আমরা জানি যে, ১৪৯২ সাল এক সারি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। যেমন, আইবেরিয় উপত্যকা থেকে মুর ও ইহুদিদের বিতাড়ন। মুর’রা দক্ষিণের দিকে চলে যায়, ইহুদিরা উত্তরের দিকে। কলম্বাস পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করে ইউরোপীয়দের কাছে অপরিচিত এক অঞ্চলে পদার্পণ করেন, এবং সেটাকে ‘ইন্ডিয়া’স (Indias)’ নামকরণ করেন। পরবর্তীতে আমেরিগো ভেস্পুচ্চি’র সম্মানার্থে এক ইউরোপীয় মানচিত্রবিদ এ অঞ্চলের নাম দেন ‘আমেরিকা’। কিছুদিন পর, বন্দি আফ্রিকানদের জোরপূর্বক অভিবাসন নয়া দুনিয়া/আমেরিকার ডেমোগ্রাফির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং আধুনিক/উপনিবেশিক জাতিগত (racial) বিন্যাসের পূর্বশর্ত তৈরি করে। ইহুদিরা একটি বৃহৎ ছবির অংশ হয়ে উঠে। খ্রিষ্টানরা এমন এক অবস্থানে ছিল যেখান থেকে তারা পরবর্তী কয়েক শতকের জন্য শ্রেণিবিন্যাস এবং সেই শ্রেণিবিন্যাসকে বৈধ করতে পারত : ইহুদি, মুসলমান, ‘ইন্ডিয়ান’, এবং ‘কালো’রা মিলে তৈরি করেছিল প্রাথমিক জাতিগত চতুর্ভুজ, যা সংযোজন-অভিযোজনের মাধ্যমে আজতক টিকে আছে।১৯
পশ্চিমা খ্রিষ্টানরাজ্য (Western Christendom) থেকে মুসলমানদেরও বিতাড়িত করা হয়েছিল, কিন্তু সে সময়ে মুসলমানদের পিছনে ছিল ইসলামি খেলাফত থেকে শুরু করে শক্তিমান অটোমান সালতানাত পর্যন্ত আটশো বছরের ইতিহাস। অ্যাজটেক, মায়া ও ইনকা সভ্যতাগুলোকে ধ্বংস করে তাদের জনগণকে ‘ইন্ডিয়ান্স’-এ পর্যবসিত করা হয়েছিল। দাস বানানো আফ্রিকানদেরকে আফ্রিকা-রাজ্য থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছিল এবং ‘কালো’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। একদিকে মুসলমানরা হয়ে উঠে বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী শত্রু (যেমন, আফ্রিকার উত্তরে ও ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বে অটোমানদের উপস্থিতি), অন্যদিকে ‘ইন্ডিয়ান্স’ ও ‘কালো’রা হয়ে যায় বহিরাগত উপনিবেশিক প্রজা। এবং পশ্চিমা খ্রিষ্টান অঞ্চলে (শীঘ্রই সেটা ইউরোপ হয়ে উঠবে) যে ইহুদিরা রয়ে গিয়েছিলেন তারা হয়ে উঠেন অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক প্রজা। উনিশ শতকের ইউরোপে জায়নের পুনরুত্থান আসলে ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের ভাঙ্গন, গির্জার প্রান্তিকীকরণ ও ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রহীন জনগণ ও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক প্রজা হিসাবে ইহুদি জীবনের একটি পরিণতি।
সাম্রাজ্যবাদী আধুনিকতার উপনিবেশিক দিগন্তে ইসরায়েল রাষ্ট্র
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বৈশ্বিক ব্যবস্থার রূপান্তরে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রকৃতি সম্পর্কে ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং তাতে পশ্চিমা ইউরোপীয়দের সমর্থন কিছু প্রশ্ন হাজির করে। আমার যুক্তিতর্কের জন্য দুটো বিষয় প্রাসঙ্গিক : ১) যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে জাতি-রাষ্ট্রের গড়ন (form)-এর হেজেমনির অধীনে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বৃহৎ পটভূমি; ২) ‘জাতি (Nation)’-এর ধারণা যার ওপর আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রীয় হাতিয়ারগুলো প্রতিষ্ঠিত।
এই বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদেরকে ষোড়শ ও উনিশ শতকের ঘটনাগুলোর দিকে পুনরায় ফিরে তাকানো দরকার। আমি ইতোমধ্যে আইবেরিয় উপত্যকা থেকে খ্রিস্টান কর্তৃক ইহুদি ও মুসলমানদের বিতাড়ন সম্পর্কে উল্লেখ করেছি। আমরা সবাই জানি, ষোড়শ শতকে মুসলমানরা কেবল স্পেন ও উত্তর আফ্রিকাতেই ছিল না। ইসলামি খেলাফত (অর্থাৎ, একজন একক খলীফার অধীনে উম্মাহ বা বিশ্বাসী সম্প্রদায়দের নিয়ে যে রাষ্ট্র) অধিকৃত অঞ্চলেও তারা বসবাস করতেন। সে খেলাফত বিস্তৃত ছিল স্পেন থেকে শুরু করে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল হয়ে একেবারে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত, পুরো পারস্য শাহানাত২০ জুড়ে; একেবারে আজ যাকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বলি পুরোটা জুড়েই ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়া। দিল্লী ভিত্তিক মুঘল সালতানাতকে ভেঙ্গে ব্রিটিশদের আগ্রাসন শুরু হয়েছিল; সেটা একেবারে কাবুল থেকে মাদ্রাজ হয়ে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; অর্থাৎ প্রায় পুরো ভারত এবং আজকের আফগানিস্তান জুড়ে। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম বৃহৎ উপনিবেশ ছিল একটি সালতানাত।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মারফতে প্রথম আগ্রাসন বাণিজ্যিক হলেও, সালতানাতকে উচ্ছেদ করে এবং আধুনিক/উপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থাপন করে “ভারতে”র ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও (১৮৫৮) হাসিল করা হয়। দ্বিতীয় ধাক্কা ছিল, পারস্য অঞ্চলে তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর পারস্য/ইরানি সালতানাতে ব্রিটিশদের আগ্রাসন। ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরান আক্রমণ করে। রেজা শাহ্কে জোর করে সিংহাসন থেকে নামানো হয়, এবং সেখানে তাঁর ছেলে রেজা শাহ্ পাহলভিকে বসানো হয়। শাহ্ পাহলভি ছিলেন ব্রিটিশ-অনুরক্ত। তিনি ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তৃতীয়ত, অটোমান সালতানাত ১৯২২ সালে ব্রিটিশদের হাতে পতন হয়। অটোমান সুলতানাতের ধ্বংসাবশেষ থেকে মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে একটি রিপাবলিকের (জাতি-রাষ্ট্র) জন্ম হয়। এবং অটোমান অধিকৃত অঞ্চলে আরেকটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় : ইরাক। বিশ শতকের গোড়াতেই সে অঞ্চলে তেল পাওয়া যায়।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা জেরুজালেমে প্রবেশ এবং দখলে নেয়ার আগ পর্যন্ত এটি অটোমান শাসনাধীন ছিল। মুসলিম, ইহুদি এবং ব্রিটিশদের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষের কারণে এই শহর টালমাটাল ও বিক্ষুদ্ধ অবস্থায় ছিল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুই অঞ্চলে ভাগ করার অনুমোদন দেয়। একটা আরব, আরেকটা ইহুদি: ইসরায়েল এবং জর্ডান। লম্বা ইতিহাসকে সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়, অটোমান সালতানাতের পতন ও ১৯৪১ সালে রেজা শাহে্র অপসারণের মাধ্যমে ব্রিটেন একেবারে মুঘল সালতানাত থেকে শুরু করে পারস্য হয়ে অটোমান পর্যন্ত এক বিশাল অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কেবল ইহুদিদের প্রতিশ্রুত ভুমিতে ফিরে আসাই নয়, বরঞ্চ একটি মূখ্য অঞ্চল সুরক্ষা করা— অর্থাৎ ইউরোপের পূবের বাফার জোন নিশ্চিত করা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাম্প্রতিক ‘ইসরায়েলের সাথে অলঙ্ঘনীয় জোট’ সংক্রান্ত ঘোষণা ইহুদি অধ্যুষিত দেশের মধ্যকার সম্পর্ক এবং ইহুদি-খ্রিষ্টান ঐতিহ্যের একতার চাইতেও অধিক ছিল। এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক জোটকেও ইঙ্গিত করে যার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিণাম রয়েছে : সীমানার একদিকে ইরান ও সিরিয়া; পূর্বে রাশিয়া ও চীন।
জাতি-রাষ্ট্রের গড়নের বিস্তারের মধ্যে “এক রাষ্ট্র, এক জাতি”র ধারণা নিহিত রয়েছে। অটোমান সালতানাতের পতন আতাতুর্কের নেতৃত্বে আধুনিক তুরষ্ক রিপাবলিকের জন্ম দিয়েছিল। এই রূপান্তরের একটি লজ্জাজনক অধ্যায় হচ্ছে জাতীয় প্রতিরক্ষা ও একতা’র নামে আর্মেনিয়দের বিরুদ্ধে জেনোসাইড বা গণহত্যা চালানো। “এক রাষ্ট্র, এক জাতি”র মধ্যে ‘অ-জাতীয়’দের কোন স্থান নেই। এক জাতির সাথে এক রাষ্ট্র— এই পূর্বানুমান পরোক্ষভাবে ভারত/পাকিস্তানের ভাগের মধ্যেও ছিল। এই একই অন্তর্নিহিত অনুমান অটোমান সুলতানের ধ্বংসাবশেষ থেকে ইরাক সৃষ্টিকারী ম্যান্ডেটকেও প্ররোচিত করেছিল, যদিওবা স্থানীয় ইতিহাসগুলো ছিল আলাদা। মুঘল সালতানাতের ওপর ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ আফিম উৎপাদনের শর্তগুলো তৈরি করেছিল এবং একই সময় চীনের সাথে আফিম যুদ্ধের শর্ত তৈরি করেছিল। সাফাভি ও অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়াতে তেল আবিষ্কৃত হয়েছিল। ইরাক জাতি-রাষ্ট্র হওয়ার পর তারা কুর্দিদের বিরুদ্ধে একই কাজ করেছিল এবং ইরাকের নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের সম্ভাব্য বিক্ষোভকে দমন করার জন্য ১৯৮০ সালে ইরানে আক্রমণ করে। সবকিছু করা হয়েছিল জাতীয় ঐক্যের নামে: এক জাতি, এক রাষ্ট্র। জাতীয় ঐক্যের নামে একের পর এক গণহত্যা ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আধুনিক/উপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থার জাতি-রাষ্ট্রের এই নিয়মের বাইরে ইসরায়েল রাষ্ট্রও যেতে পারেনি।
সেক্যুলার-ধর্মীয় ইসরায়েল রাষ্ট্র
উনিশ শতকে ইউরোপে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক জায়নবাদ বৈশ্বিক ইতিহাসের কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি হচ্ছে আধুনিক/উপনিবেশিক দুনিয়ার এক যৌক্তিক পরিণতি। এটি ছিল ইউরোপীয় ইতিহাসের উন্মোচন, যা ‘আধুনিকতা’ হিসাবে স্ব-রচিত; যা প্রয়োজন মোতাবেক জাতি-রাষ্ট্রের গড়ন উদ্ভাবন করেছিল। সেই সন্ধিক্ষণে ইহুদিরা ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে বিবেচিত না হয়ে, বরঞ্চ জাতিগত বা এথনিক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল।
হিসাবমতে, বর্তমান দুনিয়ার ইহুদি জনগণের সংখ্যা প্রায় ১.৪-১.৫ কোটি। এর মধ্যে ০.৫৭ কোটি ইসরায়েলে বসবাস করেন, ০.৫২ কোটি যুক্তরাষ্ট্রে। প্রায় দশ লক্ষের কাছাকাছি ইহুদি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন (ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, ব্রিটেন, জার্মানি ও হাঙ্গেরি), এবং দক্ষিণ আমেরিকাতে প্রায় তিন লক্ষ। আরো প্রায় পাঁচ লক্ষ ইহুদি বসবাস করেন দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউক্রেন ও রাশিয়াতে।
কিন্তু অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের একজন হাঙ্গেরীয় থিওডর হার্জল (১৮৬০-১৯০৪), তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবদ্দশাতেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের সন্ধানে জায়নবাদের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। হার্জল দ্বিগুণভাবে প্রান্তিক ছিলেন এবং তিনি সেটা অনুভবও করেছিলেন : তিনি ইহুদি ছিলেন এবং একটি প্রান্তিক ও ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যকে তখন পশ্চিমা ইউরোপীয় বাহিনী ও সাম্রাজ্যবাদী জাতি-রাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। তিনি প্রথম জায়নবাদের ধারণা নিয়ে আসেন নি, কিন্তু তিনিই ছিলেন এই প্রকল্পের মূল কারিগর। তিনি এমন এক সময়ে ইউরোপে বসবাস করছিলেন যখন পশ্চিমা ইউরোপের প্রধান দেশগুলোতে জাতি-রাষ্ট্র দৃঢ় হচ্ছিল। জাতি-রাষ্ট্র একটি সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান ছিল; এবং ফলে হার্জলের জায়নবাদও তাই।
মহিমান্বিত বিপ্লব (Glorious revolution) ও ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পাশাপাশি মহাদেশীয় ইউরোপের ফরাসি বিপ্লবের সাথে যুক্ত উদীয়মান এথনো-শ্রেণি, অর্থাৎ বুর্জোয়াদের জন্য জাতি-রাষ্ট্র ছিল আদর্শ প্রতিষ্ঠান। এটা ছিল আধুনিকতা ও প্রগতির নিশানা, শাসনব্যবস্থার ইউরোপীয় সেক্যুলার রূপ। এটা ওয়েস্টাফেলিয়া চুক্তির পরিণতিও ছিল, যে চুক্তি মরণঘাতী ত্রিশ বছরের যুদ্ধের (১৬৬০-১৭১৫) অবসান ঘটিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে বুর্জোয়ারা (এথনো-শ্রেণি, ethno-class) আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেনি, বরঞ্চ করেছিল সেটেলাররা, বসতিস্থাপনকারী উপনিবেশকরা। এবং সেটা খ্রিস্টানদের মধ্যকার ধর্মীয় বিবাদ মেটানোর জন্য নয়, বরঞ্চ ব্রিটিশদের শাসন অবসানের জন্য। ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা যেখানে রাজতন্ত্র ও গির্জাকে সরিয়ে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাগণ আদিবাসী আমেরিকানদের স্থানচ্যুত ও উচ্ছেদ করেছিলেন। নয়া দুনিয়ার স্পেনীয় উপনিবেশায়ন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়ার (Boer) ও ব্রিটিশ উপনিবেশায়নের ক্ষেত্রে ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি’ বা ‘অনিবার্য নিয়তি’ দাবি তুলে জমি দখল করা হয়েছিল; অর্থাৎ ঈশ্বরের নির্দেশে তার নির্বাচিত লোকেরা জমির দখল নিবেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপে যেখানে শ্রেণি বর্ণকে (রেস) সরিয়ে দিয়েছিল, সেখানে আমেরিকা শুরু থেকেই বর্ণগত (racial) শ্রেণিকরণ ও হায়ারার্কি বা ক্রমাধিকার দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল: আদিবাসী আমেরিকান (দক্ষিণের “Pueblos Originarios”, কানাডার ফার্স্ট নেশন) এবং দাস [বানানো হয়েছে যাদের সেইসব] আফ্রিকান। এটা ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর স্পেনে মুর এবং ইহুদিদের সমতুল্য ছিল (ইউরোপ তখনো পশ্চিমা খ্রিষ্টানরাজ্য নামে পরিচিত ছিল)। ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি (অনিবার্য নিয়তি)’ স্পষ্ট একটি বর্ণবাদী মতবাদ ছিল, যা আদিবাসী আমেরিকানদের জমি দখল করাকে জায়েজ করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী/উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত প্রথম জাতি-রাষ্ট্রগুলোর সাথে সাম্রাজ্যবাদী/উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের মিল লক্ষণীয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে হাওয়াই ও ফিলিপাইনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রগতি, আধুনিকতা, মুক্তি ও অনিবার্য নিয়তির ওপর জোর দিয়ে একধরনের বুলি আওড়ানো হয়েছিল।২১
ইউরোপের সেক্যুলারবাদ গির্জা থেকে রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিসমাপ্তি টেনে দিয়েছিল। তদুপরি, গির্জা বা রাজতন্ত্র কোনটাই উধাও হয়ে যায়নি। পর্দার পিছনে তারা তাদের প্রভাবের পরিসর ঠিকই বজায় রেখেছিল। ইউরোপের সকল তথা-কথিত উন্নত ও শিল্পায়িত দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা তাই দেখতে পাই। তবুও, জাতি-রাষ্ট্রকে, যেমনটা এই যৌগিক নাম ইঙ্গিত করছে, জন্মগত সম্প্রদায়ের (নেশন, nation) উপর ভিত্তি করে আইনগত, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক সংগঠন হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, কোন বংশগত পারিবারিক উত্তরাধিকার বা রোমান পোপের শাসনাধীন অগণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভিত্তিতে নয়। জাতীয় ভাষা, জাতীয় সাহিত্য ও জাতীয় সংস্কৃতি (মধ্যযুগে লাতিন-উদ্ভূত ভাষাগুলোয় ‘সংস্কৃতি’ ধারণাটি যা ছিল এখন তার ভিন্নার্থ যোগ হয়েছে) দ্বারাও জাতীয় প্রজা একত্রিত হয়েছিল। জাতীয় প্রজারা তখন আধুনিক অর্থে ‘নাগরিক’ হয়ে উঠে, মানুষ ও নাগরিকের অধিকার সম্বলিত ঘোষণায় (Declaration of the Rights of Man and of Citizen) তা বর্ণিত হয়েছিল।
থিওডর হার্জলের রূপকল্পে ও কর্মে জায়নবাদ মূলত একটি সেক্যুলার প্রকল্পই ছিল। এর অর্থ হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের জায়নবাদী রূপকল্প অনুমান করে নিয়েছিল যে, ইহুদিরা ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, বরঞ্চ এথনিক সম্প্রদায়। এ কারণে সেক্যুলার জায়নবাদী প্রকল্পকে ইহুদি ধর্মীয় নেতাদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল, যারা এটার বিরোধীতা করেছিলেন। মিশেল ব্রেনার ২০০৩ সালে একে আপাতবিরোধী [বা প্যারাডক্সিক্যাল] আন্তর্জাতিকতাবাদী জাতীয়তাবাদ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।২২ এই যুক্তি অনুসারে আরেকটি প্যারাডক্স বা কূটাভাষ হচ্ছে যে, শুরুতে যে আন্দোলন ছিল সেক্যুলার এবং ফলে ধর্মীয় সিলসিলার চাইতে এথনো-ইহুদি জাতীয়তাকে গুরুত্ব দিয়েছে, সে আন্দোলন ধার্মিক ইহুদিদের সমালোচনার মুখে পড়েছিল, যারা জায়নবাদকে ইহুদি-ধর্মের জন্য অবমাননাকর হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। পশ্চিমা ইউরোপ ও আমেরিকা ব্যতীত, দুনিয়ার আর কোথাও রাষ্ট্র বিষয়ে এমন ধরনের সেক্যুলার-ধর্মের (secular-sacred) বিভাজন অর্জিত হয়নি।
জায়নবাদের ইতিহাস— একদম শুরু থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত এর গতিপথের বর্ণনা— ইহুদি ও অ-ইহুদিরা একইভাবে বলেছেন। আমি দুজন বিতর্কিত ধর্মতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা থেকে শুরু করবো, যাদের কথা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি: একজন ইহুদি, আরেকজন খ্রিস্টান। প্রথমজন মার্ক এলিস এবং দ্বিতীয়জন মিশেল প্রিয়োর। এলিস বহু কারণেই পরিচিত, এর মধ্য একটা হচ্ছে, যা আমি ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি— ইহুদি ধর্ম ও ইসরায়েল সমান নয়। প্রিয়োর পরিচিত উপনিবেশবাদের ইতিহাসের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রশ্নটিকে আকার দেয়ার জন্য। এই দুই ধর্মতাত্ত্বিকের যুক্তির সাথে সঙ্গতি রেখে আমার মতামত আধুনিক ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের উপনিবেশিকতার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়াবে, যেখান থেকে জায়নবাদের উদ্ভব হয়েছিল। অন্যভাবে বললে, জায়নবাদের উদ্ভব কেন ইউরোপের একটি ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যেই (অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়) হলো এবং কেন অন্যান্য ইহুদি-ডায়োস্পোরাতে হলো না তার যৌক্তিক-ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে, সেটা কেবল দৈবাৎ ঘটনা নয়।
বৈশ্বিক রৈখিক ভাবনা, উপনিবেশিকতা এবং অধিকারচ্যুতকরণ
আমি যে যুক্তি দেখাচ্ছি সেটা হচ্ছে, ফিলিস্তিন/ইসরায়েল প্রশ্ন কোন স্থানীয় ইস্যু বা সমস্যা নয়। এটা বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রোথিত। আমি যে বৈশ্বিক ব্যবস্থার কথা বলছি তাকে কার্ল স্মিট বর্ণনা করেছিলেন বৈশ্বিক রৈখিক ভাবনা (Global linear thinking) দ্বারা পরিচালিত ‘পৃথিবীর দ্বিতীয় বিধান’ হিসাবে। এটা ইউরোপীয় রূপকল্প এবং গল্পের অর্ধেক। বাকি অর্ধেক, অর্থাৎ বৈশ্বিক রৈখিক ভাবনার পরাজিত প্রান্তের রূপকল্প; এই অর্ধেক হচ্ছে ‘ক্ষমতার উপনিবেশিক বিন্যাসের’ প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত এবং পশ্চিমা সভ্যতার জন্ম।২৩ আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচলিত ‘দ্বিতীয় বিধান’ হচ্ছে উপনিবেশিক বিন্যাসের একটি দিক। দুই আখ্যানের (দ্বিতীয় বিধান ও ক্ষমতার উপনিবেশিক বিন্যাস) কেন্দ্রে রয়েছে অধিকারচ্যুতকরণ। বৈশ্বিক রৈখিক ভাবনা আন্তর্জাতিক আইনের সমতুল্য: গ্লোব বা গোলকের পুর্ননির্মাণ দ্বিতীয় বিধানকে বাস্তবায়ন করেছিল, এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বিতীয় বিধানের সূচনা থেকেই অধিকারচ্যুতকরণকে আইনি বৈধতা দিয়েছিল, অর্থাৎ ষোড়শ শতক থেকে শুরু করে ১৮৮৪ সালের বার্লিন চুক্তির পর আফ্রিকা ভাগের আগ পর্যন্ত। ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভিত্তি সাম্রাজ্য বিস্তারের অন্যতম কৌশল থেকে উপকৃত হয়েছিল। ‘ক্ষমতার উপনিবেশিক বিন্যাস’-এর শব্দভান্ডারে, আন্তর্জাতিক আইন কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনাকে বৈধতা দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইনের সাথে যুক্ত আইনত বৈধ অধিকারচ্যুতকরণ ছিল রাষ্ট্রের বিষয়, তা সে রাষ্ট্র রাজতান্ত্রিক বা সেক্যুলার যাই হোক না কেন। এই সমারোহের মধ্যেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল : প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে যাওয়া প্রগতি ও সভ্যতার নামে অধিকারচ্যুতকরণ বৈধ করার দীর্ঘমেয়াদী পথচলা দ্বারা সমর্থিত ছিল।২৪