্মান বাড়াতে তৈরী হলো নানা প্রতিষ্ঠান ও কায়দাকানুন।



সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে লড়তে যেয়ে রামমোহন রায় শুধু যুক্তিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞানের উপর নির্ভর করেননি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর কাছে আবেগের মূল্যও কম ছিল না, যা একান্তই মানুষের সহজাত অনুভূতি। রণজিৎ গুহের মতে, এই তিনের মিলন ছাড়া কেবল যুক্তিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞান নির্ভর বুদ্ধির প্রয়োগ নিছক তত্বজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ থাকে, মানুষের কোনো উপকারে লাগে না (গুহ ২০১৯:১৭২-১৭৩)।



কিন্তু আমরা অধিকাংশ যুক্তিবাদী ও শাস্ত্রবাদীরা মানুষের হিতের চেয়ে নিজের পান্ডিত্য ফলানোতেই বোধহয় বেশি তৎপর। আর তাই আমাদের কাছে লৌকিকজ্ঞান অপরিণতবুদ্ধি হিসেবে ধিক্কৃত। আমরা তাই নৌকায় উঠলে মাঝিকে একে-একে তাঁর পুঁথিগত জ্ঞানের অভাব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে থাকি আর সদম্ভে বলতে থাকি মাঝির জীবন "কত আনা মিছে"। এভাবেই যুক্তিজ্ঞানবাদী আর শাস্ত্রজ্ঞানবাদীরা লৌকিকজ্ঞানকে বাতিল করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে। যুক্তিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞান হয়ে ওঠে বিশেষ জ্ঞান। এই বিশেষ জ্ঞানের চূড়ায় থাকেন দার্শনিক, চিন্তাবিদ, বিশেষজ্ঞ। আর সনদের ওজন অনুযায়ী মাঝে ও তলায় থাকেন পুঁথিনির্ভর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যারা এই দুই জ্ঞানের তল্পিবাহক ও জয়গানকারী। এ কারণেই বোধহয় ইংরেজ দার্শনিক ফান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন:

"দার্শনিকেরা কল্পিত মঙ্গলার্থে কল্পিত নিয়ম তৈরী করেন। তাদের মতবাদগুলো হচ্ছে নক্ষত্রের ন্যায় যা খুব কম আলো দেয়। কারণ, নক্ষত্রের মত তাদের মতবাদগুলোও অনেক উঁচুতে থাকে"।



এই জ্ঞানকল্পের বাইরে যারা থাকে তারা বাতিল হিসেবে গণ্য হয়। তাদের কাজ কেবলই দেহজীবীতা হয়ে ওঠে, যেখানে বুদ্ধির কোন প্রয়োজন নাই বলেই ধরে নেয়া হয়। তাদের জন্য নির্ধারিত হয় শ্রমঘন কাম (কাজ নয়, কারণ তারা কামলা) যার ব্যবহারিক মূল্য অসীম হলেও আমাদের আবিষ্কৃত বিনিময় মূল্যের বাজারে প্রায় মূল্যহীন। নজরুলের কুলি-মজুর কবিতার দু'খানা চরণই তাদের দশা স্পষ্ট করে তোলে:

"আজ নিখিলের বেদনা-আর্ত পীড়িতের মাখি খুন,

লালে লাল হ'য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!



লৌকিকজ্ঞান/কান্ডজ্ঞান/সহজ জ্ঞান/সাধারণজ্ঞান বহুশতক ধরে ধীরে, ধীরে লাঞ্চিত হতে হতে বাতিলের ঘরে। ফলে সাধারণের সবচেয়ে বড়ো আশ্রয়স্থল, সবচেয়ে বড়ো জ্ঞানভাণ্ডার আজ নির্বাসিত। নিজের সহজাত, আত্মস্থ জ্ঞানের উপর ভরসা হারিয়ে মানুষ আজ দিগ্ভ্রান্ত। জ্ঞান রাজ্য এখন যুক্তিজ্ঞানবাদী আর শাস্ত্রজ্ঞানবাদীদের দখল, পাল্টাদখলের কুরুক্ষেত্র। আফসোসের বিষয় হচ্ছে লৌকিকজ্ঞানের তিরোধানে আর সবার মতো যুক্তিবাদীরা ও শাস্ত্রবাদীরাও যে কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছেন তা আমরা বুঝেও না বোঝার ভান করছি। তাদের ব্যবস্থাপনা জ্ঞানকাণ্ডে ব্যবস্থাপকের চাকরিটা যে আমাদের জন্য বাঁধা।



আমিও তেমনি এক ব্যবস্থাপক। কান্ডজ্ঞানহীন।

___________

২৮শে মে, ২০২০


তথ্যসূত্র:

১। গুহ, রণজিৎ (২০১৯) রচনাসংগ্রহ: ইতিহাস-সমাজ-রাজনীতি। কলকাতা:আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

২। লুইস, সি. এস. (১৯৬৭) স্টাডিজ ইন ওয়ার্ডস। কেমব্রিজ: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস।


মূল পোস্টের লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/raasheed.mahmood/posts/10158343011607760

প্রকাশঃ ২শে চৈত্র, ১৪২৭:::ই এপ্রিল, ২০২১