স্বাধীনতা রক্ষার্থে স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা বেঠিক ও সাংঘর্ষিক

জর্জিও আগামবেন



[করোনাভাইরাস মহামারী ও উদ্ভূত জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে ‘অকারণ জরুরতের ডেকে আনা জরুরী অবস্থা’ নামের লেখাটি প্রকাশের ফলে নানা তরফ থেকে বেশ তোপের মুখে পড়েছিলেন প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন। এরপরে আগামবেন নিজের দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট ও সুসংহত করতে প্রায় নিয়মিত ছোট ছোট লেখা লিখে চলেছেন। দিয়েছেন সাক্ষাৎকারও। গত ১৩ই এপ্রিলে তিনি ও। গত ১৩ই এপ্রিলে তিনি Quodlibet প্রকাশনীর ওয়েবসাইটে Una domanda (একটি জিজ্ঞাসা, A Question) নামে এই প্রসঙ্গে আরেকটি লেখা লিখেছেন। আগামবেনের নিজের অনুরোধেই অ্যাডাম কসকো(Adam kotsko) এই লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি অনুবাদটি Giorgio Agamben: A Question নামে প্রকাশিত হয়েছে গত ১৫ই এপ্রিলে। এই ইংরেজি অনুবাদ থেকে আগামবেনের লেখাটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন কাব্য কৃত্তিকা। কাব্য কৃত্তিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন।]




"প্লেগ এই শহরের দূর্নীতির সূচনাকে চিহ্নিত করেছিল… ইতোপূর্বে ভাল হিসেবে সাব্যস্ত এমন কোন কিছুকেই কেউ আর অটলভাবে চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলো না, কেননা সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো যে, প্রত্যাশা পূরণ হবার আগেই সম্ভবত তারা মরে যাবে।"

থুসিডাইডিস, পেলোপনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৩


আগ্রহীদের কাছে আমি একটা প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই। এই প্রশ্ন নিয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আমি অনবরত আলোচনা করে যাচ্ছি। একটা অসুখের মুখে পড়ে সমগ্র দেশ রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে ধসে পড়ল-এটা কিভাবে সম্ভব হল? অথচ তা ঠাহরও করতে পারল না! এই প্রশ্ন দাঁড় করাতে খুব সতর্কতার সাথে মাপা শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে। আমাদের নিজস্ব নৈতিক ও রাজনৈতিক নীতিসমূহের প্রত্যাখ্যানের ব্যাপ্তি মূলত খুব সাদামাটাঃ কোন সেই সীমানা যাকে ছাড়িয়ে গেলে কেউ আর এগুলোকে অস্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে না! এটাই জিজ্ঞাসার বিষয়। যেসকল পাঠিকা নিম্নোক্ত প্রসঙ্গগুলোকে আমলে নেওয়ার কষ্ট স্বীকার করবে আমার মনে হয় তাঁরা এই বিষয়ে একমত হবেন, যে সীমানা মানবতাকে বর্বরতা থেকে আলাদা করে, সেই সীমানাই ছাড়িয়ে গেছে। ঠাহর-না-করে কিংবা ঠাহর-না-করার-ভান করে এই সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়ে কেউ একমত না হতে সমর্থ হবে না, যদি এই প্রসঙ্গগুলোকে অনুসরণ করে।


১। প্রথম প্রসঙ্গ: মৃত মানুষের শরীর সম্ভবত এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার বিষয়। এখন পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি কেবল এমন একটা ঝুঁকির অজুহাতে কিভাবে আমরা মেনে নিলাম যে, আমাদের ও অন্য সকলের প্রিয়জনেরা একাকী মারা যাবে?

কোনো ধরনের দাফন-কাফন এবং অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া ছাড়াই স্বজনদের মৃতদেহের সৎকার করাকে মেনে নিলাম কিভাবে? আন্তিগোনে কোনো ধরনের দাফন-কাফন এবং অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া ছাড়াই স্বজনদের মৃতদেহের সৎকার করাকে মেনে নিলাম কিভাবে? আন্তিগোনে [i] থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাসে এরকম তো কখনোই ঘটেনি!


২। তারপরে, এখন পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি কেবল এমন একটা ঝুঁকির অজুহাতে আমরা খুব বেশি সমস্যা ছাড়াই এতদূর পর্যন্ত আমাদের চলাচলের স্বাধীনতার সীমিতকরণ মেনে নিলাম। এটা ইতালির ইতিহাসে অভূতপূর্ব, এমনকি ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও (যুদ্ধকালীন সময়ে কারফিউ কেবল কয়েকঘন্টাতেই সীমিত ছিল) এমনটা ঘটেনি। এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট করা সম্ভব হয়নি কেবল এমন একটা ঝুঁকির অজুহাতের ফলাফলস্বরূপ, আমরা আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভালোবাসার সম্পর্কগুলোকে সাময়িকভাবে স্থগিত করাকেও স্বীকার করে নিলাম। কেননা, সংক্রমণের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে আমাদের নৈকট্য প্রতীয়মান হলো।


৩। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা সবসময়ই অবিচ্ছেদ্যভাবে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক। এই সঞ্জীবনী অভিজ্ঞতার ঐক্য খন্ডিত হয়ে যাওয়ার ফলে এই সকল কিছুই ঘটা সম্ভব হয়েছে। এবং এখানেই আমরা এই প্রপঞ্চের গোড়াকে ধরে ফেলি। আমাদের এই অভিজ্ঞতার একদিকে রয়েছে বিশুদ্ধ জৈবিকসত্তা, অপরদিকে রয়েছে আবেগ-অনুভূতিসম্বন্ধীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন। ইভান ইলিচ দেখিয়েছেন, এবং ডেভিড কেইলি সম্প্রতি এটাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এই খন্ডিত হওয়ার কারণ হিসেবে আধুনিক ওষুধের দায়-দায়িত্ব নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া হয়, কিন্তু এটা সবচাইতে বিমূর্ত বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে। আমি এটা বেশ ভাল করেই জানি যে, পুনর্জীবন-দানের(reanimation)৩। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা সবসময়ই অবিচ্ছেদ্যভাবে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক। এই সঞ্জীবনী অভিজ্ঞতার ঐক্য খন্ডিত হয়ে যাওয়ার ফলে এই সকল কিছুই ঘটা সম্ভব হয়েছে। এবং এখানেই আমরা এই প্রপঞ্চের গোড়াকে ধরে ফেলি। আমাদের এই অভিজ্ঞতার একদিকে রয়েছে বিশুদ্ধ জৈবিকসত্তা, অপরদিকে রয়েছে আবেগ-অনুভূতিসম্বন্ধীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন। ইভান ইলিচ দেখিয়েছেন, এবং ডেভিড কেইলি সম্প্রতি এটাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এই খন্ডিত হওয়ার কারণ হিসেবে আধুনিক ওষুধের দায়-দায়িত্ব নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া হয়, কিন্তু এটা সবচাইতে বিমূর্ত বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে। আমি এটা বেশ ভাল করেই জানি যে, পুনর্জীবন-দানের(reanimation)[ii] ব্যবস্থাপনার মারফতে আধুনিক বিজ্ঞানে এই বিমূর্তায়ন ঘটেছিল। এই পুনর্জীবনদান একটি শরীরকে পুরোপুরি গাছের-জীবনে(vegetative life)ব্যবস্থাপনার মারফতে আধুনিক বিজ্ঞানে এই বিমূর্তায়ন ঘটেছিল। এই পুনর্জীবনদান একটি শরীরকে পুরোপুরি গাছের-জীবনে(vegetative life)[iii] টিকিয়ে রাখতে পারে। যাইহোক, এই অবস্থা যদি তার নিজস্ব স্থান-কালের গণ্ডি (যা এর জন্যে সঠিক) পাড় হয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে (অনেকে এই মূহুর্তে এটাই করতে চাচ্ছে) এবং যদি এটা কোনোভাবে সামাজিক আচরণবিধির এক ধরনের শর্ত হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এটি এমন এক স্ববিরোধে পতিত হবে যেখান থেকে বের হয়ে আসার কোনো উপায় থাকবে না।


আমি জানি অনেকেই তাড়াহুড়ো করে এর উত্তর দেবেন যে, এটা একটা স্বল্প সময়ের সীমাবদ্ধ অবস্থা এবং সেই অবস্থা কেটে গেলেই সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। অদ্ভূত ব্যাপার হল, আপনি না চাইলেও নিশ্চিতভাবেই এর পুনরাবৃত্তি হওয়া সম্ভব। কারণ, কর্তৃপক্ষ ঠিক যেই মূহূর্তে জরুরী অবস্থার ঘোষণা দেন তখন থেকেই তারা আমাদের এটা মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না যে, জরুরী অবস্থা কেটে গেলেও একই নির্দেশনা এবং ‘সামাজিক দূরত্ব’ পালন করে যেতে হবে। খুব সহজভাবে বললে, সমাজের সংগঠিত হবার ক্ষেত্রে এই ‘সামাজিক দূরত্ব’ নতুন মূলনীতি হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বাস ভালো হোক বা মন্দ হোক, কেউ যখন প্রতিটি ক্ষেত্রে এটা মেনে চলতে থাকবে, তখন এটাকে আর বদলানো সম্ভব হবে না।


আমি যেহেতু আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্বের কথা ঘোষণা করেছি, সেকারণে মানুষের মর্যাদা রক্ষা করার মতন গুরুত্বপূর্ণ দায়ভার রয়েছে যাদের উপর, এই পর্যায়ে এসে তাদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। প্রথমেই বলতে চাই, চার্চের কথা। আমাদের সময়ে এসে ইতোমধ্যেই সত্যিকারের ধর্মে পরিণত হয়েছে যেই বিজ্ঞান, সেই বিজ্ঞানেরই সেবক হয়ে পড়েছে স্বয়ং চার্চ। আজ তারা বিজ্ঞানের ধামাধরার কাজ করে চলেছে এবং একইসাথে নিজের অত্যাবশ্যিক ন্যায়নীতিগুলো আমূল অস্বীকার করেছে। একজন পোপ আছেন যিনি নিজেকে ফ্রান্সিস নামে ডাকেন, অথচ তাঁর অধীনস্থ চার্চ আজকে ভুলে গেছে যে, ফ্রান্সিস একদিন কুষ্ঠরোগীদের আলিঙ্গন করেছিলেন। এটাও ভুলে গেছে যে, একজন অসুস্থ ব্যাক্তিকে দেখতে যাওয়া দয়ার কাজ। শহীদেরা আমাদের শিখিয়েছে যে, বিশ্বাস বলি দেবার চেয়ে বরং জীবন বলি দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং প্রতিবেশীকে অস্বীকার করার অর্থই হল বিশ্বাসকে অস্বীকার করা। এই চার্চ শহীদদের সেই শিক্ষাও ভুলে গেছে।


আরও এক শ্রেণীর লোক আছে যারা নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আমি আইনজ্ঞদের কথা বলছি। দীর্ঘকাল ধরে জরূরী অবস্থা জারির এই বেপরোয়া প্রয়োগে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এই জরুরী অবস্থা জারির মধ্যদিয়ে নির্বাহী ক্ষমতা মূলত আইনসভার(legislative) স্থলাভিষিক্ত হয় এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নীতি যা গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে সেই নীতিকেই নিশ্চিহ্ন করে। যাই হোক, এক্ষেত্রে, Fuher-এর ভাষায় বললে, প্রধানমন্ত্রী ও নাগরিক নিরাপত্তা প্রধানের বক্তব্যই আইনের স্থান দখল করে নিয়েছে এবং তারা সকল সীমানা অতিক্রম করে গেছে। বলা হয়েছিল যে, জরুরী অবস্থা জারির বাইরে গিয়ে স্বাধীনতার সীমিতকরণকে বজায় রাখবে। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব হবে তার কোনো সদুত্তর কেউ দিতে পারছেনা। স্বাধীনতার এই সীমিতকরণ জারী রাখবে কোন আইনের বলে? স্থায়ী জরুরী অবস্থা দিয়ে? সংবিধানের নিয়মনীতিসমূহ রক্ষা করা হচ্ছে কিনা তা যাচাই করার দায়দায়িত্ব আইনজ্ঞদের, অথচ তাঁরা সকলেই নীরব রয়েছে। Quaresileteiuristae in munuerevestro? (নিজেদের বিবেচ্য বিষয়ে আইনজ্ঞরা কেন নিশ্চুপ রয়েছে?)


আমি জানি এমন অনেকেই আছে যারা এটা বলতে দ্বিধা করবে না যে, এই ত্যাগ, এই বলিদান(যা অবশ্যই গুরুতর) আসলে নৈতিক নীতিমালার সূত্র মেনেই করা হয়েছে । তাঁদের আমি একটা নিয়মের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভালোকে রক্ষার জন্য অবশ্যই ভালোকে অস্বীকার করতে হবে এমন তত্ব আসলে ভ্রান্ত ও সাংঘর্ষিক।

স্বাধীনতা রক্ষার্থে স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করার ব্যাপারটা যেমন বেঠিক ও সাংঘর্ষিক।

____________

১৩ই এপ্রিল, ২০২০


অনুবাদকের টীকা


[i] আন্তিগোনে : ঈডিপাস, কলোনাসের ঈডিপাস ও আন্তিগোনে— গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিসের বিয়োগান্তক ত্রয়ী উপ্যাখ্যান। আন্তিগোনে নাটকে, রাজা হয়েই ক্রেয়ন ঘোষণা করেন পলিনেসেসের লাশ কেউ কবর দিতে পারবে না। যুদ্ধে নিহত আক্রমণকারী পলিনিকেসকে যথানিয়মে কবর দেয়া যাবে না বলে আদেশ জারী করেন। দেয়ার চেষ্টা করলে নিশ্চিত শাস্তি হবে মৃত্যু। কিন্তু আন্তিগোনে এই আইন অমান্য করে সমাহিত করেন নিজের ভাইকে। জেনেশুনেই আন্তিগোনে সিদ্ধান্ত নেন তিনি আইন অমান্য করবেন। ফলশ্রুতিতে জীবন্ত সমাহিত হতে হয় ঈডিপাস-কন্যা আন্তিগোনে’কে।


[ii] Vegetative State/Life : চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যবহৃত পরিভাষা। যখন একজন ব্যক্তি জীবিত আছেন কিন্তু চেতনার কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। এ অবস্থায় একজন বাহ্যিক কোন সাহায্য ব্যতীত হৃদক্রিয়া ও শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যেতে পারেন। এই অবস্থায় রোগীর কোনরূপ অর্থপূর্ণ সংবেদনশীলতা দেখা যায় না। তবে কখনো কখনো চোখ খুলতে, জাগ্রত হতে এবং নিয়মিত ঘুমাতে দেখা যায়।


[iii] reanimate : চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যবহৃত পরিভাষা। কোন মানুষ বা প্রাণীর অঙ্গ বিশেষের পুনরায় প্রাণ ফিরিয়ে আনা।


প্রথম প্রকাশঃ ১৭ই এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১৭ই এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/2794618110827962/