ক্রাইসিস এজ ফ্রিডম: আল্লামা ইকবাল ও ওয়াল্টার বেঞ্জামিন
আসাদ ডানডিয়া
[কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসাদ ডানডিয়া'র Crisis as Freedom: Muhammad Iqbal and Walter Benjamin লেখাটি গত ২৪শে জানুয়ারিতে LOS ANGELES REVIEW OF BOOKS (LARB) ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। আসাদ ডানডিয়ার এই লেখাটি অনুবাদ করেছেন সহুল আহমদ। সহুল আহমদ রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের সহ-সম্পাদক। এই অনুবাদে, আল্লামা ইকবালের উদ্ধৃতিগুলোর ক্ষেত্রে ‘ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ এর বাংলা অনূদিত [প্রথমা থেকে প্রকাশিত] গ্রন্থ থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে। কখনো কখনো বাক্যগুলো হুবহু এই গ্রন্থ থেকেই তুলে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের থিসিসগুলো অনুবাদে পারভেজ আলমের লেখাপত্রের সাহায্য নেয়া হয়েছে। অনুবাদক ও বোধিচিত্ত ইকবালের গ্রন্থটির অনুবাদক ও পারভেজ আলমের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে।]
বিদ্যমান অতিমারীর মধ্যে আমরা যখন শীতের মৌসুমে প্রবেশ করছি তখন মনে হচ্ছে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এই সঙ্কটের বুঝি আর কোন শেষ নেই। কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামী মানুষদের কাঠামোগত অধীনতা, যা কারাগারপ্রথা-বিলোপবাদী রুথ উইলসন গিলমোরের জবানে ‘গোষ্ঠী-ভেদী অকালমৃত্যুর ঝুঁকির রাষ্ট্র-অনুমোদিত বা আইনবহির্ভূত উৎপাদন ও শোষণ’, একেবারে উলঙ্গ হালতে সবার সামনে হাজির হয়েছে। অবশ্য, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন একদা লিখেছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসীসহ অন্যান্য নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য ”যে ‘জরুরি অবস্থায়’ বসবাস করা হচ্ছে তা ব্যতিক্রম নয় বরঞ্চ এটাই নিয়ম”। এই সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তুলতে রাজনৈতিক শ্রেণি এবং অভিজাত বিদ্বৎসমাজ একই নব্য-উদারনৈতিক বা নিওলিবারেল, বাজার-ভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাব করে যাচ্ছেন যা কিনা গোড়াতে এই পরিস্থিতিরই জন্ম দিয়েছিল। আন্তোনীয় গ্রামসির বিরতি (interregnum) ধারণার মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক মুহূর্তটি দূর্দান্তরূপে ধরা পড়ে: “সঙ্কটটি আদতে এই বাস্তবতার মধ্যেই নিহিত যে পুরাতনটি মারা পড়ছে এবং নতুনের জন্ম হচ্ছে না; এই বিরতিতেই অজস্র পরিমাণে অসুস্থ আলামত দেখা দেয়।“
কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় দুনিয়াজুড়ে যে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ দেখা গিয়েছে তা থেকে যদি কিছু শিখতেই হয় তাহলে সেটা হচ্ছে একটি নতুন সামাজিক বিন্যাসের (order) সম্ভাবনা, এবং এরই সাথে এই বিরতি থেকে মুক্তি পাওয়ার নতুন উপায় ঠাহর করা। বিলোপ (abolition বা তিরোহিত) গৃহস্থালি শব্দে পরিণত হয়েছে; জনগণ প্রশ্ন করছে কম্যুনিটির সুরক্ষার জন্য পুলিশিং ও কারাগারের আদৌ কোনো জরুরত আছে কিনা; এমনকি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতি-রাষ্ট্র তার কার্য সম্পাদন করে ফেলেছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন করছে। এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসার অর্থ হলো, যে পরিস্থিতি অর্থনৈতিক পতন, পরিবেশ বিপর্যয় এবং ডানপন্থী ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঘটিয়েছে—যা কিনা অতিমারীর কারণে আরো খারাপের দিকে গিয়েছে, সে পরিস্থিতিকে প্রত্যাখ্যান করা। টনি মরিসনের ভাষায়, “এটাই শিল্পীদের কাজ করার প্রকৃত সময়। এখন হতাশার সময় নয়, এখানে আত্ম-করুণার স্থান নেই, নীরবতার দরকার নেই, ভয়ের কোন জায়গা নেই। আমরা কথা বলবো, আমরা লিখবো, আমরা ভাষাকে কাজে লাগাবো। এভাবেই সভ্যতা আরোগ্য লাভ করে।“
অনেকের কাছে, কোয়ারেন্টিনের স্থিরতা এবং এর পরিণামে সময়ের শূন্যতা (emptiness of time) এই সঙ্কটকে আরো জটিল করে তুলছে। সময়ের যে সেক্যুলার ও রৈখিক ধারণার সাথে আমরা পরিচিত তাতে বৈশ্বিক মাত্রায় ছেদ পড়েছে, স্বাভাবিকতা ও বিন্যাসের সকল ভান উলট-পালট হয়ে গিয়েছে। আমরা ‘স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে’ যেতে পারবো কিনা সেই জিজ্ঞাসার পরিবর্তে (যেহেতু পারবো না) আমাদের সঙ্কটগুলোর মধ্যেই সময়ের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার নতুন উপায় প্রবর্তন করার অর্থ কী হতে পারে তা নিয়ে আলাপ করতে চাই। যদি ‘স্বাভাবিক’ই আমাদের এই সঙ্কট নিয়ে আসার কারণ হয় তাহলে আমাদের উচিৎ হবে এই স্বাভাবিকতার পূর্বানুমান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা। সেইসাথে, এই খপ্পর থেকে নিজেদের মুক্ত করে কীভাবে ধারণা ও ভাষা তৈরি করা যায় সে সম্পর্কে আরো উচ্চাভিলাষী চিন্তা করা। সময়ের মধ্যে সঙ্কট, সময় ও সঙ্কট, সময়ের সঙ্কট এবং সময় হিসাবে সঙ্কট ধারণাগুলো দিয়ে আমরা কী বুঝবো? আরো জরুরি বিষয় হচ্ছে, যে জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছি তাকে উল্টো আরো জোরদার করবে না এমন একটা উপায়ে আমরা কীভাবে কাজ করতে পারি?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে আমি বিশ শতকের ইহুদি দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের কাছে ফিরে যাবো, তাঁর সাথে তাঁর সময়েরই মুসলিম দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের একটা আলাপচারিতা ঘটাবো। সময়ের এই ঘের থেকে বাঁচার জন্য বেঞ্জামিনের প্রবন্ধ ‘থিসিস অন দ্যা ফিলোসফি অব হিস্ট্রি’ (১৯৪০, প্রকাশিত ১৯৪২) এবং আল্লামা ইকবালের ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন (১৯৩০) গ্রন্থের মধ্যে দুর্দান্ত মিল লক্ষ্য করা যায়। দুই লেখকই তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকে উক্ত বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এমনভাবে করছেন যেন আমাদের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক কল্পনা কর্তৃক চাপানো সেই জ্ঞানতাত্ত্বিক ও ডিসিপ্লিনারি বা শাস্ত্রীয় সীমাবদ্ধতাগুলোকে (যেমন, ধর্মীয় বনাম সেকুলার) খারিজ করে দেয়া যায়। একটি অতিমারী সঙ্কট যেখানে আমাদের চিন্তাকে আবদ্ধ করে ফেলেছে সেখানে সময় ও ইতিহাসের ধারণাগুলোকে পুনর্পাঠ করতে এই দুজনের কাজ থেকে আমরা কী কী উপাদান গ্রহণ করতে পারি?