সামাজিক দূরত্ব

জর্জিও আগামবেন


[করোনাভাইরাস মহামারী ও উদ্ভূত জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে ‘অকারণ জরুরতের ডেকে আনা জরুরী অবস্থা’ নামের লেখাটি প্রকাশের ফলে নানা তরফ থেকে বেশ তোপের মুখে পড়েছিলেন প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন। এই লেখাটির আরেকটা শিরোনামে আমরা চোখ বুলালেই বিতর্কের তীব্রতার মাত্রা কেমন হতে পারে তা আন্দাজ করতে পারব। অপর সেই শিরোনাম হচ্ছে ‘এক বৈশ্বিক মহামারীর উদ্ভাবন’। এরপরে আগামবেন নিজের দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট ও সুসংহত করতে প্রায় নিয়মিত ছোট ছোট লেখা লিখছেন। দিয়েছেন সাক্ষাৎকারও। ৬ই এপ্রিল, ২০২০ অর্থাৎ গতকাল তিনি ’ নামের লেখাটি প্রকাশের ফলে নানা তরফ থেকে বেশ তোপের মুখে পড়েছিলেন প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন। এই লেখাটির আরেকটা শিরোনামে আমরা চোখ বুলালেই বিতর্কের তীব্রতার মাত্রা কেমন হতে পারে তা আন্দাজ করতে পারব। অপর সেই শিরোনাম হচ্ছে ‘এক বৈশ্বিক মহামারীর উদ্ভাবন’। এরপরে আগামবেন নিজের দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট ও সুসংহত করতে প্রায় নিয়মিত ছোট ছোট লেখা লিখছেন। দিয়েছেন সাক্ষাৎকারও। ৬ই এপ্রিল, ২০২০ অর্থাৎ গতকাল তিনি Quodlibet প্রকাশনীর ওয়েবসাইটে Distanziamento sociale (সামাজিক দূরত্ব, Social Distancing) নামে এই প্রসঙ্গে আরেকটি লেখা লিখেছেন। এর কোনো অফিসিয়াল ইংরেজি অনুবাদ এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে অ্যালান ডীনকৃত (Alan Dean) একটি ‘আন-অফিসিয়াল’ ইংরেজি অনুবাদ ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশের দিনেই তিনি এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। আগামবেনের এই প্রসঙ্গে অন্যান্য লেখাগুলোর ‘অফিসিয়াল অনুবাদ’ সীলমোহর বাদ দিলে খুব একটা বিশেষ পার্থক্য ডীনের অনুবাদের বেলায় পরিলক্ষিত হয়নি। আগামবেনের গতকালের এই লেখাটি অ্যালান ডীনকৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন কাব্য কৃত্তিকা। কাব্য কৃত্তিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন।]





“মৃত্যু কোথায় কোথায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আমরা তা জানিনা, আমরা বরং তাকে সর্বত্রই খুঁজে বেড়াতে পারি। মৃত্যুর জন্য ধ্যান করা আসলে স্বাধীনতার জন্যই ধ্যান করা। যে মরতে শিখেছে সে আনুগত্যকে করেছে বিস্মৃত (unlearn)। কীভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয় সেটা জানতে পারা আমাদেরকে সকল দাসত্ব ও কুন্ঠা থেকে মুক্ত করে।”

- মিশেল দ্য মঁতেইন (Michel de Montaigne) [i]


ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেকটি সামাজিক প্রপঞ্চের রাজনৈতিক দ্যোতনা আছে বা থাকতে পারে। এ কারণে পশ্চিমা রাজনৈতিক অভিধানে নতুন করে আবির্ভূত হওয়া ‘সামাজিক দূরত্ব’র ধারণাটি যদি সতর্কতার সাথে আমরা নিবন্ধন করি তা হবে আমাদের জন্য যথোপযুক্ত। সম্ভবত ‘বন্দীদশা’র মতো রূঢ় শব্দ ব্যবহার না করার লক্ষ্যে এই শব্দবন্ধ’টি আবির্ভূত হয়েছে। এই প্রশ্নটি অবশ্যই উত্থাপন করা জরুরী যে, ‘সামাজিক দূরত্ব’র ধারণার উপর ভিত্তি করে নির্মিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা আসলে কেমন?


বর্তমান স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরুরী অবস্থাকে অনেকেই পরীক্ষাগার(Laboratory) হিসেবে দেখার পক্ষপাতী, যে পরীক্ষাগারে মানবতার প্রয়োজনেই নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোসমূহ বিকশিত হচ্ছে— এটা একেবারে বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক প্রশ্ন না হলেও এই মূহুর্তে সব'চে জরুরী প্রশ্ন।


দূরে থেকেও নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলো মানুষকে স্বাচ্ছন্দে যোগাযোগ রক্ষার সুবিধা দিয়ে থাকে বলে কিছু বোকার দল এই অবস্থাকে সন্দেহাতীতভাবেই একটি ইতিবাদক দিক হিসেবে বিবেচনা করতে চায়। এমন বোকার দল সবসময়েই ছিল এবং এখনও আছে। কিন্তু এটা বিশ্বাস করার কারণ নেই যে, ‘সামাজিক দূরত্ব’কে ভিত্তি করে গড়ে উঠা কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় মানবীয় বা রাজনৈতিকভাবে টেকসই হয়ে উঠবে। যেকোন পরিস্থিতিতে, প্রেক্ষিত যাই হোক না কেন, আমি মনে করি, এই ইস্যু নিয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিৎ।


‘সামাজিক দূরত্ব’ প্রপঞ্চটির সত্যিকারের অনন্য প্রকৃতি’ই প্রথম বিবেচ্য বিষয় । এই প্রপঞ্চটির সত্যিকার অনন্য প্রকৃতি উৎপাদন করেছে 'সামাজিক দূরত্ব'র মাত্রাসমূহ । ‘সামাজিক দূরত্ব’ প্রপঞ্চটির সত্যিকারের অনন্য প্রকৃতি’ই প্রথম বিবেচ্য বিষয় । এই প্রপঞ্চটির সত্যিকার অনন্য প্রকৃতি উৎপাদন করেছে 'সামাজিক দূরত্ব'র মাত্রাসমূহ । জনসমাগম এবং ক্ষমতা [ii](জার্মান ভাষাতে এই রচনার নাম Masse und Macht) নামক অনবদ্য রচনায় এলিয়াস কানেটি জনসমাগমকে উপলব্ধি করেছেন এমন কিছু হিসেবে যার উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং স্পর্শিত হবার ভয়কে উল্টে-দেবার মধ্য দিয়ে সেই ক্ষমতা গড়ে উঠে। মানুষ সাধারণত অপরিচিতের দ্বারা স্পর্শিত হবার ভয়ে থাকে। এবং সেই ভয় থেকেই সে তার চারপাশের সকল দূরত্ব তৈরী করে। জনসমাগম সেইখানে একমাত্র অবস্থা যেখানে এই ভীতি ঠিক তার বিপরীত মূর্তি ধারণ করে। (জার্মান ভাষাতে এই রচনার নাম Masse und Macht) নামক অনবদ্য রচনায় এলিয়াস কানেটি জনসমাগমকে উপলব্ধি করেছেন এমন কিছু হিসেবে যার উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং স্পর্শিত হবার ভয়কে উল্টে-দেবার মধ্য দিয়ে সেই ক্ষমতা গড়ে উঠে। মানুষ সাধারণত অপরিচিতের দ্বারা স্পর্শিত হবার ভয়ে থাকে। এবং সেই ভয় থেকেই সে তার চারপাশের সকল দূরত্ব তৈরী করে। জনসমাগম সেইখানে একমাত্র অবস্থা যেখানে এই ভীতি ঠিক তার বিপরীত মূর্তি ধারণ করে। “একমাত্র ভিড়ের মধ্যেই মানুষ স্পর্শিত হবার ভয় থেকে মুক্ত হয়... একজন মানুষ যতদ্রুত নিজেকে ভিড়ের মধ্যে সমর্পণ করে, মানুষের সংষ্পর্শে এসে ততদ্রুত স্পর্শভীতিকে ক্ষান্ত করে দেয়... যে মানুষটা তার বিপরীত দিক থেকে ঠেলাদিচ্ছে, সেও তার নিজের মতই। সে তাকে নিজের মতোই অনুভব করে। হঠাৎ করেই এমন মনে হয় যেন সবকিছুই একইভাবে, একই দেহে ঘটে চলেছে... স্পর্শিত হবার ভীতির দিক-ঘুরিয়ে-দেওয়া, ভিড়ের প্রকৃতির মাঝেই নিহিত রয়েছে। “যেখানে ভিড়ের ঘনত্ব যতবেশি, সেখানে পরিত্রাণের অনুভূতিও ততো বেশি।”


আমি জানি না, ভিড়ের নতুন যে ফেনোমেনোলজির মুখোমুখি আমরা হয়েছি তা সম্পর্কে কানেটি কি ভাবতেন! সামাজিক দূরত্বের পদক্ষেপসমূহ ও আতঙ্ক নিশ্চিতভাবেই এক ভিড় তৈরী করে, কিন্তু সেই ভিড় আসলে এক বিপরীতমুখী(inverted, দিক-ঘুড়িয়ে-দেয়া) ভিড়। বলতে গেলে এই ভিড় হচ্ছে সেইসব একক ব্যাক্তিদের সমষ্টি যারা যেকোন মূল্যে একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। কোন গাঢ়(dense) ভিড় নয়, কিন্তু একটি নিভৃতচারী (rarefied, কম ঘনত্ব) ভিড়; তবুও ভিড়। “এটার পক্ষে মুক্ত, স্বাধীনভাবে তৎপর হওয়া অসম্ভব... এটি অপেক্ষমান। দৃশ্যমান হবার জন্য সে নেতৃত্বের [আমরা ঈমাম মাহাদী বলতেই পারি] অপেক্ষা করে...” এই অর্থে কানেটি’র পরবর্তী ইঙ্গিত এটাকে যেভাবে নির্দেশ করে ঠিক সেইভাবে সংঘবদ্ধতা ও নিশ্চেষ্টতায় (compactness and passivity) সংজ্ঞায়িত করলেও, এটা তখনও ভিড়।


কানেটি এর কয়েক পৃষ্টা পরেই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে গড়ে উঠা ভিড়ের ধরণ বর্ণনা করেন, “এখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ একসাথে সেই কাজগুলো প্রত্যাখ্যান করে যা তারা এতদিন পর্যন্ত একা একা করে আসছিল। তারা একটি নিষেধাজ্ঞাকে মেনে চলে, এবং এই নিষেধাজ্ঞা অকস্মাৎ এবং স্ব-আরোপিত... কিন্তু যেকোন ক্ষেত্রেই এটি প্রবল শক্তিতে আঘাত হানে। এটি মূলত চরম আদেশ, আসলে এর নেতিবাচক দিকটাই হলো এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসূচক বিষয়। দৃশ্যমান অবস্থার সাথে অমিলের জায়গা হচ্ছে, এটা কখনোই বাইরে থেকে আসেনা। বরং সবসময়ই আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্থ সব প্রয়োজনের মাঝখান থেকে উদ্ভূত হয়।”


গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সামাজিক দূরত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় কোনোভাবেই ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদের দিকে ঠেলে দিবে এমনটা নয়। কেউ হয়তো সরলভাবে এটা বিশ্বাস করতে পারে। কিন্তু এমনটা ঘটে না। বরঞ্চ সম্পূর্ণ উল্টোটাই ঘটে। বর্তমানে আমাদের চারপাশে তাই দেখছি। দেখছি নিষেধাজ্ঞার ভিত্তিতে দাড়ানো এক নিভৃতচারী ভিড়, আর সেই নিষেধাজ্ঞার কারণেই এই ভিড় বিশেষভাবে সংঘবদ্ধ এবং নিশ্চেষ্ট।

____________

৬ই এপ্রিল, ২০২০


অনুবাদকের টীকা


[i] মিশেল দ্য মঁতেইন(Michel de Montaigne) ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক। ইউরোপের মধ্যযুগে স্কলাস্টিকদের হাতে আন্দাজ-নির্ভর(Speculative) দর্শন করার বাড়-বাড়ন্তকে প্রত্যাখান করেছিলেন। তাঁর অতিবাহিত জীবন সম্বন্ধে স্টেফান ভাইগের করা মন্তব্য আমাদেরকে তাঁকে বুঝতে সহায়তা করবে: মঁতেইন আমাদেরকে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সহায়তা করবে: "কীভাবে মুক্ত বা স্বাধীন থাকব?" ইতিপূর্বে "দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন তথা অনিবার্য মৃত্যুর মোকাবেলা" শিরোনামে তাঁর "THAT TO STUDY PHILOSOPY IS TO LEARN TO DIE" লেখার বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল মোজাফফর হোসেন সম্পাদিত শাশ্বতিকী পত্রিকায়(বর্ষ ৬, সংখ্যা ৯), অনুবাদক মীর ওয়ালীউজ্জামান।


[ii] এলিয়াস কানেটি(Elias Canetti) জার্মান ভাষার লেখক, জন্ম বুলগেরিয়ায়। ১৯৮১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ১৯৬০ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয় তাঁর Crowds and Power শিরোনামের বই। জনতা বা জনসমাগমের গতিপ্রবাহ এবং শাসকের ক্ষমতাকে কেন ও কিভাবে মান্য করে তাই এই বইয়ের বিষয়বস্তু। কানেটি শাসন ও প্যারানইয়া বা অযৌক্তিক আশাবাদকে পাশাপাশি এঁকেছেন তাঁর এই বইতে। ক্যারল স্টেভার্ট ১৯৬২ সালে বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। আগামবেনের এই লেখাটির ইংরেজি অনুবাদে ক্যারল স্টেভার্টের অনুবাদ কিঞ্চিৎ সংশোধন করে ব্যবহার করেছেন বলে অনুবাদক অ্যালান ডীন জানিয়েছেন।


ইংরেজি অনুবাদের হদিস— https://medium.com/@ddean3000/social-distancing-giorgio-agamben-e5abb1da795f


প্রথম প্রকাশঃ ৭ই এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৭ই এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/403682927327909/