হেগেল, মৃত্যু ও স্যাক্রিফাইস

জর্জ বাতাই



[জর্জ বাতাইয়ের “Hegel, Death and Sacrifice” লেখার ভাবানুবাদ এটি। অনেক জায়গায় ইংরেজি শব্দ রেখে দেয়া হয়েছে ইন্টারপ্রেটশনগত দূরবর্তীতা তৈরী না করার উদ্দেশ্যে। অনুবাদটি আরো পরিমার্জনের মধ্যে দিয়ে যাবে। আপাতত খসড়াটি তুলে দেয়া হল। ফেনোমেনোলজি র লেকচারে কোজেভ হেগেলের দর্শনে মৃত্যু ভাবনা যেভাবে হাজির আছে তার একটা ভাষ্য দেন। ইংরেজি অনুবাদে কোজেভের লেকচারের যে সংকলন (Introduction to the Phenomenology of Spirit) তাতে মৃত্যু বিষয়ক অংশটি নেই। এটা পরবর্তীতে আলাদাভাবে Interpretation জার্নালের ১৯৭৩ সালের শীতকালীন ভল্যিউমে “The Idea of Death in the Philosophy of Hegel by Kojève, Alexandre” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। মূলত কোজেভের এই ভাষ্যের সাপেক্ষেই জর্জ বাতাই এই লেখাটি লেখেন।]




I মৃত্যু


১৮০৫-০৬ সালে হেগেল যে লেকচার দিচ্ছেন তাতে সবচাইতে পরিণত হেগেলকে পাওয়া যায়। এই সময়টাতেই উনি ফেনোমেনোলজি অফ স্পিরিট লিখছেন। হেগেল এই লেকচারে মনুষ্যের ‘কালো চরিত্র’ (ব্ল্যাক ক্যারেক্টার) তুলে ধরছেন। কোজেভ হেগেল ব্যাখ্যাকালে বলছেন,

মানুষ হলো গিয়ে সেই রাত্রি, শূন্য নাস্তি (Empty nothingness), যা আবার তার সরল অখন্ডতার মধ্যে সকল কিছুকে ধারণ করে। ... মানুষ হলো রাত্রি, ইন্টারিওরিটি অথবা প্রকৃতির ইন্টিম্যাসিঃ একেবারে বিশুদ্ধ পার্সোনাল ইগো।


শুরুর দিকে হেগেল রোমান্টিকই ছিলেন। কিন্তু উনি রোমান্টিসিজমকে এমন কোন পদ্ধতি হিসেবে নেন নাই যার মাধ্যমে গর্বিত স্পিরিট বাস্তব দুনিয়াকে তার নিজের খামখেয়ালি কল্পনার অধস্তন করতে পারে। হেগেলের চিন্তার মূল ঝোঁক আনুধাবন করা যায় কোজেভের এই উচ্চারণেঃ মানুষের অব্জেক্টিভ রিয়েলিটি ও এম্পিরিকাল রিয়েলিটির (Dasein) উৎস ও পাটাতন হচ্ছে (নাস্তি) নাথিংনেস। এই নাথিংনেস উদ্ভাসিত হয় নঞর্থক অথবা সৃষ্টিশীল একশনের মাধ্যমে।


ফিলোসফি অফ ডেথ আর নিরীশ্বরবাদ আসলে একই কথা। কোজেভ মনে করেন ফিলোসফি অফ ডেথেই মূলত হেগেলের ডায়ালেক্টিকাল অথবা এন্থ্রোপলজিকাল দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়। মানুষ মূলত মৃত্যুই, যে মৃত্যু একটা মানবজীবন যাপন করছে।


এতদসত্ত্বেও নঞর্থকতাই একশনের মূলনীতি। হেগেলে একশনই নেগেটিভিটি, নেগেটিভিটিই একশন। একদিকে যে মানুষ (ব্যতিক্রমি বিশুদ্ধ আমি বা পিওর ইগো) নেচারকে নেগেট করে সে আবার নেচারের কেন্দ্রেই থাকে। এমনভাবে থাকে যেনো আলোর মধ্যে রাত্রি।


কিন্তু এই নেগেশন শুধু স্পিরিটের ভেতরেই থাকেনা। বহির্জগতে নেগেশনের ফলেই ন্যাচারের রিয়েলিটি পরিবর্তিত হয়। মানুষের নেগেশনের এই লড়াইয়ের কারণেই দুনিয়া বদলায়। বদলে এমন দুনিয়া আসে যে দুনিয়া ইতিপূর্বে ছিলোনা।


এই নেগেশনের খেলায় একদিকে আছে পোয়েট্রি ও পিওর নাথিংনেস। অন্যদিকে আছে নেগেটিভ একশন যা বাস্তব দুনিয়াকে বদলায় ও নির্মাণ করে।


জগতের যা কিছু হাজির আছে তার সমগ্রতার ব্যাখ্যা নির্মাণেই হেগেলের কাজের মৌলিকতা। একই সাথে এই দার্শনিকের কাজের মূল জায়গাটা খুঁজলে এই সমগ্রতার ব্যাখ্যাই উঠে আসবে। হেগেলের মতে সত্য জ্ঞান বুঝতে ও প্রকাশ করতে হবে কর্তার হিসেবে। কর্তা এইখানে গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র বস্তুকে আমলে নিলে হচ্ছেনা। অন্যভাবে বললে প্রাকৃতিক জ্ঞান আসলে অসম্পূর্ণ। মানুষের ঢুকে পড়া ছাড়া এই অসম্পূর্ণতা দিয়ে সমগ্রতাকে বোঝা যাবেনা। এই বিবেচনায় জ্ঞান অবশ্যই মানবকেন্দ্রিক হতে হবে। কোজেভ এই প্রসংগে বলছেন যে মানুষের বাস্তবতাই জ্ঞানের বিষয় হতে পারে। কারণ একমাত্র মানুষের বাস্তবতাই ডিসকোর্সের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। তবে এই মানুষ কোনভাবেই আধুনিক বিজ্ঞান যেভাবে মানুষ বোঝে সেই মানুষ নয়। এখানে মানুষকে কোনোভাবে বাস্তবতার সমগ্রতা থেকে আলাদা করা যায়না। এক অর্থে এটা একটা ধর্মতত্ত্ব। প্রকৃতিতে মানুষ এখানে ইশ্বরের জায়গা নেয়।


হেগেলের জন্য মানুষের বাস্তবতা গ্রিকদের মত না। ওনার মানববিদ্যা পড়বে বরং ইহুদী-খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের মধ্যে। এটা জোর দেয় স্বাধীনতা, ঐতিহাসিকতা ও ইন্ডিভিজুয়ালিটির ওপরে। ইহুদী-খ্রিস্টীয় মানুষের মতো হেগেলের মানুষও স্পিরিচুয়াল (ডায়ালেক্টিকাল) সত্ত। কিন্তু ফারাকের জায়গা হচ্ছে ইহুদী-খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যে স্পিরিচুয়ালিটি পূর্ণরূপে ঠাওর করা যায় পরকালে। একই সাথে সত্যিকার অর্থে একমাত্র স্পিরিট হচ্ছে ইশ্বর। এই ইশ্বর শাশ্বত ও অবিনশ্বর। হেগেলের স্পিরিট সীমিত ও নশ্বর। এর মানে দাঁড়াচ্ছে স্পিরিচুয়ালিটি অথবা ডায়ালেক্টিক্স আসলে নিশ্চিত হয় মৃত্যুর মাধ্যমেই। মৃত্যু স্পিরিটের প্রধান শর্ত। এই মৃত্যুই তার সীমা ও ক্ষণিকতা নির্দেশ করে। ইহুদী-খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের স্পিরিচুয়ালিটির সাথে হেগেলের স্পিরিচুয়ালিস্ট ভাবনা এইখানে এসেই জুদা হয়ে যায়। একই সাথে হেগেলের চিন্তায় মৃত্যুর ভূমিকার প্রাধান্যও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মৃত্যু যদি না থাকতো তবে না থাকতো মানুষ আর তার স্বাধীনতা, না থাকতো ইতিহাস, না থাকতো ব্যক্তিসত্তা। তার সকল যন্ত্রনার(Anguish) উৎস এই মৃত্যু। এই মৃত্যুকে সে অবিরত খুঁজতে থাকে, একে কামনা করে। কখনো কখনো স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছেও নেয়। মৃত্যু, যা সত্তর বিনাশ ঘটায় তাতে যখন সে অবগাহন করে, তাকে উপভোগ করে। তাতেই মানুষ অপরাপর প্রাণী থেকে আলাদা হয়। মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে সে আর কোন অনড় জড়বস্তু থাকেনা। মানুষ তার নিজের মধ্যে নেতিকে ধারণ করে। এই নেতিকে ধারণ করেই এই নেতির ভায়োলেন্সই তাকে ক্রমপরিবর্তশীল ইতিহাসে নিক্ষেপ করে। এই নেতিই তাকে বদলায়।


একমাত্র ইতিহাসই পারে (জগতে) যা আছে তা বদলাতে। অতএব শাশ্বত ও অবিনশ্বর ইশ্বরের ধারণা একটা সাময়িক সমাপ্তি। আরো ভালো কোন ধারণা আসার আগ পর্যন্ত এই ধারনা টিকে থাকে। শুধুমাত্র পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও সেখানে দাঁড়ানো সাধুই (এক্ষেত্রে হেগেল, যে সমগ্রতাটাকে ধরতে পারে। তাঁর মধ্যেই ইতিহাস পূর্ণরুপে প্রকাশিত হয়) সার্বভৌম জায়গাটা দখল করে থাকে। ইশ্বর এই জায়গা দখল করে থাকে আপদকালীন সময়ের জন্য।


এই ধরণের বোঝাবুঝি অনেকটা হাস্যকর হিসেবে হাজির হয়। হেগেল কোথাও পরিষ্কার করে এটা নিয়ে কোন মন্তব্য করছেন না। প্রায় সব জায়গায়ই ওনার কথা ধোয়াশাপূর্ণ। এমনকি কোজেভও এটা নিয়ে কোন উপসংহার টানছেন না। উনি কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌছানো থেকে নিজেকে বিরত রাখছেন। এই বুঝপত্র উপস্থাপন করার জন্য হেগেল আসলে একরকম ট্রাজেডির ঢং নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু আদতে এই বোঝাবুঝি দ্রুতই কমিক(comic) ভাবে হাজির হয়।


সে যেমনই হোক, অনন্ত অসীম ঐশ্বরিকতার সাথে মৃত্যুর সম্পর্কহীনতা এতই তীব্র যে ইহুদী-খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যে ইশ্বরের সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক নিয়ে একটা বিশেষ মিথ (যিশুর ক্রুশবিদ্ধ যন্ত্রনাময় মৃত্যু) রচনা করা লেগেছে। যিশু তো শাশ্বত। কোনভাবেই তাঁর অবিনশ্বরতার কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু তিনি ঐশি সত্ত, তিনি খামখেয়ালি মরে যাওয়ার কথা না। ঐশ্বরিকতার সাথে মৃত্যুর সম্পর্কহীনতার ঐতিহ্যের কারণে এই মৃত্যুকে পরবর্তীতে নানানভাবে ব্যখ্যা করার প্রয়োজন পড়েছে। ঐশ্বরিককে অবশ্যই মৃত্যুর থেকে দূরে রাখতে হবে, কারণ মৃত্যু সীমা নির্দেশ করে। ইহুদী-খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের শাশ্বত সত্তর সাথে এই সীমিত হয়ে পড়া সাংঘর্ষিক। যিশুর মৃত্যু তাই অনেকটা কমিক আকারে হাজির হয়।


হেগেলের “absolute knowledge” এর আগে ইহুদী-খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যে ঐশ্বরিক সত্তকে কোনভাবেই সীমিত সত্ত হিসেবে ভাবা হয়নি। যা সীমিত তা কোনভাবে ঐশ্বরিক না। যেই অস্পষ্ট কনশাসনেসের ওপরে ইশ্বরের এই মৃত্যুর মিথ দাঁড়িয়ে আছে তা হেগেলের ধারণার সাথে যায়না।


এখন, খাঁটি প্রজ্ঞা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন সাধু নিজেকে মৃত্যুর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে। এই প্রক্রিয়া যতই যন্ত্রনাময় হোক না কেন, এটাই একমাত্র উপায়। হেগেলের ফেনোমেনোলজি অফ স্পিরিটের একটা বিশেষ অনুচ্ছেদে এর প্রয়োজনীয়তার ইংগিত পাওয়া যায়।


আমরা এই অবাস্তবতাকে যদি মৃত্যু নামে ডাকতে চাই, হেগেল বলছেন, এই মৃত্যু হল সবচাইতে ভয়ংকর ব্যপার। মৃত্যুর ভূমিকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে তীব্র শক্তির প্রয়োজন। অকার্যকর সৌন্দর্য এই সচেতনতাকে এড়িয়ে যেতে চায়, কারণ তখন এর দায় ওর ঘাড়ে এসে পড়ে। যে দায় আবার এই সৌন্দর্য মেটাতে পারেনা। স্পিরিট মৃত্যুকে ভয় পায়না, বরং সে মৃত্যুকে পাশে রেখেই বেঁচে থাকে। স্পিরিটের জীবন বিনাশকে অস্বীকার করেনা। স্পিরিট তার সম্পূর্ণ বিনাশের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে সত্য জ্ঞান অর্জন করে।


এইটা সেই ক্ষমতা না যার মাধ্যমে সদর্থকতা সকল নঞর্থকতাকে না করে। যেমন কেউ বললো যে এটা মিথ্যা। এবং এই বলে সে অন্য কোন অবস্থান নিলো। স্পিরিট এই কাজ করেনা। নেতির মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। সামনে দাঁড়িয়ে নেতিকে নিয়ে ভাবনায় নিমগ্ন হয়। কোন এড়িয়ে যাওয়া না, না’কে না করাও নয়। এটাই সত্তর ভেতরে নেতির ঘর নির্মাণ করেন।


এর পরেই বাতাই ঘোষণা দিচ্ছেন যে উনি কোজেভের ব্যাখ্যাকে পুনর্ব্যক্ত করবেন। হেগেলের অস্পষ্ট বাক্যগুলি তুলে ধরা তাঁর কাম্য নয়। বরং কোজেভের পাঠকে পুনর্ব্যক্ত করার মাধ্যমেই উনি এটার আরো পরিষ্কার বিবরণী তুলে ধরতে চাচ্ছেন।


যেই উপাদান সমগ্রতা নির্মাণ করে তাঁর থেকে মানুষের বোঝাপড়ার (ভাষা, ডিসকোর্স) নিজেকে আলাদা করার একটা সক্ষমতা থাকার কথা। হেগেলে চিন্তায় এইটা ফান্ডামেন্টাল ও একই সাথে আশ্চর্যজনক ব্যপার। এই উপাদানগুলিকে (গাছ, পাখি) আদতে সমগ্রতা থেকে আলাদা করা যায়না। তারা একে অন্যের সাথে স্থানিক, কালিক ও অবশ্যই ম্যাটেরিয়াল বন্ধন দ্বারা একে অন্যের সাথে যুক্ত থাকে। একে আসলে আলাদা করা যায়না। কিন্তু মানুষের এই যে আলাদাকরণ এটাই প্রকৃতির প্রতি তার নঞর্থকতার ইশারা দেয়। এই নেতি ঘটে কোন নির্দিষ্ট পরিণতি ছাড়াই। কারণ সে যাকে নেতি করে অর্থাৎ প্রকৃতি, তার মাঝেই সেই বাস করে। তার পক্ষে কোনভাবেই এর বাইরে থাকা সম্ভব না। সবার আগে মানুষ একটা প্রাণী যাকে সে নিজেই নেতি করে। ফলত নিজেকে নেতি করা ছাড়া তার পক্ষে প্রকৃতিকে নেতি করা সম্ভব নয়।


ধরা যাক, প্রকৃতিকে নেতি করে মানুষ নিজের প্রয়োজনে যখন কোন হাতিয়ার বানায় তখন সেটা কোনভাবে নিছক প্রকৃতির নেতিতে সীমিত থাকেনা। প্রকৃতিকে নেতি করার, বিনষ্ট করার ও হ্রাস করার তার যে বাসনা তা একপ্রকারে নিজেকে নেতি করারও বাসনা বটে। প্রকৃতিকে নেতি করার মানে সেই প্রাণীকেও নেতি করা যে মানুষের মধ্যে নঞর্থকতার চাষাবাদ করে।


এই যে প্রকৃতি থেকে আমি’র আলাদা হয়ে যাওয়া এটাই তাকে নিশ্চিতভাবে উধাও করে। মানুষ প্রকৃতি থেকে নিজেকে ফারাক করে। প্রাণী সেটা করেনা। ফলত সে উধাও হয় না। গতকাল , গত বছর যে ফড়িং উড়ে বেরিয়েছে আজো সে আছে। সে নাই হয়না। হ্যাঁ, এ ব্যপারে কোন সন্দেহ নাই যে ইন্ডিভিজুয়াল ফড়িং মরে যায়। কিন্তু সমগ্রের মধ্যে এখনো ফড়িং বিদ্যমান থাকে। সে প্রকৃতিকে নেতি করেনা বলেই সে হারিয়ে যায়না। সাগরের ঢেউয়ের মতই গত বছরের ফড়িং আর আজকের ফড়িং একই। গত বছরের ফড়িং মরে গেছে? হয়তোবা। কিন্তু সে একেবারের হারায়ে যায় নাই। কিন্তু একজন জীববিজ্ঞানী খুব সহজেই অপরাপর প্রাণী থেকে তাকে আলাদা করে ফেলে। সে আলাদা করে মূলত তার নিজের প্রয়োজনেই। সেই ফড়িংয়ের জন্য সে এটাকে আলাদা করেনা। ফড়িং নিজেকে নিজের আলাদা করা জন্য মানুষের মতই চিন্তার করার ফোর্স থাকা প্রয়োজন যেটা তার নাই। সে ভাষায় প্রবেশ করতো ও নিজেকে অপরকে আলাদা করতো। মানুষ যেরকমটা করে, সে যাবতীয় উপাদানকে আলাদা আলাদা ভাবে বিবেচনা করে।


কিন্তু এই খেলায় মানুষ যা খুঁজে পায় তা হল মৃত্যু। একেবারে মানুষের মৃত্যু। এই মৃত্যুকে সে ভয় পায়, সে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু এই ভয় শুধুমাত্র তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যে ভবিষ্যতের হারায়ে যাওয়া নিয়ে সদা শংকিত।


এ পর্যন্ত হেগেল যা বলছে তা অনেকটা প্রফেটিক। কিন্তু সে এর সাথে ভায়োলেন্সের একটা ব্যক্তিগত ক্ষণের কথাও উল্লেখ করেন এবং এর বিবরণ দেন। কিন্তু হেগেল এখানে যে ভায়োলেন্স বা ফোর্সের কথা বলছেন তা প্রকৃতির নয়। এই ভায়োলেন্স মানুষের বোঝাপড়ার যা প্রকৃতিকে নেতি করে। অন্যভাবে বোঝাবুঝির নঞর্থকতাই এই ভায়োলেন্স। স্বপ্নের যে বিশুদ্ধ সৌন্দর্য এটা তার একেবারেই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। স্বপ্নের বিশুদ্ধ সৌন্দর্য অকার্যকর, অক্ষম (Impotent) ।


স্বপ্নের সৌন্দর্য সেই জগতে থাকে যা নাই অথচ তার আশেপাশে যা আছে তার থেকে সে আবারা আলাদা থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিটা উপদান স্থান ও কালে কংক্রিট উপাদান হিসেবে হাজির থাকে। অন্যদিকে চিন্তার জগতে এরা থাকে বিমূর্ত। সৌন্দর্য বোঝাপড়ার মত ক্রিয়া করতে পারেনা। সৌন্দর্যের এই ক্ষমতাটাই নাই। সে নিজেই নিজেকে সংরক্ষণ করতে পারে। বোঝাপড়া যেরকম মানুষের মৃত্যুর কাজকে উর্ধ্বে তুলে ধরে সৌন্দর্য সেটা পারেনা। কারণ এটা করতে গেলেই তার ক্রিয়া করতে হবে। বোঝাপড়া যেরকম করে পৃথিবী বদলায় এবং নিজেও বদলে যায় সেটা সৌন্দর্যের পক্ষে একেবারেই সম্ভব না।


এখানে কোজেভের সাথে বাতাই’র ইন্টারপ্রেটেশন খানিকটা ভিন্ন বলে উনি দাবি করছেন। কোজেভে মনে করেন সৌন্দর্য বোঝাপড়ার আবশ্যিক শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়। নান্দনিক ব্যক্তি, মরমি ও রোমান্টিক মৃত্যুর ধারণা থেকে পালায়। তাঁরা নাই (নাথিংনেস) এর কথা এমনভাবে বলেন যেন তা আছে। মরমিদের এরকম ব্যাখ্যা দাঁড় করানো নিয়ে কোজেভের প্রশংসা করছেন বাতাই। কিন্তু এই ব্যাখ্যা থেকে উনি খানিকটা সরে আসছেন। উনি বলছেন হেগেলে যেরকম অস্পষ্টতা আছে একই রকম অস্পষ্টতা কোজেভের ব্যাখ্যাতেও রয়ে যায়।


যাই হোক এই সৌন্দর্য আত্মসচেতন নয়। এটি কোনভাবেই মৃত্যুকে ধারণ করতে পারেনা। তবে জীবন যে কারণে মৃত্যু ও সম্পূর্ণ বিনাশ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় সে কারণে সে মৃত্যুকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়না। এই সৌন্দর্য অন্তত পক্ষে জগতে যা কিছু আছে তার অখন্ড সমগ্রতা থেকে আলাদা হওয়ার যে যন্ত্রনা তা টের পায়। তবে সৌন্দর্যের পক্ষে নঞর্থক কনশাসনেস হওয়া সম্ভব না। নঞর্থক কনশাসনেস প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের নঞর্থক সংগ্রামকে ধরে নেয়। এই সংগ্রাম ভায়োলেন্ট ও শ্রমসাধ্য। এই সংগ্রামই মানুষের পরিণতি। এটা সেই ঐতিহাসিক সংগ্রাম যার মাধ্যমে মানুষ নামকরণের মধ্য দিয়ে বিমূর্ত আমি হয়ে ওঠে। এই বিমূর্ত আমি হয়ে ওঠা তার কর্তাসত্ত নির্মাণ করে ও প্রকৃতি থেকে তাকে পৃথক করে। কোজেভে পরিষ্কার করছেন যে চিন্তা ও ডিসকোর্স যা ‘বাস্তব’কে নির্মাণ করে তার জন্ম নঞর্থক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়। Negative action অর্থাৎ এই নঞর্থক ক্রিয়া সত্তকে বিনষ্ট করার মাধ্যমে নাস্তিকে (Nothingness) প্রতিষ্ঠিত করে। এর মানে দাঁড়ায়, মানুষ আসলে এই ক্রিয়া বৈ কিছুই নয়। মানুষ আসলে মৃত্যু যে কি-না একটা মানুষের জীবন যাপন করছে।


এই দর্শনে একেবারে গভীর ও কঠিন নিত্যদিনের অনুষঙ্গের মধ্যে জারি থাকা সংযোগের ওপরে বাতাই জোর দিতে চান। পরষ্পর বিরোধী যে নানাবিধ মানবমূর্তি আছে তারা এইখানে একে অপরের মুখোমুখি হয়। একসাথে জড় হয়। যে মানুষ গর্বিত তার সাথে দেখা হয় মৃত্যুপথযাত্রীর, প্রভুর সাথে দাসের আর বিপ্লবীর সাথে দেখা হয় সন্দেহবাতিকগ্রস্থের। এই দর্শন শুধু মৃত্যুর দর্শন নয়। এই দর্শন শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রমেরও। যেহেতু এই লেখাতে বাতাই মনযোগ দিচ্ছেন মৃত্যুতে, তাই এই দিকটাতে উনি খুব একটা ঢুকবেন না। উনি বরং এরপরে দৃষ্টিপাত করবেন ‘স্যাক্রিফাইস’ এর দিকে।


II স্যাক্রিফাইস


Phenomenology of Spirit বইয়ে রিলিজিওনের ওপরে যে অধ্যায় আছে স্যাক্রিফাইসের আলোচনায় বাতাই সেইখানে গুরুত্ব দিতে চান না। বাতাই মনে করছেন স্যাক্রিফাইসের তত্ত্বের মূল জায়গা এই অধ্যায়ে খুঁজে পাওয়া যায়না। হেগেল বরং মূল থেকে অনেকটা সরে যান এই অধ্যায়ে। যদিও বাতাই মানছেন যে এই অধ্যায়ের পাটাতন হিসেবে নিঃসন্দেহে স্যাক্রিফাইসের তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ। সে যাই হোক, প্রারম্ভিকাতে স্যাক্রিফাইসের তত্ত্বের যে ইংগিত হেগেল দিচ্ছেন তাকেই ব্যাখ্যা করেন বাতাই।


হেগেলের মতে ‘মানুষ’ সত্য খুঁজে পাচ্ছে ও তা প্রতিষ্ঠিত করছে স্যাক্রিফাইসের মাধ্যমে। এই স্যাক্রিফাইস তার মাঝের প্রাণীকে ধ্বংস করে। এই প্রাণী আর মানুষ টিকে থাকে এক অশরীরি সত্য হিসেবে। এই অশরীরি সত্যই মানুষকে নির্মাণ করে বলে হেগেল বলছেন। এটাকেই হাইডেগার বলছেন Sein Zum Tode (being unto death) । অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, এটাকেই কোজেভ বলছে “মৃত্যু যে কি-না মানুষের জীবন যাপন করে”।


প্রকৃতবিচারে হেগেলের সমস্যা স্যাক্রিফাইসের ক্রিয়ার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। স্যাক্রিফাইসে একদিকে শরীরি সত্তকে মৃত্যু আঘাত করে। অপরদিকে এই স্যাক্রিফাইসেই মৃত্যু মানুষের জীবন যাপন করে।


প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্যাক্রিফাইস কার্যত সার্বিক (universal) । স্যাক্রিফাইসের এই সার্বিকতাকে আমলে নিলেই বোঝা যাবে যে নঞর্থকতা যা মানুষের মরণে উত্থিত হয় তা হেগেলের খামখেয়ালি নির্মাণ নয়। সবচাইতে সরল মানুষটার স্পিরিটের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা টের পাওয়া যায়। এটা তাজ্জব ব্যপার যে পৃথিবী জুড়ে গোষ্ঠীগত নঞর্থকতার মধ্যে অদ্ভুত স্থির সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।


বাঁচুক বা মরুক মানুষ তৎক্ষণাৎ মৃত্যুকে জানতে পারেনা।


স্যাক্রিফাইসের ক্ষেত্রে যে অবুঝ মানুষ সে কি করছে তা পূর্ণভাবে জানে আর সাধু যে পরম সত্য জেনেছে তাঁদের মধ্যে ফারাক আছে। বাতাই এই পার্থক্যের দিকে আরো পরে দৃষ্টিপাত করবে।


এই পার্থক্য সত্ত্বেও নঞর্থকতা প্রকাশের প্রশ্নটি রয়ে যায়। নঞর্থকতা প্রকাশের সবচাইতে ভালো উপায় হচ্ছে মৃত্যু। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মৃত্যু কিছুই প্রকাশ করেনা। তত্ত্বগতভাবে জন্তুর মৃত্যু মানুষের কাছে নিজেকে উদ্ভাসিত করে। কিন্তু মৃত্যু আসলে কিছুই প্রকাশ করেনা। কারণ জন্তু যখন মারা যায় তখন মানুষও আর থাকেনা। মানুষ নিজের কাছে নিজে উদ্ভাসিত হতে হলে তাকে মরতে হবে। সমস্যা হল মৃত্যুর পরে আর উদ্ভাসিত হওয়ার কিছু থাকেনা। তাই আবশ্যিকভাবে তার এটা টের পেতে হবে জীবিত থাকা অবস্থায়। যখন সে নাই হওয়ার পথে। অন্যভাবে বললে সত্তকে যেই মুহুর্তে সে ধ্বংস করছে ঠিক সেই মূহুর্তে মৃত্যুর (Self) consciousness হতে হবে । আদতে যা ঘটে তা অনেকটা প্রতারণামূলক। স্যাক্রিফাইসের মুহুর্তে যে স্যাক্রিফাইস করে সে উৎসর্গিত জন্তুর সাথে নিজেকে অভেদাত্মক ভাবে। তাই সে মরে নিজেকে মরতে দেখতে দেখতে। একভাবে বিবেচনা করলে মৃত্যু ঘটে তার নিজের ইচ্ছায়। কিন্তু এটা কমেডি!


এটা কমেডি হয় অন্তত যদি জীবিতের ওপরে মৃত্যু’র আক্রমণকে বুঝবার অন্য কোন উপায় থাকে। যে মৃত্যু সীমিত সত্তাকে শেষ করে এবং যা একমাত্র তার নঞর্থকতাই অর্জন করতে পারে। হেগেলের মতে বাসনার সন্তুষ্টি সম্ভব একমাত্র মৃত্যুর কনশাসনেসে। মৃত্যুকে বাদ দিয়ে যদি এই পরিতৃপ্তি সম্ভব হত তবে মৃত্যুই যা ঠিক করে দেয় তার সাথে সাংঘর্ষিক হত। ঠিক এই কারণেই মানুষের নিজের সম্পর্কে যে কনশাসনেস রয়েছে তাকে অবশ্যই নঞর্থকতার চলাচলে প্রতিফলিত করতে হবে। এই নঞর্থকতাই তাকে নির্মাণ করে। এটা তাকে তৈরী করে সেই জন্যেই যে এই নঞর্থকতাই একদিন তাকে খুন করবে।


সে খুন হবে তার নিজের নঞর্থকাতার হাতেই। কিন্তু এরপরে আর কিছু থাকবেনা। তার মৃত্যু একটা সৃষ্টিশীল মৃত্যু। কিন্তু জীবিতবস্থায় মৃত্যুর জাদুকরি যদি তাকে ছুয়ে না যায় তবে জীবনকালে সে টেরই পাবেনা যে মৃত্যু তাকে নিয়ে যাবে। অতএব যে মৃত্যু তার জন্য অপেক্ষা করছে তা তাকে ‘মানুষি’ বৈশিষ্ট্য দিবেনা। সকল মূল্যে মানুষকে মৃত্যুকালে বেঁচে থাকতে হবে অথবা বেঁচে থাকতে হবে মৃত্যুর পরোয়ানা পাশে রেখে।


মৃত্যুর জ্ঞানকে প্রতারণামূলক হতেই হবে। এই সমস্যার জন্য স্পেক্টেকল বা পরিবেশনের প্রয়োজন পড়ে। এই স্পেক্টেকল ছাড়া মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীন থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব হত না। বস্তুত ফিকশনের থেকে জান্তব আর কিছু নেই। ফিকশন বাস্তব থেকে, মৃত্যু থেকে দূরে অবস্থান করে।


মানুষ কেবলমাত্র ভাত খেয়ে বেঁচে থাকেনা। তার কমেডির প্রয়োজন পড়ে। এই কমেডি দিয়ে সে নিজেকে স্বেচ্ছায় প্রতারিত করে। মানুষের মাঝের যে জন্তু সে খায়। এইটা তার প্রাকৃতিক সত্ত। কিন্তু মানুষ আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। অথবা সে পড়ে, পড়তে পারে। সাহিত্য তার মধ্যে পারফরমেন্সের জাদু জারী রাখে। তাকে ভুলিয়ে রাখে। সেটা বিয়োগান্তক সাহিত্য হোক বা হাস্যরসাত্মক। ট্রাজেডি অন্ততপক্ষে এটা জানিয়ে যায় যে আমরা মারা যাই যদিও আমরা এখন বেঁচে আছি। সে যাই হোক, এটা একেবারে ক্ল্যাসিক প্রতারণার মত। এতেই মানুষ আশ্রয় খোঁজে।


হেগেলের প্রতিক্রিয়াকে স্যাক্রিফাইস ও পরিবেশনের (Representation) মৌলিক জায়গাগুলির সাথে (পারফরমেন্সে, আচার-অনুষ্ঠানে, শিল্পে) সংযুক্ত করে বাতাই দেখাচ্ছেন এই প্রতিক্রিয়া একেবারে মৌলিক মানবীয় প্রতিক্রিয়া। এইটা কোন ফ্যান্টাসি বা কল্পনাপ্রসূত আচরণ নয়। বরং এই ঘটনার বারেবারে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ট্রেডিশন এই পুনরাবৃত্তি ঘটায়। শুধু হেগেল নয়, পুরো মানবজাতি মৃত্যু কি দেয় আর কি কেড়ে নেয় সেই চিন্তায় বিভোর থেকেছে।


তারপরেও, হেগেল ও উৎসর্গের মানুষের মধ্যে একটা গভীর পার্থক্য আছে। হেগেল তার নঞর্থকতার উপস্থাপন নিয়ে সজাগ ছিলেন। সে “Coherent discourse” এর একটা নির্দিষ্ট স্থানে খুবই পরিষ্কারভাবে এটাকে স্থাপন করেছেন। এটা হেগেলের কাছে হেগেলকে প্রকাশিত করেছে। সেই সমগ্রতা এই ডিস্কোর্সকে ধারণ করে যা কিনা তাকেই প্রকাশ করে। স্যাক্রিফাইসের মানুষের সে যা করেছে তা নিয়ে কোন ডিস্কার্সিভ কনশাসনেস নাই। কেবলমাত্র একটা ‘ইন্দ্রিয়লব্ধ’ সচেতনতা আছে। এই সচেতনতা ভীষণ গোলমেলে এবং এটি দুর্বোধ্য আবেগের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ে।


এটা সত্যি যে হেগেল নিজেও মৃত্যুর আরো বেশি ভায়োলেন্ট ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছেন। এই ধাক্কা আরো বেশি ভায়োলেন্ট এই জন্য যে এটা সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায়যে হেগেলের জন্য বেঁচে থাকাই ভয়াবহ বাজে একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু স্যাক্রিফাইসের মানুষ মূলত জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকে। আঁকড়ে ধরে থাকে শুধুমাত্র এই জন্য না যে মৃত্যুর উপস্থাপিত হওয়ার জন্য জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে আসলে এটাকে সমৃদ্ধও করতে চায়। বাইরে থেকে দেখলে হেগেলের অনৈচ্ছিক সংবেদনের থেকে স্যাক্রিফাইসকে ঘিরে যে অভিপ্রেত উত্তেজনা তাকে বেশি আগ্রহ জাগানীয়া মনে হয়। বাতাই যে উত্তেজনার কথা বলছে তা সর্বজন পরিচিত। একে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এইটা একটা পবিত্র ভয়। স্পিরিটের বিভাজনেই (Dismemberment) সীমিত থাকেনা। এটা বরং উল্টোটা। থিয়েটারের পর্দার মত এটা অন্য এই জগতেরও উর্ধ্বে অন্য এক জগতকে উন্মুক্ত করে দেয়। যেখানে উদিত দিনের আলো সকল সকল কিছুকে রুপান্তরিত করে। ধ্বংস করে দেয় তার অর্থের সীমিত হয়ে পড়াকে। এটা একট সমৃদ্ধ আর যন্ত্রনাময় অভিজ্ঞতা। যাই হোক, কেউ বলতে পারবেনা যে হেগেল স্যাক্রিফাইসের এই মুহুর্ত সম্পর্কে সজাগ ছিলেন না। ফেনোমেনোলজি’র সমগ্র চলাচলে এই মুহুর্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেখানে মৃত্যুর নঞর্থকতাই জন্তু থেকে মানুষকে মানুষ বানায়।


কিন্তু যেহেতু হেগেল এটা ঠাওর করতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে স্যাক্রিফাইস নিজেই মৃত্যুর পুরো মুহুর্তের সাক্ষি হিসেবে হাজির থাকে, উনি আসলে জানতেন না ওনার বোঝাপড়া কতখানি সঠিক। হেগেল খুব একটা পরিষ্কারভাবে মৃত্যু থেকে দুঃখবোধকে আলাদা করেন নি।


সুনির্দিষ্ট করে বললে হেগেল মৃত্যুর এই একার্থক (univocal) চরিত্র দেখানোর কারণেই কোজেভ নিম্নোলিখিত কথাগুলি বলছেন। “মৃত্যুর ধারণা মানুষের ভালো থাকার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই রাখেনা। এটা থাকে সুখী ও করেনা, কোন আনন্দও দেয়না”। কোজেভ ভাবছেন নঞর্থকতার সাথে পরিচয় ঘটার ফলে কি উপায়ে আসলে আনন্দ আসতে পারে। কোজেভ মনে করছেন যে ইতর আনন্দ থেকে দূরে থাকা তাঁর কর্তব্য। স্পিরিট সম্পর্কে হেগেল যেরকম বলছেন “only attains it truth by finding itself in absolute dismemberment” মূলনীতির বিচারে তার সাথে কোজেভের নেতির কোন পার্থক্য নেই। মৃত্যুর ধারণাই “একমাত্র মানুষের দম্ভ পুরা করতে পারে”, কোজেভ এটাই বলছে ভাবাটা অত্যুক্তি হবে। প্রকৃতপক্ষে “Recognized” হওয়ার বাসনাকে একটা ভয়ডরহীন ভংগীতে প্রকাশ করা যায়। হেগেল এই বাসনাকেই ঐতিহাসিক সংগ্রামের (historical struggle) কেন্দ্রে রাখছেন। কোজেভ বলছেন “নিজের নশ্বর বা সীমিত সত্ত সম্পর্কে সজাগ হওয়ার মাধ্যমে ও জগতে ইশ্বরবিহীন বা তারও উর্ধ্বে অস্তিত্বশীল হওয়ার মাধ্যমেই মানুষ তার স্বাধীনতা, ঐতিহাসিকতা ও ইন্ডিভিজুয়ালিটি কায়েম করতে পারে”।


কিন্তু কোজেভ যদি ইতর সুখ আনন্দকে পাশ কাটিয়ে যেয়ে থাকেন, উনি হেগেলের “পরম বিভাজন”১ কেও(absolute dismemberment) পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন।বস্তুত এই প্রকৃতির বিভাজনের সাথে খুব সহজে “Recognized” হওয়ার বাসনার আপোষ হয়না।


পরিতৃপ্তি আর বিভাজন একটা জায়গা অবশ্য একবিন্দুতে চলে আসে। তাঁদের এই মিলন বিন্দু হচ্ছে আনন্দ। তাঁদের এই মিলন ঘটে স্যাক্রিফাইসে। স্যাক্রিফাইসকে Naïve form of life হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষ যা তা আসলে প্রকাশিত হয় স্যাক্রিফাইসের দ্বারা। ভেতরের জন্তুর প্রয়োজন মেটানোর শর্তেই মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে। একই সাথে মানুষ মানুষ হয়ে ওঠার পরে তার মাঝে যা কিছু নতুন থাকে তাও এই শর্তের অধীন। অর্থাৎ তার যে ‘জান্তব’ চাহিদা (animal needs) তা মেটানোর পরিপ্রেক্ষিতেই তার মাঝে এই নতুনত্ব ধরা দেয়।


যে কোন অবস্থাতেই আনন্দ (অন্তত শরীরি আনন্দ) নিয়ে কোজেভের যে বোঝাপড়া তাকে উর্ধ্বে তুলে ধরা মুশকিলের কাজ। শরীরি আনন্দকে বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বহুক্ষেত্রে মৃত্যুর ধারণা ভূমিকা রাখে। বাতাই আরো দূরে এগিয়ে যাবেন। উনি মনে করছেন অপবিত্র(defile) আদলে Erotism এর মূলে থাকে মৃত্যুর দুনিয়া। মৃত্যুর সাথে পাপের ধারণাকে যুক্ত করা হয়। ঠিক একইভাবে Pleasure এর সাথেও পাপের ধারণাকে যুক্ত করা হয়। কার্যত পারিপার্শ্বিকতা সাথে অনিয়ম ঘটানো ব্যতিরেকে কোন Human pleasure সম্ভব না। এর মধ্যে সবচাইতে সহজ সরল ও জবরদস্ত উদাহরণ হচ্ছে নগ্নতা।


উপরন্তু অধিকারকে স্যাক্রিফাইসের ছবির সাথে যুক্ত করা হতো। স্যাক্রিফাইসে নারীই ছিল প্রধান প্রধান শিকার। প্রাচীন কবিতায় সেই যে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে তা খুবই অর্থপূর্ণ। এটা আসলে সচেতনতার সুনির্দিষ্ট দশাকে সামনে নিয়ে আসে। এই দশায় ‘পবিত্র’কে ঘিরে যে ভয় তার সাথে মৃদু আনন্দের মিলন ঘটে। শেষ বিচারে আনন্দের যে ব্যবহার তার সাথে স্যাক্রিফাইসের স্বাদ ও স্যাক্রিফাইস যে আবেগ উৎপাদন করে তার মধ্যে কোন বিরোধ থাকেনা। এটাও বলতে হবে যে ট্রাজেডির মতই স্যাক্রিফাইসও ছিল উদযাপনের অনুষঙ্গ।


মৃত্যুর সাথে আনন্দের এই সম্পর্ক কোন প্রদত্ত ব্যপার নয়। অন্তত চেতনায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রদত্ততো নয় ই। মৃত্যুর দুঃখের সাথে নিঃসন্দেহে আনন্দের বিরোধীতাপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এই বিরোধীতা সবসময়েই চেতনার পটভূমিতে থেকে যায়। মূলনীতিগত জায়গায় মনুষ্য সচেতনভাবে মৃত্যুর পূর্বে ভয় পেয়ে পিছু হটে। কুঁকড়ে যায়। মূলনীতিগত জায়গায় নঞর্থকতার বিনাশী প্রভাব প্রকৃতিকে তার লক্ষ হিসেবে নেয়। কিন্তু মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য তাকে বিপদের মুখে দাঁড়াতেই হয়। জান্তবতা ও তার প্রাকৃতিক সত্ত থেকে উত্তরোণের জন্য তাকে তার ক্রিয়ার কার্য-কারণ সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকতে হয়। অজ্ঞাত থাকা তার এই মুখোমুখি দাঁড়ানোর পূর্বশর্ত। এখন, হেগেলকে নঞর্থকতা সম্পর্কে সজাগ হতে হয়েছে। মৃত্যুর ক্রিয়ার (the work of death) চোখে চোখ রেখে হেগেলকে মৃত্যু উৎপাদিত ভয়কে বুঝতে হয়েছে। যারা বলে “এটা কিছুই না” তাঁদের সাথে ওনার বিরোধিতা বেশি। এদিক থেকে যারা “পিছু হটে” তাদের সাথে বরং বিরোধ খানিকটা কম। যারা উল্লাসের সাথে প্রতিক্রিয়া দেখায় হেগেল তাঁদের সাথে নিজের দূরত্ব তৈরি করেন।


হেগেলের পরম প্রজ্ঞার সাথে সহজ-সরল বোধের যে পার্থক্য তাতে বাতাই জোর দিতে চান। এক্ষেত্রে উল্লাসের সাথে মৃত্যু-ক্রিয়া মুখোমুখি হওয়ার একটা উদাহরণ টানবেন তিনি। এটাকে হেগেল একটা স্ববিরোধী মনোভাব হিসেবে দেখবেন।


আইরিশে ও ওয়েলশদের “Wake” এর যে প্রথা তা এখন খুবই স্বল্প পরিচিত। পালন করাও হয় খুবই অল্পমাত্রায়। এর ভালো উপস্থাপন পাওয়া যায় জেমস জয়েসের শেষ লেখা Finnegans Wake এ। মৃত্যুর পরে ওয়েলশে ফিনেগানের কফিন উন্মুক্ত করে রাখা হয়। এই মৃত মানুষকে সবচাইতে সেরা স্যুট ও টুপি(Hat) পরিধান করানো হয়। ফিনেগানের পরিবার তার সকল শুভাকাঙ্ক্ষীকে আমন্ত্রণ জানায়। তাঁরা একসাথে নাচে এবং প্রচুর মদ্যপান করে।যারা নাচছে ও তার স্বাস্থের উদ্দেশ্যে মদ্যপান করছেন ফিনেগানের এই মৃত্যু তাঁদের জন্য ‘অপরের’ মৃত্যু। কিন্তু, অপরের মৃত্যু নিজেরই মৃত্যুর প্রতিমূর্তির মত। শুধুমাত্র একটি শর্তেই এই মৃত্যু নিয়ে এতো আনন্দোৎসব করা সম্ভব। মৃতের সাথে জীবিতে যে মদ্যপান করছে তার সাথে একটা চুক্তির মত এই শর্ত। জীবিত যখন মরে যাবে তখন তার পূর্বর্তীদের মতই সে হবে। কোন আলাদা অর্থ তৈরী হবেনা।


এই স্ববিরোধীতাকে মৃত্যুর অস্তিত্বকে প্রত্যখান করার বাসনার প্র্যতুত্তর হিসেবে পড়া যেতে পারে। একটা যৌক্তিক বাসনা? বাতাই একেবারেই তা মনে করেন না। আজকের দিনে (বাতাই যখন লিখছে) মেক্সিকোতে পার্কে বিনোদনের যে ব্যবস্থা থাকে তার মধ্যে দিয়ে মৃত্যুর দিকে উকি দেয়া যায়। মৃত কংকালের পুতুল, মৃত কংকালের ক্যান্ডি, মৃত কংকালের রাইড ইত্যাদি। এগুলি মৃত্যু নিয়ে তীব্র ঘোরের মধ্যে থাকার নমুনা।


আমি যদি মৃত্যুকে আনন্দময়ভাবে কল্পনা করি তার মানে এই না যে আমি বলি “মৃত্যু কিছুইনা” অথবা “এইটা ভুয়া”। উল্টোটা বরং। মৃত্যু নিয়ে আমি যখন উল্লাসের সাথে চিন্তা করি তা আমার মধ্যে একধরণের যন্ত্রণা তৈরি করে। আমার নিজস্ব যন্ত্রণার দ্বারা এই যন্ত্রণা আরো তীব্র হয়। শেষতক যন্ত্রণাময় আনন্দ আমার মধ্যে আনন্দময় যন্ত্রনা উৎপাদন করে। এটা অনেকটা জ্বরাক্রান্ত শিহরণ দেয়। এই আনন্দই আমাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করবে। এক বিষন্নতা আমায় জেঁকে ধরবে এই আনন্দের পরপরই।


জান্তব চাহিদা পূরণ হওয়ার পরে মানুষের আচরণে স্যাক্রফাইস কি ভূমিকা রাখে ও তার কি অর্থ তৈরি হয় তা নিয়ে বাতাই ইতোমধ্যে আলোচনা করেছেন। মানুষ তখন তার প্রাকৃতিক সত্তর থেকে আলাদা হয়। মানুষ হিসেবে আসলে সে তাই যার ইংগিত সে বলির মাধ্যমে দেয়। জান্তব চাহিদা থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সে সার্বভৌম হয়ে ওঠে। সে তাই করে যা তাকে সুখ দেয়। সে তাই করে যা তার করতে ভালো লাগে। সে যা করতে চায়। তার খুশিমতই সে সিদ্ধান্ত নেয়। এই শর্তগুলির অধীনেই একরকম স্বায়ত্ত্বশাসন কায়েম করে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার জান্তব সত্ত নিয়ে ভাবালু থাকছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার একটা লক্ষ্য মাথায় রাখতে হচ্ছে (তাকে খাবার খুঁজতে হবে, ঠান্ডা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আশ্রয় খুঁজতে হবে)। এটা একধরণের বশ্যতাকে স্বীকার করে নেয়া। একটা চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত করা। এটা তার জান্তব সত্তর আচরণ যাকে ছাড়া আবার সার্বভৌম মানুষ টিকে থাকতে পারেনা। কিন্তু মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও তার ডিসকার্সিভ চিন্তা ক্রিতদাসতূল্য শ্রমের অঙ্গ হিসেবেই বিকশিত হয়। শুধুমাত্র ‘পবিত্র’ ও ‘কাব্যিক শব্দেই’ সার্বভৌমত্ব পূর্ণরূপে প্রকাশিত হতে পারে। কিন্তু এটি আবার নপুংশক সৌন্দর্যেই সীমিত। স্যাক্রিফাইস তাই ততক্ষণ পর্যন্ত সার্বভৌম ও স্বায়ত্ত্বশাসিত সত্ত থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত সে অর্থপূর্ণ ভাষণ (Discourse) সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে।


সংজ্ঞাগত ভাবেই যা সার্বভৌম তা কারো অধীনস্ত হবেনা। কিন্তু ডিস্কার্সিভ চিন্তা অর্থের দিক থেকে প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগের প্রশ্ন তোলে। সহজ-সরল ভাষণকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।মূলনীতিগত জায়গায় সকল কিছুই কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে সামনে রেখে হাজির থাকে। সে এই উদ্দেশ্যের দাসত্ব করে। মৃত্যুর বা বিনাশের সাথে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার যে সম্পর্ক তাতে সার্বভৌমত্ব থেকে কৃতদাসতুল্য লক্ষ্যের ভূমিকাই মূখ্য হয়ে ওঠে। পুরাণ, যাকে আচারের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হত, তার প্রথম দিকে কাব্যের নপুংশক সৌন্দর্য ছিল। কিন্তু স্যাক্রিফাইসের ভাষণ ইতর স্ব-ভজনামূলক ব্যখ্যায় পর্যবসিত হয়েছে। সত্তর শুদ্ধতা অথবা খোদাকে শান্তকরণ দিয়ে শুরু হলেও কাব্যের ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ ভাষণ শেষ হয় বৃষ্টির প্রাচুর্য বা শহরের মঙ্গলের কথা দিয়ে। ফ্রেজার সার্বভৌমের সেই সব গড়নের কথা ফিরিয়ে আনে যা সবচাইতে নপুংশক, অক্ষম। ফ্রেজার তার শক্তিশালী কাজগুলো আচারের কর্মকান্ডের সাথে উদ্দেশ্যকে এমনভাবে যুক্ত করে ব্যখ্যা করেন যেনো তা ক্ষেতে ধান কাটার মত। উনি স্যাক্রিফাইস কৃষি সংশ্লিষ্ট আচার বলে ব্যখ্যা করেন। ওনার ব্যখ্যা স্যাক্রিফাইসকে এর মধ্যে সীমিত করে ফেলে। ফ্রেজারের Golden Bough এর প্রস্তাবনাকে এখন আর কেউ খুব একটা পাত্তা দেননা। কিন্তু এটা বলাই যায় যে সেইসকল মানুষেরা যারা সার্বভৌম স্যাক্রিফাইস করেছে তারা এটাকে কৃষকের ভাষার পরিসরের মধ্যেই খোদাই করেছে। এতা সত্য যে খুবই খেয়ালমাফিকভাবে তাঁদের স্যাক্রিফাইস কার্য-সূত্রে(laws of action) পর্যবসিত হয়েছে । তারা স্যাক্রিফাইসকে কার্য-সূত্রের কাছে সমর্পণ করে। এই সূত্রের কাছে তাঁরা নিজেরাও সমর্পিত হয়েছে অথবা হওয়ার জন্য পরিশ্রম করেছে।


অতএব স্যাক্রিফাইসের সার্বভৌমত্বকে পরম সার্বভৌমত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যায়না। হ্যাঁ, সার্বভৌমত্ব যতক্ষণ ফলপ্রসূতার সাথে সম্পর্কিত ততক্ষণ স্যাক্রিফাইসকে সার্বভৌম বলা যায়।


হেগেল পরম সার্বভৌমে না পৌছাতে পারলেও তার কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। যা স্যাক্রিফাইসকে লক্ষ্য না বানিয়ে নিছক একটা পথে পর্যবসিত করে তা থেকে আমরা হেগেলকে আলাদা করেছি। অর্থের অদল বদল ঘটিয়ে আরো সমৃদ্ধ প্রতিকৃতির দিকে চোখ না ফেরাতে পারলে এটা দৃষ্টিগোচর হত না।


হেগেলের জন্য সার্বভৌমত্ব শুরু হয় একটা অবস্থান পরিবর্তন থেকে। এটাকে ভাষণ(Discourse) প্রকাশ করে। সাধুর স্পিরিটে এই প্রকাশ থেকে আবার সার্বভৌমত্ব কখনো জুদাও হয়না। এই কারণে এটা কখনো পুরোপুরি সার্বভৌম হতেও পারেনা। প্রজ্ঞার যে লক্ষ্য সাধু কখনো একে তার অধীন না করে পারেন না। ধরে নেয়া হয় প্রজ্ঞাতে এই ভাষণের সমাপ্তি ঘটে। তাই সাধুর পক্ষে এটা না করে তাকা সম্ভব না। একমাত্র প্রজ্ঞাই হবে পুরোপুরি স্বায়ত্ত্বশাসিত। এটাই সত্তর সার্বভৌমত্ব। অন্তত পক্ষে এটা হত যদি আমরা প্রজ্ঞার অনুসন্ধান করতে গিয়ে সার্বভৌমত্ব খুঁজে পেতাম। বস্তুত খোজা শুরু মাত্র সার্বভৌম হয়ে ওঠার প্রকল্পে ঢুকে পড়া হয়। কিন্তু সার্বভৌম সত্ত একটা কৃতদাস সত্তকে পূর্বানুমান করে নেয়। হেগেল বলছে absolute dismemberment কালে ভাষণে একটা ছেদ ঘটে। এই সময়েই সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয়। কিন্তু এই ছেদ ই সার্বভৌমত্ব নয়। এক অর্থে এটা একটা দুর্ঘটনা। ফারাক থাকা সত্ত্বেও সহজ-সরল আর সাধুর সার্বভৌমত্বে একটা জায়গা একই রকম। এই সার্বভৌমত্ব মৃত্যুর সার্বভৌমত্ব। হেগেলের ক্ষেত্রে এই সুনির্দিষ্টভাবেই আকস্মিক দুর্ঘটনা। এটা নিছক দুর্ভাগ্যের ব্যপার না। Dismemberment বরং ভীষণ অর্থপূর্ণ( হেগেল লিখছে “নিজেকে absolute dismemberment এ খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে স্পিরিটই কেবলমাত্র এই সত্য অর্জনে সক্ষম”)। কিন্তু এই অর্থ দুর্ভাগ্যজনক। সাধু মৃত্যুর যেখানে রাজত্ব করে সেখানে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যা বের করে আনে এটা তাকে সীমিত ও দ্বীন-দরিদ্র করে দেয়। হেগেল সার্বভৌমত্ব কে স্বাগত জানাত একটা বোঝা হিসেবে এবং এই বোঝা উনি ছেড়ে দেন।


বাতাই কি হেগেলের মনোভাবকে লঘু করে ফেলে? কিন্তু উল্টোটাও সত্য। বাতাই বলছেন উনি হেগেলের কাজের অতুলনীয় জায়গাটা দেখাতে চান। তা করতে গিয়ে ওনার যে কিছু ব্যর্থতার অবকাশ রয়ে যায় তাও উনি আড়াল করছেন না। বাতাইর লেখায় হেগেলের পদ্ধতির যে চরম নিশ্চয়তা তাই উঠে আসে বলে উনি দাবি করেন। হেগেল যদি ব্যর্থ হন তবে এটা বলা যাবেনা যে এই ব্যর্থতা একটা ভুলের ফসল। এটা যে ব্যর্থতা ঘটাচ্ছে তার থেকে খোদ ব্যর্থতার অর্থই আলাদা।


বস্তুত মানুষ সবসময়েই একটা খাঁটি সার্বভৌমত্ব খুঁজে বেড়ায়। সার্বভৌমত্বের মৌলিকতার বিবেচনা করলে এটা হেগেলের। কিন্তু যেহেতু উনি এটা সচেতনভাবে করছেন না তাই এটাকে পুরোপুরি হেগেলেরও বলা যায়না।বিভিন্নভাবে উনি ক্রমাগত একে তাড়া করে গেছেন কিন্তু কোনদিনই নাগাল পাননি। মূল বিষয়টা হল কেউ সচেতনভাবে একে খুঁজতে পারবেনা কারণ খুঁজতে গেলেই এটা দূরে সরে যায়।

____________


প্রাথমিক নোটঃ

১। Dismemberment শব্দের অনুবাদ ঠিক বিভাজন করা যায়না। হেগেল এটি দ্বারা বোঝাচ্ছেন বহু খন্ডে ভাগ হয়ে যাওয়ার কথা।



প্রথম প্রকাশঃ ১৩ই অক্টোবর, ২০১৯

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১৩ই অক্টোবর, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/3438737609545990/