বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে

আলাঁ বাদিয়্যু

[সমকালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন প্রসঙ্গে ফরাসি মার্ক্সীয় দার্শনিক আলাঁ বাদিয়্যু'র On the Current Conjuncture লেখাটি গত ২১শে ডিসেম্বরে Verso ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। নয়া গণ কমিউনিজমের আভাস দেয়া একটা যুগ সন্ধিক্ষণে আমরা হাজির আছি এমন প্রস্তাবনা তুলে তিনি সমালোচনা করছেন পৃথিবীজুড়ে চলমান নানান সংগ্রামের। প্রখ্যাত দার্শনিক বাদিয়্যু'র এই লেখাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আলবার্তো তসকানো(Alberto Toscano)। তসকানো কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাদিয়্যু'র লেখাটি অনুবাদ করেছেন জাভেদ হুসেন। জাভেদ হুসেন অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। মার্ক্সের শুরুর দিককার রচনা ও মার্ক্সীয় দর্শনের বেশকিছু বইপত্র ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন। তিনি উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন মির্জা গালিব, মীর তকি মীর, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, আহমদ ফারায এবং সাদত হাসান মান্টো সহ আরও অনেকের লেখা। প্রকাশিতব্য বই: মির্জা গালিবের সাথে আরও কয়েকজন (মার্চ ২০২১, গ্রন্থিক প্রকাশন)]



বর্তমান কালের হাল-হকিকতের একটা যৌক্তিক মূল্যায়ন একেবারে দূর্লভ হয়ে উঠেছে। একদিকে আছে পরিবেশবাদের একদম অসতর্ক একটা ধর্মীয় বলয়। সেখান থেকে ভেসে আসছে যেন ধর্মোপদেশ। সেই উপদেশ বলছে যে, আমরা শেষ বিচারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। আরেকদিকে আছে দিশাহারা বামদের কল্পনাবিভোরতা। তাদের দাবি হচ্ছে—আমরা উদাহরণ দেয়ার মতো ‘সংগ্রামের’, অপ্রতিরোধ্য ‘গণ-আন্দোলনের’, সংকট-আক্রান্ত উদার পুঁজিবাদের ‘ধ্বসে পড়ার’ কালে বাস করছি। এমন একটা সময়ে যে কোন রকমের যৌক্তিকতা হাত ফসকে বের হয়ে যায়। বিরাজ করে এক রকমের মানসিক বিশৃংখলা। অ্যাক্টিভিস্ট বা পরাজয়বাদী সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজ করে। আমি এখানে কয়েকটা বিবেচনা পেশ করবো। এই বিবেচনাগুলো অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। আর এমন অবস্থায় কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে সেই বিচারও করা হয়েছে।


কয়েক বছর ধরে প্রায় পুরো পৃথিবীটা ভেসে যাচ্ছে সংগ্রামে। আরো স্পষ্ট করে বললে, গণ-সমাবেশ আর জমায়েতে। এই প্রবণতা সুনির্দিষ্টভাবে শুরু হয়েছে যাকে বলা হয় ‘আরব বসন্তের’ পর থেকে। বিষয়ীগতভাবে এই সাধারণ অবস্থাকে আমি ‘আন্দোলনবাদ’ নামে অভিহিত করার প্রস্তাব করছি। এই আন্দোলনবাদ একটা জনপ্রিয় দৃঢ় বিশ্বাস। বিশ্বাসটা এই যে, লক্ষণীয় রকমের বড় জন-সমাগম করতে পারলে নিঃসন্দেহে পরিস্থতিতে একটা পরিবর্তন আনা যাবে। এমনটাই দেখা যাচ্ছে হংকং থেকে আলজেরিয়া, ইরান থেকে ফ্রান্স, মিশর থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, মালি থেকে ব্রাজিল, ভারত থেকে পোল্যান্ডসহ পৃথিবীর আরো অনেক জায়গায়, অনেক দেশে।


এই সকল আন্দোলনের ব্যতিক্রমহীনভাবে তিনটি বৈশিষ্ট আছে বলে মনে হয়:

১. আন্দোলনগুলোর সামাজিক উৎস, তাদের বিদ্রোহের কারণ এবং তাদের স্বতস্ফূর্ত রাজনৈতিক বিশ্বাস মিশ্র। এই বহুরূপী প্রেক্ষিতটি তাদের সংখ্যাতেও স্পষ্ট হয়। এই আন্দোলন শুধু শ্রমিকের দলবদ্ধতা নয়, বা ছাত্রদের বিক্ষোভ নয়, নয় করের চাপে অতীষ্ট দোকানদারদের বিদ্রোহ। এ শুধু নারীবাদী প্রতিরোধ নয়, না এটা পরিবেশবাদী ভবিষ্যদ্বাণী। স্থানীয় বা জাতীয় বিচ্ছিন্নতা এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য নয়। যাদের অভিবাসী বলা হয়, আমি যাদের বলি যাযাবর সর্বহারা, এটা তাদের পদযাত্রাও নয়। এটা গড়ে উঠেছে এগুলোর সবগুলোরই একটু একটু নিয়ে। এর আছে একটা প্রভাব খাটানোর প্রবণতা। সেই প্রভাব খাটে নিখাদ কৌশলগত নিয়ম মেনে। সেই প্রভাবের প্রবণতা কি এক না একাধিক পক্ষের হবে তা নির্ভর করে স্থান আর অবস্থার নিরিখে।


২. এই পরিস্থিতি থেকে যা হয় তা হলো এই যে, এই আন্দোলনগুলোর ঐক্যের ধরন একেবারে নেতিবাচক। ভাবাদর্শ আর সংগঠনের বহাল যে অবস্থা তাতে এর অন্যথা হওয়ার উপায়ও নেই। বলা বাহুল্য যে, এই যে প্রত্যাখ্যান পৃথক পৃথক বাস্তবতা ধারণ করে। কেউ বিদ্রোহ করছে হংকঙে চিনা সরকারের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে, কেউবা আলজেরিয়াতে সামরিকচক্রীর ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে, কেউ ইরানে ধর্মীয় আধিপত্যের শ্বাসরোধী অবস্থার বিরুদ্ধে, কেউ হয়তো মিশরে ব্যক্তি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কারো বিদ্রোহ ক্যালিফোর্নিয়ায় জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল কৌশল আর বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, কারো বা মালিতে ফরাসি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, কেউ পথে নেমেছে ব্রাজিলের নয়া-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, কেউ আবার ভারতে মুসলমানদের ওপরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, পোল্যান্ডে বিক্ষোভ চলছে গর্ভমোচন আর অপ্রথাগত যৌন অভ্যাস নিয়ে পশ্চাদপদ গোড়ামির বিরুদ্ধে। বিক্ষোভ চলছে আরো এরকম আরো অনেক কিছুর বিরুদ্ধে। কিন্তু এর বেশি নয়। এই বিরুদ্ধতা বিশেষ করে এমন কিছু হয়ে উঠবে না যা সাধারণভাবে কোন পাল্টা প্রস্তাব ছুড়ে দিতে পারে। এই আন্দোলনগুলোতে এমন কিছু হাজির নেই। দিন শেষে, এতে গরহাজির এক সাধারণ রাজনৈতিক প্রস্তাব, যে প্রস্তাব সমকালীন পুঁজিবাদের সমস্যাগুলোর মাঝ থেকে পরিষ্কারভাবে আলাদা হয়ে বের হয়ে আসবে। এই আন্দোলন শেষমেষ একটা ব্যক্তি নামের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ঐক্যের দিকে গিয়ে এক হয়। সেই নামটা সাধারণত হয় রাষ্ট্র প্রধানের। কেউ আন্দোলনে নামে ‘মোবারক গদি ছাড়ো’ শ্লোগান দিয়ে। কেউ বা ‘ফ্যাসিস্ট বলসোনারো নিপাত যাক’ শ্লোগান দিয়ে। কেউ আশ্রয় নেয়, ‘বর্ণবাদী মোদি নিপাত যাক’, বা ‘ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ো’ শ্লোগানের। আমি তাহলে প্রস্তাব করছি যে এই সব আন্দোলন, এই সব সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে ‘গদি-ছাড়োবাদ’ (dégagismes)। এখানে চাওয়া হলো গদিতে থাকা নেতা গদি ছাড়ুক। যদিও যারা তা চাইছে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সেই জায়গায় কে আসবে! সেই ক্ষমতায় থাকা নেতা যদি আসলেও বিদায় নেয় তাহলে কোন প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, পরিস্থিতি আসলেও বদলাবে? সংক্ষেপে বললে, অস্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে একত্রিত হলে তা পরিস্থিতি বিশ্লেষণের কোন সুনিশ্চিত স্বীকৃতি দিতে পারে না। এমন একত্রিত হওয়াতে কোন সৃজনশীল প্রত্যয়, কোন সক্রিয় ধারণা থাকতে পারে না। সে না পারে নতুন ধরনের রাজনীতি কেমন হবে বা হতে পারে তা ধারণা করতে। এমন ধারণা না থাকলে সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে কিছু ঐক্যে। যথা, পুলিশী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে রুখে দাঁড়ানো। অন্যভাবে বললে, কর্তৃপক্ষ যে তাকে অস্বীকার করছে সেই অস্বীকারের অস্বীকৃতি। আটষট্টির’মে [প্যারিসের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন] থেকে আমি প্রত্যক্ষভাবে এটার সাথে পরিচিত। এই সময়ে সাধারণ স্বীকৃতির অনুপস্থিতিতে—কিংবা বলতে গেলে আন্দোলনের শুরুতে—রাস্তায় শ্লোগান হাঁকা হয়ঃ “CRS=SS!”* একসময় বিদ্রোহী নেতিবাচকতার মূখ্যতার দিন ফুরোয়। এটা অধিকতর কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়াষয় দিয়ে সেসময় নির্বিঘ্নে চালিত হয়েছে। স্বতন্ত্র স্বীকৃতির মধ্যকার বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সংঘাতের বিনিময়ে এটা সম্ভব হয়েছে।


৩. আজকে দুনিয়াজোড়া এই আন্দোলনবাদ যা অর্জন করেছে তা হলো ক্ষমতার আরো চাঙ্গা হওয়া পুনরুৎপাদন। এর মাঝ দিয়ে বহুলাংশে কিছু মেকি পরিবর্তন আসে। কিন্তু এই পরিবর্তন হয়ে যা আসে তা যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হয়েছিল তার চাইতেও খারাপ হতে পারে। মোবারক গেলেন, কিন্তু তার জায়গায় আসা আল-সিসি সামরিক ক্ষমতার আরেক সংস্করণ। হয়তো তা মোবারকের চাইতেও খারাপ। হংকঙের ওপর চিনের মুঠো আরো শক্ত হয়েছে। আগে বেইজিঙে যে আইন ছিল এলো তার চাইতে লাগসই আইন জারি হয়েছে, বন্দী হয়েছে বিপুল সংখ্যায় আন্দোলনকারী। ইরানে অল্প কয়েকজন ধর্মাধিকারীর শাসন অটুট রয়ে গেছে। মোদি বা বলসোনারোর মতো সবচেয়ে সক্রিয় প্রতিক্রিয়াশীলেরা দিব্যি আছে। আপনাদের ধন্যবাদ। আর ৪৩% সমর্থন নিয়ে ফ্রান্সে ম্যাক্রোঁ সাহেবের নির্বাচনী সুস্বাস্থ্য বহাল তবিয়তে আছে। তার এই সুদিন কেবল আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করার আগের চাইতেই যে ভালো এমন ভাবলে ভুল হবে। ম্যাক্রোঁ এখন তাঁর পূর্বসূরী প্রতিক্রিয়াশীল [নিকোলা] সারকোজি বা সমাজতন্ত্রী [ফ্রাসোয়া] ওলাদের চাইতে ভাল অবস্থায় আছেন। ম্যাক্রোঁ যতদিন ক্ষমতায় আছেন, সেই মেয়াদে ওলাদের জনসমর্থন ছিল মাত্র ২০%।


এখানে একটা ঐতিহাসিক তুলনা মাথায় এলো। ১৮৪৭ ও ১৮৫০ সালের মাঝে ইউরোপের বিশাল অংশ জুড়ে চলছিল শ্রমিক এবং ছাত্রদের বিশাল আন্দোলন, বিশাল গণ জাগরণ। এই সব চলছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই ব্যবস্থা ১৮১৫ সালে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তা ধূর্ততার সঙ্গে সুসংহত করা হয়েছিল ১৮৩০ এর ফরাসি বিপ্লবের পর। নিছক অস্বীকৃতি পার হয়ে ভিন্ন রাজনীতিকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন কোন দৃঢ় ভাব গরহাজির থাকায় ১৮৪৮ এর বিপ্লবের সকল উগ্রতা এক নতুন নিপীড়নকারী অবতারণা করায় কাজে লাগলো। ফরাসিদের হিসাবের খাতায় জমা পড়লো উদীয়মান পুঁজিবাদের প্রতিরূপি প্রতিনিধি তৃতীয় নেপোলিয়নের অন্তহীন রাজত্ব।


তবে জার্মান অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া মার্কস এবং এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এই সকল ঘটনাবলী থেকে কী শিক্ষা নেয়ার আছে তা বের করে আনেন। এই কাজটা তাঁরা করেন দুইভাবে। একদিকে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের টেক্সট আকারে, যেমন ফ্রান্সে শ্রেণিসংগ্রাম নামের পুস্তিকাতে। আরেকদিকে, সেই চূড়ান্ত স্বীকৃতিমূলক(affirmative) হ্যান্ডবুক যাতে কিছুটা চিরকালীন আমেজে বর্ণনা করা আছে যে, এক সম্পূর্ণ নতুন রাজনীতি কেমন হতে হবে। এই বইয়ের নাম কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। এই স্বীকৃতিমূলক গঠনকে ঘিরেই শেষ পর্যন্ত অন্য আরেক রাজনীতির ইতিহাস গড়ে ওঠে। এই স্বীকৃতি ধারণ করে আছে এমন এক পার্টির ‘ইশতেহার’ যার তখনো অস্তিত্ত্বই গড়ে ওঠেনি। এর তেইশ বছর পর আরেকবার এমন এক কাজ করবেন মার্কস। এবারে তিনি এক সমীহ জাগানো প্রয়াসের মাঝ থেকে কী শিক্ষা নেয়া যায় তা বের করে আনবেন। সেই প্রয়াস আত্মরক্ষার দিক দিয়ে বীরত্বমূলক, কিন্তু এর মাঝেও ছিল সেই স্বীকৃতিমূলক ঐক্যের কার্যকর সংগঠনের অভাব। এই প্রয়াসের নাম প্যারি(স) কমিউন।


বলা বাহুল্য যে আমাদের পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন! আজকের এই আন্দোলনবাদের শ্লোগানগুলো নেতিবাচক, এর ক্রিয়াগুলো রক্ষ্মণাত্মক। কিন্তু এগুলোকে একটি পরিষ্কার এবং সমন্বয়ী দর্শনের মাঝে নিয়ে আসা প্রয়োজন। আর আমি নিশ্চিত তা অর্জন করতে হলে আমাদের একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে। মার্কস এই ব্যাপারটাকে বলেছিলেন তাঁর চিন্তার মর্মস্থল। এই মর্মস্থল অবশ্যই নিজে নেতিবাচক। কিন্তু এই নেতিবাচকতা এমন মাপের যাকে কেবল এক সুবিশাল ইতিবাচকতা দিয়েই সমর্থন দেয়া যায়। আমি বলছি ‘ব্যক্তি সম্পত্তির বিলোপ’ এই শ্লোগানের কথা।


যদি একটু ভাল করে তাকাই তাহলে দেখব যে ‘আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করো’ বা ‘পুলিশের সহিংসতা বন্ধ করো’—এরকম শ্লোগানগুলো একটু কঠোর করে বললে রক্ষণশীল বলতে হয়। প্রথম শ্লোগান বোঝাচ্ছে যে স্থিতাবস্থায় আমরা আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা উপভোগ করি যাকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। অথচ তার বদলে আমাদের কেন্দ্রীয় সমস্যাটা হওয়া উচিত এই যে, সমতা ছাড়া স্বাধীনতা এক প্রলোভন ছাড়া কিছু নয়। বৈধ কাগজপত্র বঞ্চিত যাযাবর সর্বহারা—যাদের আগমন এক নির্মম মহাকাব্য ছাড়া আর কিছু নয়—তারা কী করে কোটিপতিদের মত নিজেকে ‘স্বাধীন’ বলবে? বাস্তবে তো কোটিপতিরা বাস্তব ক্ষমতার ধারক, তারাই তো প্রাইভেট জেট বিমান আর এর পাইলটের মালিক, তাদেরকে রক্ষা করে রাষ্ট্রের মধ্যে তাদের হয়ে কাজ করা নির্বাচনী প্রলোভন। কোন সুসংহত বিপ্লবী যদি সত্যবাদী হয়, যদি তাদের আকাঙ্ক্ষা যৌক্তিক হয় তবে এমন এক পৃথিবী তাদের পক্ষে কেমন করে কল্পনা করা সম্ভব যেখানে ক্ষমতাশীলদের পুলিশ বন্ধুত্বপূর্ণ, বিনয়ী ও শান্তিপূর্ণ হতে পারে?


তাহলে মূল প্রশ্নের ভরকেন্দ্রে ফিরে যাওয়াই ভালো। সেই প্রশ্ন হচ্ছে: সম্পত্তি। প্রত্যক্ষ আর সদর্থক সেই ঐক্যবিধানকারী শ্লোগান হবে: উৎপাদনের সমগ্র প্রক্রিয়ার যৌথায়ন। এই শ্লোগানের অন্তবর্তী দাবি হতে পারে “১৯৮৬-এর পর থেকে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত সকল বেসরকারীকরণের বিলোপ”। যারা নেতিকরণের বাসনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন তাদের হাতে কিছু কাজ তুলে দেয়ার জন্য ভালো আর নিখাদ কৌশলগত শ্লোগান হতে পারে: চলো, আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক বিভাগ দখল করি, যার নাম- অংশগ্রহণ কমিশন। আর তা করি এই কথাটা ভালভাবে বুঝে যে এই রহস্যময় নাম আসলে ১৯৮৬ সালে তৈরি করা বেসরকারীকরণ কমিশনের এক মুখোশ ছাড়া আর কিছু নয়। আর এটা সবাই জানুক যে, আমরা এই বেসরকারীকরণ কমিশন দখল করে রাখবো যতক্ষণ না প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাধারণ কল্যাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল ধরনের ব্যক্তি সম্পত্তি বিলোপ হয়ে না যায়।


বিশ্বাস করুন, স্বল্প আর দীর্ঘমেয়াদি দুই রকমের এই লক্ষ্য জনপ্রিয় করার মাধ্যমে আমরা নতুন এক যুগের সূচনা করতে পারবো। এতক্ষণ যা নিয়ে কথা বললাম, সেই সব ‘সংগ্রাম’, এবং ‘আন্দোলন’ এবং ‘প্রতিবাদে’র নেতিবাচক দ্বান্দিকতা নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। সেই সাথে নিঃশেষ করছে আমাদের। এসব পার হয়ে আমরা হয়ে উঠতে পারব এক নতুন গণ কমিউনিজমের অগ্রদূত। মার্কসের মত করে বললে যার ‘ভূত’ আরও একবার শুধু ফ্রান্স বা ইউরোপ নয়, তাবৎ দুনিয়াকে তাড়িয়ে বেড়াবে।


___________

২১শে ডিসেম্বর, ২০২০


* Compagnies républicaines de sécurité (সংক্ষেপে CRS) হচ্ছে জনতা ও দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণকারী ফরাসি জাতীয় পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স। আর The Schutzstaffel (সংক্ষেপে SS) হচ্ছে নাৎসি জার্মানিতে হিটলার ও নাৎসি পার্টির অধীনস্ত অন্যতম প্রধান আধা-সামরিক সংগঠন।


প্রকাশঃ ১৭ই ফাল্গুন, ১৪২৭:::২রা মার্চ, ২০২১