অর্ফিয়াসের চাহুনী

মরিস ব্লাঁশো


[বিশ শতকের ফরাসী সাহিত্যচিন্তায় মরিস ব্লাঁশোর অনবদ্য উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। ব্লাঁশোর সাহিত্য সম্বন্ধীয় ভাবনা, বিশেষ করে তাঁর 'লিটারেচার ও রাইট টু ডেথ' নামক লেখাটা পরবর্তীকালের ফরাসী চিন্তকদের অন্যতম রেফারেন্স পয়েন্ট হয়ে উঠেছিল। এইসব তাত্ত্বিকদের মধ্যে ছিল জ্যাক দেরিদা, জঁ-লুক ন্যান্সি, ফিলিপ্পে ল্যাকোও-ল্যাবার্থে। এই লেখাটায় যেখানে সাহিত্য আর দর্শন ওভারল্যাপ করে যায় সেইখানটাতেই তাদের বেশি আগ্রহ ছিল।ব্লাঁশোর লেখালেখির জীবনের শুরুর সময়কালে আমরা কতকগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের দেখা পাব। এদের মধ্যে বিশেষভাবে চোখ রাখতে পারি তাঁর “How is Literature Possible?” (১৯৪২), “From Dread to Language”(১৯৪৩) ও “Literature and the Right to Death”(১৯৪৯) এই লেখাগুলোতে। এই রচনাগুলোতে নেতির (negation) উপর ভর করে সাহিত্যতত্ত্ব দাড়িয়েছে, বিশেষভাবে ভাষাতত্ত্বের নির্মাণের সাথে সম্পর্কের সূত্রে। ব্লাঁশোর সাহিত্যতত্ত্ব দানা বেঁধেছে নঞর্থকতায়(negativity) মাধ্যমে। তবে খেয়াল রাখতে হবে ব্লাঁশোর সাহিত্যের ধারণায় এই নঞর্থকতা হেগেলীয় অর্থে সীমিত নয়, বরং সেটার চাইতেও 'বেশি কিছু'।


তৎকালের ফরাসী বুদ্ধিবৃত্তিক দুনিয়ায় জঁ পল সার্ত্রে ছিল অধিপতি। সার্ত্রে ছিল পূজিত ও পরিচিত।সার্ত্র যেখানে লিখছেন "সাহিত্য কী বস্তু?" সেখানে ব্লাঁশো লিখছেন "সাহিত্য ক্যামনে সম্ভব হয়ে উঠে"। ব্লাঁশোর মতে, 'সাহিত্য কী বস্তু?' কোন কাজের প্রশ্ন না। কিছু অর্থহীন উত্তর ছাড়া আর কিছুই এটা দেয়না। ব্লাঁশো বরং দেখাইতে চাইবেন অসম্ভাব্যতার মধ্যে ক্যামনে সাহিত্য সম্ভব হয়ে ওঠে। সাহিত্য নিয়ে এই দার্শনিক অবস্থানকে অনেকে সার্ত্রের সাহিত্য ভাবনার প্রত্যুত্তর হিসেবে পড়েন। যদিও এই দুইজনার বেড়ে উঠার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর একই ছিল, তবু সার্ত্রের দার্শনিক অবস্থানের মাধ্যমে আসা সাহিত্য আর রাজনীতির মাখামাখি ব্লাঁশোর কাছে সমস্যাজনক ঠেকেছে। সাহিত্যের কথিত দায়-দায়িত্ব প্রসঙ্গে উঠা বিতর্কে ব্লাঁশোর অবস্থানের ছাপ আমরা The Gaze of Orpheus লেখাটায় পাই। এটি মরিস ব্লাঁশোর সেই “The Gaze of Orpheus” লেখার অনুবাদ। লেখাটি ব্লাঁশোর কাছে সমস্যাজনক ঠেকেছে। সাহিত্যের কথিত দায়-দায়িত্ব প্রসঙ্গে উঠা বিতর্কে ব্লাঁশোর অবস্থানের ছাপ আমরা The Gaze of Orpheus লেখাটায় পাই। এটি মরিস ব্লাঁশোর সেই “The Gaze of Orpheus” লেখার অনুবাদ। লেখাটি ব্লাঁশোর The Space of Literature (l'Espace Littéraire) শিরোনামের বইতে পাওয়া যাবে]


শিল্পই মূলত সেই ক্ষমতা, অর্ফিয়াস পাতালে নামার কালে যা রাত্রীর দরজা খুলে দেয়। শিল্পের শক্তিমত্তার কারণেই রাত্রী তাঁকে স্বাগতম জানায়। এটা স্বাগত এক সৌহার্দ্য, হারমোনি ও প্রথম রাতের অর্ঘ্যে রূপ নেয়। কিন্তু অর্ফিয়াস আসলে ইউরিডাইসের দিকেই ছুটে (descended) গেছে। ওঁর জন্য ইউরিডাইসই হচ্ছে শেষ বিন্দু যেখানে শিল্পের মাধ্যমে পৌছানো সম্ভব। যে নাম তাকে লুকায় আর যে পর্দা তাকে আড়াল করে, সেই নামের বেশে, ইউরিডাইসই আসলে সেই সুগভীর অতীব জটিল বিন্দু যার দিকে শিল্প, বাসনা, মৃত্যু ও রাত্রি হেলে পরে। সেই ঘটনা যখন রাত্রি ‘অন্য’ রাত্রি(other night) হিসেবে আবির্ভূত হয়।


যাইহোক, গভীরে পতিত হওয়ার মাধ্যমে এই ঘটনা রচনার মধ্যে অর্ফিয়াসের কাজ নিহিত নয়। বরঞ্চ ওঁর কাজ এটাকে দিনের আলোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। দিনের আলোতে এটাকে আকার ও গঠন দেয়া, এটাকে বাস্তব করে তোলা। অর্ফিয়াস সবই করতে পারবে কিন্তু এই বিন্দুর মুখোমুখি হতে পারবেনা। এই রাতে, রাতেরই কেন্দ্রে তাকানো যাবেনা। ওঁ এটার দিকে ছুটে যেতে পারবে এবং এটা এখনও অধিক শক্তিশালী সামর্থ্য। ওঁ এটাকে আলোর দিকে তুলে নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু এটা ওঁ করতে পারবে শুধুমাত্র ইউরিডাইসের দিকে মুখ না ফিরিয়ে। এই ঘুরে তাকানোর মাধ্যেমেই কেবল এটির কাছে আসা সম্ভব। রাতের আধারে প্রকাশিত হলে এটাকেই গায়েব (concealment) হওয়া বলে। কিন্তু এই তৎপরতা চলাকালীন সময়ে অর্ফিয়াস তার লক্ষ্যের কথা ভুলে যায়। ওঁকে এটা ভুলতেই হবে কারণ ওঁর যে তৎপরতা তাকে কোন কাজের হতে হবে এমন নয়। বরঞ্চ কারো মুখোমুখি দাঁড়ানোটাই এই মুহুর্তের মর্মবস্তু হয়ে ওঠে। এটা যেখানে হাজির হয় অর্থাৎ রাতের কেন্দ্রে, সেখানে এর হাজির হওয়াটাই আসল কথা।


গ্রীক পুরাণ বলেঃ কাজ কাজ হয়ে তখনি উঠবে যখন তা কাজের স্বার্থেও কাজ হবেনা। যেটাকে গ্রীক পুরাণ চিহ্নিত করবে গভীরের অপরিমাপযোগ্য অভিজ্ঞতা হিসেবে (measureless experience of the deep) । এই ‘গভীর’ নিজে নিজেই উদ্ভাসিত হয়না। এটি কেবল কাজের মধ্যে লুকায়িত অবস্থায় প্রকাশিত হয়। এটা আবশ্যিক ও অপ্রতিরোধ্য জবাব। কিন্তু পুরাণ আমাদের এটা দেখায় যে এই অমোঘ বিধানের সামনে নত হওয়া অর্ফিয়াসের নিয়তি না। এবং অবশ্যই ইউরিডাইসের দিকে ঘুরে তাকানো মাত্র অর্ফিয়াসের কাজ ভুন্ডুল হয়ে যায়। ইউরিডাইস পুনরায় ছায়ায় মিলিয়ে যায়। ওঁ যখন ফিরে তাকায় রাতের সার অসার হয়ে উদ্ভাসিত হয়। এইভাবে অর্ফিয়াস কাজ, ইউরিডাইস ও রাত এই তিনকে প্রতারিত করে। কিন্তু ইউরিডাইসের দিকে ফিরে না তাকালেও এটা কোন অংশে কম অসত্য হত না।


না তাকানো হত সেই অপরিমাপযোগ্য গভীরের সাথে প্রতারণা করা (infidelity to the measureless)। যেটা তাঁর তৎপরতার অপরিণামদর্শী চালিকাশক্তি, যা ইউরিডাইসকে তাঁর দিনের আলোর সত্যে ও তাঁর প্রতিদিনকার আকর্ষণে চায়না। এটা চায় ইউরিডাইসের নিশীথের দুর্বোধ্যতা। তাঁকে দূর থেকে চায়। চায় ওঁর আবৃত শরীর, লুকায়িত মুখমন্ডল। ওঁকে তখন দেখতে চায়না যখন ওঁকে দেখা যায়। বরঞ্চ যখন আড়াল হয়, অদৃশ্য হয়। দৈনন্দিন জীবনের প্রাত্যহিকতায় চায়না। চায় ওঁর বৈদেশিকতায় যেখানে কোন অন্তরঙ্গতাই থাকেনা। এটা চায়না ওঁকে জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। বরং ওঁরই মাঝে ওঁর মৃত্যুর প্রাচুর্যতায় যাপন করতে চায়।


অর্ফিয়াস পাতালে এই জিনিসই খুঁজতে এসেছিল। ওঁর কাজের সকল মাহাত্ম, ওঁর শিল্পের সকল শক্তি, এমনকি দিনের আলোয় একটা সুন্দর প্রাণবন্ত জীবনের বাসনা, সকলই এই নির্দিষ্ট লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে বিসর্জিত হয়। রাত যা লুকায় আধারে ঠিক তার দিকে তাকানোর লক্ষ্যে, সেই অন্য রাতের(other night) জন্য। তাঁরে দেখার লাগি, হাজির হয়েও যে লুকিয়ে থাকে।


এই কাজের সমস্যার কোন সীমা নাই। দিন এটাকে একটা অসঙ্গত পাগলামী হিসেবেই সাব্যস্ত করে। ‘দিনের’ দৃষ্টিকোণ থেকে, পাতাল অভিমূখে যাত্রাই অতিরিক্ত। যে বিধান অর্ফিয়াসকে মুখ ফেরাতে নিষেধ করবে তা যে ওঁ লঙ্ঘন করবে তা অবধারিত কারণ ছায়ার জগতের উদ্দেশ্যে যাত্রাটাই একটা লঙ্ঘন। এই মন্তব্য যা ইংগিত করে তা হচ্ছে অর্ফিয়াস কখনোই ইউরিডাইসের থেকে মুখ ঘুরিয়েই রাখেনি। অর্ফিয়াস ইউরিডাইসকে অদৃশ্যতায় দেখতে পেয়েছে। ইউরিডাইসের ছায়াময় অনুপস্থিতি ও আবৃত উপস্থিতি (veiled presence) যা তার অনুপস্থিকে আড়াল করেনা তার মধ্যে অর্ফিয়াস ইউরিডাইসকে ছুয়ে দেখেছে। ওঁর দিকে ফিরে না তাকালে অর্ফিয়াস ওঁকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারতোনা। এবং সন্দেহাতীতভাবে ইউরিডাইস ওখানে নেই। কিন্তু এই ফিরে তাকানোতে অর্ফিয়াস নিজেই গায়েব হয়ে যায়। অর্ফিয়াস ওঁর থেকে কোন অংশে কম মৃত নয়। এই মৃত্যু জাগতিক মৃত্যু—যেখানে মৃত্যু মানে নীরবতা, বিশ্রাম ও সমাপ্তি— নয়। উল্টোটা বরং, এই মৃত্যু কোন শেষ নয়। সমাপ্তির যে অনুপস্থিত এই মৃত্যু তার অবিরাম অভিজ্ঞতা।


অর্ফিয়াসের এই যে অধৈর্য্য হয়ে পড়া, দিন তাকে ভর্ৎসনা করে। এমতবস্থায় যে বাসনা ইউরিডাইসকে দেখার ও অধিকার করার দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তাতেই অর্ফিয়াসের ভুল নিহিত আছে বলে মনে হয়। ইউরিডাইসের জন্য গেয়ে বেড়ানোই ওঁর নিয়তি। সংগীতের মধ্যেই কেবল সে অর্ফিয়াস। এই সংগীতের বাইরে ইউরিডাইসের সাথে ওঁর কোন সম্পর্ক নাই। ওঁর জীবন ও সত্য আছে কেবলই এই কবিতার পরে। ঠিক এই কারণেই ইউরিডাইস এই জাদুময় নির্ভরশীলতার বাইরে কিছুই রিপ্রেজেন্ট করেনা। এই নির্ভরতা অর্ফিয়াসকে ছায়ায় পরিণত করে এবং ওঁকে মুক্ত, জীবন্ত ও সার্বভৌম করে তোলে। এটা ঘটে কেবল অর্ফিক পরিসরে ও অর্ফিক মাত্রায় (Orphic space and Orphic measure)। হ্যাঁ, এটা সত্য যে শুধু সংগীতেই ইউরিডাইসের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু সংগীতেও ইউরিডাইসে ইতোমধ্যেই নাই। অর্ফিয়াস নিজেও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অর্ফিয়াস। সংগীত ওঁকে তৎক্ষণাৎ “অনন্ত মৃত” (infinitely dead) বানিয়ে দেয়। ওঁ ইউরিডাইসকে হারায় কারণ সংগীতের মাপা সীমানারও বাইরে ওঁ ইউরিডাইসকে কামনা করে। একই সাথে ওঁ নিজেকেও হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এই বাসনা, নাই হয়ে যাওয়া ইউরিডাইস আর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অর্ফিয়াস সংগীতের জন্য আবশ্যিক। ঠিক যেমন কাজের বেলায় শাশ্বত আলসেমির বিশ্রী দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে।


অর্ফিয়াসের দোষ হচ্ছে ওঁ অধৈর্য্য। ওঁর ভুল হচ্ছে ওঁ অসীমকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। সীমাহীনকে সীমায় বাধতে চেয়েছিল। সেটা এই এই জন্যে না যে ওঁ ওঁর ভুল যাত্রা অনন্তকালের জন্য ধরে রাখতে চেয়েছিল। সময়ের অনুপস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে যে চেয়েছিল তাঁর ব্যর্থতাকেই দেখা হচ্ছে অধৈর্য্য হিসেবে। অন্যভাবে বললে ধৈর্য্য হচ্ছে একটা চাতুরী যা এই অনুপস্থিতিকে অন্য সময় করে তুলতে চায়। কিন্তু সত্যিকারের ধৈর্য্য অধৈর্য্যকে বর্জন করেনা। এটা বরং অধৈর্য্যের সাথে অন্তঃরঙ্গতা, যেই অধৈর্য্য সীমাহীন যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। অর্ফিয়াসের অধৈর্য্য হয়ে পড়া এইভাবে একই সাথে একটা যথাযথ কর্ম। এর মধ্যে দিয়ে যা ওঁর নিজের আসক্তি হয়ে উঠবে তার যাত্রা শুরু হয়। এটাই ওঁর ধৈর্য্যের সর্বোচ্চ বিন্দু, মৃত্যুতে ওঁর শাশ্বত সাময়িক আবাস (infinite sojourn in death)।


প্রেরণা (Inspiration)


পৃথিবী অর্ফিয়াসের বিচার করলেও, কাজ তা করবেনা। কাজ ওঁর ত্রুটির ওপরে আলোকপাত করেনা। কাজ কিছুই বলেনা (the work says nothing)। এবং সবকিছু বিবেচনা করলে মনে হবে যেন বিধান অমান্য করা ও ইউরিডাইসের দিকে তাকানোর মাধ্যমেই কাজের গভীর যে চাওয়া তা অর্ফিয়াস পূরণ করে। যেন, এই উদ্দীপ্ত তৎপরতার মাধ্যমেই নরক থেকে দুর্বোধ্য ছায়াকে পাকড়াও করে ওঁ নিজের অজান্তেই তাকে কাজের দিনের আলোতে (broad daylight of the work) ফিরিয়ে নিয়ে আসে।


সংগীতের কথা বিবেচনা না করেই বাসনার অধৈর্য্যতা ও অপরিণামদর্শীতায় (যেটা বিধানকে ভুলিয়ে দেয়) ইউরিডাইসের দিকে তাকানোই প্রেরণা(inspiration)। তাহলে কি এই প্রেরণা রাতের সৌন্দর্য্যকে শূন্যতার অবাস্তবতায় রূপান্তরিত করে? এই প্রেরণা কি ইউরিডাইসকে ছায়ায় পরিণত করে আর অর্ফিয়াসকে বানায় “অনন্ত মৃত”? তাহলে কি প্রেরণা সেই সন্ধিক্ষণ যখন রাতের সার অসার হয়ে ওঠে এবং প্রথম রাতের স্বাগত অন্তঃরঙ্গতা (welcoming intimacy) হয়ে ওঠে প্রতারণামূলক অর্থাৎ অন্য রাত? এর উল্টোটা বলা যায়না। প্রেরণায় আমরা কেবলই ব্যর্থতা আন্দাজ করতে পারি। আমরা ঠাওর করি কেবল দ্বিধান্বিত ভায়োলেন্স। কিন্তু এই প্রেরণা যদি অর্ফিয়াসের ব্যর্থতা ও ইউরিডাইসের দুইবার হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়, যদি এটা রাত্রির শূন্যাবস্থা ও তুচ্ছতা প্রকাশ করে তবে এটাই অর্ফিয়াসকে ঘুরিয়ে দেয় এবং ব্যর্থতার দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। যেন ব্যর্থতাকে না বলা সফলতাকে না বলা থেকেও সুগভীর সমস্যার। যেন যাকে আমরা তুচ্ছ, অসার ও ভুল বলছি তার কাছে কোন প্রকার পিছুটান ছাড়াই সঁপে দেয়ার ঝুঁকি নেয়াটাই সকল প্রকার প্রামাণ্যের(authenticity) উৎস হিসেবে হাজির হয়।


এই উদ্দীপ্ত ও নিষিদ্ধ চাহুনি অর্ফিয়াস যে সব—শুধু নিজেকে নয়, শুধু দিনের বাস্তবতাকেই নয় বরং রাতের মর্মবস্তুও —হারাবে সেই নিয়তি ঠিক করে দেয়। এটা নিশ্চিত। একে নিয়ে আপত্তি তোলা যায়না। প্রেরণা অর্ফিয়াসের বিনাশের ঘোষণা দেয় এবং একই সাথে এই বিনাশের নিশ্চয়তার ঘোষণাও দেয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রেরণা কাজের সফলতার ওয়াদাও করেনা। ঠিক যেমন করেনা অর্ফিয়াসের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অথবা ইউরিডাইসের বেঁচে ফেরার কাজে। অর্ফিয়াস যে হুমকির মুখোমুখি হয় তার থেকে প্রেরণার মাধ্যমে কাজও কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়না। ঐ মুহুর্তে এটি এর চরম অনিশ্চয়তায় পৌছায়। এই কারণেই এটি যা এটাকে উদ্দীপ্ত করে থাকে তাকেই প্রায় সবসময় শক্তভাবে সাথে রেজিস্ট করে। ঠিক এই কারণেই এটা অর্ফিয়াসকে এই বলে নিজেকে রক্ষা করে যে, “তুমি আমাকে রাখতে পারবে যদিনা তুমি ইউরিডাইসের দিকে তাকাও”। যা কাজের নিশ্চয়তা দেয় তার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্ফিয়াসকে যা করতে হবে ঠিক সেটাই হচ্ছে এই নিষিদ্ধ তৎপরতা। এটা করতে হলে কাজকে ভুলে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। রাতের গহীন থেকে তাঁর কাছে যে কামনা এসে হাজির হয় তার দ্বারা প্ররোচিত হয়েই অর্ফিয়াস কাজকে ভুলে যায়। এই চাহুনীতে কাজ হারিয়ে যায়। এই তাকানোটাই একমাত্র মুহুর্ত যার মধ্য দিয়ে কাজ পুরোপুরি হারিয়ে যায়। কাজের থেকেও অধিক গুরুত্ববহ কিছু নিজের ঘোষণা দেয় ও নিজের পক্ষে সমর্থন জানায়। যেখানে কাজ হারিয়ে যায় তার আকাঙ্ক্ষিত চেহারা বাদে অর্ফিয়াসের কাছে কাজই সব।


অর্ফিয়াসের চাহুনিই কাজের প্রতি তার চূড়ান্ত উপহার। এটা এমন এক উপহার যার দ্বারা ওঁ প্রত্যাখ্যান করে, যার দ্বারা ওঁ কাজকে বলি দেয়। বাসনার মাপের অযোগ্য তৎপরতার সাপেক্ষে ওঁ নিজেকে উৎসের দিকে নিয়ে যায়। একই সাথে যার দ্বারা নিজের অজান্তেই ওঁ কাজের দিকে এগুতে থাকে, কাজের উৎসের দিকে এগুতে থাকে।


তবে নিশ্চিত ব্যর্থতায় অর্ফিয়াসের সকল কিছুই ধ্বসে পড়ে। থাকে কেবল ক্ষতিপূরণরূপে কাজের অনিশ্চয়তা। এইজন্য যে, আসলেই কোন কাজ আছে? সবচাইতে বিশ্বাসযোগ্য মাস্টারপিসের আগে যেখানে থাকে শুরুর দীপ্তি, এটাও ঘটতে পারে যে আমরা বিলীন হয়ে যাওয়া কিছুর মুখোমুখি হই। একটা কাজ আবারও উধাও হয়ে যায়, যে আসলে সেখানে আর নাই। কখনো ছিলও না। এই আচানক গ্রহণ(Eclipse) আবারও উধাও হয়ে যায়, যে আসলে সেখানে আর নাই। কখনো ছিলও না। এই আচানক গ্রহণ(Eclipse) অর্ফিয়াসের চাহুনীর সবচাইতে দূরবর্তী স্মৃতি। এটা উৎসের অনিশ্চয়তায় নস্টালজিক প্রত্যাবর্তন।


উপহার ও বলিদান (The Gift and the Sacrifice)


আমরা যদি প্রেরণার এইরকম মুহুর্ত নিয়ে বলতে চাই তবে আমাদের বলতে হবে যে এটা প্রেরণাকে বাসনার সাথে সংযুক্ত করে।


এটা কাজ নিয়ে যে উদ্বিগ্নতা তাকে নিরুদ্বেগ এক তৎপরতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। যে তৎপরতায় কাজের বলি দেয়া হয়। এখানে কাজের চূড়ান্ত বিধান ভঙ্গ হয়ে যায়। ইউরিডাইসের জন্য, ছায়ার জন্য কাজের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। বলিদানের তৎপরতা ভাবলেশহীন। এমন বলি যা কেবল আলো এবং ভাবলেশহীনই হতে পারে। সম্ভবত এটা একটা পাপ। কার্যতই এটাকে তৎক্ষণাৎ পাপের প্রায়শ্চিত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এর শাঁস হচ্ছে হাস্যরসাত্মকতা, উদ্বেগহীনতা ও সরলতা। এটা অনুষ্ঠানহীন এক স্যাক্রিফাইস। যেখানে পবিত্রকেই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে অপ্রয়োজনের কাছে যা ঠিক প্রোফেইনও না। তার থেকেও কম কিছু। এটা করা হয়েছে উদ্বেগহীন এক চাহুনীর মাধ্যমে যা কি-না আবার অপবিত্রও করেনা। অপবিত্রকরণের সক্ষমতাও কোনভাবেই এর নেই।


সেই আবশ্যক রাত্রী যা নিরুদ্বেগ চাহুনীর আগে অর্ফিয়াসকে অনুসরণ করে, সেই পবিত্র(sacred) রাত্রী যা ওঁ সংগীতীয় মুগ্ধতার মাধ্যমে পাকরাও করে তাকে অর্ফিয়াস সংগীতেরই সীমার মধ্যে জারী রাখে। জারী রাখে সংগীতের মাপা পরিসরে। অর্ফিয়াস ফিরে তাকানোর পরে যে শূন্য নিষ্ফল রাত হাজির হয় তার থেকে এই রজনী নিঃসন্দেহে অধিকতর সমৃদ্ধ(richer)। এই পবিত্র রাত ইউরিডাইসকে পরিবেষ্টিত করে। পরিবেষ্টিত করে সেই সংগীতের মধ্যে যেটা কিনা আবার সংগীতকেই ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এটা নিজে নিজেও পরিবেষ্টিত। এটা বন্ধনে আবদ্ধ, এটা অনুসরণ করে এটা আচারের শক্তির মাধ্যমে অর্জিত পবিত্র। অর্থাৎ বিধান, আইন, তাওয়ের পথ এবং ধর্মের অক্ষ। অর্ফিয়াসের চাহুনী একে মুক্ত করে, বাধন খুলে দেয়, সীমার বাইরে নিয়ে যায়, সেই বিধান ভেঙ্গে দেয় যা সারকে ধারণ করে ও আগলে রাখে। এইভাবে ওঁর চাহুনীই আসলে মুক্তির চরম মুহুর্ত।


সেই মুহুর্ত যখন সে নিজেকে নিজের থেকে মুক্ত করে। আরো গুরুত্বপূর্ণ এই যে কাজকে তার উদ্বেগ থেকে মুক্ত করে। কাজের মধ্যে ধারণকৃত পবিত্রকে মুক্ত করে। এই চাহুনী পবিত্রকে নিজের কাছে ফিরিয়ে দেয়, এটার মর্মে নিয়ে যায়, যার নাম মুক্তি। (এই জন্যই প্রেরণা আসলে উপহার।) তাই, তাকানোর সিদ্ধান্তে সকল কিছুই ঝুঁকির মুখে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তেই উৎসের (origin) সাথে চাহুনীর শক্তির দেখা হয়। যেই শক্তি রাতের সারকে অবমুক্ত করে, উদ্বেগকে উড়িয়ে দেয়, আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই এর চলমানতার মধ্যে সাময়িক বিরতি টানে। এটা বাসনার, উদ্বেগহীনতার ও কর্তৃত্বের এক মুহুর্ত।


অর্ফিয়াসের ফিরে তাকানো প্রেরণাকে বাসনার সাথে সংযুক্ত করে। ধৈর্য্যহীনতা উদ্বেগহীনতাকে বাসনার সাথে সংযুক্ত করে। কেউ যদি অধৈর্য্য না হয় সে কোনদিন উদ্বেগহীন হবেনা।


কিন্তু যেকেউ নিছক অধৈর্য্য হলেই নিরুদ্বেগ হতে পারবেনা। অর্থাৎ অর্ফিয়াসের নির্ভার চাহুনি কেবল অধৈর্য্য হলেই সম্ভব না। ঠিক এই কারণেই ধৈর্য্যহীনতাকে হতে হবে সুগভীর ধৈর্য্যের অন্তঃসার। এটাকে হতে হবে বিশুদ্ধ ঝিলিক যার জন্ম হয় এর অনঃস্থল থেকে। এটা আবার কেবল চমকে ওঠাই নয় যা চরম টেনশন থেকে জন্ম নেয়। কিন্তু এটা সেই চমৎকার বিন্দু যা ধ্যানমগ্ন অপেক্ষা থেকে পালাতে সক্ষম হয়। চরম আনন্দের দুর্ঘটনা, উদ্বেগহীনতা।


উল্লম্ফন (The Leap)


লেখালেখির শুরুই হয় অর্ফিয়াসের চাহুনী দিয়ে। এবং এই চাহুনী, বাসনার সেই তৎপরতা যা সংগীতের নিয়তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। যা একে ঘিরে যে উদ্বেগ, তার থেকে বিচ্ছেদ ঘটায়। এবং এই উদ্দীপ্ত ও ভাবলেশহীন সিদ্ধান্ত উৎসে পৌছায়, সংগীতকে পবিত্র করে। কিন্তু এই ঘটনার সম্মুখীন হতে হলে অর্ফিয়াসকে ইতোমধ্যেই শিল্পের শক্তি ধারণ করতে হয়। এর মানে হল, কেউ লেখে —একমাত্র যদি সে ঐ বিন্দুতে পৌছাতে পারে— যার রাস্তা আবার খুলে যায় লেখালেখির তৎপরতার মাধ্যমেই। লিখতে হলে, ইতোমধ্যেই লিখতে হবে। এই বৈপরীত্যের মধ্যে লেখালেখির সারমর্ম নিহিত। নিহিত আছে অভিজ্ঞতার অপ্রত্যাশিত বাধা ও প্রেরণার উল্লম্ফন।

______________



প্রথম প্রকাশঃ ১৪ই অক্টোবর, ২০১৯

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১৪ই অক্টোবর, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/4605589526180612/