সাহিত্যই আমাদের সবচাইতে বাজে সম্ভাবনা ঠাওর করাকে সম্ভব করে তোলে

জর্জ বাতাই


[১৯৫৮ সালে পিয়ের দ্যুমাই’য়ে জর্জ বাতাইয়ের একটা সাক্ষাৎকার নেন। এটাই বাতাই’র একমাত্র টিভি সাক্ষাৎকার। Literature and Evil শিরোনামে সেই সময়ে প্রকাশিত বইকে ঘিরে মূলত এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে। এছাড়াও সাক্ষাৎকারে Eroticism এর ধারণার প্রসঙ্গ এসেছে। বলে রাখা ভালো, জর্জ বাতাই এরোটিসিজমকে শুধুমাত্র যৌনতায় সীমিত করেন নি। বরং এর সাথে নীটশের ইশ্বরের মৃত্যুর ধারণা সংযুক্ত করে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। বাতাই’র অতীব জটিল লেখালেখির জগতে ঢোকার ক্ষেত্রে এই সাক্ষাৎকারটি বিশেষ কাজের হতে পারে বিবেচনা করে অনুবাদ করা হয়েছে। ভিদার ভাইকিংসনের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনূদিত।]




পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ প্রথমে আমি আপনাকে এই বইটার নাম নিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই। আপনি কোন মন্দের(evil) কথা বলছেন?


জর্জ বাতাইঃ আমি মনে করি দুই ধরণের পরষ্পর বিরোধী মন্দ আছে । প্রথমটা মানুষী কার্যক্রম ঠিকঠাক চলা এবং আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়ার প্রয়োজনীয়তার সাথে সম্পর্কিত। এবং অন্যটা ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছু একেবারে গোড়ার দিকের ট্যাবু ভাঙ্গার সাথে সম্পর্কিত। যেমন ধরুন, খুন করার বিরুদ্ধে যে ট্যাবু। কিম্বা কিছু যৌনাত্মক সম্ভাবনার বিরুদ্ধে ট্যাবু।


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ As in do evil and act evil.


বাতাইঃ হ্যাঁ


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ বইয়ের শিরোনাম কি এটার ইংগিত দেয় যে মন্দকাজ আর সাহিত্য আসলে অবিচ্ছেদ্য?


বাতাইঃ হ্যাঁ। আমি এরকমটাই মনে করি। সম্ভবত এটা প্রথমে এত পরিষ্কার হয়না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, যদি সাহিত্য মন্দ থেকে দূরে থাকে, এটা খুব দ্রুতই একঘেয়ে হয়ে পড়ে। এটা আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে। সে যাই হোক, আমি মনে করি এটা খুব দ্রুতই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাহিত্যকে আসলে যাতনা (anguish) নিয়ে কারবার করতে হয়। এই যাতনা এমন কিছুর ওপরে নির্ভর করে যা আসলে ভুল দিকে যাচ্ছে (going the wrong way)। এমন কিছু যা সন্দেহাতীতভাবেই মন্দতে রূপ নিবে। যে গল্পের একটা মন্দ সমাপ্তি আছে, যেই চরিত্রগুলি নিয়ে পাঠিকা উদ্বিগ্ন (উপন্যাস আসলে কি নিয়ে আমি সেটাকে এখন সরলীকরণ করছি) আপনি যখন পাঠিকাকে সেটা দেখান, অথবা নিদেনপক্ষে মন্দের সম্ভাব্যতার সামনে তাকে দাঁড় করান, পাঠিকা তখন একরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েন। ফলে এমন এক টেনশন হাজির হয় যা সাহিত্যকে একঘেয়েমিতা থেকে বের করে আনে।


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ তো, যেকোন ভালো লেখকই কি লেখার সময়ে অনুশোচনায় ভোগেন?


বাতাইঃ বেশিরভাগ লেখক এ বিষয়ে সচেতন নয়। কিন্তু আমি মনে করি এখানে মন্দ কোন কাজের জন্য একটা সুগভীর অনুশোচনাবোধ কাজ করে। লেখালেখি আসলে কাজের ঠিক উল্টোটা। এটা অযৌক্তিক শোনাতে পারে। কিন্তু তারপরেও সকল দুর্দান্ত বই মূলত সত্য-কাজ বিরোধী প্রচেষ্টা।


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ আপনি কি এমন এক দুইজন লেখকের কথা বলবেন যারা লেখা নিয়ে অনুশোচনায় ভুগেছেন? কারা ভেবেছেন যে লেখক হওয়াটা তাঁদের জন্য অপরাধী হওয়ার মত?


বাতাইঃ আমার বইয়ে আমি দু’জনের নাম নিয়েছি যারা এক্ষেত্রে চমৎকার উদাহরণ। এরা হচ্ছেন বোদলেয়ার ও কাফকা। এরা দু’জনই জানতেন যে তারা মন্দের দিকটায় আছেন। ফলতঃ তাঁরা অনুতপ্ত ছিলেন। বোদলেয়ারের ক্ষেত্রে তাঁর শিরোনাম বেছে নেয়া দেখলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তাঁর সবচাইতে ব্যক্তিগত লেখালেখির শিরোনাম হচ্ছে “মন্দের ফুলগুলি”(Flowers of Evil)। কাফকার ক্ষেত্রে এটা আরো পরিষ্কার। তিনি ভেবেছেন, উনি যখন লিখছেন উনি আসলে ওনার পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাচ্ছেন। এই কারণে উনি নিজেকে একটা অনুতাপের জায়গায় বসিয়েছেন। এটা সত্য যে ওনার পরিবার ওনাকে জানিয়েছিলো যে লেখালেখি করে জীবন কাটিয়ে দেয়াটা খারাপ কাজ। সঠিক কাজ হচ্ছে অর্থ-উপার্জন সংক্রান্ত কাজে নিজেকে নিযুক্ত করা। আপনি যদি এর অন্যথা করেন তারমানে আপনি খারাপ কাজ করছেন।

https://www.youtube.com/embed/5XCnGuK8CVc


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ কিন্তু, একজন লেখক হওয়া মানে যদি খারাপ কিছু করার অনুশোচনায় ভোগা হয়, সেক্ষেত্রে বোদলেয়ার ও কাফকার বেলায় লেখক হওয়া মানে অদায়িত্বশীল হওয়াও।


বাতাইঃ তাঁদের পরিবার এটাই মনে করত।


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ এই অনুশোচনাবোধ তো ওনাদের জন্য অনেকটা শিশুতোষ। আপনি মনে করেন লেখালেখির কালে বোদলেয়ার কাফকা নিজেদের বালসুলভ ভেবে অনুতপ্ত হয়েছেন?


বাতাইঃ আমি মনে করি এটা বেশ পরিষ্কার। ওনারা এমনকি এটাও বলছেন যে, ওনারা মনে করতেন যে ওনারা একই পরিস্থিতিতে আছেন। পিতামাতার সামনে শিশুর মত। এমন এক সন্তান যে দুষ্টোমি করছে। এবং যে বিবেকের দংশনে বিদ্ধ হচ্ছে। কারণ তিনি তার পিতামাতা কে যেভাবে দেখছেন সেটা হচ্ছে ওনারা সবসময়ই কি করা যাবেনা সেটা বলছেন। অর্থাৎ এটা একটা খারাপ কাজ।


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ কিন্তু সাহিত্য যদি শিশুতোষ হয়, লেখার সময়ে লেখকরা যদি এই শিশুসুলভতা নিয়ে অনুশোচনায় ভোগেন, তার মানে কি এটাও দাঁড়ায় না যে সাহিত্য আসলে শিশুসুলভতা?


বাতাইঃ আমি মনে করি মর্মগত ভাবেই সাহিত্যের একটা শিশু শিশু ব্যাপার আছে। সাহিত্য নিয়ে যে শ্রদ্ধাবোধ আছে, যেটা আমার মধ্যেও আছে, তার সাথে এটা বেমানান লাগতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এটা একটা সুগভীর ও গোঁড়ার সত্য যে আপনি সাহিত্য বোঝার ধারেকাছেও আসতে পারবেন না যদিনা আপনি এটাকে শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে না ভাবেন। আমি শিশুর দৃষ্টিকোণ বলতে হালকা বোঝাপড়া বোঝাচ্ছিনা।


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ আপনি এরোটিসিজমের (Eroticism) ওপরে একটা বই লিখেছেন। আপনি কি মনে করেন সাহিত্যে এরোটিসিজম বালসুলভ?


বাতাইঃ আমি ঠিক নিশ্চিত না, সাহিত্য এই বিচারে এরোটিসিজম থেকে ভিন্ন হবে কিনা। কিন্তু আমি মনে করি এরোটিসিজমের বালসুলভ বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরোটিসিজম অনুভব করা সেই শিশুর মত যে কিনা একটা নিষিদ্ধ খেলায় মেতে উঠতে চায়। এরোটিসিজম দ্বারা আকৃষ্ট মানুষ, পিতামাতার সম্মুখে হাজির থাকা শিশুর মত। তার সাথে কি হতে চলেছে বা কি হবে সেটা নিয়ে সে ভীত। যতক্ষণ পর্যন্ত ভয় পাওয়ার কোন কারণ আছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে থামবেও না। সাধারণ প্রাপ্তবয়স্করা যা করে সন্তুষ্ট থাকে তার জন্য তা যথেষ্ট নয়। তাকে ভয় পেতে হবে। সে শিশুকালে যেমন ছিল, নিজেকে সেই দশায় খুজে পেতে হবে। একই সাথে নিরন্তর তিরষ্কারের ভয়ে ভীত থাকতে হবে। এমনকি অসহনীয় মাত্রার শাস্তির ভয়ও তাকে পেতে হবে।


পিয়ের দ্যুমাই’য়েঃ সম্ভবত আমি এরকমটা বলেছি অথবা আপনার কথার সূত্রে মনে হয়েছে যে আপনি এই বালসুলভতাকে একরকমের দোষী সাব্যস্ত করছেন। কিন্তু কার্যত আমাদের এখন পুনরায় বইয়ের শিরোনামে ফেরত যাওয়া দরকার। সাহিত্য ও মন্দকাজ। আপনি সাহিত্য অথবা মন্দকাজ কোনটাতেই আপত্তি তুলছেন না। এই বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমাদের আরো ধারণা দেবেন কি?


বাতাইঃ এটা নিশ্চিতভাবেই একটা সতর্কবার্তা। এটা বলছে যে একটা বিপদ আছে। কিন্তু এই বিপদ সম্পর্কে সজাগ হওয়া মাত্রই এই বিপদের মোকাবিলা করার জন্য আপনার কাছে যথেষ্ট কারণ থাকবে। আমি মনে করি, এই বিপদ অর্থাৎ সাহিত্যকে মোকাবিলা করার গুরুত্ব আছে। আমি মনে করি, এটা খুবই বিরাট ও সত্যিকারের বিপদ। কিন্তু আপনি মানুষই না যদিনা আপনি এই বিপদের মোকাবিলা না করেন। আমি মনে করি,

সাহিত্যে মনুষ্য দৃষ্টিকোণকে তার সমগ্রতায় পাওয়া যায়। কারণ মনুষ্য প্রকৃতিকে তার সবচাইতে নৃশংস জায়গা থেকে বিবেচনা না করিয়ে সাহিত্য আমাদের বাঁচার অনুমতি দেয়না, সাহিত্য আমাদের বাঁচতে দেয়না।


আপনাকে শুধু ট্রাজেডি নিয়েই ভাবতে হবে। শেক্সপীয়ার। এই ঢংয়ে আরো অনেক উদাহরণ আছে। সবশেষে, সাহিত্যই আমাদের সবচাইতে বাজে সম্ভাবনা ঠাওর করাকে সম্ভব করে তোলে। একই সাথে কিভাবে সেটার সামনে দাঁড়াতে হয়, সেটাকে মারিয়ে যাওয়া যায় তার সম্ভাবনার দরজাও খুলে দেয়। সংক্ষেপে বললে, যে মানুষ খেলতে নামে সে খেলার মধ্যকার বিভীষিকা কিভাবে অতিক্রম করা যায় তা বুঝে ফেলে।

______________

প্রথম প্রকাশঃ ১৭ই অক্টোবর, ২০১৯

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১৭ই অক্টোবর, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/2982467801855297/