ঔপনিবেশিকতা এবং আধুনিকতা/যুক্তিবাদিতা

আনিবাল কিহানো



[লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুর সমাজতাত্ত্বিক ও চিন্তক আনিবাল কিহানো(Anibal Quijano)। বিউপনিবেশায়ন ও ক্রিটিক্যাল তত্ত্বচিন্তার দুনিয়ায় তাঁর কাজের বিস্তৃত প্রভাব রয়েছে। লাতিন আমেরিকার আরেক প্রখ্যাত আর্জেন্টাইন চিন্তক ওয়াল্টার মিনোলো(Walter Mignolo), যিনি "লাতিন আমেরিকার সাবঅল্টার্ন স্কুল"-এর অন্যতম তাত্ত্বিক, তাঁর কাজের সূত্রে আমরা আনিবাল কিহানোর সাথে পরিচিত হই। মিনোলো'র The Darker Side Of Western Modernity(২০১১) গ্রন্থের একেবারে শুরুর দিকেই আনিবাল কিহানো'র এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের খোঁজ দিচ্ছেন। মিনোলো যখন বোগোটা'য় গিয়েছিলেন, তখন তিনি সদ্য প্রকাশিত Los Conquistados: 1942 y La Poblacion Indígena de Las Américas (edited by Heraclio Bonilla,১৯৯২) বইটা খুঁজে পান। এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে তাঁর চোখ আটকে যায়। এটা ছিল আনিবাল কিহানো'র লেখা, যার কথা তিনি আগেও শুনেছিলেন কিন্তু তাঁর বা তাঁর লেখাজোখার সাথে পরিচয় ছিলনা। এই প্রবন্ধটি পরবর্তীতে Cultural Studies জার্নালেও প্রকাশিত হয়, শিরোনাম ছিল Coloniality and Modernity/Rationality। পরবর্তীতে মিনোলো, কিহানোর প্রবন্ধের ঔপনিবেশিকতা(Coloniality) ধারণায় মনোযোগী হন এবং তাঁর পরের দুটি গ্রন্থের কেন্দ্রীয় কনসেপ্ট বা প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কালাচারাল স্টাডিজ জার্নালে প্রকাশিত সোনিয়া থেরবন কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে আনিবাল কিহানো'র এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তানহা তাহসিন]




আজকের দুনিয়ায় লাতিন আমেরিকা নামে পরিচিত অঞ্চলে যেসব সমাজ-ও-সংস্কৃতি বিরাজ করে, সেসব পরিমণ্ডলে কর্তৃত্ব স্থাপনের মধ্যদিয়ে এক নতুন বিশ্ব-কাঠামোর পরিগঠন শুরু হয়েছিল, যেটি কি-না পাঁচশত বছর পরে এসে শেষমেষ পুরো পৃথিবী পরিব্যাপ্ত এক বৈশ্বিক ক্ষমতা রূপে হাজির হয়েছে। এই প্রক্রিয়া গুটিকয়েক ইউরোপীয় সংখ্যালঘু—এবং সবচেয়ে বড় কথা, এর শাসক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে এবং তাদের আয়েশের খাতিরে পুরো বিশ্বের সম্পদরাজির সহিংস পুঞ্জিভবনের(accumulation) দিকে ইঙ্গিত দেয়। যদিও অধীনস্তদের বিদ্রোহের মুখে কখনো-সখনো তা ভদ্র বেশ ধরেছে, তবুও এই প্রক্রিয়া এখন অব্দি জারি আছে। কিন্তু বর্তমানে চলমান সংকটকালে নতুন এক উদ্দীপনায় এই ধরনের পুঞ্জিভবনকে অবলম্বন করা হচ্ছে—এমনকি এমন এক পন্থায় বৈশ্বিক পর্যায়ে ঘটছে যা হয়তো আরও সহিংস এবং বেশ বৃহদাকারের। এখনও যার মূল সুবিধাভোগী ‘পশ্চিমা’ ইউরোপীয় শাসকগণ এবং তাদের ইউরো-উত্তর আমেরিকান পূর্বসুরীরা। সেই দলে আরও আছে বিশ্বের অ-ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো যারা কি-না কখনোই ইউরোপীয় উপনিবেশ হয়নি—প্রধানত জাপান—এবং যুক্ত আছে মূলত তাদের শাসক শ্রেণিগুলো। লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার নিপীড়িত ও শাসিত মানুষেরাই এসব যাগযজ্ঞের প্রধান বলি।



ইউরোপীয়রা সব মহাদেশেই দখলকৃত অঞ্চলের উপর একধরনের প্রত্যক্ষ, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। কিন্তু এই কর্তৃত্বকে স্থূলদৃষ্টিতে শুধুমাত্র ইউরোপকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। সবরকমের প্রাতিষ্ঠানিক এবং আলোচিত-সমালোচিত দিকগুলো বাদ দিয়ে দিয়ে আলাপ করলে, ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব তার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছে। এই পরাজয়ের প্রথম ঘটনা ছিল আমেরিকা এবং পরবর্তীতে—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে—এশিয়া এবং আফ্রিকা। ফলস্বরূপ, পশ্চিমা ইউরোপীয় সমাজগুলো কর্তৃক অন্যান্য সমাজগুলোর উপর রাজনৈতিক খবরদারির চিরাচরিত পদ্ধতির অর্থে এই ইউরোপকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদকে অতীতের বিষয় বলে মনে হয়। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার থেকে, বরং —উপনিবেশবাদের উত্তরসূরী— পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে অসমভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী দেশের আধিপত্যশীল গোষ্ঠীদের (‘সামাজিক শ্রেণিগুলো’ এবং/অথবা ‘জাতিসত্তাগুলো’) মধ্যে সামাজিক স্বার্থের এক মেলবন্ধন।



তাছাড়া, ঐ বিশেষ ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকাঠামো বিশেষ সামাজিক বৈষম্য উৎপাদন করেছে। এগুলোকে পরবর্তীতে কাল, প্রতিনিধি এবং জনসাধারণের সম্পৃক্ততার নিরিখে ‘গোষ্ঠীগত’, ‘জাতিগত’, ‘নৃতাত্ত্বিক’ কিংবা ‘জাতীয়’ ইত্যাদি রঙচঙে ট্যাগ দিয়ে নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। এমনকি ইউরোপকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের ফসল এসব আন্তঃবিষয়ী (intersubjective) নির্মাণকে কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব না দিয়ে, বরং ‘নিরপেক্ষ’, ‘বৈজ্ঞানিক’ বর্গতে ফেলা হতো। স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই এটা ক্ষমতার ইতিহাসের দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে না। এই ক্ষমতা কাঠামো হচ্ছে সেই পাটাতন, যার উপর ভর করে শ্রেণি অথবা অঞ্চলগুলোর অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কগুলো পরিচালিত হতো এবং এখনও হয়।



প্রকৃত অর্থে, আমেরিকার দখলের পর থেকে বৈশ্বিক নিরিখে শোষণ ও সামাজিক কর্তৃত্বের প্রধান প্রধান তরিকার দিকে তাকালে, সেইসাথে বর্তমান বিশ্ব-ক্ষমতার কাঠামো এবং পৃথিবীর জনগণের মধ্যে সম্পদরাজি ও শ্রমের বন্টনের দিকে একটু গভীর মনোযোগ দিলে এটি স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, শোষণ, কর্তৃত্ব ও বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরা একেবারে কাটায়-কাটায় সেসব ‘জাত’, ‘নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী’ অথবা ‘নেশনে’র অন্তর্ভুক্ত যেখানে উপনিবেশিত জনসংখ্যাকে ঐ বিশ্ব-ক্ষমতার নির্মাণ প্রক্রিয়ার বিভক্ত করা হয়েছিল।



একইভাবে, রাজনৈতিক উপনিবেশবাদ সরে গেলেও ইউরোপীয় (একে ‘পশ্চিমা’ও বলা যায়) সংস্কৃতির সাথে অন্যান্য সংস্কৃতির সম্পর্কে এখনও উপনিবেশিক আধিপত্যের বিষয়টি বিরাজ করে। এটি কেবল বাহ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের কাছে অন্যান্য সংস্কৃতির অধীস্থনতার বিষয় নয়; তীব্রতা ও গভীরতার ভিন্নতা সত্ত্বেও অন্যান্যের সংস্কৃতির উপনিবেশায়নকেও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। বাহ্যিক সম্পর্কের দিক থেকে দেখলে, এটা কেবল ইউরোপীয় সংস্কৃতির আরশের নিচে ‘অপর’দের সংস্কৃতির অধীনতার বিষয় নয়; আমাদের আলাপ-আলোচনায় অন্যান্য সংস্কৃতির উপনিবেশের ব্যাপারটাও জায়গা দিতে হবে। আর সেটা মাত্রা এবং গভীরতার নিরিখে পার্থক্য স্থাপনের মাধ্যমেই করতে হবে। এই সম্পর্ক প্রথমেই অধীনস্তদের কল্পনা-জগতে উপনিবেশায়নের ভিত-স্থাপন করে। এক অর্থে, সেই কল্পনা-জগতের জমিনে বীজ বোনে, যা কি-না আবার সেই জগতের-ই একটা অংশ।



গোড়াতে উপনিবেশবাদ একটি পদ্ধতিগত নিপীড়নের ফসল ছিল। কেবল সেইসব কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস, চিন্তা, চিত্রকল্প, প্রতীক বা জ্ঞানকাণ্ড ছাড়া যেগুলো কিনা বৈশ্বিক উপনিবেশিক আধিপত্যের জন্য দরকারি ছিল না। অন্যদিকে একইসাথে উপনিবেশকরা উপনিবেশিতদের কাছ থেকে তাদের জ্ঞানকাণ্ড, বিশেষত খনিবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যাসহ তাদের পণ্য ও কাজ সব কেড়ে নিয়েছিল। সর্বোপরি এই নিপীড়ন ছিল জ্ঞান, জ্ঞান উৎপাদন, দৃষ্টিভঙ্গির উৎপাদনের ধরণ, চিত্রকল্প ও চিত্রকল্পের ব্যবস্থা, প্রতীক, অর্থের প্রণালীর (modes of signification) উপর; ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ও objectivised (চিন্তার বিষয়ে পর্যবসিত) অভিব্যক্তির উপাদান, ছাঁচ এবং হাতিয়ারের উপর—হোক সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা ভিজ্যুয়াল। এরপরই আরোপ করা হয় শাসকদের অভিব্যক্তির নিজস্ব ধরন এবং অতিপ্রাকৃত সম্পর্কিত তাদের বিশ্বাস ও চিত্রকল্প। এই বিশ্বাস ও চিত্রকল্পগুলো কেবল অধীনস্থদের সাংস্কৃতিক উৎপাদনকেই ব্যাহত করে না। বরঞ্চ যখন তাৎক্ষণিক নিপীড়ন স্থায়ী ও পদ্ধতিগত রূপ নেয়, তখন এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণের খুবই কার্যকরী হাতিয়ার।



উপনিবেশক প্রভুরা জ্ঞান ও অর্থ উৎপাদনের নিজস্ব আদর্শ বা রীতিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রক্রিয়াও চাপিয়ে দিয়েছিল৷ প্রথমত, উপনিবেশিকরা জ্ঞান উৎপাদনের এই আদর্শ বা রীতিগুলোকে অধীনস্থদের হাতের নাগালের বাইরে রেখেছিলো। পরবর্তীতে, তাদের জ্ঞানশিক্ষা দেওয়া হয়েছিলো আংশিক ও নির্দিষ্ট পথে, যাতে করে অধীনস্থদের মধ্য থেকে কিছু লোককে তারা নিজেদের ক্ষমতাচর্চার প্রতিষ্ঠানের জন্য বেছে নিতে পারে। তারপর ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে প্রলুধ্বকর বা লোভনীয় করে তোলা হয়েছিল: এটি ক্ষমতায় প্রবেশের রাস্তা তৈরি করে দিতো। সর্বোপরি, দমনপীড়নের বাইরেও, সমস্ত ক্ষমতার প্রধান হাতিয়ার হলো এই প্রলোভন। সাংস্কৃতিক ইউরোপীয়করণ একটি আকাঙ্ক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছিল। এটি অংশগ্রহণের একটি মাধ্যম ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ইউরোপীয়দের মতো সমান বস্তুগত সুবিধা আদায় এবং ক্ষমতায় পৌঁছানোর একটি মাধ্যম হয়ে উঠে: যেমন, ‘উন্নয়ন’-এর নামে প্রকৃতিকে জয় করা। ইউরোপীয় সংস্কৃতি হয়ে উঠে সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আদর্শ। অ-ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে এই কল্পজগৎ আজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সর্বোপরি এই সম্পর্কগুলোর বাইরে এটি নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে পারে৷



সময় আর অবস্থাভেদে সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতার আকার ও প্রভাব ভিন্ন হয়ে থাকে। লাতিন আমেরিকায় সাংস্কৃতিক দমনপীড়ন এবং কল্পজগতের উপনিবেশায়ন ঘটেছিল নেটিভ বা স্থানীয়দের নির্মূলীকরণের মাধ্যমে। বিশেষত খরচাযোগ্য শ্রমশক্তি হিসেবে, দখলের সহিংসতা এবং ইউরোপীয়দের নিয়ে আসা রোগ-বালাই ব্যবহার করে এই স্থানীয় অধিবাসীদের নির্মূল করা হয়েছিল। [এরূপ উদাহরণ জোসেফ কনরাডের হার্ট অফ ডার্কনেস-এ পাওয়া যায়—অনুবাদক] অ্যাজটেক-মায়া-ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে এবং তাওয়ান্তিসুয়ানা (বা ইনকা) অঞ্চলগুলোতে, প্রায় ৬ কোটি ৫০ লক্ষ অধিবাসীকে পঞ্চাশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নির্মূল করা হয়েছিল। এই নির্মূলের মাত্রা এত বিশাল ছিল যে এতে কেবল জনসংখ্যা বিপর্যয় জড়িত ছিল না, সেইসাথে সমাজ ও সংস্কৃতির বিনাশও জড়িত ছিল। সাংস্কৃতিক দমন এবং ব্যাপক গণহত্যা একিসাথে আমেরিকার পূর্ববর্তী উচ্চ সংস্কৃতিগুলোকে মৌখিকতার ভিত্তিতে নিন্দা করে অশিক্ষিত, কৃষক উপসংস্কৃতিতে পরিণত/অবনমিত করেছিল। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিক, বিষয়ীকৃত (objectivised), বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মূর্তিগ্রাহী(plastic) বা দৃশ্যগত অভিব্যক্তির (expression, প্রকাশ) নিজস্ব আদর্শ বা রীতি বা ধরন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। অতঃপর, যারা বেঁচে যাবেন তাদের শাসকশ্রেণির আরোপিত সাংস্কৃতিক আদর্শ ব্যতীত কোন বুদ্ধিবৃত্তিক, বা মূর্তিগ্রাহী বা দৃশ্যগত(visual) অভিব্যক্তির, আনুষ্ঠানিক এবং বস্তুনিষ্ঠ অভিব্যক্তির অন্য উপায় থাকবে না; এমনকি কিছু ক্ষেত্রে অভিব্যক্তির অন্যান্য জরুরত মেটানোর জন্য এদেরকে পরাভূত করতে হলেও। নিঃসন্দেহে লাতিন আমেরিকা ইউরোপের সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নের সবচেয়ে চরমতম ঘটনা।



এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে উচ্চতর সংস্কৃতিগুলোকে এরূপ তীব্রতা এবং গভীরতার সাথে ধ্বংস করা যায়নি। তৎসত্ত্বেও এগুলোকে কেবল ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেই নীচু অবস্থানেই রাখা হয়নি, বরঞ্চ নিজস্ব বাহকদের(bearers) দৃষ্টিতেও এগুলোকে নিচে রাখা হয়েছিল। ইউরোপীয় বা পশ্চিমা সংস্কৃতি তার অগ্রবর্তী সমাজগুলোর রাজনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত শক্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক চিত্র উপস্থাপন করেছিল এবং প্রধান জ্ঞানভিত্তিক উপাদানগুলোকে (বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শৈল্পিকতার ক্ষেত্রে) সমস্ত সাংস্কৃতিক বিকাশের এবং দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শ হিসেবে আরোপ করেছিল। এই সম্পর্ক সেই সকল সমাজ এবং সংস্কৃতির পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করেছিল, যাদের সমস্ত কিছু বা কিছু অংশকে ইউরোপীয়করণের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল।



আফ্রিকাতে সংস্কৃতির বিনাশের মাত্রা অবশ্যই এশিয়া থেকে অনেক বেশি তীব্র ছিল, তবে আমেরিকার থেকে কম ছিল। ইউরোপীয়রা প্রকাশ বা অভিব্যক্তির ধরনগুলোর, বিশেষত objectification এবং visual formalization-এর সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটাতে সফল হয়নি। ইউরোপীয়রা আসলে যা করেছিল তা হচ্ছে ইউরোপীয় আদর্শে পরিচালিত বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় আফ্রিকার অধিবাসীদের বৈধতা এবং স্বীকৃতি প্রদান থেকে বঞ্চিত করেছিল। তাদেরকে ’উদ্ভট’ (exotic) বর্গে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। এটাকে ইউরোপীয় রীতিনীতির সমতুল্য তাদের নিজস্ব শৈল্পিক অভিব্যক্তির পন্থা হিসেবে তুলে ধরা হয় না। এটাই আসলে উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি।



ঔপনিবেশিকতা এখনও বিশ্বে কর্তৃত্বের সবচেয়ে সাধারণ রূপ, একসময় যা প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্পষ্টতই, এটি মানুষে মানুষে শোষণ ও কর্তৃত্বের পদ্ধতিগুলো বা শর্তগুলোকে নিঃশেষ করে দেয়নি। কিন্তু গত ৫০০ বছর ধরে এর মূল কাঠামোটি বাতিল হয়ে যায়নি। পূর্ববর্তী সময়ের উপনিবেশিক সম্পর্ক সম্ভবত একই ধরণের পরিণতি নিয়ে আসেনি এবং সর্বোপরি তারা কোনো বৈশ্বিক ক্ষমতার ভিত্তি ছিল না।