এনলাইটেনমেন্ট কী বস্তু?
ইমানুয়েল কান্ট
[প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত Beantwortung der Frage: Was ist Aufklärung? নিবন্ধটি মূলত Berlinische Monatsschrift (মাসিক বার্লিন) পত্রিকায় তৎকালীন প্রুশিয়া সরকারের এক কর্মকর্তার ছুড়ে দেয়া এই প্রশ্নের জবাবে লিখিত হয়েছিল। তৎকালে অনেক বিদ্বৎজন-ই এই প্রশ্নের সুরাহা করতে কোশেশ করেছেন। তুমুলভাবে আলোচিত ও সমালোচিত কান্টের এই "Answering the Question: What Is Enlightenment?" নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন তাহমিদ আলম ফিহাদ। ফিহাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী।]
এনলাইটেনমেন্ট(Enlightenment) হচ্ছে স্ব-আরোপিত অভিভাবকত্ব থেকে মানুষের মুক্তি। অভিভাবকত্ব হচ্ছে অন্যের দিকনির্দেশনা ছাড়া নিজের বোধশক্তি ব্যবহারের অক্ষমতা। এই অভিভাবকত্বে মানুষ স্বেচ্ছায়-আবদ্ধ হয় যখন এর কারণ যুক্তির অভাবে নিহিত থাকে না, বরং অন্যের দিক-নির্দেশনা ছাড়া তা ব্যবহারের সংকল্প এবং সাহস না থাকা এর কারণ হয়। জানার সাহস করো! (Sapare aude) “নিজের যুক্তি ব্যবহারের সাহস রাখো!”—এটাই হচ্ছে এনলাইটেনমেন্টের মূলমন্ত্র।
প্রকৃতি মানুষকে বাহ্যিক পরিচালনা(naturaliter maiorennes) থেকে মুক্ত করার অনেক সময় পরেও কেন মানবজাতির এত বড় একটা অংশ সারাজীবন অভিভাবত্বের অধীনে থাকে এবং কেন অন্যরা নিজেদেরকে এদের অভিভাবকরূপে নিযুক্ত করতে পারে, তার কারণ হচ্ছে অলসতা এবং ভীরুতা। পরিপক্ব না হওয়াটা অনেক সহজ। আমার যদি একটা বই থাকে যা আমার হয়ে বুঝে নেয়, একজন যাজকের আমার হয়ে যার বিবেক থাকে, একজন চিকিৎসক থাকে যে আমার আহার নির্ধারণ করে, তাহলে আমার চিন্তার কিছু থাকে না। আমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই, আমি যদি বেতন দিতে পারি—খুব সহজেই আমার হয়ে অন্যেরা বিরক্তিকর কাজগুলো করবে।
মানবজাতির (এবং সকল লিঙ্গের কাছে) বৃহৎ অংশটি যেন সক্ষমতার দিকে কদম উঠানোকে খুবই বিপদজনক মনে করে—যা এর শ্রমসাধ্য হওয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন—সেদিকে এই অভিভাবকরা লক্ষ্য রাখে, যারা দয়া করে আমাদের তদারকি গ্রহণ করেছে। এই অভিভাবকরা তাদের গবাদি পশুদের মূর্খ বানানোর পর এবং এই শান্ত পশুগুলো তাদের বহরের লাগাম(harness of the cart) ছাড়া একটি পদক্ষেপ নেয়ার সাহসও যেন না পায় তা নিশ্চিত করার পর, একা চলতে চেষ্টা করার যে বিপদ, তাদের সেই বিপদের ভয় দেখায়। তবে সত্যিকার অর্থে এই বিপদ এত বড় নয়, কারণ কয়েকবার পড়ার পর অবশেষে তারা নিজে নিজে হাঁটতে শিখবে। কিন্তু এই ব্যর্থতার একটা উদাহরণ তাদের ভীত করে তোলে এবং সচরাচর পরবর্তী সকল পরীক্ষা থেকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।
অভিভাবকের অধীনে থাকা যে জীবন (যা বলতে গেলে প্রায় তার স্বভাব হয়ে গেছে) তার থেকে নিজে নিজে বের হয়ে আসা যেকোন মানুষের একার পক্ষে খুবই কঠিন। নিজের এই অবস্থা তার প্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বর্তমানে সে সত্যিই নিজের যুক্তি ব্যবহারে অক্ষম, কারণ কেউ কখনো তাকে সেই চেষ্টা করতে দেয়নি। নিয়ম এবং সূত্র, যা তার প্রাকৃতিক প্রতিভার ব্যবহার বা বলা যায় ভুল ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত যান্ত্রিক সরঞ্জাম, হচ্ছে চিরস্থায়ী অভিভাবকত্বের শিকল। যে-ই এগুলো ছুড়ে ফেলে, সে সবচেয়ে সংকীর্ণ নালার উপর দিয়ে শুধু একটি অনিশ্চিত ধাপ নেয়, কেননা সে এই ধরনের মুক্ত গতির সাথে পরিচিত নয়। যে কারণে, খুব কম সংখ্যকই নিজের চিন্তার অনুশীলন দ্বারা একই সাথে নিজের অক্ষমতা দূর করা এবং স্থির গতি, এই দুটি অর্জন করতে পেরেছে।
কিন্তু এটা আরও বেশি সম্ভব যে জনগণ নিজেদের আলোকিত করবেঃ সত্য সত্যই, শুধুমাত্র যদি স্বাধীনতা প্রদান করা হয়, এনলাইটেনমেন্টও যে তা অনুসরণ করবে সেটা প্রায় নিশ্চিত। কারণ জনগণের প্রতিষ্ঠিত অভিভাবকদের মধ্যেও সবসময় স্বাধীন চিন্তার অধিকারী কেউ না কেউ থাকবে, যে নিজের কাঁধ থেকে অভিভাবকদের জোয়াল ছুড়ে ফেলার পর নিজেদের মূল্য এবং প্রতিটি মানুষের নিজের জন্য চিন্তা করার বৃত্তি, এই উভয়ের যৌক্তিক উপলব্ধির চেতনা প্রচার করবে। কিন্তু এটা বলা থাকুক যে, যে জনগণকে তাদের অভিভাবকরা প্রথমে জোয়াল পড়িয়েছে, সে জনগণই তাদের বাধ্য করে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে যখন কিছু অভিভাবক, যারা নিজেরা এনলাইটেনমেন্ট অর্জনে সক্ষম, জনগণকে মুক্ত চিন্তায় উদ্দীপিত করার চেষ্টা করে—কুসংস্কার রোপন করাটা এতই ভয়াবহ, কেননা তারা পরবর্তীতে সেই রোপনকারী বা তার বংশধরদের উপর প্রতিশোধ নেয়। যে কারণে জনগণ শুধুমাত্র ধীরে ধীরে এনলাইটেনমেন্ট অর্জন করতে পারে। বিপ্লবের মাধ্যমে হয়তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র, লালস বা নৃশংস নিপীড়নের পতন সম্ভব, কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে সত্যিকারের সংস্কার সম্ভব নয়। অধিকতর, নতুন কুসংস্কার পুরাতনগুলোর জায়গায় কাজ করে, চিন্তাশক্তিহীন এই বিপুল জনগণকে বশে রাখার জন্য।
তবে এই এনলাইটেনমেন্টের জন্য স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই প্রয়োজন নেই এবং প্রকৃতই এই শব্দটি যে সকল বস্তুর ক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রযোজ্য, তার মধ্যে স্বাধীনতাই সবচাইতে নিরীহ। এটা হচ্ছে সকল ক্ষেত্রে একজন মানুষের যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার। কিন্তু আমি সব দিকেই শুনি, “তর্ক করো না!” অফিসার বলেনঃ “তর্ক না করে অনুশীলন করো!” কর সংগ্রাহক বলেন, “তর্ক না করে কর দাও!” পাদ্রি বলেন, “তর্ক না করে বিশ্বাস করো!” শুধুমাত্র একজন রাজপুত্র [দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ] আছেন পৃথিবীতে যিনি বলেন, “যত ইচ্ছা তর্ক করো, এবং তোমার যা খুশি তা নিয়ে করো, কিন্তু মেনে চলো!” সব জায়গায় স্বাধীনতার উপর বাধা-নিষেধ।
কোন বিধিনিষেধটি এনলাইটেনমেন্টের জন্য একটি বাধা এবং কোনটি বাধা নয় বরং এর সহায়ক? একজন ব্যক্তির যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার সব সময় মুক্ত থাকা উচিত, এবং শুধু এটাই মানুষের মধ্যে এনলাইটেনমেন্ট আনতে পারে। অন্যদিকে যুক্তির ব্যক্তিগত [পরিসরের] ব্যবহার(private use) প্রায়শই খুব সংকীর্ণভাবে সীমাবদ্ধ হতে পারে, এনলাইটেনমেন্টের অগ্রসরকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা ছাড়াই। কারো যুক্তির প্রকাশ্য [বা জনপরিসরের] ব্যবহার বলতে আমি বুঝি একজন মানুষ পন্ডিত(scholar) হিসেবে পাঠক জনসাধারণের সামনে যুক্তির যে ধরনের ব্যবহার করে। ব্যক্তিগত ব্যবহার আমি সেটাকে বলি যা একজন মানুষ কোন নির্দিষ্ট বেসামরিক পদে বা কোন কার্যালয়ে ব্যবহার করে, যা তাঁর উপর ন্যস্ত হয়েছে। অনেক বিষয়ই যা সমাজের স্বার্থের জন্য করা হয়, তার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রয়োজন যার মাধ্যমে সমাজের কিছু সদস্য কৃত্রিম সর্বসম্মতিক্রমে পরোক্ষভাবে তা করে, যেন সরকার সেগুলোকে জনস্বার্থে পরিচালিত করতে পারে বা সেই স্বার্থগুলো ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। এখানে বিতর্ক অবশ্যই প্রযোজ্য নয়—আদেশ মেনে নিতে হবে। কিন্তু এই পদ্ধতির অংশ হয়েও যদি সে নিজেকে একই সাথে সম্পূর্ণ সম্প্রদায় বা বিশ্ব নাগরিকদের সমাজের অংশ মনে করে, এবং একজন পন্ডিতের ভূমিকায় জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে লিখে, সে অবশ্যই সে সকল বিষয়—যেসব বিষয়ে সে পরোক্ষ সদস্য হিসেবে আংশিক দায়িত্বশীল, সেগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করা ছাড়াই বিতর্ক করতে পারবে। এইভাবে দায়িত্বে থাকা একজন অফিসারের জন্য তার ঊর্ধ্বতন এর সাথে সেই ঊর্ধ্বতনের দেয়া আদেশের উপযুক্ততা বা উপযোগিতা নিয়ে বিতর্ক করাটা সর্বানাশা হবে; তাঁর অবশ্যই আদেশ মেনে চলতে হবে। কিন্তু একইভাবে একজন পন্ডিত হিসেবে সামরিক কর্মকান্ডের ভুলগুলোর ব্যাপারে মন্তব্য করা এবং সেগুলোকে বিবেচনার জন্য জনসম্মুখে তুলে ধরার অধিকার অস্বীকার করা যেতে পারে না। নাগরিকরা তাঁদের উপর আরোপিত কর প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে না; বস্তুতই তাঁর উপর যা ধার্য করা হয়েছে সেগুলোকে অসম্মান করে নালিশ করলে অপবাদের শাস্তি হতে পারে তাঁর (যেহেতু তা সাধারণ অবাধ্যতা তৈরি করতে পারে)। কিন্তু সেই একই ব্যক্তি একজন পন্ডিত হিসেবে এই করের অনুপযোগিতা, এমনকি অবিচার নিয়ে তাঁর চিন্তা জনসম্মুখে প্রকাশ করলেও, সে তাঁর নাগরিক কর্তব্যের বিরুদ্ধে কোন কিছু করে না। একইভাবে একজন পাদ্রী তাঁর ছাত্রদেরকে ধর্মনুশাসনের বক্তৃতা দিতে বাধ্য এবং তাঁর ধর্মসভা যে চার্চে সে চাকরি করে সেই চার্চের প্রতীকই মেনে চলবে, কারণ তাঁকে এই শর্তেই এ’কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু একজন পন্ডিত হিসেবে তাঁর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এমনকি প্রেরণাও(calling) রয়েছে, জনগণকে চার্চের যেসব ভুল রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে তাঁর চিন্তা-ভাবনা জানানোর, যে চিন্তাগুলো সচেতনভাবে পরীক্ষিত এবং ভালো উদ্দেশ্যে করা, এবং সেই সাথে রয়েছে চার্চ এবং ধর্মীয় সংগঠনের আরও ভালো ব্যবস্থাপনার জন্য উপদেশ দেয়ার স্বাধীনতা। এই কাজ করার মধ্যে এমন কিছু নেই যা তাঁর বিবেকের উপর বোঝা হয়ে থাকবে। কারণ চার্চের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর কার্যালয় অনুসারে যা সে শিখায়, সেটাকে সে বিবেচনা করে এমন কিছু হিসেবে, যা নিজের শিক্ষার আলোয় শেখানোর স্বাধীনতা তাঁর নেই; এমন কিছুর জন্য তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যা সে অন্যের নির্দেশ অনুযায়ী এবং অন্যের নামে উপস্থাপন করবে। সে বলবে, “আমাদের চার্চ এই এই জিনিসগুলো শিখায়; এই হচ্ছে সে সকল প্রমাণ যা চার্চ উল্লেখ করে।” এইভাবে সে তাঁর ধর্মসভার জন্য সকল ব্যবহারিক উপযোগিতা বের করে আনে, সে সকল সংবিধান থেকে যেগুলোতে সে নিজে সম্মতি দেয় না, কিন্তু যেগুলো বলার অঙ্গীকার সে করতে পারে, কারণ এগুলোর মধ্যে সত্য থাকা অসম্ভব নয়, এবং আর যাইহোক, অনন্ত এমন কিছু এগুলোর মধ্যে নেই যা অন্তরের ধর্মের(inner religion) বিপরীতে যায়। কারণ যদি সে বিশ্বাস করতো এমন কিছু সে এগুলোর মধ্যে পেয়েছে, তাহলে সচেতনভাবে সে তাঁর অফিসের দায়িত্ব পালন করতে পারতো না; এই কাজ তাঁর ছেড়ে দিতে হতো। একারণে একজন শিক্ষক যাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁর ধর্মসভায় সে শুধু তাঁর যুক্তির ব্যক্তিগত ব্যবহার করে, কারণ এই ধর্মসভা শুধুমাত্র একটি ঘরোয়া(domestic) সভা (এমনকি সেই জমায়েত যদি অনেক বড়ও হয়); এই অনুসারে একজন পাদ্রী হিসেবে সে স্বাধীন নয়, এবং স্বাধীন হতেও পারবে না, কারণ সে অন্যের আদেশ পালন করে। কিন্তু একজন পন্ডিত হিসেবে, যে জনগণ, বিশ্ব এবং পাদ্রীদের জন্য তাঁর লেখায় যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার করে, সে তাঁর নিজের থেকে কথা বলার সময় যুক্তির ব্যবহারে অসীম স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। জনগণের অভিভাবকরা (আত্মিক বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে) নিজেরাও অযোগ্য হবে তা অযৌক্তিকতার অনন্তকরণের মতই অযৌক্তিক।
পাদ্রীদের একটি সমাজ, হয়তো একটি চার্চের সম্মেলন বা একটি প্রবীণ বর্গ (যেভাবে ডাচরা নিজেদের মধ্যে নিজেদের সম্বোধন করে) নিজেদের অনুসারীদের উপর এবং এভাবে সকল মানুষের উপর নিরবিচ্ছিন্ন অভিভাবকত্ব ধরে রাখার জন্য, এমনকি তা চিরস্থায়ী করার জন্য কোন নির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় প্রতীকের প্রতি শপথ নিতে নিজেদের বাধ্য করলে সেটা কি ন্যায়সঙ্গত হবে? আমার উত্তর হচ্ছে সেটা একেবারে অসম্ভব। এমন চুক্তি, যা মানবজাতির কাছ থেকে এনলাইটেনমেন্টের জন্য পরবর্তী সকল পদক্ষেপ বন্ধ করে দেয়ার জন্য তৈরী, তা একেবারেই শূন্য এবং অকার্যকর, এমনকি যদি তা কোন সর্বোচ্চ ক্ষমতা, সংসদ এবং সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শান্তি-চুক্তি দ্বারাও অনুমোদিত হয়ে থাকে। একটা যুগ নিজেকে এভাবে আবদ্ধ করতে পারে না এবং উত্তরসূরীদের এমন অবস্থায় রাখার আদেশ দিতে পারে না যাতে করে তাঁরা নিজেদের জ্ঞান সম্প্রসারিত (বড়জোর মাঝে মাঝে) করতে না পারে, ভুলগুলো শোধরাতে না পারে এবং সর্বজনীন এনলাইটেনমেন্টের দিকে অগ্রসর হতে না পারে। তা হবে মনুষ্য-প্রকৃতির বিরুদ্ধে একটি অপরাধ, যার সঠিক নিয়তি নিহিত আছে এই অগ্রসরেই, এবং এই সকল আদেশ যা অন্যায্য এবং বিদ্বেষপরায়ণ উপায়ে তৈরি হয়েছে, তা যদি পরবর্তী প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করে সেটা ন্যায্য হবে।
যে কোন আইন যা জনসাধারণের জন্য গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তার মাপকাঠি হচ্ছে জনগণ কি নিজেরা সেই আইন নিজেদের উপর আরোপ করতো কিনা। এই ধরনের ধর্মীয় চুক্তি সংক্ষিপ্ত এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সম্ভব, যেহেতু তা আরও ভালো কিছুর আশায় করা হয়েছিল। কেউ একজন হয়তো সকল জনগণকে, বিশেষ করে পাদ্রীদের একজন পন্ডিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ দিতে পারে যেন তাঁরা লেখনীর মাধ্যমে বর্তমান ব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে স্বাধীনভাবে এবং প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে পারে। নতুন প্রবর্তিত ব্যবস্থা ততদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকতে পারে যতদিন না এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি এতটা সার্বজনীন হয়ে উঠে এবং এত ব্যাপক সমর্থন লাভ করে যে তাঁদের সকলের স্বর এক করে (এমনকি সর্বসম্মতিক্রমে না হলেও) এই ধর্মসভাগুলো সুরক্ষার অধীনে নেয়ার একটি একটি প্রস্তাব রাজার কাছে নিয়ে যেতে পারে, যেগুলো তাঁদের উত্তম ধারণা অনুসারে একটি ধর্মীয় সংগঠনে পরিবর্তিত হয়েছে একত্রিত হওয়ার মাধ্যমে, তবে তা যারা আগের ব্যবস্থায় থাকতে চায় তাঁদের ক্ষতিগ্রস্থ করা ছাড়াই। কিন্তু এমন একটা স্থায়ী ধর্মীয় সংগঠনে সংঘবদ্ধ হওয়া যাকে কিনা প্রকাশ্যে সন্দেহ করা যাবে না, এমনকি একজন মানুষের সম্পূর্ণ জীবদ্দশায়ও না, এবং এর ফলে মানবজাতির উন্নতির দিকে অগ্রসর হওয়ার একটা যুগকে বিফলে যেতে দেয়া, ফলাফলে পরবর্তী বংশধরদের জন্য প্রতিকূলতা সৃষ্টি করা—এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একজন মানুষ নিজের জানার ক্ষেত্রে এনলাইটেনমেন্টকে থামিয়ে রাখতে পারে (শুধুমাত্র সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য), কিন্তু তা (এনলাটেইনমেন্ট) পরবর্তী বংশধরদের জন্যও অস্বীকার করা মানে হচ্ছে মানবজাতির অধীকার ক্ষুণ্ণ করা এবং পদদলিত করা। যে আইন জনগণ নিজের জন্য নির্ধারণ করে না, তা নির্ধারণ করতে সম্রাট আরও কম পারে, কারণ তাঁর আইন প্রয়োগকারী ক্ষমতা নির্ভর করে সাধারণ জনগণের ইচ্ছা তাঁর(সম্রাট) মাধ্যমে নিজে থেকেই একত্রিত হওয়ার মধ্যে। সে যদি শুধু এতটুকু খেয়াল রাখে যে সকল সত্য বা অভিযুক্ত উন্নতি সামাজিক বিন্যাসের(civil order) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তাহলে আত্মিক কল্যাণের জন্য কি কি করা প্রয়োজন সে ব্যাপারটি তিনি তাঁর নাগরিকদের উপর ছেড়ে দিতে পারবেন। এটা তাঁর চিন্তার বিষয় না, যদিও নিজ নিজ সর্বোচ্চ ক্ষমতা অনুযায়ী এই কল্যাণ নির্ধারণ এবং প্রচার করার অধিকার যেন অন্য কারও দ্বারা হিংস্রভাবে বাধাগ্রস্থ না হয় তা খেয়াল রাখা সম্রাটের দায়িত্ব। এই ব্যাপারে নাক গলানো তাঁর নিজের মহিমাকে হ্রাস করে, যেহেতু যে সকল লেখার মাধ্যমে তাঁর প্রজারা তাঁদের মতামত হাজির করে, সে সকল লেখার দ্বারা সে তাঁর নিজের শাসনকার্য মূল্যায়ন করতে পারে। সে তা করতে পারে যখন সবচেয়ে গভীর উপলব্ধি দ্বারা তিরস্কার(reproach) সে নিজের উপর চাপিয়ে নেয়। Caesar non est supra grammaticos (ব্যাকরণবিদদের উপর সিজারের কোন ক্ষমতা নেই)। সে নিজের মহিমাকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করে যখন সে তাঁর অন্যান্য প্রজার বদলে নিজের রাজ্যের কিছু স্বেচ্ছাচারীর(tyrant) ধর্মীয় স্বৈরাচারকে সমর্থন জানিয়ে নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে অপমানিত করে।
যদি আমাদের জিজ্ঞেস করা হয়, “আমরা কি এনলাইটেন্ড(enlightened, ইতিমধ্যেই আলোকিত হয়েছে এমন) সময়ে বাস করছি?” এর উত্তর হবে, ”না”, কিন্তু আমরা এনলাইটেনমেন্ট এর সময়েই বাস করছি। এখন যে অবস্থা তাতে, অনেক কিছুর অভাব রয়েছে যা মানুষকে ধর্মীয় ব্যাপারসমূহে নিশ্চয়তা সহকারে এবং বাইরের নির্দেশনা ছাড়াই যুক্তির সঠিক ব্যবহারে বা সঠিক ব্যবহারে সক্ষম হয়ে উঠতে বাধা দেয়। কিন্তু অন্যদিকে আমাদের কাছে পরিষ্কার ইঙ্গিত আছে যে, যেখানে মানুষ মুক্তভাবে এইসব ব্যাপার মোকাবেলা করতে পারবে সেই প্রান্তরটি উন্মুক্ত হয়েছে এবং সর্বজনীন এনলাইটেনমেন্ট পথে বা স্ব-আরোপিত অভিভাবকত্ব থেকে মুক্তির পথের বাধাসমূহ ধীরে ধীরে দূর করা হচ্ছে। এই হিসাবে, এটা এনলাইটেনমেন্টের যুগ, অথবা ফ্রেডরিখের শতাব্দী।
একজন রাজপুত্র যে এই কথাটি বলা নিজের অনুপযুক্ত মনে করে না-যে সে মানুষকে ধর্মীয় ব্যাপারে কিছু না বলাকে বরং সহনশীলতার উদ্ধত নামটি পরিত্যাগ করে তাঁদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়াকে নিজের দায়িত্ব মনে করে, সে নিজেই [ইতিমধ্যে] আলোকিত এবং কৃতজ্ঞ। দুনিয়া ও উত্তরোত্তর দ্বারা সর্বপ্রথমের সম্মান পাওয়ার যোগ্য যে কিনা অন্তত সরকারের দিক থেকে সর্বপ্রথম মানবজাতিকে এর অভিভাবক থেকে সরিয়ে এনেছে এবং প্রতিটি মানুষকে বিবেকের ক্ষেত্রে নিজের যুক্তি ব্যবহারের জন্য মুক্ত করেছে। তাঁর অধীনে শ্রদ্ধেয় যাজকরা পন্ডিত হিসেবে এবং নিজেদের দাপ্তরিক দায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্থ না করে তাঁদের বিচার এবং মতামত জনসাধারণের বিবেচনার জন্য দাখিল করতে পারে যা কিনা এখানে সেখানে প্রতিষ্ঠিত ধারণা থেকে সরে এসেছে। এবং যারা কোন দাপ্তরিক দায়িত্ব দ্বারা গণ্ডিবদ্ধ নয় তাঁরা আরও বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে। স্বাধীনতার এই স্পিরিট এই ভূখন্ডের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি তাঁদের মধ্যেও যাদের সরকার দ্বারা সৃষ্ট বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতার সাথে সংগ্রাম করতে হয়, যে সরকারের নিজের স্বার্থ নিয়ে ভুল ধারণা আছে। কারণ এ ধরনের সরকারকে একটি দৃষ্টান্ত প্রমাণ দেয় যে জনসাধারণের শান্তি এবং সমাজের স্থিতিশীলতা নিয়ে চিন্তিত হবার মত বিন্দুমাত্র কারণ স্বাধীনতার মধ্যে নেই। মানুষ ধীরে ধীরে বর্বরতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেরাই কাজ করে যদিনা অন্য কোন উদ্দেশ্যপূর্ণ কৌশল তাঁদের আটকে না রাখে।
আমি এনলাইটেনমেন্টের প্রধান বিষয়টি—মানুষের স্ব-আরোপিত অভিভাবকত্ব থেকে মুক্তি—মূলত ধর্মীয় ব্যাপারগুলোর উপর স্থাপন করেছি, কারণ আমাদের শাসকের বিজ্ঞান এবং কলার ক্ষেত্রে অভিভাবকের অভিনয় করার কোন আগ্রহ নেই এবং এজন্যও যে ধর্মীয় অক্ষমতা শুধুমাত্র সবচেয়ে ক্ষতিকরই না, সবচেয়ে অবমাননাকরও। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান যে কিনা ধর্মীয় এনলাইটেনমেন্টকে আনুকূল্য প্রদর্শন করে তাঁর চিন্তার ধারা আরও দূর পর্যন্ত যায়, এবং সে দেখে যে তাঁর প্রজাদেরকে নিজেদের যুক্তি জনপরিসরে ব্যবহার(public use) করার এবং তাঁর আইনসমূহ আরও সুগঠিত করার জন্যে তাঁদের চিন্তা-ভাবনা এবং এমনকি ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়া আইনসমূহের উপর খোলা মনে সমালোচনা প্রকাশ করার অনুমতি দিয়ে আইন করলে তাতে কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। এই ক্ষেত্রে আমাদের উজ্জ্বল উদাহরণ রয়েছে, যেখানে কোন সম্রাট-ই, যাদের আমরা সম্মান করি, তাঁর উর্ধ্বস্থ নয়।
কিন্তু একমাত্র সে-ই ছায়াকে ভয় পায় না যে কিনা নিজে এনলাইটেন্ড [ইতিমধ্যেই আলোকিত হয়েছেন], এবং জনসাধারণের শান্তি রক্ষার জন্য যার সুবিশাল এবং শৃঙ্খলিত সেনাবাহিনী রয়েছে, বলতে পারেঃ “যত ইচ্ছা বিতর্ক কর, এবং যে বিষয়ে ইচ্ছা কর, শুধু মান্য কর!” একটা প্রজাতন্ত্র এমন কথা বলার সাহস করে না। এখানে মানব সম্পর্কিত বিষয়াবলীর মধ্যে একটি অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত প্রবণতা দেখা যায়, যেখানে সবকিছুই বৃহৎ পরিসরে দেখলে আপাতবিরোধী। বৃহৎ মাত্রায় নাগরিক স্বাধীনতা জনগণের মনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক মনে হয়, কিন্তু তবুও তা এর উপর অনিবার্য সীমাবদ্ধতা স্থাপন করে। বিপরীতে স্বল্প মাত্রায় নাগরিক স্বাধীনতা, প্রত্যেক মানুষ তাঁর সম্পূর্ণ ক্ষমতা বিস্তৃত করতে পারে সেজন্য মনকে সুযোগ করে দেয়। যেভাবে প্রকৃতি নিজের কঠিন খোলস থেকে তার সেই বীজটি অনাবৃত করেছে যার যত্ন সে সবচেয়ে বেশি স্নেহ দিয়ে নেয়—যা হচ্ছে মুক্ত চিন্তার প্রবণতা ও বৃত্তি—তা ধীরে ধীরে মানুষের চরিত্রের উপর কাজ করে, যার ফলে সে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা সামলাতে সক্ষম হয়ে উঠেঃ সবশেষে, এটা সরকারের নীতিসমূহকে প্রভাবিত করে, যা দেখে মানুষের সাথে তাঁর মর্যাদা অনুসারে আচরণ করাটা সুবিধাজনক, যারা কিনা এখন যন্ত্রের চেয়ে বেশি কিছু।
______________
ইংরেজি অনুবাদের হদিস-
প্রকাশঃ ২২শে ডিসেম্বর, ২০২০