সংক্রমণ/প্রতিরোধ: সংকটের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে দুটি প্রশ্ন

জ্যাক রঁসিয়ে


[জ্যাক রঁসিয়ে (Jacques Rancière) ফরাসী দার্শনিক। লুই আলথুসার, এতিয়েঁন বালিবার ও অন্যান্য চিন্তকদের সাথে তিনিও সহ-লেখক ছিলেন বিখ্যাত Reading Capital (১৯৬৫) গ্রন্থের। আটষট্টির প্যারিসের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়ায় গুরু আলথুসারের সঙ্গ ছাড়েন। নন্দনতত্ত্ব-রাজনীতির সম্পর্ক বিচারে দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছেন। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে “সংক্রমণ/প্রতিরোধ: সংকটের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে দুটি প্রশ্ন” শিরোনামে ধারাবাহিক সংলাপ (সাক্ষাৎকারও বলতে পারেন) Institut français Italia ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। দুটি প্রশ্নের জবাবে নিজেদের অভিমত জানিয়েছেন ইতালীয় ও ফরাসি চিন্তক ও দার্শনিকেরা। দ্বিতীয় সংলাপে ফরাসী দার্শনিক জ্যাক রঁসিয়ে, আন্দ্রেয়া ইনজেরিল্লো’র প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। আন্দ্রেয়া ইনজেরিল্লো ইতালীয় ভাষায় অনূদিত জ্যাক রঁসিয়ে’র দুইটি গ্রন্থের সম্পাদক। Institut français Italia-তে ইতালীয় ও ফরাসি উভয় ভাষাতে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারটি ফরাসী থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় শিক্ষক, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান। ]



আরেকবার জানতে চাই: বেঁচে থাকার জন্যে সময়টা কেমন? অদ্ভুত, তাইনা? কেমন জানি এক পার্থিব ব্যাপার-স্যাপারের দিকে ইংগিত দেয় যা দিয়ে আমাদের অস্ত্বিত্ব গঠিত। ওদের কথাই ধরুন না যাদের প্রতিদিন রুটিরুজির জন্যে বেরোতে হচ্ছে কিংবা যাদের মাথার উপর ছাদ নেই। আবার ভাবুন ঐসব সৌভাগ্যবানদের কথা যারা এই বাড়তি সময়টা অন্যভাবে কাটানোর চিন্তায় মশগুল... সন্দেহ নেই, এই বিপদে ভেদাভেদ আরও বাড়লো, যদিও এই ভেদাভেদগুলোই সামাজ গঠনের ভিত্তি। সেই সাথে, আশাবাদীর ন্যায় আমরা কি ভাবতে পারিনা যে সময়ের এই ফোঁড়ে কিছু সুযোগ এসে পরবে। এই যেমন ধরুন, জাতীয় হোক আন্তর্জাতিক হোক, আমরা এক ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছি, আশেপাশের নায়কদের চিনে নিতে পারছি; বুঝতে পারছি এ এক বিপ্লবী মুহূর্ত। ফাঁকতালে সব পরিবর্তনের একটা সুযোগও মনে হয় নেয়া যায়। কি মনে হয় আপনার?


সমস্যা হলো, এই বন্দীদশা পার্থিব ব্যাপার-স্যাপার ভাগাভাগি করে নেয়ার ক্ষেত্রে ভালোই বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। একজন সাধারণ মাপের দোকানদারের কথা ধরা যাক। দোকান থেকে তার শহরতলীর বাসায় যাতায়াত করবে এমনটিও তার সাহসে কুলায় না। বরং দোকানে দিনাতিপাত করা তার কাছে মনে হয় শ্রেয়তর।


এই সময়টাতে স্বাস্থ্যসেবকদের প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু আমাদের সাথে তাদের সুখ-দুঃখের ভাগাভাগির কোনো সুযোগ নেই। ফলে, দুই শ্রেণীর মানুষ বর্তমান সময়ের আলাপে ঝড় তুলতে পারছে—সরকার বা শাসকদল আর বুদ্ধিজীবী। প্রথমোক্ত বা শাসক দল প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রথাগত ধ্যান-ধারণা আর হাতের নাগালের সুযোগ-সুবিধা মারফত জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার। যেমন ধরুন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জনসমাগম রোধ করা ইত্যাদি। আরেকদিকে আছে বুদ্ধিজীবীরা যারা ভাবছে, ইতিহাস বা মানুষের দৌরাত্ম্যের(anthropocene) সময় বুঝি ফুরিয়ে এলো। এরা রীতিমতো ঢোল পিটিয়ে বলা শুরু করেছে এই মহামারী সবকিছু আবার অন্যভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দিল। তাদের বিশেষ আক্রমণের লক্ষ্য অবশ্য, পুঁজিবাদের যুক্তি-শৃঙ্খল। তারা বলছে এই সময়টাতে মানুষ পুঁজিবাদের মুখোমুখি দাড়ানোর সু্যোগ পেল। আরো আগ বাড়িয়ে বললে, এই গ্রহের যে অধিকার মানুষ হরণ করেছিল তা ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগও পেল। বুদ্ধিজীবীদের মোদ্দাকথা হলো, এই মহামারীর শেষ যেন হয়, সব পরিবর্তনের নতুন শিক্ষা নিয়ে। দুখ:জনকভাবে, এরা আমাদের বলতেই ভুলে গেছে এই “সব পরিবর্তনের” নেতা হবে কে? আর হলেও ঠিক কতটা সময় দরকার এই বিশেষ পরিবর্তনের? (বলে নেয়া ভালো) এজেন্ডা আর তার বাস্তবায়ন মারফৎ কিন্তু রাজনৈতিক সময়ের হিশেব করা হয়। এই বন্দীদশায় ঐ হিশেবটাই মেলানো ভার। অনুমান করা দায়; ঠিক কবে সবার সেই কাঙ্ক্ষিত (লকডাউন) “পরবর্তী” সময় আসবে? ফলে, বর্তমান সময় আর ভবিষ্যত প্রেক্ষাপটে যে বিশ্লেষণ আমাদের সামনে হাজির করা হচ্ছে তা’তো নতুন কিছু নয়। এসব কথা ব্যতিক্রম রাষ্ট্রতত্ত্ব, সমাজ নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা, বিগ ডাটার আধিপত্য থেকে শুরু করে আগাগোড়া মানুষ এবং অমানুষের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাভাবনা পর্যন্ত আলোচনার ভেতরে মজুদ ছিল। লাভের লাভ যা হলো তা হচ্ছে, শাসক দল আর বুদ্ধিজীবীদের ছকে বাঁধা ভূমিকার মাঝখানের সুনির্দিষ্ট রেখাটি চোখে পড়ল। শাসক দলের নিকট এখন রাজনৈতিক সময় মানে জরুরী অবস্থা যা তারা সপ্তাহের গণ্ডি ধরে মাপছে যেখানে কোন সুনির্দিষ্ট পূর্বপরিকল্পনা নেই। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবিরা সমানে শতবর্ষের বুড়ো পুঁজির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অভিযোগের তালিকায় আছে মানুষের পৃথিবীব্যাপী দাপিয়ে বেড়িয়ে সব নষ্ট করে দেয়ার স্বভাবও (anthropocene)। তাদের দেখে মনে হয় এই ব্যাপারে মাতব্বরি করার মত একটি উপায়ই তারা বাতলে দিতে পারে; তাহল, সময়ের ঠিক “উল্টোস্রোতে” গমন। এই মুখোমুখি টানটান পরিস্থিতি হয়ত জিইয়ে থাকবে অনির্দিষ্টকাল। (আমার মনে হয়) পরিবর্তন কেবল তাদের দ্বারাই সম্ভব যারা সময়ের দাবীতে জেগে উঠে; যাদের কাজে সমাজ বেঁচে থাকে, যাদের নিকট সমাজ প্রতিটা ক্ষণের কাজের হিসেব দিতে বাধ্য। হ্যাঁ, তাদেরই কথা বলছি, যারা সময়ের প্রয়োজনে ছুটে যায় রাজপথে কিংবা রাস্তার মোড়ে, যারা থামিয়ে দিতে পারে কাজের স্বাভাবিক স্রোত আর যাদের ইশারায় সময় তার রূপ বদলায়। আর বাকি সব ভেল্কিবাজি।


আচ্ছা, আপনি তো কথার পিছে যে পরিস্থিতির ভার তা বুঝতে এবং তুলে ধরতে সিদ্ধহস্ত। ভাবছিলাম আপনি কোন যাদুবলে, ঐ শব্দ বা শব্দাবলী ধরতে পারেন যার ভেতরে আমাদের যাপিত জীবনের ঐতিহাসিক মূহুর্তগুলো বয়ে চলেছে? এই শক্তিশালী বয়ানসমূহ কি হাজির করছে তা বুঝে ওঠার ব্যাপারেও আপনার জুড়ি মেলা ভার। এখন তো জরুরী পরিস্থিতি আর সংকটময় মুহূর্ত বোঝাতে বেশ কিছু শব্দ আমরা ব্যাবহার করছি। (বলাই বাহুল্য, এমনটি মনে হতে পারে আমরা আপাতত এই শব্দসমূহের অধীন কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আমরা আমাদের দৈনন্দিন ব্যাবহার্য শব্দাবলীর মধ্যে এসব অন্তর্ভুক্ত করে নিব।) আর সময়ের প্রয়োজনে উঠে আসা এই শব্দগুলো এমন এক সময়ের ইংগিত করে যা জরুরী পরিস্থিতির ন্যায়, যা সম্মিলিতভাবে ঘাড়ে দায়িত্ব নেবার তাড়না দেয়। মাঝেমাঝে, একেবারে খোলাখুলিভাবে অনেকটা বাধ্য হয়ে আমরা যুদ্ধ পরিস্থিতির রুপকও ব্যবহার করছি। পরিস্থিতির চাপে সেনাবাহিনী বন্দনার জল্পনা-কল্পনাও চলছে; অবশ্য যত না ভাইরাস ঠেকানোর চিন্তায়, তার চাইতে বেশি গণমানুষ ঠেকানোর চেষ্টায়; তারও বেশী এক ধরনের শিক্ষা দেয়ার উছিলায়—বর্তমানের নয়, ভবিষ্যতের জন্যে।


মাফ করবেন, যদি মনে হয় আমি কারও অনুকরণে বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করছি। সকল কিছু সত্ত্বেও দীর্ঘদিন যাবত দুইটা জিনিস বলার চেষ্টা করছি। প্রথমত আমাকে দাঁড়াতে হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে যারা বলে, দুর্বলচিত্তের উপর ছবির প্রভাব বেশি। আমার বক্তব্য হলো আমরা কথা দ্বারা প্রভাবিত হই বেশি। যতই দৃঢ়চেতা হোক না কেন, সংকটময় কিংবা নিরাপত্তার সময়ে কথা বা শব্দ ঠিকই প্রভাবিত করে। আমি আমার লা মেসেনতন্ত (১৯৯৫)[La Messentante : Politique et Philosophy, যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায়, Disagreement : Politics and Philosophy] গ্রন্থে সম্মতি আদায়ের নামে পুলিশের শোষণক্রিয়ার রাজনীতির ব্যাপারটা সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছি। এই রাজনীতি এক সংকীর্ণ বাস্তবতার জগৎ হাজির করে, যেখানে আমাদের দৃষ্টি সংকীর্ণ হতে বাধ্য; যেখানে সমস্যা বলুন, সমস্যার নাম করণ বলুন, সমাধান বলুন সবই সংকীর্ণ মানে একমুখী। আমি ১৯৯০ সনে এই দৃশ্যপটের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছি। ঐ সময় এমন বাগাড়ম্বর শুরু হলো যে দেখে মনে হচ্ছিল এ তো বিপদ নয় যেন এক অতল গহ্বর; ব্যাপারটাই এমন, “খবরদার, এক পা’ও এগুবে না আর।” যেন সমাজের ঐ সংকটময় মুহূর্তে বুঝে শুনে লড়ে যেতে হবে দিনের পর দিন। (লাভের লাভ যা হল তা হচ্ছে) অর্থনৈতিক সংকট উঠলো চরমে। আসলে এ ছিল এক আবেগঘন স্থায়ী বাস্তবতা। এতে দরকার ছিল রাষ্ট্রীয় শক্তি আর ডাক্তারের কাজের সমন্বয়। দুই দলই কিন্তু নিরাময় আর ব্যবস্থাপনা দুই ব্যাপারেই ভালো বুঝত। কিন্তু ক্ষমতার মেডিক্যালাইজেন ভালোই বাঁধার সম্মুখীন হয় যখন রাষ্ট্রগুলো স্বাস্থ্য আর গবেষণায় বরাদ্দ কমিয়ে দেয়। “কল্যাণরাষ্ট্র” বিলীন হওয়ার মূহুর্তে ঘটে গেল আরেক ঘটনা: সামাজিক বিজয় আর সংগ্রাম হতে জন্ম নিল একাত্মতা; বিনিময়ে এলো ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন। পরিবর্তনের দাবি ছিল “সকলের জন্য নিরাপত্তা।” বেশ কয়েকবছর নিরাপত্তার ধুয়া তুলে সব পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যবস্থা হল। আর্থিক সমস্যা, সন্ত্রাসবাদ, পরিবেশ বিপর্যয়, মহামারী সহ সব সমস্যার যেন এক ওষুধ—নিরাপত্তা। আবার একই সুর ধরে যাবতীয় বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলল। বৈশ্বিক সমস্যা বলতে রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হতে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তি প্রদর্শনী সংক্রান্ত পরিস্থিতি সহ সকল সিদ্ধান্ত আর কার্যক্রম বোঝানো হচ্ছে। যেহেতু এগুলো নিরাপত্তা বিষয়ক আলাপ-আলোচনা, এসব বাঁধা দেয়ার কোন প্রশ্ন তোলাই অবান্তর। সত্যি বলতে কি মহামারী নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র কতৃক কথার ফুলঝুরি—এ আর নতুন কি! এটাও আবার স্বীকার করতে হয়, কথার জালের কারণে পরিস্থিতি ভালো নিয়ন্ত্রণে আছে। সমস্যা হল, ভবিষ্যতের ব্যাপারে এই মূহুর্তে কোন সিদ্ধান্তে আসা। তার উপরে আমাদের দেশে এখন আমরা যে নিয়মনীতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, তা আমার কাছে মনে হচ্ছে চীনা শক্তি যেইভাবে কম্পিউটার ব্যবহার করে নাগরিকদের আচার-আচরণ নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণ করে, অনেকটা তার মতো। বোঝা মুশকিল একই পরিস্থিতিতে আমরাও পরতে যাচ্ছি কিনা। কথায় আছে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আর এই কর্মসম্পাদন ভালো কখন হয় জানেন তো? যখন (হুকুম অমান্য করার শাস্তির) ঝুঁকি সবখানে (জালের ন্যায়) ছড়িয়ে আছে মনে হয়; যখন মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কর্তা ঠিক কোথা হতে নজরদারি করছে। যাই হোক, এটি আসলে টিকে থাকার প্রবৃত্তিও বলা চলে। একে বাগাড়ম্বরের শক্তি বা শিক্ষার ক্ষমতার নামে চালিয়ে দেয়া ঠিক হবেনা। এ ব্যাপারে যথার্থই বলেছে হবস: ব্যক্তি আর সার্বভৌমত্বের মাঝে তখনই সামাজিক চুক্তির অবসান ঘটে যখন শেষোক্তটি (মানে সার্বভৌমত্ব) ব্যক্তির নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়।


এই মহামারী পূর্বে দেখা সিনেমার মত দৃশ্যপটের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। (যা সম্প্রতি দেখা স্টিভেন সোডারবার্গের “Contagion” ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়)। যাই হোক, এই মিল-অমিলের চিন্তায় বিভোর থাকা বাস্তবে কোন কাজ দেবেনা, কারণ সিনেমার নীতিতে তো আর বাস্তব চলেনা। কয়েক সপ্তাহ যাবত দেখি ইন্টারনেট/অন্তর্জাল জুড়ে কালচারাল উৎপাদনের ছড়াছড়ি। এসব উৎপাদন আমাদের বাস্তব বুঝতে সাহায্য করতে পারত, কিন্তু এখন এসব দেখে আপনার মনে হবে, (এই মিডিয়া নির্গত বস্তু) আপনাকে সাংস্কৃতির ব্যাপারে এমন ধারণা দেবে যেন সংস্কৃতি ব্যাপারটা হল সংগতি আর সান্তনামূলক ব্যাপার। এই ইন্টারনেট আপনাকে এমন পথে হাঁটাবে যা আপনাকে নীরবতা কি তা বুঝতে দেবে না। ব্যাপারটা আরও ভয়ঙ্কর। আপনার লিখাতেই কিন্তু আপনি অসংখ্যবার দেখিয়েছেন কিভাবে শুধু দূরত্বের কারণে কোন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। বেশী মাথা না ঘামিয়ে ভাবছিলাম এই কয়দিন আপনার পড়াশোনা বা চিন্তাভাবনা কোন বিষয়াবলীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বা বেশী ব্যাখ্যা না করে, কোন বন্ধ দরজায় ইঙ্গিত করে আপনি বুঝিয়ে দিবেন এমনই কোন কিছুর মাঝে বন্দি আমরা।


সত্যি বলতে কি, আমার কাছে এই পরিস্থিতি ফারাকের কেন্দ্রীভূত ধারণার প্রতিনিধি মনে হয়। অবশ্যই এমন নিরাপত্তার কথা বলছিনা যা অন্যদের কাছ থেকে দূরে থাকার তাগিদ দেয়। বরং বুদ্ধিজীবীদের ফারাকের অবস্থানের কথা বলছিলাম। জানেনই তো যেকোন সমসাময়িক ঘটনায় এদের মতামতের গুরুত্ব দেয়া হয়। আমার মনে হয় সত্য বলার পরিস্থিতি তখনই সৃষ্টি হয় যখন যা দেখেছি আর বুঝেছি তা [অকপটে] বলা যায়। কথা এবং কাজের সামঞ্জস্যও রাখা যায়। ঠিক একারণেই আমার ঠিক বুঝে আসেনা কেনই বা আমার বেশ কিছু সহকর্মী হুটহাট করে সাংবাদিকদের চলতি সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্নের “সহজিকরণ” সমাধান দেয়ার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরা যেকোন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি সাধারণ কার্যকারণ ছাঁচে ফেলে অতীতের ঘটনার সাথে মিলিয়ে অনুমেয় করে তোলার ধান্দায় থাকে। একইসাথে প্রতিদিনের তথ্য-উপাত্ত ব্যবস্থাপনাসহ বিশ্ববীক্ষার সমান্তরালে এনে দাওয়াই দেয়ার চেষ্টা চলে অবিরত। বিস্ময় জাগে মনে যখন দেখি এদের অনেকেই মহামারীর অন্টোলজিকাল(সত্তাসম্বন্ধীয়) ধারণা দেয়া দূরে থাক, রীতিমতো এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু করে দিয়েছে। আরও হতবাক হয়ে যাই, যখন বুঝি এই জ্ঞানের পরিধি ওই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে যা আমাদের কম্পিউটার স্ক্রীনের সীমা ছাড়িয়ে যায়নি।[অর্থাৎ কম্পিউটার স্ক্রীনে আমরা যা দেখছি তাঁর উপর ভিত্তি করেই কথা বলছি।] আমি বরং যে সময়ে আছি তাতেই সেঁটে থাকতে পছন্দ করি। স্থবির সময়ের ভাবনা আমি বেশী ভাবতে চাইনা। একভাবে ভাবলে আমি এই থমকে যাওয়া সময় পার করছি অনেক বছরের পুরনো অভ্যাসটা জারী রেখে। এই [পাঠ] অভ্যাসের কারণেই তো পাঠাগার কিংবা আর্কাইভে কাটিয়েছি বছরের পর বছর, দ্বারস্থ হয়েছি প্রাচীন ভুলে যাওয়া গল্পের। যদিও এসব বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক আলাপ নয়। সাধু সিমোনিয়ানের কর্মীদের ১৯৩০ সনে রোববারের হাঁটা কিংবা জোসেফ জাকততের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত প্রস্তাবনা—“শিক্ষক ছাড়া মূর্খ ব্যক্তি একাই ভালো শিখতে পারে,”—এসব আলাপ বর্তমান পরিস্থিতিতে জমে না। এই গল্পগুল আমি বর্তমানের সাথে মিলিয়ে দেখেছি--সেই বর্তমান যা এই পুরনো কাহিনীর অপেক্ষা করেনা, সেই বর্তমান যা শুধু এই পোস্ট-ফোর্ডিস্ট জমানায় প্রলেতারিয়েতদের কি হল বা স্কুলগুলোতে কিভাবে বৈষম্য কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে মাথা ঘামায়। আমি কিন্তু ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রেখে বর্তমানের সাথে মিলিয়ে দেখছি। আমি কিন্তু এ সকল চিহ্ন বা চিত্র/দৃশ্যপট ইত্যাদির ফারাক রেখে অতীতের আলোকে বর্তমান দেখছি, যে সকল চিহ্ন বা দৃশ্যপট মারফত গণমাধ্যম আর পণ্ডিতেরা(Academics) আমাদের জন্য লাইসেন্স(homologated) প্রাপ্ত বাস্তবতা তৈরী করে। সবকিছু থেকে বা সবদিক হতে প্রভু বা মালিক পক্ষের মাতব্বরী থেকে রেহাই পেতে চাইলে কিছুটা দূর থেকেই সব বিচার বা প্রশংসা করা ভালো। এই মনোভাব নিয়েই এখন এই চরম অপ্রত্যাশিত সময় পাড়ি দিচ্ছি। মহামারীর জ্ঞান আমার শিল্পের নামে এ কি আমরা প্রত্যক্ষণ করছি? কিভাবেই বা শিল্প আর জীবন এই দুইয়ে মিলে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে দুইশতক ধরে। সম্প্রতি ল্যান্ড স্কেপের ইতিহাসের উপর একটি বই লিখেছি। ইতিমধ্যে আমার গবেষণার সাথে জড়িত—স্থাপত্য আর সঙ্গীত—এই দুই শিল্পের ব্যাপারেও আমাকে বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছে।


এই সুযোগে আমিও হেগেলের নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক লেখা বিভিন্ন অধ্যায়ে ডুব মেরে আসলাম। নিজের গ্রন্থাগার ছাড়া যেহেতু অন্য কোন গ্রন্থাগারে ঢুঁ মারার সুযোগ নেই, তাই এই চাপিয়ে দেয়া স্থবিরতার সুযোগ নিলাম। সব বইপত্র একদিকে নিয়ে বসলাম আর ভাবছিলাম, আর্টে কিভাবে এই কাছে দূরের ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করা হয়। অন্যদিকে, ঠিকঠাকভাবে কথা বলতে শেখা ছাড়াও, বিভিন্ন কবিদের লেখা পুনরায় পড়ছিলাম। এদের মধ্যে আছে ম্যান্ডেলস্টোন, আখমাতোভা, ভেতাইয়েত্তা। এরা নিজেদের কবিতায় যে সব দুঃখ দুর্দশা তারা দেখেছে বা যার শিকার হয়েছে—ঐসব কিছুই তুলে এনেছে। এছাড়া আপনি তাঁদের কবিতায় পাবেন, এসময়ের দূর্যোগের কথা যার জন্যে একমাত্র দায়ী মানুষ, অন্যের উপর মাতব্বরী করার তাঁর সর্বগ্রাসী তৃষ্ণা, সবদিক থেকে সবকিছু জানার ইচ্ছ, বলতে পারেন, এসবই করছি আজকাল। মনে হয়না, এর থেকে কারও কিছু শেখার আছে।

____________


প্রথম প্রকাশঃ ৩০শে মে, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৩০শে মে, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/399635857882716/