বাবরি মসজিদের নিচে কি একটি মন্দির ছিল?— প্রত্নতাত্ত্বিক “প্রমাণ” পাঠ

সুপ্রীয়া ভার্মা ও জয়া মেনন



[১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাপ্রবাহ তৈরী হয় রাষ্ট্র হিসবে আলাদা হলেও নানাবিধ কারণে বাংলাদেশেও এ প্রপঞ্চ প্রভাব বিস্তার করে। ইতোমধ্যে বাবরি মসজিদ বিতর্কে আদালত তার চূড়ান্ত রায়ও জানিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনাটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই জন্যেও যে বাবরি মসজিদকে সামনে রেখে সৃষ্ট দাঙ্গার ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনেকেই নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। আবার এই বিতর্কে শাস্ত্র(discipline) হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব একটি বড় ভূমিকা রাখে ও জনপরিসরে প্রত্নতত্ত্বকে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করে। এই মামলায় প্রত্নতত্ত্বের যে ভূমিকা তার সম্বন্ধে বোঝাপড়ার জন্য সুপ্রিয়া ভার্মা ও জয়া মেননের এই লেখাটি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। তবে ব্যাপারটা এখন পূর্বের পরিস্থিতির তুলনায় অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে। এমতবস্থায় শাস্ত্র হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব কিভাবে এই মামলায় যুক্ত হয়ে পড়ল এবং ঘটনাপ্রবাহে কি ভূমিকা রাখলো তার যাচাই বাচাইয়ের উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই সুপ্রীয়া ভার্মা ও জয়া মেননের Was There a Temple under the Babri Masjid? Reading the Archaeological 'Evidence' লেখাটি অনুবাদ করা হয়েছে। Economic and Political Weekly- এর ৪৫ তম ভলিয়্যুমে লেখাটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। সুপ্রীয়া ভার্মা নয়া দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অধ্যয়ন কেন্দ্র এবং জয়া মেনন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে আছেন। লেখাটি অনুবাদ করেছে কাব্য কৃত্তিকা। কাব্য কৃত্তিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।]


বিঃদ্রঃ এই লেখাটি কেবল বিদ্যায়তনিক কাজের প্রয়োজনে অনুবাদ করা হয়েছে। কোন প্রকার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়।







১৯৬১ সালে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলাটি প্রাথমিকভাবে একটি মালিকানা বা স্বত্ত্ব-মামলা (title suit) হিসেবে শুরু হয়। এক্ষেত্রে মুসলিম সংগঠনগুলি দাবি করে বাবরি মসজিদ যেটা ১৫২৮ সাল থেকে অস্তিত্বশীল সেটার উপরে কেবল তাঁদেরই অধিকার আছে। প্রাথমিকভাবে স্বত্ত্ব-মামলা হিসেবে শুরু হলেও ১৯৮৯ সালে এটার পরিসর আরো বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এই বছরেই আরেকটি নতুন বিষয় দাঁড় করানো হয় যে, বাবরি মসজিদ একটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তার উপরে নির্মিত হয়েছে কি-না। এ কারণেই ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের মত শাস্ত্রকে এই আইনি মামলার পরিসরে নিয়ে আসা হয়।


বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্বকে যেভাবে বোঝা এবং ব্যবহার করা হয়েছে এই লেখায় আমরা সেদিকে আলোকপাত করব। জনপরিসরে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, প্রত্নতত্ত্ব একটি “সঠিক বিজ্ঞান” এবং আমাদের অতীত সম্পর্কে যে সকল কিছু জানা প্রয়োজন তা সহজেই খোঁড়াখুড়ির মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব। যাইহোক, একটি খননে যা উদ্ধার করা যেতে পারে তা হলঃ দেয়াল বা মেঝের আংশিক অবশেষ, প্রত্ননিদর্শন, সিরামিকস, হাড়, বীজ এবং অন্যান্য নিদর্শন। দেয়ালের অভ্যন্তরে বা মেঝের নিচে প্রত্নতাত্ত্বিক যা খুঁজে পায়(প্রত্নবস্তু, সিরামিকস/ জৈব নিদর্শন), তার উপরে ভিত্তি করে অতীতের দালানকোঠা, কার্যকলাপ বা ঘটনাবলী সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। উদ্ধারকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি ভগ্নাংশে প্রাপ্তির কারণেই প্রায়শ এটাই বোঝায় যে খন্ডিত উপাত্ত নিজে থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেয় না। এই কারণেই খনন চলাকালীন সময়ে, খননকৃত সঞ্চয়নের ধরন/ প্রকৃতিসহ প্রতিটি উপাত্তের পুনরুদ্ধার ও নথিবদ্ধকরণ করার ক্ষেত্রে খুবই যত্নশীল হতে হবে। এজন্যই যত উপাত্ত পাওয়া যায় তার সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ খুবই জরুরী। অথচ আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি যে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাঁদের পূর্বানুমানের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে এবং নির্দিষ্ট বর্গের প্রত্নবস্তুর ওপর দাড়িয়ে তাঁদের ভাষ্য নির্মাণ করেন।


যেহেতু এই মামলার মুসলিমপক্ষ শাস্ত্র হিসেবে প্রত্নতত্ত্বের সাথে পরিচিত নয়, তাই তাঁদের দাবি ছিল যে পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিকরা খননটি পর্যবেক্ষণ করবে। উপরন্তু, তাঁদের মতে খননের দায়িত্ব যারা পেয়েছিল অর্থাৎ ASI (Archaeological Survey Of India) তা মূলত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। ASI সরাসরি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে যা ঐ সময়ে NDA কেন্দ্র সরকারের অধীনে ছিল। এরকম খুব কম সংখ্যক প্রত্নতাত্ত্বিকই ছিলেন যাদের ASI-এর সাথে বৈরী সম্পর্ক তৈরীর অভিপ্রায় ছিল। যখন খনন শুরু হল, প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে, আমরা খুবই আগ্রহী ছিলাম এটা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে যে বাবরি মসজিদের নিচে আসলেই কি আছে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের(Sunni Central Board of Waqfs) কাউন্সিল আমাদের সাথে সেসময়ে এই বিষয়ে যোগাযোগ করে। আমরা এই মামলার সাথে সরাসরি যুক্ত হলাম যখন এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের লখনৌ বেঞ্চ ২০০৩ সালে অযোধ্যা সাইটে খনন করার নির্দেশ দিল। ২০০৩ সালের মার্চ-আগস্ট সময়ের মধ্যে যখন খনন কাজ চলছিল তখন আমরা একটা দীর্ঘসময়(১) সেখানে উপস্থিত ছিলাম।


এই প্রবন্ধে, আমরা আলোচনা করব কিভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক “প্রমাণ”, ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে, এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের বিশেষ বেঞ্চের রায়ে ব্যবহৃত হয়েছে।(২) এইজন্য অযোধ্যার প্রত্নস্থানটির প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাস জানা প্রয়োজন। আমরা আরো বর্ণনা করব, খননে উপস্থিত থাকাকালীন সময়ে আমাদের পর্যবেক্ষণসমূহ, ASI-এর অনুসরণকৃত কার্যপদ্ধতি বিষয়ে আমাদের দায়ের করা আপত্তিসমূহ এবং ASI-এর দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে আপত্তিসমূহ। আরো উল্লেখ করব, বিচার প্রক্রিয়া আমাদের আপত্তিগুলোকে কিভাবে আমলে নিয়েছে। আমাদের আরো বোঝা প্রয়োজন ASI এই প্রতিবেদনে কিভাবে ব্যাখ্যাসমূহ তৈরী করেছে, একই সাথে ১৯৭০ সালে ডিরেক্টর জেনারেল বি. বি. লাল-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই বিষয়ে ASI-এর কাজের যোগসূত্রতা আমলে নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সবশেষে, যেটাতে জোর দেওয়া জরুরী তা হচ্ছে ASI যে ধরনের প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করেছে তাতে নানান ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যার মূল কারণ এটি একটি আমলাতান্ত্রিক সংগঠন।


অযোধ্যা বিতর্কের ইতিহাস


বাবরি মসজিদ দাড়িয়ে রয়েছে যেই স্থানে তাকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয় ১৮৫৭ সাল থেকে । বিতর্ক শুরু হয় যখন হনুমানগিরির বৈষ্ণব বৈরাগীদের একটি কেন্দ্রের মহন্ত(প্রধান পুরোহিত) মসজিদের পূর্বাংশের আঙিনা দখল করে দক্ষিণ-পূর্বাংশের দিকে রাম চবুত্র (একটি ভিত্তি স্তম্ভ যাকে রামের জন্মস্থান বলা হয়) নির্মাণ করে। সেই একই বছরে বাবরি মসজিদের মুয়াজ্জিন মৌলভী মুহাম্মদ আসগর মসজিদের আঙিনা জোরপূর্বক দখল করার অভিযোগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পিটিশন দাখিল করে। বৃটিশ সরকার এখানে ১৮৫৯ সালে হিন্দু ও মুসলিমদের প্রার্থনার জায়গা আলাদা করার নিমিত্তে একটি দেয়াল নির্মাণ করে। তখন হিন্দুরা পূর্ব দিকের ও মুসলিমরা উত্তর দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করত। একই ধরনের পিটিশন মুসলিমদের দ্বারা পেশ করা হয়েছিল ১৮৬০, ১৮৭৭, ১৮৮৩ এবং ১৮৮৪ সালে ; কিন্তু প্রত্যেকটি অভিযোগই প্রত্যাখ্যান করা হয়। সর্বশেষ ১৮৮৫ সালে, মহন্ত রঘুবর দাস এই জমির আইনি মালিকানা এবং চবুত্র-য় একটি মন্দির নির্মাণের অনুমতি লাভের লক্ষ্যে একটি মামলা দাখিল করে। এই মামলার বিশেষত্বের দিক ছিল (ক) মহন্ত রঘুবর অযোধ্যার জন্মস্থানের মহন্ত হিসেবে নিজেকে দাবী করে, (খ) জন্মস্থানকে চবুত্র হিসেবে দাবী করা হয় এবং (গ) মসজিদের স্থানে আসলেই কোনো মন্দির ছিল তা দাবী করা হয়নি। ১৮৮৬ সালে মামলা এবং আপিল খারিজ হয়ে যায়।


১৮৭০ এবং ১৯২৩ সালের মধ্যে, বেশ কিছু দাপ্তরিক প্রকাশনায় যেমন- ভৌগলিক অভিধানসমূহে নথিবদ্ধ করা শুরু হল যে অযোধ্যায় অন্তত তিনটি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে এবং সেই স্থানে মসজিদ নির্মিত হয়েছে—যার মধ্যে একটি হচ্ছে বাবরি মসজিদ। মসজিদের মূল প্রবেশদ্বারে পাথরে খোদিত করে “এক নম্বর রাম জন্মভূমি” লেখার মধ্য দিয়ে এই অফিসিয়াল দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুমোদিত করা হয়। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে অখিল ভারতীয় রামায়ণ মহাসভা’র উদ্যোগে তুলসি দাসের রামচরিতমানস আবৃত্তির আয়োজন করা হয় এবং বছরের শেষে ২২-২৩ ডিসেম্বরের রাতে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদকে বিতর্কিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একটি নির্দেশনা জারি করা হয় যার দ্বারা মুসলমানদের মসজিদে প্রবেশ করাও এমনকি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে, হিন্দুরা পাশ দরজা দিয়ে মূর্তির “দর্শন” (ভক্তিমূলক দেখা দেওয়া) করার অনুমতি লাভ করে। চার জন পূজারী(পুরোহিত) নিয়োগ লাভ করে এবং তাঁদের মূর্তির কাছে যাবার পূর্ণ অনুমতি ছিল।


গোপাল সিং বিশারদ (হিন্দু মহাসভার একজন সদস্য) কোনো ধরনের বাধা ছাড়া উপাসনা করা এবং মূর্তিগুলোর অপসারণের বিরুদ্ধে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করার আর্জি নিয়ে ১৯৫০ সালের ১৬ই জানুয়ারিতে একটি দেওয়ানি মামলা দাখিল করে। ১৯৫৯ সালে নির্মোহী আখড়া (একটি গোষ্ঠী) একটি মামলা দাখিল করে সম্পূর্ণ মসজিদ তাদের কাছে হস্তান্তর করবার জন্য, যেহেতু এটা কখনোই একটা মসজিদ ছিল না, বরং মন্দির ছিল। ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বরে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড (Sunni Central Board of Waqfs) একটি মামলা দায়ের করে বাবরি মসজিদ তাঁদের কাছে হস্তান্তর করার দাবী নিয়ে। ১৯৮৪ সালের ৭-৮ এপ্রিল দিল্লীর একটি অধিবেশনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP) অযোধ্যা, মথুরা ও কাশীর মসজিদসমূহের অপসারণের ডাক দেয়, তবে প্রথমে অযোধ্যার মসজিদ অপসারণ করতে হবে (বিস্তারিত জানতে দেখুন, পানিক্কারঃ ১৯৯১)। ১৯৮৬ সালে, বাবরি মসজিদের তালা খোলা হয় এবং ১৯৮৭ সালে ফয়েজবাদ থেকে মামলাগুলো তুলে নেওয়া হয় এবং এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের লখনৌ বেঞ্চে স্থানান্তর করা হয়। বিশারদের দাখিল করা মামলাটি মামলা-১ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। অন্য একটি মামলা (মামলা-২) যা পরমহংস রামচন্দ্র দাস দায়ের করেন এবং পরবর্তীতে তা খারিজ হয়ে যায়। মামলা-৩ দাখিল করা হয় নির্মোহি আখড়ার হয়ে এবং মামলা-৪ দাখিল করে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। ১৯৮৯ সালে রামা লাল্লা নামে পরিচিত পঞ্চম মামলাটি দাখিল করেন দেওকি নন্দন আগারওয়াল, যিনি এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারক এবং VHP-এর সহ-সভাপতি। এই মামলাটি তিনি দাখিল করেন রামা লাল্লা’র সখা (“not friend”, a representative in law) হিসেবে। তাঁর মৃত্যুর পর টি. পি. ভার্মা সখা হন। যখন টি. পি. ভার্মা অসুস্থ হয়ে পড়েন, ত্রিলোকি নাথ পাণ্ডে যিনি একজন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS)-এর প্রচারক সখা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বর্তমানে তিনি কারসেওয়াকপুরামে বসবাস করেন। ভারতীয় জনতা পার্টির রবি শঙ্কর প্রসাদ মামলা-৫ এর সিনিয়র কাউন্সেলর ছিলেন।


অযোধ্যার প্রত্নতত্ত্বঃ ঐতিহাসিক পটভূমি


ASI-এর প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবার কিছুদিনের মধ্যেই ১৮৬২-৬৩ সালে আলেক্সান্ডার কানিংহাম অযোধ্যায় জরিপ পরিচালনা করেন। তাঁর প্রাথমিক আগ্রহের বিষয় ছিল হিউয়েন সাং এবং ফা হিয়েনের বর্ণনাতে ঐতিহাসিক বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলোর যে অবস্থান নির্দেশ করা আছে সেগুলো শনাক্ত করা। অযোধ্যার ক্ষেত্রেও তিনি এই কাজটিই করেছিল। তিনটি ঢিবিকে (মনি পর্বত, কুবের পর্বত ও সুগ্রীব পর্বত) তিনি বিশাল অ্যান্টিক্যুইটির সম্ভার হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং পর্যায়ক্রমে তাদের দুইটিকে স্তূপ হিসেবে শনাক্ত করেন — যার প্রথমটি অশোকের এবং দ্বিতীয়টিকে বুদ্ধের চুল ও নখ সম্বলিত স্তূপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তৃতীয়টিকে মঠ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। তিনি একইসাথে রামায়ণের গল্পের সাথে জড়িত স্থান ও কথ্য-ঐতিহ্য নথিবদ্ধ করেন যার মধ্যে জন্ম আস্তানা বা রামের জন্মস্থানের মন্দির রয়েছে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, কানিংহাম (১৮৭১ঃ ৩২১) লিখেছেন, “এখানে কোন উঁচু ঢিবির ধ্বংসাবশেষ(ভাঙ্গা মূর্তি এবং ভাস্কর্য খোদিত স্তম্ভ দ্বারা আবৃত) নেই যে সেটার মাধ্যমে অন্যান্য প্রাচীন শহরের মতন এটিকে চিহ্নিত করা যায়। তবে শুধুমাত্র একটা অনিয়মিত আবর্জনার স্তূপের সঞ্চয়ন এখানে রয়েছে যা থেকে ইট খুলে নিয়ে গিয়ে ফয়েজাবাদ শহরের সকল পাড়ার বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে।’’ তিনি বেশ কিছু ব্রাহ্মণ্য মন্দিরের কথা নির্দেশ করেন। তবে উল্লেখ করেন যে এগুলোর সবই আধুনিক নির্মাণ এবং সম্ভবত মুসলিমদের দ্বারা ধ্বংসকৃত পুরনো মন্দিরগুলোর উপরেই এগুলো তৈরি করা হয়েছে। লক্ষ করবার বিষয় এই যে যদিও তিনি জন্ম-আস্তানা মন্দিরের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন, বাবরি মসজিদের সাথে এটির কোনো যোগসূত্রতা ছিলনা; বাবরি মসজিদের কোনো উল্লেখ তিনি আদৌ করেন নি। অন্যভাবে বললে, তিনি রামের সাথে সংযুক্ত বেশকিছু ঐতিহ্য(Traditions) নথিবদ্ধ করার সময়েও বাবরি মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের উপর নির্মিত—এমনটি কোথাও উল্লেখ করেন নি।


এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে, বারানসীর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের(BHU) একটি দল (যেখানে এ. কে. নারাইন, টি. এন. রায় এবং পি. সিং অন্তর্ভুক্ত ছিলেন) অযোধ্যার খননকার্য পরিচালনা করেন, যাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল অযোধ্যা প্রত্নস্থানটির পেশাগত ইতিহাস (occupational history) বোঝা (IAR ১৯৬৯-৭০; পৃঃ ৪০-৪১)। জৈন ঘাট, লক্ষ্মণ টেকরি এবং নলটিলায় তিনটি খসড়া খনন করা হয়; যেখানে ৩টি সাংস্কৃতিক পর্যায়(cultural period) পাওয়া যায়, যার প্রথম ২টির ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায় এবং তৃতীয়টিতে কিছুদূর গিয়ে বিচ্যুতি লক্ষ্য করা হয়। কেবল সবচাইতে প্রাচীন পর্যায় ব্যতীত অন্য কোন পর্যায়ের কোনো কালানুক্রমিক বর্ণনা বা সাংস্কৃতিক নিদর্শনের উল্লেখ করা হয়নি। প্রাচীনতম পর্যায়ের ক্ষেত্রে উত্তরদেশীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র(NBPW) এবং তার সাথে জড়িত ধূসর ও লাল মৃৎপাত্র এবং আরও কিছু প্রত্নবস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁরা কানিংহামের উল্লেখ করা কুবের টিলারও জরিপ করে এবং একটি বৃহৎ ইটের স্থাপনা উন্মুক্ত করে। কিন্তু কোনো তথ্য তাঁরা প্রকাশ করে নি।


১৯৭২ সালে বি. বি. লাল ASI -এর ডিজি’র পদ ছেড়ে দেবার পরে যখন গোয়ালিয়রের জিওয়াজি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন, তখন তিনি একটি জাতীয় প্রকল্প হাতে নেন। এই প্রকল্প 'রামায়ণ প্রত্নস্থানের প্রত্নতত্ব' হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের জোট-মন্ত্রী এস. নুরুল হাসানের মাধ্যমে অযোধ্যায় এই প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। এর কিছুদিন পরেই সিমলা শহরের Indian Institute of advanced studies তে যোগ দেন বি. বি. লাল। সেই প্রকল্পটি ১৯৭৭ সালে পুনরায় চালু হয়। প্রকল্পটির সহ-পৃষ্ঠপোষকতা করে সিমলার এই প্রতিষ্ঠান এবং ASI। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানটি অর্থাৎ ASI, প্রকল্পে কারিগরী সহায়তা ও অর্থের যোগান দেয়। ১৯৮৬ সালে প্রকল্পটির সমাপ্তি ঘটে। অযোধ্যা ব্যতীত লাল সৃংগভারপুর, ভরদ্বাজ আশ্রম, নন্দীগ্রাম এবং চিত্রকূটে খনন করেন(লাল, ২০০২ঃ পৃ ৪২)। যদিও এই প্রকল্পটি শেষ হওয়ার চব্বিশ বছর হয়ে গেছে, তবুও আজ অবধি সৃংগভারপুরের একটি কূয়া ব্যতীত আর কোনোকিছুর কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। অযোধ্যার খনন বিষয়ে কেবল একটি তথ্য আমরা পাই IAR এর ১৯৭৬-৭৭ এবং ১৯৭৯-৮০ সালের সাময়িকী থেকে। BHU দলের খননের মতো না করে, লাল রামজন্মভূমি ঢিবিতে এবং হনুমানগিরির পশ্চিম দিকের উন্মুক্ত অঞ্চলে মনোযোগ দেন, এরমধ্যে সীতা-কি-রাসই'য়ে আরও কিছু ট্রেঞ্চ ছিল। তিনি এখানে সপ্তম খীষ্ট্রপূর্ব থেকে তৃতীয় খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের কার্যকলাপের চিহ্ন খুঁজে পান। তিনি আরও সনাক্ত করেন যে, এই প্রত্নস্থানে গুপ্তযুগ(৪র্থ খ্রিষ্টাব্দ-৬ষ্ঠ খ্রীষ্টাব্দের শুরুর সময়কাল) ভালোভাবে প্রকাশিত হয়নি এবং আদি ঐতিহাসিক পর্যায়ের(খীষ্ট্রপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক - ৬ষ্ঠ খ্রীষ্টাব্দ) পর থেকে "এখানে কার্যকলাপে ছেদ রয়েছে [১১ শতকের দিকে প্রত্নস্থানটি পুনরায় কার্যক্ষম হবার আগের বিবেচনাযোগ্য কিছু অবশেষ(Debris) এবং PH formation সহ]”। পরবর্তী মধ্যযুগের কতিপয় ইট-ও-কঙ্করের চুন-সুড়কির মেঝে এটির সাথে মিশে রয়েছে। কিন্তু পুরো শেষের পর্যায়কে কোন বিশেষ গুরুত্বই দেয়া হয় নি"(IAR,১৯৭৬-৭৭; পৃ ৫৩)। ১৯৭৯-৮০ সালের IAR এর প্রতিবেদনে অযোধ্যার মধ্যযুগের সঞ্চয়ন(deposit) নিয়ে কোন বিশেষ উল্লেখ নেই (৭৬-৭৭)।


বি. বি. লাল ১৯৯০ সালের অক্টোবরে আরএসএসের ম্যাগাজিন মন্থনের জন্য একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে, তিনি অযোধ্যায় ১৯৭৫ এবং ১৯৮০ সালে তাঁর পরিচালিত খননের একটি আলোকচিত্র প্রকাশ করেন। এই আলোকচিত্রে বেশ কিছু ইটের কুঁচির হিপস দেখা যায়, যেটাকে তিনি বাবর কর্তৃক ধ্বংসকৃত মন্দিরের পিলারের ভিত্তিমূল হিসেবে দাবি করেন। এই পিলার বেইজগুলোকে মন্দিরের অস্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে দাবি করা হয়ে থাকে। এটা বিষ্ময়কর, এ কারণে যে, এই তথ্য কোন প্রত্নতাত্ত্বিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। বরং একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।(৩) ১৯৯৮ সালের ৩-৭ই মে, ক্রোয়েশিয়ায় আয়োজিত বিশ্ব প্রত্নতাত্বিক আন্তঃকংগ্রেসে পঠিত একটি প্রবন্ধে তিনি(লাল, ১৯৯৮) উল্লেখ করেন যে, ১৯৯০ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারীতে বিজয়ওয়াড়ায় একটি লেকচারে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর খননকৃত পিলার বেইজের সাথে বাবরি মসজিদ তৈরীতে ব্যবহৃত পাথরের পিলারের সম্পর্ক নির্ধারণ করার একমাত্র উপায় এবং একইসাথে বাবরি মসজিদের নিচে কোন মন্দির রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হল মসজিদের নিচে খনন করা। ১৯৯১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারিতে তাঁর এই মন্তব্য হিন্দুস্থান টাইমসে প্রচার করা হয়। তাঁর এই বক্তব্য যখন সমালোচিত হয় তিনি দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকায় এর জবাব দেন। এই জবানিতে তিনি খনন করার প্রয়োজনীয়তার কথা পুনরুল্লেখ করেন। প্রাক্তন ASI-এর ডিজি'র খনন করার এই আহ্বানের কার্যে-প্রয়োগ এবং পরিণতিকে এড়ানো সম্ভব হয় না। আদালতের নির্দেশনায় তাঁরই একদা সেবা করা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ASI তাঁর এই কাজ সম্পন্ন করে । একভাবে বলতে গেলে ASI তার খননকার্যে কোন চূড়ান্ত ব্যাখ্যায় গিয়ে পৌছাবে তা অনেক বেশি সুনির্ধারিত হয়েই ছিল।


অযোধ্যার খননকার্যঃ ২০০৩ সাল


উচ্চ আদালতের নির্দেশে, ২০০২ সালের ১লা আগষ্টে অযোধ্যায় পরিচালিত অতিসাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের শুরু হয়। এই নির্দেশে উচ্চ আদালত ASI-কে ডেকে পাঠায় এই প্রত্নস্থান খনন করার জন্য। কিন্তু তখনও বিভিন্ন পার্টি থেকে বিরোধের কথা শোনা যায়। বাবরি মসজিদ একদা যেখানে অবস্থান করেছিল সেখানে একটি Ground penetrating Survey (GPR) করা হয়েছিল। GPR জরিপটির কাজ ASI অর্পণ করে Tojo-vikash international এর কাছে। ৩০শে ডিসেম্বর, ২০০২ থেকে ১৭ই জানুয়ারী, ২০০৩ পর্যন্ত এরা জরিপ কাজ চালায় এবং ASI 'র ডিজি'র কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয় যে, "এই GPR জরিপ বিভিন্ন ধরনের ব্যত্যয়(anomalies)(৪) প্রকাশ করে, যার পরিধি ০.৫ থেকে ৫.৫ মিটার গভীর এবং একে প্রাচীন এবং সমসাময়িক স্থাপনা যেমন পিলার, ভিত্তি দেয়াল, মেঝে ফলকের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা যেতে পারে। যাইহোক, এ সকল ব্যত্যয়ের আসল প্রকৃতি নিশ্চিত করতে হলে পদ্ধতিগত Ground Truthing যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক ট্রেঞ্চিং করতে হবে"(রবিলার্ড ও অন্যান্য, ২০০৩ঃ ৩১)। এরূপ একটা GPR প্রতিবেদনের সারকথা হলোঃ মাটির নিচে দেয়াল ও মেঝে থাকতে পারে তা আদতে — একটি ১০ মিটার উঁচু ঢিবির নিচে আসলে এমন স্থাপনা থাকতে বাধ্য—এই অবশ্যম্ভাবী কথাটিই বলে। আবার GPR জরিপের ক্ষেত্রে এটা কোন স্বাভাবিক ব্যাপার না যে তা মাটির নিচে থাকা স্থাপনার নির্দিষ্ট চিহ্নায়ন(label) করবে। শুধুমাত্র এইটুকু উল্লেখ করলে আরও বেশি যথাযথ হত যে, এখানে বিভিন্ন গভীরতার ব্যত্যয়ের মাত্রা বিভিন্ন রকম।


তৃতীয়ত, GPR রিপোর্টে ভূ-অভ্যন্তরে পিলারের উল্লেখ রয়েছে কিন্তু খননে কোন পিলার পাওয়া যায়নি। বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষে ২টি পিলার পাওয়া যায়(মাঝি ও মনি, ২০০৩ঃ ১৪০, ১৪৮)। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে করসেবকদের দ্বারা যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়, তখন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ জড়ো করা হয় এবং ডাঁই করা হয়—সেটার উপর রামলাল্লার দেবতার অস্থায়ী মন্দির উঠে এসেছিল। অন্তত তিনদিন সেখানে(অযোধ্যা) আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছিল; কেউই আসলে জানে না ঠিক কিভাবে মন্দিরটি উঠে এসেছিল এবং ধ্বংসযজ্ঞের পরে ঐ স্থানে আসলে কি প্রকাশিত হয়েছিল। এটা পুনরুত্থাপন করা আবশ্যিক যে ভূমির উপরিতলে যেবস্তু বিছিয়ে ছিল, তাকে কোনভাবেই যথার্থ প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে আমলে নেওয়া যায় না। কারণ, এটি ঐ সময়ে যেকোন জায়গা থেকে নিয়ে আসা সম্ভব। চতুর্থত, এমনকি একজন অপেশাদার ব্যক্তিও GPR রিপোর্টের পরিশিষ্টতে প্রদত্ত Geophysical (ভূ-তাত্ত্বিক) ভাষ্যের মানচিত্র দেখে খুঁজে বের করতে পারবে যে এর সাথে ASI-এর হাজির করা অনুমিত পিলার বেইজের কোন Alignments প্রতিফলিত করে না।


পঞ্চমত, GPR জরিপে উল্লেখ থাকা ব্যত্যয়সমূহের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে গিয়ে ASI নথিবব্ধ করে যে, "১৮৪টি ব্যত্যয়ের(Anomalies) মধ্যে ৩৯টির(যেখানে তাদের দেখানো হয়েছিল) নির্দিষ্ট গভীরতা এবং অবস্থান নিশ্চিত করা গেছে; এবং যে পরিমাণ গভীরতায় পাওয়া প্রয়োজন ছিল সে পরিমান খনন করা সত্ত্বেও অন্য ৭৪টি পাওয়া যায় নি (মাঝি ও মনি, ২০০৩ঃ ১৯)। যেহেতু ASI মনে করেছিল যে, বেশকিছু উচ্চতর-স্তরের কাঠামোর অনেক জায়গা খুঁড়ে(dig) ফেলে নিচের দিকে অগ্রসর হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ফলে তারা বাকি ২৭টি ব্যত্যয়ের শনাক্ত করতে অসমর্থ হয়। যাইহোক, এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে আমরা দেখি যে, আদতে উল্লেখিতদের মধ্যে মাত্র ২১টি ব্যত্যয় নির্দিষ্ট গভীরতায়(২০ সেমির মধ্যে) ও অবস্থানে নিশ্চিত করা গিয়েছিল। এসবের মধ্যে ১০টি ব্যত্যয়কে মেঝে বা Paving হিসেবে, ৫টি 'পিলার বেইজ' হিসেবে, ২টি স্থাপত্যিক ফিচার হিসেবে, ৩টি স্ট্রাকচার (স্থাপনা/কাঠামো) হিসেবে এবং একটি দেয়াল হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। GPR রিপোর্টে অন্য যেগুলো ঐ একই অবস্থানে প্রাপ্ত হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছিল তা আদতে ভিন্ন গভীরতায়(৫) প্রাপ্ত।


জরিপে যখন মাটির নিচে দেয়াল, পিলার এবং স্ল্যাব বিছিয়ে থাকার(flooring) উপস্থিতির কথা নিশ্চিত করা হল, ২০০৩ সালের ৫ই মার্চে উচ্চ আদালত ASI-কে খনন করবার নির্দেশ দিয়ে একটি আদেশ পাশ করল। উদ্দেশ্য বলা হল GPR জরিপের প্রতিবেদনের উল্লেখকৃত " ব্যত্যয়সমূহ/বস্তুসমূহের প্রকৃত প্রকৃতি" নির্ধারণ করা (মাঝি ও মনি, ২০০৩ঃ ৮) এবং আরও নিশ্চিত করতে চাওয়া যে "স্থাপনাটি আসলেই কোন বর্ণিত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে নির্মিত হয়েছে কি-না"।(৬) প্রত্নস্থান ও ট্রেঞ্চের লেআউট নিয়ে সাধারণ জরিপ কাজের মধ্যদিয়ে ২০০৩ সালের ১২ই মার্চ ASI কাজ শুরু করে যা ২০০৩ সালের ৭ই আগষ্ট পর্যন্ত চলে। এই কাজে একটি গ্রিডে হুইলারীয় খননপদ্ধতি অনুসরণে খনন করা হয়, যেখানে ৪×৪ মিটারের(৭) Cutting edge’সহ ট্রেঞ্চগুলোর মাঝখানে ১মিটার অখননকৃত মাটি রাখা হয়। প্রতিটি ট্রেঞ্চ একজন ট্রেঞ্চ-তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ছিল এবং শ্রমিকদের দিয়ে খনন সম্পন্ন করা হয়। ট্রেঞ্চ-তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব ছিল প্রতিদিনের ট্রেঞ্চের কর্মকাণ্ড নথিবদ্ধ করে রাখা। যাহোক একটি ট্রেঞ্চ হয়তো একজনের বেশি ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে ছিল, কেননা তত্ত্বাবধায়কদের প্রায়শই অদল-বদল হত। এভাবেই দেখা যেত যে "সাইট নোটবই"(৮) প্রায়শই একটির বেশি ট্রেঞ্চের তথ্য বহন করত, কারণ তত্ত্বাবধায়করা সম্ভবত বিভিন্ন ট্রেঞ্চের জন্যেই এগুলোকে ব্যবহার করত। সাইট নোটবইয়ে দিনের কাজের শুরুর ও শেষের সময়ের ট্রেঞ্চের গভীরতা, স্তরের সংখ্যা, ফিচার ও প্রত্নবস্তুর(artefacts) বিবরণ প্রতিটি দিনশেষে লিখে রাখতে হত। প্রতিটি নির্দিষ্ট ফিচার আসলে কিভাবে পুনরুদ্ধার করা হত এখানে তার কোন নথি নেই। খননে কন্টেক্সট ফরম ব্যবহার করা— যেখানে প্রতিটি Dig-এর পরের পুনরুদ্ধারের স্তর বিস্তৃত বর্ণনা করা হয়— যদিও এখন একটা চলতি প্রথা। সাইট নোটবইয়ের কথা বাদ দিলে, এখানে প্রাত্যহিক রেজিস্টার(প্রতিটি দিনের ট্রেঞ্চের খননের(Dig) তথ্য, খনন শুরুর এবং শেষের গভীরতা, প্রত্নবস্তুসমূহ, হাড়সমূহ এবং Glayzed ware নথিবদ্ধ করা) বজায় রাখা হত।(৯) প্রতিদিনের কাজশেষে সকল 'অ্যান্টিক্যুইটি'(অ্যান্টিক্যুইটি, একটি বাতিল টার্ম যা ASI এখনও খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু বোঝাতে ব্যবহার করে), হাড় এবং Glayzed বস্তু সকল গোষ্ঠীর— যারা প্রতিদিনের রেজিস্টারে স্বাক্ষর করে তাঁদের— সম্মুখে আনা হত। একটি অ্যান্টিক্যুইটি রেজিস্টারও বজায় রাখা হত, যেখানে প্রত্নবস্তুর বিবরণী(ট্রেঞ্চ ও লেয়ার নম্বর, গভীরতা, আকার ও বর্ণনা) থাকত। রেজিস্টার খাতায় এই প্রত্নবস্তুসমূহের রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হত। সর্বমোট ৯০টা ট্রেঞ্চ খনন করা হয়, যা আদতে ছিল ঐ পুরো অঞ্চলই।


২০০৩ সালের আগস্টে এই খননের প্রতিবেদন ২টি খণ্ডে (Text হিসেবে খণ্ড-I এবং Plates হিসেবে খণ্ড- II) আদালতের কাছে জমা দেওয়া হয়। প্রথাগত তরিকায়, প্রতিবেদনের একটি ভূমিকা, এবং কর্তিতাংশ(cuttings), স্তরায়ন(stratigraphy) ও কালানুক্রম(chronology), মৃৎপাত্র, স্থাপত্যিক ভগ্নাবশেষ,ক্ষুদ্রাকৃতির মাটির মূর্তি, শিলালিপি, সিল(Seals) , সিলিং(sealings), মুদ্রা এবং পাঁচমিশালী বস্তু সম্পর্কে অধ্যায়গুলো এবং সবশেষে ফলাফলের একটি সারাংশ রয়েছে। যাইহোক, এই প্রতিবেদনে ASI-এর অন্যান্য প্রতিবেদনের চেয়ে ব্যতিক্রমী একটা ব্যাপার ছিল। সকল অধ্যায়ের একক বা একাধিক রচয়িতা থাকলেও ফলাফলের সারাংশ অধ্যায়ের কোন রচয়িতার উল্লেখ নেই। উপরন্তু এই প্রতিবেদনে, খননে পুনরুদ্ধারকৃত প্রাণীদের হাড়সমূহ বা সমাধীগুলোতে প্রাপ্ত মানব কঙ্কালের অবশেষ নিয়ে কোন অধ্যায় নেই (মাঝি ও মনি, ২০০৩ঃ ৫৮)। মানব কঙ্কালগুলির অবশিষ্টাংশ সম্ভবত বাবরী মসজিদের উত্তর-দক্ষিণে মুসলমানদের যে গোরস্থান ছিল সেটার অবশেষ হবে।


বাবরী মসজিদের নিচে স্থাপত্যিক প্রমাণ


AYD রিপোর্টে খননের ফলাফলের সারাংশের সিদ্ধান্তসূচক অনুচ্ছেদে নিম্নোক্ত বক্তব্যটি রয়েছেঃ


Now, viewing in totality and taking into account the archaeological evidence of a massive structure just below the disputed structure and evidence of continuity in structural phases from the tenth century onwards up to the construction of the disputed structure along with the yield of stone and decorated bricks as well as mutilated sculpture of divine couple and carved architectural members including foliage patterns, āmlaka, kapotapali doorjamb with semicircular pilaster, broken octagonal shaft of schist pillar, lotus motif, circular shrine having pranāla (water chute) in the north, 50 pillar bases in association of the huge structure are indicative of remains which are distinctive features found associated with the temples of north India (Manjhi and Mani 2003: 272).


অতএব, বাবরী মসজিদের নিচে একটি মন্দির আছে, এই ধারণার সহযোগী হিসেবে কার্যত যে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণকে সামনে নিয়ে আসা হল(১০) তা মূলত দুইটি বর্গ দ্বারা গঠিত—(I) স্থাপত্যিক ভগ্নাংশ এবং (II) একটি "বৃহৎ স্থাপনা" যেটির ৫০টি "পিলার বেজ"সহ শুধুমাত্র পশ্চিমের দেয়াল(১.৭৭ মিটার চওড়া) পাওয়া গেছে।


স্থাপত্যিক ভগ্নাংশের অধ্যায়ে, ৪৪৫টির তালিকা রয়েছে যার মধ্যে কেবল ৪০টি স্তরীভূত প্রেক্ষিত(Stratified context) থেকে এসেছে এবং এদের একটিও কোনো নির্দিষ্ট মন্দিরের নয়। যেই ১২টির কথা খুব গুরুত্বের সাথে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবগুলোই ঢিবির উপরিপৃষ্ঠের ধ্বংসাবশেষে পড়েছিল এবং এগুলো বাবরী মসজিদের নিচে খনন থেকে পাওয়া যায়নি। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ধ্বংসাবশেষ কোন বৈধ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ দাঁড় করাতে পারে না। কারণ এটি কোন বদ্ধ সঞ্চয়ন(Sealed Deposit) থেকে প্রাপ্ত নয়। এই কারণে, এই খননে বাবরী মসজিদের মেঝের নিচে যা পাওয়া গেছে সেইগুলো প্রমাণ হিসেবে আমলে নেওয়া উচিৎ ছিল; মেঝের উপরের কিছু যা কি-না যেকোন জায়গা থেকে আনা সম্ভব, তা নয়। এই ১২ টি স্থাপত্যিক ভগ্নাংশের মধ্যে রয়েছে— একটি শ্রীবৎস নকশার(একটি সীমাহীন গীট্টুর প্রতীক) ১টি পাথরের স্ল্যাব যেটা জৈনধর্মের সাথে সংযুক্ত; পদ্ম নকশার ১টি পাথরের স্ল্যাব যেটা বৌদ্ধ বা জৈন রিপ্রেজেন্টেশন হতে পারে; ১টি লজেঞ্জ (Lozenge) নকশার পাথরের স্ল্যাব যেটা বাবরী মসজিদেরই অংশ হতে পারে, কারণ এটি মসজিদে বিদ্যমান আরবী লিপির নিম্নাংশের সাথে মিলে যায়; ১টি পিলারের অষ্টভূজ Shaft এবং ১টি পিলার; ১টি অমলাকা (Ornamental feature on the top a tapering tower); ১টি ভাঙ্গা দরজার অর্ধবৃত্তাকার পিল্যাস্টার (Pilaster)সহ জাম্ব(Jamb); পদ্ম ও পাতার ২টি স্টেনসিল-কাট নকশা; পদ্ম ও ফুলেল নকশার ২টি খোদিত পাথর; এবং দুটি মানবমূর্তির কোমর দেখা যায় এমন ১টি ভাস্কর্য, যাকে বর্ণনা করা হয়েছে "স্বর্গীয় যুগল" হিসেবে।


২০০৩ সালের ৬ই জুলাই তারিখে ছত্রিশ নম্বর সাইট নোটবইয়ের ৭নং পাতায় একটি এন্ট্রি রয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, "একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি(SIC)। খুব বাজেভাবে অঙ্গছেদ হওয়া মনুষ্যদেহের ভাস্কর্যের অংশ? (১.২ মিটার গভীরতায় এটি দৃশ্যমান হয়)। ডান পা'টা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান(ক্ষতিগ্রস্থ)। দেহ'টি বসা অবস্থায় রয়েছে।'' প্রাত্যহিক রেজিস্টারের(I) ২৭৬নং পাতায় এই বস্তুকে "ভাস্কর্য(ভাঙ্গা) চুনাপাথর'' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অ্যান্টিক্যুইটি রেজিস্টারে বস্তুটিকে বস্তু-তালিকায় "ভাষ্কর্যের ভগ্নাংশ(Defaced)" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং মন্তব্যে "ভাঙ্গা, যুগল" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। AYD রিপোর্টের ১৩০নং পাতার ছকে "একটি ভীষণভাবে অঙ্গছেদ হওয়া স্বর্গীয় যুগল, যারা আলিঙ্গন মূদ্রায় বসে আছে। বর্তমান থাকা অংশ কোমর, উরু এবং পা'য়ের কথা বলে" এরূপে এই বস্তুটিকে বর্ণনা করে। অ্যান্টিক্যুইটি রেজিস্টারে তালিকাভুক্ত করার জন্য ২০০৩ সালের ১৭ই জুলাই বস্তুটি পাঠ(study) করা হয় (প্রতি প্রত্নবস্তুর ব্যাগ কবে খোলা হয়েছে সেটার তারিখ সম্বলিত তালিকাভুক্তির হিসেব মতে)। এই পাঠের পরে এই ব্যাগ —যেখানে এই বস্তুসহ অন্য একটি বস্তুকে— সিলগালা করা হয় এবং উল্লেখ করা হয় এই ব্যাগ আলোকচিত্র গ্রহণের জন্য পরবর্তীতে খুলে পুনরায় সিলগালা করা হবে। ২০০৩ সালের ২২শে জুলাই ব্যাগটি পুনরায় খোলা হয় এবং সেইসঙ্গে একটি নোটে উল্লেখ করা হয়ঃ "দুইটি বস্তু ছবি তোলার জন্য খোলা হয়েছিল। ছবি তোলার পর সিলগালা করা হয়েছে।" অতঃপর, নিশ্চিতভাবেই, এটি নিয়ে পাঠ করা হয় বস্তুটি পুনরুদ্ধারের সময়ে(৬ই জুলাই, ২০০৩) এবং যখন এটি অ্যান্টিক্যুইটি রেজিস্টারে নথিভুক্ত হয় তখন(১৭ই জুলাই, ২০০৩) এবং শেষাবধি পাঠ করা হয়েছিল ২০০৩ সালের ২২শে জুলাইতে যখন ছবি তোলা হয়। দৃশ্যত আর কোন পাঠ এটি নিয়ে হয়নি। তাহলে AYD রিপোর্টে কিভাবে বস্তুটিকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল তা আমলে নেওয়া প্রয়োজন। AYD রিপোর্টের বর্ণনা, যেসব প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এটিকে উদ্ধার করেছিল বা যারা এটি নথিভুক্ত করার সময় পাঠ করেছিল তাঁদের কথার সাথে মেলেনা। তাহলে, কে বস্তুটির পরবর্তী পাঠ করলো? এটির মধ্যে স্বর্গীয়(Divinity) বৈশিষ্ট্য কে আরোপ করল? উপরন্তু, AYD রিপোর্টে যে পাতগুলির উল্লেখ ছিল(মাঝি ও মনি, ২০০৩ঃ পাত-২৩৫) তাতে বস্তুটিকে প্রাথমিকভাবে উমা-মহেশ্বর নাম দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে মুছে ফেলে 'স্বর্গীয় যুগল'-এ পরিবর্তন করা হয়। যদি কেউ আলোর দিকে ঐ পাতাটির পেছনপাশ মেলে ধরে, তবে এই পরিবর্তনটি দৃশ্যমান হবে। একটি বৈষ্ণব মন্দিরে উমা-মহেশ্বর মূর্তির প্রাপ্তি খুব বেশি কেলেংকারি হয়ে যায়। এজন্যেই কি এটিকে সংশোধন করা হয়েছিল?


অনুমিতভাবেই ASI ২০০৩ সালের খননে "পিলার বেইজ" পুনরুদ্ধার করে। এই "পিলার বেইজ"-এর উপরেই অনুমিতভাবেই ASI ২০০৩ সালের খননে "পিলার বেইজ" পুনরুদ্ধার করে। এই "পিলার বেইজ"-এর উপরেই মন্দিরের তত্ত্ব মোটাদাগে নির্ভর করে রয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, লাল'ই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাবরী মসজিদের নিচে একটি পিলার সম্বলিত মন্দিরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে 'পিলার বেইজ'-এর গুরুত্বের কথা মন্থনে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন। পিলার বেইজকে ভিত্তি মনে করা হয় যার উপরে পাথরের পিলারগুলো দাঁড়িয়ে ছিল। অপরদিকে, ছাদ'কে টিকিয়ে রাখত এই পিলারগুলো। ফলে পিলার বেইজগুলোকে হতে হবে ভার-বাহী এবং দৃঢ় প্রকৃতির। দৃশ্যত ASI খননে কেবলই লালের চিন্তাধারা অনুসরণ করে এবং মন্দিরের দূরবর্তী প্রমাণরূপে ৫০টি 'পিলার বেইজ' তৈরী করে। ASI -এর জন্য পিলারগুলো খুঁজে পাওয়া প্রয়োজনীয় ছিল, কেননা এগুলো ছাড়া মন্দিরের তত্ত্ব ভেঙ্গে পড়ত।