আমরা কি ভিন্নতা’র এমন এক অন্টলজি নির্মাণ করতে পারিনা যা নিছক বিরোধীতায় পর্যবসিত হবেনা?

জিল দেল্যুজ


Genesis and Structure of Hegel’s Phenomenology of Spirit বইটা পুরো হেগেলকেই ধারণ করে। আবার একই সাথে হেগেলের ওপরে মন্তব্যও বটে। এই নতুন বইয়ের মতলব সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটা সুনির্দিষ্ট ধারণার ভিত্তিতে ও একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে এপ্পোলিৎ Logic, Phenomenology, ও Encyclopedia কে জিজ্ঞাসাবাদ (question) করে। দর্শনকে অন্টোলজিই হতে হবে, এর অন্যথা হতে পারবেনা। কিন্তু কেবল বোধের(sense)ই একটা অন্টোলজি আছে, সারবস্তুর(essence) কোন অন্টোলজি নেই। মনে হয়, এটাই এই দরকারি বইয়ের (যার ভঙ্গিই আবার ভীষণ শক্তিশালী) আলোচ্য বিষয়। দর্শনকে অন্টোলজি হতে গেলে প্রথমে যে ব্যাপারটা আসে তা হচ্ছে দর্শন নৃবিদ্যা হবেনা। নৃবিদ্যা মানুষ সম্বন্ধীয় একটা শাস্ত্র হতে চায়। মানুষ সম্বন্ধীয় অভিজ্ঞতাবাদী বয়ানে, যে বয়ান দিচ্ছে আর যার সম্পর্কে দেয়া হচ্ছে তাদেরকে আলাদা কল্পনা করা হয়। নৃবিদ্যা এটাকে পূর্বানুমান হিসেবে ধরে নেয়। যার একদিকে থাকে প্রতিফলন(reflection), আর অপরদিকে সত্তা। জ্ঞানকে এইভাবে বোঝাটা একটা তৎপরতা যেই তৎপরতা ঐ জিনিসের তৎপরতা না। এটা বিষয়বস্তুর বাইরে থেকে যায়। জ্ঞান সেক্ষেত্রে বিমূর্তায়নের ক্ষমতা এবং প্রতিফলন(reflection) হচ্ছে বহিঃস্থ ও আঙ্গিকগত প্রতিফলন(formal reflection)।


অভিজ্ঞতাবাদ একধরনের আঙ্গিকতাবাদের দোহাই দেয়। ঠিক যেমন আঙ্গিকতাবাদ একধরনের অভিজ্ঞতাবাদের দোহাই দেয়। অভিজ্ঞতবাদী চৈতন্য এমন একধরনের চৈতন্য যে নিজেকে ইতোমধ্যে অস্তিত্বশীল সত্তার দিকে পরিচালিত করে ও প্রতিফলনকে এই চৈতন্যের সাবজেক্টিভিটিতে অবনমিত করে। অতএব সাবজেক্টিভিটিকে একটা ফ্যাক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং নৃবিদ্যা এই এই ফ্যাক্টের বিজ্ঞান হিসেবে নির্মিত হবে। কান্টের হাত ধরে সাবজেক্টিভিটি যে একটা সূত্র হয়ে ওঠে সেটা এই ক্ষেত্রে আকরগত অর্থে কিছুই বদলায়না। বিচারিক চৈতন্য(Critical consciousness) এমন এক চৈতন্য যা সত্তাকে বস্তুর স্বরূপে (thing in itself) অবনমিত করার মাধ্যমে The self of knowledge-কে প্রতিফলিত করে।


কান্ট কার্যতই বিষয় ও (চিন্তার) কর্তার সংশ্লেষণিক অভিন্নতায় নিজেকে নিয়ে যায়। কিন্তু বিষয়, কর্তার সাপেক্ষেই নিছক বিষয়। খোদ এই অভিন্নতা কল্পনারই সিন্থেসিস। এটা সত্তার মধ্যে স্থাপিত না। কান্ট মনস্তাত্ত্বিক ও অভিজ্ঞতার’ উর্ধ্বে গেলেও নৃবিদ্যার আঙ্গিনায়ই থাকেন। যতক্ষণ পর্যন্ত নিরূপণ (determination) কেবল ব্যক্তিক, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা নৃবিদ্যাকে ছেড়ে যাইনি। এটাকে ছেড়ে যাওয়ার কি কোন দরকার আছে? যদি দরকার থাকে সেটা কিভাবে সম্ভব? এই দুইটা জিজ্ঞাসা আসলে একই জিজ্ঞাসা। এটাকে ছেড়ে যাওয়ার পথই [হচ্ছে] এটাকে ছেড়ে যাওয়ার জরুরত। কান্ট সত্যিই দেখতে পেয়েছিলেন যে চিন্তা নিজেকে পূর্বানুমান হিসেবেই স্থাপিত করে। এটা নিজেকে স্থাপিত করে এই জন্য যে এটা নিজে নিজে চিন্তা করে এবং নিজে নিজেকেই প্রতিফলিত করে। এটা নিজেকে পূর্বানুমান হিসেবে উপস্থিত করে, কারণ বিষয় বস্তুর সমগ্রতা এটাকে তা হিসেবে অনুমান করে যা জ্ঞানকে সম্ভব করে তোলে। এইভাবে কান্টে, চিন্তা ও বস্তু অভিন্ন। কিন্তু চিন্তার সাথে যেটা অভিন্ন হিসেবে হাজির হয় সেটা একটা সাপেক্ষিক বস্তু। সত্তা হিসেবে বস্তুর স্বরূপ যেটা সেটা না। ফেনোমেনোলজিতে হেগেল স্থাপন(posit) এবং পূর্বানুমানের খাঁটি অভিন্নতার পর্যায়ে, অর্থাৎ পরমে, নিজেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এখানে আমাদের দেখানো হচ্ছে যে সত্তা ও প্রতিফলনের মধ্যে, বস্তুর স্বরূপ ও প্রতিভাত রূপের মধ্যে এবং সত্য ও নিশ্চয়তার মধ্যে যে সাধারণ পার্থক্য আছে তা একটা দ্বান্দ্বিকতার কংক্রিট ক্ষণগুলিতে গড়ে ওঠে। যেই দ্বান্দিকতার কাজই হচ্ছে এই ভিন্নতাকে মিলিয়ে দেয়া অথবা একে নিছক একটা দরকারি প্রতিভাস হিসেবে সংরক্ষণ করা।


এই অর্থে ফেনোমেনোলজি শুরু হয় মানষের প্রতিফলন (Human reflection) থেকে। এটা দেখানোর জন্য যে মানুষের প্রতিফলন এবং এর পরের যা কিছু ঘটে তা পরম জ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়, যেই জ্ঞানকে এরা পূর্বানুমান হিসেবে ধরে নেয়। এপ্পোলিৎ যেমনটা বলছেন, তর্কটা হচ্ছে নৃবিদ্যা কে ‘নামিয়ে নিয়ে আসা’ (reducing anthropology) ও একটা জ্ঞান যার উৎস ভীনদেশি(alien) তার হাইপোথিসিস খারিজ করাকে ঘিরে (পৃ ১৫৮)। যাইহোক, পরম জ্ঞান কেবল শেষেই অস্তিত্বশীল থাকেনা, শুরুতেও থাকে। এটা ইতোমধ্যেই সকল ক্ষণে ছিল। চৈতন্যের গড়ন অন্যভাবে বললে, ধারণার একটা ক্ষণ(moment)। সত্তা ও প্রতিফলনের মধ্যকার যে বাহ্যিক ভিন্নতা তাকে অন্য জায়গা থেকে বিবেচনা করলে সত্তার নিজেরই মধ্যকার ভিন্নতা হিসেবে বলা যায়। সত্তা যে কিনা ভিন্নতা ও মধ্যস্থতার সাথে অভিন্ন। যখন চৈতন্যের ভিন্নতা নিজের মধ্যেই ফিরে এসেছে, এই ক্ষণগুলি নিজেদেরকে সুনিশ্চিত ধারণা (concept) ও তাঁদের অর্গানিক স্ব-নির্মিত তৎপরতা হিসেবে হাজির করে (পৃ ৮৮)। কেউ কেউ বলবে নিজেকে ইশ্বরের জায়গায় বসানোতে এবং নিজের ওপরেই পরম জ্ঞান ন্যাস্ত করার মধ্যে এক ধরনের ‘অহমিকা’ আছে। যাইহোক তাকে বুঝতে হবে যে Datum(জার্মান শব্দ, আক্ষরিক অর্থ দিন বা তারিখ)-এর সাপেক্ষে সত্তা আসলে কি। এপ্পোলিৎ মনে করেন, সত্তা সারবস্তু নয়, বরং বোধ। জগৎ পর্যাপ্ত, এটা বলার মানে এই নয় যে জগৎ আমাদের জন্য পর্যাপ্ত। পর্যাপ্ত বলা মানে হচ্ছে এটা নিজ অবধি পর্যাপ্ত। এটা সত্তাকে প্রতিভাসের(appearance) উর্ধ্বে কোন সারবস্তু হিসেবে নির্দেশ করেনা। প্রথম জগতের বোধগম্য হিসেবে কোন দ্বিতীয় জগৎকে নির্দেশ করেনা। বরং এই জগতেরই বোধ হিসেবে বুঝায়। নিঃসন্দেহে প্লেটোতেই বোধ(sense) সারবস্তুকে প্রতিস্থাপিত করে। যখন তিনি দেখান দ্বিতীয় জগ নিজেই একটা ডায়ালেক্টিকের কর্তা যা(ডায়ালেক্টিক) এটাকে এই জগতের বোধে রূপান্তরিত করে। যাই হোক, এই প্রতিস্থাপনের জন্য প্রধানত কান্টই দায়ী। কারণ কান্টের ক্রিটিকে তুরীয় বা লোকোত্তর সম্ভাবনা জাগতিক সম্ভাবনাকে প্রতিস্থাপিত করে। সত্তার সম্ভাবনা প্রতিস্থাপিত করে সম্ভাবনার সত্তাকে। স্বীকৃতির সংশ্লেষনাত্মক অভেদ (synthetic identity) প্রতিস্থাপিত করে যৌক্তিক অভেদকে(logical identity)। সত্তার যৌক্তিকতা প্রতিস্থাপিত করে যৌক্তিক সত্তাকে। এক কথায় বললে বোধ সারবস্তুকে প্রতিস্থাপিত করে। এইভাবে, এপ্পোলিৎ মনে করেন, হেগেলের লজিকে মূল প্রস্তাবনা হচ্ছে যে কোন দ্বিতীয় জগ নেই। কারণ, এটা একই সাথে অধিবিদ্যাকে লজিকে এবং লজিককে বোধের লজিকে রূপান্তরিত করার হেতু। ‘বাইরে’ কিছু নেই মানে আসলে জগতের বাইরে কিছু নেই (কারণ সত্তা কেবলই বোধ)। ‘বাইরে’ কিছু নেই মানে জগতে চিন্তার ‘বাইরে’ কিছু নেই (কারণ সত্তা নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে চিন্তার মধ্যে)।


পরিশেষে, এটা বোঝায় যে, চিন্তার নিজের ভেতরেই ভাষার বাইরে কিছুই নেই। এপ্পোলিতের বই একটা পরম বয়ানের শর্তের ওপরে একটা আলোকপাত। ভাষাতীত ও কাব্যের ওপরে বইয়ের যে অধ্যায় আছে তা এই ক্ষেত্রে অতীব দরকারি। যে মানুষ বেহুদা আলাপে লিপ্ত হয় আর যে ভাষাতীতে বিশ্বাস করে তার মাঝে কোন ফারাক নেই। কারণ সত্তা একটা বোধ। সত্য জ্ঞান, পরম বা সত্তার বাইরের অন্য কিছু বিষয়ক জ্ঞান না। একটা নির্দিষ্ট উপায়ে, পরম জ্ঞান সর্বাধিক নিকটে, সবচাইতে সরল। এটা সেখানে বা সত্তার বাইরের অন্য কিছু বিষয়ক জ্ঞান না। একটা নির্দিষ্ট উপায়ে, পরম জ্ঞান সর্বাধিক নিকটে, সবচাইতে সরল। এটা সেখানে আছে। পর্দার পেছনে দেখার কিছু নেই (পৃ ৬০)। অথবা এপ্পোলিৎ যেমনটা বলছেন, গোপন ব্যাপারটা হচ্ছে আসলে কোন গোপন ব্যাপার নেই (পৃ ৯০)। এইখানে আমরা দেখতে পাই যে ঝামেলাটা হচ্ছে, এমন একটা ঝামেলা যার ওপরে এপ্পোলিৎ জবরদস্তি করে গুরুত্বারোপ করছে। অন্টোলজি যদি সারবস্তুর না হয়ে বোধের অন্টোলজি হয়, যদি কোন দ্বিতীয় জগৎ না থাকে, তবে পরম জ্ঞান, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে পৃথক হয় কিভাবে? আমরা যে সরল নৃবিদ্যাকে সমালোচনা করেছিলাম আমরা কি তাতেই ফেরত যাই না? পরম জ্ঞানকে সকল অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ধারণ করতে হবে। সে এর বাইরে আর কিছুই ধারণ করতে পারবেনা যেহেতু এর বাইরে আসলে ধারণ করার মত আর কিছুই নাই। অথচ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সাথে এর যে র‍্যাডিকাল ফারাক একই সাথে তাও ধারণ করতে হবে। এপ্পোলিৎ যেটা বলছেন তা হলঃ প্রাতিভাসিকতা সত্ত্বেও, সারবস্তুবাদ (essentialism) আমাদেরকে অভিজ্ঞতাবাদের হাত থেকে রক্ষা করেনি। এটাকে কিভাবে মাড়িয়ে যাওয়া যায় তাও বাতলে দেয়নি। অভিজ্ঞতাবাদ বা শুদ্ধ বিচারে প্রতিফলন যতখানি বাহ্যিক, সারবস্তুর দৃষ্টিতে তা কোন অংশে কম নয়। অভিজ্ঞতাবাদ নিরূপণ বা মীমাংসাকে বিশুদ্ধ অর্থে ব্যক্তিক হিসেবে স্থাপন করেছে। যত দূর এই সীমানার চৌহদ্দি বিস্তৃত, নিজেদের মধ্যকার মীমাংসাগুলিকে ও পরমের নিরূপণকে বিরোধিতা করার মাধ্যমে, সারবস্তুবাদ ততদূর'ই যায় । অপরের অবস্থান নিজের থেকে আলাদা না। উল্টোদিকে, বোধের অন্টোলজি হচ্ছে সেই সম্পূর্ণ চিন্তা যে নিজেকে নিজের মীমাংসার মধ্যে জানতে পারে। এই মীমাংসাগুলি হচ্ছে রুপের নানা ক্ষণ। অভিজ্ঞতায় ও পরমে এটা একই সত্তা এবং একই চিন্তা। কিন্তু সত্তার ও চিন্তার অভিজ্ঞতালব্ধ ভিন্নতা যে ভিন্নতা সত্তার সাথে অভিন্ন তার রাস্তা তৈরী করে দিয়েছে । (but the external, empirical difference of thought and being has given way to the difference identical with Being, to the difference internal to the Being which thinks itself.)


যার ফলে, পরম জ্ঞান আসলে অভিজ্ঞতালব্ধজ্ঞান থেকে নিজেকে আলাদা করে। কিন্তু এটা নিজেকে পৃথক করে কেবলমাত্র অভিন্ন সারবস্তুর জ্ঞানকে নেতি করার মাধ্যমে। অভিজ্ঞতায় যেরকম করে আছে, লজিকে ফেনোমেনোলজির ডায়ালেক্টিকের মত এরকম একের দ্বারা অপরকে লাভ করার চেষ্টা আর থাকেনা। উল্টোদিকে, আমি যা বলি তার বোধ জানান দেয়ার মাধ্যমেই কেবললমাত্র আমার বয়ান লজিকাল বা যথার্থভাবে দার্শনিক বয়ান হতে পারে। এবং যখন এই উপায়ে সত্তা নিজেই নিজেই বলে। দর্শনের এই রকম সুনির্দিষ্ট ধরণ অর্থাৎ এই বয়ান শুধু চক্রাকারই হতে পারে। এইক্ষেত্রে দর্শনে শুরুর সমস্যা নিয়ে এপ্পোলিৎ যে দৃষ্টিপাত করছেন তার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। এটা শুধু লজিকাল সমস্যাই না, এটা শিখন পদ্ধতি সংক্রান্ত সমস্যাও বটে (তৃতীয় ভাগের তৃতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।


এপ্পোলিৎ এইভাবে নিজেকে হেগেলের সকলপ্রকার নৃবৈজ্ঞানিক ও মানবতাবাদী ব্যাখ্যার মোকাবিলায় নিজেকে দাঁড় করান। পরম জ্ঞান কোন মানবীয় প্রতিফলন নয় বরং মানবে পরমের প্রতিফলন। পরম কোন দ্বিতীয় জগত নয়। এবং অথচ দর্শন যেমন করে নৃবিদ্যা থেকে আলাদা হয় তেমনি ভাবে পরম জ্ঞান, অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞান থেকে আলাদা হয়। লজিক ও ফেনোমেনোলজির মধ্যে এপ্পোলি যে রেখা টানছেন তা যদি নিরূপণমূলক হয়, সেক্ষেত্রে ইতিহাসের দর্শনে ও লজিকের মধ্যকার সম্পর্ক কি আরো দ্ব্যর্থবোধক হয়না? এপ্পোলি বলছে যে বোধ হিসেবে পরম হচ্ছে হয়ে উঠা বা হওয়া (becoming)। নিঃসন্দেহে এই হয়ে ওঠা কোনভাবেই ঐতিহাসিক হয়ে ওঠা নয়। কিন্তু লজিকের হয়ে ওঠার সাথে ইতিহাসের সম্পর্কটা কি? একটা ফ্যাক্টের সরল ধর্ম বাদে বাকি সবকিছুই এখানে ঐতিহাসিক হিসেবে চিহ্নিত হবে। অন্টোলজি আর অভিজ্ঞতালব্ধ মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক নিখুঁতভাবে নির্ধারিত আছে। কিন্তু অন্টোলজি আর ঐতিহাসিক মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক এভাবে নির্ধারিত নেই। কিন্তু এপ্পোলি সসীমতাকে পরমে পুনঃউপস্থাপিত করে তবে আমরা কি আবারো নতুন আদলে নৃবিদ্যায় ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়িনা? এপ্পোলিতে উপসংহার উন্মুক্তই থাকে। এটা একধরনের অন্টোলজি'র রাস্তা তৈয়ার করে। কিন্তু আমরা ইঙ্গিত করতে চাইবো যে এই ঝামেলার উৎস সম্ভবত লজিকেই ছিল। এপ্পোলিতের সাথে হেটে আমরা এটা আন্দাজ করি যে দর্শন (যদি তার কোন অর্থ থাকে) কেবল অন্টোলজি'ই হতে পারে। বোধের একটা অন্টোলজি। পরমে ও অভিজ্ঞতায় একই সত্তা আর একই চিন্তা থাকে। কিন্তু সত্তার সাথে ভিন্নতা অভেদ হিসেবে স্থাপিত হওয়ার মাধ্যমে চিন্তা ও সত্তার মাঝের ফারাক পরমে মিলে যায়। যেই ভিন্নতা নিজেই চিন্তা করে ও মানুষের ভেতরে নিজেকে প্রতিফলিত করে। সত্তা ও ভিন্নতার মাঝে এই চরম অভেদ'ই হচ্ছে বোধ। এপ্পোলিৎ যখন নিজেকে পুরোদস্তুর হেগেলীয় হিসেবে হাজির করেন তাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। সত্তা

ততদূর পর্যন্তই ভিন্নতার সাথে অভিন্ন হতে পারে যতদূর ভিন্নতা পরমের দিকে এগোয়। অর্থাৎ বৈপরীত্য পর্যন্ত। যে সত্তা নিজের বিরোধিতা করে সে-ই কল্পিত (speculative) ভিন্নতা। সত্তা যা না তার থেকে নিজে আলাদা হওয়ার মধ্য দিয়ে এ এর সত্তাকে খুঁজে পায় ভিন্নতার মধ্যে। আর এই কারণে এটি নিজে নিজের বিরোধিতা করে। যেহেতু অপর তার অপর সেহেতু এটা নিজেকে প্রতিফলিত করে কেবলমাত্র অপরের মাঝে নিজেকে প্রতিফলিত করার মাধ্যমে। লজিক, সত্তা, সারবস্তু ও ধারণার(concept) তিনটি ক্ষণকে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে এই বিষয়টাই এপ্পোলিৎ দাঁড় করান। বিরোধিতা পর্যায়ে না যাওয়ার জন্য হেগেল প্লেটো ও লাইবনিজকে ভর্তসনা করবেন। শুধু সহজ বিকল্পেই রয়ে যায় প্লেটো। লাইবনিজ থেকে যায় বিশুদ্ধ ভিন্নতায়। এটা অন্তত ধরে নেয়া যায় যে ফেনোমেনোলজির ক্ষণ আর লজিকের ক্ষণ একই অর্থে ভিন্ন ক্ষণ না। দুই ধরনের আত্ম-বিরোধীতা আছে, ফেনোমেনোলজিকাল বিরোধীতা আর লজিকাল বিরোধীতা।


এপ্পোলিতের বইয়ের বিশেষত্ব আমাদের এটা ভাবিয়ে তুলতে পারেঃ আমরা কি ভিন্নতা(difference)র এমন এক অন্টোলজি নির্মাণ করতে পারিনা যা বিরোধীতায়(contradiction) পর্যবসিত হবেনা? কারণ বিরোধীতাতো ভিন্নতার থেকে কমই হবে, বেশি নয়। বিরোধীতা নিজেই ভিন্নতার ফেনোমেনাল আর নৃবৈজ্ঞানিক দিক নয় কি? এপ্পোলিৎ বলছেন যে বিশুদ্ধ ভিন্নতার অন্টোলজি আমাদেরকে বিশুদ্ধভাবেই-বাহ্যিক ও আকারগত (formal) প্রতিফলনে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এবং দিনশেষে চূড়ান্ত বিশ্লেষণ সারবস্তুর অন্টলজি'ই হয়ে উঠবে। সে যাই হোক, এই একই প্রশ্ন ভিন্নভাবেও করা যায়ঃ সত্তা নিজেকে প্রকাশিত করে আর সত্তা নিজেকে বিরোধীতা করে এই বলা কি একই? এটা যদি সত্য হয় যে এপ্পোলিতের বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ যদি সত্তায় একটা বিরোধীতার তত্ত্ব নির্মাণ করে যেখানে বিরোধীতা নিজেই ভিন্নতার চরম, তবে প্রথম ভাগে (Theory of language) ও বই জুড়ে যে ইশারা পাওয়া যায় তাতে এপ্পোলিৎ কি অভিব্যক্তির একটা তত্ত্ব নির্মাণ করেন না, যেখানে ভিন্নতা নিজে নিজেই অভিব্যক্ত? এবং বিরোধীতা নিছক ফেনোমেনাল দিক?

______________


হদিস- SUNY প্রেস থেকে প্রকাশিত জঁ এপ্পোলিতের Logic and existence বইয়ের সংযুক্তি আকারে প্রকাশিত দেল্যুজের রিভিয়্যু।

প্রথম প্রকাশঃ ২০শে অক্টোবর, ২০১৯

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২০শে অক্টোবর, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/343529450085232/