স্যার আলেক্সান্ডার কানিংহাম (১৮১৪-১৮৯৩): ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের প্রথম পর্যায়

আবু ইমাম


[ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক আবু ইমামের 'Sir Alexander Cunningham (1814-1893): The First Phase of Indian Archaeology' শীর্ষক প্রবন্ধটি ১৯৬৩ সনে দ্যা জার্নাল অব দ্যা রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যাণ্ড আয়ারল্যান্ড-এর অক্টোবর (৩য়-৪র্থ) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আবু ইমাম, প্রত্নতত্ত্বকে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্বতন্ত্র ডিসিপ্লিন বা বিভাগ হিসেবে চালু করতে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বরেন্দ্র মিউজিয়ামের কিউরেটর এবং ইতিহাস সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শিক্ষকতা করছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে। আবু ইমামের এই প্রবন্ধটি তর্জমা করেছেন কাব্য কৃত্তিকা। কাব্য কৃত্তিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।]



গত একশ’ বছর বা এরকমই সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে প্রত্নতত্ত্বের বিকশিত হওয়ার একটি সংযুক্ত গল্পে নিবেদনের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু প্রশংসাযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারতে এটির বিকশিত হবার ক্ষেত্রে কাছাকাছি বা তুলনাযোগ্য কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। ডেনমার্ক, এজিয়ন (Aegean), মিশর এবং ক্র্যানবোর্ন চেস-এ প্রত্নতত্ত্ব বিকশিত হয়েছিল এমনভাবে যেন অনেকগুলো পরীক্ষাগারে এই নতুন শাস্ত্রের কর্মপদ্ধতি ও কৌশল নিখুঁতভাবে তৈরি হচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, কেন এই পদ্ধতিগুলো ভারতে উৎপাদিত হলো না যেখানে কিনা আক্ষরিক অর্থেই শত শত প্রত্নস্থান প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক দৃশ্যপটে কি পরিস্থিতি প্রভাববিস্তার করেছিল যে বিকশিত চিন্তা বা ধারণা (concept) এবং কৌশলের পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে এরকম দৃশ্যমান দেরী হলো? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের অবশ্যই সেই পর্যায়কে পরীক্ষা করতে হবে যখন ভারতের প্রত্নতত্ত্ব কানিংহাম ও বারজেস (Burgess)-এর নিয়ন্ত্রণে ছিল কিংবা তাঁদের মত অধিপতি ছিল।


১৮৩৩ সালে, মাত্র উনিশ বছর বয়সে সেনা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কোম্পানির কাজে আলেক্সান্ডার কানিংহাম ভারতে এসেছিলেন। তাঁর চাকরি জীবন পরিষ্কারভাবে দুইটি ভিন্ন অংশে বিভক্তঃ প্রথম, ১৮৬০ সাল পর্যন্ত তাঁর সেনাবাহিনীর জীবন এবং দ্বিতীয়— যেটার কারণে তিনি বর্তমানে অধিক পরিচিত— ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভের [জরিপ] (Indian Archaeological Survey) পরিচালক থাকার পর্যায় (একটি ছোট্ট বিরতি সহ [যখন প্রথম সার্ভে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়] ১৮৬৬-১৮৭০ পর্যন্ত)।


কিভাবে এই সেনা প্রকৌশলী এই উপমহাদেশের প্রত্নতত্ত্বে জড়িয়ে পড়লো? উত্তরের জন্য আমাদের ঐ সময়ের বৃটিশ কলকাতার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিস্থিতির দিকে তাকাতে হবে। ঐ সময়ে কোম্পানির অফিসারদের মধ্যে একজন জেমস প্রিন্সেপ, যে অসাধারণ মেধা, অবাধ সক্ষমতা এবং অসীম উদ্দীপনা নিয়ে সক্রিয় ছিল এবং কলকাতা টাকশালের দায়িত্বে ছিল। এটা এমন হয়েছিল যে কোম্পানির কারেন্সি [মুদ্রা] ব্যবস্থা বদলের ক্ষেত্রে পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ করার প্রয়োজন হয়েছিল। এই ঘটনা, ভারতের অতীতের-মুদ্রা-ব্যবস্থা নিয়ে তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। উপরন্তু তিনি এইচ. এইচ. উইলসনের (সংস্কৃত বিদ্যার একজন অভিজ্ঞ ও সম্ভ্রান্ত জ্ঞানী এবং টাকশালের প্রাক্তন প্রধান) অধীনে শিক্ষানবিশ হয়ে যান ।


পাশাপাশি ঐ সময়ে ভাগ্যের আরেকটি স্পর্শে, ভেনচুয়া (Ventura, রণজিৎ সিংয়ের ফরাসি জেনারেল) মিশরীয় পিরামিড-ডাকাতদের সাফল্যের কাহিনী দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে পাঞ্জাব ও পর্বতের সীমানাঘেষাঁ ভূমিতে খনন করতে মনস্থির করেন। এই অঞ্চলটির অভ্যন্তরে অজানা উৎসের সংখ্যাতীত টাওয়ারগুলো (Towers) রহস্যজনকভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। এগুলো স্থানীয় জনগণের ভাষায় “topes” হিসেবে পরিচিত। শুধুমাত্র এগুলোকে ঘিরে রাখা ভূমিরূপকে বাদ দিলে, স্থানীয় অধিবাসীরা বহুকাল ধরেই এই “topes”-গুলোতে মনোযোগ দেয়া বাদ দিয়ে দিয়েছিল এবং পরোক্ষ নিরুদ্বিগ্নতা অর্থাৎ অগ্রাহ্য করা শিখে গিয়েছিল। কিন্তু বিদেশীদের অত্যাশ্চর্য হওয়া ও উদ্দীপ্ত হওয়া দেখে তারা উদ্বেলিত হয়ে যায়। ভেনচুরা, রণজিৎ সিংয়ের সাথে সুসম্পর্ককে ব্যবহার করে খননের আদেশ লাভ করে।


তাঁর এই প্রাপ্তি আলোড়ন তৈরি করে এবং অন্যরা এই উদাহরণ অনুসরণ করে। আগ্রহ আরও ব্যাপ্তি লাভ করে যখন প্রচুর সংখ্যক ব্যাকট্রিয়ান, রোমান এবং ইন্দো-স্কিদিক মুদ্রা প্রাপ্তি শুরু হয়। অ্যান্টিকুয়েরিয়ান চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকা সকলেই এই নতুন বিকাশে ডুবে যায় এবং এটি প্রিন্সেপ (Prinsep)-এর হাতে সূচনা হওয়া জার্নাল অব দ্যা এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের (Journal of the Asiatic Society of Bengal) সকল বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায়।


এভাবেই, প্রিন্সেপ ভারতীয় ইতিহাসের অজানা অঞ্চলকে জানার এই নতুন কারবারের ক্রীড়নকে পরিণত হন। প্রিন্সেপের মুদ্রা ও শিলালিপি পাঠানোর আহবানে ভারতের চারদিক থেকে অভূতপূর্ব সাড়া আসে এবং খুব দ্রুতই তিনি মুদ্রার স্রোতে ডুবে যান— বিশেষত ম্যাসন, হনিগবার্গার, জেরার্ড, কেরামত আলি এবং মোহন লালের পাঠানো পাঞ্জাব এবং আফগানিস্থান থেকে প্রাপ্ত মুদ্রা দিয়ে। ভেনচুরার সংগ্রহ কলকাতায় পাঠানো হয় এবং তিনি নিজেও সেখানে চলে যান। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে— ক্যাপ্টেন কট্‌ল (Captain Cautley)-এর আকস্মিকভাবে আবিষ্কৃত বেহাতের (Behat) কাছাকাছি একটি প্রচীন শহরের অবশেষ (যা যমুনা খাল খননের সময়) পাওয়া যায়। কানিংহাম এই স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ডের মাঝামাঝি সময়ে এখানে এসে পৌঁছান। এটা কোন আশ্চর্য বিষয় নয় যে, তিনি মূহুর্তেই এই ঘূর্ণনের মধ্যে ধরা পড়েন এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রিন্সেপের সবচেয়ে কাছের সহযোগী হয়ে যান। তাঁর চোখের সামনে ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির পাঠীদ্ধার করা হয়। পিয়াদাসী (piyadasi)’র শিলালিপি পঠিত হয়। টার্নার (Turnour) আবিষ্কার করেন যে, এই পিয়াদাসী আর কেউ নয় বরং বুদ্ধিস্ট ঐতিহ্যের উদযাপিত অশোক।


ভেনচুরার দেখাদেখি, কানিংহাম নিজেই সারনাথের বৃহৎ ধামেক (Dhamek) স্তূপ উন্মুক্ত করেন। এতে অনেক খরচ এবং বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। ১৮৪২ সালে তিনি সানকিস্‌সা’র (Sankissa) প্রত্নস্থান আবিষ্কার করেন। ১৮৩৯, ১৮৪৬ এবং ১৮৪৭ সালের কাশ্মির ও লাদাখের জরিপের সময় তিনি তাঁর প্রাত্যহিক দায়িত্বের বাইরে গিয়ে...অ্যান্টিকুইরিয়ান খোঁজে লিপ্ত হন।


একই সময়ে, ১৯শ শতকের ত্রিশের দশকের দিকে একই ঐতিহাসিক সময়ে বৌদ্ধবাদ (Buddhism) আবিষ্কৃত হয় হগসন, টার্নার, সোমা (Csoma), রেমুসাট, বুর্নফ এবং ল্যাসেল-এর যৌথ গবেষণার মাধ্যমে। এটা ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব ও হিস্ট্রিওগ্রাফি বা ইতিহাস-রচনার ভবিষ্যৎ ধারার ভয়াবহ ফলাফল এবং একইসাথে ভারতীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে কানিংহামের সম্পূর্ণ মনোভাবের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।


পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি বৌদ্ধবাদ এবং ভারতে এর প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে গভীরভাবে জানতে শুরু করেন। এই সময় থেকে ভারতের প্রত্নতত্ত্বে বৌদ্ধবাদের আধিপত্য বিস্তার করা শুরু হয়, যা পরবর্তী শতাব্দীতে এর পরিচয় নির্ধারণ করে দেয়। সারনাথে তাঁর কার্যক্রম, হিউয়েন সাঙয়ের ভাষ্যের পক্ষে তাঁর প্রবন্ধ এবং চূড়ান্তভাবে ১৮৪২ সালের সানকিস্‌সার জরিপ, ১৮৫১ সালের সাঁচী খনন তাঁর বৌদ্ধবাদ-কেন্দ্রিক প্রত্নতত্ত্বের দিকে ধাবিত হবার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা হয়। কানিংহামকে তাঁর পূর্বসিদ্ধ চিন্তার কারণে ভুলভাবে সমালোচনা করা হয় যা সম্ভবত ঐ সময়ের পারিপাশ্বিক পরিস্থিতিতে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কার্যত, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের গবেষণার ক্ষেত্রে বৌদ্ধবাদ-ই তাঁকে চমকপ্রদভাবে সবচেয়ে উত্তম [প্রেরণা বা] কারণটি দিয়েছিল।