নিয়ন্ত্রিত সমাজের পুনর্পাঠ

জিল দেল্যুজ



[প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জিল দেল্যুজের ১৯৯০ সালের Post-scriptum sur les sociétés de contrôle প্রবন্ধটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে এমআইটি প্রেসের অক্টোবর নামের জার্নালের ৫৯তম ভল্যুমে অর্থাৎ ১৯৯২ সনের শীত সংখায় প্রকাশিত হয়। মিশেল ফুকোর শৃঙ্খলিত সমাজের ধারণার উপর দাঁড়িয়ে সমাজের গড়ন ও নিয়ন্ত্রণে চলমান শিফট বা পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা দেল্যুজের এই গুরুত্বপূর্ণ Postscript on the Societies of Control লেখাটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। দেল্যুজের কাজ নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত পড়াশোনা ও অনুবাদের কাজে যুক্ত আছেন তিনি তিনি পেশায় শিক্ষক, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান।]



১ ঐতিহাসিক

ফুকো আঠারো এবং উনিশ শতকের সমাজব্যবস্থায় তাঁর শৃঙ্খলিত সমাজব্যবস্থা (disciplinary societies) চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য তিনি বিংশ শতাব্দীতে এর চূড়ান্ত রূপটি দেখাতে ভোলেননি। এই ধরনের সমাজগুলোতে প্রতিষ্ঠানগুলো বৃহৎ পরিসরে বন্দীশালার ভূমিকা পালন করে। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানেরই আছে নিজস্ব রীতিনীতি, আর ব্যক্তি মাত্রই এইসব প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির বাইরে যেতে পারে না। এক প্রতিষ্ঠান হতে আরেক প্রতিষ্ঠানে গমন মানেই এক ঝাঁক রীতিনীতি ছেড়ে আরেক ঝাঁক রীতিনীতির মাঝে প্রবেশ। ভাবুন আপনার পরিবারের কথা [যখন আপনি পরিবারের মাঝে থাকেন তখন আপনি পারিবারিক/সাংসারিক কিছু নিয়ম মেনেই চলাফেরা করছেন], এরপর ভাবুন স্কুলের কথা [স্কুলে প্রবেশের সাথে সাথে আপনি আর কিন্তু পরিবারের রীতিনীতি নয়, বরং স্কুলের রীতিনীতি অনুযায়ী চলাফেরার চেষ্টা করছেন] এরপর যদি আপনি সৈন্যদের ব্যারাকে যান, আপনি কিন্তু আর স্কুলের নিয়মনীতির অধীনে নেই। এইভাবে ভাবুন কলকারখানার কথা, হাসপাতালের কথা, [সোজা কথা যখনই আপনি প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছেন, আপনি এক ঝাঁক নিয়মকানুন মাথা পেতে নিচ্ছেন] এবং সবচাইতে ধাক্কা মারার মত উদাহরণ হিসেবে অবশ্য আমরা দেখি জেলখানাকে, তার বদ্ধ পরিবেশকে, তার অলঙ্ঘনীয় শৃঙ্খলাকে। এই শৃঙ্খলিত সমাজব্যবস্থার চিত্র রোসেলিনি পরিচালিত “ইউরোপা ৫১” ছবির নায়িকার একটি উক্তিতেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কিছু শ্রমিককে দেখে তিনি আশ্চর্য্য হয়ে বলে উঠেন, “মনে হচ্ছিল যেন কিছু আসামী দেখছি।“


ফুকো কিন্তু এই বন্দিদশার চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন, কারখানার অবস্থার কথা তিনি উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করা হয়। জায়গা অনুযায়ী সাজানো হয়, সময় অনুযায়ী শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। কিন্তু কেন করা হয়? সময় এবং স্থানের পরিসরে একটা নির্দিষ্ট উৎপাদন শক্তি এক এক করে আরও লাভজনক কিছুর আশায়। ফুকো এর কাঠামোর পরিবর্তনও কিন্তু লক্ষ্য করেছেন। এই কাঠামো মূলত এসেছে সার্বভৌমত্বের সমাজগুলো (societies of sovereignty) হতে যার মূল লক্ষ্য এবং কার্যক্রম ছিল ভিন্নঃ যেমন উৎপাদনের আয়োজন করার পরিবর্তে কর আরোপ করা; জীবনযাপন শৃঙ্খলিত করার পরিবর্তে মৃত্যুর পরোয়ানা নির্ভর আদেশ জারি করা। পরিবর্তন অবশ্য একদিনে আসেনি—সময়ের প্রেক্ষিতেই এসেছে, সময় নিয়েই এসেছে। এই পরিবর্তন আনার ব্যাপারে নেপোলিয়ান বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এক সমাজ ব্যবস্থা হতে আরেক সমাজব্যবস্থায় তিনি আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছেন, কিন্তু সময়ের পথ-পরিক্রমায় এই নিয়মশৃঙ্খলাসমূহ নতুন শক্তির কব্জায় এসে পড়লো। এই নিয়ম শৃঙ্খলাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হলো এবং ব্যাপারটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পালে হাওয়া পেল। শেষকথা হলো এই যে, আমারা আর শৃঙ্খলিত সমাজের অধীনে রইলাম না, ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটেছে।


যেকোন বদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সার্বিকভাবে যে আমরা ঝামেলায় আছি বোঝাই যাচ্ছে। [বদ্ধ পরিস্থিতি মানে জেলখানা, বিদ্যালয়, পরিবার] শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে বলি বা কার্যক্ষেত্রের দিক থেকে চিন্তা করলে পরিবার ছোট অবস্থানে আছে। স্কুল, কলকারখানা, হাসপাতাল, সেনানিবাস, জেলখানা—সব জায়গার কর্তাব্যক্তির মুখে এক সুর, “পরিবর্তন দরকার”, মেয়াদ যত দীর্ঘই হোক না কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সমাপ্তি ঘোষনার সময় এসে গেছে। সবাই এখন তা জানে। ব্যাপারটা হচ্ছে নতুন পরিবর্তন দোরগোড়ায় এসে কড়া না নাড়া পর্যন্ত কিছু নিয়মনীতি পালন করা আর মানুষকে চাকরীতে বহাল রাখা, একেই বলা হচ্ছে “নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা (societies of control)”। বারোই (William S. Burroughs) প্রথম “নিয়ন্ত্রণ”-এর পরিবর্তে শব্দটা প্রস্তাব করেছেন। ফুকো তো একেই ভবিষ্যৎ বলেছেন। পল ভিরিলো (Paul Virilio) অবশ্য এই অতিমূল্যায়িত মুক্ত-ভাসমান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই মুক্ত-ভাসমান নিয়ন্ত্রণই জায়গা করে নিচ্ছে পুরনো সময় এবং স্থানের বেড়াজালে আটকে যাওয়া শৃঙ্খলব্যবস্থার, এর জন্যে অবশ্য অন্যরকম ঔষধ উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণার প্রয়োজন নেই; নেই প্রয়োজন পারমাণবিক প্রকৌশল কিংবা জিন পরিবর্তনের ধুয়া তোলা, যদিও নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রবেশের জন্যে এসবও সমালোচনার দাবি রাখে। এর মাঝে কোনটা সবচাইতে কঠোর শাসনব্যবস্থা এই প্রশ্ন তোলা অবান্তর, কেননা প্রতিটা শাসনব্যবস্থার মাঝেই বিদ্যমান পরস্পর ক্রিয়াশীল গলা চেপে ধরা এবং মুক্ত করে দেয়ার ব্যাপারস্যাপার। হাসপাতালের বদ্ধ পরিবেশের কারণে অনেকে কাছাকাছি ক্লিনিক, ডে-কেয়ার, হসপিস বা সেবা সদনের চিন্তা করতে পারে কিন্তু এরাও নামান্তরে বদ্ধ জায়গায় নিয়ন্ত্রণেরই ব্যবস্থাপনা। পরিশেষে বলতে হবে, ভয় পাওয়ারও কিছু নেই, আবার আশান্বিত হওয়ারও কিছু নেই, শুধু নতুন অস্ত্র কিংবা উপায়েরই অপেক্ষা।

২ যুক্তি

ব্যক্তি যে সকল ভিন্ন স্থান বা বন্দিদশার মধ্যে জীবনযাপন করে তাদের প্রত্যেকেরই ভিন্নতা আছে। প্রতিটা প্রেক্ষিতে ব্যক্তিকে শূন্য থেকে চিন্তা করা লাগে, যদিও সব স্থানের ভাষা একই—“তুলনীয়” বলা যেতে পারে। অন্যদিকে ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (কন্ট্রোল মেকানিজম) সমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কিন্তু ভিন্ন, যা গঠন করে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক ব্যবস্থাপনা। এই জ্যামিতিক ব্যবস্থাপনার ভাষা মূলত “গাণিতিক” বা “সংখ্যাসূচক” [যা অবশ্যই “বাইনারি(যুগ্ম বৈপরীত্য)” নয়]। এই আবদ্ধ জায়গাসমূহকে এক একটা ছাঁচ হিসেবে ভাবা যেতে পারে যার প্রতিটা ভিন্ন জাতের ঢালাই। কিন্তু কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটাকে ভাবতে হবে “মড্যুলেশন” হিসেবে। এই মড্যুলেশনের কিন্তু নিজেকে নিজের ভাঙ্গার বা পরিবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে—প্রতিটা ক্ষণে, প্রতিটা মূহুর্তে। এই মড্যুলেশন চালুনি বা ঝাঁঝরির ন্যায় যার প্রতিটা জাল একে অপর হতে স্থান বিশেষ ভিন্ন।


বেতনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ প্রকট। একটা সময় ছিল যখন কারখানাগুলো ছিল মূল প্রতিষ্ঠান। এই কারখানাগুলো তাদের ভেতরের শক্তিগুলোর মাঝে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করত। চেষ্টাটা চলত সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভাব্য কম মজুরী দেয়ার টানাপোড়েনের মাঝে স্থিতি স্থাপন করার। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত সমাজে কর্পোরেশন হলো মূল চালিকাশক্তি বা গ্যাস। কারখানাগুলো অবশ্য শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো বা বোনাস দেয়ার ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলো, কিন্তু কর্পোরেশন বেতনের উপর মড্যুলেশন আরোপের জন্যে আরও সূক্ষ্মভাবে কাজ করে। ঝুঁকি, প্রতিযোগিতা কিংবা অসম্ভব হাস্যকর দলীয় সভার মারফত কার্যকর এই কর্পোরেশন ক্রমাগত মেটাস্ট্যাবিলিটিতে থাকা অবস্থার মারফত কাজ করে। টিভিতে সবচাইতে ফালতু গেমশো জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো তারা কর্পোরেট অবস্থা বেশ নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলে। একটা সময়, ফ্যাক্টরিগুলো সকলকে সংঘবদ্ধভাবে উপস্থাপন করতো। এতে মালিক পক্ষের দ্বিগুণ লাভ হতোঃ মালিকপক্ষ সবকিছু নিখুঁতভাবে সার্ভে করতে পারতো আর ইউনিয়ন সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধের দিকে ধাবিত হতে পারতো। পক্ষান্তরে, কর্পোরেশন নগ্ন প্রতিযোগিতার সমতা আনয়নকারী এক চমৎকার উদ্দীপক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকে যা ব্যক্তিকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায় এবং বিবাদ সৃষ্টি করে। “মেধা অনুসারেই বেতন” এই হল মড্যুলেটিং-এর মূল সূত্র যা জাতীয় শিক্ষাকার্যক্রমকেও প্রভাবিত করে। কর্পোরেশন যেরূপে কলকারখানায় জায়গা করে নিচ্ছে, “ক্রমাগত প্রশিক্ষণ” জায়গা করে নিচ্ছে স্কুলের। আর নিয়ন্ত্রণ জায়গা করে নিচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতির। স্কুলকে কর্পোরেশনের দিকে ঠেলে দেয়ার এক সুনিশ্চিত ব্যবস্থা বৈকি।


শৃঙ্খলিত সমাজে ব্যক্তিকে প্রতিটা ক্ষেত্রে নতুন করে শুরু করতে হয় (স্কুল থেকে সেনানিবাসে, সেনানিবাস থেকে কারখানায়)। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রিত সমাজে কোন এক নির্দিষ্ট স্থান শুধু তার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। কর্পোরেশন, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা বাহিনী এই সমাজ ব্যবস্থাপনায় মেটাস্টেবল অবস্থায় এক হয়ে সহাবস্থান করে এবং এদের মড্যুলেশন একই, অনেকটা নিজেকে নিজে ভাঙ্গার সার্বজনীন রীতির ন্যায়। দুই জাতের সমাজ বাস্তবতার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিজেকে বসিয়ে [ফ্রানৎস] কাফকা তাঁর “দি ট্রায়াল” গল্পে সবচাইতে ভয়ানক বিচার-ব্যবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। শৃঙ্খলিত সমাজে (দুই বন্দীদশার মাঝে) আপাতত যে “মুক্ত অবস্থা” এবং নিয়ন্ত্রিত সমাজে (নিরবচ্ছিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়) যে “অগণিত ছেদ কিংবা যতি” – এই দুই ব্যবস্থাপনা দুই ধরনের বিচার ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়। ক্রান্তিলগ্নে যখন আমরা এক সমাজব্যবস্থা হতে আরেক সমাজব্যবস্থায় প্রবেশ করছি, আইনকে হয়তো বিক্ষিপ্ত মনে হতে পারে।


শৃঙ্খলিত সমাজের দুই দিকঃ “ব্যক্তিকে” চিহ্নিত করার স্বাক্ষর এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নম্বর পদ্ধতিতে দেয়া একটি সংখ্যা যা দিয়ে “সমষ্টি”র মধ্য হতে “ব্যক্তি”কে চিহ্নিত করা যায়। এর কারণ হলো, এই সমাজব্যবস্থায় এই দুইয়ের মাঝে কোন অসঙ্গতিই দেখতে পায়নি। আরও একটা কারণ হল, ক্ষমতা যেমন ব্যক্তিকরণও করে আবার সমষ্টিকরণও করে। আরও খোলাসা করে বললে, এভাবেই দাঁড়ায়, ক্ষমতা যাদের ওপর কর্তৃত্ব করে তাদের সংগঠিত করে এবং ঐ সমষ্টির প্রতিটা ব্যক্তিরই স্বাতন্ত্র্য কেটে ছেটে দেয়। (ফুকো গ্রাম্য ধর্মযাজকদের মাঝে এই দ্বৈত ক্ষমতার প্রয়োগ দেখেছেন—বিশেষ করে পশুর পাল এবং এর প্রতিটা পশুর ব্যাপারে। যাইহোক, সিভিল পাওয়ার বা ক্ষমতার গতিপ্রকৃতি অবশ্য ভিন্ন। এটি নিজে নিজের “ধর্মযাজক” প্রসব করে।) অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত সমাজে ব্যাপারটা ভিন্ন। এইখানে না স্বাক্ষর, না সংখ্যা—কোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়; যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল কোড [code], কোড মানে “পাসওয়ার্ড”। অন্যদিকে শৃঙ্খলিত সমাজ কিন্তু মূলত “ওয়াচওয়ার্ড” বা “পুলিশিবাক্য” দ্বারা চালিত [একীভূত করার দৃষ্টিকোণ হতে এটি যেমন সত্য, প্রতিরোধের দৃষ্টিকোণ হতেও তা-ই]। নিয়ন্ত্রণের যে গাণিতিক ভাষা তা মূলত কোড। এই কোড দিয়েই তথ্যভাণ্ডারে ঢুকতে পারা, না পারা নির্ভর করে। এমতাবস্থায় আমরা নিজেদের আর ব্যক্তি/সমষ্টি এই ধরনের জোড়ায় খুঁজে পাব না। ব্যক্তি বা individual এখন dividual-এ পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে সমষ্টিকে ধরা হয়, স্যাম্পল বা নমুনা, ডাটা বা তথ্য, বাজার, ব্যাংক ইত্যাদি। এই দুই সমাজের পার্থক্য সম্ভবত সবচাইতে ভালো বোঝা যায় টাকার মাপকাঠিতে, যেহেতু শৃঙ্খলা (discipline) বলতে একসময় টাকশালের টাকা আর তার পেছনে নির্দিষ্ট অংকের মজুদকৃত স্বর্ণকে বোঝাতো, কিন্তু নিয়ন্ত্রণকে বুঝতে হবে মুক্ত বিনিময় হারের (যা নির্দিষ্ট বিনিময় হারের বিপরীত) সাপেক্ষে। এই মুক্ত বিনিময় হার সামঞ্জস্য বিধান করে চলতি এবং গ্রহণযোগ্য মুদ্রার হারের প্রেক্ষিতে। পূর্বের আর্থিক একক বদ্ধ জায়গার প্রাণী বা চামচিকার ন্যায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত সমাজে এই আর্থিক একক সাপের ন্যায়। আমাদের গন্তব্য এক প্রাণী হতে আরেক প্রাণীঃ চামচিকা থেকে সাপে।


বিভিন্ন জাতের মেশিন যেকোন সমাজেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যাপারটা এমন নয় যে, এর দ্বারা কিছু নির্ধারিত হয়, বরং এই মেশিন সমুহ সামাজিক কাঠামো নির্দেশ করে, বিশেষ করে সামাজিক কাঠামোর সেই ক্ষমতা যা এই ধরনের মেশিন উৎপাদন এবং ব্যাবহার করতে পারে। পুরাতন সার্বভৌমত্বের সমাজ লিভার, কপিকল , ঘড়ি ইত্যাদির সমন্বয়ে সরল মেশিন তৈরী করতো। কিন্তু সাম্প্রতিক শৃঙ্খলিত সমাজ নিজের সাথে মেশিনকে জুড়ে নিচ্ছে শক্তি প্রবাহের সমন্বয়ে। এই শক্তি প্রবাহের মাঝে আছে সুপ্ত এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা কিংবা নাশকতার সরাসরি সম্ভাবনা। এদিকে নিয়ন্ত্রিত সমাজের কাজ কর্ম তৃতীয় আরেক জাতের মেশিন নিয়ে—তা হল কম্পিউটার, যার মাঝে সুপ্ত বিপদ হিসেবে ঘুমিয়ে থাকে কোন কিছু আটকে দেয়ার সম্ভাবনা আর, স্বয়ংক্রিয় বিপদ হিসেবে জেগে থাকে জালিয়াতি আর ভাইরাস লেলিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা।


আমাদের জীবনযাপনে এবং অন্যদের সাথে সম্পর্ক রক্ষার্থে এই ধরনের ব্যবস্থাপনায় আমরা বেঁচে থাকি। শৃঙ্খলিত মানুষ অনিয়ন্ত্রিত শক্তির উৎপাদক, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত মানুষ নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্কের কক্ষপথে ঢেউয়ের মত চলতে থাকে। সবখানেই পুরনো “খেলা”র জায়গায় এসে পড়েছে “সার্ফিং”।


মেনে নিতেই হবে প্রযুক্তির এই বিবর্তন মানে পুঁজিবাদের আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তন অবশ্য পরিচিত পরিবর্তন, কথাটা এভাবেও বলা চলে যে, উনিশ শতকের পুঁজিবাদ উৎপাদন এবং সম্পত্তি উভয়কে ঘনীভূত করার পুঁজিবাদ। সেই সময় পুঁজিপতিরা উৎপাদন প্রক্রিয়া সহ অন্যান্য জায়গাজমির মালিক হওয়ার কারণে শ্রমিকদের বাসস্থান কিংবা স্কুলের আদলে; কলকারখানাগুলোকে আবদ্ধ জায়গা হিসেবে নির্মাণ করে। বাজারে আধিপত্য বিস্তারের ছলাকলাও চলতে থাকে। তা হয়, মাঝে মাঝে পণ্যের বিশেষায়নের মারফত, মাঝে মাঝে (এক ধরনের) উপনিবেশায়ন অথবা মাঝে মাঝে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে। কিন্তু এই সময়ে, পুঁজিবাদ সরাসরি উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত নয়। জটিল ধরনের কাপড় বুনন, ধাতু নির্মাণ থেকে তেল উৎপাদন সবই এখন পুঁজিবাদী দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পুঁজিবাদ উঁচুস্থরের উৎপাদনের সাথে জড়িত। এই পুঁজিবাদ কাঁচামালও কেনে না, পরিপূর্ণ পণ্যও বিক্রি করে না, পুঁজিবাদী দেশগুলো বরং পরিপূর্ণ দ্রব্য কিনে নেয় কিংবা যন্ত্রাংশ জোড়া দেয়ার কাজ করে [যাকে আমরা assemble করা বলি], ধনী দেশগুলো এখন “স্টক” কেনার বিনিময়ে পণ্যের “সেবা” বিক্রি করতে চায়। এই পুঁজিবাদকে বরং উৎপাদনের পুঁজিবাদ না বলে দ্রব্যের পুঁজিবাদ বলা ভালো— আরও গুছিয়ে বললে যে দ্রব্য বাজারজাত হওয়া বা বিক্রিত হওয়ার জন্যে প্রস্তুত, তার-ই পুঁজিবাদ এটা। কর্পোরেশন এখন কলকারখানার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর আবশ্যকিভাবে আগের পুঁজিবাদ আর বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। এখন আর বলা চলেনা যে পরিবার, স্কুল, প্রতিরক্ষা সবই রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তির ইচ্ছার আওতাধীন একই জাতের প্রতিষ্ঠান। এসব এখন শুধু ভেঙ্গে দেয়ার মত এবং পরিবর্তন করার মত কিছু “কোড” যা একক কোন কর্পোরেশনের আয়ত্ত্বাধীন। এই কর্পোরেশন এখন স্টেকহোল্ডার। এমনকি তার নিজের সীমানা ছাড়িয়ে ব্যাংকের চক্করে প্রবেশ করেছে। বাজার জয় করার জন্যে দীর্ঘ দিনের প্রশিক্ষণ নয়, বরং বাজার আয়ত্ত্ব করার কৌশল জানলেই চলে। পণ্য মূল্য কমিয়ে নয়, বরং বিনিময় মূল্য যুতসইভাবে জুড়ে দিতে পারলে হয়; পণ্যের বিশেষায়ন নয়, জায়গা বুঝে পরিবর্তন করে দিতে পারলেই চলে। দুর্নীতির নতুন মাত্রা আরকি। কর্পোরেশনের মূল নীতি বা “আত্মা”ই হলো বাজারজাতকরণ বা মার্কেটিং, আমরাও শিখলাম কর্পোরেশনেরও “আত্মা” আছে। পৃথিবীর জন্যে ভয়াবহ ব্যবস্থা বৈকি।


বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনায় এখন সমাজ নিয়ন্ত্রণের উপায় এবং এর মারফতেই আমাদের নিয়ন্ত্রকদের পরবর্তী বেহায়া জাত গঠিত হয়। নিয়ন্ত্রণ বলতে স্বল্প সময়ে দ্রুত লাভ বোঝায়। এটি বিরামহীন এবং সীমাহীন; অন্যদিকে শৃঙ্খলা ব্যাপারটা দীর্ঘ মেয়াদের দিকে নির্দেশ করে, এটিও সীমাহীন ব্যবস্থাপনা তবে ছেদযুক্ত। মানুষ এখন বন্দী মানুষ নয়, ঋণগ্রস্থ মানুষ। সত্য বটে পুঁজিবাদ টিকেই আছে তিন-চতুর্থাংশের চরম দারিদ্রের কারণে। যেই দরিদ্রগুলো এত দরিদ্র যে এরা ঋণও নিতে পারেনা। আবার এরা সংখ্যায় এত বেশি এদের এক ছাঁচে আবদ্ধ করা যায় না। নিয়িন্ত্রণ মানে তো শুধু সীমানা মুছে দেয়া নয়; এর মানে নোংরা শহর কিংবা বস্তিতে বিস্ফোরণ চালানোও বটে।

৩ প্রোগ্রাম বা ব্যবস্থাপনা

নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার ধারণা কিন্তু মোটেও বৈজ্ঞানিক কোন গালগল্প নয়। যেকোন কিছুকে [তা সে হোক আবদ্ধ অবস্থার পশু কিংবা কর্পোরেশনের মানুষ] গলায় বৈদ্যুতিক কলার পরিয়ে খোলা জায়গায় ছেড়ে দেয়ার মত। ফেলিক্স গুয়াত্তারি এমন এক শহরের কথা প্রায় চিন্তা করে থাকে যে যেখানে কেউ (স্বাচ্ছন্দে) তার বাসা, রাস্তা, এলাকা ছেড়ে ঘুরতে পারবে। সেই (individual) বৈদ্যুতিক কার্ডকে ধন্যবাদ দিতেই হয় যা সকলের মাঝে এক (অদৃশ্য) দেয়াল তুলে দিয়েছে। কিন্তু মন্দ দিকটা হল, এই কার্ড এক দিনে বা নির্দিষ্ট কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে বাতিল করে দেয়া যায়। প্রতিটা ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারণের জন্যে কম্পিউটার এখন বড় ভূমিকা পালন করে। আইনি বা বেআইনিভাবে কম্পিউটার এখন সবার অবস্থানই [নজরে রাখে বা] ট্রাক করে আর ইউনিভার্সেল মড্যুলেশনকে প্রভাবিত করে।


শুরু থেকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণের কলকব্জাগত সামাজিক-প্রযুক্তিগত বোঝাপড়া হওয়া উচিত শ্রেণিবদ্ধ; এবং এটাও পরিষ্কার করে বুঝে নিতে হবে শৃঙ্খলিত আবদ্ধ অবস্থার পরিবর্তে কোন ব্যবস্থাপনা তার জায়গা দখল করবে, কিংবা কাদের সমস্যা সর্বত্র প্রকটভাবে দেখা দেবে। হতে পারে, পুরনো সার্বভৌম সমাজ আবার নতুনভাবে ফিরে আসবে—হয়তোবা নতুন রূপে। আর ব্যাপার হচ্ছে আমরা কিছু একটা[র] গোড়াতে আছি। “কারারূদ্ধ পরিস্থিতিতে” ছোটোখাটো কোন অপরাধের “প্রতিস্থাপনের” দণ্ডের চেষ্টায়, এবং বৈদ্যুতিক কলার ব্যবহারের চেষ্টায় যা দণ্ডিত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট কয়েক ঘন্টা বাসায় থাকতে বাধ্য করা। স্কুল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আছে বিরামহীন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, এর প্রভাব গিয়ে পড়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা হতে শুরু করে সব প্রশিক্ষণের বেলায়। মানে স্কুল ব্যবস্থাপনার মধ্যেই কর্পোরেশন ব্যবস্থা চালু করা। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে “ডাক্তার কিংবা রোগী” ছাড়া নতুন পথ্য যা সম্ভাব্য রোগী এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের আলাদা করে ফেলবে। বলা হয় ব্যাপারটা কোনোভাবেই “individuation” ব্যক্তির individuation-এ জোর দেয়না বরং ব্যক্তির প্রতিস্থাপনে আসে সংখ্যা, অবিভাজ্য ব্যক্তি বিভাজ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয় [individual to dividual] যা নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ। আর কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় পুরনো কলকারখানার পদ্ধতিতে আর নতুন উপায়ে টাকা লেনাদেনা, লাভ এবং ব্যক্তি কোনোটাই খাপ খায়না। এগুলো আসলে খুবই ছোট উদাহরণ, প্রতিষ্ঠান সংকট ব্যাপারটা ভালোভাবে বোঝার জন্যে যে ধরনের উদাহরণ দরকার তা হলো, ক্রমবর্ধমান এবং ক্রমপ্রসারিত নতুন আধিপত্যবাদী ব্যবস্থাপনার গেঁড়ে বসা। এবার হয়তো ইউনিয়ন সমূহের অদক্ষতার ব্যাপারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসতে পারে। কেননা এই ইউনিয়ন সমূহের সমগ্র ইতিহাসই হলো শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ইতিহাস কিংবা বদ্ধ অবস্থায় থেকে সংগ্রামের ইতিহাস, এই নিয়ন্ত্রিত সমাজের সাথে নিজেদের খাপখাওয়াতে কি পারবে এরা? নাকি নতুন ব্যবস্থাকে এরা তাদের জায়গা ছেড়ে দেবে। বাজারজাতকরণের আনন্দ নষ্ট করে দেয়া এই মোটাদাগে উদীয়মান নতুন ব্যবস্থাপনা কি আমরা হজম করতে পারছি? অসংখ্য তরুণ আজবভাবে এই ব্যাপারে “উৎসাহিত”, তারা তো রীতিমতো এই ব্যাপারে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, কর্মশালার বারবার দাবী জানাচ্ছে, যদিও এটা তাদের ব্যাপার খুঁজে বের করা যে কিসের উদ্দেশ্যে তাদের তৈরী করা হচ্ছে; যেমনটি, বিশেষ কোন অসুবিধা ছাড়া, তাদের পূর্বসূরীরা শৃঙ্খলের সম্ভাবনা এবং উদ্দেশ্যখুঁজে নিয়েছিল। সাপের কুণ্ডলী ছুঁচোর গর্তের চাইতে* জটিলই বৈকি।


* ছুঁচোর গর্ত ভেতরের দিকে রাইজোম(rhizome) সদৃশ এবং আন্তর্জালিক।



অনুবাদকের টীকাঃ

[] খেয়াল রাখা ভালো, ফুকো বলেছেন শৃঙ্খলিত সমাজ (disciplinary societies) আর দেল্যুজ বলছেন নিয়ন্ত্রিত সমাজ (societies of control)। দেল্যুজ মনে করেন নিয়ন্ত্রিত সমাজই এখন শৃঙ্খলিত সমাজের জায়গা করে নিচ্ছে।

[] মড্যুলেশন (modulation) ব্যাপারটা দুই শৃঙ্খলিত স্থানের মধ্যবর্তী সামঞ্জস্য বিধানের জায়গাটা বোঝানো হচ্ছে।

[] মেটাস্ট্যাবিলিটি (metastability) পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষা। উদাহরণ মারফত বললে, বলতে হয়, ব্রিলিয়ার্ড বল যখন গর্তের একেবারে কিনারায় এসে যে অবস্থায় (মানে অতি মৃদু কম্পনেও যা গর্তে পড়ে যেতে পারে) দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি।

[] দেল্যুজ এখানে যা বোঝাতে চাচ্ছে তা হল, ফুকো যেই শৃঙ্খলিত সমাজের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের রয়েছে, নির্দিষ্ট নিয়মকানুন যার কারণে এক জায়গার আচরণবিধি অন্য জায়গায় প্রযোজ্য নয়।

[] বলে রাখা ভালো individual শব্দটি ল্যাটিন শব্দ থেকে আগত যা অবিচ্ছেদ্য বোঝায়, আর dividual মানে যা ব্যবচ্ছেদ করা যায় তা বোঝানো হচ্ছে।

[] দেল্যুজের মতে সবকিছুই মেশিন—হোক তা প্রাণী, বস্তু কিংবা সামাজিক সংস্থা।

[] ভৌত ব্যবস্থায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা-মাত্রা বা এনট্রপি (Entropy) বা রুদ্ধতাপ হলো পরিসংখ্যানিক বলবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাশি। কোন প্রক্রিয়ায় আগাগোড়াই যদি তাপীয় সাম্যাবস্থা সংরক্ষিত থাকে, তাহলে সেখানে বিশৃঙ্খলা-মাত্রার মানও অপরিবর্তিত থাকে।

[] দেল্যুজ এই স্থলে পরিবর্তন বোঝাতে মিউটেশন (mutation) শব্দটি ব্যবহার করেছে। আমরা জানি “জিন”গত পরিবর্তন সাধনকেই মিউটেশন বলা হয়।

[] এই স্থলে “telos” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে—যা এরিস্টটল ব্যবহার করেছিলেন।


হদিস- https://www.jstor.org/stable/778828?seq=1

প্রকাশঃ ২৫শে মাঘ, ১৪২৭:::৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১