যখন সানকিস্সার প্রত্নস্থান আবিষ্কার করেন, তিনি সেই খবরটি লন্ডনে থাকা কর্ণেল স্কাইসকে প্রদান করেন এই বার্তা সহ যে, একটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ করা “রাজনৈতিকভাবে ভারতীয় সরকার এবং ধর্মীয়ভাবে বৃটিশ জনগণের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হবে।“ প্রথমত, এটা দেখাবে যে ভারত সাধারণত অগণিত রাজ্যে (cheifships) বিভক্ত ছিল যা প্রতিটি সাফল্যমণ্ডিত আক্রমণের ক্ষেত্রে অপরিবর্তনশীলভাবে ভূমিকা রেখেছে। যখনই এটি একক রাজার অধীনে ছিল তখনই সবসময় এটি বিদেশী শক্তিকে দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করেছে। অন্যদিকে, এটা দেখাবে যে ব্রাহ্মণ্যবাদ অপরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তনীয় ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল ধরে টিকে ছিল যা তুলনামূলকভাবে আধুনিক উৎস থেকে আগত এবং ক্রমাগত সংযুক্তি ও বিযুক্তি গ্রহণ করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, খ্রিস্টধর্মের গোড়াপত্তন ভারতে অবশ্যই সাফল্যমণ্ডিত হবে।৪
বৌদ্ধবাদ এবং এর প্রত্নতত্ত্ব এখানে গবেষণা করা হয়েছে মূলত খ্রিস্টধর্মকে প্রচার করার উদ্দেশ্য। সর্বোপরি ব্রাহ্মণ্যবাদ—এতো বেশি অপরিবর্তনশীল ছিলনা। যাইহোক, বৌদ্ধবাদের একটি নিয়মতান্ত্রিক গবেষণার লক্ষ্যে, সরকারী খরচে একটি সার্ভে প্রয়োজন ছিল।
স্কাইসকে চিঠি লেখার সময়ে তাঁর মাথায় একটা সার্ভে তৈরি করার চিন্তা খেলা করছিল। সানকিস্সা’র আবিষ্কার তাঁকে বিস্ময়ের মধ্যে ফেলে দিল। স্কাইসকে ঐ একই চিঠিতে তিনি লিখেনঃ “বর্ষাকালেও হেঁটে হেঁটে দায়িত্ব পালন করে এবং নূন্যতম বিরতি না নিয়ে এই অল্প কিছু বিষয় (points) যা আমার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে, তা আপনাকে এটা দেখাবে যে যদি কেউ সময় নিয়ে এই কাজটা করার সুযোগ পেত, সকল স্থান (যা আগ্রহোদ্দীপক বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত করে) হেঁটে হেঁটে দেখার সুযোগ পেত তাহলে কি হতে পারত... এগুলো উন্মুক্ত করা এবং ভারতের সকল বুদ্ধিস্টিক্যাল অবশেষ শনাক্ত করার কাজ বৃহত্তর আগ্রহের এবং গুরুত্বপূর্ণ। কি পরিমাণ আনন্দ এবং উৎসাহ নিয়েই কেউ ফা হিয়েনের মথুরার যাত্রাপথ, তাঁর প্রথম ভারতীয় স্টেশন, সিলনের দিকে তাঁর যাত্রা করার রাস্তা শনাক্ত করবে।“ ১৮৪৮ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের নিজ আবাসে এই বিষয়গুলো আরেকটি পত্রের মাধ্যমে প্রবেশ করে।৫ ভারতের ইতিহাসকে চিত্রায়িত করার জন্য বেদ এবং পুরাণ ছাপানো যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বৌদ্ধবাদের টিকে থাকা অবশেষও—তাদের স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, মুদ্রা এবং লিপিসমূহের প্রকাশনা— ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা সরকারের সেইরকম একটি দায়িত্ব ছিল, যা করার জন্য তারা এই দেশের প্রতি দায়বদ্ধ ছিল। উপরন্তু, স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যের অবশেষসমূহ প্রতিনিয়ত ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছিল এবং লিপিসমূহ ভাঙা ও বিকৃত হয়ে পড়ছিল। “ভারতে বৌদ্ধবাদ অনেক শতক ধরে বিকশিত হয়েছিল এই সত্যটি কেবল মনুমেন্ট বা স্মৃতিস্তম্ভ থেকেও মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। মাহমুদ গজনবীর অধীনে মুসলমানদের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত মনুমেন্ট, মুদ্রা এবং লিপিসমূহ সবই বুদ্ধীয় উত্থানকে নির্দেশ করে।... মনুর প্রতিষ্ঠানসমূহ, রামায়ণ, মহাভারত এবং চমৎকার পুরাণগুলো বৌদ্ধবাদ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ ছিল যেন এই ধর্মটি ভারতে কখনোই বিকাশ লাভ করেনি...।” তিনি আরও নির্দেশ করেন কিভাবে “ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের একজন অনুসন্ধানকারীর চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এবং ফা হিয়েনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিৎ।“
এটাই ছিল সেই চিন্তার ভূল যেটাকে তিনি পরবর্তীতে দেখতে পাবেন, পরিণত অবস্থায় দেখতে পাবেন। [ফ্রান্সিস] বুকাননের (যাকে এক অর্থে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপকারীও বলা যায়) জরিপ, সাম্প্রতিক সময়ে সুবিস্তৃতভাবে পরিচিত হয়েছে মার্টিন-এর করা ডাইজেস্ট-এর মধ্য দিয়ে। ম্যাকেঞ্জি এবং টডের দাপ্তরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে এন্টিক্যুইটি সংগ্রহ দীর্ঘদিন যাবত পরিচিত ছিল। এটা সেই সময় যখন স্কটিশ নীল-চাষী ফার্গুসন (১৮৩৫-৪২) মাত্রই তাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্রমণ সম্পন্ন করেন—ভারতে পরিচালিত প্রথম ভ্রমণ যা শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল এবং তাঁদের এই উপলব্ধিসমূহ কানিংহাম বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। উনিশ শতকের শুরুর দিকে করা ত্রিকোণমিতিক ও ট্রপোগ্রাফিক জরিপগুলোও উদ্দীপ্ত হবার একটি উৎস ছিল। সোমা করোসি’র তিব্বতের অভিযান এবং হনিগবার্গার, কোর্ট, ভেনচুরা এবং ম্যাসনের ত্রিশের দশকের শুরুর দিকের উদাহরণসমূহ স্মৃতিতে তখনো সতেজ ছিল এবং বৌদ্ধবাদের প্রত্নতাত্ত্বিক যারা হতে চায় তাঁদেরকে উদ্দীপ্ত করেছিল। আমরা পূর্বেও যেটা দেখেছি, কানিংহামের নিজেরই শ্রমসাধ্য ভৌগোলিক জরিপ করার অভিজ্ঞতা ছিল যার সাথে সে মাঠ-প্রত্নতত্ত্বকে একত্রিত করেছিলেন। কিন্তু কানিংহামের ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ গতিপথ ঠিক করে দেয় দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা—ফা হিয়েনের ভারত ভ্রমণ বিবরণীর অনুবাদ।৬
ইন্দোলজির দুনিয়ায় এটির প্রকাশনার ফলাফল বর্তমান সময়ে অনুধাবন করা মুশকিল, যখন ভারতীয় ইতিহাসের মূল সাবস্ট্যান্স (substance) হয়ে পড়েছে কমনপ্লেস। প্রথমবারের মত, অনুবাদটির প্রকাশনার মাধ্যমে ভারতীয় ইতিহাস এমন এক ধরনের বাস্তবতার দিকে গেলো যা এই সময়ের পূর্ব পর্যন্ত অপূর্ণ ছিল। একইসাথে প্রথমবারের মতো ফা হিয়েনের ভাষান্তর—যতটাই খুঁত-সম্পন্ন এটা হোক না কেন—ভারতের হারিয়ে যাওয়া শহরগুলোর চিহ্নগুলো শনাক্ত করার বা খুঁজে বের করার কিছু তাগিদের যোগান দিয়েছিল, যদি শুধুমাত্র কারো পর্যাপ্ত অবসর থাকে ভাষান্তরটি হাতে নিয়ে এর খোঁজে বের হবার। এটা ভারতের জন্য সেই ধরনের দিকনির্দেশনা দিয়েছিল যেমনটা pansanians ধ্রুপদী পৃথিবীর ক্ষেত্রে দিয়েছিল এবং কানিংহাম ও অন্যান্যেরা খুব দ্রুতই এটি অনুধাবন করে। ফা হিয়েনের অনুবাদকরা তাঁদের টেক্সটে ভৌগোলিক নোটসমূহ যুক্ত করেছিল, যদিও স্বীকার করা যায় যে এটি খুব বেশি কার্যকরীভাবে নয়। কিন্তু JRAS-এ উইলসনের একটি আলোচনার পরেই এটি প্রমাণিত হয়।৭ এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে উইলসন প্রায় সমস্ত প্রত্নস্থানকে নিখুঁতভাবে নিরূপণ করেছিল। ১৮৫৭ এবং ১৮৫৮ সালে স্ট্যানিসলাস জুলিয়ানের করা হিউয়ান সাঙের অনুবাদটি ফা হিয়েনের অনুবাদের ধারায়ই হয়েছিল৮ যেটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং একইভাবে সুদূরবিস্তারী প্রভাব রেখেছিল এবং উপরন্তু এটি ভারতের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের আরও সুপিরিয়র (বৃহৎ) নির্দেশনা হিসেবে কাজ করেছে। এই অনুবাদের মূল্য আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ভি. সেইন্ট মার্টিনের উচ্চমানের ভৌগোলিক আলোচনার সংযুক্তির মাধ্যমে।
এই বইটি সঠিক সময়েই আসে। একটি সার্ভে প্রতিষ্ঠিত করার এর চেয়ে ভালো আর কি সময় হতে পারত? ভারতীয় ইতিহাসের সামগ্রিক রূপ (outline) পূর্বের থেকে আরও স্পষ্টতর হচ্ছিলো— কানিংহামের ভিলসা টোপ (Bhilsa Topes)-এ এটির নকশা/খসড়া তৈরি করার নিজস্ব চেষ্টায় সফল হওয়াই এর বড় প্রমাণ, ল্যাসেন-এর আরও বড় পরিসরের কাজের কথা না বললেও। বৌদ্ধবাদ সম্পর্কিত বেশি নির্ভরশীল উপাদানগুলো তখন স্কলারদের আয়ত্তের মধ্যে ছিল। ভারতের শিল্পকলার (art) ইতিহাসের কিছু বিষয় ঐ একই সময়ে জানা যায়। খরোষ্ঠী এবং ব্রাহ্মী উভয়ই পঠিত হয়। রাজনৈতিকভাবে ভারত বৃটিশ শাসনের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণের অধীনে একত্রিত ছিল। প্রান্তীয় অঞ্চল যেখানে এতদিনে প্রবেশাধিকার সহজ ছিল না তা সহজগম্য হয়েছিল তখন। বিদ্রোহের সময়কার হলোকাস্টের পরে The Pax Britannica আরও প্রতিপত্তির সাথে সাম্রাজ্য বিজয় করেছিল। কানিংহাম তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পরে নিজেই অবসরের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন তাঁর পুরো সময়ের মাস্টার হয়ে যেতে পারতেন যা তিনি তাঁর পছন্দের গবেষণার খোঁজে নিয়োগ করতে সক্ষম হতেন। ভাইসরয় নিজেও পরিচিত ছিলেন এই ধরনের বিষয়ে (আলোকিত?) আগ্রহের জন্য। তিনি মাত্রই (১৮৫৬) জিওলজিক্যাল সার্ভে [ভূতাত্ত্বিক জরিপ]-কে সঠিক স্থানে স্থাপন করেছিলেন।
১৮৬১ সালের নভেম্বরে কানিংহাম লর্ড ক্যানিংয়ের উদ্দেশ্যে একটি মেমোরান্ডাম লেখেন৯ যেখানে তিনি ভারতের এন্টিক্যুইটির প্রতি সরকারের অনুভূতিহীনতার অভিযোগ করেন। এটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না যে, সরকার তখন পর্যন্ত বৃটিশরাজের বিস্তার ও সুসংহতকরণের দিকে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু প্রাচীন ভারতের যত প্রকার স্থাপত্য বিদ্যমান বৃটিশ রাজ এর মর্যাদা রক্ষায় সমপরিমান গুরুত্ব দিয়ে এদের নিয়মতান্ত্রিক নিরীক্ষণ করার সময় চলে এসেছিল। এই কাজ সমাপ্ত হলে ভারতের উপরের দিককার অংশের যত প্রত্নতাত্ত্বিক অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায় তার একটি বিস্তারিত এবং নিখুঁত ছবি পাওয়া যেত। বিদ্রোহ পরবর্তী সেই অবস্থায় সরকার মুহূর্তেই এই চিন্তাটি গ্রহণ করে এবং লর্ড ক্যানিং খুব দ্রুতই কানিংহামকে সার্ভের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আদেশ জারি করেন, “ভারতের এই অঞ্চলে অন্য যেকোন কর্মকর্তার চেয়ে বেশি এই দেশের এন্টিক্যুইটিকে তাঁর গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন” সেই মানুষ হিসেবে।
জরিপসমূহ তাঁর সময়ে খুব বেদনাময় বিপর্যয়মূলক কর্ম ছিল। বেশিরভাগ ভ্রমণ ঘোড়ার পিঠে চড়ে করতে হতো। তবে তিনি হাতি, মোষের গাড়ি এবং উটও ব্যবহার করেছিলেন। এমনকি কখনো কখনো তিনি পায়ে হেঁটেও ভ্রমণ করেছিলেন এবং যত সময় অতিবাহিত হতে থাকে তিনি ট্রেনে বেশি বেশি ভ্রমণ করতে থাকেন। ইতিহাসবিদদের পরিশ্রম সহ্য করার নিছক সামর্থ্যের চেয়েও বেশি কিছু দরকার ছিল— কৌশল ও দক্ষতার আহবানও তারা দেয়। সেই সব কম আলোকিত সময়ে, লোকজন সবসময়ই প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে ওৎ পেতে থাকা নিয়ে সন্দেহগ্রস্থ থাকতো— গুপ্তধন পুনরুদ্ধার করা ছাড়া তার আর সম্ভাব্য কি-ই বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে? শিলালিপিগুলো শুধু এ ধরনের গুপ্তধনের সূত্র দিচ্ছে! বিদ্রোহ পরবর্তী সেই দিনগুলোতে কানিংহামের নির্দিষ্টভাবে ধর্মীয় সংবেদনশীলতার বিষয়েও সতর্ক থাকতে হয়েছিল। প্রায়শই একজন অসহযোগী পুরোহিত, কোন শিলালিপির কপি বা ভাষ্কর্যের ড্রয়িং সংগ্রহ করার তাঁর সমস্ত উদ্যোগ ধুলিস্মাৎ করে দিত। উপরন্তু, অতৃপ্ত ভূত এবং ভয়ঙ্কর আত্মার আতঙ্ক তাঁর নিয়োগ দেওয়া শ্রমিকদের মস্তিষ্কে ভয়াবহভাবে চেপে বসেছিল—দে বতারা নিজেরা যে আক্রমণ করতে পারে সেই আতঙ্কের কথা না বললেই নয়। কার্যতই, প্রায়শই ভূতের উপদ্রবের কারণে তাঁর খনন বন্ধ বা বাঞ্চাল হয়েছিল। সেখানে আরও বাস্তবিক বিপদের আশঙ্কা ছিল, যেমন- বাঘ, ডাকাত এবং অসুখ।
যাইহোক, তাঁর অনুসন্ধানমূলক ভ্রমণগুলো প্রত্নস্থান থেকে প্রত্নস্থানে দ্রুত দেখে যাওয়া ব্যতীত কিছু ছিল না। এক সিজনে তাঁকে ত্রিশটির মতো প্রত্নস্থানও হয়তো দেখতে হয়েছে। এই স্বল্প সময়ের ভ্রমণে তিনি প্রত্নস্থানগুলোর প্রতি কদাচিৎ সদাচার করতে পারতেন। সাধারণত তিনি একটা প্রত্নস্থানে ৩-৬ দিনের মতোন অবস্থান করতেন, তবে ক্ষেত্রবিশেষ বড় কাজের জন্য তিনি হয়তো ২ সপ্তাহ অবস্থান করতেন। তাঁর জন্য খনন শেষ পর্যন্ত এক ধরনের পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ হিসেবেই রয়ে যায়, যা কখনোই নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে এমন কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম ছিল না। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল হিউয়েন সাঙের দেখা শহরগুলো এবং সেই শহরের দালানগুলো শনাক্ত করা। তাঁর মতে, ধ্বংসাবশেষ দেখে প্রাচীন শহরগুলোর শনাক্তকরণের দক্ষতা একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া। কদাচিৎ তাঁর অনুসন্ধানগুলো নিছক বস্তু খোঁজার অভিযানে পরিণত হতো। তিনি প্রত্নস্থান পরিদর্শন করতেন, চারপাশের জঙ্গল সাফ করতেন এবং বিশাল শ্রমিকদলকে মুদ্রা, শিলালিপি এবং ভাষ্কর্য খোঁজার জন্য নিয়োগ দিতেন। প্রায়ই “এমনকি একটি একক অক্ষর”-এর জন্য পুরস্কার ঘোষণা করতেন। তারপর তিনি হয়তো নিজেই গ্রামাঞ্চলে, বাগানে, ঝোঁপে এবং মানুষজনের বাসস্থান নিজের হাতে পরিষ্কার করতেন। এভাবেই তিনি বহু সংখ্যক শিলালিপি ও ভাষ্কর্য সংগ্রহ করেছেন, বিশেষত ভারহুত, কৌসাম্বী এবং মথুরা থেকে।
যাহোক,তাঁর প্রত্নতত্ত্ব সীমিত সুযোগের মধ্যেও হয়তো চর্চায় ছিল, তত্ত্বত তাঁর অন্তত অনেক বেশি বিশদ idea (চিন্তা?) ছিল— একটি আইডিয়া যা কার্যতই বর্তমানের যেকোন চিন্তার মতই সুসংহত। তিনি এটি তাঁর Memorandam of Instruction-এ ব্যক্ত করেন, যেটা তিনি ১৮৭১ সালে তাঁর সহকারীদের কাছে তুলে ধরেন এবং তাঁর প্রতিবেদনের তৃতীয় ভলিয়্যুমে প্রকাশ করেন।
তিনি এই ঘোষণা দিয়ে শুরু করেন যে, “প্রত্নতত্ত্ব ভাঙা ভাষ্কর্য, পুরনো দালান এবং ধ্বংসাবশেষের ঢিবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং পৃথিবীর ইতিহাসে যা কিছু রয়েছে সবই ধারণ করে।“ যদিও স্থাপত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বস্তু “সকল প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের গবেষণা বৃদ্ধি করা উচিৎ যা তাদের পূর্ববর্তী সময়ের আচরণ ও প্রথাসমূহের ইলাস্ট্রেট (illustrate) করতে সাহায্য করবে”। স্থাপত্যে নির্দিষ্টভাবে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো গবেষণা করা প্রয়োজন “যেগুলো ভারতের স্থাপত্যকলার ক্রমশ বিকাশ বা উন্নতির ধারাকে দেখাবে... সকল সুন্দর অলংকরণ বা অদ্ভূত নির্মাণশৈলীর উদাহরণসমূহ-ও নোট করতে হবে...”। প্রাগৈতিহাসের প্রয়োজনীয়তার কথা ভুলে যাওয়া হয়নিঃ “পাথরের সেল্টের (celts) সাথে জড়িত রয়েছে বৃহৎ মাটির ঢিবিসমূহ, পাথরের চক্রগুলো এবং পাথরের বাড়িগুলো (dolmens) যা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে পাওয়া যায়। সবগুলোর অবস্থান এবং আকৃতি নথিবদ্ধ করা প্রয়োজন ভবিষ্যৎ গবেষণা এবং খননের জন্য। ছোট স্থাপনাগুলো হয়তো একবারেই উন্মুক্ত করা যেতে পারে যেহেতু কিছুদিনের বেশি এই কাজ আটকে থাকবে না; কিন্তু সকল বড় ঢিবিসমূহ অবশ্যই রেখে দিতে হবে সময় নিয়ে অনুসন্ধান করবার জন্য। মনোলিথ বা মেনহিয়া (menhirs, পশ্চিম ইউরোপের [মধ্য ব্রোঞ্জ যুগের] মানুষের-বানানো খাড়া পাথর) কদাচিৎ পাওয়া যাবে... কিন্তু মুদ্রা, লিপি, স্থাপত্য এবং ভাষ্কর্য এগুলোই প্রত্নতত্ত্ববিদের মনোযোগের যোগ্য একমাত্র বস্তু নয়। তিনি মনে করেন, “এটাও আশা করা যায় যে অনেক গ্রামীণ কিন্তু আগ্রহোদ্দীপক কৃষিজ সরঞ্জাম যা এখনো যমুনার দক্ষিণ দিকের সন্নিহিত জেলাগুলোয় দেখা যায় তার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। তাদের নামগুলো নোট নেয়া উচিৎ এবং প্রত্যেকটির প্রায়োগিক দিক খসড়া স্কেচ বা নকশার মাধ্যমে দেখানো উচিৎ যেখানে প্রত্যেকটি অংশ কি ধরনের উপাদান দিয়ে নির্মিত তা দেখা যায়। চিনি এবং তেলের বিভিন্ন ধরনের মিলগুলোও নোট করতে হবে। ... স্থানীয় মালবাহী গাড়ির ধরন বা নির্মাণের কোন ধরনের ভিন্নতা থাকলে সেটাও সুবিধাজনকভাবে নথিবদ্ধ করতে হবে।... এগুলোর কিছু হয়তো পুরাতন স্থাপনাগুলোর খোদাইকৃত ভাষ্কর্যের দৃশ্যসমূহের দিকে আলোকপাত করবে, অন্যগুলো প্রাচীন লেখকদের সম্পর্কে চিত্রায়ন করতে সাহায্য করবে; অনেক অঞ্চলের জিনিসপত্রের সম্পর্কে জ্ঞান সংরক্ষণ করতে এই সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হবে, যা বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে এবং দ্রুতই অব্যবহৃত ও বিস্মৃত হয়ে যাবে।
এভাবেই তাঁর প্রত্নতত্ত্বের সংজ্ঞা প্রায় সম্পূর্ণটাই নৃবিজ্ঞান এবং সমাজতত্ত্বের গুণাগুণ-সম্পন্ন হয়ে ওঠে। তাঁর প্রাগৈতিহাসিক বস্তুসমূহ নিয়ে যে সচেতনতা তাও আগ্রহোদ্দীপক। অনেকেই সন্দেহ করেন যে তাঁর ১৮৬৬ এবং ১৮৭০ সালের মধ্যকার ইউরোপে অবস্থান প্রত্নতত্ত্বের চিন্তা তৈরী হবার পাটাতন হিসেবে কাজ করে। নির্দিষ্টভাবে যখন আমরা মনে করতে পারি যে এটাই সেই সময় ছিল যখন লায়েল, লুব্ধক এবং টাইলরের বইগুলোর মাধ্যমে প্রাগৈতিহাস বিস্তৃতভাবে পরিচিতি পাচ্ছিল। একইসাথে ঐ সময়ে নৃবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের ফিল্ডেও দ্রুততার সাথে গুরুত্ববহ গবেষণাগুলো চলছিল এবং এটার প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া কঠিন ছিল— যদিও মর্গানের বিখ্যাত কাজটি তখনো বাইরে আসেনি।
কিন্তু যাইহোক, তিনি তাঁর এই আদর্শ ইশতেহারের ধারা মেনে জীবন কতটুকু চালিয়েছেন তা অন্য ব্যাপার। অনুশীলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে তাঁর পদ্ধতিসমূহ ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্বের পরিসরে বিকশিত হতে ব্যর্থ হয়, এমনকি প্রাগৈতিহাসও কোন গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগ পায়নি শুধুমাত্র পাথরের বস্তুসমূহের সংগ্রহ করা ছাড়া—এই ব্যাপারটা একটু উদ্ভট যে তাঁর জীবনের কর্ম সক্রিয় বেশিরভাগ বছরগুলোয় ইউরোপে এবং নিকট প্রাচ্যে নির্দিষ্টভাবে Aegean অংশে পুরনো ধরনের অ্যান্টিকুয়্যেরিয়ানিজম ধীরে ধীরে প্রত্নতত্ত্বের মূল রূপ নিচ্ছে নিউটন, কনজ্, ফিওরেল্লি, ডোর্পফেল্ড এবং শেলিম্যান-এর মতোন মানুষদের দ্বারা। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এই শতাব্দীর শেষ দিকে দুইজন মহৎ ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক পিট রিভার্স এবং পেত্রিয়ের দ্বারা।
ভারতে আমরা এর সীমানার বাইরে যত পদ্ধতি ও কৌশলের বিকাশ হচ্ছে তা সম্পর্কে একটি অবিশ্বাস্য রকমের অসচেতনতা শনাক্ত করতে পারি। কার্যতই কানিংহামের লেখায় কেউ একজন কাদাচিৎ তাঁর সমসাময়িক অন্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের (যারা তাঁর সাথে কাজ করেছে তাদের কোন ধরনের) উল্লেখ পাবে, লায়ার্ডের একটি আকস্মিক রেফারেন্স ছাড়া। ১৮৭০ সালে দ্বিতীয় সার্ভের প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে, ১৮৬১ সালের মতোন একই উপায়ে তিনি তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো আবার তুলে নেন। বছরের পর বছর একই রকমের (pattern) অনুসন্ধান, খনন এবং প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে যে মনে হয় যেন এই সময়ের মধ্যে প্রত্নতত্ত্বের বিজ্ঞানে নতুন কিছুই ঘটেনি। তিনি ভারতে তাঁর সাথে ঢিবি খননের বৃটিশ ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে আসেন এবং আসলে কখনোই এর বাইরে বের হতে পারেন নি। কার্যত তিনি প্রায়শই “borrow (ঢিবি)” শব্দটি ব্যবহার করেছে একটি স্তূপ (stupa)-কে বর্ণনা করার সময়ে এবং অন্তত একবার প্রাচীনতম স্তূপকে সাধারণ মাটির ঢিবি হিসেবে উল্লেখ করেছে “যেরকম ঢিবি এখনো ইংল্যান্ডে অস্তিত্বশীল”।