অভিধানে ডিসপোসিটিফ/ডিসপোসিটর-এর তিন রকম মানে পাওয়া যায়। একটা হল আইনি বিচারব্যবস্থা বোঝাতে, আরেকটা অর্থ হল মেশিন এবং তার বর্ধিত যন্ত্রাংশের কার্যক্রম বোঝাতে। আর বাকিটা হল, সামরিক পরিকল্পনা বোঝাতে।
এরপরে আগামবেন গ্রীক Oikonomia [গ্রীক: οἰκονομία (ঐকোনমিয়া), economy যেখান থেকে এসেছে] শব্দের আলাপ টানেন। শব্দটা মূলত গৃহস্থালি কাজকর্মের ক্ষেত্রে ব্যবহার হত। এরিস্টটল বলেন, এসব কাজের সঠিক কোন রূপরেখা নেই, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়াই হচ্ছে ঐকোনমিয়া। আগামবেন আরও বলেন, পরবর্তীতে গীর্জার যাজকেরা ট্রিনিটি বা ত্রিত্বের ধারণা ব্যাখ্যা করার জন্যে এই শব্দটা টেনে আনেন। গির্জার যাজকেরা যখন ঈশ্বরের তিন রূপ—পিতা, পুত্র ও পরমাত্মা—ব্যাখ্যা হাজির করলো, তখন অনেকেই ব্যাপারটা মানতে চাইলো না। বিরোধী পক্ষের মতে, ঈশ্বরের নানারূপ তত্ত্ব মানে প্রকারান্তে পৌত্তলিক ধর্মের দিকে ফিরে যাওয়া। তখন যাজকদের পাল্টা যুক্তি ছিল, খোদা এক ঠিক আছে কিন্তু উনার মহান ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্যে দরকার ঐকোনমিয়া (Oikonomia)। গৃহকর্তা যেমন অবস্থা বুঝে মুশকিল আসানের ব্যবস্থা নেয়, খোদাও তেমনি। ভক্তকূলের ভক্তিরস যোগান দেয়ার জন্যে ঈশ্বর, মরিয়ম এবং যীশুর রূপ হাজির করেছেন। আগামবেন বলছেন, এই ব্যবস্থাপনার অংশই হল ডিসপোসিটিফ/ডিসপোসিটর।
এই ফারাকের কারণেই প্রতিচ্যে, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতে নৈতিকতার আলাপ বেশি জমে না, কেননা এই ব্যবস্থাপনা বা ঐকোনমিয়া বা বাইরের কাঠামোর ঘেরাটোপেই ভক্ত ঘুরে ঘুরে হয়রান। মূল খোদার আরশের দেখা আর হয়না। ধর্মীয় আলাপ এখানে মূখ্য নয়। মূখ্য হচ্ছে ঐকোনমিয়া বা ব্যবস্থাপনা কি এটা বুঝে নেয়া। এই ঐকোনমিয়া বা বাহ্যিক তরিকার ল্যাটিন নামই হল disopositif, dispositive, disposition, dispositor ইত্যাদি।
তাহলে বোঝা যায়, আমাদের একদিকে আছে সারবস্তু, আরেকদিকে ডিসপোসিটর। একদিকে আছে রক্ত মাংসের মানুষ, আরেকদিকে রয়েছে এই ডিসপোসিটর। এই ডিসপোসিটর মানুষকে সারাক্ষণ জড়িয়ে রাখে যাতে নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধে হয়।
সম্ভবত মানুষের জীবনে প্রথম ডিসপোসিটর হল ভাষা, যা থেকে সে কখনো মুক্তি পায় না। পেন্সিল, কলম, কম্পিউটার, মোবাইল এসবও ডিসপোসিটর। মোবাইল ফোন হচ্ছে এদের মধ্যে জঘন্যতম। একদিকে নানা জিনিসপত্র, আরেকদিকে ডিসপোসিটর’স (dispositors)—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে ব্যক্তি হয়ে পড়ে ক্রীড়নক। ব্যক্তির কর্তাসত্তা হয়ে উঠার ব্যাপারটা বহুর উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। পুঁজিবাদ কিন্তু এই তাবৎ ডিসপোসিটর হজম করে নিয়ে ব্যক্তিকে বহুধা বিভক্ত করে দিয়েছে, যদিও ব্যক্তি মনে করে সকল বিভক্তি পেড়িয়ে সে সম্মিলিত অবস্থানেই আছে।
এই সময়, এই সর্বগ্রাসী ক্ষমতা বলয় বা ডিসপোসিটর (dispositor) থেকে বাঁচার উপায় কি? আগামবেন প্রস্তাব করছেন প্রফেনেশন (profanation, অপবিত্রকরণ)-এর ধারণা। রোমে যা কিছু ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় ঐসব ব্যক্তি-স্থান বা মানুষকে প্রফেনেশন-এর আওতাভুক্ত মনে করা হত। মন্দির, পুরোহিত ইত্যাদি দেবদেবীর সাথে সম্পর্কিত তাই এদের ধর্মীয় গণ্য করা হত। কোন কিছু ধর্মীয় গণ্ডি থেকে সাধারণ গণ্ডিতে আনতে চাইলে কুরবানি বা বলিদান মারফৎ তা সম্ভব ছিল। তাই পশু বলির পর তার ভেতরের কিছু অংশ দেবতার ভোগে যেত (যা ধর্মীয়), আর বাকিটুকু প্রফেনেটেড (profanated, অপবিত্র-কৃত) বা সাধারণের অংশ হিসেবে গণ্য হত।
আগামবেন বলছেন, আমাদের কাজ হচ্ছে এই ডিসপোসিটর বা বিশেষ ক্ষমতাবলয় হতে প্রফেনেশন-এ চলে আসা। আর এই আসার উপায় হল “তামাশা করা”। আপনারা জানেন বাচ্চারা ইদানীং যে খেলাগুলো খেলে, যেমনঃ রিং-অ্যারাউন্ড-দ্যা-রোজি (ring-around-the-rosey), রাউন্ড-নাচ এগুলো ছিল বিয়ের অনুষ্ঠানের কার্যকলাপ; বল, চাকতি গোলক সংক্রান্ত খেলাগুলো দেবদেবীর সূর্য-দখল-সংক্রান্ত কার্যকলাপ; অনুমান সংক্রান্ত খেলা দেবদেবীর ঐশী বাণীর অনুকরণ। বাচ্চাদের খেলাধুলাই বলে দেয় প্রফেনেশন (অপবিত্রকরণ) কি চিজ। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যমূলক কাজ কিভাবে ধুলায় লুটাতে হয় শিশুরা তা ভালোই বোঝে।
স্মরণ করা যেতে পারে কাফকা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের বলা একটা কথাঃ যে আইন প্রয়োগ না করে শুধু অধ্যয়নের জন্যে তুলে রাখা হয় তা দিয়ে বিচারের দরজায় পৌঁছানো যাবে, বিচার পাওয়া যাবে না।
ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেছেন, পুঁজিবাদ এখন এমন এক শক্তি, ধর্ম আগে যা দিয়ে বিভেদ রেখা টানত তাও সে মুছে দিয়েছে। তেমনি একসময় কিছু বলিদান বা উৎসর্গ করেই স্যাক্রেড (পবিত্র) হতে প্রফেন (অপবিত্র) করা যেত, এখন আর ঐ অবস্থা নাই। প্রতিটা জিনিস, মানুষের শরীর থেকে শুরু করে যৌনতা, ভাষা সব শতধা বিভক্ত এবং স্থানচ্যুত। পুঁজিবাদের এই চরম রূপে, ভোগের দুনিয়ায় প্রফেনেশন বা অপবিত্রকরণের পথ কই? এই অপবিত্রকরণ-অযোগ্য (improfanable)’কে অপবিত্রকরণ-যোগ্য (profanable) করাই হবে অনাগত প্রজন্মের রাজনৈতিক কাজ।
____________
পুনশ্চঃ এই বক্তৃতাটির পরিমার্জিত রূপটি পাওয়া যাবে আগামবেনের The Apparatus: And Other Essays (২০০৯) গ্রন্থে। পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও উদ্ধৃতি-যুক্ত প্রবন্ধটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ফুকো ব্যবহৃত এ প্রত্যয়টির লিনিয়েজ নিয়ে আগামবেনের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন ইতালীয় স্কলার মাতোও পাসকোলোনি (Matteo Pasquinelli)। পাসকোলোনির মতে, ফুকো এই প্রত্যয়টি পেয়েছেন যুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক জর্জ কাঙ্গিলেমের সূত্রে। ফুকোর পিএইচডি কাজকে সম্পূর্নরূপে বুঝতে অক্ষমতার কথা জানিয়ে ইপ্পোলিৎ তাঁকে এই জর্জ কাঙ্গিলেম (Georges Canguilhem)-এর কাছেই পাঠিয়েছিলেন। কাঙ্গিলেম একইসাথে দর্শন ও মেডিসিনে প্রশিক্ষিত ছিলেন। ১৯৫২ সনে প্রকাশিত কাঙ্গিলেমের Machine and Organism প্রবন্ধ ও ১৯৬৬-তে প্রকাশিত The Normal and the Pathological গ্রন্থকে পাসকোলোনি এই ধারণার উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন।