ছবিঃ দিনাজপুরের বিরলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উন্মোচিত স্থাপত্য ও প্রত্নপলল (আনু. সময়কাল খ্রি. ৮ম শতক - ১৭শ শতক)। এই প্রত্নস্থানে বৌদ্ধ স্থাপনাকে রূপান্তর ও আত্মীকরণ করে ব্রাক্ষ্মণ্য স্থাপনা (সপ্তরথ মন্দির) নির্মিত হয়েছিল। পরে একই পরিসর আনু. ১৫শ-১৭শ শতকে মানববসতি হিসেবে আত্মীকৃত ও ব্যবহৃত হয়েছিল। উক্ত খননের প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে (লিঙ্ক: https://www.academia.edu/39998047/Preliminary_observations_on_the_outcomes_of_two_archaeological_excavations_on_Teesta_Mega_Fan_TMF_Bangladesh)


‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে’ জিজ্ঞাসাবাদ : ভারতের প্রাচীন লিখিত সূত্রের বিবিধ স্বর

ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়



[ অনুবাদকের টীকা: অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব-ইতিহাসের শিক্ষার্থী ও পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নাই। আদি মধ্যযুগের নতুন তত্ত্বায়ন থেকে শুরু করে গ্রামীণ বসতির অভিলেখভিত্তিক ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক বিভিন্ন যুগে অপরত্বের সন্ধান থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা প্রস্তাব, ঐতিহাসিক ভূগোল থেকে আরম্ভ করে নগরের প্রত্নতত্ত্ব – প্রাক ঔপনিবেশিক কালের দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসতত্ত্বের নানা প্রসঙ্গে অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের অবদান আমাদের অনেককেই পথ দেখিয়ে চলেছে। Interrogating ‘Unity in Diversity: Voices from India’s Ancient Texts শিরোনামের এই প্রবন্ধটি উনার The Concept of Bharatvarsha and Other Essays (Permanent Black, 2017) বইটি থেকে নেয়া। প্রথমে এই প্রবন্ধটি ২০১৪ সালে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের অধিবেশনে সভামূখ্যের ভাষণ হিসেবে পড়েছিলেন। পরে প্রবন্ধটি Social Scientist জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। মূল প্রবন্ধটি পড়তে আগ্রহী পাঠকদের জন্য ওই প্রবন্ধটি আপলোড করলাম। তবে বইয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধটির সঙ্গে এই প্রবন্ধের বৈসাদৃশ্যও মনে রাখতে হবে:

interrogating-unity_bdc


প্রবন্ধটি আমাদের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অসম্ভব গুরুত্ব বহন করে বলে আমার মনে হয়েছে। নানা উদাহরণে বর্তমান জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের উল্লেখ থাকলেও, ইতিহাসের বোঝাপড়ার পদ্ধতিগত দিক থেকে এবং নানা প্রাত্যহিক প্রসঙ্গে ইতিহাসের বিচিত্র উল্লেখের চলতি প্রবণতার প্রেক্ষিতে এই প্রবন্ধটি অত্যন্ত জরুরি। লিখিত নানা উৎসের নিরিখ করে কীভাবে বিভিন্ন স্বতঃসিদ্ধ ধারণা ও অনুশীলনকে প্রশ্ন করা যায় তা শেখা ও বোঝার জন্যও এই প্রবন্ধটি একটি প্রামাণ্য হতে পারে।


হালের উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রসারে যেখানে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে তটস্ত করে রেখেছে, তখন এমন প্রবন্ধ আমাদের বিদ্যায়তনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মতুষ্টিকে আঘাত করার জন্য অত্যন্ত দরকারী। আশা করি পাঠকবৃন্দ গভীর আগ্রহের সঙ্গে অনুবাদটি পড়বেন। ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী বয়ানগুলোকে যেমন প্রশ্ন করা যায় তেমনই লিবেরাল ও সেক্যুলার ইতিহাসের বয়ানকেও প্রশ্ন করা যায়। প্রশ্ন করার তৎপরতার প্রস্তুতি-অনুশীলন-চিন্তার জন্যও প্রবন্ধটি বিশেষভাবে শিক্ষণীয়।


বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই অনুবাদটি পুরোপুরি অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কেবল শিক্ষার জন্য করা হয়েছে। এখানে প্রকাশিত সংস্করণটিকে প্রথম খসড়া হিসেবে বিবেচনা করলে বাধিত হবো। অনুবাদটি করার সময় মানস চৌধুরী ও তমাল মোহাইমেনের বিভিন্ন সাহায্যর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রুফ পাঠ করে সংশোধন করার জন্য জাহিন জামালকে অনেক ধন্যবাদ।


ইংরেজি রেফারেন্সে প্রতিবর্ণীকরণের জন্য ব্যবহৃত ডায়াক্রিটিক চিহ্নগুলো ব্যবহার করতে পারি নাই। তৃতীয় বন্ধনীতে কয়েকটি স্থানে সংযোজিত শব্দ অনুবাদকের। ফন্টের রূপান্তরসহ কিছু টেকনিকাল কারণে বেশ কিছু যুক্তাক্ষর ভেঙ্গে গেছে। ধীরে ধীরে সেগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করবো। সকলকে ধন্যবাদ ও সকলের জন্য শুভকামনা। – স্বাধীন সেন (অনুবাদক) ]

অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় ও অনুবাদক

সম্মানীত অতিথিবৃন্দ এবং আমার অগ্রজ, সতীর্থ ও অনুজ অতীতের [শাস্ত্রের] শিক্ষার্থীবৃন্দ,

প্রথম বক্তব্য পরিবেশন করার সম্মান পাওয়া বিশাল সুযোগ হলেও, আরও অনেকে যারা বক্তৃতা করবেন, তাদের মধ্যে একজন হওয়ায় বক্তৃতার বিষয়বস্তু বেছে নেওয়ার কর্মভার কোনোভাবেই সহজ না। আমি যতটুকু জানি তাতে করে এই বেছে নেওয়ার পথে নির্দেশনা প্রদান করবে এমন কোনো বিধিবদ্ধ নীতিমালা নাই। আমি এও জানি যে, কিছু প্রচলিত প্রথার অস্তিত্ত্ব রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন বিগত বছরে প্রকাশিত গবেষণাগুলোর একটা সমীক্ষা ও মূল্যায়ন করা তার দায়িত্ব বলে সভামূখ্য মনে করতেন। গত বছরগুলোতে সেটা পাল্টে গিয়ে সভামূখ্যের উপরে তার নিজের গবেষণা ক্ষেত্রের মধ্য থেকে একটি বিষয়বস্তু বাছাই করার, এবং উপাত্ত সমৃদ্ধ ও সকলকে উদ্ভাসিত করে এমন পর্যালোচনা হাজির করার দায় বর্তেছে। তবে, সেই বিষয়বস্তু আয়োজনে উপস্থিত বেশিরভাগের মুখ্য বিবেচ্য নাও হতে পারে। এপর্যন্ত বেছে নেওয়া উপায়গুলো সহজ যোগাযোগের রাস্তাকে কোনোভাবে সীমিত করে বলে আমার মনে হয়েছে। আগেকার ও হালের চর্চাগুলো, কেবল আমার সামনে হলেও, একটি আয়োজনে বাছাই করার সঙ্কট হাজির করে। এই আয়োজন চিন্তায় শরিক হওয়ার ও চিন্তার বিনিময় করার; এই আয়োজন একমুখী যোগাযোগের নয়, বরং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া নির্ভর। সবার আগ্রহের হবে এমন একটি সমস্যা হাজির করার মাধ্যমে সম্ভবত এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে বলে আমি অনুভব করেছি। বিশুদ্ধার্থে, ঐতিহাসিক প্রকৃতির না হলেও, সমস্যাটিকে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। আমি নিশ্চিত, সকলের আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে এমন অনেক প্রসঙ্গই রয়েছে, যেগুলো নিয়ে আলাপে অন্যান্যদের মতোই ইতিহাসবিদগণের অংশগ্রহণ ও প্রতিক্রিয়া জানা দরকার। কোনও সমস্যার একটি চূড়ান্ত সমাধান খুঁজে বের করতে ইতিহাসবিদগণের অভ্যাসগত আত্মবিশ্বাস কঠোরভাবে সমালোচিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে, যদি সেই সমস্যাকে আলোচনার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। মুক্ত অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে এমন পরিসরে কোনও ইতিহাসবিদই তার বিশেষ চিন্তাশীল মনোযোগ না দিয়ে পারেন না। দাবি করেই বলা যায়, এই মনোযোগ ব্যতিরেকে কোনও সমস্যারই পর্যাপ্ত পর্যালোচনা করা যায় না।


যদি অনুমতি দেন, তবে যাকে একজন ‘ইতিহাসবিদের ধাঁধা’ (কারণ পদ হিসেবে এটিকে একটি স্ববিরোধ বলে মনে হয়) নামে আখ্যায়িত করতে চাই, তাকে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ অভিব্যক্তিটির মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমরা সকলেই এই অভিব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত। ভারতবর্ষকে প্রকাশ করে যে চরিত্রাবলি, তাদের মোক্ষম প্রকাশ হিসেবে এই অভিব্যক্তিটি দীর্ঘদিন ধরেই পরিগণিত হয়। এই অভিব্যক্তিটি এমন একটি ধারণা, যা আমরা উত্তারাধিকারসূত্রে পেয়েছি এবং আমাদের দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ এই ধারণাটিকে বহু অলঙ্কারে শোভিত করেছেন। জীবনের শুরু থেকেই আমরা আমাদের নিজেদের দেশের পরিচয় পাওয়া শুরু করি এই অভিব্যক্তিটি দিয়েই। সারাজীবন ধরে দেশের এই ভাবমূর্তি আমরা বহন করে চলি। এই মহতী আয়োজনে আলোচ্য শব্দবন্ধটি নিয়ে পুনর্চিন্তন করাকে আমি বেছে নেওয়ার মানে এই না যে, এই শব্দবন্ধের অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনার বৈধতাকে প্রশ্ন করতে হবে। যেহেতু এ—ধরনের বিষয় সম্পর্কিত হালের আলাপচারিতা ব্যর্থ হয়েছে, তবুও নতুন করে জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন :


ক. এই অভিব্যক্তির মধ্যে ‘ঐক্যের’ মানে কী, অথবা ‘বৈচিত্র্যের’ সঙ্গে সংযুক্ত অর্থে এই ঐক্যের সীমানাগুলো কী কী? অন্যভাবে বললে, যদি ‘ঐক্যকে’ গঠনকারী হিসেবে বৈচিত্র্যগুলোকে বিবেচনা করা হয়, তবে যখন ‘ঐক্যকে’ নির্দেশ করা হয়, তখন কোন পর্যায় অব্দি ‘বৈচিত্র্যগুলো’ থাকে?


খ. একটি তুলনামূলকভাবে পরিবর্তনপ্রবণ ঐতিহাসিক প্রশ্ন পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সম্পর্কিত – যে পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যের ধারণার উদ্ভব ঘটেছিল, আর যে—কারণেই হোক না কেন, যে পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণা অব্যহতভাবেই পরিপুষ্ট হয়ে চলেছে। প্রায়শই দেখা যায় যে, দেশের প্রাচীন অতীত সভ্যতা বা নিদেনপক্ষে প্রাক—ঔপনিবেশিক ভারতীয় সভ্যতার উল্লেখ করে ঐক্যের ধারণাকে বৈধতা দেয়া হয়। তাই ঐক্যের ধারণার প্রবক্তাগণ অতীতের কোন কোন উপাত্ত ব্যবহার করছেন, তা নিরিখ করা প্রয়োজন।


গ. যদি একটি দেশের ‘বৈচিত্র্যকে’ (যে অর্থেই ‘বৈচিত্র্য’ পদটি ব্যবহার করা হোক না কেন) ঐক্যের একটি কাঠামোতে একাঙ্গীভূত হিসেবে দেখা হয়, তখন বৈচিত্র্যের বিভিন্ন সংযোগপথগুলো ‘ঐক্য’ হিসেবে উপলব্ধ দশার মধ্যে কীভাবে ক্রিয়াশীল থাকে? আর এই সংযোগপথগুলো অতীতেই বা কীভাবে ক্রিয়াশীল ছিল?

এই অভিব্যক্তির মধ্যে ‘ঐক্যের’ মানে কী, অথবা ‘বৈচিত্র্যের’ সঙ্গে সংযুক্ত অর্থে এই ঐক্যের সীমানাগুলো কী কী? অন্যভাবে বললে, যদি ‘ঐক্যকে’ গঠনকারী হিসেবে বৈচিত্র্যগুলোকে বিবেচনা করা হয়, তবে যখন ‘ঐক্যকে’ নির্দেশ করা হয়, তখন কোন পর্যায় অব্দি ‘বৈচিত্র্যগুলো’ থাকে?



একটি তুলনামূলকভাবে পরিবর্তনপ্রবণ ঐতিহাসিক প্রশ্ন পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সম্পর্কিত – যে পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যের ধারণার উদ্ভব ঘটেছিল, আর যে—কারণেই হোক না কেন, যে পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণা অব্যহতভাবেই পরিপুষ্ট হয়ে চলেছে। প্রায়শই দেখা যায় যে, দেশের প্রাচীন অতীত সভ্যতা বা নিদেনপক্ষে প্রাক—ঔপনিবেশিক ভারতীয় সভ্যতার উল্লেখ করে ঐক্যের ধারণাকে বৈধতা দেয়া হয়। তাই ঐক্যের ধারণার প্রবক্তাগণ অতীতের কোন কোন উপাত্ত ব্যবহার করছেন, তা নিরিখ করা প্রয়োজন।



যদি একটি দেশের ‘বৈচিত্র্যকে’ (যে অর্থেই ‘বৈচিত্র্য’ পদটি ব্যবহার করা হোক না কেন) ঐক্যের একটি কাঠামোতে একাঙ্গীভূত হিসেবে দেখা হয়, তখন বৈচিত্র্যের বিভিন্ন সংযোগপথগুলো ‘ঐক্য’ হিসেবে উপলব্ধ দশার মধ্যে কীভাবে ক্রিয়াশীল থাকে? আর এই সংযোগপথগুলো অতীতেই বা কীভাবে ক্রিয়াশীল ছিল?

আরো অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে। কিন্তু আমি যে সংশয় সকলের মধ্যে সঞ্চালিত করতে চাই, তা এই জিজ্ঞাসাগুলোর মাধ্যমেই বোধগম্য হওয়া উচিত। যদি ভারত আসলেই ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের’ ঐতিহাসিক কার্যকরীতাকে প্রতিনিধিত্ব করে ( যে—কেউ ভাবতেই পারেন : কোনও না কোনও অর্থে কোন দেশ করে না?) তবে এখন সময় এসেছে আমাদের কল্পনায় এই ধারণার বিজড়নের ইতিহাস ফিরে দেখার। এই ইতিহাস ততটাই ফিরে দেখা, যতটায় বোঝা যায় কেন সংলগ্ন বৈচিত্র্যের শর্ত বাদে হালের ‘ভারত এক’ স্লোগানটি এক অশুভ হুমকির মতো শোনায়।


প্রশাসনিকভাবে শাসনযোগ্য রাষ্ট্র হিসেবে ভারত একটি অঞ্চলগত/মানচিত্রগত একক — এই ধারণা ঔপনিবেশিক। আমি এই বিবৃতিটি কিছুটা স্পষ্ট করতে রাজি থাকলেও, এর সারসত্তাকে ধরে রাখতে চাইব। দেশের ঐক্যের ধারণা আসলেই আকর্ষণীয়। এই ধারণা ঊনবিংশ—বিংশ শতকের স্থানীয়ভাবে বিকশিত জাতীয়তাবাদী চিন্তকদের কাছে অন্য আরেকটি আবিষ্কৃত ধারণার মতোই আবেদনময় ছিল। ওই ধারণাটি হলো : আর্য নামে একটি জাতিগত—সভ্যতাগত বর্গ। মর্যাদাভুখ ভারতীয় নাগরিকগণ যাদের অনেকে মনু ও অন্যান্যদের দ্বারা চিহ্নিত আর্যাবর্তের সীমানার বাইরে বসবাস করে তাদের কাছে আবিষ্কৃত আর্য বর্গটি অত্যন্ত উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রাহ্যতা পেয়েছিল, আর অব্যহতভাবে এখনও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে চলেছে। আমাদের জাতীয় চৈতন্য দানা বাঁধার শুরুর দিকে ও পরিণত পর্যায়ে কেবল রাজনৈতিক চিন্তকদের কাছেই নয়, সৃষ্টিশীল লেখক ও শিল্পীদের কাছেও ঐক্যের ধারণা কেন পরম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল তা বোধগম্য। রাজনৈতিক প্রভু ‘বিদেশীদের’ ঐক্যবদ্ধ বিরোধীতার জন্য বিবিধতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও সাময়িকভাবে ভুলে যাওয়ার দরকার ছিল। কিছুটা হলেও, একটি দেশ ও তার জনগণের ছবির অখণ্ডতা প্রমাণের জন্য এই বিস্মৃতি ঘটেছিল। দেশকে একটি ‘মাতৃভূমি’ হিসেবে, দেবি হিসেবে, কতগুলো প্রতীমালক্ষণবিশিষ্ট হিসেবে উপলব্ধি করা ও পরিবেশন করা যেতে পারে। এর অধিবাসীদেরও একটি অখণ্ড একক বা একীভূত সত্তা হিসেবে ওই দেশের অধিবাসী (ভারতবাসী) হিসেবে ধারণা করা যায়।


ঐক্যের ধারণার প্রথমদিকের ঐতিহাসিক বিবৃতিগুলোর মধ্যে একটি ছিল রাধাকমল মুখার্জীর দ্য ফান্ডামেন্টাল ইউনিটি অব ইন্ডিয়া। ভারতীয় সভ্যতার একটি মৌলিক সারসত্তা/নির্যাস হিসেবে ঐক্যের চেতনার ঐতিহাসিক উপস্থিতি নির্দেশ করার জন্য এই বইয়ে প্রধানত আদি (আর খুব বেশি আদি নয় এমনও) কতগুলো লিখিত উপাদানের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছিল। অতীতের কোনও কোনও পর্বে বিচ্যূতি ঘটে থাকলেও বৈচিত্র্যের তুলনায় ঐক্যকেই স্বাভাবিক ভারতীয় দশা হিসেবে উপস্থাপন করা হল। অতীতে ও এখনও আমাদের শত শত স্কুল টেক্সটবইয়ে বৈচিত্র্যের বদলে ঐক্যকেই ভারতের স্বভাবজাত গুণ হিসেবে অনুমান করা হয়। ঐক্য অর্জিত হওয়ার অতীত প্রসঙ্গে কোনও জিজ্ঞাসার প্রয়োজনীয়তাকেই আড়াল ও অগ্রাহ্য করা হয়। ইতিহাসতাত্ত্বিক দিক থেকে, কৌতুহলউদ্দীপকভাবে, এমনকি ‘ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্যের’ ধারণা সম্পর্কিত সাম্প্রতিক আলাপের চেষ্টাগুলো ধারণাটিকে কোনও পর্যালোচনামূলক জিজ্ঞাসার বিষয়বস্তুতে পরিণত না-করেই উপসংহারে পৌঁছেছে।১০ বরং প্রবল ঐতিহ্য ও বিভিন্ন গৌণ ঐতিহ্য হিসেবে যেগুলোকে গণ্য করা হয়, সেগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়ার উল্লেখ করে এই ধারণাকে যৌক্তিকতা প্রদানের পথ খোঁজা হয়েছে। অথবা কেন্দ্রাভিগ আর কেন্দ্রাতিগ প্রবণতাগুলোর একটি থেকে আরেকটির দিকে পেন্ডুলামের মতো এদিকে থেকে ওদিকে যাওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনীয় পুরোনো ভাবনা দিয়ে ধারণাটির যৌক্তিকতা অনুসন্ধান করা হয়েছে। বিভিন্ন পদ বা শব্দগুলোকেই কেবল ভারতীয়করণ করার চেষ্টা হয়েছে। কেন্দ্রাভিগ সংস্কৃতায়িত হয়েছে কেন্দ্রাভিমুখী হিসেবে আর কেন্দ্রাতিগকে সংস্কৃতায়িত করা হয়েছে প্রান্তাভিমুখী। মনে হয়েছে, অতীতে যেন কোনও সক্রিয় কুশীলবের সচেতন সক্রিয়তায় বিভিন্ন উপাদান শৃংখলাবদ্ধ হয়েছে; এই কুশীলবের সক্রিয়তা বৈচিত্র্যের খারিজযোগ্য উপাদানগুলো আর কাঙ্খিত একীভূতকরণের বা কেন্দ্রীভূতকরণের মানদণ্ড যেন নির্ধারণ করেছিল।

যাকে প্রবল হিসেবে ঠাহর করা হচ্ছে তার প্রবল হয়ে ওঠার ইতিহাস রয়েছে। গৌণতা বা ক্ষুদ্রতার মতো প্রবলতাও নিজে নিজেই পয়দা হয় না। কেন্দ্রমুখীনতাকে কাঙ্খিত লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা আর প্রান্তাভিমুখীনতাকে অনাকাঙ্খিত বিচ্যুতি হিসেবে চিহ্নিত করার ভাবনার সঙ্গে একটি একীভূত রাষ্ট্রের ধারণার পূর্বতসিদ্ধভাবে যুক্ততা এতই স্পষ্ট যে, তা নিয়ে বিশদ উল্লেখ না করলেও চলে।

কৌতুহলউদ্দীপক বিষয় হল, কেন্দ্রাভিমুখী আর প্রান্তাভিমুখী, কিংবা প্রবল ঐতিহ্য আর গৌণ ঐতিহ্যের মতো পদাবলি অব্যহতভাবে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে আমরা এমন একটি ধারণাকে অবিরাম স্থায়ীভাবে ধরে রাখি, যা কেবল মতাদর্শপ্রভাবিতই নয়, বরং অনৈতিহাসিকও বটে। নৈমিত্তিক সাধারণ আলাপচারিতার মধ্যে যখন সতর্কীকরণসুলভ মন্তব্য করা হয় যে, ‘ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে কোথাও স্বতঃসিদ্ধভাবে অস্তিত্বশীল কোনও কিছু না ভেবে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বোঝা কাজের হতে পারে’ (নজরটান মূল লেখায়ই রয়েছে)১১ , তখনও এই অনৈতিহাসিকতা বহাল থাকে। যাকে প্রবল হিসেবে ঠাহর করা হচ্ছে তার প্রবল হয়ে ওঠার ইতিহাস রয়েছে। গৌণতা বা ক্ষুদ্রতার মতো প্রবলতাও নিজে নিজেই পয়দা হয় না। কেন্দ্রমুখীনতাকে কাঙ্খিত লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা আর প্রান্তাভিমুখীনতাকে অনাকাক্সিক্ষত বিচ্যুতি হিসেবে চিহ্নিত করার ভাবনার সঙ্গে একটি একীভূত রাষ্ট্রের ধারণার পূর্বতসিদ্ধভাবে যুক্ততা এতই স্পষ্ট যে, তা নিয়ে বিশদ উল্লেখ না করলেও চলে। এই রাষ্ট্রকে অধিবাসীগণ নিজের দেশ বলে মনে করেন। ভিন্নতা যে অনেক ছিল তা স্বীকার করার বাধ্যবাধকতার বোধ থাকলেও১২ ঐক্যের ধারণাকে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখার গুরুত্ব দিয়ে এই ধারণাকে একটি বিকাশমান জাতীয়তাবাদের প্রণোদনা হিসেবে বোঝা যেতে পারে বৈকি। অতীতে ভারতীয়গণ (নিদেনপক্ষে কতিপয় ভারতীয়) নিজেদের সম্পর্কে কীভাবে ভাবতেন আর যাদের তারা অপর ভাবতেন তাদের নিয়ে কীভাবে আলাপ করতেন তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করায় অব্যহত অনীহা বলবৎ রয়েছে। একটি সমাজের মধ্যে ভিন্নতা এবং বৈচিত্র্য নিয়ে উপলব্ধির যে প্রকৃতি তা হল ওই সমাজকে গঠনকারী বিভিন্ন উপাদানের একটির সঙ্গে আরেকটির মিথস্ক্রিয়া কেমন হবে তা বোঝাবুঝির নির্দেশক। এমনকি যদি অতীতেও এমন বৈচিত্র্য আর পারস্পরিক উপলব্ধি ও মিথস্ক্রিয়া কাজ করে থাকে, তাহলেও ভারতীয় ঐক্যের ধারণা কীভাবে বলবৎ রাখতে পারা যাবে সেই প্রসঙ্গে সম্ভবত নতুন করে ভাবা দরকার হবে ভারতীয় সমাজের জটিল বাস্তবতার একটি নকশা তৈরি করার জন্য। এছাড়াও, এমনকি বৈচিত্র্যের স্পষ্ট ফারাকগুলো ঢেকে রাখার ঘোমটা সদৃশ একটি সর্বব্যপী সংস্কৃতির ধারণা নিয়ে আমরা যদি অগ্রসর হই, তাহলেও এই ঘোমটার কাপড় কীভাবে বোনা হল তা আলোচনা করা দরকার। সেই আলোচনাকে প্রত্যক্ষণগত উপাত্তের ভিত্তিতে ন্যায্যতা দেয়া যদি নাও যায়, অন্ততপক্ষে কোনও না কোনও আঙ্গিকে যৌক্তিক অনুমান সেখানে থাকতে হবে। একটি শাস্ত্র হিসেবে ইতিহাসের এই জিজ্ঞাসাগুলো প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের প্রতিই আমি এখন অনেক সংশয় সমেত মনোযোগ দেব।

অতীতে ভারতীয়গণ (নিদেনপক্ষে কতিপয় ভারতীয়) নিজেদের সম্পর্কে কীভাবে ভাবতেন আর যাদের তারা অপর ভাবতেন তাদের নিয়ে কীভাবে আলাপ করতেন তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করায় অব্যহত অনীহা বলবৎ রয়েছে।


1

বৈচিত্র্য আর ভিন্নতার নানান উপলব্ধি

তাড়াহুড়ো করে, অসমর্থিতভাবে কোনও একটা নকশা আঁকা হচ্ছে এমনটা মনে হওয়ার ঝঁুকি থাকা সত্ত্বেও একথা বলতে হয়। আদিকালের টেক্সটগুলোর লেখকদের চিন্তাকে বৈশিষ্ট্যায়িত করেছিল এমন একটা অনুভব যে, সামাজিক পরিস্থিতি কতগুলো বিপরীত জোড়ের মিলে, অথবা বহু বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। সরাসরি বলা হয়েছিল বিপরীত জোড়গুলোর মধ্যকার সম্পর্ক স্পষ্টতই পুনর্মিলিত হওয়ার অযোগ্য। অন্যদিকে, সামাজিক বাস্তবতার অংশ হিসেবে বিবেচিত ভিন্নতা হিসেবে বিবিধতার মধ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যক্ত হতো নানাবিধভাবে। আর্যদস্যুর মতো পদাবলির মাধ্যমে ঋগ্বেদে যেভাবে দুটো বর্গের বৈপরীত্যকে প্রকাশ করা হয়েছে, সেই বৈপরীত্য কেবল দুটো দলের সমসাময়িকতার প্রকাশক ছিল না ১৩। দুটো দলের মধ্যে বিরাট সাংস্কৃতিক ফারাকের কারণে বলা হয়েছে যে, আর্যদের প্রয়োজন দস্যুদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। আর্য ও ম্লেচ্ছ বর্গের ফারাক ভাষাগত ভিন্নতা থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে। এক্ষত্রে জেনেরিক বর্গ হিসেবে ম্লেচ্ছ পদটি যবন, শক, তুষার, চিন, হুনের মতো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে নির্দেশ করত। দুটি জাতিবর্গের পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে যাওয়ার অসম্ভাব্যতার ধারণা সর্বকালেই অটুট ছিল। আর্যদের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুর প্রতি লেখকদের (যেহেতু এই প্রারম্ভিক পর্বের লেখকগণ এই বর্গেরই প্রতিনিধিত্ব করতেন) অনুরাগ থাকার কারণে অন্যদের তুলনায় আর্যদের ছবি আঁকা হয়েছে মহত্তর হিসেবে। ফলশ্রম্নতিতে, বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বিভাজন ও উচ্চনীচশ্রেণীকরণ ঘটেছিল তাৎপর্যময় মাত্রায়। এই ফলাফল অন্য সাংস্কৃতিক বগার্য়নের দিকে চালিত করেছিল। অন্যান্য প্রকারের বিপরীত জোড়কে – যেমন : নাগরিক – গ্রামীণ, জনপদ – অরণ্য, মার্গী – দেশি — এই অবস্থার উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।



বিভিন্ন জনসমষ্টি অধ্যুষিত ভৌগোলিক পরিসরকে অনুধাবন করা হতো যে পরিপ্রেক্ষিতে, সেখানে বিপরীত জোড়গুলোর উপরে আরোপ করা গুণাবলি স্পষ্টতই উপস্থিত ছিল। জম্বুদ্বীপ বা ভারতবর্ষকে (উভয় পদই বর্তমান ভারতকে নির্দেশ করছে বলে বিবেচনা করা হয়) পাঁচ ভাগে, সাত ভাগে বা নয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বিভাজিত এলাকার সংখ্যা যাই হোক না কেন, আলাদা আলাদাভাবে অধিবাসীসহ এলাকার সমষ্টি হিসেবে বিবেচিত এই পরিসর সুষ্পষ্টভাবেই মধ্যদেশ বা আর্যাবর্তের আর অন্যান্য অঞ্চলের (দিশ) মধ্যে ভিন্নতার বোধকে ধারণ করেছিল। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে এই ভিন্নতার বোধের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়১৪ :


পূর্বদিকে যেখানে সরস্বতী আর দেখা যায় না, কালক বনের পশ্চিমে, হিমালয়ের দক্ষিণে এবং পরিযাত্রা পর্বতমালার উত্তরে বিস্তৃত অঞ্চলই আর্যদের ভূমি। এই ভূমির আচারই কেবল প্রামাণ্য।



আর্য আর অন্যান্যদের মধ্যকার ভিন্নতাগুলোর মতোই আর্যাবর্তে বা মধ্যদেশে অন্যান্য দিকের এলাকাগুলোর সঙ্গে ভিন্নতার ধারণা বিরাজমান ছিল। একটি আদর্শ সামাজিক বিন্যাস – সমেত মধ্যদেশ বা আর্যাবর্ত ছিল একটি পবিত্র ভূমি। অন্যান্য এলাকাগুলো ছিল গুণগতভাবেই অশুদ্ধ ও নিকৃষ্ট। কালক্রমে এই পবিত্র ভূমির অনুমিত সীমানা পাল্টালেও, শুদ্ধতার নিরিখে তৈরি এই সুস্পষ্ট ফারাক টিকে ছিল। সাধারণ অব্দের কালপঞ্জির প্রারম্ভিক পর্বে সরস্বতী ও দৃষদ্বতী নামক দুই পবিত্র নদীর মধ্যবর্তী স্থানের এই দেশকে বেদ—ভূমি হিসেবে মনু চিহ্নিত করেছিলেন। তার মতে, ‘ওই দেশের (চার) বর্ণের আচরণ … সদাচারী মানুষের আচরণ’। একইভাবে, ‘যজ্ঞ করার উপযুক্ত’ ছিল বলে মধ্যদেশ ও আর্যাবর্ত উভয়েই পবিত্র ছিল। ‘দ্বিজদের এই দেশগুলোতে বসবাস করার জন্য সকল প্রকারের চেষ্টা করা উচিত; কিন্তু একজন ভৃত্য (শূদ্র) যদি জীবিকার জন্য ক্ষুধার্থ থাকে, তবে সে যে—কোনো দেশে বসবাস করতে পারে।’১৫ আসলে, মনুর ‘যজ্ঞকৃত্যের জন্য উপযুক্ত’ ভূমি আর্যদের অনুপস্থিতিতে অশুদ্ধ হওয়া বর্বর (ম্লেচ্ছদের) বাসভূমি থেকে সুষ্পষ্টভাবেই পৃথকীকৃত ছিল। সাধারণ অব্দের কালপঞ্জির প্রারম্ভিক পর্বের স্মৃতিশাস্ত্রের লেখকগণ যদি স্থানকে পবিত্রতা ও অপবিত্রতার ভিত্তিতে বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে একই কালপঞ্জির দশম শতকে রাজশেখরকেও আমরা একই ধারণা অব্যাহত রাখতে দেখি। কাব্যমীমাংসায় দেখা যায়, তার কাছে মধ্যদেশ ছিল ‘সদাচারের উৎস’ (তন্মুলশ্চ সদাচার) এবং ‘কবিদের কাব্যরীতিও ওই অঞ্চল থেকেই আহৃত’ (তত্রত্যো ব্যবহারঃ প্রায়েণ কবীনাম)১৬ ছিল।

মার্গ যেমন স্বর্গীয় হিসেবে আর দেশী যেমন পার্থিব বা অন্তঃসারশূন্য হিসেবে সংজ্ঞায়িত হতো, সেভাবেই অপবিত্র বা অশুদ্ধ হিসেবে যা চিহ্নিত হতো, তার বিপরীতে পবিত্র বা শুদ্ধ হিসেবে অন্যগুলোকে অনুধাবন করা হতো। এই ভিন্নতা বা পার্থক্যের ধারণার উদ্ভব ঘটে থাকতে পারে একেবারেই কঠোর ব্রাক্ষ্মণ্য চিন্তার তরিকা থেকে।

মার্গ যেমন স্বর্গীয় হিসেবে আর দেশী যেমন পার্থিব বা অন্তঃসারশূন্য হিসেবে সংজ্ঞায়িত হতো, সেভাবেই অপবিত্র বা অশুদ্ধ হিসেবে যা চিহ্নিত হতো, তার বিপরীতে পবিত্র বা শুদ্ধ হিসেবে অন্যগুলোকে অনুধাবন করা হতো। এই ভিন্নতা বা পার্থক্যের ধারণার উদ্ভব ঘটে থাকতে পারে একেবারেই কঠোর ব্রাক্ষ্মণ্য চিন্তার তরিকা থেকে। তবে যে—কোনো সামাজিক বাস্তবতার অনুধাবনই হতে হবে তার প্রত্যক্ষণনির্ভরতার ভিত্তিতে; তার পরিবর্তনশীলতার, অসঙ্গতির সাপেক্ষে; সংঘাতপ্রবণ, রূপান্তরশীল হিসেবে; ব্যক্তি কুশীলবের সক্রিয়তার সাপেক্ষে।১৭ যে অগণিত জনপদ কোনও একটি জনগোষ্ঠীর বা কতগুলো সমন্বিত জনগোষ্ঠীর মূল বাসস্থল ছিল, সেগুলোর অস্তিত্বের প্রত্যক্ষণগত বাস্তবতা এখানে অনুধাবন করতে হবে। এই উপলব্ধির মাধ্যমেই স্থান বা পরিসরের ক্ষেত্রে পবিত্র ও তেমন—পবিত্র—নয়— এমন বিপরীত সত্তাবিশিষ্ট স্থানের ধারণা প্রসারিত করা যেতে পারে। জনপদ, নাড়ু– বা অন্য যে—নামেই এই স্থানিক এককগুলোকে প্রকাশ করা হোক না কেন, ওই স্থানে বসবাসকারী মানুষজনের স্থানিক পরিচয় এই নামেই নির্ধারিত হতো।১৮ তবে মনে রাখতে হবে যে, একটি জনপদ হিসেবে নির্দিষ্ট স্থান বা অঞ্চলও ভেদাভেদ মুক্ত ছিল না। আদি তামিল কবিতায় উল্লিখিত তামিলহামকে যদি একটি বড় আকারের নাড়ুর বিশাল বিস্তৃতির সমতুল্য একটি পরিসর হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বড় মাপের জনপদের সঙ্গে তুলনীয়, তবে এর ভূক্ষেত্রকে উপস্থাপন করেছিল যে ভিন্নতাগুলো, সেগুলো কবির অনুভব ছিল। ভিন্নতাগুলো কেবল টপোগ্রাফির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। বিবিধ অনুভূতিমালার ভূক্ষেত্রকে কবিতাগুলো সামনে নিয়ে আসে। পাহাড় ও অরণ্য (কুরিঞ্জী), তটরেখা (নেতাল), নদীবাহিত প্লাবনভূমি (মরুতম), চারণভূমি (মুলাই) আর ভীতিকরভাবে শুষ্ক, পতিত জমি (পলাই)—এর মতো ভিন্ন ভিন্ন ভৌত ভূমিরূপের সৃষ্ট নানান মেজাজ ও অনুভূতি—প্রতিক্রিয়া কবিতাগুলো বর্ণনা করে।১৯ কিন্তু পুরাণাদিসমেত বেশিরভাগ লিখিত উৎসেই উদ্ধৃত জনপদগুলো একটি থেকে অন্যটি কীভাবে ভিন্ন ছিল তা উল্লিখিত হয় নাই। কেবল কোনটি কোন দিশায় (পূর্ব, পশ্চিম এবং এমনতরভাবে) অবস্থিত তা উল্লেখ করা আছে। জনপদ কিংবা নাড়ু– ছিল অসংখ্য। সময়ের পরিক্রমায় কয়েকটি জনপদ মিলে গিয়ে একটি মহাজনপদ, একটি রাষ্ট্র বা একটি দেশ গঠিত হতে পারত। একটি কালানুক্রমিক রূপরেখা অনুসারে নির্মিত ভারতের ঐতিহাসিক ভূগোল তৈরি করার জন্য একটি সামগ্রিক প্রচেষ্টা দরকার। যে পরিসর আদি লিখিত উৎসগুলোতে ভারতবর্ষ হিসেবে ধারণাকৃত হয়েছিল, এই প্রচেষ্টাই কেবল সেই পরিসরব্যাপী জনপদ, নাড়ু, মহাজনপদ, রাষ্ট্র এবং অন্যান্য হ্যাবিট্যাট/রাজনৈতিক এককগুলোর পরিবর্তনশীল সংখ্যা আর বিস্তৃতির বিন্যাস স্পষ্ট করতে পারে।

তবে সার্বভৌম শাসক সমগ্র দেশের উপরে (বা সেই পরিসরের উপরে যা চক্রবর্তীক্ষেত্র নামে ধারণায়িত হতো) রাজত্ব করতেন না। বহু শাসক কতৃর্ক সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির উপরে, ‘বিশ্ববিজেতার’ প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের উপরে সার্বভৌমত্ব নির্ভর করত

জনপদগুলো ছাপিয়ে গিয়ে পারিসরিক/রাজনৈতিক বিভিন্ন পরিসর সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার প্রতি এবং জনপদ ও নাড়–গুলোর দিকে ইঙ্গিত করার কারণগুলো হলো, এগুলোর প্রতিটি বনভূমি, গ্রাম আর নগরের বিন্যাসের সমন্বয়ে গঠিত পরিসর হিসেবে স্বীকৃত হতো।২০ এমন পরিসর যেখানে বিভিন্ন মানব সম্প্রদায় বাস করত। এসবের মাধ্যমেই সেগুলো নিজেদের পরিচয় পরিবেশন করতো, অন্যদের কাছেও পরিচিত হতো। জনপদের সংখ্যা যেমন বহু হতো, তেমনই বহু ছিল ক্ষমতাধর শাসক । একজন সার্বভৌমের উদ্ভবের সম্ভাবনা তাত্ত্বিকভাবে স্বীকৃত ছিল, বাস্তবে প্রত্যাশিতও ছিল, এবং এই সার্বভৌম একজন চক্রবর্তী (যার রথের চাকা চিরন্তন গতিতে, কোনও বাধাবিঘ্ন ছাড়াই চলতে থাকে) হিসেবে বিবেচিত হতেন। তবে সার্বভৌম শাসক সমগ্র দেশের উপরে (বা সেই পরিসরের উপরে যা চক্রবর্তীক্ষেত্র নামে ধারণায়িত হতো) রাজত্ব করতেন না। বহু শাসক কতৃর্ক সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির উপরে, ‘বিশ্ববিজেতার’ প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের উপরে সার্বভৌমত্ব নির্ভর করত।২১ এমন না যে, বিভিন্ন এলাকার দখল ও সংযুক্তিকরণ ঘটত না। কিংবা বিভিন্ন অঞ্চলের সাম্রাজ্যগুলো তাদের শাসনাধীন এলাকার মধ্যে প্রশাসনিক সমরূপতা কায়েম করার জন্য কোনও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করত না। তাসত্ত্বেও, ঐতিহাসিক শাসকবর্গ তাদের প্রশস্তিকারদের রচিত দীর্ঘ প্রশস্তিতে যখন তাদের সমসাময়িক শাসক ও রাজত্ব জয়ের বিশাল তালিকা দিতেন, তখন অতিরঞ্জিত বিজয়ের কথা মূলত প্রয়োজনীয় অলঙ্কারসর্বস্ব ছিল। তাদের সার্বভৌমত্বের দাবি এবং প্রধান সকল যাগযজ্ঞ নিষ্পন্ন করার (কখনও কখনও তা সংখ্যায় হাজার হাজার) যে দাবি, তা একজন চক্রবর্তী সম্রাটের যোগ্যতার প্রয়োজনের সঙ্গে২২ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। এই দাবির সঙ্গে যুক্ত ছিল বহু পরাভূত ও অনুগত শাসকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রসঙ্গও । এই সম্পর্ক সর্বদা এদিক—ওদিক করত। কারণ, রাজনৈতিক চিন্তকগণ প্রস্তাবিত রাজ্যশাসনের জন্য আদর্শ রূপরেখার মধ্যে শত্রুর উপস্থিতির পূর্বকল্পনা করেছিলেন। রাজণ্য—চক্রের (মণ্ডল) ধারণার যে—কোনো বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই মণ্ডলের ভিত্তি ছিল, শত্রু হোক বা মিত্র হোক একদল শাসকের উপস্থিতি। দিগ্বিজয়ের (বিজিগিষু) মাধ্যমে একজন সার্বভৌমের মর্যাদা অর্জনের বাসনাতাড়িত রাজাকে এই শাসকগণ পরিবেষ্টিত করে রাখবেন। মনুস্মৃতি২৩ আর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র২৪ — দুটোতেই বিপুল সংখ্যক উপাদানের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এই উপাদানগুলো একটি রাজ্যের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনকারী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রাজণ্য—চক্রের অবয়ব সম্পর্কে একটি ধারণা কৌটিল্যও তৈরি করেছেন নিম্নবর্ণিতভাবে২৫ :

‘চক্রের বিভিন্ন অংশ হিসেবে রাজণ্যবর্গ একে অন্যের থেকে আলাদা থাকেন একটি (মধ্যবর্তী জায়গার মাধ্যমে)। একদল থাকেন চক্রের বৃত্তাকার বাইরের দিক (নেমি) হিসেবে। যারা ঘনিষ্ঠ তারা থাকেন নেমি ও কেন্দ্রকে সংযোগকারী দণ্ডগুলো (অর) হিসেবে। নেতাকে কেন্দ্র (নাভী) হিসেবে অবস্থান করে নিজেকে বাইরের দিকে প্রসারিত করা উচিত।



নেতা ও তার মিত্রবর্গের মধ্যবর্তী পরিসরে অবস্থান করা শত্রুরা যদি শক্তিশালীও হয়, তাহলে তাদেরকে ধ্বংস করা বা যন্ত্রণা দেয়া সহজ হয়।’

কেন্দ্রসমেত একটি চাকার চিত্ররূপ সত্ত্বেও কৌটিল্য আর অর্থশাস্ত্র বিষয়ক চিন্তকগণ অবশ্যই একটি কেন্দ্রের ভিত্তিতে কিংবা কেন্দ্রাভীগতা বা কেন্দ্রতীগতার ভিত্তিতে ভাবেন নাই। কৌটিল্যের আশ্বস্তকরণে প্রতিভাত হয় যে, দিগ্বিজয়ীর অবস্থান ছিল উন্মুক্ত: ২৬

‘ছোট জায়গায় শাসন করলেও কারও (রাজার) যদি ব্যক্তিগতভাবে নানাবিধ উপাদানের উৎকৃষ্টতার সঙ্গে সম্মিলিত হওয়ার গুণাবলি থাকে, রাজনীতির (বিজ্ঞানের) সঙ্গে পরিচিতি থাকে, তবে তিনি সমগ্র দুনিয়া জয় করেন। কখনও পরাভূত হন না।’

ধর্ম, রীতি, প্রবৃত্তি আর অন্যান্য ভিন্নতা

বলা হয়েছিল জনপদ অগণিত। এই জনপদগুলো নির্দেশ করত সেইসব পরিসর যেগুলো কোনও ব্যক্তি বা কোনও সম্প্রদায়ের আবাস ছিল; জনপদগুলোর আকার বা আকৃতি যাই হোক না কেন। একটি জনপদকে আরেকটি জনপদ থেকে কী কী আলাদা করেছে, সেই সম্পর্কে আদি লিখিত উপাদানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরব।


বলা হয়েছিল জনপদ অগণিত। এই জনপদগুলো নির্দেশ করত সেইসব পরিসর যেগুলো কোনও ব্যক্তি বা কোনও সম্প্রদায়ের আবাস ছিল; জনপদগুলোর আকার বা আকৃতি যাই হোক না কেন। একটি জনপদকে আরেকটি জনপদ থেকে কী কী আলাদা করেছে, সেই সম্পর্কে আদি লিখিত উপাদানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরব। উদাহরণস্বরূপ, আনুমানিক আর কখনও কখনও বেঠিক ভৌগোলিক অবস্থানের প্রসঙ্গ বাদ দিলে, অঙ্গ থেকে মগধের কী ভিন্নতা ছিল, । ভিন্নতার মানদণ্ড সম্পর্কে একধরনের ইঙ্গিত রয়েছে। সেখানে ধর্মের বহুত্বের অস্তিত্বের প্রসঙ্গ আছে। এই বহুত্ব এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে ভিন্ন ছিল ঠিক তেমন নয়। তাসত্ত্বেও বিভিন্ন নীতিমালা, আচার ও রীতির প্রচলনের দিকে একধরনের ইঙ্গিত তো বটেই। তা সত্ত্বেও, ষোড়শ শতকের যোগিনী—তন্ত্রের একটি ভাষ্যে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও এলাকার সঙ্গে ধর্ম এক অর্থে সম্পর্কিত ছিল।২৭ যোগিনী পীঠে [আসাম] ধর্ম কিরাত থেকে উদ্ভূত। এখানে ‘কিরাত’ পদটি উত্তরাঞ্চলীয় জনমানুষের জন্য কম বেশি ব্যবহার করা হয়। ধর্ম পরিশেষে দুরধিগম্য। বিভিন্ন জায়গায় প্রাজ্ঞ২৮ লোকজন যেসব চর্চা করেন, সেগুলোকেই ধর্ম হিসেবে প্রতিনিধিত্বশীল বিবেচনা করা যেতে পারে। যখন কোনও রাজা যুদ্ধ করতে আর অন্য দেশ দখল করতে বাধ্য হন, তখনকার একটি নীতি হিসেবে মনু এমনই পরামর্শ দেন।২৯ সম্ভবত, স্থানীয় রীতির দীর্ঘস্থায়ী শক্তিমত্তার কারণেই :

‘তাদের [অধিবাসীদের] ভাষ্য, যেভাবে নিজস্ব দেশাচারকে চিহ্নিত করে সেভাবেই তাকে [রাজাকে] কতৃর্ত্বশীল দেশাচারগুলো বলবৎ রাখা উচিৎ। ধনরত্ন প্রদান করে তাকে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সঙ্গে (নতুন রাজাকে) সম্মান করা উচিত। [তৃতীয় বন্ধনীতে প্রদত্ত শব্দগুলো অনুবাদকের]’


মনু আরো বলেন,

‘একজন (দিগ্বিজয়ী) রাজা একজন দৃঢ় মিত্র অর্জন করার মাধ্যমে যত ক্ষমতা বাড়াতে পারেন ততটা সোনা—দানা অধিকার করে ও রাজ্য দখলের মাধ্যমে পারেন না। সেই মিত্র যদি দুর্বলও হন (এখন, হয়ে উঠতে পারেন) ভবিষ্যতে সক্ষম।’


কেবল মনুই বিভিন্ন ধর্মের অব্যাহত ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পরামর্শ দেন নাই। যাজ্ঞবল্ক-স্মৃতির৩০ মতো অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রও এসব পরামর্শও দিয়েছে যে,

‘নিজ দেশ [রাষ্ট্র] শাসন করার ক্ষেত্রে রাজার যে ধর্মই বজায় থাকুক, একই ধর্ম অধীনতা স্বীকারকারী অপরাপর রাষ্ট্র [পররাষ্ট্র] সুরক্ষায় রাজার জন্য প্রযোজ্য। (অধীনে নিয়ে আসা দেশের) আচার, ব্যবহার, কুলস্থিতি – যাই হোক না কেন, সেগুলো যেমন আছে তেমনভাবেই বলবৎ রাখতে হবে।’


বিভিন্ন ভেদ (সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যাবলি) এবং বৃত্তি (জীবিকার উপায়) সংরক্ষণের উল্লেখ করে এই সুপারিশ আরও স্পষ্ট করা হয়েছে।

মনু—স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক—স্মৃতি কিংবা নারদ—স্মৃতির মতো আদর্শস্থাপনমূলক টেক্সট একদিকে রাজনৈতিক পরিসরে স্পষ্টতই স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম নিয়ে আলাপ করেছে। অন্যদিকে, নাট্যশাস্ত্র ও কাব্যমীমাংসার মতো যেসব লেখা অরাজনৈতিক হিসেবে বিবেচিত সেগুলোও বিভিন্ন ছাঁচের ভিন্নতার উল্লেখ করেছে। জীবনধারার বিভিন্ন গুঢ় ব্যঞ্জনার মধ্যকার ভিন্নতা, পুরুষ ও নারীর চলনে—বলনের ভিন্নতার প্রতি নজর দিয়েছে। এসব ছাঁচ অনুসারে একটি জনপদ, বা একটি এলাকা কিংবা একটি অঞ্চলের সঙ্গে অপর একটি কীভাবে সম্পর্কিত তা বিবেচনা করতে হবে এদের পরস্পরের ভিন্নতাগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক হিসেবে। লিখিত বিভিন্ন সূত্রে উল্লিখিত ছাঁচ বা আদলের বোঝাপড়া অবশ্যই দুরূহ। বিভিন্ন লিখিত সূত্রের বিভিন্ন জায়গায় যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো ঐতিহাসিক সত্য নাও হতে পারে। তবে বিভিন্ন সমসাময়িক উপলব্ধি এবং মনোভঙ্গির ইশারা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে। কোনও একটি লিখিতসূত্রে যদি একটি জনপদের একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়ে থাকে, তবে অন্য আরেকটিতে সম্পূর্ণ ভিন্নমত প্রকাশ করা হয়েছে। এধরনের লিখিত উৎসগুলো, বা সাধারণভাবে যেকোনো লিখিত টেক্সট নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে একজনকে তাই এগুলোতে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান ও বৈশিষ্ট্যাবলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। এই উপাদান ও বৈশিষ্ট্যগুলো এক জনপদের সঙ্গে আরেক জনপদের ফারাককে নজরে আনার জন্য উল্লেখ করা হয়েছিল। একথা বলার মানে হল, বিভিন্ন টেক্সট সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নিয়ে কোনও বিবৃতি প্রদান করে না। বরং টেক্সটগুলো ভিন্ন ভিন্ন ফারাকগুলোর সম্পর্ককে বিবৃত করে। বলায় আর লেখায় ভাষা ও ভাষার ভঙ্গিগুলো যেভাবে সঞ্চালিত হতো তাকে নিয়মিতভাবেই ভিন্নতা বা ফারাকের প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শন করা হতো। তবে ভিন্নতাকে চিহ্নিত করার আর দাগিয়ে দেয়ার জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রও ছিল। পণ্ডিতগণ ভরতের যে জীবনকালই নির্ধারণ করুন না—কেন, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির নানাবিধ প্রকাশভঙ্গির ধরনের মধ্যে ভিন্নতার বিচলন ভরতের নাট্যশাস্ত্রের লেখায় খোঁজ করা যায়। নাট্যর (নাটক) উদ্ভব নিয়ে লিখতে গিয়ে শুরুতে৩১ নানারকম প্রয়োগের সমস্যা নিয়ে আলাপ করেন ভরত এবং ভারতী, সাত্বতী, আরভটী এবং কৈশিকী বৃত্তি তালিকাবদ্ধ করেন। বলা হয়েছে, এগুলোর মধ্যকার ফারাক উৎপন্ন হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জনে (বা জনসমষ্টিতে) যেগুলো থেকে বিভিন্ন রীতির উদ্ভব হয়েছে। কৈশিকী বৃত্তি সফলভাবে পালন করার করার জন্য ব্রক্ষ্মা যে অপ্সরাদের সৃষ্টি করেছিলেন তাদের নামের মধ্যে মাগধী আর কেরলের মতন নাম থাকাও এমন রীতিগুলোর বহুবিধ উদ্ভবকে নির্দেশ করে। এই বহুবিধ রীতিকেই ভরত সংশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছিলেন। প্রবৃত্তি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে ভরত ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের নামে তাদের আরও নানা বর্গে বিভক্ত করেছিলেন, যেমন : অবন্তী, দাক্ষিণাত্য, পাঞ্চালী এবং ওড্র—মাগধী।

‘প্রবৃত্তি কী?’ ভরত জিজ্ঞেস করলেন।৩২ উত্তর হলো : যা আমাদের জানায় যে এই পৃথিবীতে বিভিন্ন পোশাক—আশাক, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা এবং আলাদা আলাদা রীতি বিশিষ্ট নানা দেশ রয়েছে। সত্যি সত্যি বিভিন্ন দেশ রয়েছে। কিন্তু কীভাবে আপনি তাদের চারটি দলে ভাগ করবেন? উত্তর হলো : বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে যেসব (দেশের তাদের একত্রে শ্রেণিভুক্ত করা)। যদিও ওইসব ভিন্নতা রয়েছে, বৃত্তির (উৎপাদনের ধরন) প্রতি লক্ষ্য রেখে, চতুর্বর্গীয় বিভাজনটা গৃহীত হয়েছে মানুষের কাছে (লোকানুমত)।’


অতিভাষা, আর্যভাষা, জাতিভাষা এবং জাত্যন্তরী—ভাষার মতো সংস্কৃত ও প্রাকৃতর বিভিন্ন বাচনভঙ্গির উল্লেখ করা ছাড়াও, বিভিন্ন ধরনের নাট্যভাষার কথা বলতে গিয়ে ভরত তালিকা করেন সাতটি আঞ্চলিক ভাষারীতির : মাগধী, অবন্তী, প্রাচ্যা, সূরসেনী, অর্ধমাগধী, বাহ্লীকা এবং দাক্ষিণাত্য।৩৩ অবশ্যই যে ভাষাভঙ্গিগুলো সংস্কৃত ও প্রাকৃতরই বিভিন্ন ধরন সেগুলোই নাটকে ব্যবহারের উপযুক্ত। তবে অন্যান্য ভাষার প্রচলন থাকার স্বীকৃতি ভরতে রয়েছে। যেমন : বর্বর, কিরাত, দ্রাবিড় ও অন্ধ্র জাতির মানুষজনের জন্য তাদের নিজস্ব ভাষার পরিবর্তে শূরসেন ব্যবহার করা যেতে পারে। ভরত ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সঠিক ভাষারীতি সুনির্দিষ্ট করে দেন আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য আরও ভাষার অস্তিত্বের ইঙ্গিত করেন।৩৪

‘যোদ্ধা ও নগররক্ষীদের প্রধানের জন্য ভাষা হওয়া উচিত দাক্ষিণাত্য, আর উত্তরে বসবাস করা খসদের জন্য বাহ্লীক। শবর ও শক, আর এদের স্বভাবসম্পন্ন অন্য জাতিদের জন্য শাকারী ভাষা, পুলস্ক ও তাদের মতোদের জন্য চাণ্ডালী ভাষা প্রযোজ্য।’


একইভাবে কিছু বানৌকসী [বনবাসী] সমেত কয়লাপ্রস্তুতকারক (অঙ্গারকার), শিকারি (ব্যাধ), যারা গাছপাতা কুড়িয়ে জীবনধারণ করেন (কাষ্ঠপত্রোপজীবিনাম্) তাদের জন্য শবর—ভাষা প্রযোজ্য। যারা হাতি, ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া ও উটের রক্ষক তাদের জন্য বিহিত হল আভীরী ও শাবরী ভাষা। সুরঙ্গখননকারী, সন্ধিকার (সিঁধ-কেটে চুরি করা চোর), এবং বিপন্ন নায়িকাদের আত্মরক্ষায় মাগধী প্রযোজ্য।৩৫


ভরত কতৃর্ক নাটক প্রযোজনায় নানাবিধ ভিন্নতার স্বীকৃতি ও অন্তভুক্তির্ কেবল তালিকা তৈরির উদ্দেশ্যেই ছিল না; সেগুলো উচ্চনীচক্রম ও মর্যাদাও প্রকাশ করেছিল। যেমন : প্রয়োগযোগ্য চার ধরনের ভাষার মধ্যে অতিভাষা কেবল দেবগণের আর আর্যভাষা কেবল রাজগণের চরিত্র রূপায়নের জন্য নির্দেশিত। ভারতবর্ষে (ম্লেচ্ছদেশপ্রযুক্তা চ ভারতবর্ষমাশ্রিতা) জাতিভাষা ‘বিদেশী’ শব্দের মিশ্রণে নানারকমে প্রচলিত ছিল। জাত্যন্তরী ভাষা (বিকল্পপাঠ : যোন্যন্তরী—ভাষা) ‘ছিল একটা নাটকে গ্রাম্য, অরণ্যচারী, ও পশু, পাখীর চরিত্রের জন্য’।৩৬


ভরতের বৃত্তি ও প্রবৃত্তির ধারণার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাজশেখরও প্রবৃত্তি নিয়ে আলাপ করেছেন। তিনি প্রবৃত্তিকে বেশ—বিন্যাস—ক্রম, ৩৭ বৃত্তিকে নৃত্য—গীত—কলাবিলাস—পদ্ধতি এবং রীতিকে বচন—বিন্যাস—পদ্ধতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। ভিন্নতা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে এসব বৈশিষ্ট্যই ভরত ও রাজশেখরের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল। তবে এসব সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের আলোকে বিবেচনা করলেও, বৈচিত্র্য এত ব্যাপক ছিল যে, রাজশেখর অনিবার্য প্রশ্নটিই উত্থাপন করেছিলেন আর সেটির উত্তরও দিয়েছিলেন: ‘যদি দেশ অসংখ্য হয় তবে বৃত্তি—প্রবৃত্তির কেবল চারটি শ্রেণির মধ্যে সকলকে অন্তভুর্ক্ত করা যাবে কীভাবে?’ এই প্রশ্নে রাজশেখরের উত্তর ছিল ভরতের অনুরূপ : ‘চক্রবর্তী—ক্ষেত্রের [ভারতবর্ষের] সাপেক্ষে দেশের সংখ্যা যদি অনন্ত হয়, তাদের চারটি শ্রেণিভুক্ত করে কল্পনা করা হয়ে থাকে। তাই অনন্ত সংখ্যক (দেশের) কথা ভাবা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় [এদের মধ্যে অবান্তর—বিভাগহেতু দেশের সংখ্যা আবার অনন্তই হয়ে পড়ে]।’৩৮ চলতি বৈচিত্র্যের এমন ব্যাপকতার নিদান দেয়ার জন্য ভরত আর রাজশেখরের এই প্রচেষ্টা বিশৃঙ্খল ফারাকগুলোর দশাকে কোনোরকম একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার প্রয়োজন প্রসঙ্গে তাদের উদ্বেগই প্রকাশ করে।


কাম শাস্ত্র নামের আরেক প্রকারের টেক্সটের দিকে নজর দিতে চাই। এতক্ষণের আলাপে স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, অনুমিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি ও আরোপিত চালচলনের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে কতগুলো আদল বা ছাঁচ নির্মাণের একটা প্রবণতা টেক্সটগুলোর রয়েছে। তাসত্ত্বেও, এমনকি এসব অপ্রমাণিত বৈশিষ্ট্যাবলিও বিবিধ ভিন্নতার অস্তিত্বের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনুমিত হতে হতো। মানবজীবনের অন্যতম আবশ্যকীয় অভীপ্সা হিসেবে কামের (শরীরী প্রেমের পাশাপাশি বাসনা) পরিক্ষেত্রে তাত্ত্বিকগণ, বিশেষত বাৎসায়নের মতো কামসূত্রের লেখক, চালচলন আর বিভিন্ন যৌনাচারকে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন ‘বিভিন্ন অঞ্চলের আচারের’ (দেশশাতম্যাচ্চ যোষিতঃ উপাচারেত) আওতায়। কামসূত্রের নির্দেশনা হলো :৩৯ ‘একজন নারীর আঞ্চলিক প্রকৃতি অনুসারে একজন পুরুষ ওই নারীর সঙ্গে আচরণ করবেন।’ বাহ্লীক ও অবন্তিকার পাশাপাশি মধ্যদেশের নারীদের ‘অপ্রচলিত রতিক্রিয়ার অনুরক্ত বললেও’ এই টেক্সট তাদের চুম্বন, নখক্ষত ও দন্তদংশন বিমুখ বলে চরিত্রায়িত করে। একইভাবে, ‘মালব ও অভীরার নারীদের নিজস্ব পছন্দ—অপছন্দ যেমন রয়েছেম, তেমনই সিন্ধু ও অন্য পঞ্চনদী বিধৌত ভূমির অধিবাসী নারীগণ মুখ—মুখমৈথুন পছন্দ করেন।’ এই টেক্সটটি কোঙ্কন ও লাট, স্ত্রী—রাজ্য এবং কোশল, আর অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, দ্রাবিড়, বনবাস, মগধের পাটালিপুত্র ও গৌড়ের নারীগণের যৌনাভ্যাস নিয়ে আলাপ করতে থাকে। একবারে উল্টো দৃষ্টিভঙ্গি টেক্সটে অন্তভুর্ক্ত হয়ে জোর দিয়ে বলতে পারে যে, অঞ্চলের তুলনায় ব্যক্তির প্রকৃতি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, ‘স্থানীয় রীতি এক্ষেত্রে কোনও বিষয় নয়’, সময়ের পরিক্রমায় আচরণ, বেশভূষার ধরন, আর খেলাধুলা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।’৪০ নানাবিধ ভিন্নতাকে অবশ্যই অতিক্রম করা যেতে পারে। তবে যখনই কোনও শ্রেণিকরণের রূপরেখা নির্মাণ করা হয়েছে তখনই আবশ্যকীয় উপলব্ধি হিসেবে ভিন্নতাগুলোকে আমলে নেয়া দরকার পড়েছিল।


অবশ্যই বলা দরকার যে, সামগ্রিকভাবে কিংবা প্রত্যক্ষণগতভাবে শ্রেণিকরণের এমন রূপরেখাগুলোকে নিরিখ করা সম্ভব নাও হতে পারে। লিখিত বিভিন্ন উৎসে অঞ্চলসমূহের বৈশিষ্ট্যের বিবরণ এবং শ্রেণিকরণ নিরপেক্ষও ছিল না, নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার অভিপ্রায়—প্রসূতও ছিল না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভিন্নতার বৈশিষ্ট্যায়ন উচ্চনীচক্রম প্রকাশ করতো এবং অনুধাবনকৃত গুণাবলির সাপেক্ষে বিভিন্ন মূল্যবিচারমূলক হতো। এসব সাধারণীকরণ বিশাল ব্যাপ্তিজুড়ে ছিল। অঞ্চলের ও বর্ণগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি, বিভিন্ন জাতিসমষ্টির চরিত্র, যৌনাভ্যাসের ঝোঁক, সামাজিক রীতি, বাচনভঙ্গি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মাচারের সঙ্গে সম্পৃক্তি এই ব্যাপ্তির অন্তভুর্ক্ত ছিল। সেজন্যেই, এত এত ভিন্নতা আর বৈশিষ্ট্যের গোলকধাঁধায় সমাজের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ার কোনও সম্ভাব্য বিন্যাসের একটা ছাঁচ তৈরি করার চেষ্টা করা প্রায় অসম্ভব।


সম্ভবত, হয় ভাষিক নয়ত জাতিগত অর্থে ভিন্নতার অনুধাবনগুলোর সবচেয়ে ভালো আদি নমুনা কতগুলো বিশেষ বর্গের টেক্সটে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এই টেক্সটগুলো বৈশিষ্ট্যগতভাবে কোনও সম্প্রদায় সম্পৃক্ত না, এমনকি সশ্রদ্ধও না। খ্রি. সাধারণ কালপঞ্জির প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়কালীন হিসেবে চিহ্নিত একাঙ্কিকা বা ভাণ এই বর্গের টেক্সটের উদাহরণ।৪১ কোনও—না—কোনও বড় নগর, যেমন উজ্জয়িনী, পাটালিপুত্র বা এমন কোনও নগরের পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত নাটকে বিচিত্র জায়গা থেকে আসা মানুষের ব্যতিক্রমী লক্ষণা নিয়ে একজন পর্যবেক্ষক—কথকের নানারকম পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা থাকত। উদাহরণস্বরূপ, ভাণ পাদতাড়িতকে৪২ শক, যবন, তুষার, পারসিক, কিরাত, কলিঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, অঙ্গ, মহীষক, পাণ্ড্য, কেরল, ইত্যাদি নানা এলাকা ও লোকজনের কথা উল্লিখিত হয়েছে। নাটকের পর্যবেক্ষক—কথক বিট কাম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন এলাকার রীতিনীতি প্রসঙ্গেই (স্ব – দেশৌপায়িকম)৪৩ বারবার বিরক্তিসহ আলাপ করছেন। কীভাবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আচার—আচরণ করেন তা নিয়ে সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ঠাট্টা—তামাশা করছেন। লাটর দিণ্ডিকাদের প্রসঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তিনি বলেন :৪৪

‘[এরা] পিশাচের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন না। কারণ, এরা ন্যাংটো হয়ে স্নান করে। এমনকি মানুষজনের সামনেই নিজেদের কাপড়—চোপড় নিজেরাই ধোয়াধুয়ি করে। চুল এলোমেলো রাখে। পা না ধুয়েই বিছানায় শুতে যায়। হাঁটতে—চলতে এটা সেটা খায়। ছেঁড়া কাপড় পড়ে। কারও দুর্বল জায়গায় আঘাত করার পরে সে যখন কাতরাতে থাকে, তখনও এরা নিজেদেরকে সাহসের জন্য বাহবা দিতে থাকে।’


নাটকের মধ্যে আরেক জায়গায় একজন কর্মকর্তা প্রসঙ্গে বিটর মতামত হল :৪৫

‘… তার চুল বেনী করে উপরে তোলা আর কানে কলসের মতন কুন্তল। জ—আওয়াজ করে (য—এর বদলে) লাটদের মতন মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে। … সব লাটই তাদের দুই বাহু ঘিরে রেখে উত্তরীয় পরে। কোমড়ে বেড় দিয়ে গিঁট দিয়ে কাপড় পরে। দেখা—সাক্ষাৎ করতে আসা মানুষজনকে সম্বোধন করে শ—ধ্বনিতে (স—এর বদলে) আর পা ফেলে ঝুঁকে ঝুঁকে।’


দিণ্ডিদের প্রসঙ্গে বিট আরও নানারকম অবমাননাকর মন্তব্য করেন। তার কাছে দিণ্ডিরা বানরের চেয়ে আলাদা কিছু না। একই নগরের দাশেরকদের সম্পর্কে ভিটার প্রতিক্রিয়া নিম্নোল্লিখিতভাবে ব্যক্ত হয়েছে :৪৬

‘এই যে একজন পুরুষ যার মুখ পাঠার মতন। যার নিম্নাঙ্গ একখণ্ড কাপড়ে ঢাকা থাকে। যার কাঁধ ঘন লোমে ঢাকা…সে একটা মুলা চাবাতে চাবাতে আসে। যদি দাশেরক না হয় তাহলে এ নিশ্চয়ই পিশাচ … এই দাশেরককে দেখার ফলে দুষিত চোখকে আমি কোথায় ধুয়ে পরিষ্কার করব?’


একইভাবে,

‘সৌরাষ্ট্রের লোকেরা আর বানর একই প্রজাতির। দাঁত আর চোখই কেবল সাদা এমন অন্ধকারের দেবী [হিসেবে বর্ণিত] বরবরী গণিকাদের প্রতি তাদের আসক্তি আছে।’৪৭


একই নগরের যবন গণিকাগণ বানরী, এবং মালব অঞ্চলের, আর কামাবেগে আসক্ত কোনও পুরুষ হলো গাধা। একজন গায়ক ও এরা সকলেরই একটা সাধারণ মিল রয়েছে প্রকৃতিগতভাবে।৪৮ এই নাট্যলিখনীর বিশ্লেষণ অনুসারে ব্রহ্মা সবসময়ই এক ধরনের জিনিসকে একত্রে নিয়ে আসায় পটু। আরও স্পষ্ট করার জন্য বিট যোগ করেন :

‘… কখনো কখনো তর্জনী উচু করে কথা বলা আর বানরের মতন কিচমিচ করে আওয়াজ করে কর্কশ স্বরে আর অস্পষ্ট ব্যাঞ্জনধ্বনী বহুল উচ্চারণে যবন গণিকাদের আলাপ কে আর শুনবে?’ ৪৯


প্রত্যাশিতভাবেই, গান্ধার অঞ্চলনিবাসী আরেকটি চরিত্রকে একই নাটকে হস্তি—মুর্খ হিসেবে বর্গভুক্ত করা করা হয়েছে।৫০ ঠিক এভাবেই একাদশ শতকে রচিত প্রবোধচন্দ্রোদয় নামের আরেকটি রূপকাত্মক নাটকে রাঢ় অঞ্চলবাসী একটি চরিত্রকে অহঙ্কারের অবতার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।৫১ যেমনটা ধারণা করা যায় ঠিক তেমনভাবেই সেই চরিত্রই নিজের সুযোগ আসলে ‘পুরো জগতকেই মুর্খে ভরা’ (অহো মূর্খবহুলং জগত) হিসেবে দাগিয়ে দেন।৫২


এখন পর্যন্ত যা যা উদ্ধৃত হল সেই বক্তব্যগুলো একটি ঐক্যের চৈতন্যের দিকে না, বরং পারস্পরিক অবিশ্বাসমূলক বৈচিত্র্যের দিকে নির্দেশ করে। সহিষ্ণুতার একটা স্টেরিওটাইপ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসতত্ত্বে বহাল থাকলেও, পারস্পরিক বোঝাবুঝির এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বিভিন্ন ধর্মমত এবং সম্প্রদায়ের পরিসর অব্দি বিস্তৃত করলে একই ধরনের রূপ উন্মোচিত হবে। বিভিন্ন বাদ (বা মতবাদের) মধ্যের প্রতিরুদ্ধতার ঐতিহ্য বেশ পুরোনো। বুদ্ধের সমসাময়িককালের মধ্যেই সম্ভবত উত্তর ভারতেই অনেকগুলো মতবাদ এবং বিশ্ববীক্ষার অস্তিত্বের প্রমাণ লিখিত বিভিন্ন উৎসে পাওয়া যায়। সবগুলোই একমাত্র সত্য হওয়ার দাবি করেছিল।৫৩ অবশ্য যে—কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন যে, ভিন্নতা বা বিরোধ থাকলেও ভিন্নতার স্বীকৃতি আর সেগুলোর প্রতি সম্মান দেখানোও ছিল। যেমন সম্রাট অশোক প্রচার করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে।৫৪ সমাজে বহুত্বের সহাবস্থান নিশ্চিত করেছিল এই স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন। তবে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহিষ্ণুতার জন্য অশোকের বার্তা খুবই অনন্য ছিল। এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উল্টোদিক থেকে বিবেচনা করা যায়। অশোকের বার্তা প্রচার সহিষ্ণুতার অনুপস্থিতির স্বীকৃতিও বটে। যে—কারণে রাষ্ট্রের বা সম্রাটের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়েছিল। ভারতীয় দর্শনের সমগ্র ইতিহাস একটা প্রাথমিক ফারাক দিয়ে শুরু হয় : বেদের কতৃর্ত্বকে মান্যতা প্রদান করে বলে মনে করা হয় এমন বাদ বা মতবাদ।৫৫ অবশ্যই ভাবা উচিত না যে, বেদ উল্লেখ করে বৈধতা চাওয়া সকল মতবাদ একটা সমরূপ বর্গ গঠন করেছিল। বৈদিকের ‘অপর’ অর্থাৎ না—বৈদিক, বা অন্যভাবে বললে অবৈদিক মতবাদগুলো কেবল নাস্তিক কিংবা চার্বাকদেরই প্রতিনিধিত্ব করত না। সৌগত বা বৌদ্ধমতাবলম্বীগণ, নিগ্রন্থ বা ক্ষপণকরা, অথবা জৈন মতাবলম্বীরা এই ‘অপরের’ অন্তভুর্ক্ত ছিল। ইতিহাসের চলার পথে এদের প্রত্যেকেই অনেক ভাগে বিভক্ত হতে থাকেন। তখনও নতুন মতবাদ আর নতুন নতুন সম্প্রদায়ের উদ্ভব হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ফাঁকা জায়গা অবশিষ্ট ছিল। আদিকালের ভারতে, কিংবা সেভাবে বললে ভারতীয় ইতিহাসের অন্যান্য যুগগুলোতেও বিভিন্ন পন্থী সম্প্রদায়গত চিত্রের মাঠপর্যায়ের প্রকৃত বাস্তবতা এমন ছিল যে, একটি হেজিমোনিক মতবাদ কিংবা বিশ্বাস ( যেটিও পুনর্মিলনের অযোগ্য কতগুলো খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পরতে পারত) অনুপস্থিত ছিল। এই অনুপস্থিতির কারণে প্রতিপক্ষতা, বিরুদ্ধতা, বিদ্রুপ, শরীরী সহিংসতা, আর অবশ্যই, সৌহার্দ্যপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমেও ভেদাভেদগুলো পরস্পর লেপ্টালেপ্টি করে সঞ্চালিত হয়ে থাকতে পারত। অভূতপূর্ব জটিলভাবে একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার পরিস্থিতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের, ধর্মাচরণের, ও প্রতিষ্ঠানের আর আচারপালনকারী দলগুলোর আন্তঃসম্পর্কের বিন্যাসগুলোকে স্পষ্ট করে তোলার কোনো সহজ সূত্র নাই। সম্পর্কের এই বিন্যাসকে সরলভাবে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অথবা সংশ্লেষ ও সমন্বয়বাদের অভিব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করাকে উগ্রতা, ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়ন ও সহিংসতার ঐতিহাসিক উদাহরণগুলো খারিজ করে দেয়।৫৬ মতাদর্শিক দুরত্ব আর তিক্ততার বিভিন্ন অভিব্যক্তির আলামত লিখিত সূত্রগুলোর মধ্যে অসংখ্য পাওয়া যায়। তবে সেগুলোর অপরিসীম জটিলতা বিশদভাবে উল্লেখ করার দরকার নাই। ভিন্নতা প্রসঙ্গে প্রদত্ত মতামতগুলোকে স্পষ্ট করার জন্য আদি লিখিত উৎসগুলো থেকে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়ার মধ্যেই আমি সীমাবদ্ধ থাকব। নীলকেশী নামের দক্ষিণ ভারতীয় একটি জৈন টেক্সট থেকে প্রথম উদাহরণটি পাওয়া যেতে পারে।৫৭ সম্পাদনাকারী টেক্সটির সময়কাল নির্ধারণ করেছেন আনুমানিক খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী। নীলকেশী নামের একজন জৈনমতে দীক্ষিত নারীকে নিয়ে লিখিত এই টেক্সট। একের পরে এক নানাবিধ মতবাদ বা বাদকে মিথ্যা প্রমাণ করার কাজে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। এই মতবাদগুলো হলো : কুণ্ডলকেশী—বাদ, অর্কচন্দ্র—বাদ, মোকাল—বাদ, বুদ্ধ—বাদ, আজীবক—বাদ, সাংখ্য—বাদ, বৈশেষিক—বাদ, বেদ—বাদ এবং ভূত—বাদ। এই লেখাটিতে আরেকজন রূপবতী জৈন নারীর গল্প বলা হয়েছে। প্রতারণা করে এই নারীকে এক বৌদ্ধমতাবলম্বী ঘরে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু অতিথি হিসেবে আসার পরে ওই ভিক্ষুর জন্য মাংসের একটা পদ রাঁধতে তাকে বলা হয়। তখন মাংসাহারী বৌদ্ধদের সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে তার দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। এই দুদর্শা কমানোর জন্য ওই ভিক্ষুর খানিকটা সময়ের জন্য রেখে যাওয়া চামড়ার জুতা দিয়ে তিনি মাংসের একটা সুস্বাদু পদ রান্না করেন। এই প্রতারণা ফাঁস হয়ে যায় আর শাস্তি হিসেবে স্বামীর ঘরের লোকজন শহরের সবচেয়ে অসতী নারী হিসেবে তাকে অপবাদ দেয়। দৈব হস্তক্ষেপে প্রকৃতঅর্থেই শহরের সবচেয়ে সতী নারী হিসেবে তার পরিচয় পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে গল্প শেষ হয়। নিজস্ব বিশ্বাসের সমর্থনে প্রতারণামূলক কাজ করা এভাবেই পুণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়, আর নিজের মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার আখ্যানে ন্যায্যতা অর্জন করে। এক্ষেত্রে নিজে হলেন জৈন মতবাদের অনুসারী। একদিকে একটি ব্রাহ্মণ্য উপদেশ হল,৫৮ হাতির তাড়া খেলেও কারও কোনও জৈন মন্দিরে প্রবেশ করা উচিত না। অন্যদিকে, জৈন আখ্যানগুলোতে আবার বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণ আর বৌদ্ধদের দেখানো ভ্রান্ত পথে যারা চলছে, কেবল জৈন আচার্যরা সুরক্ষা দিলেই তারা সত্য খুঁজে পাবে।৫৯ চূড়ান্তভাবে পুণ্য ও পাপের মধ্যের রূপক যুদ্ধে রূপ নেয়া বিভিন্ন মতবাদের মধ্যের সংঘাতের আরেকটি দুর্দান্ত আলামত হল চাণ্ডেলা শাসনের সময়কার একাদশ শতকে কৃষ্ণ মিশ্র বিরচিত প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক।৬০ এই নাটকে পাপ উপস্থাপিত হয়েছে নানা নেতিবাচক চরিত্রের মাধ্যমে, যেমন : কাম—রতি (শরীরী ভালোবাসা ও কামনার পুরুষ আর নারী রূপ হিসেবে), মহারাজ মহামোহ, বিভ্রমবতী, মিথ্যাদৃষ্টি, দম্ভ, অহঙ্কার, ক্রোধ, ইত্যাদি। একইসাথে এই নেতিবাচক চরিত্রগুলো চার্বাক, দিগম্বর, শৈব, পাশুপাত, এবং সোমসিদ্ধান্ত বা কাপালিক রূপেও দেখানো হয়েছে। পুণ্য উপস্থাপিত হয়েছে বিষ্ণুভক্তি, মতি, শান্তি, করুণা, মৈত্রী, রূপের পাশাপাশি সরস্বতী, উপনিষদ, যজ্ঞ—বিদ্যা ইত্যাদি হিসেবে। প্রত্যাশিতভাবেই, পুণ্য যখন পাপ বা মন্দকে পরাজিত করে, তখন পাপ বিভিন্ন দিকে ছুটে পালিয়ে যায়: সৌগত বা বৌদ্ধদের দিকে, সিন্ধু, গান্ধার, পারসিক, মগধ, হূণ, বঙ্গ, কলিঙ্গর দিকে। এই সকল জায়গাই পুণ্যময় মধ্যদেশ থেকে দূরবর্তী। একইভাবে দিগম্বর ও কাপালিকরা ছুটে যান মালব এবং আভীরে, অশিক্ষিতদের মধ্যে লুকানোর জন্য। একইভাবে, শৈব ও পাশুপতগণ ছুটে পালান তুরুস্ক দেশের পানে যেখানে ‘মানুষজন সম্মানিত অতিথিদের একটু পা—ধোয়ার জল আর বসার আসনও এগিয়ে দেয় না’। ‘শুদ্ধ’ টেক্সটগুলো অনুসারে, কেবল মধ্যদেশেই পুণ্য সুরক্ষিত হতে থাকে।


সুপরিচিত উপহাসমূলক নাটক, মত্তবিলাস—প্রহসনের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করেই এই প্রসঙ্গে আলাপ শেষ করব।৬১ এই নাটকটি সপ্তম শতকে পল্লব বংশীয় রাজা মহেন্দ্র—বিক্রম—বর্মন রচিত বলে ধারণা করা হয়। মনে করা হয়, জৈন মত পরিত্যাগ করে এই রাজা শৈব মত গ্রহণ করেন । নাটকের ঘটনাবলি সংঘঠিত হচ্ছে কাঞ্চিপুরমে। নাটকের চরিত্ররা হচ্ছেন একজন কপালিন (একজন কাপালিক সন্ন্যাসী), তার সঙ্গিনী দেবসোমা, একজন শাক্য—ভিক্ষু (বৌদ্ধ ভিক্ষু), এক পাশুপত সন্ন্যাসী এবং এক উন্মাদ। পোড়ানো মাংস ভরা কপালিন সন্ন্যাসীর কপাল—পাত্র [পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত করোটির উর্ধ্বাংশ] হারানো ও ফিরে পাওয়ার ঘটনাবলি নিয়ে নাটকটি রচিত। কপাল—পাত্রটি হারিয়ে ফেলায় কপালিন খুবই হতাশ কারণ, পাত্রটিকে তার কাজকর্মে কেন্দ্রীয় বলে মনে করেন তিনি : ‘আমার তপস ভেঙে গেল! আমি কীভাবে আর কপালি থাকবো!’ [ভ্রষ্টং ম তপঃ/কেনাহামীদানীং কপালী ভবিষ্যামি?] মদ্যপান তপসকে ব্রত—ভঙ্গের মতোই মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে বলে সদ্যই সঙ্গিনীও তাকে মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে বারংবার বলছেন। কপালীন সন্দেহ করে যে, হয় কোনও কুকুর নয়ত কোনও বৌদ্ধ ভিক্ষু মাংস ভরা কপাল—পাত্রটি চুরি করেছে (আসলে, কুকুর এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু উভয়েই মাংসাহারী)। তিনি কেবল বৌদ্ধ ভিক্ষুকেই চোর হিসেবে অভিযুক্ত করেন না। বুদ্ধকেও চোর—শাস্ত্রের (চৌর্য্য—কলার ম্যানুয়াল) লেখকের চেয়েও বড় চোর হিসেবে সাব্যস্ত করেন। কারণ, ‘যখন ব্রাহ্মণরা চোখের পলক ফেলেছে’, তখন স্বয়ং বুদ্ধ মহাভারত ও বেদান্তর বিভিন্ন ধারণা দিয়ে নিজের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন। একইসময়ে, বিভিন্ন বেদের প্রতি তার মনোভঙ্গিও খুব একটা ভক্তিমূলক না। অনবরত মাতলামির মধ্যে, এভাবেই কপালিন মদ্যশালাকে (সুরাপানো) বৈদিক যজ্ঞস্থানের সঙ্গে তুলনা করেন :

‘দেখ! দেখ!, বন্ধু! একটি যজ্ঞগৃহের মতই এই সুরাখানা বৈভবময়। এখানকার ধ্বজ—স্তম্ভ হল যজ্ঞ—স্তম্ভ; যারা পান করছে তারা হল পুরোহিত [ঋত্বিজ]; জগগুলো হল সোম পাত্র [চমষাঃ]; ঝলসানো খাবার মাংস [শূল্য—মাংস] হল বিশেষ ঘ্রানের নৈবেদ্য [উপ—দংশ—হাবির—বিশেষঃ]; মাতালদের—আলাপ হল যজুর শব্দমালা; তাদের গান হল সাম গীত/ তৃষ্ণা হল আগুন; আর মদ্যশালার মালিক হল যজ্ঞের যজমান।’


মত্তবিলাস—প্রহসন নাটকের সমাপ্তি ঘটে এক আশ্চর্যজনক সৌহার্দ্যর বার্তায়। তবে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যকার ভেদাভেদের প্রসঙ্গগুলো নাট্যভিনয় ধরনের ছিল না। সেগুলো বাস্তবিকই ছিল। বাস্তবতার একদিক যদি পুনর্মিলন আর ভেদাভেদের নিরসন হয়, অন্য পরিপূরক বাস্তবতা নানাবিধ বৈপরীত্যের উপস্থাপক : সেই বাস্তবতা হল চাপা উত্তেজনার, দ্বন্দ্বের, প্রতিরূদ্ধতার, আর এমনকি সহিংসতার।৬২ উপযুর্ক্ত পর্যালোচনা করা হয়েছে বিভিন্ন ভাষ্যের মধ্যে সঞ্চালিত ও অভিব্যক্ত উপলব্ধিগুলোর উপরে ভিত্তি করে; এই পর্যালোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে সেইসব ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের নানাবিধ উপলব্ধির মাধ্যমে। ইতিহাসবিদদের জন্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাদের বিবিধ স্বর লিপিবদ্ধ হয় নাই। কেউ সেগুলোর বিবিধতায় অবাক হতে পারেন কেবল। এসব প্রতিপক্ষতার স্বর গ্রামের সাপ্তাহিক বাজারের মতোই কেমন শোরগোল তৈরি করতে পারে আর কেমন প্রাণময় শোনাতে পারে সেই কল্পনা কেউ করতে পারেন।


ঐক্যের প্রসঙ্গে প্রত্যাবর্তন


তাই বেশ কৌতুহলউদ্রেককারী বিষয় হল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে, কেবল ভারতই উপস্থাপন করে এমন ভাবমূর্তির উপরে জোরারোপ ঔপনিবেশিক—প্রাচ্যবাদী, জাতীয়তাবাদী, মাক্সর্বাদী, আর সম্ভবত, কারও কারও মতে যা উত্তর—মাক্সর্বাদী৬৫ — সকল ধরনের ভারতীয় ইতিহাসতত্ত্বে খুঁজে পেতে হবে। বৈচিত্র্যের প্রতি বাধ্যতামূলকভাবে জোরারোপ করার ঝোঁক সত্ত্বেও, এমন ‘ধারণার’ উপস্থিতি সকল ধরনের লেখালেখিতে এতটাই উচ্চকিত যে, কেউ অনিবার্যভাবে আবারও সেই জিজ্ঞাসাগুলো করবেন যেগুলো এ—পর্যন্ত স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় নাই:


কোনও এক প্রাজ্ঞমতে,৬৩ ‘ঐতিহ্যের নির্যাস ভাষার মাধ্যমেই অস্তিত্বশীল’। একইরকম ন্যায্যভাবে, কেউ দাবি করতে পারে যে, সহজবোধ্য হতে হলে ঐক্যের নির্যাস একটি ভাষার ধারণার অবয়বের মধ্যে অস্তিত্বশীল হতে হবে। অধুনা ইন্দো—আর্য ভাষাগুলোতে একটি ঐক্যেও ধারণা ব্যক্তকারী একটি একক শব্দ হতে পারে ‘ঐক্য’, যা ‘একা’ বা এক থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু যেমনটি ঋগ্বেদের একটি স্তোত্রে৬৪ পাওয়া যায় তেমনই বহুধা বা বিচিত্রকে কিংবা অনেককে ঘিরে রাখা একা—এর ধারণা প্রকৃতপক্ষে একা (এক)—কে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, মাতরিশ্বান প্রভৃতি নানা নামের বেশ কয়েকজন দেবতার সঙ্গে সমীকৃত করে। এই সমীকরণ কোনও অর্থেই ভারতীয় ঐক্যের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এমনকি সীমিতসংখ্যক যে কয়েকটি লিখিত আলামতের নমুনা আমি উল্লেখ করেছি সেগুলোর প্রমাণ করা উচিৎ যে, যারা এই পুরোনো টেক্সটগুলো লিখেছিলেন, তারা তাদের সমাজের ও সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে ঐক্যের ধারণা নিয়ে ভয়াবহভাবে চিন্তিত ছিলেন বলে মনে হয় না। বরং টেক্সটগুলো বোধহয় বিপরীত একটা অনুভূতিই তৈরি করে। তাই বেশ কৌতুহলউদ্রেককারী বিষয় হল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে, কেবল ভারতই উপস্থাপন করে এমন ভাবমূর্তির উপরে জোরারোপ ঔপনিবেশিক—প্রাচ্যবাদী, জাতীয়তাবাদী, মাক্সর্বাদী, আর সম্ভবত, কারও কারও মতে যা উত্তর—মাক্সর্বাদী৬৫ — সকল ধরনের ভারতীয় ইতিহাসতত্ত্বে খুঁজে পেতে হবে। বৈচিত্র্যের প্রতি বাধ্যতামূলকভাবে জোরারোপ করার ঝোঁক সত্ত্বেও, এমন ‘ধারণার’ উপস্থিতি সকল ধরনের লেখালেখিতে এতটাই উচ্চকিত যে, কেউ অনিবার্যভাবে আবারও সেই জিজ্ঞাসাগুলো করবেন যেগুলো এ—পর্যন্ত স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় নাই : ক. যদি ভারত প্রকৃতপক্ষেই বৈচিত্র্যকে পরিবেশন করে, তাহলে বিচিত্র উপাদানগুলো কীভাবে তাদের নিজস্ব প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে মুছে ফেলে এমন একটা প্রপঞ্চকে সৃষ্টি বা গঠন করেছিল যাকে ঐক্য নামে আখ্যায়িত করা হয়? অন্যভাবে বললে, কোন সেই ম্যাজিক ফমুর্লা যা সকল ভেদাভেদ অতিক্রম করে একটি ঐক্যবদ্ধ সত্তা হিসেবে বিকশিত হওয়ার জন্য কেবল ভারতীয়রাই খুঁজে পেয়েছিল? খ. ওই ঐক্য অর্জনকে পরিবেশন করে এমন এমন কোনও সন্ধিক্ষণ কি রয়েছে? কারণ, যদি থেকে থাকে, তবে নতুন কোনও উপাদানের ওই ঐক্যে আবারও অবদান রাখার সম্ভাবনা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাদ পড়ে যায়। ওই ঐক্য অর্জনের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পরে যুক্ত অতিরিক্ত উপাদান হিসেবে। বিকল্পভাবনা হল, আসলে কি এমন যে, যাকে আমরা ঐক্য বলে অনুমান করি তা নতুন কোনও গঠিত—প্রপঞ্চের অভিমুখে একটি চলমান প্রক্রিয়া? আর সেই প্রক্রিয়া কি অতীতে সবসময় একইরকম ছিল? যে—প্রক্রিয়া নতুন বিকল্পগুলোর জল্পনা করার জন্য আমাদের মনোজগতে পুরো ঐক্যের ধারণারই পুনর্বিবেচনা ও পুনর্বিন্যাসকে প্রয়োজনীয় করে তোলে?


যদি ভারত প্রকৃতপক্ষেই বৈচিত্র্যকে পরিবেশন করে, তাহলে বিচিত্র উপাদানগুলো কীভাবে তাদের নিজস্ব প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে মুছে ফেলে এমন একটা প্রপঞ্চকে সৃষ্টি বা গঠন করেছিল যাকে ঐক্য নামে আখ্যায়িত করা হয়? অন্যভাবে বললে, কোন সেই ম্যাজিক ফমুর্লা যা সকল ভেদাভেদ অতিক্রম করে একটি ঐক্যবদ্ধ সত্তা হিসেবে বিকশিত হওয়ার জন্য কেবল ভারতীয়রাই খুঁজে পেয়েছিল?



আসলে কি এমন যে, যাকে আমরা ঐক্য বলে অনুমান করি তা নতুন কোনও গঠিত—প্রপঞ্চের অভিমুখে একটি চলমান প্রক্রিয়া? আর সেই প্রক্রিয়া কি অতীতে সবসময় একইরকম ছিল? যে—প্রক্রিয়া নতুন বিকল্পগুলোর জল্পনা করার জন্য আমাদের মনোজগতে পুরো ঐক্যের ধারণারই পুনর্বিবেচনা ও পুনর্বিন্যাসকে প্রয়োজনীয় করে তোলে?


শুরুতে আমি যেগুলো উত্থাপন করেছি সেগুলোর সম্পূরক হিসেবে এমনকি এই মৌলিক প্রশ্নগুলো উত্থাপনের চিন্তা করার আগে আমি এমন দুইজন চিন্তকের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে বিবেচনা করতে চাই যারা উভয়েই ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণা গ্রহণ করেছিলেন: রবীন্দ্রনাথ এবং কোসাম্বি। রবীন্দ্রনাথের স্মরণীয় লেখালেখিগুলো তাদের সারসত্তা হিসেবে এই ধারণাকে পরিবেশন করে। এদের মধ্যে রয়েছে তাঁর দীর্ঘ গীতিকবিতা ভারত—তীর্থ৬৬ (অর্থাৎ তীর্থস্থান হিসেবে ভারত) আর তাঁর ছোট প্রবন্ধ : ভারতবর্ষের ইতিহাস৬৭ (ভারতের ইতিহাস)। ভারত—তীর্থতে দুটো প্রধান রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। একটি হলো মহামানবের সাগরতীরে এক পবিত্র তীর্থস্থান। যেখানে বিভিন্ন জায়গা ও উৎস থেকে মানুষজন এসে মিলিত হবে, অবশ্যই তাদের শেষ বিশ্রামের স্থান অনুসন্ধানের পরিণতিতে। অন্য রূপকটি হলো শরীরের। ভারত এমন একটি শরীর হিসেবে পরিগণিত যাতে আর্য ও অনার্য, দ্রাবিড়, চৈনিক, শক, হূণ, পাঠান, মোগল সকলেই একে অপরের মধ্যে লীন হয়ে গেছে। শরীরের রূপকটি এখানে তাৎপর্যময় কারণ, একটি জীবন্ত ও প্রাণময় জীব হিসেবে শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একটি ক্রিয়াগত সম্পর্কে আন্তঃসম্পর্কিত। যার কোনও অঙ্গ বা টিস্যুকে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে পরিত্যাগ করা যায় না। সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক এই ধারণাটিকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে সামনে নিয়ে আসেন যখন তিনি বলেন: ‘ভারতবর্ষ কোনও কিছুকেই বর্জন করে নি’। রবীন্দ্রনাথের ধারণায় ভারতীয় ইতিহাস কেবল রাজবংশের আর যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি না। বরং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের নিরন্তর খেঁাজ, মিলনের অযোগ্য বলে মনে হওয়াকে পুনর্মিলিত করার পথের অন্তহীন অনুসন্ধান। এই ধারণার পাটাতন আবারও সেই প্রায় অনন্ত ব্যাপ্তির সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ যেগুলোকে সংশ্লেষিত করেই শনাক্তযোগ্য ভারতীয় অবয়বের উদ্ভব হয়েছে। ঐক্যের আলাপ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিষ্পন্ন হয়ে যাওয়া কোনও কর্মোদ্যোগের উপরে জোর দেন নাই। তাঁর ‘সন্ধান’ শব্দটির প্রয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে ঐক্য খুঁজে চলার দিকে লক্ষ্য করে। যা সাফল্য অর্জনের একটি অনিবার্য, চূড়ান্ত কোনও পূর্বধারণাবিহীন হবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য অর্জন করার চলমান গতিশীল প্রক্রিয়ার উপরে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব দেয়া কোনোভাবেই একটি সাংস্কৃতিক অবয়ব বা অভিব্যক্তির অপর আরেকটিকে পরাজিত করে বিজয়ী হওয়াকে বোঝায় না। সামগ্রিকভাবে তা সম্ভবত যাকে বোঝায় তা হল সাংস্কৃতিক মূল্যবিচার ছেঁটে ফেলে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া।


ডি.ডি. কোসাম্বির কাছে ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। তাঁর দ্য কালচার অ্যান্ড সিভিলাইজেশন অফ অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া ইন হিস্টোরিকাল আউটলাইন—এর প্রথম বাক্যগুলো শুরু হয় এভাবে :৬৮

‘নির্লিপ্ত ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে একজন নিরাবেগ পর্যালোচক যদি ভারতের দিকে নজর দেন, তাহলে তিনি দুটো পরস্পর সম্পর্কিত বিরোধী বৈশিষ্ট্য দ্বারা আক্রান্ত হবেন : একইসঙ্গে বৈচিত্র্য এবং ঐক্য। অনন্ত বৈচিত্র্য ধাক্কা লাগার মতন, প্রায়ই অসমন্বিত। মানুষের পোশাক, বচন, শরীরী অবয়ব, রীতিনীতি, জীবনযাপনের মান, খাবারদাবার, জলবায়ু, ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যাবলি সবকিছুই সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় ভিন্নতাকে পরিবেশন করে।’


এখানে উল্লিখিত বৈচিত্র্যগুলো প্রাচীন টেক্সটগুলোতে সঞ্চালিত বৈচিত্র্যগুলোকে পুনরুৎপাদিত করে। কিন্তু এভাবে বিদ্যমান বৈচিত্র্যগুলো কোসাম্বির কাছে তাৎপার্যময় নয়। কারণ ‘আফ্রিকা কিংবা চিনের ইউনানও এত বেশি বৈচিত্র্য পরিবেশন করে’।৬৯ অন্য দেশগুলো থেকে ভারতকে আলাদা করে ‘ভারতে আমাদের খুঁজে পাওয়া গত তিন হাজার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অব্যাহত ধারাবাহিকতা’। নিজের দেশে চলমান ভারতীয় সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কোসাম্বির ধারাবাহিকতার ধারণার নিহিতার্থ হল আদিমতম শিকার—সংগ্রহ থেকে সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তি পর্যন্ত সকল সাংস্কৃতিক আঙ্গিকের একই সঙ্গে উপস্থিতি : ‘ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক স্তরের মধ্যে অনেক আঙ্গিকের টিকে থাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পর্বগুলোকে পুনর্গঠন করাকে অনুমোদন করে’।৭০ এভাবেই টিকে—থাকা আঙ্গিকগুলো আর আদিবাসী সমাজগুলোর সাধারণ (অন্যভাবে বললে, একটি আরও জটিল সমাজের) অংশে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া হল ধারাবাহিকতা। রবীন্দ্রনাথের সবকিছুর-সঙ্গে- মানিয়ে-নেয়া ভারতীয় ঐক্যের ধারণার সঙ্গে এই ধারাবাহিকতার সাদৃশ্য রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। উভয় ধারণাই ঐক্য অর্জনের অভিমুখে অভিযাত্রায় বিরাজমান দশাকে কাঁপিয়ে দেয়া উত্তেজনার প্রয়োজনীয়তাকে আগেভাগেই খারিজ করে দেয়।


তাসত্ত্বেও, ঐতিহাসিক পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্বে এবং সর্বকালীন গতিময়তার দশার সম্পর্কের মধ্যে বিচিত্র উপাদানের উপস্থিতি আবশ্যিকভাবেই ঐক্যকে সংজ্ঞায়িত করে না; ঐক্যের বিভিন্ন প্রতীক আর অর্থ (ইতিহাসতত্ত্বের বিভিন্ন মতাদর্শ নির্বিশেষে যদিও এই অর্থকে ভারতীয় সমাজের একটা লাগসই চরিত্র বলে অনুধাবন করা হয়) বাস্তবিকই অনির্দিষ্ট রয়ে গেছে। সুতরাং যা বোঝা দরকার তা হল ভারতীয় সমাজে ও সংস্কৃতিতে বিদ্যমান উপাদানগত বৈচিত্র্য কীভাবে এক অপরের সঙ্গে এবং ঐক্যকে পরিবেশনকারী হিসেবে বিবেচিত জটিল কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। ঠিক এই কারণেই আমি আপনাদের সামনে পেশ করার জন্য এই প্রশ্নটি বেছে নিয়েছি। এই বিচিত্র উপকরণগুলো কি একটি নিখুঁত সাম্যাবস্থা ও স্থিতিশীল সম্পর্কের দশায় একটি সুস্থির অবয়ব হিসেবে বিরাজমান? অথবা, এই স্থিতিশীলতার দশা কি ঠুনকো, অনিশ্চিত আর সার্বক্ষণিক সংঘাতময় দশায় থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর আমি এমনকি অনুমানও করতে পারি না; যতক্ষণ পর্যন্ত ধারণাটি ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির গঠিত হওয়ার পর্বের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে ততক্ষণ আমি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যর প্রসঙ্গটি নিয়ে সবিনয়ে কেবল আমার বক্তব্য নিবেদন করতে পারি। সেটা করার প্রয়াস করার আগে আরও একবার আদি টেক্সটগুলোর উল্লেখ করা যাক। যদি পুরাণ ও অন্য টেক্সটগুলোতে যে পরিসরকে ভারতবর্ষ হিসেবে ধারণা করা হয়েছে তা এখনকার ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী হয় তবে এই বর্ষকে অন্য বর্ষগুলো থেকে কী কী আলাদা করেছে তা সম্পর্কেও পুরাণে মতামত রয়েছে।৭১ অন্য বর্ষগুলো থেকে ফারাক করা হয়েছে জোর দিয়ে একথা বলে যে, ভারতবর্ষই একমাত্র বর্ষ যেখানে কর্মর ফল লাভ করা যায়। আর কার্য—কারণগতভাবে, এখানে অধিবাসীগণ চতুর্বর্ণর সামাজিক বিভাজনে বিন্যস্ত। কর্মর মতাদর্শ সারসত্তাগতভাবে ধর্মের মতাদর্শসমূহের সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরাণাদি অনুসারে ফল (কর্মফল) আর পুনর্জন্ম ভারতবর্ষের অনন্য শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। কেউ কেউ কর্মের এই মতাদর্শকে ভারতীয় ঐক্যের পৌরাণিক সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করতে চান। তবে দেশের বিপুৃল বিস্তারী বৈচিত্র্যকে অতিক্রমকারী হিসেবে একে গ্রহণ করা দুরূহ। ভারতীয়দের মানসে মতাদর্শটির সাংঘাতিক বিস্তার থাকলেও, একথা সত্য যে এটা বর্ণাশ্রমধর্মের ব্রাক্ষ্মণ্য মতাদর্শের অন্যতম পাটাতন ছিল। ফলে সকল সম্প্রদায় এই মতাদর্শকে আবশ্যকীয়ভাবে গ্রহণ করে নাই।৭২ সবচাইতে বড় কথা, ঐতিহাসিক ও অস্তিত্ত্বগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলির মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক বোঝাপড়ার সমস্যার কোনও জবাব এখনওা পাওয়া যায় নাই। অন্যান্য সাহিত্যিক উৎসের মতন পুরাণাদিও ভারতবর্ষকে গঠনকারী জনপদগুলোর বহুত্বের দিকে ইশারা করেছে। আবার এই ভারতবর্ষ একটি বিশাল মহাবৈশ্বিক কাঠামোর একটি উপাদানও বটে। তবে বর্ষগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক কিংবা মিথষ্ক্রিয়ার সমস্যা এমন কোনও প্রসঙ্গ না যা নিয়ে আলাপে টেক্সটগুলো আদৌ আগ্রহী ছিল।


বৈচিত্র্যের সমর্থনে

যখন পেছনের দিকে আদিযুগের অতীতে প্রক্ষিপ্ত হয়, বিশেষ করে তখন ভারতীয় ঐক্য বলতে কী বোঝায়? প্রত্যক্ষণগত ও তত্ত্বীয়ভাবে ভারতবর্ষ একটি রাজনৈতিকভাবে একীভূত পরিসর ছিল না; আদর্শ, সার্বভৌম শাসকের সার্বভৌমত্ব অন্যান্য বহু শাসককে অধস্তন করাকে ঘিরে তৈরি হতো।৭৩ আমি যে—সব শাস্ত্র উদ্ধৃত করেছি সেগুলো জনপদের সংস্কৃতিগুলোর বৈচিত্র্যের দিকে আর বাস্তব, কিংবা লেখকের রচিত, বানানো পরস্পরকে উপহাস করার মনোভাব বিরাজমান থাকার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে। অতীতে একটি ‘সর্বজনীন ইতিহাসের, সর্বজনীন নানান বীরপুরুষের, সর্বজনীন সাহিত্যের, সর্বজনীন শিল্পকলার, সর্বজনীন আইনের’৭৪ অস্তিত্ত্ব কল্পনা করা একজন উপনিবেশিত ‘দেশপ্রেমিকের’ বিভিন্ন দাবির জন্য সন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। কিন্তু তা প্রত্যক্ষণগত পরীক্ষা—নিরীক্ষা উৎরাতে পারে কমই। তাহলে কি আমরা ঐক্যের ধারণা পুরোপুরি পরিত্যাগ করব? ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করলে মনে হয়, ঐক্যের ধারণাকে বেশি হলে নানারকম স্থানীয়, উপ—আঞ্চলিক/সাব—রিজিওনাল, এবং আঞ্চলিক/রিজিওনাল (অন্যভাবে বললে, বিভিন্ন জনপদ, নাড়ু ইত্যাদির) সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর মধ্যে বিভিন্ন স্থান ও কালব্যাপী মিথস্ক্রিয়ার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মিথস্ক্রিয়ার এই প্রক্রিয়া রূপান্তরমূলক এবং অসম। রূপান্তরমূলক সংলাপ ভাগাভাগি, ধার, ব্যাখ্যা, প্রত্যাখ্যান আর সমন্বয়ও বোঝাতে পারে। এমন সক্রিয় মিথস্ক্রিয়ার প্রাবল্য নির্ভর করবে মিথস্ক্রিয়ায় যুক্ত পরিসরগুলোর নৈকট্য বা দুরত্বের উপরে। অন্য একটা লেখায়৭৫ আমি বলেছি যে, একটি ভৌগলিক পরিসর হিসেবে ভারতকে বিভিন্ন গ্রন্থিত অঞ্চলের ভূমি হিসেবে দেখা যেতে পারে। এভাবে দেখার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য হবে ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি এবং পরস্পর গ্রন্থিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক, বিশেষকরে ভাষিক ও সদৃশ্য বৈশিষ্ট্যগুলোর দিক থেকে মিল দুটি দুরবর্তী অঞ্চলের তুলনায় বেশি হবে। অবশ্য মনে রাখতে হবে, অঞ্চল—অতিক্রমী সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের প্রধান প্রতীকগুলোর বিশাল ব্যাপ্তি আর যোগাযোগ ভৌগোলিকভাবে নির্ধারিত হয় নাই। সক্রিয়তা ছিল মানুষের, এবং ভারতীয় ঐক্যর প্রকৃতি পাঠোদ্ধারে গভীরভাবে আগ্রহী ইতিহাসবিদগণ এই দুই সক্রিয়তাকেই বিবেচনায় নিলে ভালো করতে পারেন। পাশাপাশি, সেসব স্থিতিশীল প্রতীকগুলোকেও বিবেচনায় নিতে পারেন, যেগুলো ভারতীয় জনগণের কেবল কোনও একটি অংশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই সময়ের জন্য আমি সর্বোচ্চ যে দূরকল্পনা করতে প্রস্তুত থাকতে পারি তা হল, মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া কালক্রমে এমন একটি উল্লেখযোগ্য— সৃষ্টি করেছিল যার সঙ্গে বহুরূপ সাংস্কৃতিক উপাদান আর ভৌগোলিক পরিসর সম্পর্কিত হতে পারত। এই প্রসঙ্গসূত্রটি ছিল ভারতবর্ষের ধারণা, কিংবা হিন্দুস্থানের মতো পরবর্তীকালীন অন্য কোনও পদ যা ভারতবর্ষর পরিবর্তে ব্যবহৃত হতে পারত। একটা একক তুলনাযোগ্য প্রসঙ্গসূত্র/রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে একটি দেশের ধারণা বিচিত্র, এমনকি পরস্পর—বিরোধী স্থানীয়, উপ—আঞ্চলিক, এবং আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যাবলিকে আত্তীকরণ করতে পারত, আর করেছিলও। এমন অন্যান্য অভিলেখর মধ্যে একটি হিসেবে চতুর্দশ শতকের উপকূলীয় অন্ধ্রর একটি অভিলেখে নয়টি অংশে বিভক্ত আর অনেক ভাষা ও রীতির সমষ্টিতে বৈশিষ্ট্যময় ভারত নামের বর্ষের মধ্যে তিলিঙ্গা দেশের অবস্থানের কথা উল্লিখিত হয়েছিল। এই লিপি চতুর্দশ শতকের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষ ও এখানকার অন্যান্য জনপদের৭৬ সঙ্গে এই এলাকার সাদৃশ্য স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভিন্ন সাংস্কৃতিক সত্তার দাবিও পেশ করেছিল। এই সত্তাও অনেক ভেদাভেদের মধ্য থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল, আর এখনও অনেক ভেদাভেদ ধারণ করে। একটি বিশেষ সত্তার দাবিকে ওই নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তের অনিশ্চয়তা সাপেক্ষ এক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখা উচিত।


যে প্রসঙ্গটি জোর দিয়ে বলা দরকার বলে আমার মনে হয় তা হল, ঐক্যের ধারণা নিয়ে আমাদের গোঁ-ধরা জেদের কারণে ঐক্যের গঠিত হওয়ার তাৎপর্যগুলোকে সাধারণত উপেক্ষা করার ঝোঁক রয়েছে।৭৭

‘প্রাক—আধুনিক যুগেও একটি নির্দিষ্ট জীবন প্রণালীর প্রতিষ্ঠা সাধারণত অন্যান্য বিশ্ববীক্ষা আর জীবনাচারকে অধীনস্ত বা প্রান্তিকীকরণ করে অর্জিত হতো। … যৌথ এবং উচ্চনীচভেদবিশিষ্ট সামাজিক বিন্যাস গঠনকারী উপাদানগুলোর অসমতার উপরেই ভিত্তি পায়।’


ঐক্যের অর্থ যদি সমরূপতা, বৈচিত্র্য, দ্বন্দ্ব, আর ভিন্নমতের পরিসরবিহীন এককত্ব হয়, তবে সেই অর্থ অতীতের কিংবা বর্তমানের ভারতের ক্ষেত্রে কেউ ব্যবহার করতে চাইবেন কিনা সে—ব্যাপারে আমার সংশয় রয়েছে। আসলে, ঐক্য অথবা এমনকি একটি সভ্যতার গঠিত হওয়াও একভাবে ধ্বংসাত্মক। পরস্পর সম্পর্কহীন উপাদানগুলোকে ক্ষয় কিংবা বিনাশ করার মাধ্যমেই ঐক্য একত্রে নিয়ে আসে। এমনকি সভ্যতা—পূর্ব, সারসত্তাগতভাবেই স্থানীয় বা সম্প্রদায়গত উপাদানসমূহ সভ্যতার গঠন প্রক্রিয়ার অনুপ্রবেশ করে মিথস্ক্রিয়া, গ্রহণ, বিশ্বজনীনীকরণ, কিংবা অন্য কোনও উপায়ে। তখনও নতুন গঠিত কাঠামো অভিন্নভাবেই নির্বাচিতভাবে আত্মীকরণ, প্রান্তিকীকরণ, বিনাশ বা অধীনীকরণকে বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রধান ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলোর উদ্ভবের প্রক্রিয়ায় যখন বন ক্ষেত্রে৭৮ (যা একটি জটিল সামাজিক গঠন বিশিষ্ট স্থায়ী চাষাবাদ নির্ভর পরিসর), তখন বন বনের মতোই বিরাজমান থাকতে পারে না। পুরির জগন্নাথ উপাসনার ঐতিহ্যে বনবাসী বা বনের উপাদানগুলোর উপস্থিতি ছিল। তাসত্ত্বেও, এই ঐতিহ্য এত সম্পূর্ণভাবে ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যপ্রভাবিত হয়েছিল এবং সামাজিক উচ্চনীচ ভেদাভেদের ব্রাহ্মণ্য ধারণার মাধ্যমে নিজের পরিচয় তৈরি করেছিল যে, অনিবার্যভাবেই মহিমা ধর্মের মতো একটি সমতাবাদী আন্দোলন এই ধর্মাচার ঐতিহ্যকে আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করতে পেরেছিল।৭৯ আরও সাম্প্রতিককালে, বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায় অব্যাহতভাবে দিগম্বরী বা দিগবসনা (যার বসন আকাশ, বা যেকোনো বসন পরিধান করে না) হিসেবে কালী দেবীকে আখ্যায়িত করতে থাকলেও, পুজার প্রতীমা হিসেবে শাড়ি পরিয়ে তাকে ভদ্রলোকদের আদর্শর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলা হয়।

আসলে, ঐক্য অথবা এমনকি একটি সভ্যতার গঠিত হওয়াও একভাবে ধ্বংসাত্মক। পরস্পর সম্পর্কহীন উপাদানগুলোকে ক্ষয় কিংবা বিনাশ করার মাধ্যমেই ঐক্য একত্রে নিয়ে আসে। এমনকি সভ্যতা—পূর্ব, সারসত্তাগতভাবেই স্থানীয় বা সম্প্রদায়গত উপাদানসমূহ সভ্যতার গঠন প্রক্রিয়ার অনুপ্রবেশ করে মিথস্ক্রিয়া, গ্রহণ, বিশ্বজনীনীকরণ, কিংবা অন্য কোনও উপায়ে। তখনও নতুন গঠিত কাঠামো অভিন্নভাবেই নির্বাচিতভাবে আত্মীকরণ, প্রান্তিকীকরণ, বিনাশ বা অধীনীকরণকে বোঝায়।


এভাবেই ধর্ম এবং ‘সংস্কৃতায়িত আদিকল্পের’ ধারণার ঘোষণা করার প্রচেষ্টায় যারা ভারতীয় ঐক্যের একটি প্রতীমার মায়াজাল তৈরি করেছে তারা ঐক্যের নেতিবাচক সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলে মনে হয় না। একটি সম্ভাব্য অনন্তকালীন ভারত প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক এই বিবৃতিটি বিবেচনা করুন,৮০ ‘একটি বহুভাষী, বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, বহুসংস্কৃতির ভারতের ধর্ম—শাসিত একটি জাতির কোনও না কোনওভাবে একটি অন্তভুর্ক্তিমূলক পরিকাঠামো ছিল’। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকাঠামো হিসেবে ধর্মকে সামনে নিয়ে আসা ধর্মের বহুত্বকে স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়। কোনও কারণে একটি সমস্যা সমাধান করায় ধর্মগুলোর ব্যর্থতার ক্ষেত্রে, শাস্ত্র অনুমোদিত প্রণালি মোতাবেক রাজশাসনাদি (রাজকীয় অভিলেখাদি) চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হতো।৮১ ধর্মগুলো দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারত আর সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলও। মতাদর্শিক ব্যঞ্জনাবিশিষ্ট একটি পবিত্র ভাষা হিসেবে সমগ্র ভারতব্যাপী প্রসারিত হওয়ার কারণে ভারতীয় ঐক্যেকে প্রতীকায়িত করা ‘সংস্কৃতায়িত আদিকল্প’৮২ নিয়ে আলাপ করতে গেলে, ভাষাতত্ত্ববিদগণ আমাদের কী বলেছিলেন তা স্মরণ করা সম্ভবত দরকার। প্রাথমিকভাবে দ্রাবিড়িয় থেকে সংস্কৃতের ধার করার সম্ভব্যতা স্বীকার করায় প্রাথমিকভাবে ভাষাতত্ত্ববিদগণের অনীহা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এম.বি. এমানু বলেছিলেন৮৩: ‘অন্যান্য ভাষার বিনিময়ে সংস্কৃতকে সিংহাসনে আসীন করে ভারতীয় সভ্যতা নিজেই পশ্চিমা পণ্ডিতদের সংস্কৃত সম্পর্কে এমনটা ভাবতে শিখিয়েছে’। দ্রাবিড়িয়সহ অন্যান্য ভাষাগুলোর বিনিময়েই যে সংস্কৃতের সিংহাসন আরোহন সম্ভব হয়েছিল তা এমানু আরও জোর দিয়ে বলেছেন :৮৪ ‘মধ্যভারতে দ্রাবিড়ীয় ভাষাভাষীগণ আর আগ্রাসী সংস্কৃতভাষাজাত ইন্দো—আর্য ভাষাভাষীগণের ভৌগোলিক বিস্তৃতি, এবং সীমানার প্রকৃতিই ইন্দো—ইউরোপীয়দের সামনে দ্রাবিড়ীয়দের ক্রমাগত পশ্চাদপসরণের উৎকৃষ্ট আলামত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে’। আরও সম্প্রতি, ‘দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাতাত্ত্বিক প্রাগিতিহাস’ প্রসঙ্গে একটি সামগ্রিক আলাপ দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তৃতির সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে অস্ট্রোএশীয় মুণ্ডা ভাষা প্রসঙ্গে নিচের অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে :৮৫

‘মূলত উত্তর—পূর্ব ভারতে মুণ্ডা ভাষায় কথা বলা হয়ে থাকে। আর আরো দুরে মধ্য ভারতে ইন্দো—ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মধ্যেও পরিবেষ্টিত অবস্থায়ও মুণ্ডা ভাষা রয়েছে। … মুণ্ডাদের ভৌগলিক বিস্তৃতি নির্দেশ করে যে, এই ভাষা একসময় ভারতে বিস্তৃত ছিল। আর তা পরে ইন্দো—ইউরোপীয় এবং দ্রাবিড়িয় উভয় ভাষার চাপে বা উভয় ভাষাগোষ্ঠী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছিল। আদি গবেষণাগুলোতে ইন্দো—ইউরোপীয় ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে সুদুর পশ্চিমে এমনকি পাকিস্তানের দারদীয় ভাষায়ও মুণ্ডা প্রভাব শনাক্ত করা হয়েছে। সাম্প্রাতিক গবেষণা—প্রকাশনাগুলোতে এখনও এই ধারণাটিকে সমর্থন করা হয়ে থাকে।’


অস্ট্রোএশীয় অথবা অন্যান্য ভাষা গোষ্ঠীর পরিবর্তনশীল প্রাগৈতিহাসিক ভূগোল যাই হোক না কেন, এপ্রসঙ্গে কোনও সন্দেহ করার কারণ নাই যে, একটি ‘কসমোপলিসকে’৮৬ উপস্থাপনকারী হিসেবে সংস্কৃতর দিগ্বিজয়ী বিস্তার অর্জিত হয়েছিল কেবল সেই ভাষাগুলোকে বিলুপ্তিকরণ আর প্রান্তিকীকরণের বিনিময়েই নয় যেগুলোকে ‘ফাইলা’ শ্রেণির ভাষা আর ‘বিচ্ছিন্ন ভাষা/ল্যাঙ্গুয়েজ আইসোলেট’৮৭ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পাশাপাশি প্রাকৃত এবং পালির মতন অপরাপর ইন্দো—ইউরোপীয় ভাষাগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। কারও ভুলে যাওয়া উচিত না যে, ব্যাপক বিস্তারী সুক্ষ্ম দার্শনিক চিন্তা আর অসাধারণ সাহিত্যের বাহন হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরেই বর্ণ, জাতি ও বর্ণ—সংকরের ধারণার মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্যের একটি মারাত্মক ক্ষতিকর মতাদর্শকে সংস্কৃত পরিপুষ্ট করেছে। ভারতের মানুষের একটি প্রধান অংশকে শাস্তি দিয়ে অধঃপতিত করেছে বিভক্তি আর অস্পৃশ্যতায়।৮৮ ‘সংস্কৃতায়িত আদিকল্প’ পরিব্যাপ্ত ছিল। কিন্তু এই আদিকল্প ছিল মতাদর্শিক আধিপত্যেরও একটি প্রতীক। ছিল না অংশীদারিত্বমূলক অংশগ্রহণ যা ছাড়া ঐক্যের অর্থ হয়ে পড়ে ফাঁপা।

ইতিহাসে একটা পরিহাস হল, বিবিধ সাংস্কৃতিক পরিসরের একত্রিত হওয়ার, অন্তর্ভুক্ত করার, একটি একীভূত প্রপঞ্চ হিসেবে কাজ করার গতিশীলতা বজায় থাকে কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই এমন বহু পরিসরকে ত্যাগ করার মাধ্যমে। তাদের এই ত্যাগ করার প্রকৃতি নির্ভর করে তাদের বিলুপ্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতের উপরে।


ইতিহাসে একটা পরিহাস হল, বিবিধ সাংস্কৃতিক পরিসরের একত্রিত হওয়ার, অন্তর্ভুক্ত করার, একটি একীভূত প্রপঞ্চ হিসেবে কাজ করার গতিশীলতা বজায় থাকে কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই এমন বহু পরিসরকে ত্যাগ করার মাধ্যমে। তাদের এই ত্যাগ করার প্রকৃতি নির্ভর করে তাদের বিলুপ্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতের উপরে। ভারতে অনেকগুলো পরিসরই বিলুপ্ত হয়ে যায় নাই, তবে একটি পরিবর্তন বা রূপান্তরের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। অপরাপর অনেকগুলো টিকে গিয়ে দেশটিতে ধারাবাহিকতার একটি অনন্য চেহারা প্রদান করেছে। নতুন মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্কে জড়ানো নতুন নতুন সাংস্কৃতিক আঙ্গিক আমাদের ইতিহাসও দিয়েছে। বৈচিত্র্যের প্রতি নিবেদিত আমার উদযাপন গাঁথা বেশি বিলম্ব না করে তাড়াতাড়িই হয়ত শোকগাঁথায় পরিণত হত পারে বলে আমার ভয় হয়। দ্রুততার সঙ্গে বিপজ্জনক বৈশ্বিক সমরূপীকণের শিকারে পরিণত হতে থাকা এক দুনিয়ায় বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পরিসরগুলোর টিকে থাকুক — কেবলই এই প্রার্থনারত আমি। আমাদের চারপাশের সবকিছু থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের পরিবর্তে আমরা আমাদের বিশাল বিশ্বের বিচিত্র জৌলুসের অভিজ্ঞতা আশেপাশের মেগা মলগুলো থেকে নিতে আরম্ভ করেছি। আমাদের নিজেদের দেশে যাকে আমি ম্যাগি—ম্যানিয়া বলে আখ্যায়িত করেছি, তা কিন্নুর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে৮৯ আর একইসঙ্গে মিলিতভাবে আমাদের ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত রান্নাবান্নার পছন্দ—অপছন্দের৯০ প্রতি অনবরত অব্যাহতভাবে হুমকি বাড়াচ্ছে। এরই সমান্তরালে আজকের মধ্যদেশ কেন্দ্রীকতা এবং স্বৈরাচার বেড়ে চলেছে আর একটি বহুভাষিক পরিসরে একটিমাত্র ভাষার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাশা অদম্য হয়ে উঠছে । আমাদের প্রাচীন বিভিন্ন লেখালেখি থেকে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, দ্বন্দ্ব, আর এমনকি সংঘাতেরও যেসব আলামত আমি উপরে উদ্ধৃত করেছি, সেগুলো একটি বহুরূপ সমাজে গতিশীল মিথস্ক্রিয়ার প্রমাণ ছিল। বাদানুবাদময় হলেও সেই গৌরবময় বহুরূপতাকে মনে রেখে আমাদের আশা এই যে, আজ যেন আমরা স্বেচ্ছায় সেই দেশটিকে, আমাদের অনেক ভারতকে, অন্তভুর্ক্তি আর ঐক্যের নামে যান্ত্রিক এক সুসমতার কৃষ্ণবিবরে নিক্ষেপ না করি।

আমাদের প্রাচীন বিভিন্ন লেখালেখি থেকে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, দ্বন্দ্ব, আর এমনকি সংঘাতেরও যেসব আলামত আমি উপরে উদ্ধৃত করেছি, সেগুলো একটি বহুরূপ সমাজে গতিশীল মিথস্ক্রিয়ার প্রমাণ ছিল। বাদানুবাদময় হলেও সেই গৌরবময় বহুরূপতাকে মনে রেখে আমাদের আশা এই যে, আজ যেন আমরা স্বেচ্ছায় সেই দেশটিকে, আমাদের অনেক ভারতকে, অন্তভুর্ক্তি আর ঐক্যের নামে যান্ত্রিক এক সুসমতার কৃষ্ণবিবরে নিক্ষেপ না করি।

____________

টীকা ও হদিস

২০১৪-এর ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ান হিস্টোরি কংগ্রেসের প্লাটিনাম জুবিলি সেশনে এই প্রবন্ধটি প্রথম জেনারেল প্রেসিডেন্টের বক্তব্য হিসেবে পাঠ করা হয়েছিল। একটি ফেলোশিপ আর তার সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডি, সিমলায় প্রাপ্ত সুযোগসুবিধা ছাড়া এই বক্তৃতা সম্পূর্ণ করা আমার পক্ষে কঠিন হতো। গত কয়েকমাস যাবত ইন্সটিটিউটে প্রশ্ন—উত্থাপন করার সংস্কৃতির একজন অংশীদার হওয়াকে অনুমোদন করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকসমেত সকল ফেলোর প্রতি আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। অত্যাবশ্যকীয় কৃৎকৌশলগত সহযোগিতা এবং উৎসাহ প্রদান করার জন্য আমি ড. অরুণা বোম্মারেড্ডি ও ড. সুস্মিতা বসু মজুমদারের কাছে ঋণী।


১. উদাহরণস্বরূপ দেখুন, S. Bhattacharya, Talking back: The Idea of Civilization in Indian Nationalist Discourse (New Delhi, 2011).. প্রধানত ইতিহাসতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ধরনে লেখা আর রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী এবং নেহেরুর মতন প্রধান চিন্তকদের লেখনীর উপর ভিত্তি করে লেখা টকিং ব্যাক আদৌ আদি টেক্সটগুলোর উপলব্ধি নিয়ে ভাবিত নয়। আরো দেখুন, , idem, Introduction to the collection of essays titled Cultural Unity of India (Ramakrishna Mission Institute of Culture, Kolkata, 2013), XL-XLI.


২. http://www.wikipedia.org -এ `Unity in Diversity’— এর আওতাধীন ভুক্তিগুলো দেখুন।


৩. সাম্রাজ্যের মানচিত্রায়নের জন্য প্রথম দিককার বিপুল কর্মযজ্ঞ প্রসঙ্গে বিশদ জানার জন্য দেখুন, M. Edney, mapping an Empire: The Geographical Construction of British India, 1765-1843 (University of Chicago Press, Chicago, 1997).


৪. মনু—স্মৃতি (Manu-smrti, II.17-24). এখানে মনু—স্মৃতির The Laws of Manu শিরোনামের ইংরেজি অনুবােদের লেখক, Wendy Doniger and Brian K. Smith (Penguin Books, New Delhi,1992).


৫. বঙ্কিমচন্দ্র প্রধান জাতিগত—ভাষাগত বিভিন্ন দলের আঙ্গিকে, নানাবিধ জাতি, ধর্ম, ভাষা, রীতি ও আরো নানান আঙ্গিকে ভারতীয় সমাজে অনেক ভিন্নতার (ভেদ) ধারণা করেছিলেন। এমন প্রকোষ্ঠে—প্রকোষ্ঠে বিভাজিত ভিন্নতার রূপ তাকে ভারত—ভূমিকে মৌমাছি—পূর্ণ একটা মৌচাকের সঙ্গে তুলনার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। দেখুন, J.C Bagal, ed., Bankim Rachanavali, vol.2 (Calcutta, 1964). The essay s titled Why is India Unfree ?, pp.234-41


৬. যে বঙ্কিমচন্ত্র আঞ্চলিক নানান দলের ভিত্তিতে ভিন্নতার কথা লিখেছিলেন, তিনিই দেশকে আদিতে মাতারূপে অনুধাবন কারীদের মধ্যে একজন ছিলেন। তার ১৮৮২ সালে উপন্যাস আনন্দমঠ প্রথমদিকের দেশপ্রেমমূলক উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই উপন্যাসে পৌরাণিক দুর্গারূপে নির্মিত মাতৃবন্দনা করা হয়েছে। বঙ্কিম রচনাবলি, প্রথম খণ্ড, ১০ম অধ্যায় (Bankim Rachanavali, vol. 1, chapter 10)| বন্দে—মাতরম গানটি দেশকে নির্দেশ করছে বলে একজন সাধারণমানুষের সন্দেহের উত্তরে সন্ন্যাসী জোর দিয়ে বলেন যে, জন্মভূমি অবশ্যই মা।


৭. ১৯০৫ সালে অঁাকা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুৃরের ভারতমাতার প্রতিকৃতিতে দেবিকে চারহাতবিশিষ্ট হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল। দেবির প্রতিহাতে যথাক্রমে একটি পাণ্ডুলিপি, এক গোছা ধান, একটি জপমালা আর একটুকরো কাপড় তাঁকে দেশবাসী সন্তানদের শিক্ষা—অন্ন—দীক্ষা—বস্ত্রর সংস্থানকারী হিসেবে প্রতীকায়িত করেছে। ভারত—মাতার প্রতীমালক্ষণবিদ্যা যে সুনির্দিষ্ট ছিল না তা জানার জন্য দেখুন, Sumathi Ramaswamy, The Goddess and the Nation (New Delhi edition, 2011), pp. 15-17 and passim.


৮. ভারতবাসীদের উল্লেখ করা হয়েছিল একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গানে। ১৯০৮ সালে বৃটিশরা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে ফাঁসি দেয়াকে স্মরণ করতে এই গানটি রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বাংলায় এই গানটি এখনো অব্যহতভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়। গানটির নানা সংস্করণ ও তার বিশ্লেষণ জানার জন্য দেখুন, অরুণ কুমার নাগ, গল্প ও তার গরুতে অন্তভুর্ক্ত দ্বীপান্তরী অভিরাম, কলিকাতা, ২০০৫, পৃ. ১০৯—১২৭।


৯. Radhakumud Mookerji, The Fundamental Unity of India (London, 1913; New Delhi edition, 2003), passim.


১০. Sabyasachi Bhattacharya, Talking Back , passim; also idem, Introduction.


১১. Sabyachi Bhattacharya, Introduction, p xxi.


১২. যদি বঙ্কিমচন্দ্রের ভিন্নতার অনুধাবন অনেক জাতির অস্তিত্ত্বের মধ্যে থাকে এবং অন্যভাবে বললে, ঐক্যের অনুভবের অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে, অন্যান্যরা অনেক ভাষা, অনেক পোষাকের রীতি, অনেক বিশ্বাস ও মতামত থাকা সত্ত্বেও মহামিলনের গান গাইতে পেরেছিলেন [উদাহরণ, অতুলপ্রসাদ সেনের, নানা ভাষা, নানামত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখি মিলন মহান, দেখুন, গীতিগুঞ্জ (কলিকাতা, ১৯৩৫)।]


১৩. ঋগ্বেদ (Rg veda 10.22.8); আরো দেখুন, B.D Chhattopadhyaya, Accommodation and Negotiation in a culture of Exclusivism; some Early Indian perspectives, in Bipan Chandra and Sucheta Mahajan, eds, composite culture in a Multicultural society (National Book Trust, New Delhi, 2007), pp.145-65


১৪. বৌধায়ন ধর্মশাস্ত্র (Baudhayana Dharmasutra, 1.2.9-14)


১৫. মনু মধ্যদেশ ও আর্যাবর্তের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। আর্যাবর্ত তুলনামূলকভাবে মধ্যদেশের চাইতে বড়, (2.21-2, Doniger and Smith, p .19).


১৬. কাব্যমীমাংসা, ১৭ অধ্যায়। যে সংস্করণ ব্যবহার করা হয়েছে সেটা হল নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর রাজশেখর ও কাব্যমীমাংসা (শান্তিনিকেতন, ১৯৬০), পৃ. ১৬৯। কাব্যমীমাংসা থেকে প্রদত্ত অন্যান্য উল্লেখও এই এই সংস্করণেরই।


১৭. দেখুন, Ananda K. coomaraswamy, ‘The Nature of Folklore and Popular Art’, in Rama P. Coomaraswamy, ed, The Essential Ananda coomaraswamy (The Bloomington World wisdom, Bloomington, 2029), pp. 215-22. কুমারস্বামী এভাবেই গঠিত (সংস্কৃত) এবং প্রাদেশিক ( দেশী) কিংবা মহাপথ (মার্গ) এবং একটি স্থানীয় বা শাখাপথ (দেশী)— এর ফারাক করেছেন। “… ব্রাক্ষ্মণের (যারা পৃথিবীতে ঈশ্বরের সমতূল্য) দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করলে বলা যায় যেখানে স্বর্গীয় অবয়ব—রূপগুলো সঠিকভাবে অনুকৃত হয়েছে সেই একটি পবিত্রভূমি (আর্যাবর্ত) থেকে যাকিছু ভৌগলিকভাবে এবং/কিংবা গুণগতভাবে মূল কেন্দ্র থেকে দুরে সরিয়ে ফেলা হয় তাইই একইসময়ে ভৌগলিক ও আধাত্মিকভাবে ‘প্রাদেশিক’ হবে; তারাই প্রধানত দেশী যারা সীমার বাইরে বসবাসকারী বর্হিভাগের বর্বর, আর তাই দেশী হলো পৌত্তলিকের, বা বিধর্মীর/হিদেন সমতূল্য।


১৮. এপ্রসঙ্গে পূনার্ঙ্গ আলোচনার জন্য দেখুন, B.D.chattopadhyaya, ‘Space History and cultural process; some Ideas on Ingredients of sub-regional Identity’, in H. Kulke and G. Berkemer, eds, Centres Out There? facets of sub-regional Identities in Orissa (New Delhi, 2011), pp.21-38. আরো দেখুন, B.D. Chattopadhyaya, ‘A survey of Historical Geography of Ancient India’ (Calcutta, 1984)-— এর বিভিন্ন জায়গায়; একই রচয়িতার, ‘The Concept of Bharatavarsa and its Historiographical Implications’ (বর্তমান বইয়েই অন্তভুর্ক্ত প্রবন্ধ).


১৯. K. Sivathamby, ‘Early South Indian Society and Economy: The Tinai Concept’, Social Scientist, vol 3, no 5 (1974), pp. 29-37; G.D. Sontheimer, Pastoral Deities in Western India, translated by Anne Feldhaus (New York; Oxford 1989), chapter 2.


২০. B.D. chattopadhyaya, Aspects of Rural Settlements and Rural Society in Early Medieval India (Calcutta, 1990), Chapter I.


২১. বিজয়যাত্রার সফল সমাপ্তির পরে বিশ্বজিৎ যজ্ঞ করা হতো বিশ্ব জয়কে বোঝাতে। যদিও বিশ্বকে এখানে ভৌগলিক অর্থে বোঝানো হয় নাই। কালিদাস রঘু দিগজিগীষুর বিজয় শোভাযাত্রা চিত্রিত করেছেন। রঘু চতুর্দিক জয় করার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলেন পূর্বদিক থেকে এবং বিশ্বজিৎ যজ্ঞ করেছিলেন পূর্বদিকেই যাত্রা শেষ করার পরে। রঘুবংশ ((Raghuvamsam in C.R. Devadhar, Works of Kalidasa, vol. 2 (poetry) (New Delhi, 2002), 4th sarga)|


২২. দেখুন, D.C. Sircar, ‘Cakravartī-kṣetra’, in Studies in the Geography of Ancient and medieval India (Delhi,1971), Chapter I


২৩. মনুস্মৃতি (Manusmṛti 7.154-8); Doniger and smith, pp. 143-4.


২৪. কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র (Kautiliya Arthasastra), 6.239-40. অর্থশাস্ত্রের যে টেক্সট এখানে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো, , R.G Basak, Kautikiyam Arthasastram in two pasts (Calcutta, 1964). The translation is by R.P. Kangle , The Kautiliya Arthasastra part 2 (An English Translation with Critical and Explanatory Notes) (University of Boambay, 1963)


২৫. Kangle, কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র (Kautiliya Arthasastra), p.371.


২৬. অর্থশাস্ত্র (Arthasastra), 6.1.18, প্রাগুক্ত।


২৭. S.K. Chatterji, Contributions of Different Languages-Culture Groups in H. Bhattacharya, ed. The cultural Heritage of India Vol. I (Calcutta, 1958), p.90 – এ উল্লিখিত।


২৮. মহাভারত, বনপর্ব, অরণ্যেয়—পর্বাধ্যায়। ধর্ম কী — যক্ষর এই প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্টির বলেন: ‘বিভিন্ন বেদ আলাদা। বিভিন্ন স্মৃতিও আলাদা; এমন কোনো মুনি নাই যার মত (অন্যদের মতের তুলনায়) আলাদা নয়। ধর্মের ধারণা গুহাভ্যন্তরে থাকে (অর্থাৎ, রহস্যময় থাকে); সেই পথই ধর্ম যা প্রজ্ঞাবান অতিক্রম করেন।’ প্রকৃতপক্ষে, ধর্মের অর্থ কী — যক্ষের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে, যুধিষ্টির কতগুলো রীতিকে উল্লেখ করছেন যেগুলো কোনো একটি সম্প্রদায়কে মেনে চলতে দেখা যেতে পারে।


২৯. মনু—স্মৃতি (Manu-smṛti, 7.203 and7.208); Doniger and Smith, p. 149.


৩০. যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃৃতি (Yājñavalkya Smṛti, 1.342-3).


৩১. নাট্যশাস্ত্রের যে টেক্সট এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও ছন্দা চক্রবর্তী কতৃর্ক সম্পাদিত আর দুই খণ্ডে বিভক্ত (কলকাতা, ৪র্থ পুনমুর্দ্রন, ২০১৩)। নাট্যশাস্ত্র, ১.৪১—৫।


৩২. নাট্যশাস্ত্র, চতুর্দশ অধ্যায়।


৩৩. প্রাগুক্ত, অষ্টাদশ অধ্যায়।


৩৪. প্রাগুক্ত।


৩৫. নাট্যশাস্ত্র, অষ্টাদশ অধ্যায় (১৮.৫২—৫.)


৩৬. নাট্যশাস্ত্র, ১৮.২৬।


৩৭. নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রাজশেখর ও কাব্যমীমাংসা, তৃতীয় অধ্যায়।


৩৮. প্রাগুক্ত, অনন্তান = অপি হি দেশাংশ = চতুর্র্ধা = ইভ = আকল্য কল্পযন্তি = চক্রবর্তী—ক্ষেত্রং সামান্যয়েন তদ = অনন্তরা—বিশেষয়ঃ পুনার = অনন্তা এভা ইতি যায়াভার্য।


৩৯. দেখুন, Wendy Doniger and Sudhir Kakar: Vātsyāyana Mallanāga: Kāmasūtra (A New Complete English Translation of the Sanskrit Text ) (New York, 2002),5.12, pp. 49-50.


৪০. Doniger and Kakar, p. 50


৪১. Manomohan Ghosh, Glimpses of Sexual Life in Nanda-Maurya India (Translation of the Caturbhāṇi together with a critical edition of the text ) (Calcutta, 1975). ঘোষ এই ভানগুলোর টেক্সটের সময়কাল নন্দ—মৌর্য যুগ হিসেবে নির্ধারণ করলেও কোনো গ্রহণযোগ্য পরিপূরক আলামত এই সময়কালকে সমর্থন করে না।


৪২. Manomohan Ghosh, Sexual Life, pp. 130-67, 71-81 (text).


৪৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১, আরো দেখুন, পৃ. ৭৬ (টেক্সট), যথা দেশ—জাতি—কুল—তীর্থ সময় ধর্ম …; পৃ. ৮৭ (টেক্সট)।


৪৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৬ (টেক্সট)


৪৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১—৩; পৃ. ৯১ (টেক্সট)।


৪৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৫; পৃ. ৯৩ (টেক্সট)।


৪৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫; পৃ. ১০৮ (টেক্সট)।


৪৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৬—৫৭; পৃ. ১১০ (টেক্সট)।


৪৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৭; পৃ. ১১০ (টেক্সট): বানরী নিষ্কুজিতোপমানি চীৎ—কার—ভূয়ি—স্থং—অপরাত্যভিঙ্গেয়— ব্যঞ্জজনানী কিঞ্চিত—করেণানতরাণী প্রদেশিনীধালন—মাত্র সূচিন্তানি।


৫০. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৫; পৃ. ১১৬ (টেক্সট), গান্ধারকেণ হস্তিমুর্খেন।


৫১. S.K. Nambiar, Prabodhacandrodaya of Krsna Misra (Sanskrit text with English translation, a critical Introduction and Index) (Delhi, second edition, 1998), p. 26: দক্ষিণ—রাঢ়—প্রদেশাদ—আগত …


৫২. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬। তার বিপুল জানাশোনার প্রকাশযোগ্য গর্ব হলো অহঙ্কার। পশু—প্রবৃত্তির অবিশ্বাসী/হেরেটিক, শৈব এবং পাশুপতদের সম্পর্কে তার নিজের মতামত হলো, এমনকি তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেও মানুষজন নরকে যাবে। দুর থেকেও তাদের চোখের সামনে আসা পরিহার করা উচিৎ: পৃ. ২৯।


৫৩. বাদ শব্দটি এসেছে বদ বা বলা থেকে। কোনো একটি মতবাদের কেন্দ্রীয় কথ্য বিতর্ক অর্থেই এই শব্দের মূল প্রয়োগ।


৫৪. তার দ্বাদশ প্রধান শিলা লিপিতে (Major Rock Edict XII), তিনি ঘোষনা করেছিলেন যে, তিনি তার রাজত্বের সকল মতাবলম্বীকে (পাষড) উপহার ও অন্যান্য দানসামগ্রী দিয়ে সম্মান করছেন। অশোক সকল মতাবলম্বীকে বাক সংযম চর্চা করতে এবং অন্যদের মতের নিন্দা করে নিজেদের মত প্রচার করা থেকে নিবৃত্ত থাকতে আদেশ করেন। তাঁর মতে, এই চর্চা আদপে কারো নিজের সম্প্রদায়ের উপকারও করে না। লিপিটি ও তার সংস্কৃত সংস্করণের জন্য দেখুন, D.C. Sircar, Select Inscriptions Bearing n Indian History and Civilization, vol. I (second edition. Calcutta University, Calcutta, 1965), pp. 32-4.


৫৫. S. N. Dasgupta, A History of Indian philosophy, vol. I (Cambridge University Press,1963), pp. 67-8.


৫৬. ঔপনিবেশিক ইতিহাসতত্ত্বের সূত্রপাত ঘটানো এবং একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসবিদের গ্রহণ করা ভারতীয় ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক সংস্করণকে নাকচ করতে গিয়ে, প্রায়শই আমরা একদম বিপরীত মেরুতে গিয়ে প্রাক—ঔপনিবেশিক ভারতে ধর্মীয় শান্তির একটি আদর্শায়িত ছবি প্রক্ষেপ করি। যদিও সামাজিক জীবনের একমাত্র মোটিফ হিসেবে নয়, বরং একটি মাত্রা হিসেবে রেষারেষি ও সহিংসতা ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন যুগেই অস্তিত্বশীল ছিল। কয়েকটি উদাহরণের জন্য দেখুন, B. D. Chattopadhyaya, Representing the Other? Sanskrit Sources and the Muslims: Eighth to Fourteenth Century (New Delhi, 1998), passim. Idem, other or the others? Varieties of Difference in Indian Society at the Turn of the First Millennium and Their Historiographical Implications, in studying Early India, Archaeology, Texts and Historical Issues (Delhi, 2003), pp. 191-224.


৫৭. A. Chakravarti, editor and publisher, Neelakesi (second edition, Jaipur, 1994),


৫৮. নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর রাজশেখর ও কাব্যমীমাংসা, পৃ. ৬০ (বঙ্গানুবাদ ও টিকাসহ অংশ)—এ উল্লিখিত। সম্প্রদায়গত বিদ্বেষের ব্যঞ্জনা রাজশেখরের নিচের বিবৃতিতে স্বতঃসিদ্ধভাবেই শনাক্তযোগ্য। তিনি কামকে সম্বোধন করে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন। সেখানে কামকে স্বরূপ উন্মোচন করতে নিশ্চয়তা প্রদান করে বলেন যে, তার সঙ্গীরা সবাই কেবল বৈষ্ণব আর শঙ্কর আশেপাশে নাই। (রূপম দর্শর্য় নাত্র শঙ্কর—ভয়ম সর্বে ভয়ং বৈষ্ণবাঃ), প্রাগুক্ত, ষোড়শ অধ্যায়, পৃ. ১৩৪।


৫৯. ফাউলিস গ্রানোফ (Phyllis Granoff) মধ্যযুগে জৈন গদ্যসাহিত্যের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্যের কথা বলেছেন, The Forest of Thieves and the Magic Garden (An Anthology of Medieval Jain Stories) (Penguin Books, New Delhi, 1998), p. 5. বৈচিত্র্যময় কাহিনির হলেও পরিশেষে সেগুলো নীতিশিক্ষামূলক। সঙ্কলনটির পাশাপাশি দেখুন, The Forest of Thieves and the Magic Garden, আরো দেখুন, The Clever Adulteress and Other stories (A Treasury of Jaina Liteature), edited by Phyllis Granoff (1st Indian edition 1993), পুরো বই দেখুন।


৬০. S. K. Nambiar, Prabodhacandrodaya, পুরো বই দেখুন।


৬১. ‘Matta-vilāsa: A Farce by Mahendravikrama-varman’, translated by L. D Barnett, Bulletin of the School of oriental studies, Vol 5, 1930. pp. 697-710. এই প্রহসন নিয়ে একটি অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন আলোচনার জন্য দেখুন, G. subbiah, ‘Matta-vilāsaprahasanam: Countering a Counter Culture’, in Pathways to Literature, Art and Archaeology (Pandit G. N. Bahura Felicitation Volume, Jaipur, n.d.), pp. 50-8.


৬২. এমন রেষারেষি ও সংঘাত সম্পর্কে এই সাম্প্রতিক পর্যালোচনার জন্য দেখুন, D. N. Jha, ed. Contesting Symbols and Stereotypes; Essays on Indian History and Culture ( Delhi, 2013). বিশেষভাবে দেখুন, Chapters 2 and 3.


৬৩. Hans Georg Gadame, cited in M. G. phillips, ‘What is Tradition when it is Not “Invented”? A Historiographical Introduction’, in M. G. Phillips and G. Schochet, Questions of Tradition (Toronto, 2004), pp. 3-32.


৬৪. R.T. H Griffith, The Hymns of the Ṛg-veda (second edition, 1896); 1.164.46: তারা তাকে ডাকে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, এবং তিনি স্বর্গীয় ডানা—বিশিষ্ট গরুতমান। যা কিছু এক, তাকেই ঋষিগণ বিভিন্ন ভাবে সম্বোধন করেন [;] তারা তাকে ডাকে অগ্নি, যম, মতারিস্বান।


৬৫. একই শব্দ ব্যবহার করে একই ভাবনার উপস্থিতি ভি. এ. স্মিথ (১৯১৯), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০২) এবং ডি. ডি. কোসাম্বির লেখায় থাকা বেশ তাৎপর্যময় হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ। তথ্যসূত্রের জন্য দেখুন পূর্বোল্লিখিত, S. Bhattacharya, Talking Back.


৬৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারত—তীর্থ (১৯১০)। গীতাঞ্জলি, রবীন্দ্র রচনাবলি, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ (পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৬১), পৃ. ২৮০—২। এই সংস্করণে যদি গানটিতে নাম নাই, ক্রমিক নম্বর দেয়া হয়েছে। Rabindranath Thakur [Tagore], Bharata-tirtha (1910), in Gitanjali, Rabindra Rachanavali, Birth Centenary Edition (West Bengal Government, Calcutta, 1961), pp. 280-2. স্মর্তব্য, গ্রেট হিউম্যানিটি মহামানবের ইংরেজি হিসেবে সন্তোষজনক নয়।


৬৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইতিহাস, প্রবোধ চন্দ্র সেন ও পুলিন বিহারী সেন কতৃর্ক সঙ্কলিত (কলিকাতা, ১৯৫৭), পৃ. ১—১১।


৬৮. The Culture and Civilization of Ancient India in Historical Outline (Delhi reprint, 1975), p. 1


৬৯. প্রাগুক্ত (Ibid., p. 9).


৭০. প্রাগুক্ত (Ibid., p. 13).


৭১. Viṣṇu-Purāṇam, 2.3.2,5: ‘কর্ম—ভূমির—্যাম’; আরো দেখুন, ‘ন খলবন্যত্র মর্তানাং কর্ম ভূমৌ বিধীয়তে’। আরো দেখুন, ৭৬ নম্বর টিকা।


৭২. A. K. Ramanujan, ‘Is there an Indian Way of Thinking? An Informal Essay’, in Contributions to Indian Sociology, 23.41 (1989), pp. 41-58 — এর আলাপআলোচনা দেখুন। Vinay Dharwadker, General Editor, The Collected Essays of A.K. Ramanujan ( Oxford University press, New Delhi, 1999), pp. 34-61 — গ্রন্থে এই প্রবন্ধটি অন্তভুর্ক্ত হয়েছে।


৭৩. দিগ্বিজয়ের ধারণা (চতুর্দিক জয় করা যাকে প্রায়ই বিশ্বজয় হিসেবে অভিহিত করা হয়) মহাভারত, এবং কালিদাসের রঘুবংশসহ অসংখ্য আদি টেক্সটে উল্লিখিত হয়েছে। বৈশ্বিক শাসক/রাজার মর্যাদা অর্জন করার জন্য চারদিক বশীভূত করার প্রয়োজনীয়তা এর মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, Sabhāparva (25-32) of the Maāabhārata, translated by Paul Wilmot (Clay Sanskrit Library, New York University Press, 2006).


৭৪. V. D. Savarkar, cited by Michael Gottlob, India’s Unity in Diversity as a Question of Historical Perspective, Economic and Political Weekly , vol. 42, no. 9 (2007), pp. 779-89.


৭৫. B.D. Chattopadhyaya, ‘Space, History and Cultural process; some Ideas on the Ingredients of Sub -regional “Identity”’, in Herman Kulke and Georg Berkemer, ed., Centres out There? Facets of sub-regional Identities in Orissa, pp. 21-38


৭৬. N. Venkataramanayya and M. Somasekhara Sharma, ‘Vilasa Grant of Praloya Nayaka’, Epigraphia Indica, vol, 32 (1959), pp. 239-63; in particular, p. 260. এই লিপিটিতে ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে নিচের অভিব্যক্তিগুলো ব্যবহৃত হয়েছে: ফলন্তি কর্মাণি কৃতানি যাত্রা/ ভাষা সমাচার—ভিদা বিভিন্নৈর—দেশৈর—অনেকৈর—বিভক্তে ( যেখানে কর্ম করা হতো ফল লাভের জন্য, আর যে—স্থান অনেক ভাষা ও আচারে বিভক্ত, অনেক দেশে বিভক্ত ছিল)


৭৭. Michael Gottlob, India’s Unity in Diversity, op. cit, p. 780.


৭৮. এই দুটি পরস্পর বিরোধী পদ ব্যবহারের আলাপের জন্য দেখুন, G.D. Sontheimer, ‘The Vana and the Kṣetra: The Tribal Background of Some Famous Cults’ in G.C. Tripathi and Hermann Kulke, eds, Religion and society in Eastern India: Anncharlott Eschmann Memorial Lectures, vol. I (1978-86) (Bhuvaneshwar , 1987), pp. 117-64.


৭৯. এই আন্দোলনের বিশদ পর্যালোচনার জন্য দেখুন, Ishita Banerjee-Dube, Religion, Law and Power: Tales of Time in Eastern India 1860-2000 (London, New York, Delhi, 2012), particularly Chapters I and II.


৮০. Indranath Chaudhuri, Fundamental Unity of the Indian polity in Bulletin of the Ramakrishna Mission Institute of Culture, vol. 65 no. 6 (June2014), pp. 264-70.


৮১. R.S. Sharma, Rajasasana: Meaning Scope and Application in proceedings of the Indian History Congress, 37th Session (calicut,1976), pp. 76-7.


৮২. for the explication of the expression. See S. Bhattacharya, Intro-duction in Cultural Unity of India. op. cit., pp. xxii-xxiii.


৮৩. M.B. Emeneau, Linguistic prehistory of India. In Anwar S. Dil, ed., Language and Linguistic Area: Essays by M.B. Emeneau (Stanford University Press. 1980). p. 90.


৮৪. প্রাগুক্ত। আরো দেখুন নিচের মন্তব্যগুলো : ‘ তিন গোষ্ঠীর (ইন্দো—ইউরোপীয়, দ্রাবিড়িয় ও মুন্ডা) ঐতিহাসিক সম্পর্ক বৃহদার্থে পুনর্গঠন করার বিষয়বস্তু। মধ্যভারতে তিন গোষ্ঠীর মধ্যকার সীমানাগুলোর ভৌগলিক প্রকৃতি থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, ইন্দো—ইউরোপীয়র সম্প্রসারনের আগে দাবিড়িয়র উত্তর দিকের সীমানা অনেক দিন যাবতই দক্ষিণদিকে পশ্চাদপসরণ করছে। প্রধান সীমানার উত্তর দিকের দ্রাবিড়িয় বচনের ছোট ছোট দ্বীপ এখনো বিলুপ্ত না—হওয়া পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছোপ ছোপ দাগের মতন। একইভাবে, মুন্ডার ক্ষেত্রে সেগুলো বৃহৎ বা ক্ষুদ্র বিস্তারের পরস্পর বিচ্ছিন্ন সব দ্বীপ আর এগুলো হয় ইন্দো—ইউরোপীয় নয়ত দ্রাবিড়িয়দের দ্বারা পরিবেষ্টীত এবং চাপের ফলে সঙ্কুচিত। এই কারণে মনে হওয়া উচিৎ যে মুন্ডা ও দ্রাবিড়িয় উভয়ের জন্যই বিস্তৃতি অনেক বড় ছিল আদিযুগগুলোতে।’ M.B. Emeneau, India as a Linguistic Area in Anwar S.Dil, op. cit, p. 100.


৮৫. Roger Blench, ‘Re-evaluating the Linguistic Prehistory of South Asia’, in Toshiki Osada and Akinori Uesugi, eds., Occassional paper 3: linguistics, Archeology and the Human Past ( Kyoto 2008), pp. 159-78


৮৬. এই অভিব্যক্তি বা পদটি শেলডন পোলক ব্যবহার করেছেন, ঝযবষফড়হ চড়ষষড়পশ, Sheldon Pollock, ‘The Sanskrit Cosmopolis, 300-1300: Transculturation, Vernacularization, and the Question of Ideology’, in J.E.M. Houben, Ideology and Status of Sanskrit: Contributions to the History of Sanskrit Language (Leiden, 1998), Chapter 8. আরো দেখুন, Sheldon Pollock, The Language of the Gods in the World of men: Sanskrit Culture and Power in Premodern India (University of California press: Berkley, Los Angeles, London, 2006), part I.


৮৭. বিভিন্ন স্ব স্ব ভাষাগোষ্ঠীকে এবং ( যেমন, ইন্দো—ইউরোপীয়, দ্রাবিড়িয়, ইত্যাদি) দ্যোতিত করার জন্য এই পদাবলির প্রয়োগের জন্য দেখুন, Roger Blench, Re-evaluating the linguistic prehistory, op. cit. অভিজাতশ্রেণি এবং আমলাতান্ত্রিক মনে সংস্কৃতের হেজিমনিক দখলদারিত্ব নিচের বিবৃতিতে স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয়: … ভারতের জনগণ এমন এক অনুভূতির সঙ্গে সংস্কৃতকে ভালোবাসে আর ভক্তি করে যে অনুভূতি কেবল ভারত মাতার প্রতি দেশপ্রেমের পরেই আসে। দেখুন, Report of the Sanskrit for the Nation, Modern Asian Studies, 33.2 (1999), pp. 339-81.


৮৮. কখনো কখনো বর্ণব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়া হয় ভগবদগীতার উল্লেখ করে। এক্ষেত্রে দাবি করা হয় যে, গুণ ও কর্মর উপরে ভিত্তি করে কৃষ্ণ চাতুর্বন্য সৃষ্টি (সৃষ্টম) করেছেন। কৃষ্ণ একইসঙ্গে এই ব্যবস্থার স্রষ্টা এবং স্রষ্টা নন (অকরতা); যা ব্যবস্থাটির স্বর্গীয় উৎপত্তিকেও প্রচ্ছন্নভাবে নির্দেশ করে। এধরনের বৈধতা প্রদান একথা স্বীকার করতে ব্যর্থ হয় যে, এই বিভাজন অপরিবর্তনীয় ও উত্তরাধিকার সূত্রে লভ্য ছিল (iv 13-18)। মনু (চতুর্থ অধ্যায়) স্পষ্ট করেছিলেন যে, বর্ণ অলঙ্ঘনীয় আর বর্ণ—সঙ্কর হলো অশুভ; মনু যাদের ‘হিংস্র’ অস্পৃশ্য চণ্ডাল বলেছেন মানুষের মধ্যে ‘নিকৃষ্টতমদের’ নিটশে হচপচ (hotchpotch) মানবকুল হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন (Doniger and Smith, pp. xx and p. 236) — এ উল্লিখিত। উপরিল্লিখিত, ভারততীর্থ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য সামাজিক বর্গগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ব্রাক্ষ্মনদেরও ডেকেছেন একত্রে মাতৃভূমির প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে তিনি ব্রাক্ষ্মণদের আহ্বান করছেন: ‘এসো ব্রাক্ষ্মণ, শুচি করি মন/হাত ধরো সবাকার’। ব্রাক্ষ্মণদের মন শুচি করার এই আহ্বান সেই মর্যাদার পুরোপুরি উল্টো যে মর্যাদায় সে শুচিতার—ক্রমবিন্যাসে সবার উপরে তার অবস্থান।


৮৯. ২০১৪ সালের জুন মাসে হিমাচল প্রদেশের বাস্পা উপত্যকার ছিটকুল নামের এক দুরবর্তী গ্রামে একবার যাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে একথা বললাম।


৯০. যারা এই বিশ্বাসে অটল যে আমিষাহার ভারতীয় ঐতিহ্যের বিরোধী এবং পাশ্চাত্য থেকে আসা একটা ঘৃণ্য তামসিক অভ্যাস তাদের জন্য বিভিন্ন প্রমাণ যেসব গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে Om Prakash, Food and Drinks in Ancient India (New Delhi, 1961, passim and Appendix VII) | । এছাড়াও রয়েছে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত যা এই বিশ্বাস ভুল প্রমাণ করতে পারে। এরপরেও, যে—কেউ বাল্মীকির রামায়নে (অযোধ্যা—কাণ্ড, সর্গ ৮৫.২১—৭৭) নির্বাসনে থাকা রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সময় ভরতের সেনাবাহিনীকে ঋষি ভরদ্বাজ কীভাবে আপ্যায়ন করেছিলেন তার বিবরণী পড়ে দেখতে পারেন।


প্রথম প্রকাশঃ ১২ই কার্তিক, ১৪২৮ ::: ২৮শে অক্টোবর, ২০২১

[ লিঙ্কঃ https://swadhinsen.com/2021/10/28/191/?fbclid=IwAR1AjemD6HM6GANrSmza95CFMq-emk0TMTBBairN9dYWutAI6oedHqtubwA ]

পুনঃপ্রকাশঃ ২৮শে অগ্রহায়ণ,১৪২৮ ::: ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২১