বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মার্কসের ভাবনা ও প্রকৃতির প্রত্যাবর্তন

জন বেলামি ফস্টার


অনুবাদঃ ৌরাঙ্গ হালদার, লেখক ও অনুবাদক




ওরেগন ছাড়ার আগে, জন বেলামি ফস্টার (John Bellamy Foster) আমাকে লিখেছিলেন, “আমাদের ঘর খালি করতে হয়েছে। আর পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। তবে আমি সকালেই সাক্ষাৎকারটা পাঠানোর চেষ্টা করবো।” আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে ভয়াবহ আগুন লাগার ফলে বায়ু দূষণের মান উঠে যায় ৪৫০-এ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সর্বোচ্চ ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। এটি চরম বিপজ্জনক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি। ওরেগনে চল্লিশ হাজার মানুষকে তাদের ঘর ছাড়তে হয়েছে। যদি বিপদের হুমকি বাড়ে, তাহলে আরও অন্তত পাঁচ লাখ লোক পালানোর অপেক্ষায় আছে। ফস্টার বলছেন, “এই হল জলবায়ু পরিবর্তনের দুনিয়া”। ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের প্রফেসর এবং ‘মান্থলি রিভিয়্যু’ পত্রিকার সম্পাদক ফস্টার, বিশ বছর আগে ‘মার্কসের ইকোলজি [ভাবনা] (Marx’s Ecology) লিখে ‘মার্কসীয় ইকো-সমাজতন্ত্র’কে বৈপ্লবিক করেছেন। এই বইয়ের সাথে সাথে, মার্কসবাদে ইকো-সমাজতান্ত্রিক পর্যালোচনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সূচনা করেছে ‘মার্কস অ্যান্ড নেচার’। বইটি পল বুর্কেট (Paul Burkett)-এর সঙ্গে যৌথভাবে লেখা। ইকো-সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থা ও কর্মসূচী বিস্তৃত করার লক্ষে, আমাদের কালে এই পর্যালোচনা খোদ কার্ল মার্কস সম্পর্কে সকল ধরনের ঘাপটি মারা আন্দাজের মুখোমুখি হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কসীয় বাস্তুতান্ত্রিক চিন্তার বিরাট অগ্রগতির ক্ষেত্রে, ‘মান্থলি রিভিয়্যু’র সাথে সম্পৃক্ত অনেকে এবং ফস্টার একটি বাকবদলকারী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের কাজ দেখিয়েছে, উনিশ শতকে লেখা সত্ত্বেও, আমাদের সমকালীন বাস্তুতান্ত্রিক অবক্ষয় নিয়ে বলতে হলে মার্কস কতটা অপরিহার্য। তাঁর চলতি প্রত্যয়টি পরিচিত হয়েছে ‘বিপাক-ক্রিয়ায় ফাটল (metabolic rift)’-এর ঘরানা হিসেবে। ফস্টার এই প্রত্যয় উদ্ধার করেছেন মার্কসের পুঁজি গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড থেকে। এর ফলে সামাজিক বিভাজন ও মহামারী-বিদ্যা থেকে শুরু করে সমুদ্র শোষণের অধ্যয়ন, সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান গবেষণায় অসংখ্য ইকো-বস্তুতান্ত্রিক (ecomaterialist) ধারণা বিকশিত হয়েছে। তাঁর সবশেষ বই ‘রিটার্ন অব নেচার’ প্রকাশ নিয়ে বলতে গেলে, এটি বড় মাপের ইকো-সমাজতান্ত্রিক চিন্তকদের আদ্যপান্তের বিশাল একটি সৌধ। বইটি সম্পন্ন করতে তাঁর লেগেছে বিশ বছর। মার্কসের মৃত্যুর পরে ১৯৬০ ও ৭০ দশকে পরিবেশবাদের আবির্ভাব, সেইসাথে ‘মার্কসের ইকোলজি’ থেকে নিয়ে তাঁর নতুন বইয়ের সাথে এর সম্পর্ক এবং সবচেয়ে বিখ্যাত মার্কসীয় বাস্তুতন্ত্র ভাবনার চলতি বিতর্কে এইসকল প্রধান ব্যক্তিত্বরা যে পথে ভ্রমণ করেছেন, ফস্টার সে সম্পর্কে আমাদের বলেছেন। কাজেই, তাঁর ভাবনাবলী এই লিগ্যাসির গুরুত্ব নিয়ে পুনঃচিন্তা করতে আমাদের সাহায্য করে। এক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি হল, যেসব শর্তাবলীর কারণে আজ আমাদের পৃথিবী অস্তিত্ব সংকটে আছে, তাকে অতিক্রমণের জন্য জরুরী প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।


সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয় স্পেনে। Viento Sur পত্রিকায়। অক্টোবর-নভেম্বর ২০২০ (১৭২) সংখ্যায়। এরপর প্রায় একই সঙ্গে ছাপা হয় দুটি দেশ থেকে। ফিনল্যান্ডে Rab Rab: Journal for Political and Formal Inquiries এবং আমেরিকায় ‘মান্থলি রিভিয়্যু’ পত্রিকায়। বাংলা অনুবাদের জন্য ‘মান্থলি রিভিয়্যু’ প্রকাশিত ইংরেজি সংস্করণটি ব্যবহৃত হয়েছে।

মার্কসের ইকোলজি (২০০০) বইয়ে মার্কস ও বাস্তুতান্ত্রিক ভাবনার মাঝে সম্পর্ক নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলো আপনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আপনার এই প্রত্যাখ্যান মার্কসবাদের ভেতরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই দৃশ্যমান। যেমনটা বলা হয়, মার্কসের লেখায় বাস্তুতান্ত্রিক ভাবনা ছিল প্রান্তিক। তাঁর কিছু বাস্তুতান্ত্রিক অন্তর্দৃষ্টি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছিল তাঁর প্রথম দিককার রচনায় (যদি একমাত্র না হয়)। অথবা তিনি প্রগতির প্রশ্নে প্রমিথীয় দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতেন। মানে, তিনি প্রকৃতির সাথে সমাজের বিরোধগুলোর সমাধান মনে করতেন উৎপাদিকা শক্তি ও টেকনোলজি উন্নয়নের মাঝে। কাজেই তিনি পরিবেশের ওপর মানুষের কাজকারবারের ফলাফলের ক্ষেত্রে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক আগ্রহ দেখাননি। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি আপনার এই বইটি, উপরে বলা সব ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করেছে। এবং এই ধারণাগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক ধরনও সরিয়ে দিয়েছে। আপনি কি মনে করেন, এইসব ধারণা চলতি বিতর্কে উপযুক্ত?



ইংরেজিভাষী দেশগুলোর সমাজতন্ত্রী ও বাস্তুতন্ত্রী চক্রগুলোর মাঝে, এবং সত্যি বলতে কি, দুনিয়ার প্রায় বেশিরভাগ জায়গাতেই, বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মার্কসের বিরুদ্ধে প্রথম দিককার এই সমালোচনাগুলো এখন অপ্রমাণিত হিসেবে চিহ্নিত। আসলে এই সমালোচনাগুলোর যে কেবল ভিত্তি নেই তা’ই নয়, বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মার্কসের অত্যন্ত শক্তিশালী আলাপের সাথে তা সম্পূর্ণরুপে সাংঘর্ষিক। পরিবেশ-সমাজতন্ত্রের বিকাশে এটি মৌলিক এবং পুঁজিবাদ কর্তৃক উৎপাদিত বাস্তুতান্ত্রিক অবক্ষয়ের সকল সামাজিক-বৈজ্ঞানিক আলাপেও তা ক্রমাগতভাবে মৌলিক হয়ে উঠছে। এটি বিশেষ করে প্রমাণিত বিস্তৃতভাবে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা মার্কসের বিপাক-ক্রিয়ার ফাটল তত্ত্বে। বিপাক-ক্রিয়ায় ফাটল নিয়ে আমাদের বোঝপড়া ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। এবং তা এখন আমাদের চলতি বাস্তুতান্ত্রিক সমস্যাগুলোর প্রায় সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ইংরেজিভাষী দুনিয়ার বাইরে, কেউ হয়তো এখনো ঘটনাক্রমে এই ভুল ধারণাগুলোর মুখোমুখি হয়। নিঃসন্দেহে তার কারণ হলো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। এবং এর বেশিরভাগটাই এখনো অনুবাদ হয়নি। তবে আমার মনে হয়, প্রায় বৈশ্বিকভাবে বাতিল মনে হওয়া প্রথম দিককার এই সমালোচনাগুলোকে এখন আমরা বাতিল হিসেবেই বিবেচনা করতে পারি। এটি কেবল আমার কাজের ক্ষেত্রেই নয়, একই সঙ্গে পল বুর্কেটের ‘মার্কস অ্যান্ড নেচার’ এবং কোহে সাইটো (Kohei Saito)’র ‘কার্ল মার্কসের ইকো-সমাজতন্ত্র’সহ আরও অনেকের কাজে ঘটেছে। সব ক্ষেত্রে শিল্পায়ন সমর্থন করার অর্থে, বাম ঘরানার কারুর জন্য মার্কসকে কেবল একজন প্রমিথীয় চিন্তক হিসেবে দেখা আজকের দিনে কঠিন। মার্কসের চিন্তায় কী করে প্রকৃতির বস্তুতান্ত্রিক ধারণা এবং বিজ্ঞান প্রবেশ করলো, সে সম্পর্কে এখন বিস্তৃত বোঝাপড়া রয়েছে। এই বিভাব বলবৎ হয়েছে তাঁর কিছু বৈজ্ঞানিক/বাস্তুতান্ত্রিক সারসংক্ষেপের নোটবুক প্রকাশ থেকে। এই নোটবুকগুলো পাওয়া যাবে মেগা প্রকল্পে (Marx-Engels Gesamtausgabe)। কাজেই,মার্কসের চিন্তায় বাস্তুতান্ত্রিক বিশ্লেষণ প্রান্তিক ছিল বলে যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে তা এখনকার ইংরেজিভাষী দুনিয়ার সমাজতন্ত্রীদের মাঝে খুব বেশি ভরসা যোগায় বলে আমি মনে করি না। এবং এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সবখানেই খুব দ্রুত পিছু হঠছে। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যে বাস্তুতান্ত্রিক মার্কসবাদ অত্যন্ত বড় একটি বিষয়। আসলে সেটা প্রায় সবখানে। কেউ যদি বাস্তুতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে চরম সংকীর্ণ এবং নিজেকে পরাজিত করার ধারণা গ্রহণ করে, তাহলেই কেবল মার্কসের বাস্তুতান্ত্রিক বিশ্লেষণকে প্রান্তিক হিসেবে দেখা যেতে পারে। তাছাড়া বিজ্ঞানে কোন চিন্তকের সবচেয়ে বেশি ‘প্রান্তিক’ অন্তর্দৃষ্টিকে কখনো কখনো সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক এবং ধারালো হিসেবে দেখা যায়।



মার্কস বাস্তুতন্ত্রকে উপেক্ষা করেছিলেন – গোড়ার দিকে এমন ধারণায় অনেকেই আস্থা রেখেছিল কেন? আমার মনে হয়, সবচেয়ে সোজাসুজি জবাব হলো, মার্কসের কাজের মাঝে থাকা বাস্তুতান্ত্রিক বিশ্লেষণগুলোকে বেশিরভাগ সমাজতন্ত্রী সহজভাবে এড়িয়ে গেছেন। সবাই মার্কসের মাঝে একটা বর্ণনাধর্মী কায়দায় একই জিনিস পড়ে। ফলে, তাদের কাছে যা কম গুরুত্বের এবং দ্বিতীয় সারির মনে হয়েছে, তা তারা এড়িয়ে গেছেন। আমার মনে আছে, কয়েক বছর আগে একজনের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন যে, মার্কসের কাজে বাস্তুতন্ত্র নিয়ে কোন আলাপ ছিলো না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি কখনো পুঁজির তৃতীয় খণ্ডে কৃষি এবং খাজনা সম্পর্কিত অধ্যায়গুলো পড়েছেন কিনা। জবাবে তিনি বললেন যে পড়েননি। আমি জানতে চাইলাম – “আপনি যদি পুঁজির সেই অংশগুলো পড়ে না থাকেন, যেখানে মার্কস কৃষি ও মাটি সম্পর্কে নিরীক্ষা চালিয়েছেন, তাহলে আপনি কীভাবে নিশ্চিত হতে পারেন যে, মার্কস বাস্তুতান্ত্রিক প্রশ্ন নিয়ে কারবার করেননি?” তার কাছে কোন জবাব ছিলো না। অনুবাদের দিক থেকেও অন্যান্য সমস্যা ছিলো। পুঁজির মূল ইংরেজি অনুবাদে, মার্কসের ‘বিপাক-ক্রিয়া’ (Stoffwechsel, ইংরেজিতে metabolism) ধারণা অনূদিত হয়েছিল ‘বস্তুগত বিনিময়’ অথবা ‘আন্তঃপরিবর্তন’ হিসেবে। এই অনুবাদ ধারণাটি বুঝতে সাহায্য করার পরিবর্তে বরং বাধা তৈরি করেছিল। তাছাড়া সেখানে আরও গভীর কারণ ছিলো। যেমন, বস্তুবাদ বলতে মার্কস নিজে কী মনে করতেন তা এড়িয়ে যাওয়া – তিনি কেবল ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ধারণাই নির্দেশ করেননি, সেই সাথে আরও গভীরভাবে প্রকৃতির বস্তুতান্ত্রিক ধারণা নির্দেশ করেছিলেন।



বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মার্কসের পর্যালোচনার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যে তা পুঁজিবাদের রাজনৈতিক -অর্থনীতি পর্যালোচনার সাথে একত্রিত। আসলে এখানে বলা যেতে পারে, একটা ছাড়া আরেকটা কোন অর্থ তৈরি করে না। ব্যবহার মূল্য নিয়ে মার্কসের পর্যালোচনার বাইরে, পুঁজিবাদের বিনিময় মূল্য নিয়ে মার্কসের পর্যালোচনার কোন গুরুত্ব নেই – যেটি প্রাকৃতিক-বস্তুগত শর্তাবলীর সাথে সম্পর্কিত। ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ধারণার কোন মানে নেই, যদি না তাকে প্রকৃতির বস্তুতান্ত্রিক ধারণার সাথে সম্পর্কিত হিসেবে দেখা হয়। প্রকৃতির সাথে বিচ্ছিন্নতা বাদ দিয়ে শ্রমের বিচ্ছিন্নতা দেখা যেতে পারে না। প্রকৃতি শোষণের ভিত্তি হলো পুঁজি কর্তৃক “প্রকৃতির অবারিত দান”-এর আত্মসাৎকরণ। ইস্তভান মেসজারোস (István Mészáros) তাঁর মার্কসের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব (১৯৭০) বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, মানুষকে প্রকৃতির আত্ম-সৃজনকারী সত্তা হিসেবে মার্কসের সংজ্ঞার ভিত্তি হলো,“মানুষ ও প্রকৃতির বিপাক-ক্রিয়া” হিসেবে শ্রম প্রক্রিয়ার ধারণার ওপরে। শ্রমশক্তির শোষণ বৃদ্ধির উপায় হিসেবে বিজ্ঞান, প্রকৃতির ওপর আধিপত্য হিসেবে ধারণা করা বিজ্ঞান থেকে আলাদা করা যায় না। বিপাক-ক্রিয়ায় ফাটল প্রশ্ন থেকে মার্কসের সামাজিক বিপাক-ক্রিয়ার প্রত্যয়টি বাদ দেয়া যায় না। এবং আরও অনেক প্রশ্ন থেকে বাদ দেয়া যায় না। মার্কসের কাজে আসলে এই বিষয়গুলো আলাদা ছিলো না। তবে পরবর্তীকালের বামপন্থী চিন্তকরা একটা থেকে আরেকটা বাদ দিয়েছিলেন। তারা সাধারণভাবে বাস্তুতন্ত্রের প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। নয়তো তারা যান্ত্রিক, ভাবতান্ত্রিক এবং দ্বৈতবাদী প্রেক্ষিত নিয়ে এসেছেন। আর এভাবেই রাজনৈতিক অর্থনীতির পর্যালোচনা তার সত্যকার বস্তুগত ভিত্তি থেকে ছিনতাই হয়ে গেছে।



প্রমিথিয়াস বিষয়ে কীভাবে মার্কসের ভাবনাকে পড়তে হবে, তা প্রমিথিয়বাদ প্রসঙ্গে আপনি আপনার কাজে দেখিয়েছেন। মানে কী করে এপিকিউরাস (এবং রোমান কবি লুক্রেশিয়াস) নিয়ে মার্কসের নিজস্ব পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার সাথে সম্পর্কিত করে তা পড়তে হবে। কাজেই, উন্নতির পক্ষে অন্ধ ওকালতির চাইতে বরং তাঁকে এনলাইটেনমেন্টের ইহজাগতিক জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত করার দরকার আছে। তবে তা হলেও, বেশ সাধারণভাবেই ‘প্রমিথিয়বাদ’ পরিভাষাটি ব্যবহারের প্রাধান্য বহাল রয়ে গেছে। সেটা মার্কসীয় সাহিত্যের মাঝেও – যা দ্রুত পুঁজিতান্ত্রিক পরিবর্তন এবং প্রযুক্তি-পূজা প্রবণতার জন্য নিশ্চিত জায়গা দেয়। এক্ষেত্রে তারা তাদের লক্ষ হাসিলে মার্কসকে দাবি করে। এই ধারণাকে আরও কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করা উচিত কিনা, অন্তত মার্কস ও তাঁর বস্তুতান্ত্রিক চিন্তার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে?



এটা একটা জটিল ইস্যু। সবাই জানে, মার্কস প্রমিথিউসের প্রশংসা করেছেন। মার্কস অবশ্যই এস্কাইলাসের “প্রমিথিউস বাউন্ড”-এর অনুরাগী ছিলেন। তিনি এটি বারবার পড়েছেন। মার্কস তাঁর ডক্টরাল থিসিসে এপিকিউরাসকে তুলনা করেছেন প্রমিথিউসের সঙ্গে। এমন কি মার্কস নিজেও ‘রাইনিশে জাইটুং (Rheinische Zeitung)’ পত্রিকায় কাজ করার সময়, চাপের প্রেক্ষিতে প্রমিথিউস হিসেবে চিত্রিত হয়েছিলেন। এই বিখ্যাত চিত্রটি হাজির হয়েছে মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের ‘কালেক্টেড ওয়ার্ক্‌স’-এর প্রথম খন্ডে। ফলে, মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রমিথিয় হিসেবে চিত্রিত করতে, মার্কসবাদের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন সমালোচকদের কাছে এটি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়। বিশেষ করে সেটা এমনভাবে যে, তিনি যেন চরম উৎপাদনবাদীতাকেই সমাজের প্রধান লক্ষ হিসেবে দেখেছেন। তাঁর সমালোচকরা কোন প্রমাণ ছাড়াই বলেন,মার্কস মানুষের সামাজিক (এবং বাস্তুতান্ত্রিক) সম্পর্কের আগেই শিল্পায়ন হাজির করেছেন। আর এক্ষেত্রে কোন প্রমাণ ছাড়াই তারা তাদের প্রসঙ্গ বৈধ করে নিতে ‘প্রমিথিয়বাদ’ পরিভাষাটিকে পন্থা হিসেবে তৈরি করে নেয়। এটি আসলে মার্কসের সাথে সাধারণ সম্পৃক্তি থেকে নিখাদ সুবিধা নেয়া।



তবে এটি ছিল বহুদিক থেকেই একটি বিকৃতি। গ্রীক মিথে, এক টাইটান প্রমিথিউস মানুষকে আগুন এনে দিয়ে জিউসকে অস্বীকার করেন। আগুনের অবশ্যই দুটো প্রকাশ্য গুণ আছে। একটি আলো, অন্যটি এনার্জি বা শক্তি। গ্রীক মিথের ব্যাখ্যায় লুক্রেশিয়াস এপিকিউরাসকে বিবেচনা করেছেন আলো অথবা জ্ঞানের আনয়নকারী হিসেবে। সেটা প্রমিথিয় অর্থে। এবং এখান থেকেই ভলতেয়ার এনলাইটেনমেন্টের ধারণা গ্রহণ করেছিলেন। ঠিক এই একই অর্থে মার্কস নিজেও এপিকিউরাসকে প্রমিথিউস হিসেবে প্রশংসা করেছেন – যে প্রমিথিউস মানুষকে আলো প্রদান করেছিলেন। মার্কস এপিকিউরাসকে উদযাপন করেছেন প্রাচীনকালের এনলাইটেনমেন্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তাছাড়া এস্কাইলাসের ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’ নির্দেশ করে মার্কস সবসময় প্রমিথিউসের ভূমিকাকে বিপ্লবী হিসেবে দেখেছেন। এবং অলিম্পিয় দেবতাদের প্রকাশ্য বিরোধীতায় তার নায়কোচিত চরিত্রের ওপর জোর দিয়েছেন।



বিস্ময়ের কিছু নেই, খোদ এনলাইটেনমেন্টের যুগে প্রমিথিউস মিথকে দেখা হয়েছিল আলোকায়ন হিসেবে। এনার্জি বা উৎপাদন হিসেবে নয়। ওয়াল্ট শেসবি (Walt Sheasby) বড় মাপের একজন ইকো-সমাজতন্ত্রী। ‘‘ক্যাপিটালিজম, নেচার, সোশ্যালিজম’’ লেখার গোড়ার দিনগুলোতে আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছিলাম। একই সাথে তখন ‘অর্গানাইজেশন অ্যান্ড এনভারনমেন্ট’-এর সম্পাদক ছিলাম। পরে, ১৯৯৯ এর মার্চ সংখ্যায় সেখানে তিনি দুর্দান্ত একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। লেখাটায় তিনি উপসংহারমূলকভাবে একটা প্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করেন। শেসবি বলেন, প্রাথমিকভাবে উনিশ শতক পর্যন্ত প্রমিথিয়বাদ ও প্রমিথিয় মিথের ব্যবহার ছিলো আলোকায়ন অর্থে। এর ব্যবহার কখন পাল্টে গেলো, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত না। তবে নিশ্চিতভাবেই, মেরি শেলি’র ফ্রাংকেনস্টাইন; অর, দ্য মডার্ন প্রমিথিউস (১৮১৮) এবং পিয়েরে যোসেফ প্রুধোঁ’র ফিলোসোফি অব পোভার্টি (১৮৪৬) বইয়ে একটি বদল ঘটেছে। সেখানে শিল্প বিপ্লবকে প্রতীকায়িত করে, প্রমিথিয়বাদ এসেছে যান্ত্রিকতা এবং শিল্পায়ন অর্থে। প্রমিথিউসকে দেখা হয়েছে যান্ত্রিক শক্তির পক্ষে দাঁড়ানো এক চরিত্র হিসেবে। মজার ব্যাপার হলো, মার্কস তাঁর “দর্শনের দারিদ্র” বইয়ে প্রুধোঁ’র যান্ত্রিক প্রমিথিউসবাদ সরাসরি আমলে নিয়ে, এই ধরনের সমস্ত ধারণাগুলো আক্রমণ করেন। তবুও, প্রমিথিয় মিথ পরিণত হয় শিল্পায়নের কাহিনিতে। প্রাচীন গ্রীকরাও সম্ভবত কখনো এমন করে কল্পনা করেনি। মার্কসের সাথে প্রমিথিউসের এই সাধারণ পরিচিতি, জনমানসে মার্কসকে বাস্তুতান্ত্রিক প্রেক্ষিত থেকে আলাদা করার এক উপায় হয়ে ওঠে। আরও মজার ব্যাপার হলো, প্রমিথিয় হিসেবে মার্কসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটি অন্য কোন চিন্তকের দিকে নয়, একমাত্র মার্কসের দিকেই তাক করা হয়েছিল। এটি আপনি পাবেন লেসজেক কোলাকোস্কি (Leszek Kolakowski), অ্যান্থনি গিডেন্স, টেড বেন্টন এবং যোয়েল কোবেল (Joel Kovel) এর মতো লেখকদের কাজে। এতে অবশ্য অভিযোগের ভাবাদর্শিক চরিত্রও নির্দেশিত হয়।



বিষয়গুলোর কাছাকাছি আছেন এমন যে কেউ, শিল্পায়ন মহিমান্বিত করার নিরিখে মার্কস প্রমিথিয় ছিলেন বলে প্রমাণ খুঁজতে পারেন। তবে এই প্রমাণ খোঁজার শেষ প্রান্ত ছিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র প্রথম অংশে, বুর্জোয়াদের সম্পর্কে মার্কসের প্রশংসায়। কিন্তু এটি ছিল কেবল সেই একই বুর্জোয়াদের পর্যালোচনার কথামুখ। কাজেই, তিনি কয়েক পৃষ্ঠা পরে ঘুরে গিয়ে, বুর্জোয়াদের শাসন পদ্ধতির সমস্ত বিরোধগুলোর মাঝে হাজির হন। সেখানে তিনি যাদুকরদের নবিশী, বাস্তুতান্ত্রিক শর্তাবলী (গ্রাম ও শহর), ব্যবসা চক্র এবং অবশ্যই পুঁজির কবর খোদক প্রোলেতারিয়েতদের নির্দেশ করেছেন। মার্কস আসলে কোথাও মুক্ত ও পরিপোষক (Sustainable) মানব উন্নয়নের বিরুদ্ধে গিয়ে, লক্ষ হিসেবে শিল্পায়ন সমর্থন করেন নি। যদিও, এই সবকিছু ব্যাখ্যায় সময় নেয়, অন্যদিকে আমার কাজে বিভিন্ন সময় এই বিষয়গুলো নিয়ে এসেছি, ফলে সাধারণভাবে এটি দেখানো যথেষ্ট যে, মার্কস কোন প্রমিথিয় চিন্তক ছিলেন না। যদি একে শিল্প কারখানা, প্রযুক্তি এবং উৎপাদনবাদের উপাসনা, অথবা পরিবেশের প্রতি একটি চরম যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বাস করা বোঝাতো তাহলে কী হতো, যা আসলে নিজের মাঝেই শেষ হয়ে যায়। এই বাস্তব প্রেক্ষিত অনুসারে, মিথ থেকে জন্ম নেয়া দ্বিধাচ্ছন্নতা যে একপাশে সরিয়ে রাখতে হবে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

মার্কসের ইকোলজি (২০০০) বিপাকীয় ফাটল ঘরানার বিশাল একটি কাজ। যেটি মার্কস এবং ইকোলজি সম্পর্কে আজকের দিনের বিতর্ক রুপান্তর করেছে। তো সেই মার্কসের ইকোলজি লেখার বিশ বছর পরে,তখনকার প্রেক্ষিত এবং চলতি অবস্থার মাঝে পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতাগুলো কী?



এখানে আলোচনা ও বিতর্কের কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধারা রয়েছে। আমি আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পৃথিবীর চলতি বাস্তুতান্ত্রিক সংকট বোঝার পন্থা হিসেবে বিপাকীয় ফাটল নিয়ে বিশাল আকারের গবেষণা এবং বিষয়টির প্রতি সাড়া দিতে, কী করে বৈপ্লবিক ইকো-সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। মূলত, যেটা পরিবর্তিত হয়েছে তা হলো মার্কসীয় বাস্তুতন্ত্রের নজরকাড়া উত্থান। এই উত্থান কেবল সমাজবিজ্ঞানেই নয়, তা একই সাথে বহু ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রসহ, প্রকৃতি বিজ্ঞানেও আলো ফেলেছে। যেমন ধরুন, মরিসিও বিটানকোর্ট (Mauricio Betancourt) সম্প্রতি দারুণ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধটি ছিল “বিপাকীয় ফাটল উপশমে কিউবার কৃষি-বাস্তুতন্ত্রের ফলাফল” ভিত্তিক “বৈশ্বিক পরিবেশগত পরিবর্তন” এর ওপর। স্তিফানো লোঞ্জো, রেবেকা ক্লাউসেন এবং ব্রেট ক্লার্ক “পণ্যের ট্রাজেডি”র মাঝে সামুদ্রিক ফাটল বিশ্লেষণে মার্কসের পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। হানা হোলম্যান তাঁর “ডাস্ট বোলস অব এম্পায়ার” বইয়ে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন অতীত ও বর্তমানকালের ভূমি বিরান প্রক্রিয়া আবিষ্কারে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা বুঝতে, বিবেচনাযোগ্য সংখ্যক কাজে বিপাকীয় ফাটল ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে। ব্রেট ক্লার্ক, রিচার্ড ইয়র্ক এবং আমার যৌথ কাজ ‘দি ইকোলজিক্যাল রিফ্‌ট’ এবং আয়ান আংগুসের ‘ফেসিং দ্য এনথ্রোপোসিন’ বইয়েও আমরা এই ধারণা ব্যবহার করেছি। অন্যান্যদের অবদানের সাথে, আন্দ্রেস মালাম, ইয়ামোন স্লাতের, ডেল ওয়েস্টন, মিশেল ফ্রিডম্যান, ব্রায়ান নেপোলিতানো এবং নাম উল্লেখ করার ক্ষেত্রে সংখ্যায় অনেক পণ্ডিত ও অ্যাক্টিভিস্টদের কাজগুলো এই আলোকে দেখা যেতে পারে। একটা গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হচ্ছে ‘গ্লোবাল ইকোসোশ্যালিস্ট নেটওয়ার্ক’। সেখানে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন জন মলিনাক্স। আমেরিকায় এটা ছিলো “জলবায়ু পরিবর্তন নয়, বরং ব্যবস্থাতন্ত্র পরিবর্তন” এর আওয়াজ। নাওমি ক্লেইনের কাজ রচিত হয়েছে বিপাকীয় ফাটল ধারণার ওপর ভিত্তি করে। এটি ব্রাজিলে ভূমিহীন শ্রমিকদের আন্দোলনে এবং চীনে বাস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার প্রশ্ন ঘিরে আলাপ আলোচনায় ভূমিকা রেখেছিল। আরেকটি ইস্যু হলো বর্ণবাদী পুঁজিবাদ। মার্কসীয় নারীবাদী সামাজিক প্রজনন এবং মার্কসীয় বাস্তুতন্ত্রের মাঝেও তা সম্পর্কের নতুন বিশ্লেষণে মনোযোগ দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই তিনটি প্রেক্ষিতের সবকিছুই চিত্রিত হয়েছে মার্কসের “বেদখল (Expropriation)” ধারণার ওপর – যেটি তাঁর সামগ্রিক পর্যালোচনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তা “শোষণ” ছাড়িয়ে প্রসারিত। এই সংযোগগুলো ব্রেট ক্লার্ক এবং আমাকে, আমাদের সাম্প্রতিক বই “দি রবারি অব নেচার” লিখতে উৎসাহিত করেছে। বইটি লেখা হয়েছে ‘ফাটল ও ডাকাতি’র মাঝে সম্পর্কের ওপর। মানে – ভূমি, ব্যবহার মূল্য ও মানবদেহের আত্মসাৎকরণ এবং তা কীভাবে বিপাকীয় ফাটলের সাথে সম্পর্কিত। একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ এবং অসম বাস্তুতান্ত্রিক বিনিময় – যেটা নিয়ে আমি ব্রেট ক্লার্ক এবং হান হোলম্যানের সঙ্গে কাজ করেছি।



আজকের দিনে, বাস্তুতন্ত্র প্রসঙ্গে মার্কসকে নিয়ে নতুন কিছু সমালোচনা আছে। সেটা খোদ বিপাকীয় ফাটল তত্ত্বকে লক্ষ করে। বলা হয়, বিপাকীয় ফাটল তত্ত্ব দ্বান্দ্বিক নয় বরং দ্বৈতবাদী। অবশ্যই এটি একটি ভুল ধারণা। কারণ, মার্কসের কাছে যখন থেকে তা শ্রম ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মানুষ ও (মানুষ অতিরিক্ত) প্রকৃতির মাঝে সামাজিক বিপাক-ক্রিয়া, তখন তা সমাজ ও প্রকৃতির মাঝে ‘মধ্যস্থতা’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত। পুঁজিবাদের এই ক্ষেত্রে, এটা নিজে বিপাকীয় ফাটলের আকারে এক ‘বিচ্ছিন্নকৃত মধ্যস্থতা’য় প্রকাশিত হয়। সামগ্রিকতার দ্বান্দ্বিক মধ্যস্থতা হিসেবে শ্রম অথবা বিপাক-ক্রিয়ার ওপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে, এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বৈতবাদের প্রতি খুব বেশি বিরোধী হতে পারে না।



অন্যান্যরা বলে যে, ধ্রুপদী মার্কসবাদ যদি বাস্তুতন্ত্রের প্রশ্ন চিহ্নিত করতো, তাহলে মার্কস পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণে তা দৃশ্যমান হতো, কিন্তু তা হয়নি। এই অবস্থানটিও ভ্রান্ত। আসলে এই প্রশ্নটি দি রিটার্ন অব নেচার’(২০২০) -এ আমলে নেয়া হয়েছে। যথাক্রমে ১৮৮২ ও ৮৩ সালে ডারউইন এবং মার্কসের মৃত্যুর পরের শতকে, সমাজতান্ত্রিক ও বস্তুতান্ত্রিক ইকোলজিতে, পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতার দ্বান্দ্বিকতা অনুসন্ধানে সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা ছিল।



আসলেই, মার্কসের ইকোলজি বইয়ে আপনি ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের বিবর্তন তত্ত্বের সাথে যৌথ সম্পর্কে, মার্কসের বস্তুবাদের রূপায়ন ও আবির্ভাবের ওপরে আলোকপাত করেছেন। এবং একদম সঠিকভাবেই তা উক্ত দুই ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে শেষ করেছেন। এখন, আপনার নতুন বইয়ে— ১৯৬০ ও ৭০ দশকে বাস্তুতান্ত্রিক আন্দোলনের আবির্ভাব অবধি— প্রধান ইকো-সমাজতন্ত্রী চিন্তকদের বৌদ্ধিক ঠিকুজি শনাক্ত করতে, আপনি ঠিক এই বিন্দু থেকে শুরু করেছেন। বেশ দীর্ঘ সময় ধরে এই গল্পগুলো যথেষ্ট মনোযোগ পায়নি। এগুলো পুনরুদ্ধারে এতো দীর্ঘ সময় নিলো কেন? এবং কীভাবে এই সংযোগগুলোর পুনরাবিষ্কার, ভিন্নভাবে বাস্তুতন্ত্রবাদী আন্দোলনের আবির্ভাব বুঝতে সাহায্য করতে পারে?



দি রিটার্ন অব নেচার’ বইটা মার্কসের ইকোলজি বইয়ের পদ্ধতিকে ধারাবাহিক করেছে। এটা আগের বইয়ের উত্তরভাষ এবং পরের বইটির বাহাসের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যেতে পারে।মার্কসের ইকোলজি (উত্তরভাষ অংশ বাদে) শেষ হয় মার্কস ও ডারউইনের মৃত্যুর সাথে। দি রিটার্ন অব নেচার’(২০২০) বইটি শুরু হয়েছে তাঁদের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান এবং একজন ব্যক্তির সাথে। এই ব্যক্তিটি দুজনের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার জন্যে পরিচিতি ছিলেন। তাঁর নাম ই. রে. ল্যাংকেস্টার। তিনি ছিলেন বড় মাপের ব্রিটিশ প্রাণীবিদ্যাবিশারদ এবং ডারউইন ও থমাস হাক্সলির শিষ্য-স্থানীয়। এবং সেইসাথে মার্কসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ‘দি রিটার্ন অব নেচার’ সহজভাবে মার্কসীয় ধারণা বিকাশের দিকে চালিত হয়নি। তবে, বিশ্লেষণের বিচারমূলক ধরন হিসেবে আজ যাকে আমরা বাস্তুতন্ত্র বলি, তাকে যেসব বস্তুবাদী এবং সমাজতন্ত্রীরা বিকশিত করেছেন, তাদের দিকে এই কাজ চালিত হয়েছে। তাছাড়া আমরা দেখবো, এই ধারণাগুলো কীভাবে ঐতিহাসিক-বংশপরম্পরাগত কায়দার মাঝে উত্তরিত হয়েছিল।


তাহলে, সকল মার্কসীয় ইতিহাস-অধ্যয়নের মতোই এটা নিরবচ্ছিন্নতা ও পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিকতা এবং উৎপত্তির গল্প। এটা ব্যপকভাবে ছেদহীন এক বংশপরম্পরা তুলে ধরে যা, একটা জটিল পথে হলেও, ডারউইন এবং মার্কস থেকে ১৯৬০ এর দশকের বাস্তুতান্ত্রিক বিস্ফোরণ পর্যন্ত প্রসারিত হয়। আমার বাহাসের একাংশ বলছে, উনিশ শতকের শেষদিক থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি, ব্রিটেনে সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য এর মাঝে সঙ্গিন অবস্থায় ছিলো। ব্রিটিশ সমাজতন্ত্র বিকাশে এই কালপর্বটা যে শুধু প্রধান ছিলো তাই নয়, একই সঙ্গে এই কালপর্বে বিবর্তনগত বাস্তুতান্ত্রিক লাইনের পাশাপাশি, বিজ্ঞানে সবচেয়ে সৃজনশীল কাজগুলো ছিলো মার্কস ও ডারউইনের এক ধরনের সংশ্লেষের ফল। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা ছিলেন বিপ্লবী মার্কসীয় চিন্তকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আবার এই মার্কসীয় চিন্তকরা সোভিয়েত বাস্তুতন্ত্রবিদ্যার সবচেয়ে গতিশীল পর্যায়ের সাথেও যুক্ত ছিলেন (পরে, তাদের প্রায় সবাই জোসেফ স্তালিনের অধীনে বাদের খাতায় যান) কিন্তু তাদের সোভিয়েত অপরাংশ বিরূপ হলেও, বামপন্থী ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা নিজেদের ধারণা রক্ষা ও বিকশিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা বিষয়গুলো মৌলিকভাবে নতুন সামাজিক-বাস্তুতান্ত্রিক এবং বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিতের মাঝে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।



মার্কসের ইকোলজি(২০০০) বইটা বের হওয়ার পরে একটা সাধারণ সমালোচনা উঠেছিল। সমালোচনাগুলো আসে ‘‘ক্যাপিটালিজম, নেচার, সোশ্যালিজম’’ পত্রিকায়। একদম শুরু থেকেই। সেখানে বলা হয়, মার্কস যদিও বাস্তুতন্ত্র নিয়ে শক্তিশালী পর্যালোচনা বিকশিত করেছিলেন, তবে পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় তা আর সামনে এগোয়নি। এর দুটো জবাব ছিলো। প্রথমটা হলো রোজা লুক্সেমবার্গের বিবৃতি। রোজা তাঁর বিবৃতিতে বলছেন, মার্কসের বিজ্ঞান সে সময়কার তাৎক্ষণিক আন্দোলন এবং অন্যান্য ইস্যু ছাড়িয়ে আরও দূরে পৌঁছে গিয়েছিলো। আর যেহেতু নতুন বিরোধ ও চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছিলো, মার্কসের বৈজ্ঞানিক লিগ্যাসির মাঝে তার নতুন উত্তরও খুঁজে পাওয়া যাবে। আসলে সত্য হলো, তাঁর সময়ের প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে, পুঁজিবাদের বাস্তুতান্ত্রিক সংকট সম্পর্কে মার্কসের অনুমান, ঐতিহাসিক উন্নয়ন ও আন্দোলনের চাইতে আরও অনেক দূর এগিয়ে ছিলো। যেটি কোন না কোনভাবে তাঁর বিশ্লেষণকে একটুও কম নয়, বরং এক্ষেত্রে আরও বেশি মূল্যবান করে তোলে। আর অন্য জবাবটি হলো, সেখানে সমাজতান্ত্রিক বাস্তুতন্ত্র বিশ্লেষণ ছিলো না বলে যে আন্দাজ আছে তা ভুল। প্রকৃতপক্ষে,বিচারমূলক ক্ষেত্র হিসেবে বাস্তুতন্ত্রবিদ্যা ছিলো বহুলাংশে সমাজতন্ত্রীদের সৃষ্টি। আমি এরই মাঝে ‘মার্কসের ইকোলজি’র উত্তরভাষ অংশে এর ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছিলাম। তবে সেখানে আরও বেশি ব্যাখ্যা দরকার ছিলো। চ্যালেঞ্জ ছিলো মার্কসের পরের শতকে বস্তুতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ইকোলজির ইতিহাস উন্মোচিত করার ক্ষেত্রে। তবে যেহেতু সেখানে হেলেনা শীহানের দুর্দান্ত কাজ –মার্কসিজম অ্যান্ড দি ফিলোসফি অব সায়েন্স ছাড়া বলার মতো কোন সাহিত্য ছিলো না, ফলে এগুলো করতে গিয়ে বিপুল দায় নিতে হয়েছিল।



‘দি রিটার্ন অব নেচার’ বইয়ের জন্য ২০০০ সালেই আমি আর্কাইভ গবেষণা শুরু করেছিলাম। সে সময় মার্কসের ইকোলজি বইটি বের হয়েছিল। তো ধারণাটা ছিলো, ব্রিটিশ প্রেক্ষিতের ওপর আলো ফেলতে গিয়ে উত্তরভাষ অংশে যেসব ইস্যু হাজির হয়েছিল, সে সম্পর্কে আরও অধিকতর আবিষ্কার করা দরকার। তবে একই সাথে, যেহেতু আমি তখন কাজ শুরু করেছিলাম, আমি ‘মান্থলি রিভিয়্যু’র যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিই (ঘটনাক্রমে একমাত্র সম্পাদক)। স্বাভাবিকভাবেই সেটা আমাকে রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকে টেনে নেয় – যেটা বছরের পর বছর ধরে আমার কাজকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। তাছাড়া আমি যখন সেই বছরগুলোতে বাস্তুতন্ত্র নিয়ে লিখছিলাম, আমাকে প্রথমত এবং প্রধানত তাৎক্ষণিক সংকট নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। ফলে, আমি যখন শিক্ষকতার চাপ থেকে ছুটিতে থাকতাম, তখনই কেবল ‘দি রিটার্ন অব নেচার’ এর মতো নিবিড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে পারতাম। ফল হিসেবে, অনেক বছর ধরে অসংখ্যবার থেমে থেমে, ধীরগতিতে কাজটা এগিয়েছিল। আমার কয়েকজন বন্ধু (বিশেষ করে জন মেইজ, যাকে আমি বইটা উৎসর্গ করেছি) যদি প্রতিনিয়ত উৎসাহ না দিতেন, তাহলে হয়তো কাজটা কখনোই শেষ করতে পারতাম না। আর যে ঘটনাটা দেখা গেলো, রচনার ক্ষেত্রে বাস্তুতন্ত্রের সমস্যা এতো বড় আকারে এলো যে, খোদ ‘মান্থলি রিভিয়্যু’র কাছেই বাস্তুতন্ত্র নিয়ে পর্যালোচনা, রাজনৈতিক অর্থনীতি পর্যালোচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটা সুসংবদ্ধ ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত করতে অন্য যে কোন সময়ের চাইতে আরও বেশি প্রয়োজনীয় ছিল।



যাই হোক, বইটা লিখতে এতো দীর্ঘ সময় নেয়ার বড় কারণ হচ্ছে, এই কাহিনীগুলো জানা ছিলো না এবং এর জন্য আর্কাইভ নিয়ে বিপুল পরিমাণ গবেষণা করতে হয়েছিল। বুঝতে হয়েছিল এর অস্পষ্ট উৎসগুলো। সেখানে এমন বইপত্র ছিলো যা কেউ আধা শতকেও পড়েনি। বড় কাজগুলো একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল এবং সেগুলো একটার পর একটা উঁচু হয়ে উঠছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা কোণায়। অন্যান্য লেখাগুলো ছিলো অপ্রকাশিত অথবা সেগুলো দৃশ্যমান হয়েছে এমন জায়গায় যেখানে তা খুঁজে পাওয়া ছিলো কঠিন। জে. বি. এস. হ্যালডেন, জোসেফ নিডহ্যাম, জে. ডি. বার্নাল, হেম্যান লেভি এবং ল্যাংকলোট হোগবেন-এর মতো চিন্তকরা, বাস্তুতান্ত্রিক ভাবনা বিকাশে অজানা অথবা বিস্মৃত হয়ে গেছিলেন। অথচ গোড়ার দিকে তাঁরা ছিলেন উল্লেখযোগ্য চিন্তক। ব্যাপারটা অংশত ঘটেছিল খোদ মার্কসবাদের মাঝে মারাত্মক সংগ্রামের ক্ষয়ক্ষতি হিসেবে। একই সঙ্গে বেঞ্জামিন ফ্যারিংটন, জর্জ থমসন ও জ্যাক লিন্ডসের মতো বড় মাপের বামপন্থী ধ্রুপদী চিন্তকরাও বিস্মৃত হয়ে গেছিলেন। এই সবকিছু নিয়ে কারবার করতে, বিশ্লেষণের বিশাল সুযোগ ধরতে, তাদের উপযুক্ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করতে সময় লেগেছিলো।



কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, ঐতিহাসিক যোগসূত্রগুলো নিশ্চিতভাবে ওখানেই ছিলো। শেষ পর্যন্ত এই গল্পগুলো ব্যারি কমোনার এবং র‍্যাচেল কার্সনের মতো ব্যক্তিত্বদের দিকে যায়। একই সঙ্গে আছেন স্টিফেন জ্যয় গৌল্ড, রিচার্ড লেভিনস, রিচার্ড লিওন্তিন, স্টিভেন ও হিলারি রোজ, লিন্ডসে এবং ই. পি. থম্পসনের মতো ব্যক্তিত্বরা (থমসন ব্রিটেনের নেতৃস্থানীয় নিউক্লিয়ার-বিরোধী অ্যাক্টিভিস্টে পরিণত হয়েছিলেন)। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে হলেও এঁদের সবাই এই বৌদ্ধিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যে ব্যপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই ইতিহাস আজকের সংগ্রামে কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে এই প্রশ্নের জবাবে,সবচেয়ে যুতসই জবাব সম্ভবত কোয়েন্টিন স্কিনারের বিবৃতি। ‘দি রিটার্ন অব নেচার’-এর সূচনায় আমি তাঁকে উদ্ধৃত করেছি। তিনি বলেছেন,এই ধরনের ইতিহাসের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা দেখানো যে “কীভাবে আমাদের সমাজ আমাদের কল্পনায় সীমারেখা এঁকে দেয়”। তিনি আরও বলেন, “এ ক্ষেত্রে আমরা সবাই মার্কসবাদী”।

গিওর্গ লুকাচের (এবং আন্তোনিও গ্রামসির) লিগ্যাসি নিয়ে আপনার নিজস্ব আত্তিকরণ, কীভাবে প্রকৃতির ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ব্যবহারে বাধা তৈরি করেছে তা আপনি মার্কসের ইকোলজি বইয়ে উল্লেখ করেছেন। আপনি দেখিয়েছেন, এই সাধারণ দুর্বলতার কারণে পশ্চিমা মার্কসবাদ বিজ্ঞানের দর্শন ও প্রকৃতির ক্ষেত্র থেকে কিছুটা পরিত্যাক্ত হয়ে চিন্তার যান্ত্রিক ও দৃষ্টবাদী ধরনের এলাকায় যায়। তবে দি রিটার্ন অব নেচার (২০২০) বইটি শুরু হয়েছে লুকাচ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন দিয়ে। সেগুলো প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা থেকে পশ্চিমা মার্কসবাদের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। কী কী শর্তাবলী এইরকম গুরুত্বপূর্ণ অনেক ফলাফল পেতে বিলম্ব ঘটিয়েছে? বিশেষ করে বাস্তুতন্ত্রবিদ্যার সাথে মার্কসবাদ নিয়ে যেসব আন্দাজ ছিলো, সেসবের প্রধান প্রভাব কী ছিলো?



আমি হয়তো এর কিছুটা ব্যাখ্যা করতে পারি আমার নিজস্ব বৌদ্ধিক বিকাশের ভেতর দিয়ে। আমি যখন স্নাতকের ছাত্র ছিলাম, তখন ইমানুয়েল কান্ট, হেগেল, আর্থার শোপেনহাওয়ার, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন এবং ম্যাক্স ওয়েবারের কাজ মোটামুটি ব্যপকভাবেই অধ্যয়ন করেছিলাম। সেইসাথে অধ্যয়ন করেছিলাম হারবার্ট মার্কুস, মেসজারোস, আর্নস্ট কাজিরার, এইচ. স্টুয়ার্ট হিউস এবং আর্নল্ড হাউসারের মতো চিন্তকদের কাজ। ফলে, আমি যখন স্নাতকোত্তরে [পড়তে] গেলাম, কান্টবাদ/নব্য-কান্টবাদ এবং হেগেলবাদ/মার্কসবাদের মাঝে সীমা সম্পর্কে আমার বেশ ভালো একটা সাধারণ ধারণা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, বিচারমূলক তত্ত্বের কোর্সে অংশ নিয়ে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। সেখানে একদম প্রথম যে প্রত্যয় শেখানো হয়েছিলো তা হলো, প্রকৃতিতে দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগ করা হয়নি। প্রাথমিকভাবে এর ভিত্তি ছিলো লুকাচের হিস্টোরি অ্যান্ড ক্লাস কনশাসনেস’(১৯২৩, ইংরেজিতে অনূদিত ১৯৭১) বইয়ের একটা পাদটীকা। সেখানে তিনি প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের সমালোচনা করেছিলেন। বাহাস করা হয়েছিল, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রত্যাখ্যান করেও কেবল ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার হুবহু, বিষয়ী-বিষয় (subject-object, অর্থাৎ চিবতার কর্তা-চিন্তার বিষয়) অনুসারে দ্বান্দ্বিকতা সংজ্ঞায়িত করা যায়।



যেহেতু লুকাচ নিজেই পরে খোলাসা করেছিলেন, তিনি অবশ্যই কখনো সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা অথবা “নিখাদ বিষয়গত দ্বান্দ্বিকতা”র প্রত্যয় পরিত্যাগ করেননি। যেটি তিনি হিস্টোরি অ্যান্ড ক্লাস কনশাসনেস’ (১৯২৩) বইয়ের কোথাও কোথাও উল্লেখ করেছেন। বস্তুত, লুকাচ মার্কসকে অনুসরণ করে ‘হিস্টোরি অ্যান্ড ক্লাস কনশাসনেস’ বইয়ে, ১৯৬৭ সালের বিখ্যাত সূচনায়, বিপাক-ক্রিয়া হিসেবে শ্রমের ভেতর দিয়ে সমাজ ও প্রকৃতির মাঝে দ্বান্দ্বিক মধ্যস্থতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। আর এই অর্থে তা ছিলো প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা ধারণার ওপর জোর দেয়া। এই একই বাহাস করা হয়েছিল তাঁর কনভারসেশন উইথ লুকাচ (১৯৬৮) বইয়ে। বইটি আমি পড়েছিলাম ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে।



পশ্চিমা মার্কসবাদী দার্শনিক ধারণায় দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগযোগ্য ছিলো কেবল মানব-ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে। প্রকৃতিতে (অথবা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে) নয়। বিষয়টি প্রদত্ত হয় যান্ত্রিকতাবাদ অথবা দৃষ্টবাদে। সম্পূর্ণরূপে নেয়া ছাড়াই আমি এই প্রেক্ষিত কিছুটা ব্যবহারিক স্তরে আত্তীকরণ করেছিলাম। সেটা ছিলো অস্পষ্টতা আর অনিশ্চয়তা নীতির প্রেক্ষিত থেকে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা দেখার জন্য যাতে আমরা ইতিহাস বুঝতে পারি। মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ই. পি. থম্পসন একে বিকশিত করে বলেন, কারণ ইতিহাস আমরাই তৈরি করেছি। যদিও গভীরতর স্তরে আমি চিহ্নিত করেছি যে তা পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। যেহেতু মানুষ একাই ইতিহাস তৈরি করে না। সে ইতিহাস তৈরি করে প্রকৃতির সার্বিক বিপাক-ক্রিয়ার সাথে যুগপৎ সংঘটনে— মানব সমাজ যার এক প্রকাশমান অংশ। ১৯৮০ এর দশকে আমার আগ্রহ ছিলো প্রধানত ইতিহাস ও রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকে। সেখানে এই ধরনের ইস্যুগুলো হাজির হতো কখনো-সখনো। যেহেতু, যতটা সম্ভব এখানে মনোযোগে ছিলো মানুষের ঐতিহাসিক ক্ষেত্র, কাজেই প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার প্রশ্ন ব্রাকেটবন্দী করা বেশ সহজ ছিলো।



১৯৮০ এবং ৯০ এর দশকে আমি যখন আরও সরাসরি বাস্তুতন্ত্রের প্রশ্নে আসি, তখন এই সমস্যা আর এড়ানো গেলো না। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে নির্বিরোধীভাবে একপাশে সরিয়ে রাখা যেতে পারে শুধু ভাবতান্ত্রিক (idealist) অথবা যান্ত্রিক বস্তুবাদের জমিনে। তবুও,মার্কসের ইকোলজি লেখার সময়, মার্কসের সাথে সম্পর্কে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে বিস্তারিত এবং যে কোন মূর্ত বিবেচনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছি। বিষয়গুলো ছিলো জটিল। আর সেগুলো তখন শনাক্ত করতেও প্রস্তুত ছিলাম না। যদিও পরিষ্কারভাবেই মার্কসের সামাজিক বিপাক-ক্রিয়ার ধারণা তাঁকে ওই দিকেই নিয়ে গেছে। আর তাই,‘মার্কসের ইকোলজি ভাবনা’র ‘উত্তরভাষ’ অংশে, আমি “বস্তুর মুক্ত গতি” নিয়ে আলাপের পন্থা হিসেবে সহজভাবে মার্কসের “দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি” নির্দেশ করেছি। এই পদ্ধতি কীভাবে এপিকিউরাস সহ অন্যান্য বস্তুবাদীদের ঐতিহ্যের অংশ ছিলো এবং হেগেল অধ্যয়নের মধ্যস্থতায় তিনি কীভাবে তাদের কাছ থেকে এই ধারণা গ্রহণ করেছিলেন তাও আমি দেখিয়েছি। জ্ঞানতাত্ত্বিক অ্যাপ্রোচ হিসেবে আমি ইঙ্গিত দিয়েছি, কান্টে মানব চৈতন্যের জন্য ধর্মতত্ত্ব যে ভূমিকা পালন করে, তা অনুসন্ধানমূলকভাবে এর সমান হতে পারে। কিন্তু মার্কস, এঙ্গেলস (এবং লুকাচের) সাথে সম্পর্কের নিরিখে এবং তাদের মাঝে প্রকাশিত হিসেবে, আমার কাজে “তথাকথিত নৈব্যক্তিক বা বিষয়গত দ্বান্দ্বিকতা”র বিস্তৃত সত্তাতাত্ত্বিক প্রশ্নের বেশিরভাগই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।



বের্টেল ওলম্যান এবং টনি স্মিথ ২০০৮ সালে একটি বই সম্পাদনা করেন। সেখানে আমি একটা অধ্যায় লিখেছিলাম। এই অধ্যায়টি লেখার আগে আমি বিস্তারিতভাবে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে চিহ্নিত করিনি। (পরে অধ্যায়টি দি ইকোলজিক্যাল রিফ্‌ট গ্রন্থে যুক্ত হয়) আমি তখনো “লুকাচ সমস্যা”য় আটকে ছিলাম। যদিও পরিণত লুকাচের কারণেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম,বিপাক -ক্রিয়া নিয়ে মার্কসের বাহাস, সমগ্র জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং সত্তাতাত্ত্বিক উভয়সংকটের বাইরেই একটি প্রশস্ত পথ প্রদান করেছিলো। (অন্যদিকে আমি বাহাস করেছি, আরেকটা পথ পাওয়া গেছে। মার্কস যাকে বলতেন “সংবেদনশীল নিশ্চয়তার দ্বান্দ্বিকতা”। এটি এপিকিউরাস, ফ্রান্সিস বেকন ও লুডভিগ ফয়েরবাখের বস্তুবাদ তুলে ধরেছিলো। এবং মার্কসের প্রথম দিকের কাজে এই ধারণা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল)। যদিও, আমি হয়তো এক কদম সামনে এগিয়েছি, তবু আমার অ্যাপ্রোচ ছিলো বিভিন্ন দিক থেকেই অপর্যাপ্ত। যেহেতু আমি বিষয়গুলো বুঝতে চেয়েছিলাম, বস্তুতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতার দার্শনিক সীমাবদ্ধতা ছিলো কঠিন দিকগুলোর একাংশ (এবং একই সময়ে তা ছিলো আরও বড় আকারের বৈজ্ঞানিক সুযোগ)। যেটি কখনোই হেগেলের ভাবতান্ত্রিক দর্শনের মতো চক্রাকার, বদ্ধ ব্যবস্থার হতে পারে না। কিংবা তা অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক ও জানালাহীন মোনাডের সর্বাত্মক একচেটিয়া কোন ব্যবস্থা নয়। পদার্থ জগতের ক্ষেত্রে যেমন ছিলো, ঠিক একইভাবে মার্কসের কাছে দ্বান্দ্বিকতা ছিলো উন্মুক্ত। আবদ্ধ নয়।



দি রিটার্ন অব নেচার’ বইয়ে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার প্রশ্ন ছিলো কেন্দ্রীয়। পরিণত লুকাচের অধ্যয়ন ছিলো একটা উপাদান। বিশেষ করে দি ইয়াং হেগেল (১৯৪৮) এবং অন্টোলজি অব সোশ্যাল বিইং (১৯৭৩)। এখানে একটা বড় ফ্যাক্টর ছিলো হেগেলের ভাবনার নির্ধারক নিয়ে লুকাচের বাহাস। এটি আমাকে একটা পন্থা বুঝতে সাহায্য করেছে, যার মাঝে একটা বিবেচনাযোগ্য পরিসরে এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ উৎসাহিত হয়েছিল। সেটা হয়েছিলো হেগেলের লজিক-এ সারসত্তার মতবাদ দ্বারা। আরেকটি ব্যাপার আমাকে প্রভাবিত করেছিলো। মার্কসের ইকোলজি’র কাছে ফিরে গেলে,সেটি ছিলো রয় ভাস্করের বৈচারিক বাস্তববাদ। বিশেষ করে তাঁর ‘ডায়ালেক্টিকঃ দি পালস অব ফ্রিডম’ (১৯৯৩)। তবে দি রিটার্ন অব নেচার’(২০২০) প্রকল্পের একদম হৃদপিন্ডে ছিলো এঙ্গেলসের প্রকৃতির দ্বান্দিকতা ( (Dialectics of Nature, ১৯২৫)-এর অনুপুঙ্খ বিচার। (একই সাথে এই বিচারের আওতায় ছিলো লেনিনের রচনাবলী)। এগুলোর গভীরতা ছিলো অকথিত। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা সমস্যা নিয়ে এঙ্গেলস যেসব চিন্তকদের প্রভাবিত করেছিলেন, তার একটা তালিকা প্রস্তুত করতে এটা আমাকে সমর্থ করে। এঁদের মাঝে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হলেনঃ নিডহ্যাম, ক্রিস্টোফার কডওয়েল এবং লিন্ডসে। এছাড়া শিল্পে (Art) উইলিয়াম মরিস এবং বিজ্ঞানে জে. ডি. বার্নাল, হ্যালডেন, হগবেন এবং লেভি বস্তুতান্ত্রিক ও দ্বান্দ্বিক বাস্তুতন্ত্রবিদ্যার ক্ষেত্রে শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টির একটি ধরন প্রদান করেন।



বিচ্ছিন্ন করা শ্রমের বিভাগ কীভাবে পুঁজির বিশেষায়িত কাজকারবারে প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞানের শৃঙ্খলাগত বিভাগ বৃদ্ধি করে, লুকাচ তা উল্লেখ করেছেন। প্রায়োগিক বা অনুশীলনের দর্শন (philosophy of praxis) হিসেবে মার্কসবাদ অন্যান্য বিষয়ের মাঝে সমগ্রতাবাদী প্রকল্প হিসেবে প্রস্তাবিত হয়। তা হয় বিজ্ঞান ও শিল্পের মাঝে, প্রকৃতি ও সমাজের মাঝে পুঁজিবাদ যে অনেক ও বিভিন্নরকম ফাটল বড় করেছে বা আরোপ করেছে তার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে। আপনার নতুন বইয়ের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো বাস্তুতন্ত্রে সমান্তরাল অ্যাপ্রোচের অস্তিত্ব এবং শিল্প ও বিজ্ঞানে সমাজতন্ত্র। এই সংযোগগুলো কীভাবে বস্তুবাদী ইকো-সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় অবদান রাখে? বাস্তুতন্ত্র ও বাস্তু-সামাজিক সম্পর্কের আন্তক্রিয়া নিয়ে আমরা যেসব সংকটের মুখোমুখি হই তার পুনর্চিন্তায় এগুলো কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে?



‘দি রিটার্ন অফ নেচার’ বইটি লেখার সময় ‘নিউজ ফ্রম নোহোয়ার’ এর একটা বিবৃতি সবসময় আমার মনে ছিলো। মরিস সেখানে বলেছেন, বিজ্ঞান ও শিল্পের দুটি অলঙ্ঘনীয় রূপ আছে। বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মনোযোগী সব মার্কসবাদী চিন্তকই বিভিন্ন পন্থায় এই সীমাগুলো পার হয়ে গেছেন। কাজেই, সমান্তরালভাবে বিকশিত যে কোন পরম্পরাগত-ঐতিহাসিক খতিয়ানগুলো পরখ করতে হয়েছিল। স্পষ্টতই, বিজ্ঞান ও প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার সাথে এর সম্পর্ক হিসেবে বাস্তুতন্ত্রের বিশ্লেষণগত উন্নতি প্রধানত বিবর্ধিত হয়েছে বৈজ্ঞানিক ধারার ভেতর দিয়ে। কিন্তু একে সমাজতান্ত্রিক নন্দনভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা ছিল খুব কঠিন।



কাজেই, ল্যাংকেস্টারের বন্ধুত্ব ছিলো মরিস এবং প্রাক-রাফায়েলপন্থীদের সঙ্গে। হগবেন তাঁর সমাজতান্ত্রিক প্রেরণা প্রধানত নিয়েছিলেন মরিসের কাছ থেকে। মরিসের কাজে আমরা যে বিশ্লেষণ খুঁজে পাব তা একটি ধারণার মাঝে প্রোথিত। ধারণাটি হলো, সকল বিচ্ছিন্নতাহীন কাজ শিল্প (Art) ধারণ করে। মরিস এই ধারণা নিয়েছিলেন জন রাস্কিন থেকে। তবে এই ধারণায় তিনি গভীরতা দিয়েছেন মার্কস হয়ে। মরিস অবশ্য সকল শিল্পের সামাজিক চরিত্রের প্রত্যয় পুনরুৎপাদন করেছিলেন মার্কস থেকে স্বাধীনভাবে। বাস্তুতান্ত্রিক পর্যালোচনায় কডওয়েল দুর্দান্তভাবে উভয়ত নন্দনতাত্ত্বিক এবং বৈজ্ঞানিক ধারা আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনা অঙ্কিত হয়েছে ‘মিমেসিস’-এর ধারণা থেকে যার ভিত্তি ছিলো এরিস্টটলে। এবং ক্যামব্রিজ রিচুয়ালিস্টদের র‍্যাডিকেল ব্রিটিশ ধ্রুপদী ঐতিহ্যে। এই ঐতিহ্য তুলে ধরেছিলেন জেন হ্যারিসন। কডওয়েল পরে বস্তুতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতার সাথে একে মিলিয়েছেন। কডওয়েলের শক্তিশালী অ্যাপ্রোচ চালিত হয়েছে কবিতা ও নাটকের উৎস নিয়ে জর্জ থমসনের অসামান্য বিশ্লেষণে।



বাম ঘরানায় এই সমগ্র নন্দনতাত্ত্বিক -বাস্তুতান্ত্রিক বিকাশ চূড়া ছুয়েছে অস্ট্রেলিয় মার্কসবাদী জ্যাক লিন্ডসের কাজে। লিন্ডসে তাঁর ব্যপক মাত্রার ধ্রুপদী, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার প্রত্যয় সামনে এনেছেন। তা এনেছেন উভয়ত নন্দনতত্ত্ব এবং বিজ্ঞান থেকে একত্রে। এটা মোটেই কোন দুর্ঘটনা নয় যে – লুকাচ, মেসজারোস ও থমসনের মতো চিন্তকরা লিন্ডসের কাজকে উচ্চতর মর্যাদায় দেখেছেন। তবে লিন্ডসের কাজ যথেষ্টরূপে মূল্যায়িত হয়নি। তার কারণ সম্ভবত লিন্ডসের ১৭০ খন্ড রচনা সঙ্কলনের গুরুভার। প্রাচীন ধ্রুপদী রচনা থেকে নিয়ে সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে তাঁর কাজের বিস্তৃতি সহজভাবে বললে অতি ভয়াবহ।



আপনার নতুন বইয়ে প্রধান চরিত্র এঙ্গেলস। বহুদিন ধরেই নির্দিষ্ট মার্কসবাদের মাঝে, মার্কসের চিন্তাকে স্থুল করার জন্য এঙ্গেলসকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু পুঁজিবাদের বাস্তুতান্ত্রিক এবং সামাজিক পর্যালোচনার জন্য আপনি এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জটিলতা ও প্রাসঙ্গিকতার কথা বলেছেন। ক্রমাগতভাবে চিনে নেয়া হলেও আপনি দেখবেন, মার্কস ও এঙ্গেলসের কাজের বন্ধন সম্পর্কে এঙ্গেলস এখনো অবজ্ঞার শিকার। এটা কীভাবে ঘটছে? মার্কসীয় বাস্তুতান্ত্রিক চিন্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এই অবস্থানগুলো আমরা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারি?



আমার মনে আছে,ডেভিড ম্যাকলিলেনের বক্তব্য শুনেছিলাম ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে। সেটা মার্কসের জীবন নিয়ে তাঁর লেখার খুব বেশি পরে নয়। এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে তাঁর দুর্দান্ত দীর্ঘ বক্তৃতায় আমি সম্পূর্ণরুপে হতচকিত হয়ে গেছিলাম। এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে বলাটাই ছিলো তাঁর বক্তৃতার মূল বিষয়। এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে আক্রমণে এই বক্তৃতাটা ছিলো আমার প্রথম বাস্তব অভিজ্ঞতা। শীতল যুদ্ধ চলাকালে এই বক্তৃতা অনেকভাবেই পশ্চিমা মার্কসবাদী ঐতিহ্যকে সংজ্ঞায়িত করে। আর তা অব্যাহত থাকে শীতল যুদ্ধের পরেও। আলভিন গৌল্ডনার একে বলতেন “দুই মার্কসবাদ”। তবে “দুই মার্কসবাদের” চাইতে চিন্তক হিসেবে এঙ্গেলস সম্পর্কে এর সবকিছু ছিলো আরও নিচের দিকের। একটা বিবেচনাযোগ্য মাত্রায়, পশ্চিমা মার্কসবাদ ও একাডেমির জগত মার্কসকে তাদের নিজেদের বলে দাবী করলো। একজন নাগরিক চিন্তাবিদ হিসেবে দাবী করলো। কিন্তু এদের বেশিরভাগই আন্দাজে এঙ্গেলসকে অতি “অমার্জিত” হিসেবে বর্জন করলো। এঙ্গেলসের ভূমিকাকে দেখা হলো বিনষ্টকারী হিসেবে। যেন তিনি এমন এক “মার্কসবাদ” সৃষ্টি করেছেন যার সাথে মার্কসের কোন সম্পর্ক নেই। আর এভাবেই তিনি নাকি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ছাড়িয়ে স্ট্যালিন অবধি, অর্থনীতিবাদ, নির্ধারণবাদ, বিজ্ঞানবাদ, স্থুল দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের জন্য দায়ী।



কাজেই, আমাদের হয়তো এতে বিস্মিত হওয়া উচিৎ নয় যে, এঙ্গেলসের প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে শত শত বা হাজার হাজার নিবন্ধ লেখা হয়েছে। আর সেখান থেকে আমাদের শেখার আছে খুব সামান্যই। কারণ, তারা এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করেছে হয় পুরানো প্রাতিষ্ঠানিক মার্কসবাদ বা একটা মতবাদিক পন্থায়, নয়তো পশ্চিমা মার্কসবাদী ঐতিহ্যে এন্টি-ড্যুরিং (১৮৭৭) অথবা কখনো কখনো প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ থেকে কয়েকটা লাইনের উদ্ধৃতি হিসেবে, যাতে করে মার্কসবাদে এঙ্গেলসের স্থুলকরণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। টেরেল কার্ভারের মতো অন্যান্য লেখকরা, যারা এঙ্গেলসের ওপর ব্যপকভাবে লিখেছেন, তারা এঙ্গেলসের কাজ বোঝার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করেননি। তারা বরং মার্কসের কাজ থেকে এঙ্গেলসের কাজকে পদ্ধতিগতভাবে সংকটাপন্ন করেছেন।



আমার মনে আছে, আমি যখন কার্ল পাডোভারের ‘কার্ল মার্কসের চিঠিপত্র’ দেখছিলাম, আমি ভাবছিলাম, এই বইটা মার্কসের নিজের কথা দিয়ে ভরা হলেও, এত শূন্যগর্ভ লাগছে কেন। আমি এর কারণ বুঝলাম। এই বইয়ের প্রায় সবগুলো চিঠি ছিলো এঙ্গেলসের প্রতি, আর সেই বই থেকে এঙ্গেলসকেই বাদ দেয়া হয়েছিলো! কাজেই, এটা ছিলো একপাক্ষিক আলাপ। যেন শুধু মার্কসই সেখানে আমলযোগ্য ব্যাপার এবং মার্কস নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মার্কস-এঙ্গেলস যোগাযোগ অবশ্যই দ্বিপাক্ষিক আলাপ আলোচনা। এই দুজন বিরাট চিন্তকের মাঝে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ হিসেবে তা ছিলো দুর্দান্ত। মার্কস-এঙ্গেলস দুজনে মিলেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।



মার্কসীয় বাস্তুতন্ত্র প্রসঙ্গে এঙ্গেলস অপরিহার্য। কেননা, এক্ষেত্রে মার্কসের বিশ্লেষণ যেমন দুর্দান্ত ছিলো, এঙ্গেলসের শ্রেণি-ভিত্তিক [রোগবিস্তারবিদ্যা বা] মহামারীবিদ্যার বিপুল অবদানও আমরা এড়ানোর চেষ্টা করতে পারি না (মহামারীবিদ্যা ছিলো তাঁর কন্ডিশন অফ দি ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড (১৮৪৫)-এর প্রধান বিষয়)। আবির্ভাব ও প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, প্রকৃতিকে জয় করার পর্যালোচনা কিংবা মানুষের বিবর্তনগত বিকাশ বোঝার ক্ষেত্রেও আমরা তাঁকে এড়াতে পারি না। ‘এন্টি-ড্যুরিং’ বইয়ে এঙ্গেলস যেভাবে ডারউইন আত্মস্থ করেছেন, তা ছিলো বিবর্তনবাদী বাস্তুতন্ত্র বিকাশে মৌলিক। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা বইয়ে বিকশিত আবির্ভাবতান্ত্রিক বস্তুবাদ (emergentist materialism) ছিলো বিচারমূলক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বিষয়।

তৃতীয় বিশ্বের বৈপ্লবিক সংগ্রাম নিয়ে ‘মান্থলি রিভিয়্যু’ সবসময় মহৎ সংবেদনশীলতা দেখিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেনিনের তত্ত্ব, পল সুইজি ও পল বারানের ‘মনোপলি ক্যাপিটাল’, (রুয়া মাউরো ম্যারিনি, সামির আমিন এবং অন্যান্যদের কাজে) নির্ভরতা তত্ত্ব এবং বিশ্ব-ব্যবস্থা বিশ্লেষণে এর সংলাপ, অন্য অনেক প্রভাবের মাঝে মেসজারোস (Mészáros)-এর অবদান আপনার সুনির্দিষ্ট ইকো-সমাজতান্ত্রিক পর্যালোচনার জন্য অপরিহার্য ছিলো। দুর্ভাগ্যবশত— এবং কিছু পরিসরে পশ্চিমা মার্কসবাদের সাথে সংযোগে— অন্যান্য মার্কসবাদী ও বাস্তুতান্ত্রিক ধারায় বাস্তুতন্ত্রবিদ্যা এবং সাম্রাজ্যবাদের মাঝে সংযোগকে প্রায়ই হেয় করে দেখা হয়েছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সাথে কারবারে, সাম্রাজ্যবাদকে কেউ কেউ একটা মেয়াদোত্তীর্ণ ক্যাটেগরি বা বর্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। বামপন্থীদের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়, ভূরাজনীতি ও বাস্তুতন্ত্রবিদ্যার মাঝে বিভাজন শক্তিশালী হিসেবে বহাল রয়ে গেছে কেন? এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কি একটা ভিন্নরকম দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভব?



আমেরিকায় আমার প্রজন্ম প্রভাবিত হয়েছে চিলির ক্যু এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে। মার্কসবাদে যারা আকর্ষিত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই এসেছেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার ভেতর দিয়ে। আগেভাগেই ‘মান্থলি রিভিয়্যু’র প্রতি আকর্ষণ বোধ করার কিছু কারণ রয়েছে। বিশেষ করে, ১৯৪৯ সালে এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ব-ব্যবস্থা বিশ্লেষণ, নির্ভরতা তত্ত্ব এবং সাম্রাজ্যবাদ পর্যালোচনার প্রধান উৎস ছিলো ‘মান্থলি রিভিয়্যু’ পত্রিকা। ‘দি এইজ অফ ইমপেরিয়ালিজম অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজমঃ ফ্রম দি কলোনিয়াল এইজ টু দি প্রেজেন্ট’ গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে হ্যারি ম্যাগডফের লেখা আমাদের কাছে কেন্দ্রীয় হয়ে দেখা দেয়। একই সাথে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে পল বারান, পল সুইজি, অলিভার ক্রোমওয়েল কক্স, শে গেভারা [চে গুয়েভারা], আন্দ্রে গুন্দার ফ্রাঙ্ক, ওয়াল্টার রডনি, সামির আমিন, ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন এবং অন্যান্যদের কাজও আমাদের কাছে কেন্দ্রীয়। ফ্যাক্ট হলো, আমেরিকার বেশিরভাগ বৈপ্লবিক প্রেক্ষিত এসেছে ঐতিহাসিকভাবে কালোদের আন্দোলন থেকে। যেটি সবসময় ছিলো আরও বেশি আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং এর প্রেক্ষিতের মাঝেই তা ছিলো সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধীতা। আমেরিকার র‍্যাডিকেল বামদের সংজ্ঞায়নে এটা গুরুতর বা মূল ব্যাপার। তথাপি, এই সবকিছু নিয়ে আমেরিকায় সবসময়ই বড় মাপের সামাজিক-গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব রয়েছে। যেমন ধরুন, মিশেল হ্যারিংটন। তিনি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের শান্তি বজায় রেখেছিলেন। আজকের দিনে, ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’র জন্য নতুন আন্দোলনে কিছু প্রতিনিধি নিয়মিত তাদের একটা অন্ধ চোখ দিয়ে বিদেশে ওয়াশিংটনের নির্দয় হস্তক্ষেপের দিকে তাকায়।



অবশ্যই এর কিছুই নতুন নয়। ইংল্যান্ডে বামপন্থীদের মাঝে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে বিরোধের বিভিন্নতাকে, গোড়ার দিককার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে দেখা যেতে পারে। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা এইচ. এম. হিন্ডম্যান এবং ফেবিয়ানপন্থীদের অন্যতম নেতা জর্জ বার্নার্ড শ – দুজনেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং “সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ” সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে, সোশ্যালিস্ট লীগের সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। যেমন, উইলিয়াম মরিস, এলেনর মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। এঁদের সবাই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের কালপর্বে, সাম্রাজ্যবাদের ইস্যুই সবচেয়ে উপর্যুপরিভাবে ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভাগ করে ফেলেছিলো। লেনিনের ‘ইম্পেরিয়ালিজম, দি হাইয়েস্ট স্টেজ অফ ক্যাপিটালিজম’ বইয়ে বিষয়টি পুনরায় আলাপ করা হয়েছে।



১৯৬০ এর দশক থেকে ব্রিটেনে নয়া বামপন্থীদের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা প্রধান উৎস ছিলো সাম্রাজ্যবাদ। প্রথম নয়া বামপন্থী ঘরানায় যারা পরিচিত ছিলেন, যেমন ধরুন থমসন, র‍্যালফ মিলিব্যান্ড ও রেমন্ড উইলিয়ামস শক্তিশালীভাবে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ছিলেন। অন্যদিকে, দ্বিতীয় নয়া বামপন্থী ঘরানা সম্পৃক্ত ছিলো বিশেষ করে ‘নিউ লেফট রিভিয়্যু’র সাথে। তারা এমন কি সাম্রাজ্যবাদকে ইতিহাসে একটি প্রগতিশীল শক্তি হিসেবে দেখেছেন। বিল ওয়ারেনের বেলায় যেমন, অথবা বলা যায়, সব মিলিয়ে এর গুরুত্ব নিচের দিকে ঝুঁকেছিলো। বিশেষ করে এই শতকে বিশ্বায়ন ভাবাদর্শের উত্থানের সাথে এর ফল ছিলো উভয়ত ব্রিটেন এবং আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদ অধ্যয়নে নাটকীয় প্রত্যাখ্যানের মাঝে। (তবে বেড়ে ওঠা উপনিবেশবাদ এবং উত্তর-উপনিবেশবাদের সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের অনুষঙ্গে)। এর যৌক্তিক ফল হিসেবে, আজকের দিনে, ডেভিড হার্ভের মতো প্রভাবশালী বাম ঘরানার ব্যক্তিত্ব সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, পশ্চিমে সাম্রাজ্যবাদ এখন থেকে পরাজয় প্রান্তের দিকে “পিছু হটছে”।



এই সবকিছু, বাম ঘরানায় সাধারণভাবে বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব অথবা অসম বাস্তুতান্ত্রিক বিনিময়ের তত্ত্ব বিকাশে খুব দুর্বল উপস্থাপনার প্রশ্নে নিয়ে যায়। এ হলো পুঁজিবাদ কর্তৃক পৃথিবীর বেশিরভাগ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র এবং [সম্পদের] উৎসগুলোর নির্মম ‘বেদখল’ (Expropriation) আবিষ্কারে পদ্ধতিগত ব্যর্থতার ফল। এটা হলো ব্যবহার মূল্য সম্পর্কে কথা, কেবলমাত্র বিনিময় মূল্যের কথা নয়। কাজেই, ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভারতে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, তাকে দেখতে হতো ব্রিটিশ কীভাবে জোর করে ভারতের খাদ্য ব্যবস্থা পাল্টে দিয়েছিল, ব্যবহার মূল্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, বিপাকীয় সম্পর্ক ও মানুষের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য পানি-প্রবাহগত পরিকাঠামো বদলে দিয়েছিল এবং একই সাথে ভারতের উদ্বৃত্ত বহুদূরে চলে যাচ্ছিলো তার প্রেক্ষিতে। যদিও এই বাস্তুতন্ত্রগত ‘বেদখল’ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের বামপন্থীরা উপলব্ধি করেছেন। যেমন করেছেন দক্ষিণ গোলার্ধের বেশিরভাগ অঞ্চল। উত্তর গোলার্ধের মার্কসবাদীরা একে এখনো পুরোপুরি ধরতে পারেননি। এক্ষেত্রে দুর্দান্ত একটা ব্যতিক্রম হলো মাইক ডেভিসের বই ‘লেইট ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্ট’।



একইভাবে, ইউরোপীয় মাটি উর্বর করার জন্য, পেরু থেকে বিশাল পরিমাণের গুয়ানো ‘বেদখল’ পেরুর পুষ্টি উপাদান কেড়ে নিচ্ছিলো (বিপাকীয় ফাটলের একটি প্রকাশ)। এটি ছিল পেরুর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সব ধরনের নেতিবাচক উন্নয়নের প্রভাব। এখানে গুয়ানো খননের জন্য যেসব শর্তাবলীর অধীনে চীনের শ্রমিক নিয়ে আসা হয়েছিল, তার চরিত্রকে প্রায়ই “দাসত্বের চাইতেও জঘন্য” বলা হতো। এর সবকিছু বাঁধা ছিলো – এদুয়ার্দো গালেয়ানো যাকে বলতেন “লাতিন আমেরিকার উন্মুক্ত শিরা”য়।



এগুলো আমাদের বলে যে, বাস্তুতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদের ইস্যু সবসময়ই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলো এবং প্রতি মুহুর্তেই তা আরও নিবিড়ভাবে বিজড়িত হয়ে উঠছে। ‘ইনস্টিটিউট অফ ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস’ ২০২০ সালের ‘বাস্তুতান্ত্রিক হুমকি রেজিস্টার’ প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ অন্তত ১.২ বিলিয়ন মানুষ তাদের বাড়ি থেকে স্থানচ্যুত হয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হবে। এই ধরনের ঐতিহাসিক শর্তাবলীর অধীনে, পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের প্রক্রিয়া থেকে সাম্রাজ্যবাদকে আর স্বাধীনভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে না। মানে বাস্তুতান্ত্রিক সংকট থেকে স্বাধীনভাবে দেখা সাম্রাজ্যবাদ এমন একটি সত্তায় এসেছে যা আজকের দিনে অচল হয়ে গেছে। ব্রেট ক্লার্ক এবং আমি এই বার্তাই ‘দি রবারি অফ নেচার’ -এ দিতে চেয়েছিলাম। হানা হোলম্যানের সঙ্গে আমরা দুজন মিলে “চলতি ভূতাত্ত্বিক যুগে সাম্রাজ্যবাদ” (Anthropocene) নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। এটি বেরিয়েছিল ‘মান্থলি রিভিয়্যু’র ২০১৯ জুলাই-অগাস্ট সংখ্যায়। ওই প্রবন্ধে আমরা উপসংহার টেনে বলেছিলাম, “চলতি অস্তিত্ব সংকটের সামনে কোনও বাস্তুতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারে না, যদি না তা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বিপ্লব হয়। যাতনাক্লিষ্ট বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে শক্তি আহরণ না করে তা হতে পারে না…পৃথিবীর উত্তরাধিকার হওয়া উচিৎ গরিব মানুষদের, নয়তো উত্তরাধিকারের জন্য কোন পৃথিবীই থাকবে না।”

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে মার্কসের ইকো-সমাজতন্ত্র নিয়ে আগ্রহ ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অবশ্যই, এটি মার্কসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে ছাড়িয়ে যায়। চলতি বাস্তুতান্ত্রিক চিন্তার জন্য মার্কসের ধারণাগুলোর কাছে ফিরে আসা গুরুত্বপূর্ণ কেন? এবং আজকের দিনে মার্কসীয় বাস্তুতন্ত্র চিন্তার জন্য চ্যালেঞ্জগুলো কী?



বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মার্কসের ভাবনা একটি সূচনা বিন্দু এবং একগুচ্ছ ভিত্তি, সমাপ্তি বিন্দু নয়। মার্কসের চিন্তার মাঝে আমরা সর্বোপরি রাজনৈতিক অর্থনীতি পর্যালোচনার ভিত্তি খুঁজে পাই। এবং একই সাথে তা ছিলো পুঁজিবাদ কর্তৃক বাস্তুতন্ত্র লুন্ঠন করার পর্যালোচনা। এটা একেবারেই কোন দুর্ঘটনা নয়, যেহেতু মার্কস সমাজ ও প্রকৃতির সামাজিক বিপাক-ক্রিয়া (মধ্যস্থতা হিসেবে কাজকারবার) হিসেবে দ্বান্দ্বিকভাবে শ্রম প্রক্রিয়াকে উপস্থাপন করেছিলেন। মার্কসের কাজে, পুঁজিবাদ শ্রম প্রক্রিয়ার বিচ্ছিন্নকরণের সাথে সাথে, প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে বিপাক-ক্রিয়ায় বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। ফলে সেখান থেকে বিপাকীয় ফাটল সৃষ্টি হয়। মার্কস একে যৌক্তিক উপসংহার হিসেবে নিয়ে বলেন, কেউ পৃথিবীর মালিক নয়। এমন কি দুনিয়ার সব দেশের সব মানুষও পৃথিবীর মালিক নয়। মানে, সোজা কথায়, পৃথিবীর প্রতি যত্নশীল হতে মানুষের দায় আছে। এবং যদি সম্ভব হয়, সংসারের একজন ভালো কর্তার মতো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধারা বজায় রাখার জন্য মানুষ পৃথিবীকে উন্নত করে তুলবে। সমাজতন্ত্রকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন প্রকৃতি ও মানুষের বিপাক-ক্রিয়ার যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ হিসেবে। যাতে করে, যতটা সম্ভব শক্তির সংরক্ষণ সম্ভব হয় এবং মানুষের পূর্ণ বিকাশে সমর্থন দেয়া যায়। পুঁজিবাদ নিয়ে আংশিকভাবে যতই প্রশ্ন তোলা হোক না কেন, গতানুগতিক বা এমন কি বামপন্থী গ্রীন থিয়োরিতে (green theory) কিছু নেই। মানে এখানে বাস্তুতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক পর্যালোচনার মাঝে ঐক্য রয়েছে অথবা পূর্ণাঙ্গ একটি ঐতিহাসিক সংশ্লেষ হিসেবে তার মাঝে ঐক্য রয়েছে। এর ফলে, আমাদের গ্রহগত জরুরী অবস্থা (planetary emergency) হিসেবে, মার্কসের ভিত্তি প্রদানকারী ধারণায় অপরিহার্যভাবেই বাস্তুতান্ত্রিক-সমাজতন্ত্র চলে আসে। পরিবেশ আন্দোলন যদি কোন ব্যাপার হয়েই থাকে, তাকে অবশ্যই ইকো-সমাজতান্ত্রিক হতে হবে।



তবে অবশ্যই, সমাজতান্ত্রিক বাস্তুতন্ত্র যদি সহজভাবে মার্কসের মাঝেই শুরু ও শেষ হয়ে যেত,তাহলে আমি ‘দি রিটার্ন অফ নেচার’ লিখতাম না, যেটি মার্কস ও ডারউইনের মৃত্যুর পরের শতকের ওপর আলোকপাত করেছে। এটা বুঝতে পারা অতীব জরুরী যে, কীভাবে উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের শেষভাগে সমাজতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতা, বস্তুতান্ত্রিকতা এবং ইকোলজিক্যাল প্রেক্ষিত বিকশিত হয়েছে। ঐতিহাসিক তত্ত্ব এবং চর্চা ধারণ করার লক্ষে যা আজকের সংগ্রামে রসদ যোগায়। আমাদের এখনকার কাজ অতীতে ঝুলে থাকা নয়। বরং এই সবকিছু এগিয়ে নিতে, আমাদের ঐতিহাসিক কালের সকল বোঝা ও চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে একত্রে মোকাবিলায় যাওয়া। মার্কস দেখিয়েছেন, আমাদের অপরিহার্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-বাস্তুতান্ত্রিক বিরোধগুলোর অভিন্নতা (One-ness) এবং তাদের ভিত্তি রয়েছে বর্তমান বিচ্ছিন্ন সামাজিক ও বাস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাঝে। এগুলো বর্তমানকালের বিরোধসমূহের মুখোশ উন্মোচনে আমাদের সাহায্য করে। তবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করতে, আমাদের একটা চোখ রাখতে হবে অতীত কীভাবে বর্তমানকে অবগত করে, এবং ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় বৈপ্লবিক কাজের কল্পনা কীভাবে আমাদের অনুমিত করে তার ওপর।



মার্কসীয় বাস্তুতন্ত্রীয় চিন্তার উদ্দেশ্য কেবল এখনকার সামাজিক বাস্তুতান্ত্রিক বিরোধগুলো বুঝতে পারা নয়, বরং সেই বিরোধগুলো অতিক্রম করে যাওয়া। এটি এখন জানা যে, মানুষ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন আরও বৃহত্তর বিপদের মুখোমুখি। একটা নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিতান্ত্রিক ট্রেন গিরিখাদের কিনার দিয়ে ছুটছে। এটি এখন আমাদের প্রধান উদ্বেগ। পৃথিবীর বাস্তুতান্ত্রিক জরুরী অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার মানে, আমাদের অবশ্যই আগের যে কোন সময়ের চাইতে আরও বেশি বৈপ্লবিক হতে হবে। মার্কস যেমন বলতেন, “উপর থেকে নীচে” সমাজ বদলের প্রশ্ন তুলতে ভীত হওয়া যাবে না। আমরা যেখানে আছি সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। বেশিরভাগ পরিবেশবাদের ধাপে ধাপে বা সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এমন কি স্বল্পমেয়াদেও কাজ করবে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাজার এবং প্রযুক্তির ওপর ভরসা রাখে। একই সাথে এই দৃষ্টিভঙ্গি তার চলন বজায় রাখে বৃহদাংশে পূর্বতন ব্যবস্থার সাথে। অবিশ্রান্ত ও সর্বগ্রাসীভাবে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের সাথে। পুঁজিবাদের বাস্তুতান্ত্রিক অসঙ্গতি নিয়ে এখন শত বছরেরও বেশি সময়ের সমাজতান্ত্রিক পর্যালোচনা আছে। এই পর্যালোচনার রয়েছে বিরাট তাত্ত্বিক শক্তি এবং ভিন্ন একটি অনুশীলনের দর্শন নির্দেশ করার সামর্থ্য। আমাদের চলতি ক্রমবর্ধমান উপলব্ধিতে, পুঁজিবাদের জ্বলন্ত ঘর থেকে বের হওয়া ছাড়া আর কোন পছন্দ নেই। বাস্তুতান্ত্রিক মার্কসবাদ, অপরিহার্য হিসেবে মুক্তির মানবিক, সামাজিক এবং বাস্তুতান্ত্রিক সম্ভাব্যতা তুলে ধরেছে। কাজেই, তার আরও গভীর তাত্ত্বিক বোঝাপড়া প্রয়োজন। ডরিস লেসিং— যিনি আমার দি রিটার্ন অফ নেচার বইয়ে যদিও সংক্ষিপ্তভাবে এসেছেন— তিনি তাঁর দি গোল্ডেন নোটবুক এর সূচনায় বলছেন, “মার্কসবাদ বিষয়বস্তুকে দেখে সামগ্রিক এবং একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক হিসেবে।” এ হলো এক বৈপ্লবিক সক্ষমতা যা আজ আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার।

____________

ডিসেম্বর, ২০২০

পরিভাষা

বেদখলকরণ (Expropriation) -বঞ্চিতকরণ। কারও কাছ থেকে কোনও কিছুর অধিকার কেড়ে নেয়া। কোন সম্পত্তির প্রকৃত মালিককে সেই সম্পত্তির অধিকার থেকে উচ্ছেদ বা বঞ্চিত করা। রাজনৈতিক অর্থনীতির সমান্তরালে এখানে প্রকৃতিকে লুন্ঠন করা, ভারসাম্যহীন করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

বিপাকীয় ফাটল (Metabolic Rift) - শব্দটি এসেছে জার্মান “Stoffwechsel” থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ সরাসরি “বস্তুগত বিনিময়”। মানব শ্রম থেকে উদ্ভূত ‘বিপাক-ক্রিয়া’ ধারণাটি প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে গতিশীল আন্তঃপরিবর্তনের ছবি আঁকে। বস্তুগত আদান-প্রদান ও নিয়ন্ত্রক কাজের ধারণা সমেত বিপাক-ক্রিয়া’র ধারণা প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ককে অভিন্ন হিসেবে প্রকাশ করে। এই সম্পর্ক “প্রকৃতি-নির্ধারিত শর্তাবলী” ও তার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে মানব সক্ষমতা –এই উভয় দিককেই নির্দেশ করে। এই প্রক্রিয়ায় যখন ছেদ ঘটে তখন তাকে ‘বিপাকীয় ফাটল’ বলে। ‘বিপাক-ক্রিয়া’ মার্কসের কেন্দ্রীয় ধারণাগুলোর মাঝে অন্যতম শক্তিশালী ধারণা।

চলতি ভূতাত্ত্বিক যুগ (Anthropocene, অ্যান্থ্রোপোসিন) - পৃথিবীর ভূ-বৈশিষ্ট্য, বাস্তুতন্ত্র এবং জলবায়ুর ওপরে মানুষের কর্মকান্ডজাত ফলাফলের প্রভাবসমূহের সূত্রপাত নির্দেশ করার জন্য প্রস্তাবিত ভূতাত্ত্বিক যুগ। এই যুগ বর্তমান কালে প্রসারিত এবং তা সীমাবদ্ধ নয়।

পরিপোষক (Sustainable) - শব্দটি সাধারণত ‘টেকসই’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে এখানে প্রাকৃতিক শক্তি বা উপাদান ব্যবহারে এমন ধরনের কথা বলা হয়েছে যাতে প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থা ধ্বংস না হয়।


পরিচিতিঃ

জন বেলামি ফস্টারের জন্ম -১৯৫৩ সালে। আমেরিকার সিয়াটল–এ। ‘মান্থলি রিভিয়্যু’ পত্রিকার সম্পাদক এবং ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি Marx’s Ecology: Materialism and Nature, The Ecologycal Rift, The Return of Nature, The Ecologycal Revolution, The Vulnarable Planet, The Robbry of Nature, The Great Financial Crisis, The Theory of Monopoly Capitalism সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের রচয়িতা।

সাক্ষাতকার-গ্রহীতা: সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলেয়ান্দ্রো পেড্রেগাল। তিনি লেখক, চলচিত্র নির্মাতা এবং ফিনল্যান্ডের আল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক।

প্রকাশঃ ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮:::২৮শে মে, ২০২১