মানুষ যা’কিছুকে ভয় পায় সেগুলোর মধ্যে মৃত্যু’কেই সব’চে কম জানে

জিগমুন্ট বম্যান


[জিগমুন্ট বম্যান, পোলিশ সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। ‘কম্যুনিস্ট’ সরকারের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন ও নাগরিকত্ব হারান। এরপরে ইংল্যান্ডে বসবাস করতে শুরু করেন। সমাজতাত্বিক ও দার্শনিক বম্যান আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, তরল আধুনিকতা ও ভোগবাদ নিয়ে বিস্তৃত কাজ করেছেন। “তারল্য” ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ, নজরদারি ও শাসনব্যবস্থা, ভয় ও প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদি। তাঁর Liquid Fears বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। Anthrocom নামের নৃবিজ্ঞানের অনলাইন জার্নালে এই বইয়ের একটি রিভিয়্যু লিখেছেন ম্যাক্সিমিলিয়ানো করস্তানে(Maxi Korstanje)। করস্তানে আর্জেন্টিনার পালের্মো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের গবেষক এবং সন্ত্রাসবাদ, মোবিলিটি ও ট্যুরিজম তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। রিভিয়্যুটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন কাব্য কৃত্তিকা। কাব্য কৃত্তিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন।]


তরল ভয়ঃ বর্তমান সমাজ ও তার তরল ভয়সমূহ

সম্ভাব্য বিপদের সংকেত দেবার মাধ্যমে রক্ষা করা মানবীয় প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হবে ভয় ও আতঙ্ক(phobias)। যাইহোক, যুক্তরাষ্ট্রের ১১ই সেপ্টেম্বরের(২০০১, টুইন টাওয়ারে হামলা) আক্রমণের পরে এগুলো ত্রাসে(panic) পরিণত হয়েছে। শিল্পোন্নত সমাজের মধ্যে এটা আরও বড় হয়ে উঠেছে। এই রিভিয়্যুতে আধুনিক তরল সমাজে বিদ্যমান এ ধরনের ভয়ের প্রভাব নিয়েই মূলত আলোচনা করা হবে। শুরুর দিকের এক অধ্যায়ে বম্যান দেখান যে, প্রানীকূলের (নির্দিষ্ট কোন অবস্থা থেকে পালানোর জন্য একধরনের সহজাত আবেগীয় অনুভূতি হিসেবে প্রাথমিকভাবে এই ভয় কাজ করে) বিপরীতে মানুষের আনুষঙ্গিক ভয়কে ব্যাখ্যা করার দক্ষতা রয়েছে। “সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে” আনুষঙ্গিক এই ভয় পুনরুৎপাদিত হতে থাকে।


অদ্ভূতভাবে, ‘যখন এই ভয় কোনো বাধনহীন, নোঙ্গরহীন এবং ঘরহীন অথবা একটি সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই মুক্তভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে; যখন এটা ব্যাপ্ত, বিক্ষিপ্ত অথচ পরিষ্কার নয়, তখনই এই ভয় আরও বেশি ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায় ’ (বম্যান, ২০০৮: ১০)। সহজভাবে বললে, মানবীয় ভয় মানুষের কল্পনার ভেতরে থাকাকালীন অবস্থায়ই স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করে যেতে পারে। এটা মানুষের চৈতন্যের ভেতরেই শায়িত থাকে এবং মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি যখন কোনও সরাসরি হুমকি অস্তিত্বশীল না(অমূলক ভয়) তখনও এটা কাজ করে।


এই বিপদ ও “অমূলক ভয়”কে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:


ক) ব্যক্তিকে দৈহিকভাবে আতঙ্কিত করে যেসকল ভয়

খ) ব্যক্তির সামাজিক বিন্যাসের স্থায়িত্ব নষ্ট করার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ যেসকল ভয় এবং

গ) (ফেনোমেনোলজিক্যাল) এই পৃথিবীতে ব্যাক্তির স্থানকে হুমকিতে ফেলে যেসকল ভয়।


একটা অমূলক ভয় যদিও আসন্ন কোন বিপদকে নির্দেশ করতে পারে না, তবুও সহযোগিতার মূলনীতি অবলম্বন করে এমন অন্যান্য উপায়ে্র মারফতে অনিরাপত্তা বোধ ছড়িয়ে দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, আধুনিক রাষ্ট্র হলো তার জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বপালনকারী ব্যবস্থা। কিন্তু, রাষ্ট্র যখন তার নিজস্ব সম্ভাবনা'কে ছাড়িয়ে যায়, তখন পুঁজির বাজারের মতন অন্যান্য স্তরের হাতে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেয়।


এই ব্যাখ্যা অনুসারে, মানুষ ভয়কে ঝুঁকিতে রূপান্তরিত করে। যার মাধ্যমে মানুষ স্বভাবতই আকস্মিক ঘটনার অনাকাঙ্খিত সব ফলাফলগুলো কমানোর চেষ্টা করে। দার্শনিকভাবে, ঝুঁকিকে হিসাবযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে নিশ্চয়তা “দৃশ্যমান ও সম্ভাব্য বিপদ” সম্পর্কে আলোকপাত করে। বম্যানের রূপরেখায়, কোন দুর্যোগই অসম্ভবের চেয়ে কঠিন কিছু না। “সভ্যতার” ধ্বসে পড়াতে প্রকৃতির রাজ্য (State of Nature, হবসীয় থিসিস অনুসারে) সর্বজনীন বস্তুগত সম্পদ প্রদানের মধ্য দিয়ে মানুষকে হানাহানি থেকে নিবৃত্ত করেছে । এভাবেই বিশৃঙ্খলা ও বর্বরতার সীমার বাইরে থাকা সভ্য জীবন এক প্রকার আচ্ছাদন হিসেবে হাজির হয়। তথাকথিত “টাইটানিক সিনড্রোম”-এ বম্যান এইকালের তরল আধুনিকতায় বিদ্যমান আতঙ্কের প্যারাডক্সকে ব্যাখ্যা করেন। বিলাসবহুল ট্রান্সআটলান্টিকের মতোই টাইটানিক বিপর্যয় সামাজের বিন্যাসকে প্রকাশ করে; যেখানে বিশাল বরফখণ্ডটি হচ্ছে মানবিকতার দোদুল্যমানতা বা নড়বড়ে অবস্থার প্রতীক।


মূলত, নিত্যকার জীবনকে ক্রমশ ক্ষয় করছে যে ভয়, সেই ভয় দিয়েই আধুনিক সমাজগুলো বিধ্বস্ত হচ্ছে । সেই সকল স্বার্থপরতা ও প্রগতিশীল সামাজিক ভাগগুলোকে সাধুবাদ, যার কারণে প্রতিটি নাগরিক এককভাবে এই ভয়গুলোর সম্মুখীন হয়। এটাই আধুনিক “মৃত্যু অব্দি ত্রাস’’ (terror to death)-এর বিষয়। এখানেই বম্যান আধুনিক টেলিভিশন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব খুঁজে পান। বিগ ব্রাদারের মত অনুষ্ঠানগুলো জনসম্মুখে মানুষের দূর্বলতাগুলোকে প্রকাশ করে। যেখানে দেখা যায়, মাত্র একজনের পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব, বাদ বাকি সবাই দণ্ড ভোগ করবে। বম্যানের মতে, বিগ ব্রাদার একটা “নৈতিক উপদেশমূলক গল্পের” মতো কাজ করে, যেখানে সংহতির চেয়েও শাস্তি এবং প্রায়শ্চিত্ত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পৃথিবীর প্রাণীকূলের মধ্যে একমাত্র মানুষই মৃত্যুর উপস্থিতিকে ভয় পায়।


পুরো বইতে বম্যান বারবার এই বিষয়টাই বলার চেষ্টা করেছেন। এটা শুধু সহজাত নয়, বরং উদ্বিগ্নতার সাথে এই পৃথিবীতে টিকে থাকার একটা তাড়নাকেও প্রকাশ করে। মানুষ যা কিছু ভয় পায়, তার মধ্যে মৃত্যুই তাঁদের কাছে সব'চে কম জানা বিষয়। এক্ষেত্রে, সংস্কৃতি একটি পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে, যা মানুষকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতি বহন করতে সাহায্য করে।


এভাবেই “আদি পাপ”, “পরিত্রাণ” এবং ফলাফলস্বরূপ নির্বাণ লাভ(salvation) এইগুলো মানুষের পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রায়শ্চিত্তের উর্ধ্বে গিয়ে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতি নির্বাচন করে। পক্ষান্তরে, পরিত্রাণের মতোই যশও আমাদের নিয়তি ও গন্তব্য এবং সেও একটা যথার্থ বলিদান প্রত্যাশা করে। সেইক্ষেত্রে ধর্ম কোনো নায়কোচিত একক যশ এবং পরিত্রাণ খোঁজে না, বরং মানুষ তার ব্যক্তিগত অমরত্বের সুবিধা না পেলেও যেকোন সময় যেন উৎকর্ষতা লাভ করতে পারে, লোকোত্তর হতে পারে সেই সুযোগ ধর্ম প্রদান করে।


বম্যানের মতে, ফরাসি বিপ্লবের প্রারম্ভে ফরাসিরা প্রাচীন রোমের বম্যানের মতে, ফরাসি বিপ্লবের প্রারম্ভে ফরাসিরা প্রাচীন রোমের pro patria (পিতৃভূমির জন্যে জীবন উৎসর্গপিতৃভূমির জন্যে জীবন উৎসর্গ) সূত্রটি গ্রহণ করেছিল। যার ফলে, আধুনিক রাষ্ট্র ও তার নাগরিকেরা নিজেদের মধ্যে সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার একটি বন্ধন তৈরি করে। যার মধ্য দিয়ে তাদের টিকে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। যুদ্ধের ময়দানে নামগোত্রহীন যারা মারা গিয়েছিল, তাদের জন্য সমাজের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই উদাহরণের মাধ্যমে বুঝতে সুবিধা হয়, কেন নাগরিকেরা উদ্বিগ্নতা কমানোর একটা উপায় হিসেবে নির্বাণের প্রতি নিবেদিত। যদি হবসীয় এবং ডুর্খেমীয় থিসিস সঠিক হয়, তবে মানবকূল সমাজকে(লেভিয়াথান) প্রতিষ্ঠিত করেছিল পবিত্র যাগযজ্ঞের একক হিসেবে, যার বিপরীতে ছিল রহস্যের ক্রিয়াকলাপ।


অথচ আজকের তরল আধুনিক ভোগের সমাজে, যা কিছু চিরজীবী(long-lived) তাকে প্রান্তিক বা খর্ব করার লক্ষ্যেই সমস্ত কৌশল মোতায়েন করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, মানুষ তার চিরঞ্জীব সব অভিজ্ঞতাকে হ্রাস করতে থাকে, কমায়ে ফেলতে থাকে। দুইশত বছর আগের সমাজের মত আমাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি আজ আর শাশ্বত হবার লক্ষ্যে কাজ করেনা, বরং একটি ক্ষণস্থায়ী জীবনযাপনের(অপবিত্র, profane) লক্ষ্য ধারণ করে।


মৃত্যুর ডিকনস্টাকশনিজমে, নেতিবাচক ও সর্বনাশা ফলাফলসমূহ পেছনে পড়ে যায়; মানবসমাজের অভিজ্ঞতায় আতঙ্কের(সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক ফলাফলের কারণে) মাত্রা বেড়ে যায়। অন্যভাবে বললে, মরে যাওয়ার ভয় আসলে বাদ পড়া(exclusion), পতিত হওয়া, এবং প্রতিবেশিদের দ্বারা বিস্মৃত হওয়ার বাজে অনুভূতির বাইরে কিছুই না। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও অহমবাদ (egoism)-এর কারণে মানবজাতি ক্রমশ টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে। এভাবে আমাদের চিরকাল বেঁচে থাকবার ঘোর একটি বাহন হিসেবে বিচ্ছিন্ন( disaggregation) হবার দিকে পরিবর্তিত হয়। আদতে, মৃত্যু একটা বাহ্যিক ও অস্বাভাবিক বিষয় এমন বিশ্বাসে একটা সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। হালের সময়ে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এসে এরকম একটি সামাজিক বিশ্বাস'কে ঠান্ডা করে ফেলেছে এবং আমাদের আবেগের বাঁধনসমূহকে তুচ্ছ করে তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সংক্ষেপে বললে, সামাজিক বন্ধনগুলো যখন দূর্বল হয়ে পড়ে ঠিক তখনই একটি দুর্বিষহ ঘটনার উদ্ভব হয়। নৈতিকতার এই সংকটের মতোই।


লেখার এক পর্যায়ে এসে বম্যান খারাপ(evil) এবং ভয়ের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। মানবসমাজ তাদের চিন্তা ও উদ্দীপনার নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে ভয়(scaring) পেতে থাকে। খারাপের অর্থ একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা হিসেবে কাজ করে, যেখানে “আল্লার ইচ্ছা”কে বুঝতে ও বৈধতা দিতে পারে। অননুমিত বিপর্যয় বা ঘটনাবলী শুধু শুধু ঘটেনা। অন্যভাবে বললে, মানুষের পাপের জবাবে ঐশ্বরিক নীলনকশার অংশ হচ্ছে এগুলো।


এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে সবকিছুই (আভাস থাকুক বা না থাকুক) মানব আচরণের কারণে ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অপরাধ এবং জেরুজালেমে আইখমানের বিচারের সময় ঘটনাসমূহকে বৈধতা দানের জন্য তাঁর বুদ্ধিমান আইনজীবীরা যে যুক্তি প্রয়োগ করেন তা হল: এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাৎসি উচ্চপদস্থ(হায়ারার্কিকাল) আমলাতন্ত্র। এখানে যে মূল থিসিসটি বম্যান রূপায়ন করছেন তা হচ্ছে, আমাদের যৌক্তিক নালিশ বার বার আমাদের জীবনে(শুধু সুনামিই নয় বরং নৃগোষ্ঠীর গণহত্যাও) মন্দের উপস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয়। মূলত মানবিক সম্পর্ক যখনই ধ্বসে পড়ে তখন থেকেই উদ্বিগ্নতার সৃষ্টি হতে থাকে। কারণ দুনিয়ার অর্থ ও তাৎপর্য (sense) অনুমান করা সম্ভব হয় না। সাংস্কৃতিকভাবে, ক্যাটরিনার মতন[কিংবা বর্তমানের করোনাভাইরাস মহামারি] প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রকাশ করছে যে, আমেরিকার অন্যান্য শ্রেণীর তুলনায় গরীবরা বেশি সংস্কারগ্রস্ত।


ক্যাটরিনার উদাহরণ দিয়ে বম্যান এটা নিশ্চিত করেন যে, নিউ অরলিয়েন্সের বেশিরভাগ অধিবাসী “কালো বা ল্যাটিন আমেরিকার”। এদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ক্যাটরিনা বাদ দিলেও বহু আগে থেকেই এর ভুক্তভোগীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। আধুনিকতাবাদ, আমেরিকার পুজিবাদের মতোই শুরু থেকে কর্তৃত্ববাদী আকাঙ্খার চেয়েও অধিক গুরুত্বসহকারে জনগণের নিরাপত্তা দেবার প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেটা কেবল গুটিকয়েক নির্বাচিত ও বিশেষ লোকদের জন্যই সীমিত। ভিন্নভাবে বললে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা বিপর্যয় পৃথিবীকে দুইভাগ করে ফেলে, যেখানে পূর্ববর্তী সাংস্কৃতিক ফ্রন্টিয়ারের গুরুত্ব অনুসারে একদল লোক নির্ধারিত হয় যাদের বেঁচে থাকা প্রাপ্য, আরেকদল যাদের বেঁচে থাকা প্রাপ্য নয়।


বম্যানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল, সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের কাজের দায়িত্বকে আধুনিক আমলাতন্ত্র নৈতিকভাবে শুধু প্রভাবিতই করেনা, বরং আবেগকে চেপে ধরার মাধ্যমে পারষ্পরিক নৈতিক আদানপ্রদানকে গৌণ করে তোলে। বিংশ শতকে মানবজাতি যান্ত্রিক কৌশলাদির দ্বারা নৈতিক মতামতকে হটিয়ে দিয়েছে, সিদ্ধান্ত-গ্রহণ-প্রক্রিয়াকে আরো দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে এই যান্ত্রিক কৌশলাদি হাতে তুলে নেয়া হয়েছে। যখনই এগুলোকে যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করার দক্ষতা কমে গেছে, প্রযুক্তির বা কৃৎকৌশলের এই উন্নতি তখনই মানুষের স্বাধীনতার মূল্য কমিয়ে দিতে মনস্থির করেছে। নৈতিক শৃঙ্খলাগুলোর রহিতকরণ ও নৈতিক দায়িত্বের পরিসমাপ্তি আমাদের সামনে একত্রিত হয়ে এই পরিবর্তনশীল সময়ের অধিপতি হয়ে উঠেছে। চিন্তার এই পরিবর্তনের ফলে, প্রযুক্তিগত ফেটিশিজম (নৈতিক বিষয়ে পর্যবেক্ষনের অভাবের কারণে ঘটা) আধুনিক পাপবোধকে প্রতিস্থাপন করার একটি রাজনৈতিক ক্রিয়াকৌশলের ভূমিকা পালন করছে। অনবরত আপডেট থাকার প্রয়োজন দিয়ে এই প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে। অন্যভাবে বললে, তথ্য ও প্রযুক্তি আমাদের খারাপ কাজ ও সিদ্ধান্তকে সমান করে(equilibrate) ও পরিশোধন করে। প্রযুক্তির এই প্যারাডক্স আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যদিও ব্যাপক গতিতে আমাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সাধিত হচ্ছে, কিন্তু আমাদের নৈতিকতা আদম-হাওয়ার আমল থেকেই অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।


আর. ক্যাসেলের কাজের সূত্র ধরে বম্যান দেখান যে, জনগনের মধ্যে ঝুঁকি ও অনিরাপত্তার অনুভূতি নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে বাড়ে না। বরং স্বচ্ছতার অভাবে এটা হয়, যাকে আমরা ভাগ্য হিসেবে চিহ্নিত করি। একটি কু মতলব আমাদের মধ্যে দৃঢ় ও স্থায়ী সংযোগ সৃষ্টি করতে না পারার নিজস্ব এক অসম্ভাব্যতার আয়না হয়ে দাড়িয়ে আছে। অধিক অ-ব্যক্তিগত আধুনিক ট্রেডমার্ক দ্বারা তাদেরকে প্রতিস্থাপন করছে। ঐতিহাসিকভাবে, ভয় সবসময়ই মানুষের সঙ্গী ছিল। কিন্তু তরল আধুনিকতায় জাতিরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের আওতার বাইরে গিয়ে ভয়ের বাণিজ্য করা হয়েছে। আরও একবার, অত্যধিক প্রতিযোগিতা আমাদের পারস্পারিক আদান প্রদান ও সংহতিকে ভন্ডুল করে দিয়েছে।


অপরদিকে, বিপর্যয়ের প্রভাব অনেক চরম ও বিশৃঙ্খল হয় এই কথাটা সামাজিক উপলব্ধিতে ঢুকিয়ে দেয়ার কাজটা করে অজ্ঞতা ও অহমবাদ। প্রাচীন সময়ে, নবী-রাসূলরা ‘কেয়ামত চলে আসছে বা পৃথিবীর শেষ হতে চলেছে’ এমন অনুমান করাতেই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। এভাবেই, ইতিহাসের রেখায় মানুষ সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে যাতে করে সত্যসত্যই কেয়ামত আসাকে রোধ করা যায়।


এতদসত্ত্বেও, আধুনিক সময়ে ফ্যান্টাসি ও বাস্তবের মাঝখানে কোনো সীমারেখা নাই। ভবিষ্যৎ বাণীর অভাবের কারণে, নেতিবাচক আধুনিক বিশ্বায়ন নিশ্চিতভাবেই একটা বাস্তব বিপর্যয়ে পরিণত হবে। সম্ভবত, দীর্ঘকালের একটি স্থায়িত্বের পরে যেকোন ক্ষুদ্র পরিবর্তন বা বিচ্যুতিকে সামাজিক ভাঙনকে তরান্বিত করা বিপর্যয়ের একটি সংকেত হিসেবে গণ্য করা হবে।


বম্যানের বইয়ের কিছু বিষয় স্পষ্ট ও ব্যাখ্যা করা উপরোক্ত পর্যালোচনার উদ্দেশ্য। যদিও আরও কিছু পদ্ধতিগত বিষয় পুনর্বিবেচনা করা দরকার। প্রথমত, পুঁজিবাদী ট্রেডমার্ক কিভাবে সংহতিকে কমিয়ে ফেলে তা এখানে স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, কিভাবে ভয়ের মুখে হারিয়ে যেতে থাকা সমাজের সুরক্ষার কারণ হবে এই বাঁধাগুলো। এমনিতে বম্যানের বই সুলিখিত কিন্তু ব্যাকরণের হেঁয়ালির (যেমন-বন্ধনীর ব্যবহার) কিছু অংশ পড়তে বাধা সৃষ্টি করে।


সবশেষে, যদিও বম্যান তাঁর কাজের কোথাও ভয়ের সংজ্ঞা প্রদান করেননি, তিনি আধুনিক আতঙ্কের বিস্তারে milenarism(শত বছরে অকস্মাৎ ও নাটকীয় পরিবর্তনের বিশ্বাস)-এর প্রভাব ভুলে গেছেন। খুব সম্ভবত, যুক্তরাষ্ট্রে ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলার ঘটনার চেয়েও অনেক বেশি (নাও হতে পারে) প্রভাব বিস্তার করেছে। বিবেচ্য বিষয় হল, উদ্বিগ্নতা, ভয়, আতঙ্কের সাথে সম্পর্কিত বিচিত্রসব অনুভূতি নিয়ে এই সহস্রাব্দের সমাপ্তিলগ্ন জেগে উঠেছে এবং এগুলোর তত্ত্বতালাশে নতুন রাস্তা, নতুন পন্থা’র দাবি করে। উল্লেখিত বিষয়গুলো জানা সত্ত্বেও যারা এই জাতীয় বিষয় নিয়ে আগ্রহী, তাঁদের জন্য আমরা তরল ভীতি (Liquid Fears, ২০০৬) কে অনেক বেশি গুরূত্বপূর্ণ বই হিসেবে বিবেচনা করি।


______________



***উচ্চারণ অনুসারে ‘জিগমুন্ত বাউমান’ কাছাকাছি হয়। কিন্তু তাঁর কাজ নিয়ে এই দেশে যৎসামান্য যেটুকু আলোচনা হয়েছে, ‘জিগমুন্ট বম্যান’ নামেই হয়েছে, এভাবেই পরিচিত হয়েছে। আমরাও সেটাই বহাল রাখলাম।—বোধিচিত্ত



প্রথম প্রকাশঃ ২২শে এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২২শে এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/358860662109430/