গ্রাহাম হারমান ও অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজিঃ (উত্তর)আধুনিকতা থেকে প্রস্থান




[ বিভিন্ন পক্ষ ও অবস্থান থেকে আধুনিকতাকে চিহ্নায়ন ও পর্যালোচনা করার পাশাপাশি নানান কৌশলে এর থেকে অনেকেই বের হয়ে আসতে চেয়েছেন; উত্তর-আধুনিকদের মধ্যেও এই চেষ্টা লক্ষনীয়। পরবর্তীতে উত্তর-আধুনিক ভাবুকদের প্রত্যুত্তরকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসে অনেকটা আধুনিক বনাম উত্তর-আধুনিক দ্বিত্ব তৈরী করা হয়েছে। এই দ্বিকোটিক জগতের বাইরে এসে অবস্থান নেন ফরাসী দার্শনিক ব্রুনো লাতুর, যিনি নিজেকে ন-আধুনিক বলে দাবী করেন। গ্রাহাম হারমান’দের অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজি অনেকটা এই অবস্থান থেকে অনুপ্রাণিত এবং একধরনের দার্শনিক ধারবাহিকতা। স্মরণ রাখতে হবে যে এই ধারাবাহিকতা কেবল বিস্তৃতি বা নিছক অনুসরণ নয়। It is a continuation with rupture. পশ্চিমা দর্শনে দীর্ঘদিনের চর্চিত ‘সাবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজি’ থেকে হারমানদের এই যে বের হওয়ার প্রচেষ্টা, তা আমরা পাই তাদের অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজির আলাপে। পশ্চিমের কন্টিনেন্টাল দর্শনে এই সময়ে চলমান এই দার্শনিক বিতর্ক সম্পর্কে বাংলা ভাষাভাষী বিদ্যায়তনে পরিচিতি নাই বললেই চলে। এই লেখায় লাতুরের সূত্র ধরে গ্রাহাম হারমানের প্রস্তাবনার মূলে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। কাজী তাফসিন এই লেখায় আমাদেরকে এই নতুন চিন্তার সাথে পরিচিত করানোর কোশেশ করেছেন।]




Object Oriented Ontology(OOO)-র যাত্রা দর্শনের জগতে প্রায় নতুনই বলা চলে। যদিও এরকম নতুন কিছুর আসার সম্ভাবনা এবং আলাপ অনেক দিন ধরেই চলছিলো। আর এদিকে Object Oriented Ontology নিয়ে আমার নিজের আগ্রহও একেবারেই শিশু অবস্থায় আছে। কিন্তু আমার এই আগ্রহ বোধ করারও যথেষ্ট কারণ আছে। নৃবিজ্ঞান নিয়ে একদিক দিয়ে পড়াশোনা শুরু করা এবং বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে জানাশুনার আগ্রহ ছিলো বিধায় আমি কোনো এককালে খুঁজতে শুরু করেছিলাম বিজ্ঞান বিষয়ক জায়গাগুলোতে নৃবিজ্ঞানের কোনো কন্ট্রিবিউশান/কাজ আছে কিনা। এই নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতেই আমি ব্রুনো লাতুরের Laboratory Life (১৯৭৯) নামের এথনোগ্রাফিটা খুঁজে পাই।


Laboratory Life নামের এই এথনোগ্রাফিটা ছিলো ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করা একটা ল্যাবরেটরিকে নিয়ে, যেখানে লাতুর আর উলগার যৌথভাবে বেশ কিছুদিন যাবত নৃবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। ওই বইয়েই ব্রুনো লাতুর প্রথমবারের মত বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিকতা নামের এই এথনোগ্রাফিটা ছিলো ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করা একটা ল্যাবরেটরিকে নিয়ে, যেখানে লাতুর আর উলগার যৌথভাবে বেশ কিছুদিন যাবত নৃবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। ওই বইয়েই ব্রুনো লাতুর প্রথমবারের মত বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন তোলা শুরু করেন এবং দেখাতে চেষ্টা করেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা যে আসলে ‘অরাজনৈতিক’ কোনো কিছু না। ওই সময়ে, মানে ১৯৭৯ সালে, লাতুর যখন ল্যাবরেটরি লাইফ নামের এই এথনোগ্রাফিটা প্রকাশ করেছিলেন তখন বিজ্ঞানবোদ্ধারা এটা পড়ে নানানরকম আলোচনা সমালোচনা ও গালাগালি শুরু করে দেন। পরবর্তীতে লাতুর এই কাজগুলো শুধু এথনোগ্রাফিক কাজে সীমাবদ্ধ না রেখে দার্শনিক জায়গা থেকেও তাঁর অবস্থান প্রকাশ করা শুরু করলেন। বিজ্ঞান ও রাজনীতির এরকম পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়েই লাতুর তখন নিজেদের চক্রের অন্যান্য বন্ধুবান্ধব মিলে Actor-network Theory(ANT) নামে একটা সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক অনুসন্ধানের বা পদ্ধতির সূচনা করলেন।


Actor Network Theory মূলত Flat Ontology-ওয়ালা একটা তত্ত্ব যেখানে কিনা সব জিনিসই(entity) একেকটা অ্যাক্টর, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই জিনিসটা কোনো না কোনোভাবে ক্রিয়াশীল থাকে এবং ঐ জিনিসটা(entity) অন্য জিনিসের(entity’র) সাথে সম্পর্কিত থাকে কোনো না কোনোভাবে। মানে হিলারি ক্লিনটন, রিপন ভিডিও, পারমাণবিক বোমা, ব্যাটম্যান, প্লাস্টিকের বোতল, স্মার্ট ফোন, পাশের বাড়ির তালগাছ, ক্রিকেট বল, ডিএনএ স্যাম্পল সবকিছুই সমান গুরুত্বপূর্ণ এই অ্যাক্টর নেটওয়ার্ক থিওরির জন্য। এখানে উল্লেখ করা প্রত্যেকটা এন্টিটিই হচ্ছে লাতুরের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত একেকটা ‘Actor যতক্ষন পর্যন্ত সেগুলো অন্যকিছুর ওপর কোনো না কোনোভাবে প্রভাব রাখতে থাকবে।(দেখুন গ্রাহাম, ২০১৪)


প্রশ্ন হলো, সবকিছুকে এমন এক কাতারে এনে ‘Actor’ হিসেবে দেখানোর প্রয়োজনটা কি? এই প্রয়োজনটা লাতুরের মাথায় হাজির হয়েছিল Laboratory Life (১৯৭৯) বইটা লেখার পর থেকেই। সেখানে ‘সায়েন্স’ নিয়ে যখন একরকম বিতর্ক যখন শুরু হলো তখন এই বিতর্ক করতে করতে লাতুরের আলোচনা মডার্নিটির সমালোচনার মুখোমুখি এসে ঠ্যাকে। মডার্নিটি নিয়ে যখন লাতুর সমালোচনা শুরু করেছিলেন তখন উনি মডার্নিটির একটা বড় ঝামেলা দেখতে পেয়েছিলেন। ঝামেলাটা শুরু হয় যখন থেকে মডার্নিটি ন্যাচার এবং কালচারকে আলাদা করা শুরু করে। তিনি দেখাচ্ছিলেন যখন থেকেই মানুষ ন্যাচার এবং কালচারকে আলাদা করা শুরু করল, তখন থেকেই মানুষ আসলে একটা মেটাফিজিকাল সীমাবদ্ধতায় পড়ে গেল। মডার্নরা এভাবে সবকিছুর মধ্যে বিভক্তি এনে কিছু বিষয়কে অধিক গুরুত্ব এবং কোনো কোনো বিষয়কে কম গুরুত্ব দিয়ে একটা জঞ্জাল তৈরি করলো। এটা করলো তারা মেটাফিজিকালি দুইটা পোল/মেরু তৈরি করার মাধ্যমে। এই মেরু দুইটার মধ্যে মডার্নিটি একপাশে রাখলো ন্যাচারকে এবং অপর পাশে তারা রাখলো সমাজকে/কালেক্টিভকে/কালচারকে। এরপর তাদের বানানো এই মেরু দুইটা অনুযায়ী, তারা তাদের জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখাকে ভাগ করে দিল, চিন্তার ফ্যাকাল্টিগুলোকেও ভাগ করল। মানে, যারা ন্যাচার পোল নিয়ে কাজ করবে মডার্নিটি তাদের নাম দিলো সায়েন্টিস্ট এবং যারা সায়েন্স বাদে অন্য ফ্যাকাল্টিগুলো নিয়ে কাজ করবে মডার্নিটি তাদেরকে রাখলো সোসাইটি/কালচার পোলের আশেপাশে। এভাবে জ্ঞান ও চিন্তার ভাগবাটোয়ারা করার মাধ্যমে মডার্নিটি একধরনের যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতা তৈরি করলো নিজেদের মধ্যেই। এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা যখন তৈরি হলো, তার কিছুকাল পর থেকেই দেখা গেলো ন্যাচার পোল নিয়ে যারা কাজ করা শুরু করল তারা কালচার পোলের বিশেষজ্ঞদের কথা কানে নেয় না এবং একই ভাবে কালচার পোল নিয়ে যারা কাজ করে তারা ন্যাচার পোলের বিশেষজ্ঞদের কথা কানে নেয় না।


“It is as if we cannot have sociology and the content of science under the same gaze at once.” (Latour 1992)


এই যে মডার্নিটি এভাবে দুইটা মেরু বানালো, এরপর দুই জাতের বোদ্ধা বানিয়ে নিজেরদের মধ্যেই তারা আবার রেষারেষি করা শুরু করলো- এই বিষয়টার সমাধান করার জন্যই লাতুর বিদ্যমান সকল জিনিসকে বা Entity’কে (সেই জিনিস হোক মানুষ কিংবা না-মানুষ) একই নজরে দেখার প্রস্তাব করেন তাঁর Actor Network Theory’তে। ANT ব্যবহার করার মূল সুবিধাই হলো যে, এই তত্ত্ব মডার্নিটির বানানো সকল 'অধিক গুরুত্বপূর্ণ' বিষয়গুলাকে একরকম মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসে এবং এই অধিক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে(Entity) কে ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ জিনিসগুলোর পাশাপাশি এক কাতারে বসিয়ে দেয়। পাশাপাশি এক কাতারে বসানোর পর, ANT প্রত্যেকটা জিনিস(entity)কে এক একটা অ্যাক্টর(Actor) হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের সম্পর্কগুলোকে একটা ব্যবস্থা/নেটওয়ার্কের মত করে দেখিয়ে সেগুলোর কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করা শুরু করে।


Actor Network Theory (ANT)’র আরেকটা সুবিধা হচ্ছে, এটা যেহেতু সবকিছুকেই একেকটা অ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করে, তাই মডার্ন (এবং পোস্টমডার্ন) তত্ত্বগুলির মত ANTকে Subject position এবং Object Position নিয়ে ভাবতে হয় না খুব একটা। এভাবে লাতুর একভাবে মডার্নিটি এবং পোস্টমডার্নিজম এই দুটো জায়গা থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ব্রুনো লাতুরের কাজ নিয়ে আরো পড়তে চাইলে তাঁর We Have Never Been Modern (১৯৯৩) বইটা দেখতে পারেন।


Object Oriented Ontology (OOO)


Object Oriented Ontology’র আলোচনা শুরু হয় লাতুরের এই ফ্ল্যাট অন্টোলজির গুরুত্ব নতুনভাবে আমাদের সামনে হাজির করার মাধ্যমে। মানে ANT যেমন subject position এবং object position ছেড়ে দিয়ে সব কিছুকেই অ্যাক্টর হিসেবে দেখতে বলে, Object Oriented Ontology’ও তেমনি মেটাফিজিকালি সাবজেক্ট আর অবজেক্টের ক্যারিকেচার বাদ দিয়ে সবকিছুকে “Object” হিসেবে দেখতে বলে। Object Oriented Ontology’র এই অবজেক্ট কিন্তু আবার এতোদিন ধরে আমরা দর্শনে যে অবজেক্টকে চিনে এসেছি সেই অবজেক্ট নয়। Object Oriented Ontology’র এই ‘Object’/‘অবজেক্ট’ বলতে কিন্তু কোনো বস্তু বা কোনো জড় পদার্থ বা কোনো ম্যাটারকেও বোঝানো হয় না। সাধারণ অর্থে object বলতে বস্তু কিংবা জড় পদার্থ বোঝানো হলেও Object Oriented Ontology(OOO)-তে Objectবলতে শুধুমাত্র সেগুলোই বোঝায় না। OOO’তে বরং দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান, কাল্পনিক, বাস্তবিক সকল কিছুই এক কাতারে একেকটা ‘Object’।


(শেষ অনুচ্ছেদে অবজেক্ট লেখার সময় ছোট হাতের ‘object’ এবং বড় হাতের ‘Object’ এর ব্যবহারের পার্থক্য খেয়াল করুন)


Object Oriented Ontology’র এই আলোচনার শুরু করেন গ্রাহাম হারমান (Graham Harman)। ইনি বেশ অদ্ভুত কিসিমের এক লোক, অন্তত আমার কাছে। আমি গ্রাহামকে এমনকি ময়লার বাঙ্কারের মধ্যে বসেও দার্শনিক আলোচনা করতে দেখেছিলাম একটা ভিডিওতে। দর্শনের ছাত্র হলেও গ্রাহাম কিছুদিন খেলার ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেন। ছাত্রজীবনের প্রথম দিকে গ্রাহাম মূলত হাইডেগার নিয়েই আগ্রহী ছিলেন। তাঁর ডক্টরাল থিসিসটাও হাইডেগারের ওপরেই করা। ওখানে হাইডেগারের Tool Analysis নিয়ে পড়তে পড়তে একসময় গ্রাহাম খোঁজ পান ব্রুনো লাতুরের। কন্টিনেন্টাল ফিলোসফিতে যে লোক হাইডেগারের ভক্ত হবে, তার পক্ষে আসলে লাতুরের খোঁজ পাওয়ারই কথা, যেহেতু হাইডেগার আর লাতুর দুইজনই সায়েন্সের ‘সবজান্তা শমসের’ হয়ে ওঠা নিয়ে বরাবরই বিরক্ত ছিলেন। এসব নিয়ে গ্রাহাম হারমান যখন ঘাঁটাঘাটি করছিলেন, তখনই তিনি তাঁর Tool-being আর Guerrilla Metaphysics বই দুইটা লিখেন। এরপর তিনি এই কিছুদিন আগে তাঁর নিজের দাঁড় করানো নতুন দার্শনিক প্রস্তাবনা নিয়ে আরো কয়েকটা বই লিখেন যেগুলোর মধ্যে আছে The Quadruple Object (২০১১), Weird Realism: Philosophy and Lovecraft (২০১২), Immaterialism: Objects and Social Theory (২০১৬), Speculative Realism (২০১৮)। তবে আমি এই কমেন্টারিতে শুধুমাত্র গ্রাহামের (২০১৮)। তবে আমি এই কমেন্টারিতে শুধুমাত্র গ্রাহামের Immaterialism: Objects and Social Theory(২০১৬) নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করবো।


থার্ড টেবিল আর্গুমেন্ট


Object Oriented Ontology মূলত নিজেকে পরিচিত করায় ‘Third Table Argument’ দিয়ে। এখন কথা হচ্ছে ‘থার্ড টেবিল আর্গুমেন্ট’টা কী? থার্ড টেবিল আর্গুমেন্টের বিষয়টা গ্রাহাম হারমান তাঁর একটা প্রবন্ধে উপস্থাপন করেন যেটা তার মাথায় আসে পদার্থবিদ এডিংটন যখন ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরায় লেকচার দিচ্ছিলেন সেটা শোনার পর।


গিফোর্ড লেকচার দেয়ার সময় পদার্থবিদ এডিংটন যে টেবিলের ওপর হাত রেখে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন সেটা নিয়েই তিনি ‘টু টেবিল আর্গুমেন্ট’ ধাঁচের একটা আলোচনা করেন। এডিংটন বলেন তিনি যে টেবিলের ওপর হাত রেখে কথা বলছেন সেটা দুই রকম হতে পারে। প্রথমত টেবিলটা হচ্ছে, নির্দিষ্ট কিছু অণু-পরমাণুর সমষ্টি যে অনু-পরমাণুগুলো একত্রিত হয়ে এই টেবিলটা গঠিত হয়েছে। মানে এটা একরকম সায়েন্টিফিক টেবিল যেটাকে শুধুমাত্র বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই বোঝা সম্ভব, অন্যথায় না।


দ্বিতীয়ত, টেবিলটাকে ব্যবহার করা যায় মানুষের দৈনন্দিন কাজে। এটাই এডিংটনের সেকেন্ড টেবিল। ধরেন আপনি টেবিলটার ওপর হাত রেখে কথা বলতে পারেন।


কিন্তু এই দুই রকম টেবিলের মধ্যে পদার্থবিদ হিসেবে এডিংটন প্রথম টেবিলটাকেই উনার নিজের জন্য বাস্তবসম্মত হিসেবে মেনে নেন, যেহেতু এটাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বোঝা সম্ভব।


এখানে এসে গ্রাহাম হারমান দাবি করতে শুরু করেন, এডিংটনের এই দুই রকম টেবিল বাদেও তৃতীয় আরেকটা টেবিল আছে, যেটা আমাদের আলোচনা থেকে সবসময়ই বাদ পড়ে এসেছে। তৃতীয় এই টেবিলটাই হচ্ছে গ্রাহাম হারমানের ‘Object’। এই তৃতীয় টেবিলটা আসলে বাদ পড়েছে প্রথম দুইটা টেবিলকে ওই দুইভাবে বুঝতে চাওয়ার সীমাবদ্ধতার কারণে।


এবার প্রশ্ন আসে তাহলে এডিংটনের প্রথম টেবিলের সীমাবদ্ধতা কোথায়? প্রথম কথা হচ্ছে, একটা বস্তুকে শুধু নির্দিষ্ট কিছু অণু-পরমাণুর সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করলে এটার মধ্যকার পরিবর্তনশীলতা বা অপরিবর্তনশীলতা ঠিকমত বোঝা যায় না। ধরুন প্রতি সাত বছর পরপর মানবদেহে সব অণু-পরমাণু পরিবর্তন হয়ে প্রতিস্থাপিত হতে থাকে। কিন্তু এই প্রতিস্থাপনের পরেও বাইরে থেকে দেখতে মানে আপাদমস্তক দেহ-মনের মানুষটা কিন্তু একই রকম থেকে যেতে পারে। আবার একই রকম নাও থাকতে পারে। এই যে একই রকম থাকতে পারা কিংবা না-পারা নিয়ে যে আলোচনা সেটা কিন্তু আদৌ করা সম্ভব নয় যদি আমরা একটা বস্তুকে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু অণু-পরমাণুর সমষ্টি হিসেবে ব্যাখ্যা করতে থাকি।


কিংবা ধরেন প্রতিদিন আমার মাথা থেকে বিশটা চুল পড়ে। কিন্তু তার মানে এই না যে প্রতিটা চুল পড়ার সাথে সাথে আমি একটা ভিন্ন কিসিমের মানুষ হয়ে পড়বই। হতে পারে, আমার মাথা থেকে যেকোন একটা চুল পড়ার আগে ও পরে আমি ভিতরে ভিতরে ঠিক একই মানুষটাই থেকে যেতে পারি।


কিংবা ধরুন, এডিংটনের টেবিলের একটা পায়া আপনি পরিবর্তন করে সে জায়গায় একই রকম দেখতে অন্য আরেকটা পায়া টেবিলে জোড়া লাগিয়ে দিলেন। তার মানে তো এই না যে কার্যত আপনার জন্য পুরো টেবিলটাই বদলে গিয়ে ভিন্ন একটা টেবিলে পরিণত হয়ে গেলো। তা নাও হতে পারে। এই যে কোন কিছুর পরিবর্তন হওয়া কিংবা না হওয়া, এটা নিয়ে আলোচনা করার জায়গা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় যদি আমরা কোন একটা কিছুকে সুনির্দিষ্ট কিছু অণু-পরমাণুর সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করতে থাকি অথবা কোন কিছুকে তার ক্ষুদ্রতম একক( smallest unit)-এ রূপান্তর করে তা নিয়ে আলোচনা করতে থাকি। তাই এডিংটনের এই প্রথম টেবিলের সমস্যা হচ্ছে, প্রথমত এই টেবিলের মৌলিকত্ব কিংবা অমৌলিকত্ব সম্পর্কে ঠাওর করা যায় না এবং এই টেবিলের মধ্যে যদি কোন পরিবর্তনশীলতা বিদ্যমান থাকে কিংবা না থাকে সেটা নিয়েও আলোচনা করার জায়গা খোলা থাকে না যেহেতু আমরা টেবিলকে একটা ক্ষুদ্রতম এককের সমষ্টি হিসেবে দেখছি। গ্রাহাম হারমান এই সমস্যাটার নাম দিয়েছেন আন্ডারমাইনিং(Undermining)। আন্ডারমাইনিং-এর সমস্যা হচ্ছে এই দোষে দুষ্ট যেকোনো দার্শনিক চিন্তা কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতি কোন কিছুর Emergence (বা হঠাৎ করে হাজির হওয়া)-কে ব্যাখ্যা করতে পারে না।


আন্ডারমাইনিং-এর এই ঝামেলাটা শুরু করেছিল মূলত গ্রিক পর্বে, সক্রেটিস পূর্ববর্তী কিছু দার্শনিক এবং বিশেষত ডেমোক্রিটাসের হাত ধরে। তবে মোটা দাগে বলা যায়, এখনকার বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই Undermining এর দোষে দুষ্ট, যা কোন কিছুর ক্ষুদ্রতম একক বের করে শুধুমাত্র সেটা নিয়েই মাথা ঘামাতে থাকে এবং এই নিয়ে মাথা ঘামানো থেকে আজীবন আর বের হতে পারেনা। বস্তুকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে ভাগ করতে করতে বিজ্ঞান আজকে কোয়ান্টাম ফিজিক্সে এসে পৌঁছে গেছে। গ্রাহাম হারমান প্রথমত এই আন্ডারমাইনিং-এর সমস্যা থেকে দর্শনকে বের করে নিয়ে আসতে চান।


এডিংটনের প্রথম টেবিলের ল্যাঠা তো চুকলো। এবার আসি দ্বিতীয় পদের টেবিলের প্রসঙ্গে। এডিংটন তাঁর বর্ণনায় দ্বিতীয় রকমের টেবিলটাকে মূলত এটির তৎকালীন ব্যবহার দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন মাত্র। অর্থাৎ এডিংটনের কাছে দ্বিতীয় টেবিলটা ঠিক সেটাই, ওই মুহূর্তে টেবিলটাকে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে কোন কিছুকে শুধুমাত্র সেটার বাস্তবিক ব্যবহারযোগ্যতা দিয়ে ব্যাখ্যা করাও সমস্যাজনক বলে মনে করেন গ্রাহাম হারমান। ব্যবহারযোগ্যতা এবং সম্পর্কযুক্ততা এই দুটো দিয়ে ব্যাখ্যা করার এই প্রবণতা অনেকটা প্রাচীন গ্রীক দর্শনের ম্যাগারিয়ানদের মত শোনায়, যারা মনে করতোঃ একজন রাজমিস্ত্রি যিনি ঘর বানান তিনি কখনোই রাজমিস্ত্রি হবেন না, যতক্ষণ না তিনি ওই মুহূর্তে একটি ঘর বানাতে থাকবেন। পশ্চিমা দর্শনশাস্ত্রে ম্যাগারিয়ানদের এই ধরনের যুক্তি অ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্স গ্রন্থেই বেশ সমালোচিত হয়েছিল। এরিস্টটল বলেছিলেন যে, এই ধরনের যুক্তি দিয়ে আমরা কোন কিছুর অকস্মাৎ পরিবর্তনকে(change) আর ভিন্নতা(difference)-কে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। মানে এই মুহূর্তে একজন অধিক পারদর্শী কিন্তু ঘুমন্ত রাজমিস্ত্রি এবং খুবই অল্প পারদর্শী সজাগ রাজমিস্ত্রি যে কিনা এই মুহূর্তে ঘর বানাচ্ছে- তাদের মধ্যেকার যে তফাৎ সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারবো না। আবার এমনও হতে পারে আজকে যিনি পেশায় বাবুর্চি তিনি হয়তো কালকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রাজমিস্ত্রি হয়ে উঠতে পারেন। এই যে কারো কারোর হঠাৎ করে অন্য যেকোন কিছু হয়ে ওঠার যেই সম্ভাবনা- সেই সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলা যাবে না যদি আমরা সব কিছুকে এর বাস্তব সম্পর্কযুক্ততা কিংবা ব্যবহারযোগ্যতা দিয়ে বিবেচনা করতে থাকি। মানে কেউ তো জানেনা যে কোনটা কি হয়ে উঠতে পারে, কিসের মধ্যে কি লুকিয়ে থাকতে পারে। হতে পারে কালকে আমি হবো পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো প্যাশনেট ক্রিকেটার (যদিও আমি আজকে অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজি নিয়ে লিখে আনন্দ পাচ্ছি এবং এই মুহূর্তে আমি খেলাধুলাকে হুদাই সময়ের অপচয় বলে মনে করছি)।


ফলে যেকোনো কিছুর মধ্যকার যে সম্ভাবনা (contingency) এবং ইমারজেন্স সেটা আমাদের নজর এড়িয়ে যাবে যদি আমরা কোন কিছুকে শুধুমাত্র এর সম্পর্কযুক্ততা কিংবা বর্তমান ব্যবহারযোগ্যতা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। গ্রাহাম হারমান এই সমস্যার নাম দিয়েছেন ওভার-মাইনিং(Overmining)। যেমন Empiricism হচ্ছে একরকম Overmining, যেখানে কোন বস্তুর দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যসমূহ ওই বস্তুটিকে সংজ্ঞায়িত করে (যেমন শিংওয়ালা চতুষ্পদ হাম্বা হাম্বা ডাক দেওয়া বিষয়টারে গরু বলে যা হাল চাষ করা, দুধ দেয়া ইত্যাদি কাজে লাগে)।


আরো এগিয়ে গিয়ে হারমান দেখান এমনকি তার সবচেয়ে পছন্দের দার্শনিক ব্রুনো লাতুরের Actor Network Theory’ও — যেখানে প্রতিটা অ্যাক্টরের সংজ্ঞায়ন করা হয় ঐ এক্টরের সাথে অন্যান্য অ্যাক্টরদের সম্পর্ক বা relation দ্বারা—এই ওভারমাইনিং এর দোষে দুষ্ট। তাই কোনো কিছুকে এভাবে তার চলমান সম্পর্ক কিংবা বৈশিষ্ট্য/গুণাবলী দিয়ে বিচার করলে বস্তুর নিজস্ব যে Potentiality কিংবা Emergence থাকে সেটা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।


তাহলে প্রথমে আমরা দেখলাম যে আন্ডারমাইনিং-এর মাধ্যমে অবজেক্টকে ক্ষুদ্রতম এককে ভাগ করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয় যেখানে এর মূল ontological প্রশ্ন থাকে, “এটা কি?” বা “What it is?”


আবার দ্বিতীয় দফায় ওভারমাইনিং-এর প্রবণতায় আমরা দেখলাম যে, অবজেক্টকে শুধুমাত্র এর কার্যকারিতা এবং বিদ্যমান সম্পর্কতে নামিয়ে আনা বা হ্রাস করা হচ্ছে। যা Ontlogically শুধুমাত্র প্রশ্ন করতে পারে, “এটা কি কি করে?” বা “What it does?”


এই দুই রকম সমস্যা বাদেও জ্ঞানতত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্রে আরেকটা সমস্যা বা প্রবণতা বেশিরভাগ সময় দেখা যায়। গ্রাহাম সেটার নাম দিয়েছেন Duomining— যেখানে Undermining এবং Overmining একই সাথে ঝালমুড়ির মত গুলিয়ে ভেলকি দেখানোর চেষ্টা করে। মানে, যখনই এই দুই ধরনের প্রবণতা একই সাথে কোন জ্ঞানতত্ত্বে বা চিন্তায় হাজির থাকে তখন সেটাকে ডুওমাইনিং বলা হয়। পারমেনাইডিসকে বলা যায় একেবারে প্রথমদিককার ডুওমাইনিং এর বাপ, যিনি একরকম দ্বৈত জগতের কথা বলেন যেখানে একদিকে থাকে একীভূত একক সত্ত আবার অন্য দিকে থাকে জগতের এই একক সত্তরই বহুরকম ব্যাখ্যা এবং তার নানারকম উপস্থিতি। অনেক সময় Scientific Materialism এরকম ডুওমাইনিং করে যখন কোন একটা মহাজাগতিক বস্তুকে পার্টিকেল, ফিল্ড, স্ট্রিং এর মাধ্যমে প্রথমে আলাদা করে ব্যাখ্যা করা শুরু হলেও পরমুহূর্তেই বলা হয় যে এসব পার্টিকেল কিংবা ফিল্ডকে আবার গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব (উদাহরণ হিসেবে দেখুন মেয়াঁসু, ২০০৮)।


“What it can do?”


এভাবে গ্রাহাম হারমান দর্শন এবং জ্ঞানতত্ত্বে দুইটা বড় বড় সমস্যা/প্রবণতা যথা আন্ডারমাইনিং এবং ওভারমাইনিংকে চিহ্নিত করেন। এই সমস্যা দুটি থেকে সরে আসার জন্য Object Oriented Ontology’র আলাপ শুরু করেন, যেখানে তার মূল ontological প্রশ্ন “What it is” নয় এবং একইসাথে “What it does” নয়। বরং Object Oriented Ontology(OOO)’র অন্টোলজিকাল প্রশ্ন হচ্ছে “What it can do?” মানে আন্ডারমাইনিং এবং ওভারমাইনিংকে সরিয়ে দিয়ে Object Oriented Ontoogy একরকম Neither-nor ধরনের অবস্থানে নিজেদেরকে দাঁড় করায়, যেখানে তারা কোনো কিছুর আন্ডারমাইনিং করতেও রাজি নয় এবং একই সাথে ওভারমাইনিং করতেও রাজি নয়। এই দুইটা ঝামেলায় পা না ফেললেই একমাত্র বোঝা সম্ভব গ্রাহাম ‘Object’ বলতে আসলে কি বোঝাতে চাচ্ছেন।


‘Realism’ without Materialism?


একটা নতুন চিন্তাকে অবশ্যই পুরানো সব চিন্তার থেকে নিজের পার্থক্য চিহ্নিত করা লাগে। আর এই চিহ্নিত করার জন্য প্রথমত এই নতুন চিন্তাকে চিহ্নিত করা লাগে কোনটা কোনটা পুরানো চিন্তা। নতুন এই চিন্তার সাথে পুরানো চিন্তার ফারাকগুলো খুঁজে বের করে দেখিয়ে দিতে হয়। এইজন্য আমি এখানে আরো একটু সময় নিব OOO’র সাথে বর্তমান সময়ের বেশি পরিচিত দর্শনের অন্যান্য স্কুলগুলোর কি কি পার্থক্য আছে সেগুলো আরও ভালোভাবে পরিষ্কার করার জন্য।


ওভারমাইনিং এর ঝামেলার প্রসঙ্গে এবার আরেকটু ফেরত যাই। ওভারমাইনিং এর প্রবণতা গ্রাহাম হারমান এমনকি Idealism এবং Realism এর মধ্যেও দেখতে পান। তবে এই দুটোর মধ্যে New Materialist (এবং মোটাদাগে দেল্যুজিয়ান)-দের ওপর গ্রাহাম হারমান তাঁর ইম্ম্যাটেরিয়ালিজম(২০১৬) বইতে বেশি সময় ব্যয় করেছেন। New Materialist-দের সাথে OOO’র কয়েকটা জায়গায় যে বেসিক পার্থক্যগুলো আছে সেগুলো এখানে বলে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ।


New Materialist’রা মনে করে সবকিছুই ক্রমাগত পরিবর্তনশীল কিন্তু এদিকে OOO মনে করে এই পরিবর্তন ক্রমাগত হয় না। OOO মনে করে যেকোনো Object এর পরিবর্তনশীলতা কোন কোন সময় খুব দ্রুত হয় আবার কোন কোন সময় পরিবর্তন একেবারেই হয় না। অন্যদিকে দেল্যুজিয়ান নিউ ম্যাটেরিয়ালিস্টরা মনে করে মহাবিশ্ব একটা ইমানেন্স এর মধ্যে ডুবে থাকে এবং এই ইমানেন্স এর বিষয়টা দরকারী, উল্টোদিকে ট্রানসেনডেন্সই বরং সব ঝামেলার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে কিন্তু OOO একেবারেই উল্টো দিক থেকে ভাবে। গ্রাহাম বরং মনে করেন, মহাজাগতিক সবকিছু যদি অন্তহীনভাবে এই ইমানেন্সের মধ্যে ডুবে থাকত তাহলে সবকিছুই দুর্বিষহ হয়ে উঠতো তার নিজের জন্য।


এবার আসি ভাববাদের প্রসঙ্গে। একটা পর্যায়ে গিয়ে OOO নিয়ে পড়তে পড়তে মনে হতে পারে গ্রাহামের এই চিন্তা নতুন বোতলে পুরানা কাসুন্দির মতন কিনা- যেহেতু OOO মনে করে প্রত্যেকটা অবজেক্টের এসেন্স বা সারসত্তা আছে। এই কথা শুনে OOO’র সাথে ভাববাদী স্কুলের যোগাযোগ আছে বলে আপনার মনে হতে পারে যেহেতু ভাববাদীরাও সারসত্তার বিষয়টা নিয়ে অনেক লাফালাফি করে।


কিন্তু না! OOO কোনোভাবেই পুরানা ভাববাদকে ফিরিয়ে আনতে চায় না, যেই ভাববাদীরা মনে করতো যে কোনো কিছুরই সারসত্তা আছে এবং সেই সারসত্তাকে জানা সম্ভব। যেমন প্রাচ্যবাদীরা মনে করত প্রাচ্যের মানুষজন সারসত্তাগতভাবে স্বশাসনে অযোগ্য, তাই একমাত্র পশ্চিমই পারবে প্রাচ্যকে শাসন করতে। OOO এই জায়গায় ভাববাদী ও অন্যান্য সারসত্তাবাদীদের থেকে আলাদা। OOO মনে করে যেকোনো অবজেক্টেরই সারসত্তা আছে এবং সেই সারসত্তাকে সরাসরিভাবে (directly) কখনোই জানা সম্ভব না।


আর ভাববাদী ধ্যানধারণাতেই যেহেতু OOO’র আপত্তির অনেক জায়গা রয়ে গেছে, তাই ভাববাদ থেকে আসা বস্তুবাদ নিয়ে OOO কি মনে করে তা নিয়ে আলাদা করে আলোচনা করব না এখানে।


তবে Immaterialism বইটা পড়ার সময় এই ভেবেও আপনার বিরক্ত লাগতে পারে যে OOO কি অবজেক্টের দোহাই দিয়ে আদ্দিকালের রিয়েলিজমকে দর্শনের জগতে আবারো ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে কিনা। এটা মনে হবার যথেষ্ট কারণও আছে। যেহেতু এক অর্থে OOO দর্শনের স্পেকুলেটিভ রিয়েলিজম(Speculative Realism) ধারারই একাংশ।


কিন্তু, OOO মোটেই আদ্দিকালের মাসুম যে রিয়েলিজম —যারা কিনা মনে করতো যে রিয়েলিটি (বাস্তব) আমাদের মনের বাইরে অবস্থান করে এবং এই রিয়েলিটি কে জানা সম্ভব— ছিল সেটাকে আবারও ফিরিয়ে আনতে চায় না। গ্রাহাম মনে করেন, বরং রিয়েলিটি আমাদের বা কোন অবজেক্টের বাইরে অবস্থান করলেও এই রিয়েলিটিকে কখনোই আমরা জানতে পারবো না। আর OOO শুধুমাত্র “reality exists outside our mind” এর মেটাফিজিক্স নিয়েই পড়ে থাকে না, যেহেতু মানুষ সাবজেক্টকে(subject position)কে গ্রাহাম হারমান এতো গুরুত্ব দিয়ে দেখতেই রাজি নন।


এভাবেই একদিকে পুরানা ভাববাদী এবং একইসাথে মাসুম ধাঁচের রিয়েলিস্ট চিন্তা-ভাবনা থেকে নিজেদেরকে আলাদা করার কারণে OOO’র লোকজন মনে করে যে, দর্শনে তাঁরা Idealism vs. Realism এর বহুদিনের বিতর্ক থেকে নিজেদেরকে পুরোপুরি আলাদা করে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছে।


Indirect approach ও ব্ল্যাকহোল দর্শন


এই পর্যায়ে এসে আমরা যেহেতু আন্ডারমাইনিং এবং ওভারমাইনিং দু’টোই বাদ দিয়ে দিচ্ছি, তখন কিন্তু প্রশ্ন আসে যে, অবজেক্ট নিয়ে তাহলে আমরা কিভাবে কথা বলব? অবজেক্ট নিয়ে কথা বলার কি কোনো উপায় আছে?


Immaterialism (২০১৬) বইয়ে গ্রাহাম এই প্রশ্নটিরই উত্তর দিতে চেয়েছেন। ‘Object’ নিয়ে কথা বলার বা প্রকাশ করার জন্য তিনি কিছু উপায় আমাদের সামনে এনে হাজির করছেন তাঁর এই বইয়ে। Object Oriented Ontology প্রথমত সকল অবজেক্ট নিয়ে indirect approach-এ কথা বলাতে জোর দেয়। কিন্তু indirectly কোনো কিছু সম্পর্কে কিভাবে বলা সম্ভব?


Indirect approach নিয়ে বোঝানোর ক্ষেত্রে ব্ল্যাকহোল দেখার উদাহরণ এখানে কাজে লাগতে পারে। ধরুন, একটা দৃশ্যমান তারার অবস্থান মহাকাশে আমরা খুব সহজেই বের করে ফেলতে পারব প্যারালাক্স মেথড ব্যবহার করে। কিন্তু কোনো একটা ব্ল্যাকহোলকে কি আমরা ডিরেক্টলি বা সরাসরি দেখতে পাব? মোটেই না। বরং প্রাথমিকভাবে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব ও অবস্থান আমরা Indirectly বুঝতে পারি ব্ল্যাকহোলের দূরবর্তী অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের গোলযোগ কিংবা অসামঞ্জস্য সম্পর্কে ধারণা নিয়ে। মানে, ব্ল্যাকহোলের কারণে এর দূরবর্তী গ্রহ-নক্ষত্রের স্বাভাবিক আবর্তনে যে ব্যাঘাত ঘটে সেই ব্যাঘাতকে পর্যবেক্ষণ করেই আমরা ব্ল্যাকহোলের আপাত একটা অবস্থান নির্ণয় করতে পারি।


যদিও আমি এখানে ব্ল্যাকহোলকে যে ইনডিরেক্টলি দেখা যেতে পারে সেই উদাহরণ দিলাম, Object Oriented Ontology(OOO) ঠিক একইভাবে Object এর এরকম Indirect বর্ণনায় জোর দেয়। এই Indirect Approach আরো অনেক ভাবেই কাজ করতে পারে।


ড্যানিয়েল ড্যানেটের কোয়ালিয়া


Indirect approach এর মধ্যে একটা মাধ্যম হচ্ছে মেটাফোরের ব্যবহার। মেটাফোর কখনোই কোন কিছুকে পুরোপুরি বা সরাসরি বলে ফেলতে চায় না বলেই এর গুরুত্ব এখানে বেশি। তাই মেটাফোর নিয়ে যারা কাজ করেন বা যেসব পেশাজীবী, এমনকি, মেটাফোরের ওপর নির্ভর করেন তাদের সম্পর্কে গ্রাহাম হারমানের আগ্রহ অনেক বেশি, সেটা হোক আর্ট ক্রিটিক, আর্কিটেকচার ক্রিটিক, কিংবা ওয়াইন ক্রিটিক। ধরুন, পেশায় ওয়াইন টেস্টার একজন লোককে যখন আপনি এক পেগ ওয়াইন দিলেন, তখন সে ওই পেগে একটা চুমুক দিয়ে বললঃ “A flamboyant and velvety Pinot, though lacking in stamina”। এই যে ওয়াইন মুখে নেয়ার পর একজন ওয়াইন টেস্টার যে এই মেটাফোর ব্যবহার করলো, এই ব্যবহারটাকে ড্যানিয়েল ড্যানেটের মত কগনিটিভ সায়েন্টিস্টরা বাতিল করে দেবেন শুধু এটা একটা কোয়ালিয়া(Qualia) বলেই। কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট ড্যানিয়েল ড্যানেট যে কোনো রকমের qualia থেকে আমাদেরকে ‘উদ্ধার’ করতে চান যেটা কিনা ভাষাতীত এবং অনির্বচনীয়(Ineffable)। এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যই ড্যানেট আমাদেরকে এক ধরনের Wine Taster Machine বানানোর প্রস্তাব করেন, যেটা কিনা ওয়াইন এর রাসায়নিক বিশ্লেষণ(chemical analysis) এর মাধ্যমে এর স্বাদের মান বিচার করে দিবে। কিন্তু ড্যানিয়েল ড্যানেটের এই ওয়াইন টেস্টার মেশিন বানানোর প্রস্তাব গ্রাহাম হারমানের কাছে খুবই হাস্যকর। গ্রাহাম বলেন যে, আমরা যদি ওয়াইন কে শুধুমাত্র এর রাসায়নিক একক(unit)-এ রূপান্তর করে এর স্বাদ বিচার করার চেষ্টা করি, তাহলে সেটা একরকম undermining হবে । কারণ এর মাধ্যমে ওয়াইনের স্বাদের যে পটেনশিয়ালিটি (Potentiality) এবং surplus এই দুটোর কোনোটার সম্পর্কেই আমরা জানতে পারবো না।


কিন্তু যখনই ওয়াইন টেস্ট করার পর একজন পেশাদার ওয়াইন টেস্টার “A flamboyant and velvety Pinot, though lacking in stamina” ধাঁচের মেটাফোরিক কিছু একটা বলবে তখনই কিন্তু একে সরাসরি প্রকাশ করা হয় না এবং ওয়াইনটার স্বাদ যে কখনোই পুরোপুরি প্রকাশযোগ্য না কিংবা এটার স্বাদকে প্রকাশের যত রকম চেষ্টাই করা হোক না কেন, এর মধ্যে যে তবুও অপ্রকাশযোগ্য একটা বাড়তি অংশ বা surplus থেকে যায় সেটাও তুলে ধরা যায়।


মেটাফোর ব্যবহারের আরেকটা সুবিধা হচ্ছে একে উন্মুক্তভাবে ব্যবহার করা যায়। মেটাফোরকে যাচ্ছেতাই ভাবে ও মনমতো বসানো সম্ভব। এমনকি একটা মেটাফোরকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নানানভাবে বলা যায় এবং প্রত্যেকবার একে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পরিবর্তন করে বলার পর ওই মেটাফোরের অর্থ পুরোটাই বদলে দেয়া সম্ভব। যেমন Sea dark wine আর Wine dark sea — এই দুইটা মেটাফোর এপিঠ-ওপিঠ করে বলা হলেও দুইটাই কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মেটাফোরিকাল অর্থ প্রকাশ করে, ভিন্ন অনুভূতি তৈরি করে বক্তা এবং শ্রোতার মধ্যেও। তাই মেটাফোরের এই খেলা গ্রাহাম হারমানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এটা Object এবং এর সম্পর্কে আমাদের জাগতিক কিংবা জগতোর্ধ্ব বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দেয়। হুসার্লের Phenomenological method এর ওপর একই কারণে গ্রাহাম হারমানের আগ্রহ বেশি, যেহেতু হুসার্ল অভিজ্ঞতার চেয়ে অনুভূতি ও ফেনোমেনাকে অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব দেন।


আসলে OOO যেহেতু শুধুমাত্র “Reality is out there” এর মেটাফিজিক্স নিয়ে পড়ে থাকে না আবার এটাকে পুরোপুরি খারিজও করে না তাই অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজির সবকিছু নিয়েই কথা বলার মতো রাস্তা খোলা রাখতে হয়- সেটা হোক বাস্তব কোনকিছু কিংবা অবাস্তব বা হ্যালুসিনেটরী কোনো কিছু। যেগুলো আমি আপনি চোখে দেখি না কিন্তু অনুভব করতে পারি সেগুলো নিয়েও কথা বলার সুযোগ খোলা রাখতে হয় অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজির। আর স্বভাবতই দর্শনের সবকিছু নিয়ে কথা বলতে পারতে হয়— সেটা না বলতে পারলে এটা নতুন একটা দার্শনিক চিন্তা আদৌ হয়ে উঠতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ইনডিরেক্টলি কথা বলার আরও অনেক উপায় থাকতে পারে। এমন নয় যে, যেই অবজেক্ট নিয়ে আমরা কোন কিছু প্রকাশ করতে পারব না সে ব্যাপারে তরুণ ভিটগেনস্টাইনের মত আমাদেরও চুপ থাকতে হবেই। তবে কৌশলগত নীরবতাও এক্ষেত্রে বলার মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। এগুলো বাদেও গ্রাহাম অবজেক্ট নিয়ে আলোচনার জন্য Socratic Method কিংবা অ্যারিস্টটলের Rhetoric বই থেকে অনেক কিছু ধার করার পরামর্শ দেন।


অবজেক্ট ও তার জীবদ্দশা


এই আলাপগুলো বাদেও অবজেক্ট নিয়ে কথা বলার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে গ্রাহাম কোন অবজেক্টের জীবদ্দশা বা Life-span নিয়ে কথা বলার প্রস্তাব করেছেন । হ্যাঁ, অবজেক্টের জীবদ্দশা আছে। গ্রাহাম মনে করেন একটা অবজেক্ট যে রকমই হোক না কেন, সেটা হোক মানুষ(Human), কিংবা না-মানুষ(Non-human), কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান, বা কোন জন্তু বা কোন বস্তু কিংবা কোন সাম্রাজ্য বা কোন শহর বা কোন কিছুর ধারণা(concept)- সেটার একটা জীবদ্দশা আছে। কোন অবজেক্ট তার এই জীবদ্দশায় অন্যান্য অনেক অবজেক্টের সংস্পর্শে আসতে পারে এবং এর সাথে একরকম বন্ধন তৈরি করতে পারে। অবজেক্টের এরকম বন্ধনে যুক্ত হওয়াকে গ্রাহাম হারমান নাম দিয়েছেন সিমবায়োসিস (Symbiosis)। কোনো অবজেক্টের জীবদ্দশার এই ভেজালটা বোঝার জন্য আমি আগে ‘সিমবায়োসিস’ নিয়ে আলোচনা করে নিব যেন জীবদ্দশার ব্যাপারটা যেকেউ আরো সহজে বুঝতে পারে।


সিমবায়োসিস


‘Symbiosis’ নামটা মূলত বিবর্তনবাদ নিয়ে কাজ করা লোকজন এবং লিন মারগুলিসের থেকে ধার করা। একটু আগেই বলেছিলাম যে, কোন অবজেক্ট তার এই জীবদ্দশায় অন্যান্য অনেক অবজেক্টের সংস্পর্শে আসতে পারে এবং এর সাথে একরকম বন্ধন তৈরি করতে পারে, যে বিষয়টাকে সিম্বায়োসিস বলেছেন গ্রাহাম হারমান। সিমবায়োসিস হচ্ছে একরকম বন্ধন যেটা ন-পারস্পরিক বা Non-reciprocal। মানে অনেকটা একপাক্ষিক কিংবা one sided entanglement এর মতন (এই বাক্যের দায় এই রচয়িতার নিজের)। মানে, সিমবায়োসিস কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মত নয় বা সিমবায়োসিস এমন কিছু না যে দুইটা object এর মধ্যে সিমবায়োসিস হবার পরে দুইটা অবজেক্টের মৌলিক সত্তা বা এসেন্স গায়েব হয়ে ভিন্ন একটা সামগ্রিক সত্তায় পরিণত হবে নতুন করে। মানে সিমবায়োসিস এমন না যে দুই অনু হাইড্রোজেন আর এক অনু অক্সিজেন নিলে পানির মত সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কিছু তৈরি করবে যেটা হাইড্রোজেন গ্যাস এবং অক্সিজেন গ্যাস থেকে আলাদা।


গ্রাহাম হারমান সিম্বায়োসিসকে বুঝিয়েছেন দিয়েছেন আগুনে জ্বলন্ত তুলার উদাহরণ দিয়ে। “Fire Burning Cotton” গ্রাহাম হারমানের বহুল পরিচিত একটা উদাহরণ। মানে যদি আগুন আর তুলা কাছাকাছি আসে এবং তুলা আগুনের উত্তাপে জ্বলে পুড়ে যায়, তার মানে এই না যে নিশ্চতভাবে তুলার অস্তিত্ব একেবারে নাই হয়ে গেল অথবা এই নয় যে আগুন তুলাকে পুরোপুরি নাই করে দিল। বরং অবজেক্ট হিসেবে আগুন তুলার সেই অংশগুলোকে কাজে লাগালো বা Translate করল যে অংশগুলো আগুনের পক্ষে জ্বালানো সম্ভব হয়েছে। আবার আগুনে জ্বলে যাওয়ার পর তুলাও ছাই হয়ে যায় না।


তবে দুই বা ততোধিক অবজেক্টের সাথে একটা অবজেক্ট সিমবায়োসিস করার পর ওই অবজেক্ট অন্য অবজেক্টটার তুলনায় অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তবে কোন অবজেক্ট অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠবে এটার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। সিম্বায়োসিসের পর শক্তিশালী অবজেক্টটা কি করবে সেটাও নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ নাই আমাদের।


সিমবায়োসিস মূলত এমন কিছু না যে এটা নিউটনের সূত্রের মত দুদিক থেকেই ‘পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয়’। সিমবায়োসিস পুরোপুরি একটা একমুখী সম্পর্ক। মানে “সিমবায়োসিস মূলত এমন কিছু না যে এটা নিউটনের সূত্রের মত দুদিক থেকেই ‘পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয়’। সিমবায়োসিস পুরোপুরি একটা একমুখী সম্পর্ক। মানে “‘ক’ অবজেক্টের সাথে অবজেক্টের সাথে ‘খ’ অবজেক্ট সিমবায়োসিস করেছে” মানে কিন্তু এই না যে অবজেক্ট সিমবায়োসিস করেছে” মানে কিন্তু এই না যে ‘খ’ অবজেক্টেরও একই সাথে পারস্পরিকভাবে ‘ক’অবজেক্টের সাথে সিমবায়োটিক সম্পর্ক থাকতে হবে। সিমবায়োসিস কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক না।


সিমবায়োসিস এমন কিছুও না যেটা সব সময় আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়া সম্ভব। আবার সিমবায়োসিস কোন Noisy Event বা শব্দময় ঘটনাও না সব সময়। সিমবায়োসিস একদমই নীরবে-নিভৃতে হওয়া সম্ভব। হয়তো সিমবায়োসিস এর ফলাফলস্বরূপ অবজেক্টের যে পরিবর্তন হয় সেটা আমাদের নজরে অনেকটা সময় পরে একটা ইভেন্ট বা ঘটনা আকারে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে বা অনেক পরে এসে হাজির হয়। কিন্তু তার মানে এই না যে যেই মুহূর্তে আমরা কোন অবজেক্টকে অনেক বিশালাকারে এবং শক্তিশালী হিসেবে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হতে দেখি ঠিক সেই মুহূর্তেই অবজেক্টের সিমবায়োসিস ঘটেছে। হতে পারে একটা শক্তিশালী অবজেক্ট তার সিমবায়োসিস অনেক আগেই করেছে কিন্তু সেটা আমাদের চোখের সামনে হওয়া সত্ত্বেও আমরা খেয়াল করিনি। কিন্তু এরকম সিমবায়োসিস এর উদাহরণ কিভাবে দেয়া সম্ভব? উদাহরণ দিতে গিয়ে গ্রাহাম হারমান একটা অবজেক্ট এর বর্ণনা দিয়েছেন তার Immaterialism: objects and social theory বইয়ে, যেটা নিয়ে এখানে লিখব।


ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী(VOC): লাইবনিজ আর গ্রাহামের তর্কাতর্কি


Immaterialism বইয়ের দ্বিতীয় অংশে গ্রাহাম হারমান অবজেক্টের জীবদ্দশার উদাহরণ দিতে গিয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি(VOC) কে একটা ‘Real Object’ হিসেবে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো মহাবিশ্বে এত এত অবজেক্ট থাকতে গ্রাহাম হারমান কেনই বা ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (VOC)-কে নিয়ে লিখতে লিখতেই এই বইয়ের অর্ধেকটুকু জায়গা খরচ করলেন?


ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়ে গ্রাহাম হারমান চিন্তিত মূলত লাইবনিজকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই। লাইবনিজকে চ্যালেঞ্জ করতে চাওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। লাইবনিজ তাঁর Substance এবং Monade বিষয়ক রচনা গুলোতে লেখালেখি করতে করতে গ্রাহাম হারমানের ‘object’ এর বর্ণনার প্রায় কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। Substance নিয়ে এবং Nature নিয়ে আলোচনা করার সময় লাইবনিজ প্রকৃতিতে আছে এমন দুই ধরনের “Machine” এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন (দেখুন নিউ সিস্টেম অফ নেচার) । প্রকৃতিতে এই দুই জাতের বিষয়-আশয়ের মধ্যে প্রথম অংশটা হচ্ছে সকল জীবন্ত বস্তু বা Natural Machine। লাইবনিজ মনে করতেন, ন্যাচারাল মেশিন হচ্ছে এমন কিছু একটা যেটার substance এবং আত্মা বলে কিছু একটা আছে এবং সেই সাবস্টেন্স ওই ন্যাচারাল মেশিনের একাত্মতা বা unity ধরে রাখে। এই সাবস্টেন্স থাকার কারণে প্রত্যেকটা জীবন্ত বস্তু বা ন্যাচারাল মেশিনের সবগুলো ভিন্নভিন্ন অর্গান একই সাথে কাজ করতে পারে। সাবস্টেন্স এভাবে শরীরের প্রত্যেকটা অংশে একই সাথে বিরাজমান থেকে এর একাত্মতা(unity) বজায় রাখে।


প্রকৃতিতে দ্বিতীয় রকমের যে বস্তু(ম্যাটেরিয়াল অর্থে নয়, Thing অর্থে) আছে তার নাম হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল মেশিন(Artificial machine) যার কোন একক সাবস্টেন্স নেই বলে মনে করতেন লাইবনিজ। এই Artificial Machine হচ্ছে মূলত একাধিক সাবস্টেন্সের সমষ্টি, যেমন একদল আর্মি, এক পাল ভেড়া, একগুচ্ছ পাথর ইত্যাদি। দেখতে এদের একত্রিত বলে মনে হলেও এদের আসলে কোন সাবস্টেন্স নেই বরং এরা অনেকগুলো সাবস্ট্যান্সের সমষ্টি। এই সমষ্টিগত সাবস্ট্যান্সগুলোকে লাইবনিজ নাম দিয়েছেন এগ্রিগেট(Aggregate)। যেমন, হাতঘড়ি একটা আর্টিফিশিয়াল মেশিন/এগ্রিগেট যেটার কোন সাবস্টেন্স নেই। অপরদিকে একজন মানুষকে একটা ন্যাচারাল মেশিন বলা যেতে পারে, যেহেতু তার সাবস্টেন্স আছে। মানবশরীরের প্রত্যেকটি অর্গানের সাথে এক ধরনের সামঞ্জস্য বজায় রাখা সম্ভব হয় এই সাবস্টেন্সের মাধ্যমে।


অন্যদিকে, আর্টিফিশিয়াল মেশিনকে লাইবনিজ ব্যাখ্যা করছেন অনেকগুলো ছোট ছোট সাবস্ট্যান্সের সমষ্টি হিসেবে—যাদের মধ্যে কোন একাত্মতা নেই, যাদেরকে একত্র করা হয়েছে কৃত্রিমভাবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এক ব্রিগেড সৈন্যের কথা, কিংবা একটা পুকুর ভর্তি মাছের কথা। এদেরকে উপর থেকে দেখলে একটা সাবস্ট্যান্স বলে মনে হয় কিন্তু আসলে এরা একাধিক সাবস্ট্যান্সের কৃত্রিম সমষ্টি বলে মনে করতেন লাইবনিজ।


মজার বিষয় হচ্ছে প্রকৃতি দর্শন (Philosophy of Nature) সম্পর্কিত এই লেখালিখিগুলোতে লাইবনিজ তখন কম্পাউন্ড সাবস্টেন্স/আর্টিফিশিয়াল মেশিনের উদাহরণ দিয়েছিলেন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিয়ে। তিনি বলেছিলেন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেহেতু ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘ন্যাচারালভাবে’ তৈরি হওয়া কোন কিছু না বরং ‘কৃত্রিমভাবে’ জমায়েত হওয়া কিছু মানুষের তৈরি করা একটা প্রতিষ্ঠান— তাই এটার কোন একক সাবস্ট্যান্স নেই। তাই লাইবনিজের কাছে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটা আর্টিফিশিয়াল মেশিন। আর স্বভাবতই লাইবনিজ ভেবেছিলেন যে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তো কোনভাবেই নির্দিষ্ট করা যায় না, কোনোভাবে একে সুনির্দিষ্টভাবে সীমায়িত করা যায় না। ধরুন, আজকে VOC-এর সৈন্যসংখ্যা ৩০০০ হলে কালকে সৈন্য সংখ্যা হয়ে যেতে পারে ৪০০০ জন, আবার পরশু VOC-এর সৈন্য সংখ্যা হয়ে যেতে পারে মাত্র ৫০০ জন। ধরুন, আজকে VOC এর জাহাজ সংখ্যা ৫টা হলেও কালকে এরা ২৫টা জাহাজের মালিক হয়ে যেতে পারে। মানে VOC-কে আসলে কোনোভাবেই যেহেতু সুনির্দিষ্ট করা যায় না, তাই VOC একটা আর্টিফিশিয়াল মেশিন যার কোনো সুনির্দিষ্ট ‘Unity’ নেই, যার একক কোন Substance নেই। বরং VOC হচ্ছে অনেকগুলো সাবস্ট্যান্সের সমষ্টি যেটা কিনা একটা Compound, Aggregate এবং প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া কোনো কিছুই না।


কিন্তু ইম্ম্যাটেরিয়ালিজম বইয়ে গ্রাহাম হারমান দাবি করেন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটা ‘রিয়েল অবজেক্ট’ এবং যেহেতু ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একটা রিয়েল অবজেক্ট, তাই এটার একক একটা সাবস্টেন্স আছে এবং এর ইউনিটিও বিদ্যমান ছিল।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রাহাম হারমান কিভাবে VOC-কে একটা অবজেক্ট হিসেবে আমাদের সামনে দাঁড় করাচ্ছেন। VOC-কে অবজেক্ট হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য গ্রাহাম হারমান প্রথমে VOC-এর জীবদ্দশায় বা Lifespan এ যতগুলো সিমবায়োসিস হয়েছিলো সেগুলোকে চিহ্নিত করেন এবং পরবর্তীতে এই জীবদ্দশায় হওয়া সিমবায়োসিসগুলোকে ব্যাখ্যা করা শুরু করেন। শুধুমাত্র সিমবায়োসিসের জায়গাগুলি গ্রাহাম চিহ্নিত করেই বসে থাকেননি। এরপর গ্রাহাম এই সিমবায়োটিক মোমেন্ট বা মুহূর্তগুলোর সাথে একটা অবজেক্টের জীবদ্দশায় বিভিন্ন ধাপ বা স্টেইজগুলোকে (Phase নয়) দেখানোর চেষ্টা করেন। এবং ঐ ধাপগুলো না ঘটলে VOC কিরকম হত সেটারও ব্যাখ্যা দেন।


শুনতে অদ্ভুত লাগলেও আপনি ঠিকই পড়ছেন। হ্যাঁ, সিম্বায়োসিসের ফলেই অবজেক্টের জীবদ্দশায় এই স্টেইজগুলোর উদ্ভব হয়। গ্রাহাম মনে করেন অবজেক্টের জীবদ্দশায় জন্ম(Birth), বেড়ে ওঠা/পরিপক্কতা (Ripeness), বার্ধক্য (Decadence), মৃত্যুর (Death) মত কয়েকটা ধাপ আছে। একটা অবজেক্ট তার জীবদ্দশায় জন্ম, পরিপক্কতা, বার্ধক্য এবং মৃত্যুর মতো ধাপগুলোকে উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর জন্যই তিনি অবজেক্ট হিসেবে VOC এর ইতিহাস নিয়ে কিছুদূর ঘাঁটাঘাটি করেছেন। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও আপনি ঠিকই পড়ছেন। হ্যাঁ, সিম্বায়োসিসের ফলেই অবজেক্টের জীবদ্দশায় এই স্টেইজগুলোর উদ্ভব হয়। গ্রাহাম মনে করেন অবজেক্টের জীবদ্দশায় জন্ম(Birth), বেড়ে ওঠা/পরিপক্কতা (Ripeness), বার্ধক্য (Decadence), মৃত্যুর (Death) মত কয়েকটা ধাপ আছে। একটা অবজেক্ট তার জীবদ্দশায় জন্ম, পরিপক্কতা, বার্ধক্য এবং মৃত্যুর মতো ধাপগুলোকে উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর জন্যই তিনি অবজেক্ট হিসেবে VOC এর ইতিহাস নিয়ে কিছুদূর ঘাঁটাঘাটি করেছেন। তবে Immaterialism বইয়ে VOC-এর ইতিহাস আলোচনা মূল লক্ষ্য ছিলনা, বরং মূল লক্ষ্য ছিলো VOC এর আদৌ কোনো সাবস্ট্যান্স আছে নাকি লাইবনিজ VOC সম্পর্কে যা বলেছিলেন সেটাই যথাযথ এই নিয়ে একটা দার্শনিক অনুসন্ধান চালানো। এই আলোচনাটা এগিয়ে নেয়ার জন্য আমি VOC সম্পর্কে এখানে কিছু তথ্য দিয়ে তারপর এগোবো।


ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (Vereenigde Oostindische Compagnie/VOC) নামের আমস্টারডাম ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি ছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। কোম্পানিটি ১৬০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেটা একইসাথে পৃথিবীর প্রথম কোম্পানি যারা স্টক এক্সচেঞ্জের মতো করেই তাদের ব্যবসা চালাতো। এরা মূলত এশিয়া থেকে জাহাজ দিয়ে মসলা আমদানি করত ইউরোপে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে এই কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে যায়। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে VOC ইন্দোনেশিয়ার বাতাভিয়া (বর্তমান জাকার্তা), বাণ্ডা, আমবন, মালাকুসহ কয়েকটা বড় বড় দ্বীপ দখল করেছিল সেখানে। এমনকি ওই দ্বীপগুলোর স্থানীয়দের ওপর তারা অত্যাচার করেছে, দ্বীপবাসীদের দাসে পরিণত করে তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ওই জায়গায় জায়ফল, জয়ত্রী, লবঙ্গ, গোলমরিচসহ বিভিন্ন মসলা চাষ করিয়েছে পুরোপুরি বাধ্যতামূলকভাবে।


ছবি: ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের ম্যাপ


VOC-এর প্রসঙ্গ আসলেই যে ব্যক্তির নাম সবার আগে আসে তার নাম জ্যান পিটারসন কোয়েন (১৫৮৭-১৬২৯), যাকে মূলত উপনিবেশিক সময়কার ভিলেনদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হিসেবে ধরা হয়। কোয়েন ১৬১৮-১৬২৩ এবং ১৬২৭-১৬২৯, এই দুই কিস্তিতে VOC-এর জল্লাদ গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জল্লাদ ধাঁচের লোক গভর্নর কোয়েন আসলে ইন্দোনেশিয়ায় স্থানীয় লোকজনের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ বাঁধিয়ে সেখানকার অনেকগুলো দ্বীপ তাঁর গভর্নর পদে থাকাকালীন অবস্থায় বাগিয়ে নিয়েছিলেন জোর-জবরদস্তি করে। তবে VOC কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় অধিবাসীদের ওপরই ধরপাকড়-অত্যাচারের পাশাপাশি আরেকটা কাজ করেছিলো। সেটা হলো ইন্দোনেশিয়ার যেসব এলাকায় VOC এসে পৌঁছানোর আগেই ব্রিটিশরা (মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি/EIC) দখল করে রেখেছিল সেই জায়গা থেকে তাদেরকে বন্দুকের নল দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে।


ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থানরত ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের সাথে VOC’র প্রথম টানাপোড়েন বাঁধে ১৬১৩ সালে, যখন সম্ভাব্য জল্লাদ কোয়েনকে অপমান করেন জর্ডিয়ান নামের একজন জল্লাদ ব্রিটিশ কমান্ডার। ডাচ জল্লাদ কোয়েন ভার্সেস ব্রিটিশ জল্লাদ জর্ডিয়ানের বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে কোয়েন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে ইন্দোনেশিয়ার ওই দখলকৃত জায়গা ছেড়ে দেয়ার জন্য হুঁশিয়ারি দেন এবং বিভিন্ন রকম হুমকি-ধামকি দেয়া শুরু করেন।


কোয়েনের হুমকি-ধামকি দেয়ার ঘটনার পরের বছরই(অর্থাৎ ১৬১৪ সালে) কোয়েন VOC-এর ব্যবসা এবং দখলদারীর ভবিষ্যতটা নিশ্চিত করার জন্য বড় একটা কর্মপরিকল্পনা বা নীল নকশা আঁকেন। কোয়েনের লেখা এই নীল নকশা বা কর্মপরিকল্পনার বইটা Discourse on The State of India (১৬১৪) নামে পরিচিত, যে বইটা তিনি ওই বছরই আমস্টারডামে অবস্থানকারী VOC এর গভর্নিং বডির কাছে উপস্থাপন করেন এবং গভর্নিং বডি কোয়েনের এই কর্মপরিকল্পনা একরকম সাথে সাথেই মেনে নেয়।


মেনে নেয়ার কিছুদিন পরেই, ১৬১৬ সালে, কোয়েন আবারও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আই (Ai) দ্বীপের অবস্থিত ব্রিটিশ ঘাঁটিটা উচ্ছেদ করবেন বলে হুমকি দেন এবং কিছুদিন পর VOC সেটা জোরজবরদস্তি করে দখলও করে নেয়। এর পরপরই ৩১ বছর বয়সী কোয়েনকে ১৬১৮ সালে VOC এর গভর্নর জেনারেল বানিয়ে দেয় আমস্টারডামে অবস্থানরত গভর্নিং বডি। গভর্নর জেনারেল হবার পর কোয়েন মূলত তাঁর মত করেই VOC এর দখলী জায়গা ইন্দোনেশিয়ায় আরো বাড়িয়ে তোলা শুরু করেন।


এর এক বছর পর ১৬১৯ সালে কোয়েন VOC এর জাহাজ ভর্তি সৈন্য নিয়ে বাটাভিয়ার (বর্তমান জাকার্তার) দিকে রওনা দেন এবং সেখানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবস্থানরত লোকজনকে প্রায় তাড়া করে বের করে দেয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরবর্তীতে ইন্দোনেশিয়ায় ছেড়ে দিয়ে ভারতে চলে আসে। আই দ্বীপ(Ai) এবং বাতাভিয়া/জাকার্তা দখল করার পর VOC খুব সহজেই ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপগুলোতেও তাদের দখলদারিত্বের পরিধি বাড়ানো শুরু করে । ১৬২১ সালে তাঁরা বাণ্ডায় এসে সে জায়গার স্থানীয় মানুষদের উপর অত্যাচার করে, স্থানীয় অধিবাসীদের অন্যদ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে তাদের জায়গাও দখল করে। VOC এর পলিসিটা ছিলো মূলত একটা দ্বীপ দখল করে সেটার স্থানীয় মানুষজনকে দাস বানিয়ে ওই দাসদেরকে অন্য জায়গায়/অন্য দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে ঐ দাসদেরকে দিয়েই জোরপূর্বক মশলা চাষ করানো। এভাবে VOC সারা ইন্দোনেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো এবং নিজেদের সরাসরি কর্তৃত্ব স্থাপন করলো যা ১৬২৩ এর দিকে পুরোপুরি চোখে পড়ার মত হয়ে উঠলো। আশেপাশের সব দ্বীপগুলো আস্তে আস্তে VOC এর নখদর্পণে চলে আসে। কোয়েন এমনকি নির্দেশনাও দিয়েছিলেন যেন VOC এর দখলকৃত জমি বাদে অন্য কোথাও যেন জায়ফলের গাছ পর্যন্তও না থাকে। যদি কোথাও জায়ফলের গাছ থেকেও থাকে সেটা যেন উপড়ে ফেলা হয়।


VOC এর দখলদারিত্বের এরকম সুদিন আসার পর কোয়েন ১৬২৩ সালে আমস্টারডাম চলে যান এবং ১৬২৭ সালে তিনি আবারো ফেরত আসেন দ্বিতীয়বারের মত VOC এর গভর্নর জেনারেল হয়ে। কোয়েন কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৬২৯ সালে।


এখন আমরা যদি গভর্নর জেনারেল কোয়েনের জীবনীর থেকে VOC-কে বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে দেখবো যে এখানে সিমবায়োসিসের তিনটা মুহূর্ত লক্ষ্য করা যায়।

১৬১৪ সাল: এখানে, VOC এর জীবদ্দশায় প্রথম তিনটা সিমবায়োটিক মুহূর্তের মধ্যে, প্রথমত কোয়েন যখন তাঁরই লেখা Discourse on the State of India বইটা আমস্টারডামে উপস্থাপন করলেন সে মুহূর্তটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বইয়ের লেখা কর্মপরিকল্পনাগুলো গৃহীত হবার পরপরই কিছুদিনের মধ্যেই কোয়েন গভর্নর জেনারেল হয়ে যান এবং পদ পাওয়ার সাথে সাথেই VOC এর শক্তিশালী হয়ে ওঠার একরকম প্রবণতা শুরু হয়ে যায়।


১৬১৯ সাল: আবার ১৬১৯ সালটা VOC এর সিমবায়োটিক মোমেন্ট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এই সালে VOC তার নিজের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেয়ার জন্য একটা বড় ধাপ অতিক্রম করে বাতাভিয়া শহর দখল করার মাধ্যমে এবং একই সাথে ইংরেজদেরকে বাতাভিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। এভাবে VOC এর কর্তৃত্ব একরকম বাস্তব রূপ পেয়েছিল। এছাড়া বাতাভিয়া/জাকার্তা শহর দখল করার একটা ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল যেটা খালি চোখে ইন্দোনেশিয়ার মানচিত্র দেখলেও বোঝা যায়।


১৬২৩ সাল: সর্বশেষ ১৬২৩ সালে আম্বন দ্বীপ দখল করে ওই দ্বীপের স্থানীয়দের ওপর অত্যাচার করা এবং দ্বীপবাসীদেরকে দাস বানিয়ে অন্যদিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া, সেখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধিয়ে রাখার মতো ঘটনাগুলো VOC এর ইন্দোনেশিয়ার এইভাবে টিকে যাওয়ার জন্য দরকারি একটা মুহূর্ত। এভাবেই কয়েকটা দ্বীপে জবরদখল, অত্যাচার শুরু করার পরই Object হিসেবে VOC এর যে কর্তৃত্ব, সেটা পরিষ্কার হওয়া শুরু করেছিল।


গ্রাহাম হারমান বলছেন, এরকম ঘন ঘন বা পরপর ঘটে যাওয়া এতগুলো সিমবায়োসিসই আমাদেরকে ইঙ্গিত দেয় যে একটা অবজেক্টের জন্ম হয়ে গিয়েছে। মানে, গ্রাহাম মনে করেন জন্মের সময়ে একটা অবজেক্টের জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার সিমবায়োসিস হয়। VOC এর জীবদ্দশায় গ্রাহাম এরকম পাঁচটা সিমবায়োসিস খুঁজে বের করেছেন, যার মধ্যে প্রথম তিনটা সিমবায়োসিস নিয়ে আমি এই কমেন্টারিতে আলোচনা করেছি। (তবে কোনো একটা অবজেক্টের জীবদ্দশায় মোট সিমবায়োসিসের সংখ্যা কিন্তু বাঁধাধরা কিছু না। আপনি চাইলে VOC এর বিশটা সিমবায়োসিস খুঁজে বের করে ফেলতে পারেন, কোনো ঠিক নাই।)


VOC-এর প্রথম সিমবায়োসিস হয়েছিল অবজেক্ট হিসেবে এটার জন্মের সময়েই। মানে, ১৬১৪ সালে যখন কোয়েন তার কর্মপরিকল্পনা বিষয়ক বইটি VOC এর জন্য লিখেন তখনই। প্রথমদিককার এই সিমবায়োসিস গুলো ঘটে যাওয়ার পরপরই একটা অবজেক্ট এর স্বরূপ (বা ইন ইটসেলফ) রিয়েলিটি তৈরি করে নেয় এবং এই স্বরূপ রিয়েলিটি অবজেক্টের একক সাবস্টেন্স কে নির্মাণ করে দেয়। এরপরের দুইটা সিম্বায়োসিস হয়েছিলো ১৬১৪ আর ১৬২৩ সালে। মানে ১৬১৯ আর ১৬২৩ সালে VOC যখন পালাক্রমে বাতাভিয়া আর আম্বন দখল করলো। এরপর থেকেই অবজেক্ট হিসেবে ভকের একটা নিজস্ব রিয়েলিটি তৈরি হল। মানে (ইন ইটসেলফ) রিয়েলিটি তৈরি হলো এবং নিজস্ব এই রিয়েলিটি VOC এর Unity বা একাত্মতাকে কে তখন তৈরি করে দিল।


এবার পেছনে ফেরত যাই একটু। এই কমেন্টারিতে অবজেক্ট হিসেবে আমি VOC এর উদাহরণ নিয়ে লেখার সময় প্রথমেই বলেছিলাম যে আমাদের চোখের সামনে যে মুহূর্তে একটা Object প্রভাববিস্তারকারী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই যে এটা সিমবায়োসিস করা শুরু করেছিল তা নয়। হতে পারে, অনেক আগেই ওই অবজেক্টের জন্ম হয়েছে এবং সেই অবজেক্ট ততদিন কোন ইমপ্যাক্ট ফেলাই শুরু করেনি। অবজেক্ট এর জীবনের এই ধাপটাকে গ্রাহাম নাম দিয়েছেন Dormancy বা সুপ্তময়তা। এই Dormancy বা সুপ্তময়তার বিষয়টা অনেকটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত যেটার জন্ম অনেক আগে হলেও এর উদগীরণ আমাদের চোখের সামনে এসে হাজির হয় অনেক পরে।

অবজেক্ট -এর জন্মের পরপর কিছুকাল এই Dormancy বা সুপ্তময়তায় থাকার বিষয়টা অনেকটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত যেটার জন্ম অনেক আগে হলেও এর উদগীরণ আমাদের চোখের সামনে এসে হাজির হয় অনেক পরে। ছবি: ভিসুভিয়াসের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি


Object এর সুপ্তময়তার জন্যই অবজেক্ট তার জন্মের পরপরই আমাদের চোখের সামনেই একটা ঘটনা (গ্যাঞ্জাম/noisy event) হিসেবে সাথে সাথেই হাজির হয়ে যায় না বলে গ্রাহাম মনে করেন। অর্থাৎ, “Objects as events are echoes of objects as objects”(হারমান, ২০১৮)। একটা গ্যাঞ্জামের(event) সময় আমরা ‘object as event’ হিসেবে যেই অবজেক্টকে উপস্থিত দেখি, সেটা হচ্ছে আসলে ‘অবজেক্টের প্রতিধ্বনি’/‘echoes of object’ যেটা তার মূলধ্বনি উৎপন্ন করার অনেক পরে আমাদের কানে ঘটনা হিসেবে আসে একটা প্রতিধ্বনি রূপে।


যেমন ১৬২৩ সালে VOC সবচেয়ে প্রভাবশালী অবস্থায় ছিল যখন এটা বাটাভিয়া আর আম্বন দখল করে ব্রিটিশ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে ফেলে তখন। এভাবে প্রভাবশালী হয়ে object as event-রূপে সবার দৃষ্টিগোচর হওয়ার ঘটনা শুনে ওই জায়গায় উপস্থিত মানুষজনের মনে হতে পারে যে অবজেক্ট হিসেবে VOC এর জীবদ্দশা ১৬২৩ সাল থেকে শুরু হয়েছিলো। কিন্তু না, VOC এর ‘অবজেক্ট’ হয়ে ওঠা আসলে ১৬২৩ সাল থেকে শুরু হয় নি। বরং ১৬১৪ থেকেই VOC এর অবজেক্ট হবার সব কারবারি শুরু হয়ে গিয়েছিল যখন কমান্ডার কোয়েন Discourse on the State of India (১৬১৪) লিখলেন ও এই বইয়ের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশ্বাস পেলেন আমস্টারডামের গভর্নিং বডি থেকে।


প্রাথমিক পর্যায়ে একটা অবজেক্ট যখন কয়েকটা সিমবাইয়োটিক মুহূর্ত পার করে ফেলে তারপর শুরু হয় ওই অবজেক্টের পরিপক্বতার বা Ripeness এর পর্যায়। রাইপনেস এর পর্যায় এসে একটা অবজেক্ট যেটা করে তা হচ্ছে সেটা সিমবায়োসিসের সময় যেসকল অন্যান্য অবজেক্টকে আশেপাশে পেয়েছিল (যেমন বাতাভিয়া আমবন) তাদের আরও বেশি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। যেমন আমরা দেখতে পাই যে ১৬৪১ সাল থেকে ১৬৯১ সাল পর্যন্ত VOC তার দখলী দ্বীপগুলো বাদেও আশেপাশের আরো অনেক দ্বীপ দখল করে সেগুলোতেও সারা বছর ব্যাপী মসলা চাষ শুরু করে। এভাবে তারা মসলা চাষে একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু করে সারা বিশ্বে। VOC সিমবায়োসিসকে আরো প্রসারিত করেছিল ঠিক এই সময়ে এবং সিমবায়োটিক বন্ধনগুলোকে আরো শক্ত করে তুলেছিল। প্রথমদিককার সিম্বায়োটিক বন্ধন এভাবে শক্তিশালী করার মাধ্যমে VOC তার পরিপক্বতা (Ripeness) অর্জন করে। এই পরিপক্কতাই আবার একসময় গিয়ে অবজেক্টের জীবদ্দশার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। VOC যখন মসলার বাজারে দুনিয়াজুড়ে এক বিশাল আধিপত্য কায়েম করল, তার কিছুদিন পরেই মসলার বাজারে লাভ কমে আসতে শুরু করেছিল এবং অপরদিকে বিশ্ববাজারে কাপড় এবং চায়ের ব্যবসা খুবই লাভজনক হতে শুরু করেছিল।এছাড়া VOC বিভিন্ন জায়গায় সেটা জাপান, চীন, তাইওয়ান কিংবা ভারতের কলকাতা এবং অন্যান্য জায়গায় দখলদারির বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়া শুরু করেছিল। এভাবে ব্যর্থ হওয়া এবং শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়ায় তাদের দখলকৃত দ্বীপগুলোতে মসলা চাষে নিজেদেরকে অধিক যুক্ত করে ফেলাই VOC-এর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় যেটার মাধ্যমে VOC-এর বার্ধক্যের পর্যায় শুরু হয়েছিল বলে গ্রাহাম মনে করেন।


VOC যেহেতু শুধুমাত্র মসলার চাষ নিয়েই পড়ে ছিল ইন্দোনেশিয়াতে এবং মগ্ন ছিল সেটাতেই, তাই তখন ওই মুহূর্তে আসলে চা কিংবা কাপড়ের ব্যবসা করতে পারেনি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে চা এবং কাপড়ের ব্যবসা ততদিনে ফরাসী এবং ব্রিটিশ কলোনিগুলোর হাতে চলে গিয়েছিল। এভাবেই আম্বন কিংবা বাতাভিয়া আর আশেপাশের দ্বীপগুলোর সাথে সিমবায়োসিসের বন্ধনকে আরো জোরালো করার ফলে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অবজেক্ট হিসেবে বার্ধক্য চলে আসে। পরে ক্রমান্বয়ে আস্তে আস্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (VOC)।


এইযে শক্তিশালী বন্ধন অর্থাৎ VOC এর সাথে আমবন কিংবা বাতাভিয়ার সিমবায়োটিক বন্ধন যে অবজেক্টের দুর্বলতা ডেকে আনছে এই পর্যবেক্ষণটা কিন্তু গ্রাহামই প্রথম আমাদের সামনে হাজির করেননি। গ্রাহাম হারমান তাঁর এই যুক্তিটি ধার করেছেন সমাজতাত্ত্বিক গ্রানোভেটারের লেখালেখি থেকে। গ্রানোভেটার মনে করেন, যেকোন শক্তিশালী বন্ধন যখন একটা নির্দিষ্ট শক্তিশালী বন্ধনে আটকে যায়, তখন আশপাশ থেকে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্য যতরকম বন্ধনের সম্ভাবনা থাকতে পারত সেগুলোর সম্ভাবনা নাই হয়ে যাওয়া শুরু করে। যার জন্য যেকোন বন্ধনকে আপাত দুর্বল রাখাটা অবজেক্টকে শক্তিশালী রাখতে পারে বলে গ্রাহাম মনে করেন। গ্রানোভেটার এইটাকে বলেছিলেন “Strength of weak ties”। (দেখুন গ্রানোভেটার, ১৯৭৩)


অবজেক্টকে বোঝার জন্য OOO আরও একটা কাজ করে। সেটা হচ্ছে অবজেক্টের Relational জায়গাগুলোতে কম জোর দিয়ে non-relational জায়গাগুলো নিয়ে বেশি ভাবে। Object Oriented Ontology এটা করবেই, কারণ রিলেশনাল জায়গা থেকে কোন অবজেক্টকে বুঝতে চাইলে সেটা একরকম ওভারমাইনিং করা হয়ে যায় আর অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজি সবদিক থেকেই ওভারমাইনিং এর বিরোধী সেই প্রথম থেকেই। তাহলে non-relational বা ন-সম্পর্কীয় জায়গাগুলোকে Object Oriented Ontology কিভাবে দেখে? নন-রিলেশন বা ন-সম্পর্ক বলতে কি বোঝানো হচ্ছে?


VOC এর মাধ্যমে অবজেক্টের ন-সম্পর্কীয় জায়গার একটা উদাহরণ দেয়া যায়। VOC যখন ১৬৪১ এর মধ্যে মোটামুটি ইন্দোনেশিয়ার প্রায় সকল দ্বীপপুঞ্জ দখল করে অনেক বিশাল আকারের এনটিটিতে পরিণত হয়, তখন দেখা যাচ্ছিল VOC ইন্দোনেশিয়ায় একরকম স্থায়ীভাবে গেড়ে বসে এবং আমস্টারডামও যখন দেখল যে VOC কোম্পানি হিসেবে ভালোই করছে তখন আমস্টারডাম কোন রকম হস্তক্ষেপ না করেই VOC’কে একরকম নিজের মতোই চলতে দিতে থাকল। ফলে আমস্টারডামের নাক গলানো থেকে রেহাই পেয়েছিল এই কোম্পানিটি। এই রেহাই পাওয়ার আরেকটা কারণ হতে পারে, সেই সময়ে কোন যোগাযোগ প্রযুক্তি ছিল না যার মাধ্যমে খুব সহজে আমস্টারডাম থেকে ইন্দোনেশিয়ায় যোগাযোগ করা সম্ভব ছিলো। হয়তো আজকের দিনে VOC এর জন্ম হলে এমনটা হতো না, যেহেতু মোবাইল-ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন এই দূরত্ব খুব সহজেই নাই করে দেয়া যায়। জীবদ্দশায় আমস্টারডামের সাথে VOC এর এরকম একটা ন-সম্পর্কীয় জায়গা বা নন-রিলেশনাল জায়গা তৈরি হয়েছিল যেটাকে Object Oriented Ontology গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। হয়তো নন-রিলেশনাল জায়গা তৈরি না হলে অবজেক্ট হিসেবে VOC তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারতো না এবং দ্রুত নিজেকে এতগুলো সিমবায়োসিসের মাধ্যমে প্রকাশও করতে পারত না।


এভাবে গ্রাহাম তাঁর ইম্ম্যাটেরিয়ালিজম (২০১৬) বইয়ে অবজেক্টের জীবদ্দশার সিমবায়োসিসগুলোকে চিহ্নিত করতে করতে ‘Object’ নিয়ে কথা বলার আরও কিছু উপায়ের কথা বলেছেন। এগুলো নিয়ে আরো জানার জন্য ইম্ম্যাটেরিয়ালিজম (২০১৬) বইটার সাথে আরও কিছু বই একসাথে মিলিয়ে পড়া যেতে পারে ।


এখানে এর পাশাপাশি যেটা আরো বলে রাখতে চাই সেটা হচ্ছে গ্রাহামদের Object Oriented Ontology ইতোমধ্যেই দর্শনের বিভিন্ন চিন্তা স্কুলগুলোর সাথে নানারকম সংলাপ শুরু করে দিয়েছে(সংলাপ মানে কিন্তু বিবাদ নয়)। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্লাভো জিজেকের সাথে গ্রাহাম হারমানের সংলাপ। এই সংলাপ বাদেও সাইকোঅ্যানালিটিক স্কুলে আলেনকা যুপানশিক, ম্লাদেন দলার আর স্লাভো জিজেকদের যে জনপ্রিয় কার্নেল আছে তারাও মোটামুটি ‘অফিসিয়ালি’ Speculative Realism এর সাথে তাঁদের ভিন্নতার জায়গা গুলো তুলে ধরতে শুরু করেছেন। তবুও দেখা যায় অনেক জায়গাতেই তাঁরা দুইটা দলই আবার একমত পোষণ করেছেন, যেহেতু Object Oriented Ontology এবং Alenka-Mladen-Zizek এর সাইকোঅ্যানালিটিক কার্নেল উভয়ই পোস্টমডার্নিজম থেকে একরকম প্রাণপণে সরে আসতে চাচ্ছেন।

____________


প্রথম প্রকাশঃ ৮ই জানুয়ারি, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৮ই জানুয়ারি, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/3275826305879437/