ভারতবর্ষীয় দার্শনিক সঙ্ঘের সভাপতির অভিভাষণ

শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



[ব্রিটিশ ভারতে ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বরে ভারতবর্ষীয় দার্শনিক সঙ্ঘের (Indian Philosophical Congress) প্রথম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কলকাতার সিনেট হলে এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের এই ভাষণটি modern review পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালের জানুয়ারিতে, শিরোনাম ‘The Philosophy of our people’ এবং ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৩৩২ সনের মাঘ সংখ্যায় এটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। বঙ্গানুবাদটি দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় (সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে) এখানে তুলে দেয়া হল। এখানে অবিকল তুলে দেওয়া হয়েছে প্রবাসী’তে ছাপা অনুবাদটি। এবং বানানও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।]



অদ্যকার অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অধিকার করিবার ন্যায়-সঙ্গত দাবী আমার নাই। সুতরাং আপনাদের এই সম্মানটি সম্যক্ উপভোগ করিবার পথে অন্তরায় হইতেছে আমার সঙ্কোচ ও আতঙ্ক। আমার এই ক্ষণস্থায়ী পদোন্নতিতে আশঙ্কার কারণ ত আছেই, উপরন্তু ইহার দরুণ অনেকের বিরাগ বিদ্রূপ অর্জ্জন করারও সম্ভাবনা। এমন অবস্থায় আপনাদের নিমন্ত্রণ প্রতিগ্রহ করা সমীচীন কিনা তাহা ভাবিতেছিলাম। একবার মনে হইল, ডাক্তারের সার্টিফিকেট পেশ করিয়া এ সঙ্কট উৎরাইয়াই [য়-এর উপরের রেফ দেয়া সম্ভব হয়নাই।-বোধিচিত্ত] যাই। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, এই দার্শনিক সমাগমে আমার পদবীর সব চেয়ে কায়েমী স্বত্ব হয়ত আমার দর্শন শাস্ত্রে অনভিজ্ঞতার মধ্যেই নিহিত। এমন হইতে পারে যে, সভাপতি হিসাবে আপনার তেমন লোকটিই চান যিনি নির্ব্বিকারভাবে উদাসীনপন্থী, যিনি অন্তত কোন বিশেষ মতবাদের বশ্যতা জ্ঞানতঃ স্বীকার করেন না, কারণ যাবৎ মতবাদ সম্বন্ধেই তিনি নিরপেক্ষভাবে অনভিজ্ঞ। এক্ষেত্রে আমার গুণাগুণ তুলনামূলক সমালোচনার বহির্ভূত; কারণ তাহা অস্তি নাস্তি দুই বাদেরই বাহিরে এবং হয়ত আমাকে এইস্থানে আনিবারপক্ষে সেটা মস্ত সুবিধার কথা । এ অবস্থায় আমার মনে হয় আমি যেন একটা বাতিদান; বাতির মত তার আলোক বিকীরণের শক্তি নাই বলিয়াই যেন দীপ্তিহীন নিষ্ক্রিয় গাম্ভীর্য্যে অবিচলিত থাকার পক্ষে সে বেশী উপযোগী।



কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এই যে, আপনারা আমায় নীরব থাকিতে দিলেন না, যদিও আমাদের প্রাচীন বিজ্ঞব্যক্তিদের উপদেশ অনুসারে আমার এ অবস্থায় নীরব থাকাই উচিত ছিল। এই দ্বিধা কাটাইয়া আমার পাণ্ডিত্যরিক্ত মনটিকে কথা বলাইতে সাহায্য করিয়াছে একটি জিনিষ। সেটি এই যে, আমাদের ভারতে যাবতীয় বিদ্যা—দর্শন কাব্য যাহা হউক—একটি একান্নবৰ্ত্তী পরিবারের অন্তভূক্ত। স্বাতন্ত্র্যপ্রসূত অসূয়ার বালাই তাহাদের নাই, সুতরাং পাশ্চাত্যসুলভ দণ্ডবিধির সাহায্যে অনধিকার প্রবেশকে ঠেকাইয়া রাখিতে হয় না ।



দার্শনিকপ্রবর প্লেটো তাঁহার আদর্শ গণরাষ্ট্র হইতে কবিদের নিৰ্ব্বাসিত করেন। কিন্তু ভারতবর্ষে দর্শন চিরদিন কাব্যকে মিত্ৰপক্ষীয় বলিয়া আদর করিয়া আসিয়াছে। কারণ এখানে দর্শনের চরম লক্ষ্য সাধারণের জীবনকে অধিকার করা—বিদগ্ধমণ্ডলীর রুদ্ধদ্বার খাসকামরা আশ্রয় করা নহে। এই জন্যই বোধ হয় শঙ্করাচার্য্যের মত দার্শনিকের প্রতিও অনেক কবিতার আরোপ করিতে আমাদের জনশ্রুতি কিছুমাত্র দ্বিধা করে নাই। অথচ এই শঙ্করাচার্য্যকে কোনও আতিথ্যদ্বেষী "ইমিগ্রেশন" আইনের সাহায্যেই প্লেটো তাঁহার আদর্শরাষ্ট্র হইতে বহিষ্কৃত করিতে পারিতেন কিনা সন্দেহ। হয়ত সেইসব কবিতা অধিকাংশই উচ্চ অঙ্গের কাব্য নহে, কিন্তু কবিতা সরবরাহ করাটা তত্ত্বজ্ঞানীর পক্ষে একটা অপরাধ বা রুচিবিগর্হিত ব্যাপার বলিয়া কোন কাব্যামোদী দোষারোপ করেন না।



আমাদের জনসাধারণ সহজেই তত্ত্বদর্শীকে কবিত্বের অধিকার দিয়া থাকে যখন তাঁহার ধীশক্তি প্রজ্ঞার আভায় প্রদীপ্ত হইয়া উঠে। আমাদের মহাকাব্য মহাভারত ইহার সাক্ষী। বিশ্বসাহিত্যে ইহা অতুলনীয়। ছোট বড় কত রকমের মানব চরিত্র, কি অসভূত বৈচিত্র্যে, কত বিভিন্ন স্তরের মনস্বত্ত্বে ছত্রে ছত্রে ফুটিয়া উঠিয়াছে! কিন্তু শুধু তাহাই নহে; কত নীতি, রাষ্ট্ৰীয় ও আধাত্ম্য তত্ত্বের বিচারবিন্যাস এই মহাভারতের উদার(?) আয়তনে কেমন সহজে আশ্রয় পাইয়াছে ! এই অমিতাচারী ঔদার্য্যের ফলে কাব্য তার নিজস্ব সীমা লঙ্ঘন করিবার বিপদ স্বীকার করিয়াছে। কিন্তু ইহাও সম্ভব হইল ভারতবর্ষে; কারণ এখানে সাহিত্যের বিভিন্ন গোষ্ঠী এক বিরাট্ সাধারণতন্ত্রে (Communism) বিধুত। বস্তুত মহাভারত যেন একটি ব্ৰহ্মাণ্ড বিশেষ; ইহার মধ্যে কত বিচিত্র মানস সৃষ্টি, অসংখ্য গ্রহনক্ষত্রের মত জটিল-বিষম ছন্দে নৃত্য করিয়া ফিরিবার যথেষ্ট অবকাশ পাইয়াছে। একজন বিশেষ কবির খামখেয়ালী ইহাতে নাই, সমগ্র জাতির সাধারণ মনোভাব এখানে দেখিতে পাই। আমাদের এই জাতিটি বিচিত্র তর্কবিতর্ক জটিল পন্থা আশ্রয় করিয়া সেই ভাবলোকে ভ্ৰমণ করিতে ক্লান্তি বোধ করে না যাহা অসংখ্য উপাখ্যানের উপগ্রহপরিবেষ্টিত একটি মহাআখ্যায়িকার সৌরমণ্ডল বলিলেই হয়।



মুসলমানযুগেও এই ভারতে যে-সব সাধুসন্ত আবির্ভূত হইয়াছেন, তাঁহারা প্রায় প্রত্যেকেই গীতরসিক। তাঁহাদের গান ভাবের আগুনে দীপ্তিমান, তাঁহাদের ধৰ্ম্মবোধ তত্ত্বজ্ঞানের মৰ্ম্মস্থল হইতে উৎসারিত, মানবের চিরন্তন প্রশ্নগুলি ও জীবনের চরম সার্থকতা লইয়া তাঁহাদের কারবার। হয়ত ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কোন কথা নাই। কিন্তু যখন দেখি যে তাঁহাদের সেই সমস্ত বাণী,সমস্ত সঙ্গীত কেবলমাত্রে শিক্ষিত পণ্ডিতমণ্ডলীর জন্য নহে, তাহা গ্রামে গ্রামে নিরক্ষর নরনারীর আদরের ধন, তখন বুঝিতে পারি দর্শন বস্তুটি কি গভীরভাবে আমাদের সাধারণের মগ্নচৈতন্যলোকে প্রবেশ করিয়াছে এবং সমস্ত জীবনকে ওতপ্রোতভাবে পরিব্যাপ্ত করিয়াছে।



শৈশবে মনে পড়ে একজন ভক্ত হিন্দু গায়কের মুখে কবীরের এই গানটি শুনিঃ


পানীমে মীন পিয়াসী রে

মুকো শুনত শুনত লাগে হাঁসী রে।

পূরণ ব্ৰহ্ম সকল ঘট বরতে;

ক্যা মথুরা ক্যা কাশীরে।



কবীরের এই উচ্চ হাস্য সেই হিন্দুগায়কের ধৰ্ম্মনিষ্ঠায় এতটুকুও আঘাত করে নাই। বরং কবীরের সঙ্গে তিনি একাত্ম ; কারণ, তত্ত্বজ্ঞান যে তাঁহার মনকে মুক্তি দিয়াছে এবং তিনি বুঝিয়াছেন তীর্থ হিসাবে মথুরা বা কাশীর প্রতীকগত তাৎপর্য্য থাকিলেও চিরন্তন সত্য হিসাবে তাহাদের স্থান নাই। সুতরাং উক্ত স্থানদ্বয়ে তীর্থযাত্রা করিতে উন্মুখ হইলেও তিনি নিঃসংশয়ে জানেন যে ব্রহ্মের সৰ্ব্বব্যাপিত্ব সাক্ষাৎভাবে উপলব্ধি করিবার শক্তি যদি তাঁহার থাকিত তাহা হইলে কোন বিশেষ স্থানে যাইয়া ধৰ্ম্মবোধ জাগাইবার কোন প্রয়োজনই হইত না। তবে যে সমস্ত ধৰ্ম্মমন্দিরে কত যুগ ধরিয়া কত সাধকের ভজন পুজন কেন্দ্রীভূত হইয়াছে, তাহার উদ্বোধিনী শক্তিটি তাঁহার মত সাধকের তেমনই প্রয়োজন বলিয়া তিনি স্বীকার করেন যেমন প্রয়োজন আমাদের আবহমানকাল প্রচলিত মন্ত্রের, যে মন্ত্র বহুযুগের ভক্তসাধকের কণ্ঠস্বরে প্রাণবান্ হইয়া আমাদের প্রাণকে সহজে উদ্বোধিত করিতে পারে।



পূৰ্ব্ববঙ্গের একটি গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই—সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। তিনি গাহিলেন;


মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমীন;

শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম;

আর পয়দা করিয়াছে ঠাণ্ডা আর গরম।

নাকে পয়দা করিয়াছে খুষবয় বদবয়।



এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনই ভাবে বলিয়াছেন যে, যে-পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আদিত্যমণ্ডলে অধিষ্ঠিত।


রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে।

আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে॥



এই সব তত্ত্ব-সঙ্গীতের বিশেষত্ব এই যে, ইহা গ্রাম্য সাধারণের ভাষায় লিখিত এবং নিতান্ত অমার্জ্জিত বলিয়া উচ্চ সাহিত্য কর্ত্তৃক অবজ্ঞাত। এইসব গ্রাম্য গায়কেরা তত্ত্ববিদ্যার কোন ধার ধারেন না, সেটা তাঁহারা বেশ একটু জোরের সঙ্গেই বলিয়া থাকেন। এমনি একটি কবির কিম্বদন্তী আছে যে, বৈষ্ণব রসতত্ত্বের ব্যাখান শুনিয়া তিনি এই গানটি রচনা করেনঃ


ফুলের বনে কে ঢুকেছেরে সোণার জহরি

নিকষে ঘসয়ে কমল আ মরি মরি।



বাউল সম্প্রদায় আমাদের বাঙলার সেই শ্রেণীর হইতে আসিয়াছে যাহারা প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত নয়। আমি তাহাদের গান কতকগুলি আমায় লিখিয়া দিতে অনুরোধ করায় দেখি তাহার বেশ একটু বিব্রত হইয়াছিল; শেষে যখন ভরসা করিয়া লিখিল, আমি তাহার পাঠোদ্ধার করিতে যাইয়া হতাশ হইলাম, তাহাদের বানান ও অক্ষরবিন্যাস এমনই অপ্রত্যাশিত রকম অসনাতনী। কিন্তু এই সব কবি-বাউলদের সাধন পদ্ধতি মানবদেহতত্ত্বের ষে অতীন্দ্রিয় অনুভূতির উপর প্রতিষ্ঠিত, তাহা জটিল ও দুরবগাহ। ইহারআ পথে বিপথে তাহাদের গান গাহিয়া ফেরে; আমার পথের ধারের জানালা হইতে একটি গান বহুকাল পূৰ্ব্বে শুনি, কিন্তু এখনও মনের মধ্যে গাথা হইয়া আছে।



খাচার মধ্যে অচিন পাখী কম্‌নে আসে যায়,

ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম তারি পায়।



এই গ্রাম্য কবি দেখি উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে একমত; আমাদের বাক্য ও মন ভূমাকে ধরিতে যাইয়া প্রতিনিবৃত্ত হয়, তবু সেই প্রাচীন ঋষিগণের মত এই গ্রাম্য কবি অসীমের অভিসার হইতে নিরস্ত নন; বরং এই দুঃসাহসিক ব্ৰতে সার্থক হইবার একটা পন্থা আছে তাহার ইঙ্গিত করিতেছেন। ইহা শেলীর সেই কবিতাটির কথা স্মরণ করায় যাহাতে তিনি সুন্দরের অতীন্দ্ৰিয় আবেশের বন্দনা গাহিয়াছেন।



সেই অজানা দুরধিগম্য হুইলেও যেসকল সত্যের মূল সত্য, তাহা এই বিখ্যাত ইংরেজ কবি এবং এই অজ্ঞাতনামা বাঙালী বাউল উভয়েই বুঝিয়াছেন। সেইজন্য তাহার গ্রাম্য সঙ্গীত সেই অজানা পাখীর ডানার ছন্দে মুখরিত। শুধু এই প্রভেদ যে শেলীর ভাষা জনকয়েক শিক্ষিত লোকের জন্য--আর এই বাউল গান গ্রামের চাষী ও সৰ্ব্বসাধারণের, যাহার এই গানের আধ্যাত্মিক অতি আধ্যাত্মিক অতি-বাস্তবতায় অতিষ্ঠ হইয়া উঠে না।



একটি কারণে এসমস্ত সম্ভব হইয়াছে; লোকশিক্ষার ষে আশ্চর্য্য প্রণালী বহুকাল ধরিয়া ভারতে চলিয়া আসিয়াছে তাহাই সমস্ত বিকাশের মূলে; কিন্তু তাহা আজ ধ্বংসোন্মুখ। আমাদের প্রাক্তন বিদ্যায়তনগুলিতে দলে দলে ছাত্ৰগণ নানা দেশ হইতে আসিয়া প্রসিদ্ধ অধ্যাপক ও আর্য্যগণের চারিদিকে সমবেত হইত। সেই শিক্ষাসত্রগুলি গভীর ও স্থিরসলিল হ্রদের মত; সেখানে আসিতে হইলে দুর্গম পথ অতিবাহন করিতে হয়। কিন্তু সেই সব জলাশয় হইতে প্রতিনিয়ত বাম্পোদগম হইয়া যে সব মেঘ জন্মিত, তাহা বায়ুভরে কত প্রান্তর পর্ব্বত উপত্যকার উপর দিয়া সমগ্র দেশে পরিব্যাপ্ত হইত। পৌরাণিক কাহিনীকে অবলম্বন করিয়া কত গীতিনাট্য, কথক-শিল্পীর মুখে কত বিচিত্র উপাখ্যান কথা, ভিক্ষুক বাউল গায়কের মুখে লোকসাহিত্যের কত অমূল্য গীতসম্পদ দেশে বিদেশে প্রচারিত হইত; এবং এই মেঘপুঞ্জই ত জনসাধারণের চিত্তক্ষেত্রকে সুসিঞ্চিত ও উৰ্ব্বর করিয়া তুলিত এবং যে সমস্ত তত্ত্ব মূলতঃ অতি কঠিন তাহা সাধারণগম্য করিত। সাংখ্যযোগ ও বেদান্ত দর্শনের গভীর মতবাদগুলি লোকসাহিত্যে রূপান্তরিত হইয়া প্রাণের ফসল ফলাইত এবং যে অগণ্য নরনারী শিক্ষা ও অবসরের অভাবে কোন দিনই সেই তত্ত্ববিদ্যার মুল উৎসে যাইতে পারিত না, তাহাদেরও গৃহদ্বারে সেই তত্ত্বগুলিকে উপস্থিত করিত।



সভ্যতাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের নানা জটিল কর্ম্মভার বহিবার জন্য এক দল লোককে বাস্তব অভাবাদি দূর করিবার ভার লইতে হয়। সে দায়িত্ব যতই গুরুতর হউক না কেন, তাহা এড়ান চলে না। সুতরাং এই সব মানুষদের পক্ষে মানসিক উন্নতি সাধন করার সুযোগ হয় না। এই ভাবে বিরাট্ জনসঙ্ঘ শুধু পণ্য উৎপাদনের চাপে লুপ্তচৈতন্য যন্ত্রমাত্রে পর্য্যবসিত হয় বলিয়াই কয়েক জন মানুষ বড় ভাব ও অমর শিল্পরূপের স্ফুরণ করে এবং বিশ্বমানবকে অধ্যাত্মসাধনার উত্তঙ্গ শিখরে লইয়া যায়।



সমাজের জন্য এই যে সকল ব্যক্তি আত্মবলিদান দিয়াছেন, তাঁহাদিগকে ভারত কোন দিন উপেক্ষা করে নাই, তাঁহাদের জীবনব্যাপী শ্রমের ভীষণ অন্ধকারের উপর আলোকপাত করিতে চেষ্টা করিয়াছে এবং নানা অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়া মানসিক ও আধ্যাত্মিক খাদ্য তাঁহাদের উপযোগী করিয়া তাঁহাদের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছে এবং সহজ কৰ্ত্তব্য-বোধেই তাহা করিয়াছে। কোন বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বারা এই কাজটি হয় নাই; কিন্তু স্বতঃস্ফূৰ্ত্ত সামাজিক ব্যবস্থার ফলেই ইহা জীবদেহে রক্তপ্রবাহের মত সৰ্ব্বত্র সঞ্চারিত হইয়াছে। এই জন্যই তাহার মূল উদ্দেশ্যটি চাপা পড়িলেও কাজটি চলিতেছে।



এক সময় আমি বাঙলার একটি সামান্য গ্রামে যাই। সেখানে প্রধানত মুসলমান চাষীদের বাস। গ্রামবাসীরা আমার জন্য একটি যাত্রা গানের পালা অভিনয় করে। সে নাট্যের আখ্যানবস্তু একটি লুপ্তপ্রায় ধৰ্ম্মপন্থীদের শাস্ত্র হইতে আহরিত, একদা সেই ধর্ম্মের বিস্তৃত প্রভাব ছিল। সে ধৰ্ম্ম আজ প্রাণহীন, তবু তাহার বিশেষ বাণী জনসাধারণের নিকট ইহার নিজস্ব তত্ত্বটি প্রচার করিতেছে এবং শিক্ষা ও সংস্কারে সেই লোকেরা ভিন্ন হইলেও সে বাণী শুনিতে তাহাদের বিতৃষ্ণা নাই। এই সম্প্রদায়ের বিশেষ মতবাদ অনুসারে উক্ত গীতি-নাট্যটি মানবস্বরূপের বিভিন্ন উপাদান, তাহার দেহ, অহংবোধ ও আত্মা লইয়া বিচার করিয়া চলিল। পরে কথোপকথন ব্যপদেশে একটি মানুষের ইতিহাস বিবৃত হইল। মানুষটি রসকুঞ্জ বৃন্দাবনে যাইতে চায় কিন্তু এক প্রহরী পথরোধ করিয়া তাহার বিরুদ্ধে চৌর্য্যাপরাধ উপস্থিত করিল। স্তম্ভিত হইয়া মানুষটি প্রশ্ন করায় প্রহরী তাহাকে অপরাধী প্রমাণ করিয়া দিল, যেহেতু যাত্ৰীটি তাহার গাত্রাবরণের মধ্যে অতি সঙ্গোপনে তাহার অহংটিকে অবৈধপণ্য হিসাবে বৃন্দাবনে আম্‌দানি করিতে উদ্যত; অহং বস্তুটি ষে মালিকের, তাহার নিজের নয়, সেটা সে স্বীকার করে নাই! সেই বমালশুদ্ধ ধরা পড়ায় অপরাধীর নিকট তায় কল্পলোকের পথ অবরুদ্ধ। বাঁশের উপর ছিন্ন সামিয়ানা খাটাইয়া, ধোঁয়াটে কেরোসিনের আলোয় গ্রামের লোক ভিড় করিয়া শুনিতেছে, মধ্যে মধ্যে ধান্যক্ষেত্র হইতে শৃগালের পাল চীৎকার করিয়া রসভঙ্গ করিতেছে। রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসে, তবু শ্রোতাদের ঔৎসুক্যের অন্ত নাই। তাহারা নাটকটির অভিনয় দেখিতেছে এবং আপাত-বিসদৃশ নৃত্যগীত ও হাস্যপরিহাসের আবেষ্টনে মানব-জীবনের অনেক চরম সমস্যা ও তাৎপর্য্যের ব্যাখ্যান চলিতেছে।



এই উদাহরণগুলি হইতেই বুঝা যাইবে, ভারতে কাব্য ও দর্শন কেমন হাত ধরাধরি করিয়া চলিয়াছে। জীবনে পূর্ণতা লাভের সহজ ও সম্ভব পথটি মানুষকে ধরাইয়া দিবার দায়িত্ব দর্শন গ্রহণ করিয়াছে বলিয়াই এটি ভারতে সম্ভব হইয়াছে। সে পূর্ণতার অর্থ কি ? ইহার অর্থ সত্যের মধ্যে মুক্ত, যাহার জন্য এই প্রার্থনা জাগিয়াছে—অসতো মা সদ্‌গময়—কারণ যাহা সত্য, তাহাই আনন্দ।



আমি ছন্দ-শিল্পী । কাব্য-কারবারের ভিতর দিয়া আমি সত্যের একটি আনন্দরূপ উপলব্ধি করিয়াছি। চিত্তের মুক্তিপথ দিয়া সত্যেব আস্বাদ আমাদের দান করাই সমস্ত শিল্পের মূল প্রকৃতি। সেই সম্বন্ধটি মনে রাখিয়া যখন আমরা সৌন্দর্য্যতত্ত্বের (aesthetics) কথা বলি, তখন সৌন্দর্য্যের সাধারণ সংজ্ঞা ছাড়িয়া তাহাতে কবিগণ যে গভীরতর তাৎপৰ্য্য দিয়াছেন সেই কথাই ভাবি : “সত্যই সুন্দর এবং সুন্দরই সভ্য।” চিত্র-শিল্পী একটি জরাজীর্ণ মানুষের ছবি আঁকিলেন; ইহা দেখিতে শোভন নয়, তথাপি তার সেই ছবিখানি ছবি হিসাবে সম্পূর্ণ হইয়া উঠে যখন আমরা তাহার সত্য মূর্ত্তিটি গভীরভাবে অনুভব করি। ব্রাউলিঙ্এর কবিতায় ঈর্ষাউন্মত্ত যে নারীটি বিষ প্রস্তুত হইতে দেখিতেছে এবং সেই বিষ তাহার প্রেমঈর্ষার পাত্রীটিকে কি ভাবে জর্জ্জর করিবে তাহা কল্পনায় উপভোগ করিতেছে—এ-হেন নারীর মনকে সুন্দর বলা যায় না। কিন্তু যখন এই নারীর ছবিটি পরিকল্পন ও রূপস্ফূরণের সুসঙ্গতিতে আমাদের চোখের সম্মুখে জীবন্ত সত্য হইয়া উঠে, তখন আমরা এই ছবিও উপভোগ করি। মহাভারতে বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণের চরিত্রে মধ্যে মধ্যে যে নীচতা প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে—তাহার দরুন শিল্পসঙ্গতির আনন্দ ইহাতে আমরা যতটা পাই, কেবল মাত্র অবিমিশ্র ঔদার্য্যের আদর্শ চিত্র হইতে ততটা পাইতাম না। নৈতিক আদর্শের পূর্ণতাটি নানা বিসংবাদী রসের দ্বারা প্রতিহত হইয়াছে বলিয়াই উক্ত চরিত্রটি আমাদের কাছে সত্য হইয়া উঠিয়াছে এবং সেইজন্যই ইহা আমাদের আনন্দ দেয়, প্রীতিকর বলিয়া নহে, সৃষ্টির ছন্দে সুনির্দিষ্ট বলিয়া।



জীবনে যাহা আমাদের মিলে না তাহা শিল্পের ভিতর দিয়া আমরা কতকটা উপভোগ করি বলিয়াই যে শিল্পের এত মূল্য তাহা সম্পূর্ণ সত্য নহে। শিল্পের আসল মূল্য এইখানে যে তাহার বিচিত্র সৃষ্টির ভিতর দিয়া ইহা আমাদের সঙ্গে সত্যের সাক্ষাৎ পরিচয় স্থাপন করিয়া দেয়। সেই শিল্প সৃষ্টিগুলি আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্যের সঙ্গে হুবহু মিলিয়া যাইবার দরকার নাই, তাহারা আমাদের উপলব্ধির মধ্যে সত্য হইয়া উঠিলেই আনন্দ দেয়। শিল্পের জগতে আমাদের চেতনা ও অনুভূতি স্বার্থবন্ধন হইতে মুক্ত বলিয়াই আমরা ঐক্য ও সঙ্গতির একটি অপ্রতিহত স্বপ্নরূপ উপভোগ করি; পূর্ণসত্যের মানসীপ্রতিমা বলিয়াই তাহা চিরন্তন আনন্দের উৎস।



শিল্পীর জগতে যে নিয়ম, বিধাতার জগতেও তাই; সৃষ্টির উৎস ও চরম লক্ষ্য যে নিঃস্বার্থ আনন্দ, তাহা লাভ করিতে হইলে অহমের কবল হইতে মুক্ত হওয়া চাই। সেই মুক্তির প্রতীক্ষায় আমাদের আত্মা উন্মুখ হইয়া আছে। এবং তাহার যে তৃ’ষত আমিটা আপাত সত্যের মৃগতৃষ্ণকার পিছনে ছুটিয়া মরিতেছে, তাহাকে সত্যের ঐক্যলোকে মুক্তিদিবার জন্য ক্ৰন্দন করিতেছে। এই মুক্তির আদর্শটি আমাদের তত্ত্বজ্ঞানের ভিত্তিকে আশ্রয় করিয়া আছে ইহা ভারতের জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করিয়াছে এবং আমাদের সমস্ত ভাবপ্রেরণা ও প্রার্থনাকে উৎসারিত করিয়া দিব্য লোকের পানে ছুটাইয়াছে; কাব্য পক্ষপুটে ভর করিয়া আমাদের আত্মা উৰ্দ্ধে উড়িয়া যায়। সহজবিশ্বাসী তুচ্ছশিক্ষিত কত লোক দেখি তাহাদের প্রার্থনা মুক্তিদায়িণী তারাকে নিবেদন করিয়া গাহিতেছে—


তারা, কোন্ অপরাধে দীর্ঘ মেয়াদে সংসার-গারদে থাকি বল্।



আমাদের দেশের এই সব সাধারণ মানুষ সত্যের জগৎ হইতে বিচ্যুত হইবার ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত; বস্তু-জগতের ফেনপুঞ্জের মধ্যে একটানা ভাসিয়া যাওয়া, পুলক-বেদনার তরঙ্গভঙ্গে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হওয়া, জীবনের কোন চরম খুঁজিয়া না পাওয়া, ইহার মত আতঙ্কের বিষয় তাহাদের আর কিছু নাই। ইহাদের মধ্যে কেহ গাড়োয়ান হাটে গাড়ী হাঁকাইয়া যায়, কেহ বা জেলে মাছ ধরিয়া বেড়ায়। তাহারা যে সকল গান গায় তাহার গভীর অর্থ সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে তাহারা খুব সম্ভব উপযুক্ত জবাব দিতে পারিবে না, কিন্তু তাহাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলে বুঝিতে পারা যায় যে, একটি বিষয়ে সেখানে কোন সন্দেহ নাই। সেটি এই যে, সমস্ত দুঃখের কারণ জীবনের আসবাব্ পত্রের অভাব নয়, জীবনের সভ্য তাৎপর্য্য সম্বন্ধে চেতনার অভাব। এই জন্যই দেখি যে “আমি ও আমার” এই ভাবটার উপর অযথা জোর দিলেই আমাদের দেশের লোক তাহার নিন্দা করিয়া থাকে, কারণ “আমি ও আমার” উগ্ৰবোধটা সত্যের পরিপ্রেক্ষণকে অলীক করিয়া তোলে। তাহারা যে দেখিয়াছে, সংসারের সমস্ত সম্বল পিছনে ফেলিয়া দিয়া সত্যের অভিসারে বাহির হইয়াছে কত মানুষ, যাহাদের সামাজিক পদবী বা মানসিক বিকাশ সাধারণের উপরে যায় না।



এই সকল দুর্গমপথ-যাত্রীদের যে পার্থিব শক্তি সম্পদ্ বাড়াইবার দিকে লক্ষ্য নাই, তাহারা যে মুক্তির ভিখারী, সেকথা আমাদের দেশের লোক বোঝে। তাহারা হয়ত এমন মানুষকে দেখিয়াছে, যে তাহাদেরই মত দরিদ্র এবং গ্রামে তাহাদের সঙ্গে এক ব্যবসায়লিপ্ত। সে তাহার দৈনন্দিন কাজ করিয়া সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছে, তবু তাহার সম্বন্ধে মানুষের ধারণা যে সে একজন মুক্তজীব—শাশ্বত পুরুষের হৃদয়ে সে আশ্রয় পাইয়াছে। এমন একটি মানুষ একবার আমার চোখে পড়িয়াছিল; সে একটি জেলে, সারাদিন গঙ্গায় মাছ ধরিয়া ফেরে আর তন্ময় হইয়া গান গাহিয়া যায়; একজন মাঝি তাহাকে ভক্তিভরে দেখাইয়া বলিল, উনি মুক্তপুরুষ। সমাজ মানুষের উপর যে মামুলী মূল্য নিৰ্দ্ধারণ করিয়া থাকে, এ-লোকটি তাহার উর্দ্ধে উঠিয়া গিয়াছে; বাজার দর অনুসারে দোকানে সাজান পুতুলের মত মানুষকে সমাজ যে ভাবে সাজায়, তার কোন কোটায় এ লোকটি পড়ে না।



এই জেলেটির মুখ যখন মনে পড়ে, তখন না ভাবিয়া থাকিতে পারি না যে, বন্ধন-মুক্ত আত্মার মহাকাব্য যাহারা জীবন দিয়া রচনা করিয়া যায়, তাহাদের সংখ্যা হয়ত নিতাস্ত কম নয়—যদিও ইতিহাসে তাহাদের নাম কখনও দেখিব না। এই সব অবিকৃত আত্মা সামান্য চাষাভূষা জানে যে, সম্রাট্ তাহার সাম্রাজ্যের সঙ্গে শৃঙ্খলিত হইলে বিচিত্ৰবেশী ক্রীতদাস মাত্র; লক্ষপাত তাহার কৰ্ম্মফলে সোনার খাচায় বন্দী, কিন্তু ঐ সামান্য জেলেটি জ্যোতির্লোকে মুক্তি পাইয়াছে।



যখন অন্ধকারে হাত বাড়াইয়া ফিরিতেছি, তখন কোন একটি জিনিষে ঠোক্কর খাইয়া সেইটিকে আঁকড়াইয়া ধরি এবং তাহাকে আমাদের একমাত্র আশা ও নির্ভরস্থল মনে করি। কিন্তু যখন আলোকের প্রকাশ হয়, তখন ঐ সমস্ত টুকরা টুকরা বস্তুকে ছাড়িয়া দিই। কারণ দেখি যে ভূমার সঙ্গে আমরা সকলে সম্বন্ধযুক্ত, বস্তুগুলি ত তার অংশমাত্র। গ্রামের সামান্য লোকেরা জানে মুক্তি কি জিনিষ—অহমের বিচ্ছন্নতা হইতে মুক্তি, যাহা হইতে আমাদের অত্যুগ্র অধিকার বোধ জাগে সেই বস্তুর ভেদলিপ্সা হুইভে মুক্তি। তাহারা জানে যে কেবল মাত্র বন্ধন অস্বীকার করিলেই মুক্তি আসে না, সম্পদের হ্রাস হইলেও নয়-মুক্তি আছে আস্তিক্যবোধের সাধনে, তাহার সিদ্ধি প্রাণে বিশুদ্ধ আনন্দের প্লাবন বহাইয়া দেয়, তাই গান উঠে:


যে জন ডুব্‌ল সখী তার কি আছে বাকি গো

তাই ত ইহারা গাহিয়া থাকে :

মনরে আমার মনের সাথে মিল্‌বি যদি আয়

দুই মনেতে এক মন হয়ে আজ্জব সহর চলে যাই।



এক মন আমারে বাহিরে এই বৈচিত্র্যের রাজ্যে নানা বস্তু খুঁজিয়া ফেরে আর এক মন ভিতরে ঐক্যের স্বপ্নমূৰ্ত্তির সন্ধানে ছোটে—এই দুই মনের মধ্যে দ্বন্দ্বটি যখন মিটিয়া যায়, তখনই আমরা ‘আজব’কে, অনিৰ্ব্বচনীয়কে উপলব্ধি করি। কবীরও এই সত্যটির প্রচার করিয়াছেন।



পরব্রহ্ম কেবল মাত্র অন্তরের অধ্যাত্ম লোকে বাস করেন ইহা বলিলে বাহিরের এই বস্তুলোকের অপমান করা হয় এবং যখন তাঁহাকে কেবল মাত্র বাহিরে নির্দেশ করি তখনও সত্য বলি না।



এই সব বাউল গায়কদের মতে সত্য ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং মুক্তি ঐক্যের সাধনে। আমাদের দৈনিক আরাধনা ও ধ্যানের মন্ত্ৰাদি মনকে সেই শিক্ষা দিতে চেষ্টা করে যাঁহাতে মনকে বিশ্ব হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার যত ব্যবধান আছে সব জয় করিতে পারা যায় এবং তাঁহাকে চিনিতে পারা যায় যিনি অদ্বৈতম্ বলিয়াই অনন্তম্। গভীর তত্ত্বজ্ঞান বাষ্পের মত ভারতের জনসাধারণের চিত্তে সৰ্ব্বত্র পরিব্যাপ্ত হইয়া আমাদের দৈনন্দিন প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানাদি জাগাইয়াছে। এই জ্ঞান প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়া দিতেছে এই সৃষ্টিপ্রপঞ্চের বাহিরে চলিয়া যাইতে; কারণ এখানে তথ্য মাত্র তথ্য বলিয়া আমাদের কাছে বিদেশী সঙ্গীতের ধ্বনির মত অপরিচিত। কিন্তু স্বরগ্রামের সহিত পরিচয় হইলে যেমন আমরা তাহাদের ঐক্যটিকে সঙ্গীতরূপে পাই; তেমনি অন্তহীন বহু যেখানে এককে প্রকাশ করে, সেই সৰ্ব্বভূতের অস্তরতম সত্যের মধ্যে মুক্তি লাভ করিবার পরামর্শ এই জ্ঞান হইতে আসে।



এই মুক্তি একমাত্ৰ সত্যেই আছে, সত্যাভাসে নাই; সেইজন্য ফলপ্রাপ্তির লোভ তাড়াতাড়ি যে সার্থকতার পথ কাটিয়া বসে। তাহা ঠিক পথ নহে, একজন নগণ্য গ্রাম্য কবি, যাহাকে বিশ্বের মান্যগণ্য লোকেরা কেহ জানে না, যাহার মনের উপর সরকারী শিক্ষাবিভাগ তাহার ছাঁচেঢালা শিক্ষার নিগড় চাপায় নাই, সেই মানুষটি গানের ভিতর দিয়া ঐ পরম সত্যের ইঙ্গিত করিয়াছে।



নিঠুর গরজী

তুই কি মানস-মুকুল ভাজ্‌বি আগুনে ?

তুই ফুল ফুটাবি, বাস ছুটাবি সবুর বিহনে।

দেখ্‌না আমার পরম গুরু সাই,

সে যুগ যুগান্তে ফুটায় মুকুল তাড়া হুড়া নাই।

তোর লোভ প্রচণ্ড, তাই ভরসা দণ্ড;

এর আছে কোন্ উপায় ?

কয় সে মদন, দিস্‌নে বেদন, শোন নিবেদন,

সেই শ্রীগুরুর মনে,

সহজ ধারা আপন হারা তাঁর বাণী শোনে,

রে গরজী।



কবি জানেন জোর করিয়া মুক্তি লাভের কোন বাহ্য উপায় নাই। অন্তরের সাধনপ্রক্রিয়ায় নিজেদের উৎসর্গ করিয়া হারাইতে পারিলেই তবে মুক্তির দিকে যাওয়া যায়। বন্ধন তার অসংখ্য রূপে আমাদের এই অহমের মধ্যেই কেল্লা গড়িয়া বসিয়াছে। তাহা বর্হিজগতে নাই। বন্ধন রহিয়াছে আমাদের চৈতন্যের নিম্প্রভতায়, আমাদের দৃষ্টিরাজ্যের সঙ্কীর্ণতায় এবং সৰ্ব্বত্র আমাদের স্থায়ী মূল্য নিৰ্দ্ধারণের ভ্ৰমে।



ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাই আমাদের বর্ত্তমান সভ্যতার মধ্যে; এই সভ্যতা এক নিরবচ্ছিন্ন অভাবের তাড়নায় চালিত; এই যে দুৰ্দ্দমনীয় গতিবেগের অন্ধশক্তি (inertia), যাহা কোথায় কেমন করিয়া থামিতে হয় তাহা জানে না—এই আপাতমুক্তিকেই সত্য মুক্তি বলিয়া মানুষ ভ্ৰম করিতেছে। কোন কোন বর্ব্বর জাতি মানুষের মাথার খুলির উপর একটা মনগড়া মূল্যের আরোপ করিয়া থাকে এবং সেই সম্বন্ধে তাহাদের গাণিতিক উন্মত্ততা এমনই বাড়িয়া যায় যে, তাহারা নরমুণ্ড সংগ্ৰহ করিয়া আর শ্ৰান্ত হয় না। নিষ্ঠুর নিয়তি যেন তাহাদিগকে একটা অন্তহীন বাড়াবাড়ির পথে টানিয়া লইয়া যায় এবং তাহারা কেবলই যোগের পর যোগ দিয়া ছুটিতে থাকে। এই বীভৎস সংগ্রহের পথে যে অবাধ স্বাধীনতা তাহা ঘূণ্যতম বন্ধনেরই নামান্তর। ইহাদের এই নিষ্ঠুর দাবীর তাড়না কেবল বাড়িয়াই চলে, কারণ যে বস্তু তাহাদের লক্ষ্য ও কাম্য তাহা সত্যের উপর নির্ভর করিয়া নাই। সেইরূপ এ কথাটাও আমাদের মনে রাখা উচিত যে, কেবল মাত্র গতিবেগকে বাড়াইয়া, তামসিক ভোগের আড়ম্বর ও আসবাব পৰ্ব্বতপ্রমাণ করিয়া, প্ৰাণহিংসার যাবতীয় উপাদান ও অন্ত্রশস্ত্রের বিভীষিকা বিপুল করিয়া তুলিয়া, যাহা মহান্, যাহা বিরাট্ তাহার একটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কদর্য্য পরিহাসোৎসব মাত্র করিতেছি। বন্ধনের শৃঙ্খল কেবলই বাড়িয়া চলিতেছে এবং একটা নিরর্থক নিরবচ্ছিন্ন অভাব ও দাবীর তাড়না সমস্ত পৃথিবীকে শৃঙ্খলিত করিতে উদ্যত হইয়াছে।



খৃষ্টীয় ধৰ্ম্মতত্ত্বে দেখি, যে, জন্মগত একটি শাস্তি হইতে নিস্তার লাভই মুক্তি। ভারতে মুক্তি হয় আবিষ্কার অজ্ঞানের অন্ধকারা হইতে, যে অবিদ্যা অহম্‌কেই চরম বলিয়া মোহ উৎপাদন করে। কিন্তু যে প্রজ্ঞা আমাদিগকে এই অবিদ্যা হইতে মুক্তি দিবে তাহা শূন্যগর্ভ নহে। শূন্যতায় মুক্তি নাই। যে অবাধ সুসঙ্গত গতিবিধির ভিতর দিয়া আমরা আমাদের এই আবেষ্টন—এই পার্থিব জীবনের সঙ্গে একাত্ম হইতে হইতে পারি, তাহাই মুক্তি। শূন্য নিষ্ফল নিঃসঙ্গতা নহে, সমগ্রের সঙ্গে সঙ্গতি—ইহাই ত উপনিষদের কথা—সৰ্ব্বভূতে ধনি নিজের আত্মাকে মিলাইয়া দেখিয়াছেন, তাঁহার কাছে সত্য আর অপ্রকাশ থাকেন না।



বাস্তব জগতেও মুক্তির সেই একই তাৎপৰ্য্য। শুধু তাহা তাহার নিজস্ব ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। প্রাকৃতিক ঘটনাবলী যতদিন আমাদের কাছে এক দুৰ্ব্বোধ্য যুক্তিহীন খামখেয়ালীর প্রকাশ মনে হইয়াছে, ততদিন আমরা যেন এক অজ্ঞেয় বিজাতীয় লোকে বাস করিয়াছি। তাহার মধ্যে ষে আমাদের স্বরাজের স্থান আছে, তাহা স্বপ্নেও ভাবি নাই। কিন্তু যে-মুহূৰ্ত্তে এই জগতের চালচলনের সঙ্গে আমাদের জ্ঞানের যোগ হইয়া গেল, সেই মুহূৰ্ত্তে সেই মিলনের সেই সঙ্গতির মধ্যেই যে ঐক্য ও মুক্তি দেখা দিল। অবিদ্যাই আমাদের আবেষ্টনের সঙ্গে আমাদের অনৈক্য ঘটায়। এবং বিদ্যা যাহা বস্তুজগতের মধ্যে ব্রহ্মের প্রকাশকে বুঝাইয়া দেয়, সেই ব্ৰহ্ম-বিদ্যাই ত বাস্তবজগতের মৰ্ম্মস্থলের ঐক্যটিকে ধরাইয়া দেয়—অদ্বৈতম্‌কে চিনাইয়া দেয়।



জগতের ব্যবস্থা সম্বন্ধে ভ্ৰান্ত ধারণার মধ্যে যাহারা বাড়িয়াছে, যাহারা জানে না যে, জ্ঞানের দাবীতে এই জগত তাহাদেরই, সেই সব মানুষ কাপুরুষতায় কায়েমী শিক্ষা লাভ করিয়াছে। যে নিয়তি অসন্দিগ্ধভাবে আঘাত করিয়া চলিয়াছে—যাহার বিরুদ্ধে আপিল নাই- সেই নিয়তির উপরই আশাহতদের আস্থা। এমন কি মানুষের স্বাভাবিক অধিকার হইতেও যখন তাহারা; বঞ্চিত হয় তখনও তাহারা বিনা সংগ্রামে আত্মসমর্পণ করে। কারণ তাহারা ভাবিতে অভ্যস্ত হইয়াছে যেন তাহারা জন্ম হইতেই আইনের বাহিরে এবং এ জগৎ সৰ্ব্বদাই তাহাদের উপর দূর্ব্বোধ্য দুর্ঘটনার উপদ্রব চাপাইবে।



সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই পর-ভাব এবং অদ্বৈতবোধের অভাবই মুক্তির অন্তরায়। মিলনের প্র'স্থগুলির উপর জবরদস্তি চলিতেছে বলিয়াই আমাদের বন্ধন। কেহ কেহ মনে করিতে পারেন যে যাহাদের সঙ্গে একত্র বাস করা যাইতেছে, তাহাদের সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করাই মুক্ত; কারণ সম্বন্ধের অর্থই হইতেছে অপরের প্রতি দায়িত্ব-বোধ। কিন্তু হেঁয়ালীর মত শুনাইলেও ইহা সত্য, যে, জীবজগতে অন্যোন্য সম্বন্ধ বোধটি পূর্ণ করিয়া সুসঙ্গত করিয়া পরস্পরের ভার গ্রহণেই মুক্তি। উৎকট ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বশে কোম দায়িত্বই স্বীকার না করা কেবল মাত্ৰ বৰ্ব্বরদের পক্ষেহ সম্ভব এবং সেই জন্যই বৰ্ব্বরদের পূর্ণ আত্মবিকাশ সম্ভব নয়। যে আগুন ভাল করিয়া জলে নাই সুতরাং ধূমজালেই আচ্ছন্ন, সেই আগুনের মতই বৰ্ব্বরগণ চাপা পড়িয়া থাকে, তাহারা তামস সমূদ্রে ডুবিয়া আছে। এই নির্ব্বাপিতপ্রায় তমসাচ্ছন্ন জীবনের কারাবাস হইতে তাহারাই মুক্তি পায়, যাহারা পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া করিতে ও এক জোটে কাজ করিতে সমর্থ। মানবের মুক্তির ইতিহাস মানবসম্বন্ধের পূৰ্ণবিকাশেরই ইতিহাস।



এই সৰ্ব্বাঙ্গীণ মুক্তির পথে সৰ্ব্বপ্রধান অন্তরায় ব্যক্তির বা দলের স্বার্থপরতা। বিশ্বমানবের পূর্ণ বিকাশে যত দূর সম্ভব সাহায্য করাই সভ্যতার চরম লক্ষ্য। কিন্তু নৈতিক আদর্শের স্থান অধিকার করিয়া যখন কোন রকম স্বার্থপরতা অবাধে সমাজের মূল উপাদানগুলি গ্রাস করিতে বসে, তখন সভ্যতার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কারণ, গ্রাস করিবার লোভ এবং সৃষ্টি করিবার জীবন্ত শক্তি পরম্পরবিরোধী। জড়ের জগতে প্রাণই প্রথম মুক্তির জয়ধ্বজা উড়াইয়াছে; কারণ প্রাণ কেবল বাহ্যিক ঘটনা মাত্র নহে, ইহা অন্তরজগতের প্রকাশ, ইহা বস্তুর সীমা ছাড়াইয়া যায়—উপাদানের ভারে আত্মাকে আটক করিতে দেয় না, অথচ নিজের সত্য সীমাটি মানিয়া চলে। প্রাণের প্রাচুর্য্যে তাহার বৃদ্ধি ও সঙ্গতি চাপা পড়ে না; ভিতর এবং বাহির, লক্ষ্য এবং উপায়,বর্ত্তমান এবং অনাগত এক সমন্বয়ে ঐক্য লাভ করে।



জীবন কেবলমাত্র সঞ্চয় করে না, পরিপাক করে। ইহার বস্তু এবং শক্তি, কৰ্ম্ম এবং সত্তা নিগূঢ় ভাবে একীভূত। আমাদের পারিপার্শ্বিক জগতের জড় উপাদান যখন ওজন ছাড়াইয়া ভয়াবহ হইয়া উঠে, যখন তাঁহারা যন্ত্র এবং সঞ্চয়ের স্তুপ মাত্র, তখন আমাদের জীবন ও আমাদের জগতের মধ্যে সংগ্রামে জীবনই পরাস্ত হয়। প্রাণনদীর স্রোতটি ক্ষীণ হইয়া হটিয়া যাওয়ায় যে খাদ বাহির হইয়া পড়ে, তাহা অবিশ্রাম ধন বর্ষণে পূর্ণ করিতে আমরা চেষ্টা করি কিন্তু দেখি যে ধন ভরাট করিতে পারিলেও যোগ স্থাপন করিতে পারে না। সেজন্য বস্তুস্তূপের চোরাবালির চাকচিক্য বিপদ্‌জনক ফাটলগুলিকে শুধু লুকাইয়া রাখে। কিন্তু একদিন যখন আমরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন পুঞ্জীভূত বস্তুর ভারে হঠাৎ সব তলাইয়া যায়।



কিন্তু আসল দুদৈর্ব মনুষ্যত্বের পরাভবে, বৈষয়িক অনুদ্বেগের বিনাশে, নহে। মানুষ তাহার আবেষ্টনকে তাহার প্রাণে ও প্রেমে সজীব করিয়া সৃষ্টিধারা বজায় রাখিয়া চলিয়াছে; কিন্তু তাহার সুযোগধৰ্ম্মী দুরাকাঙ্ক্ষার বশে সেই মানুষেই আবার নির্ম্মম লোভের দাস হইয়া সমস্ত জগৎকে বিকৃত ও কদৰ্য্য করিয়া তুলিতেছে। মানুষের সৃষ্ট এই যন্ত্ৰজগতের বেসুরো আর্ত্তনাদ ও কলের মতন নড়াচড়া মানুষের প্রকৃতির উপর বিষম প্রভাব বিস্তার করিতেছে এবং সৰ্ব্বদা এমন একটি বিশ্বংস্থানের দ্যোতনা করিতেছে যাহা সম্বন্ধহীন ও নিরপেক্ষ। এহেন জগতে মুক্তির অবকাশ নাই; কারণ বিচ্ছিন্ন তথ্যের চাপে তাহা নিরেট হইয়া গিয়াছে। শুধু খাঁচাটাই সৰ্ব্বস্ব, তাহার বাহিরে আকাশ নাই। তাই জগৎটা সৰ্ব্বতোভাবে একটা বদ্ধ জগৎ; কঠিন খোলার ভিতর বীজের মস্ত বন্দী। কিন্তু বীজের মর্ম্মস্থলে তখনও প্রাণ কাঁদিতেছে মুক্তির জন্য তাহার সম্ভাবনা পৰ্য্যন্তও যখন মৌন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। মুক্তির জন্য এই জীবস্ত পিপাসাকে যখন কোন একটা বিরাট লোভ পদদলিত করিয়া স্তব্ধ করিয়া দেয়, তখন স্ফুরণশক্তিহীন বীজের মত মানব সভ্যতা মরিয়া যায়।



ভারতের মুক্তির আদর্শ নিষ্ক্রিয়তা-তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত, ইহা পূর্ণভাবে সত্য নহে। ঈশোপনিষৎ উচ্চকণ্ঠে প্রচার করিয়াছেন যে, মানুষের কৰ্ত্তব্য শতায়ু হইয়া কৰ্ম্ম করা। কারণ ইহার মতে পূর্ণতার নিষ্ক্রিয় আদর্শ এবং তাহার বিকাশের সক্রিয় পদ্ধতির মিলন করা চাই, অসীম ও সসীমের সমন্বয়সাধন চাই; ইহাতেই পূর্ণ সত্য। সুতরাং শুধু অসীমকেই চরম সত্য বলিয়া যাহারা অনুসরণ করে, তাহারা গভীরতর অন্ধকারে পতিত হয়; তাহাদের তুলনায় সসীমবাদীদের অধঃপতন কম গুরুতর। পরিবর্ত্তনশীল কতকগুলি স্বরের সমষ্টিতেই অপরিবর্ত্তনীয় সঙ্গীতের চরম তাৎপৰ্য্য বলিয়া যে বিশ্বাস করে, সে নিশ্চয় নিৰ্ব্বোধ; কিন্তু যে ব্যক্তি ভাবে সঙ্গীতে স্বরের কোন বালাই নাই, তাহার নির্ব্বুদ্বিতা ততোধিক। কিন্তু সমম্বয় কোথায়? তুরীয়ধর্ম্মা (Transcendental) সঙ্গীত কেমন করিয়া বিচ্ছিন্ন স্বরগ্রামকে তাহার আত্মপ্রকাশের বাহন করিয়া লয় ? ইহার সৃষ্টির পর্ব্বে পৰ্ব্বে যে ছন্দ, যে সীমা দেখা দেয় তাহার দ্বারাই ইহা সম্ভব হয়। সসীমের পস্থা অতিক্রম করিয়াই আমরা অসীমকে লাভ করি। এই কথাই ঈশোপনিষৎ ইঙ্গিত করিয়াছেন—


বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্ বেদোভয়ং সহ

অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নু তে।



সীমার ছন্দেই আমাদের জীবন সুনিয়ন্ত্রিত এবং তাহার বিধিনিষেধের ভিতর দিয়াই আমরা অমরত্ব লাভ করি। অমৃতত্ব মাত্র এই বাহ্য জীবনের প্রসারমাত্র নহে—ইহা পূর্ণতার সিদ্ধি, ইহা জীবনের সুসঙ্গত সুন্দর সীমানির্দ্দেশ; প্রাণ প্রতি মুহূর্ত্তে সেই সীমা অতিক্রম করিয়া ভূমাকে প্রকাশ করে। ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকেই উপদেশ আছে, মা গৃধ ; লোভ করিও না। কিন্তু কেন করিব না ? কারণ লোভ সীমার মর্য্যাদা রক্ষা করে না বলিয়া জীবনের ছন্দকে বিনষ্ট করে; সেই ছন্দের ভিতর দিয়াই যে অসীম আত্মপ্রকাশ করেন।



আধুনিক সভ্যতায় দেখি আত্মহননকারীদের সংখ্যা বাড়িতেছে। ইহারা আধ্যাত্মিক আত্মঘাতক। এই সভ্যতায় অনিয়ন্ত্রিত বাসনা ও ‘অহম্‌’কে অতিস্ফীত করিয়া তুলিবার অন্তহীন প্রবৃত্তি সীমাবদ্ধ করিবার শক্তি চলিয়া গিয়াছে। জীবনের ধৰ্ম্ম হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়াছি বলিয়াই আমরা জীবনের সৌন্দৰ্য্যসংস্কৃতিও হারাইতেছি। অলীক কবির মত আমরা বাকচাতুর্য্যকেই শক্তি বলিয়া, বাস্তববাদকে সত্যবস্তু বলিয়া, ভ্ৰম করিতেছি। মধ্যযুগে যখন ইউরোপ স্বৰ্গরাজ্যে আস্থাবান্ ছিল, তখন জীবনের বিচিত্র শক্তিকে ছন্দোবদ্ধ করিতে এবং সেই আদর্শের সঙ্গে মিলাইতে চেষ্টা করিয়াছে। প্রবৃত্তির রুদ্রসংঘাতের মধ্যে সেই আদর্শ জীবন ডাক দিয়াছে এবং ইউরোপের কৰ্ম্মপ্রচেষ্টাকে নিয়ন্ত্ৰিত করিয়াছে। এই প্রয়াসের মূলে ছিল একটি সৃষ্টির প্রেরণা—একটি গভীর আস্তিক্যবোধ যাহা আদেশ করিয়া বলিত-লোভ করিও না, আপন সীমাটি চিনিয়া লও। সুসঙ্গত সৌধের স্থান জুড়িয়া আজ অসংখ্য ইটের পাঁজা গড়িয়া তুলিবার প্রচও উৎসাহ দেখা দিয়াছে, এবং চূর্ণইটের গুঁড়ায় দক্ষ স্থপতির আদর্শটি চাপা পড়িয়া গিয়াছে। ইহাতে বিদ্যার সহিত অবিদ্যার বিচ্ছেদ সূচিত হইতেছে। সেই জন্যই এক ছন্দহীন শক্তি সমস্ত সৃষ্টিপ্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করিয়া এক প্রচ্ছন্ন অগ্নিদাহের সৃষ্টি করিয়াছে, যাহাতে দীপ্তি নাই, শুধু তাপ আছে।



ছন্দেই সৃষ্টি; ছন্দেই বিদ্যা ও অবিদ্যার, সীমা ও অসীমের মিলনভূমি। অরূপের বক্ষ হইতে শতদলটি কেমন করিয়া ফুটিয়া উঠিল জানি না। অস্পষ্টতার গর্তে যতদিন ইহা লুকাইয়াছিল ততদিন আমাদের কাছে ইহার কোন তাৎপৰ্য্যই ছিল না, তবু কোথাও সেই পদ্মটি ছিল ত। কোন দুরবগাহের তলদেশ হইতে উঠিয়া কেমন করিয়া অপূৰ্ব্ব ছন্দসীমায় ইহা ধরা দিল, আমাদের চেতনায় একটি নূতন আবর্ত্ত জাগাইল! অসীমের স্পর্শে যে আনন্দ চিনিলাম, তাহা যে সীমারই দান। সৃষ্টিকৰ্ত্তার সৰ্ব্বাপেক্ষা বড় কাজই যে সীমা নির্দ্দেশ করা ; তিনি যে বন্ধনের মধ্য দিয়াই মুক্তি পান, সীমার ভিতর দিয়াই অসীমকে পান। জড়-বস্তুর উপাসনায় অসীম অতৃপ্তি। তাহা ক্ৰমবৰ্দ্ধমান আতিশয্যের পথে শুধু ছুটায়, কিছু প্রকাশ করে না; তাহার কোন রূপ নাই। এই লোক চিরঅন্ধকারে আবুত, অদ্ধেন তমসাবৃতা; এখানে আছে শুধু মূক বস্তপিণ্ডের বোঝা। মানুষের সত্য প্রার্থনা বৃহৎকে চায় না; সত্যকে চায়, আলোককে চায়। তাহা অগ্নিকাণ্ড নয় জ্যোতিরুন্মেষ; মানুষ অমৃতকে চায়, কালের ব্যাপ্তিতে নয়, পূর্ণের শাশ্বত গৌরবে।



মুক্তির অন্তর্লোকের পথ রুদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছি বলিয়াই আমাদের নিকট বহির্জগতের দাবী এমন ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিয়াছে। সে লোকে বস্তু আছে কিন্তু তাহার অর্থসিদ্ধির পথ অবরুদ্ধ। সে লোকে বাঁচিয়া থাকা দাসত্ব। জীবনের সত্য যাহাতে নিহিত, অন্ধতার বশবর্তী হইয়া তাহাই আমরা হারাইয়া ফেলিয়াছি বলিয়া মানুষের পক্ষে জীবনকে পাপ বলা সম্ভব হইয়াছে। একটি পাখায় ভর করিয়া পাখী আকাশে উড়িতে গিয়া বাতাসের উপরেই ক্রোধ প্রকাশ করে—কেন সে তাহাকে আঘাত করিয়া ধূলায় ফেলিয়া দিল। খণ্ড সত্যমাত্রই পাপ৷ খণ্ড সত্য মানুষকে পীড়া দেয়; কারণ তাহা যাহা দিতে পারে না আভাসে তাহারই কথা মনে জাগায়। মৃত্যু আমাদের পীড়া দেয় না, কিন্তু রোগ যন্ত্রণা দেয়, কারণ রোগ কেবলই স্বাস্থ্যকে স্মরণ করাইয়া দিয়া তাহাকেই কাড়িয়া রাখে। অসম্পূর্ণ জগতে জীবনও পাপ; কারণ যেখানে জীবনের অসম্পূর্ণতা প্রত্যক্ষ, সেখানেও তাহা পূর্ণতার ভাণ করে, শুধু পানপাত্রটি মুখের কাছে ধরে কিন্তু প্রাণ-রস হইতে আমাদের বঞ্চিত রাখে। সত্য খণ্ডিত থাকিয়া যায় বলিয়া, তাহার বিকাশযন্ত্রটির পূর্ণাবৰ্ত্তন হয় না বলিয়াই সৃষ্টির মধ্যে এত দুদৈর্ব।



শত বৎসরের পুরাতন একটি বাউলের গান শুনাইয়া আমি আজিকার বক্তব্য শেষ করিব। এই গানে কবি অনন্তের সহিত সান্ত জীবাত্মার চিরন্তন মিলন বন্ধনের কথা গাহিয়াছেন; এ বন্ধন হইতে মুক্তি নাই, কারণ এই পরম্পর সম্বন্ধেই সত্য সম্পূর্ণ হয়, কারণ প্রেমই পরমতত্ত্ব, নিরপেক্ষ স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বন্ধাতা ও শূন্যতামাত্র। অবিমিশ্র বিদ্যাতেও সত্য নাই, অবিদ্যাতেও নাই, দুইয়ের মিলনেই সত্যের প্রকাশ—উপনিষদের এই কথায় যাহা পাই, এই গানটিতেও আমরা সেই ভাবটি উপলব্ধি করি।



হৃদয়-কমল চলতেছে ফুটি কত যুগ ধরি।

তাতে তুমিও বাঁধা, আমিও বাঁধা, উপায় কী করি।

ফুটে ফুটে কমল, ফোটায় না হয় শেষ,

এই কমলের যে-এক মধু রস যে তা’র বিশেষ।

ছেড়ে যেতে লোভী ভ্রমর পারে না যে তাই ।

তাই তুমি ও বাঁধা, আমিও বাঁধা,

মুক্তি কোথাও নাই।


____________

*এই অভিভাষণটি মূল ইংরেজী হইতে অনুদিত।


*** রায়হান রাইন সম্পাদিত বাংলার ধর্ম ও দর্শন (২০০৯;সংবেদ, ঢাকা) গ্রন্থে এই বঙ্গানুবাদটি সংকলিত হয়েছে।


প্রকাশঃ ১০ই মে, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/419745692366359/