এনলাইটেনমেন্ট কী বস্তু?

ইমানুয়েল কান্ট



[প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত Beantwortung der Frage: Was ist Aufklärung? নিবন্ধটি মূলত Berlinische Monatsschrift (মাসিক বার্লিন) পত্রিকায় তৎকালীন প্রুশিয়া সরকারের এক কর্মকর্তার ছুড়ে দেয়া এই প্রশ্নের জবাবে লিখিত হয়েছিল। তৎকালে অনেক বিদ্বৎজন-ই এই প্রশ্নের সুরাহা করতে কোশেশ করেছেন। তুমুলভাবে আলোচিত ও সমালোচিত কান্টের এই "Answering the Question: What Is Enlightenment?" নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন তাহমিদ আলম ফিহাদ। ফিহাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী।]


এনলাইটেনমেন্ট(Enlightenment) হচ্ছে স্ব-আরোপিত অভিভাবকত্ব থেকে মানুষের মুক্তি। অভিভাবকত্ব হচ্ছে অন্যের দিকনির্দেশনা ছাড়া নিজের বোধশক্তি ব্যবহারের অক্ষমতা। এই অভিভাবকত্বে মানুষ স্বেচ্ছায়-আবদ্ধ হয় যখন এর কারণ যুক্তির অভাবে নিহিত থাকে না, বরং অন্যের দিক-নির্দেশনা ছাড়া তা ব্যবহারের সংকল্প এবং সাহস না থাকা এর কারণ হয়। জানার সাহস করো! (Sapare aude) “নিজের যুক্তি ব্যবহারের সাহস রাখো!”—এটাই হচ্ছে এনলাইটেনমেন্টের মূলমন্ত্র।


প্রকৃতি মানুষকে বাহ্যিক পরিচালনা(naturaliter maiorennes) থেকে মুক্ত করার অনেক সময় পরেও কেন মানবজাতির এত বড় একটা অংশ সারাজীবন অভিভাবত্বের অধীনে থাকে এবং কেন অন্যরা নিজেদেরকে এদের অভিভাবকরূপে নিযুক্ত করতে পারে, তার কারণ হচ্ছে অলসতা এবং ভীরুতা। পরিপক্ব না হওয়াটা অনেক সহজ। আমার যদি একটা বই থাকে যা আমার হয়ে বুঝে নেয়, একজন যাজকের আমার হয়ে যার বিবেক থাকে, একজন চিকিৎসক থাকে যে আমার আহার নির্ধারণ করে, তাহলে আমার চিন্তার কিছু থাকে না। আমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই, আমি যদি বেতন দিতে পারি—খুব সহজেই আমার হয়ে অন্যেরা বিরক্তিকর কাজগুলো করবে।


মানবজাতির (এবং সকল লিঙ্গের কাছে) বৃহৎ অংশটি যেন সক্ষমতার দিকে কদম উঠানোকে খুবই বিপদজনক মনে করে—যা এর শ্রমসাধ্য হওয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন—সেদিকে এই অভিভাবকরা লক্ষ্য রাখে, যারা দয়া করে আমাদের তদারকি গ্রহণ করেছে। এই অভিভাবকরা তাদের গবাদি পশুদের মূর্খ বানানোর পর এবং এই শান্ত পশুগুলো তাদের বহরের লাগাম(harness of the cart) ছাড়া একটি পদক্ষেপ নেয়ার সাহসও যেন না পায় তা নিশ্চিত করার পর, একা চলতে চেষ্টা করার যে বিপদ, তাদের সেই বিপদের ভয় দেখায়। তবে সত্যিকার অর্থে এই বিপদ এত বড় নয়, কারণ কয়েকবার পড়ার পর অবশেষে তারা নিজে নিজে হাঁটতে শিখবে। কিন্তু এই ব্যর্থতার একটা উদাহরণ তাদের ভীত করে তোলে এবং সচরাচর পরবর্তী সকল পরীক্ষা থেকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।


অভিভাবকের অধীনে থাকা যে জীবন (যা বলতে গেলে প্রায় তার স্বভাব হয়ে গেছে) তার থেকে নিজে নিজে বের হয়ে আসা যেকোন মানুষের একার পক্ষে খুবই কঠিন। নিজের এই অবস্থা তার প্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বর্তমানে সে সত্যিই নিজের যুক্তি ব্যবহারে অক্ষম, কারণ কেউ কখনো তাকে সেই চেষ্টা করতে দেয়নি। নিয়ম এবং সূত্র, যা তার প্রাকৃতিক প্রতিভার ব্যবহার বা বলা যায় ভুল ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত যান্ত্রিক সরঞ্জাম, হচ্ছে চিরস্থায়ী অভিভাবকত্বের শিকল। যে-ই এগুলো ছুড়ে ফেলে, সে সবচেয়ে সংকীর্ণ নালার উপর দিয়ে শুধু একটি অনিশ্চিত ধাপ নেয়, কেননা সে এই ধরনের মুক্ত গতির সাথে পরিচিত নয়। যে কারণে, খুব কম সংখ্যকই নিজের চিন্তার অনুশীলন দ্বারা একই সাথে নিজের অক্ষমতা দূর করা এবং স্থির গতি, এই দুটি অর্জন করতে পেরেছে।


কিন্তু এটা আরও বেশি সম্ভব যে জনগণ নিজেদের আলোকিত করবেঃ সত্য সত্যই, শুধুমাত্র যদি স্বাধীনতা প্রদান করা হয়, এনলাইটেনমেন্টও যে তা অনুসরণ করবে সেটা প্রায় নিশ্চিত। কারণ জনগণের প্রতিষ্ঠিত অভিভাবকদের মধ্যেও সবসময় স্বাধীন চিন্তার অধিকারী কেউ না কেউ থাকবে, যে নিজের কাঁধ থেকে অভিভাবকদের জোয়াল ছুড়ে ফেলার পর নিজেদের মূল্য এবং প্রতিটি মানুষের নিজের জন্য চিন্তা করার বৃত্তি, এই উভয়ের যৌক্তিক উপলব্ধির চেতনা প্রচার করবে। কিন্তু এটা বলা থাকুক যে, যে জনগণকে তাদের অভিভাবকরা প্রথমে জোয়াল পড়িয়েছে, সে জনগণই তাদের বাধ্য করে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে যখন কিছু অভিভাবক, যারা নিজেরা এনলাইটেনমেন্ট অর্জনে সক্ষম, জনগণকে মুক্ত চিন্তায় উদ্দীপিত করার চেষ্টা করে—কুসংস্কার রোপন করাটা এতই ভয়াবহ, কেননা তারা পরবর্তীতে সেই রোপনকারী বা তার বংশধরদের উপর প্রতিশোধ নেয়। যে কারণে জনগণ শুধুমাত্র ধীরে ধীরে এনলাইটেনমেন্ট অর্জন করতে পারে। বিপ্লবের মাধ্যমে হয়তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র, লালস বা নৃশংস নিপীড়নের পতন সম্ভব, কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে সত্যিকারের সংস্কার সম্ভব নয়। অধিকতর, নতুন কুসংস্কার পুরাতনগুলোর জায়গায় কাজ করে, চিন্তাশক্তিহীন এই বিপুল জনগণকে বশে রাখার জন্য।


তবে এই এনলাইটেনমেন্টের জন্য স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই প্রয়োজন নেই এবং প্রকৃতই এই শব্দটি যে সকল বস্তুর ক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রযোজ্য, তার মধ্যে স্বাধীনতাই সবচাইতে নিরীহ। এটা হচ্ছে সকল ক্ষেত্রে একজন মানুষের যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার। কিন্তু আমি সব দিকেই শুনি, “তর্ক করো না!” অফিসার বলেনঃ “তর্ক না করে অনুশীলন করো!” কর সংগ্রাহক বলেন, “তর্ক না করে কর দাও!” পাদ্রি বলেন, “তর্ক না করে বিশ্বাস করো!” শুধুমাত্র একজন রাজপুত্র [দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ] আছেন পৃথিবীতে যিনি বলেন, “যত ইচ্ছা তর্ক করো, এবং তোমার যা খুশি তা নিয়ে করো, কিন্তু মেনে চলো!” সব জায়গায় স্বাধীনতার উপর বাধা-নিষেধ।