শত বছরের সঙ্কট

ইয়ুক হুই



[ইয়ুক হুই (Yuk HuiYuk Hui) সিটি ইউনিভার্সিটি অব হংকং-তে পড়ান। On the Existence of Digital Objects (২০১৬), Recursivity and Contingency(২০১৯) প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত। করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে তাঁর One Hundred Years of Crisis শীর্ষক লেখাটি গত এপ্রিলে প্রকাশিত হয়েছে e-Flux অনলাইন জার্নালে। ইয়ুক হুইয়ের এই লেখাটি অনুবাদ করেছেন তাহমিদ আলম ফিহাদ। তাহমিদ আলম ফিহাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী।]




"দর্শন যদি কখনও সহায়ক, নাজাতকারী কিংবা প্রতিষেধক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে থাকে, তাহলে সেটা হয়েছে কোন সুস্থ সংস্কৃতিতে। পীড়িতরা, একে কেবল পীড়িত’ই করেছে।"

— ফ্রেডরিখ নীটশে, Philosophy in the Tragic Age of the Greeks



১. “চেতনার সঙ্কটের” শতাব্দী

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে ফরাসী কবি পল ভ্যালেরি “চেতনার সঙ্কট”-এ লিখেছিলেনঃ “আমরা শেষের সভ্যতা’রা … আমরাও জানি যে আমরা নশ্বর।” শুধু এরকম বিপর্যয়ে এবং এরকম ঘটনার পরেই (as après coup) আমরা জানতে পারি যে, আমরা এক ঠুনকো সত্তা ছাড়া আর কিছুই না। একশো বছর পরে চীনের একটি বাদুড়—যদি করোনাভাইরাস আসলেই বাদুড় থেকে এসে থাকে—সারা পৃথিবীকে আরেকটা সঙ্কটের মধ্যে ধাবিত করেছে। ভ্যালেরি যদি এখনও বেঁচে থাকতেন, তাঁকে তাঁর ফ্রান্সের বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হতো না।


১৯১৯ সালের চেতনার যে সঙ্কট তার পূর্বে ছিল একটি নাস্তিবাদ (nihilism)। ছিল একটি শূন্যতা বা নাস্তি (nothingness) — যা ১৯১৪ সালের পূর্বের সময়ে ইউরোপকে তাড়া করে ফিরছিল। যুদ্ধ-পূর্ব কালে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা সম্পর্কে ভ্যালেরি লিখেছেনঃ “আমি দেখি…শূন্যতা! শূন্যতা… এবং তারপরেও একটি অসীম সম্ভাবনাময় শূন্যতা।” ভ্যালেরির ১৯২০ সালের কবিতা Le Cimetière Marin (সমুদ্রের পাশে সমাধিস্থল)-তে আমরা পাই ফ্রেডরিখ নীটশের ইতিবাচক ডাকঃ “বাতাস বাড়তে শুরু করেছে!...আমাদের অবশ্যই বাঁচার চেষ্টা করতে হবে!” পরবর্তীতে এই পঙক্তি’টিকে হায়ায়ো মিয়াজাকি তাঁর (জিরো হরিকোশি'কে নিয়ে বানানো) আ্যনিমেশন ফিল্মের শিরোনাম হিসেবে গ্রহণ করেন। জিরো হরিকোশি হচ্ছে সেই ইঞ্জিনিয়ার, যিনি জাপানী সাম্রাজ্যের জন্য যুদ্ধবিমানের নকশা তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে সেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই নাস্তিবাদ নীটশীয় একটি পরীক্ষা হিসেবে বারবার ফিরে আসেঃ একটা দৈত্য আমাদের সবচেয়ে একাকী একাকীত্বে হানা দেয় এবং জিজ্ঞেস করে আমরা একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার মধ্যে বাঁচতে চাই কিনা—সেই একই মাকড়সা, গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সেই একই চাঁদের আলো, এবং সেই একই দৈত্য(যে কিনা একই প্রশ্ন করে)। যে কোন দর্শন যা এই নাস্তিবাদের সাথে থাকতে পারে না এবং সরাসরি এটার মোকাবিলা করতে পারে না, তা কোন যথেষ্ট উত্তর প্রদান করে না। কেননা এমন দর্শন অসুস্থ সংস্কৃতিকে শুধু আরও অসুস্থই করে, অথবা আমাদের কালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরতে থাকা হাস্যকর দার্শনিক মিমে অপসৃত হয়।


যেই নাস্তিবাদের সাথে পল ভ্যালেরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, সেই নাস্তিবাদ আঠারো শতক থেকে চলে আসা প্রযুক্তিগত ত্বরণ (acceleration) এবং বিশ্বায়ন দ্বারা প্রতিনিয়ত পরিপুষ্ট হচ্ছিলো। যেমনটা ভ্যালেরি তাঁর প্রবন্ধের শেষ দিকে লিখেছেনঃ


“কিন্তু ইউরোপীয় চেতনা—অথবা অন্তত এটার সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়গুলো— কি সম্পূর্ণভাবে ছড়িয়ে (diffuse) যেতে পারবে? গণতন্ত্র, পৃথিবীর শোষণ, এবং প্রযুক্তির সাধারণ বিস্তার—এসব কিছু যা ইউরোপের অবস্থা হারানোর (deminutio capitis) পূর্বাভাস দেয়… এসবকে কি নিয়তির চরম সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে অবশ্যই?”


ছড়িয়ে পড়ার এই যে হুমকি—যা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ হয়তো ইউরোপ নিয়েছে— তার সম্মুখীন হওয়া ইউরোপের একার পক্ষে আর সম্ভব না। এবং সম্ভবত ইউরোপীয় “ট্র্যাজিস্ট(tragist, বিয়োগান্তক)” চেতনা দিয়ে আবারও সম্পূর্ণভাবে তা পরাস্ত করা, আর কখনই সম্ভব হবেনা। সবার প্রথমে “ট্র্যাজিস্ট” চেতনা গ্রিক ট্র্যাজেডির সাথে সম্পর্কিত। সেইসাথে এটি সেই চেতনা’র যুক্তি যেটা নিজের ভিতর থেকে উদ্ভূত স্ববিরোধিতা সমাধানের চেষ্টা করে। “এনলাইটেনমেন্টের সমাপ্তির পর কি শুরু হয়?” এবং অন্যান্য প্রবন্ধে, আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি কিভাবে একেশ্বরবাদ (এনলাইটেনমেন্টের সময় থেকে এবং একেশ্বরবাদের পতনের পর) মনো-টেকনোলজিসম (অথবা প্রযুক্তি-ঈশ্বরবাদ) (অথবা প্রযুক্তি-ঈশ্বরবাদ)[i] দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। মনো-টেকনোলজিসম(mono-technologism) আজকের দিনে ট্রান্সহিউম্যানিজম [ii] এ পরিণত হয়েছে। আমরা আধুনিকরা ইউরোপীয় হ্যামলেটের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারী। ভ্যালেরির “আত্মার সঙ্কটে” এরাই লাইবনিজ, কান্ট, হেগেল, মার্ক্সের মাথার খুলি গোণার মাধ্যমে ইউরোপীয় বৌদ্ধিক উত্তরাধিকারের দিকে ঘুরে তাকায়। এই আধুনিক আমরা ভ্যালেরির লেখার একশো বছর পরও বিশ্বাস করেছি এবং এখনও বিশ্বাস করি যে আমরা অমর হবো। বিশ্বাস করি যে আমরা আমাদের রোগ-প্রতিরোধব্যবস্থাকে সকল ভাইরাসের বিরুদ্ধে গড়ে তুলবো অথবা যখন সবচেয়ে খারাপটা ঘটবে, আমরা কেবল মঙ্গলগ্রহে পালিয়ে যাব। ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোধকল্পে এবং জীবন বাঁচাতে মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার গবেষণা এই করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। আমরা নশ্বরেরা যারা এখনও এই পৃথিবীতে বাস করছি, আমাদের হয়তো অমর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ হবে না। ট্রান্সহিউম্যানিস্টরা তাঁদের কর্পোরেট স্লোগানে যেমনটা বলেছেন, তেমন সুযোগ হবেনা। নীটশের পর, নাস্তিবাদের আরেকটা ফার্মাকোলজি [ঔষধবিজ্ঞানের ইংরেজি পরিভাষা ফার্মাকোলজি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ফার্মাকন (Pharmacon) থেকে, যার অনেকগুলি আভিধানিক অর্থের একটি হল “ঔষধ”, আরেকটি হচ্ছে “বিষ”।] লেখা এখনোও বাকি আছে। কিন্তু বিষটি ইতিমধ্যে বিশ্বের শরীরে ছড়িয়ে পরেছে এবং এর রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সঙ্কট তৈরি করেছে।


জ্যাক দেরিদার মতে (যার বিধবা পত্নী মার্গারেট দেরিদা সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেনযার বিধবা পত্নী মার্গারেট দেরিদা সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন), ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে[টুইন টাওয়ার] আক্রমণটি একটি অটো-ইমিউন (autoimmune) সঙ্কটের প্রকাশকে চিহ্নিত করে। এটা বহু যুগ ধরে স্থিতিশীল থাকা প্রযুক্তিভিত্তিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোকে দ্রবীভূত করে ফেলে ও অবসান ঘটায়ঃ একটি রূপান্তরিত কোষ বা ভাইরাসের মত ভিতর থেকে, একটি বোয়িং-৭৬৭’কে অস্ত্রের মত ব্যবহার করা হয়। একে ব্যবহার করা হয় সেই দেশের বিরুদ্ধেই যে দেশটি এর আবিষ্কারক। “অটো-ইমিউন” পরিভাষাটি শুধুমাত্র একটি জীববৈজ্ঞানিক রূপক। যখন একে রাজনৈতিক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়ঃ বিশ্বায়ন হচ্ছে এমন একটি বিশ্ব ব্যবস্থাপনা নির্মাণ, যার স্থিতিশীলতা নির্ভর করে প্রযুক্তিবিজ্ঞান এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের উপর। ফলস্বরূপ, ৯/১১ কে দেখা শুরু হয় একটি ছেদ হিসেবে। এনলাইটেনমেন্টের সময় হতে খ্রীষ্টিয় পশ্চিমাদের দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে এর মাধ্যমে। তৈরি করে একটি রোগ-প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটে একটি স্থায়ী ব্যতিক্রমি অবস্থায়—যুদ্ধের উপর যুদ্ধ। করোনাভাইরাস এখন এই রূপকের পতন ঘটিয়েছে—জীববৈজ্ঞানিক এবং রাজনৈতিক একাকার হয়ে গিয়েছে। ভাইরাসকে আটকে রাখতে শুধুমাত্র জীবাণুনাশক ও ওষুধ জড়িত না। বরং সামরিক বাহিনী মোতায়ন এবং দেশ, সীমানা, আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগ ও রেলপরিবহনের লকডাউনও জড়িত।


জানুয়ারির শেষে Der Spiegel পত্রিকা একটি সংখ্যা প্রকাশ করে। সংখ্যাটির শিরোনাম Coronavirus, made in china:Wenn die Globalisierung zur todlichen Gefahr wird [করোনাভাইরাস, চীনে উৎপাদিতঃ যখন বিশ্বায়ন হয়ে উঠে প্রাণঘাতী ঝুঁকি]। এটি প্রকাশিত হয় একজন চীনা ব্যক্তির ছবিসহ, যিনি অতিরিক্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম পড়ে একটা আইফোনের দিকে প্রায় চোখ বন্ধ অবস্থায় তাকিয়ে ছিলেন। মনে হয় যেন প্রার্থনা করছিলেন কোন ঈশ্বরের কাছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কোন সন্ত্রাসী আক্রমণ নয়—চীনে এর প্রথম সূত্রপাত হওয়া ছাড়া এখন অব্দি ভাইরাসটির উৎপত্তির কোন নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় নি— বরং এটি একটি অর্গানোলজিকাল [করোনাভাইরাস, চীনে উৎপাদিতঃ যখন বিশ্বায়ন হয়ে উঠে প্রাণঘাতী ঝুঁকি]। এটি প্রকাশিত হয় একজন চীনা ব্যক্তির ছবিসহ, যিনি অতিরিক্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম পড়ে একটা আইফোনের দিকে প্রায় চোখ বন্ধ অবস্থায় তাকিয়ে ছিলেন। মনে হয় যেন প্রার্থনা করছিলেন কোন ঈশ্বরের কাছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কোন সন্ত্রাসী আক্রমণ নয়—চীনে এর প্রথম সূত্রপাত হওয়া ছাড়া এখন অব্দি ভাইরাসটির উৎপত্তির কোন নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় নি— বরং এটি একটি অর্গানোলজিকাল(organologicalorganological) ঘটনা। এখানে একটি ভাইরাস উন্নত পরিবহনব্যবস্থার নেটওয়ার্কের সাথে নিজেকে যুক্ত করে ৯০০ কিলোমিটারের বেশি বেগে ভ্রমণ করতে থাকে। এটি এমনও একটি ঘটনা যা, মনে হচ্ছে আমাদেরকে ফিরিয়ে আনে জাতি দ্বারা সংজ্ঞায়িত একটি ভূ-রাজনীতি এবং জাতি-রাষ্ট্রের ডিসকোর্সে। ফিরে আসা বলতে আমি যা বুঝাচ্ছিঃ প্রথমত, করোনাভাইরাস সীমানার ঘটনা। এখানে একটি ভাইরাস উন্নত পরিবহনব্যবস্থার নেটওয়ার্কের সাথে নিজেকে যুক্ত করে ৯০০ কিলোমিটারের বেশি বেগে ভ্রমণ করতে থাকে। এটি এমনও একটি ঘটনা যা, মনে হচ্ছে আমাদেরকে ফিরিয়ে আনে জাতি দ্বারা সংজ্ঞায়িত একটি ভূ-রাজনীতি এবং জাতি-রাষ্ট্রের ডিসকোর্সে। ফিরে আসা বলতে আমি যা বুঝাচ্ছিঃ প্রথমত, করোনাভাইরাস সীমানার (border, জাতিরাষ্ট্রের সীমানাborder, জাতিরাষ্ট্রের সীমানা) অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছে বা প্রত্যর্পণ করেছে। এই বিষয়টা বিশ্ব পুঁজিবাদ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দ্বারা প্রণোদিত ক্রমবর্ধমান গতিশীলতার ফলে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বজুড়ে এই প্রাদুর্ভাব প্রকাশ করেছে যে, এখন পর্যন্ত বিশ্বায়ন শুধুমাত্র একটি মনো-টেকনোলজিকাল সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছে যেটি কিনা শুধুমাত্র একটি অটো-ইমিউন প্রতিক্রিয়া এবং বড় রকমের পশ্চাদপসরণের দিকে চালিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই প্রাদুর্ভাব এবং জাতি-রাষ্ট্রের ধারণায় প্রত্যাবর্তন, জাতিরাষ্ট্র ধারণাটিরই ঐতিহাসিক এবং সত্যিকারের সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত করে। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে ঢাকতে চেয়েছে অন্তর্নিহিত তথ্যযুদ্ধ দ্বারা, সীমান্তের বাইরে সম্প্রসারিত হয় এমন তথ্যবলয়র বিকাশ ঘটিয়েছে যেটি কিনা শুধুমাত্র একটি অটো-ইমিউন প্রতিক্রিয়া এবং বড় রকমের পশ্চাদপসরণের দিকে চালিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই প্রাদুর্ভাব এবং জাতি-রাষ্ট্রের ধারণায় প্রত্যাবর্তন, জাতিরাষ্ট্র ধারণাটিরই ঐতিহাসিক এবং সত্যিকারের সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত করে। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে ঢাকতে চেয়েছে অন্তর্নিহিত তথ্যযুদ্ধ দ্বারা, সীমান্তের বাইরে সম্প্রসারিত হয় এমন তথ্যবলয়(infosphereinfosphere) [iii] নির্মাণের মাধ্যমে। তবে একটি বৈশ্বিক ইমিউনোলজি নির্মাণের মাধ্যমে। তবে একটি বৈশ্বিক ইমিউনোলজি (immunologyimmunology) তৈরি না করে এর বিপরীতে বৈশ্বিক পরিসরের আপাত অনিশ্চিয়তাকে ব্যবহার করে এই তথ্যবলয়গুলো বায়োলজিক্যাল যুদ্ধ তৈরি না করে এর বিপরীতে বৈশ্বিক পরিসরের আপাত অনিশ্চিয়তাকে ব্যবহার করে এই তথ্যবলয়গুলো বায়োলজিক্যাল যুদ্ধ (biological warbiological war) পরিচালনা করে। এমন একটি বৈশ্বিক রোগ-প্রতিরোধবিদ্যা যেটি দ্বারা আমরা এই পর্যায়ের বিশ্বায়নের মোকাবিলা করতে পারবো, তা এখনও পাওয়া যায় নি। অবশ্য যদি এই মনো-টেকনোলজিক্যাল সংস্কৃতি চলতে থাকে তাহলে হয়তো এটাকে কখনই পাওয়া যাবে না।


২. একজন ইউরোপিয়ান স্মিট দেখে লাখ লাখ ভূত

২০১৬ সালে ইউরোপের উদ্বাস্তু সঙ্কটের সময়, দার্শনিক পিটার স্লটারডিক ২০১৬ সালে ইউরোপের উদ্বাস্তু সঙ্কটের সময়, দার্শনিক পিটার স্লটারডিক (Peter Sloterdijk) সিসেরো ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জার্মানির চ্যান্সেলর আ্যঞ্জেলা মার্কেলের সমালোচনা করে বলেছিলেনঃ “আমরা এখনো সীমান্তকে মহিমান্বিত করা শিখিনি…আজ হোক বা কাল, ইউরোপীয়’রা একটি অভিন্ন সীমান্ত নীতিমালা তৈরি করবে। পরিণামে, সীমানার আদেশগুলোই প্রভাবশালী হয়ে দেখা দিবে। যেহেতু নিজেকে ধ্বংসের বেলায় কোন নৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই।” জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের উচিৎ ছিল উদ্বাস্তুদের জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া—এই কথাটি বলে স্লটারডিক এমনকি যদি ভুলও করে থাকে, অতীতের দিকে তাকিয়ে একজন এটাও বলতে পারেন, সীমান্তের প্রশ্নটি যে ভালভাবে ভাবা হয় নি এই ব্যাপারে অন্তত স্লটারডিক সঠিক ছিলেন। রবার্তো এসপাজিতো পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যে সীমান্তের ক্রিয়াকলাপের বিষয়ে একটি বাইনারি যুক্তি প্রভাব বিস্তার করে আছেঃ যার একটি বর্হিশত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হিসেবে কঠিন নিয়ন্ত্রনের উপর জোর দেয়—যা নিজ এবং অপরের বৈপরিত্যের উপর ভিত্তি করা ইমিউনোলজির একটি ধ্রুপদী এবং স্বজ্ঞামূলক (intuitive) বোঝাপড়া। আরেকটি হচ্ছে, ব্যক্তিসমূহ ও পণ্যদ্রব্যের যাতায়াতের স্বাধীনতা প্রদানের জন্য এবং সম্মিলনের সম্ভাবনা তৈরি করার জন্য সীমান্তের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ প্রস্তাব করে। এসপোজিতো সুপারিশ করছেন যে, এই দুটি চরমপন্থার কোনটিই নৈতিকভাবে এবং প্রায়োগিক দিক থেকে অনভিপ্রেত নয়। এই বিষয়টি আজকের দিনে অনেকটাই সুস্পষ্ট।


চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল নভেম্বরের মাঝামাঝিতে। জানুয়ারির শেষে এর সতর্কবার্তা ঘোষিত হয়। জানুয়ারির ২৩ তারিখে উহান শহর লকডাউন করা হয় এবং অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সীমানা নিয়ন্ত্রণের দিকে [বিশ্বের দেশগুলো] ধাবিত হয়। এর শিকার হয় চীনা’রা, এমনকি এশীয়দের মত দেখতে মানুষেরাও। এদের চিহ্নিত করা হয় ভাইরাসের বাহক হিসেবে। ইতালি ছিল সেসব দেশগুলোর একটি যারা সবার প্রথম চীনে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ইতিমধ্যেই জানুয়ারির শেষের দিকে রোমের সান্টা সিসিলিয়া কনজারভেটরি “প্রাচ্যদেশীয়” ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস করা স্থগিত করে, এমনকি যারা কোনদিন চীনে যায়নি তাঁদেরও। এই কাজগুলো—যেগুলোকে আমরা রোগ প্রতিরোধমূলক বলতে পারি—করা হয়েছে ভয় থেকে, তবে আরও মৌলিকভাবে অজ্ঞতা থেকে।


গুয়াংডং প্রদেশের শেনজেন শহরের (এই অঞ্চলটি হুবেই প্রদেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি যেসব এলাকায় ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তার একটি) ঠিক পাশে অবস্থিত হংকং’য়ে দৃঢ়স্বরে সরকারকে জোর করা হয়েছিল চীনের সাথে সীমান্তটি বন্ধ করে দিতে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের উপর ভ্রমণ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা থেকে বিরত থাকার যে উপদেশ দেয়, হংকং সরকার তা উদ্ধৃত করে বিষয়টি নাকচ করে দেয়। চীনের দুটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের একটি হিসেবে, হংকং (Hongkong SAR) চীনের বিরোধিতা করতে পারে না এবং চীনের সাম্প্রতিক প্রবল অর্থনৈতিক বিকাশের বোঝাও বাড়াতে পারে না। তারপরেও, হংকং-এর কিছু রেস্টুরেন্ট তাদের দরজায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে এই ঘোষণা দিয়ে যে, মান্দারিন বলা ব্যক্তিরা আমন্ত্রিত নন। মান্দারিন চীনের মূলভূখন্ডের ভাইরাস বাহক চীনাদের সাথে সম্বন্ধযুক্ত। সেকারণে ভাষাটি বিবেচিত হয় একটি বিপদের চিহ্ন হিসেবে। সাধারণ অবস্থায় একটি রেস্টুরেন্ট যেটি খোলা থাকে সামর্থ্য আছে এমন সকল মানুষের জন্য, তা এখন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য খোলা থাকবে।


সকল ধরনের বর্ণবাদই(racism) মৌলিকভাবে রোগ-প্রতিরোধমূলক। বর্ণবাদ একটি সামাজিক অ্যান্টিজেন, যেহেতু এটি নিজ এবং অন্যকে পরিষ্কারভাবে আলাদা করে এবং অন্যের দ্বারা সৃষ্ট যেকোন অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখায়। তবে সকল রোগ-প্রতিরোধমূলক ক্রিয়াকেই বর্ণবাদ বলা যায় না। যদি আমরা এই দুইয়ের মধ্যে যে দ্ব্যর্থবোধকতা তার মুখোমুখি না হই, সবকিছুকে আমরা নিমজ্জিত করবো রাত্রির গভীরে—যেখানে সকল গরুর রঙ ধূসর। একটি বৈশ্বিক মহামারীর ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়া বিশেষতই অনিবার্য, যেখানে কিনা আন্তঃমহাদেশীয় বিমান ও রেল যোগাযোগ দ্বারা সংক্রমণ ছড়ানোটা সহজতর। উহান বন্ধ হওয়ার আগে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক উহান ছেড়ে অন্যান্য জায়গায় যায়। এবং অনিচ্ছুকভাবেই শহরের বাইরে ভাইরাসটি বহন করে নিয়ে যায়। বাস্তবিকভাবে, একজন লোক উহান থেকে আসা কিনা তা আসলে অপ্রাসঙ্গিক, যেহেতু সকলেই হতে পারে সন্দেহভাজন। এই বিচারে যে কোন লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই ভাইরাসটি বেশ কিছুদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং এ সময় ভাইরাসটি সারাক্ষণ তার আশপাশকে সংক্রমিত করতে থাকে। যখন জেনোফোবিয়া এবং মাইক্রো-ফ্যাসিজম রাস্তায় এবং রেঁস্তোরায় সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠে, তখন একজন মানুষ রোগ-প্রতিরোধমূলক মুহূর্তগুলো থেকে সহজে রেহাই পায় নাঃ যখন আপনি অনিচ্ছকৃতভাবেই কাশি দেন, সবাই আপনার দিকে তাকায়। অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি এখন মানুষ চায় একটি রোগ-প্রতিরোধক্ষেত্র(immunosphere)—পিটার স্লটারডিক যেটার প্রস্তাব দিয়েছেন—সুরক্ষা ও সামাজিক সংগঠন হিসেবে।


দেখা যাচ্ছে যে রোগ-প্রতিরোধমূলক কাজগুলো, যেগুলোকে শুধুমাত্র বর্ণবাদী আচরণে হ্রাস করা যায় না, সেগুলো সীমান্তের ধারণায় ফিরে যাওয়াকে ন্যায্যতা দান করে—ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং জাতীয় সীমান্ত। জীববৈজ্ঞানিক রোগ-প্রতিরোধবিদ্যায় এবং রাজনৈতিক রোগ-প্রতিরোধবিদ্যায় নিজ-অপর প্যারাডাইম এবং অর্গানিজমিক (organismic) প্যারাডাইমের উপর বহু বছরের বিতর্কের পর, আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ প্রতিরোধের সবচেয়ে সহজ এবং স্বজ্ঞামূলক রূপ হিসেবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রনেই ফিরে গেছে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রনেই ফিরে গেছে, এমনকি যখন শত্রুকে দেখাও যায় না। বাস্তবিকভাবেই, আমরা শুধুমাত্র শত্রুর অবতারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। এইখানটায় আমরা সকলে, কার্ল স্মিট যাকে বলেছেন রাজনৈতিক (political), যা সংজ্ঞায়িত হয় শত্রু এবং বন্ধুর পার্থক্য দ্বারা, তার দ্বারা আবদ্ধ। এমন একটি সংজ্ঞা যাকে সহজে অস্বীকার করা যায় এবং যা সম্ভবত একটি বৈশ্বিক মহামারীর সময় আরও শক্তিশালী হয়। যখন শত্রুকে দেখা যায় না, তখন একে একটি রুপ (incarnation) দিতে হয় এবং চিহ্নিত করতে হয়ঃ প্রথমে চীনাদের, এশীয়দের, এবং তারপর ইউরোপীয়দের, উত্তর-আমেরিকার অধিবাসীদের; অথবা চীনের ভিতর উহানের বাসিন্দাদের। জেনোফোবিয়া জাতীয়তাবাদকে পরিপুষ্ট করে—হয় নিজ হিসেবে (যে কিনা জেনোফোবিয়াকে একটি অনিবার্য রোগ-প্রতিরোধমূলক ক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে) অথবা অপর হিসেবে (যে জেনোফোবিয়া ব্যবহার করে ইমিউনোলজি রুপে নিজের জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে)।


লীগ অব নেশনস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে গঠন করা হয়। যুদ্ধরোধের একটি কৌশল হিসেবে সকল জাতিকে একটি সাধারণ সংগঠনে একত্রিত করে একে গঠন করা হয় এবং পরবর্তীতে এটির উত্তরাধিকার হয় জাতিসংঘ। [কার্ল] স্মিট সম্ভবত এ পদক্ষেপের সঠিক সমালোচনাই করেছেন এই বলে যে, লীগ অফ নেশনস (গতবছর যার জন্মের একশো বছর পার হলো) ভুলভাবে মানবতাকে বিশ্বরাজনীতির সাধারণ ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, যেখানে মানবতা কোন রাজনৈতিক ধারণা না। বরং, মানবতা একটি বিরাজনীতিকরণের ধারণা। যেহেতু একটি বিমূর্ত মানবতা যার কোন অস্তিত্ব নেই, তা “শান্তি, ন্যায়বিচার, প্রগতি এবং সভ্যতার অপব্যবহার করে এগুলোকে নিজের বলে দাবী করতে পারে এবং শত্রুকে এগুলো থেকে বঞ্চিত করতে পারে।” যেমনটা আমরা জানি, লীগ অব নেশনস ছিল বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের একটি দল, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (যা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়গুলোর একটি) রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এবং সেকারণে জাতিসংঘ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। একই যুক্তি কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার(WHO) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়? একটি বৈশ্বিক সংগঠন যার কিনা রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যার ব্যাপারে সতর্কতা, উপদেশ এবং দিকনির্দেশনা দেয়ার কথা ছিল? করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোন ধরনের ইতিবাচক ভুমিকা না থাকার ব্যাপারটি—যদি না সেটাকে নেতিবাচক ভূমিকা বলিঃ এর জেনারেল ডিরেক্টর এটিকে বৈশ্বিক মহামারী বলতেও অস্বীকার করছিলেন, যতদিন না পর্যন্ত আসল ব্যাপারটি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে—বিবেচনা করলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রয়োজনটা কি আসলে? স্বাভাবিকভাবেই, যারা সংগঠনের ভিতরে এবং সংগঠনের সাথে কাজ করছে, তাদের কাজ অগণিত সম্মানের দাবীদার। কিন্তু তারপরেও করোনাভাইরাসের ব্যাপারটি বৃহৎ সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে যে সঙ্কট রয়েছে তা উন্মোচিত করেছে। তারচেয়েও বাজে ব্যপার হল, এমন একটি বৃহৎ বৈশ্বিক পরিচালনা পর্ষদ, একটি টাকা পোড়ানোর মেশিন। এটার সমালোচনা আমরা কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেই করতে পারি, ঠিক যেন বাতাসে চিৎকার করার মত। কিন্তু কারোর কিছু পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই, যেহেতু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো সংরক্ষিত রাষ্ট্রগুলোর জন্য।


৩. মনো-টেকনোলজিসম এর বিরূপ অন্তহীনতা

আমরা যদি [কার্ল] স্মিটকে অনুসরণ করি, তাহলে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা প্রাথমিকভাবে একটি বিরাজনীতিকরণ যন্ত্র। যেহেতু করোনাভাইরাসের সম্পর্কে সতর্ক করার ব্যাপারে এটার যে কাজ তা যেকোন সংবাদসংস্থা আরও ভালভাবে করতে পারতো। বাস্তবিকই, পরিস্থিতির উপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শুরুর দিকের মতামত অনুসরণ করে বেশ কিছু রাষ্ট্র অনেক দেরীতে পদক্ষেপ নেয়। যেমনটা স্মিট লিখেছেন, একটি আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পরিচালনা পরিষদ (যা মানবতার নামে গঠিত) “যুদ্ধের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে না। ঠিক যেমনভাবে উচ্ছেদ করেনা রাষ্ট্রব্যবস্থা। বরং এটি যুদ্ধের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার অনুমতি দেয়। কোয়ালিশন ওয়ার-এর সম্মতি প্রদান করে। কিছু নির্দিষ্ট যুদ্ধের অনুমোদন দেয়া এবং সেগুলো বৈধ করার মাধ্যমে যুদ্ধের জন্য যে সকল প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলোকে একেবারে সরিয়ে দেয়।” বিশ্বশক্তিসমূহ এবং ক্রমাগত পরিবর্তনীয় পুঁজি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যেভাবে বিশ্ব পরিচালনা পরিষদগুলোকে কৌশলে নিয়ন্ত্রন করছে, তা কি এই যুক্তিরই ধারাবাহিকতা নয়? এই ভাইরাস (যা শুরুতে নিয়ন্ত্রযোগ্য ছিল), এটা কি পৃথিবীকে একটি বৈশ্বিক যুদ্ধাবস্থায় নিমজ্জিত করেনি? পরিবর্তে, এই সংগঠনগুলো বিশ্বব্যাপী অসুস্থতাকে বৃদ্ধি করে, যেখানে মনো-টেকনোলজিক্যাল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সামরিক বাহিনীর বিস্তারই মূল লক্ষ্য, যা মানুষকে তার বসতভিটা—যার মূল পৃথিবীর গভীরে নিহিত—থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং একে একটি কাল্পনিক পরিচয় দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে। এই পরিচয় আবার আকৃতি পায় আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র এবং তথ্যযুদ্ধ দ্বারা।


মূলত ব্যতিক্রমী অবস্থা বা জরুরী অবস্থা ধারণাটির উদ্দেশ্য ছিল সার্বভৌম যেন কমনওয়েলথকে অনাক্রম্য (immunize) করতে পারে। কিন্তু নাইন-ইলেভেনের পর থেকে এটি রাজনৈতিক স্বাভাবিকতায় (norm) পরিণত হচ্ছে। জরুরী অবস্থার স্বাভাবিকীকরণ শুধুমাত্র সার্বভৌমের চূড়ান্ত ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ নয়। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রসমূহ যে তাদের অধিকারে থাকা সকল রকমের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক মাধ্যম ব্যবহার করে সীমান্ত স্থাপন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই বৈশ্বিক অবস্থার মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে এবং তাতে ব্যর্থ হচ্ছে, এটি তারও বহিঃপ্রকাশ। সীমান্ত নিয়ন্ত্রন শুধুমাত্র তখনই একটি কার্যকরী রোগ-প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যখন কেউ ভূ-রাজনীতিকে বুঝে সীমারেখা দ্বারা সংজ্ঞায়িত সার্বভৌমের বিচারে। স্নায়ুযুদ্ধের পর ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগীতা একটি মনো-টেকনোলজিক্যাল সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে যা অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মধ্যে কোন ভারসাম্য রক্ষা করে না। বরং এগুলোকে একত্রিত করে একটি ধ্বংসাত্মক শেষবিন্দুর দিকে ধাবিত হয়। মনো-টেকনোলজি ভিত্তিক প্রতিযোগিতা পৃথিবীর সম্পদসমূহ নিঃশেষ করে দিচ্ছে এবং এটি অন্য প্রতিযোগীকেও ভিন্ন দিক এবং পথ গ্রহণে বাধা দেয়—যে “প্রযুক্তি-বৈচিত্র্য” র জন্ম দিয়েছে যা অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মধ্যে কোন ভারসাম্য রক্ষা করে না। বরং এগুলোকে একত্রিত করে একটি ধ্বংসাত্মক শেষবিন্দুর দিকে ধাবিত হয়। মনো-টেকনোলজি ভিত্তিক প্রতিযোগিতা পৃথিবীর সম্পদসমূহ নিঃশেষ করে দিচ্ছে এবং এটি অন্য প্রতিযোগীকেও ভিন্ন দিক এবং পথ গ্রহণে বাধা দেয়—যে “প্রযুক্তি-বৈচিত্র্য” (techno-diversity)-এর ব্যাপারে আমি ব্যাপকভাবে লিখেছি। প্রযুক্তি-বৈচিত্র্য মানে শুধুমাত্র এই নয় যে ভিন্ন ভিন্ন দেশ একইরকম প্রযুক্তি (মনো-টেকনোলজি) ভিন্ন ভিন্ন নামে এবং কিছু ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়ে উৎপাদন করছে। বরং, এটি নির্দেশ করে বহু ধরনের কসমোটেকনিকস[iv]-এর দিকে যেগুলো একটি আরেকটি থেকে মূল্যবোধ, জ্ঞানতত্ব এবং অস্তিত্বের রুপের (forms of existence) প্রেক্ষিতে ভিন্ন। প্রতিযোগীতার বর্তমান রূপকে—যা রাজনীতিকে অগ্রাহ্য করার জন্য অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে—প্রায়ই নয়া-উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এবং এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ট্রান্সহিউম্যানিজম রাজনীতিকে বিবেচনা করে শুধু একটি মানবতাবাদী জ্ঞানতত্ব হিসেবে যা কিনা প্রযুক্তিগত ত্বরণ(technological acceleration) দ্বারা শীঘ্রই পরাস্ত হবে। আমরা আধুনিকতার একটা অচল অবস্থায় পৌঁছাই যেখানে একজন মানুষ এই প্রতিযোগিতা ত্যাগ করতে পারে না এই ভয়ে যে অন্যরা তাকে ছাড়িয়ে যাবে। এটা যেন নীটশের বর্ণিত আধুনিক মানবের রূপকের মতঃ একদল মানুষ অসীমকে খোঁজার উদ্দেশ্যে চিরতরে তাঁদের গ্রাম ছেড়ে এক সমুদ্রযাত্রায় পাড়ি জমায়, কিন্তু সমুদ্রের মাঝে এসে উপলব্ধি করে যে অসীম কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নয়। এবং যখন কোন উপায় থাকে না আর পিছে ফিরে যাওয়ার, তখন অসীমের চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।


অন্য সব বিপর্যয়ের মত, করোনাভাইরাসও আমাদের বাধ্য করতে পারে চিন্তা করতে যে আমরা কিসের দিকে আগাচ্ছি। যদিও আমরা জানি যে, আমরা একটি শূন্যগর্ভের দিকে আগাচ্ছি। তারপরেও, আমরা চালিত হয়েছি “বাঁচতে চেষ্টা করার” একটি ট্র্যাজিস্ট আবেগ দ্বারা। এই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে রাষ্ট্রের আগ্রহ আর তার নাগরিকদের (subject) উপর নেই, বরং তা রয়েছে অর্থনৈতিক বিকাশের উপর—নাগরিকদের যা কিছু তত্ত্বাবধান করা তা কেবল অর্থনৈতিক বিকাশে তাঁদের অবদানের জন্য। এই ব্যপারটি স্বতঃপ্রমাণিত হয়, যখন চীন করোনাভাইরাসের সংবাদ লুকাতে চেষ্টা করে এবং শি জিনপিং—ভাইরাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে—এই সতর্কবাণী দেয়ার পর নতুন সংক্রমণের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে শূণ্যে নেমে আসে। এটি সেই একই নিষ্ঠুর অর্থনৈতিক যুক্তি, যার কারণে অন্য দেশগুলো অপেক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ প্রতিরোধমূলকব্যবস্থা যেমন ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যার বিরুদ্ধে উপদেশ দিয়েছিল), বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং পরীক্ষা, এবং অলিম্পিক গেমস মুলতবি করা ইত্যাদি পর্যটন ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে।


এশীয় “কর্তৃত্বপরায়ণ পদ্ধতি” এশীয় “কর্তৃত্বপরায়ণ পদ্ধতি” (authoritarian approach) এবং পশ্চিমা দেশগুলোর বাহ্যত উদার/মুক্তিপরায়ণ/গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যাপারে অনেক সংবাদমাধ্যম এবং সেই সাথে অনেক দার্শনিকও কিছুটা বালকসুলভ যুক্তি দেখিয়েছেন। চীনা (বা এশীয়) কর্তৃত্বপরায়ণ পদ্ধতি—যা প্রায়শই কনফুসীয় ভেবে ভুল বোঝা হয়, যদিও কনফুসিয়াসবাদ একেবারেই কর্তৃত্বপরায়ণ বা দমনমূলক দর্শন নয়—ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ভোক্তা নজরদারি প্রযুক্তি (চেহারা সনাক্তকরণ [facial recognition], মোবাইল ডাটা বিশ্লেষণ ইত্যাদি) ব্যবহার করে ভাইরাসের সংক্রমণ চিহ্নিত করার মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়। ইউরোপে যখন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, তখনও ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করা হবে কিনা তা নিয়ে তর্ক চলছিল। কিন্তু আমাদেরকে যদি সত্যিই “এশিয়ান কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন” এবং “পশ্চিমা উদার/মুক্তিপরায়ণ শাসন”-এর মধ্যে নির্বাচন করতে হয়, তাহলে এশীয় কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন দুর্যোগের সম্মুখীন হতে বেশি রাজি ছিল। যেহেতু এই বৈশ্বিক মহামারী রোধে মুক্তিপরায়ণবাদী পদ্ধতি অপরিহার্যভাবে ইউজেনিসিস্ট*, যা স্ব-নির্বাচনের (self-selection) মাধ্যমে বয়স্ক জনগণদের দ্রুত লোপ পেতে দেয়। তাছাড়া, এই ধরনের সকল সাংস্কৃতিক সারসত্তাবাদী (essentialist, নির্যাসবাদী) বিরোধিতাগুলো বিভ্রান্তিকর, যেহেতু এগুলো বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি ও স্বতঃস্ফুর্ততা এবং পরিবার ও বয়স্কদের প্রতি মানুষের নৈতিক দায়িত্বের বৈচিত্র্যকে অগ্রাহ্য করে। তারপরও বলতে গেলে, এই ধরনের অজ্ঞতা নিজের শ্রেষ্ঠত্বের নিরর্থক অভিব্যক্তির জন্য জরুরী।


কিন্তু আমাদের এই সভ্যতা আর কোন দিকে যেতে পারে? এই প্রশ্নটি যে মাত্রার, তা আমাদের কল্পনাকে প্রায় পুরোপুরি বিহ্বল করে ফেলেএবং শেষ আশ্রয় হিসেবে এই আশায় আমাদের রেখে যায় যে আমরা একটি “স্বাভাবিক জীবন”-এ ফিরে যেতে পারবো—এ স্বাভাবিক জীবনের মানে যাই হোক না কেন। বিংশ শতাব্দীতে বুদ্ধিজীবীরা, রাজনীতির স্মিটীয় ধারণাকে অতিক্রম করার জন্য অন্য ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পন্থার খোঁজ করেছেন। যেমনটা করেছেন জ্যাক দেরিদা, তাঁর বন্ধুত্বের রাজনীতি বইতে। এখানে দেরিদা বন্ধুত্বের ধারণাকে অবিনির্মাণ (deconstruction*) করার মাধ্যমে স্মিটের ধারণার উত্তর দিয়েছেন। অবিনির্মাণ বন্ধুত্ব এবং গোষ্ঠীর মধ্যে একটি সত্ত্বাতাত্ত্বিক (ontological) পার্থক্যের দরজা খুলে দেয় এবং বন্ধু-শত্রুর বৈপরীত্যকে ছাড়িয়ে—যে বৈপরীত্য বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক তত্ত্বের একটি ভিত্তি— অন্য রাজনীতির পরামর্শ দেয়, যার নাম আতিথেয়তা (Hospitality)। “নিঃশর্ত” এবং “হিসাববিহীন” আতিথেয়তা—যাকে আমরা বন্ধুত্ব বলতে পারি—সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করার জন্য ভূ-রাজনীতিতে ধারণা হিসেবে গ্রহণ করা যায়, যেমন জাপানিজ অবিনির্মাণবাদী দার্শনিক কোজিন কারাতানি (Kōjin Karatani) যখন দাবি করেছিলেন যে কান্টের চিরস্থায়ী শান্তির স্বপ্ন শুধুমাত্র তখনই বাস্তবায়ন সম্ভব যখন সার্বভৌমত্বকে উপহার স্বরূপ দেয়া যায়— মার্সেল মাউসের (Maussian) গিফট ইকোনমি* হিসেবে, যা বিশ্ব পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যকে অনুসরণ করবে। তবে, এই ধরনের সম্ভাবনার পূর্বশর্ত হচ্ছে সার্বভৌমত্বের উচ্ছেদ। অর্থাৎ অন্যভাবে বলতে গেলে, জাতি-রাষ্ট্রের উচ্ছেদ। কারাতানি’র মতে, এর জন্য প্রয়োজন একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরেই একটি আন্তর্জাতিক পরিচালনা পরিষদ (যার ক্ষমতা হবে জাতিসংঘের চেয়ে বেশি)। এমনকি অ্যাঞ্জেলা মারকেলের উদ্বাস্তু নীতি এবং দেং শিয়াওপিং (Deng Xiaoping) দ্বারা গৃহীত অসাধারণ “এক দেশ, দুই নীতি” কোন যুদ্ধ ছাড়াই এই দিকে আগাচ্ছে।[দেং শিয়াওপিংয়ের] পরের ব্যবস্থাটির মধ্যে একটি ফেডারেল সিস্টেমের এর চেয়েও বেশি আকর্ষনীয় এবং বাস্তবধর্মী গঠনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু পূর্বতনটি ভয়াবহ আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে এবং পরেরটি সঙ্কীর্ণ চিন্তার জাতীয়তাবাদী এবং মতান্ধ স্মিটীয়দের দ্বারা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। যদি কোন দেশই এগিয়ে না আসতে চায়, তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই দ্রুততম উপায়।


এইদিন আসার পূর্বে, এবং আরও গুরুতর বিপর্যয় যা আমাদের বিলুপ্তির কাছে নিয়ে যাবে (যেটা আমরা এখুনি অনুভব করতে পারছি) সেটি আসার পূর্বেই, আমাদের হয়তো জিজ্ঞেস করা দরকার একটি “অর্গানিজমিক” বিশ্ব রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা—যা শুধু করোনাভাইরাসের সাথে সহাবস্থান করার কথাই বলে না— সেটা কেমন হতে পারে। যদি আমরা চাই বিশ্বায়ন অব্যাহত থাকুক এবং তা হোক আরও কম স্ব-বিরোধী উপায়ে, তা হলে কি ধরনের কো-ইমিউনিটি এবং কো-ইমিউনিজম (একটি নয়াপরিভাষা যা দার্শনিক পিটার স্লটারডিক প্রস্তাব করেছেন) সম্ভব? স্লটারডিকের কো-ইমিউনিটির কৌশলটি আকর্ষণীয়, তবে রাজনৈতিকভাবে পরষ্পরবিরোধী—সম্ভবত এই কারণেও যে তাঁর মূখ্য কাজগুলোতে এটার যথেষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি— যা কিনা অতি-ডানপন্থী (একটি নয়াপরিভাষা যা দার্শনিক পিটার স্লটারডিক প্রস্তাব করেছেন) সম্ভব? স্লটারডিকের কো-ইমিউনিটির কৌশলটি আকর্ষণীয়, তবে রাজনৈতিকভাবে পরষ্পরবিরোধী—সম্ভবত এই কারণেও যে তাঁর মূখ্য কাজগুলোতে এটার যথেষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি— যা কিনা অতি-ডানপন্থী জার্মানীর জন্যে বিকল্প (Alternative für Deutschland-AfD) দলের সীমান্ত রাজনীতি এবং রবার্তো এসপাজিতোর সংক্রমিত প্রতিরোধব্যবস্থা্র (contaminated immunity) মধ্যে দোল খায়। তবে সমস্যাটি হচ্ছে আমরা যদি এখনও জাতি-রাষ্ট্রের যুক্তি অনুসরণ করি, আমরা কখনই কো-ইমিউনিটি’তে পৌঁছাতে পারব না। শুধুমাত্র এইজন্য না যে একটা রাষ্ট্র কোন কোষ বা জীব নয়(তাত্ত্বিকদের জন্য এই রূপকটি যতই প্রায়োগিক এবং আকর্ষনীয় হোক না কেন), বরং আরও মৌলিকভাবে বললে এজন্যও যে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাটাই শুধুমাত্র বন্ধু এবং শত্রু ভিত্তিক একটি রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, সেটা কোন আন্তর্জাতিক সংগঠন বা পরিষদের রূপ নিক বা না নিক। আধুনিক রাষ্ট্রের (যা লেভিয়াথানের মত সকল নাগরিকদের দ্বারা গঠিত) অর্থনৈতিক বিকাশ এবং সামরিক বাহিনীর সম্প্রসারণের বাইরে অন্যকোন আগ্রহ নেই—অন্তত যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন মানবিক সঙ্কট এসে হাজির হয়। একটি অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক সঙ্কট দ্বারা তাড়িত হয়ে রাষ্ট্র হয়ে উঠে কারসাজি করা ভুয়া খবরের একটি উৎস (ভুয়া খবরের লক্ষ্য হওয়ার বদলে)।


৪. বিমূর্ত এবং মূর্ত সংহতি

এখন আমরা আবার ফিরে যাই সীমান্তের প্রশ্নে এবং প্রশ্ন তুলি যে লড়াইটা আমরা এখন করছি তার প্রকৃতির ব্যাপারে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যে লড়াইকে বলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের সামনে আসা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভাইরাসের বিরূদ্ধে এই যুদ্ধটি প্রথমত একটি তথ্যযুদ্ধ। শত্রুকে দেখা যায় না। এটাকে শুধুমাত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর ব্যাপারে তথ্য এবং প্রতিটি ব্যাক্তির চলাচলের তথ্য দ্বারা চিহ্নিত করা যায়। এই যুদ্ধের ফলপ্রসূতা নির্ভর করবে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা এবং সেই সাথে সর্বোচ্চ কার্যকারিতা অর্জনের জন্য হাতে থাকা সকল সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতার উপর। যেসব দেশে রয়েছে কঠোর অনলাইন সেন্সরশিপ, সেসব দেশে ভাইরাসটিকে (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরতে থাকা একটি “সংবেদনশীল” শব্দকে যেভাবে আটকে রাখা হয় ঠিক সেভাবে) আটকে রাখা সম্ভব। রাজনৈতিক প্রসঙ্গে “তথ্য” শব্দটিকে প্রায়শই প্রোপাগাণ্ডার সাথে তুলনা করা হয়েছে।তবে একে শুধুমাত্র গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা, এমনকি বাকস্বাধীনতার একটি প্রশ্ন হিসেবে দেখা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। তথ্যযুদ্ধ একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধ। এটা কোন নির্দিষ্ট ধরনের যুদ্ধ নয়, বরং যুদ্ধের স্থায়িত্বের যুদ্ধ।


“সমাজকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে”—এই বক্তৃতাসংকলনে (১৯৭৬) মিশেল ফুকোর যেসব বক্তৃতা সংগৃহীত হয়েছে, তাতে তিনি কার্ল ভন ক্লজেভিটজের“সমাজকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে”—এই বক্তৃতাসংকলনে (১৯৭৬) মিশেল ফুকোর যেসব বক্তৃতা সংগৃহীত হয়েছে, তাতে তিনি কার্ল ভন ক্লজেভিটজের(Carl Von ClausewitzCarl Von Clausewitz) “যুদ্ধ বিকল্প উপায়ে রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা” এই এফোরিজমটিকে “রাজনীতি বিকল্প উপায়ে যুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা”তে উল্টে দেন। যদিও এই উল্টে দেয়াটা প্রস্তাব করে যে ক্লজেভিটজের চিন্তায় যুদ্ধের যে রূপ ছিল তা আর নেই। ফুকো তখনও পর্যন্ত তথ্যযুদ্ধের উপর কোন ডিসকোর্স গঠন করেননি। বিশ বছরেরও বেশি সময় আগে, দুই সাবেক বিমানবাহিনীর কর্নেল চীনে সীমিতাবস্থাহীন যুদ্ধ (超限戰, যা অফিসিয়ালি অনুদিত হয়েছিল Unrestricted Warfare বা Warfare beyond Bounds হিসেবে) নামে একটি বই প্রকাশ করে। বইটি শীঘ্রই ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয় এবং বলা হয় এটি টিক্কান কালেকটিভ (Tiqqun collective) এবং পরবর্তীতে ইনভিসিবল কমিটিকে (Invisible Committee) প্রভাবিত করেছিল। এই দুই সাবেক কর্নেল—যারা ক্লজেভিটজকে চিনতো ভালমতো, কিন্তু ফুকো পড়েনি— এ সিদ্ধান্তে আসেন যে গতানুগতিক যুদ্ধ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে এবং তা প্রতিস্থাপিত হবে বিশ্বজুড়ে একটি অন্তর্নিহিত যুদ্ধ দ্বারা যা মূলত সৃষ্টি এবং সম্ভবপর হবে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে। বইটি পড়া যায় যুক্ত্ররাষ্ট্রের বৈশ্বিক যুদ্ধকৌশলের বিশ্লেষণ হিসেবে। কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে বললে, তথ্যপ্রযুক্তি কিভাবে রাজনীতি এবং ভূ-রাজনীতিকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করছে তার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ হিসেবে বইটিকে পড়া যায়।


করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ একই সাথে ভুলতথ্য এবং মিথ্যাতথ্যের (disinformation) যুদ্ধ, যা সত্য-উত্তর (post-truth) রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য। ভাইরাসের আবির্ভাবটি হয়তো একটি আকস্মিক ঘটনা যা বর্তমান সঙ্কটের সূত্রপাত ঘটিয়েছে, কিন্তু এই যুদ্ধটি আর সম্ভাব্য (contingent, আকস্মিক ও সম্ভাব্য) নয়। এই তথ্যযুদ্ধ আরও দুটি সম্ভাবনা (কিছুটা ফার্মাকোলজিকাল) সৃষ্টি করেঃ প্রথমত, এমন যুদ্ধের যা রাষ্ট্রকে আর পরিমাপের একক (unit of measure) হিসেবে দেখে না। বরং অদৃশ্য অস্ত্র দ্বারা এবং কোন স্পষ্ট সীমান্ত ছাড়া অনবরত রাষ্ট্রের ডিটেরিটোরিয়ালাইজেশন ঘটায়। দ্বিতীয়ত, সম্ভাবনা সৃষ্টি করে গৃহযুদ্ধের, যা রূপ নেয় তথ্যবলয়সমূহের প্রতিদ্বন্দ্বীতায়। করোনাভাইরাসের বিরূদ্ধে যুদ্ধটি ভাইরাস বাহকদের বিরূদ্ধেও একটি যুদ্ধ এবং তা সংগঠিত হচ্ছে ভুয়া খবর, গুজব, সেন্সরশিপ, মিথ্যা পরিসংখ্যান, ভুলতথ্য ইত্যাদি দ্বারা। সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তার তথ্যবলয়ের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে এবং বিশ্বের বেশিরভাগ জনসংখ্যার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে, সেই সমান্তরালে চীনও বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং জটিল ও সফিসটিকেটেড তথ্যবলয়গুলোর একটি তৈরি করেছে। এই তথ্যবলয়গুলো মানুষ এবং যন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত ফায়ারওয়াল (firewall) দ্বারা সুসজ্জিত এবং যার কারণে চীন ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যেও ভাইরাসটিকে রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। চীনের “ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড” পদক্ষেপের ফলে এই তথ্যবলয় সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে আফ্রিকায় এর অন্তর্জাল (network) প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র সাড়া দিতে বাধ্য হয় এবং সুরক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির নামে হুয়াওয়ে (Huawei)কে নিষিদ্ধ করে যেন এর তথ্যবলয়ের সম্প্রসারণ রোধ করা যায়। অবশ্যই তথ্যযুদ্ধ শুধু সার্বভৌমসমূহের মধ্যে সংগঠিত হয় না। চীনের মধ্যেই বিভিন্ন বিরোধী জোট (faction) দাপ্তরিক গণমাধ্যম, গতানুগতিক গণমাধ্যম যেমন সংবাদপত্র এবং স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে একে-অপরের বিরূদ্ধে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, গতানুগতিক গণমাধ্যম এবং স্বাধীন গণমাধ্যম উভয়েই ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের যে রাষ্ট্রীয় উপাত্ত তার সত্যতা-তদন্ত (fact check) করে রাষ্ট্রকে বাধ্য করে তার ভুল প্রতিকার করতে এবং উহানের হাসপাতালগুলোতে আরও বেশি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে।


নিজেদের ভৌত সীমান্ত (physical border) রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা থেকে রাষ্ট্রগুলো যে তথ্যযুদ্ধ পরিচালনা করে—একই সাথে তারা নতুন সীমান্ত তৈরির জন্য প্রযুক্তিগতভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে ভৌত সীমানার বাইরে সম্প্রসারিত হয়—সেই তথ্যযুদ্ধের অন্তুর্নিহিত রূপ করোনাভাইরাস উন্মোচিত করেছে। তথ্যবলয়গুলো মানুষদের দ্বারা নির্মিত এবং সাম্প্রতিক যুগগুলোতে এদের অত্যন্ত সম্প্রসারণ সত্ত্বেও এরা কি হয়ে উঠবে তা অনিশ্চিত রয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত কো-ইমিউনিটি এর কল্পনাটি—রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একটি সম্ভাব্য সাম্যবাদ অথবা পারস্পরিক সহযোগিতা হিসেবে—শুধুমাত্র একটি বিমূর্ত সংহতির ধারণায় রয়ে যায়, ততক্ষণ তা সিনিসিজমে (cynicism) পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় থাকে, ঠিক মানবতার ধারণাটির মতই। সাম্প্রতিক যুগগুলোতে দেখা গেছে যে, কিছু দার্শনিক ডিসকোর্স বিমূর্ত সংহতির ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, যেটা শাখা-ভিত্তিক গোষ্ঠীতে রূপান্তরির হতে পারে এবং এদের রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা নির্ধারিত হয় সম্মতি এবং অসম্মতির মাধ্যমে। বিমূর্ত সংহতি আকর্ষনীয়, কারণ এটি বিমূর্তঃ বিমূর্ত সংহতি, যা মূর্ত সংহতির বিপরীত। এটা ভূমিতে স্থাপিত নয় এবং এর কোন নির্দিষ্ট এলাকা(locality) নেই। এটা যেকোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে এবং যেকোন জায়গার থাকতে পারে। কিন্তু বিমূর্ত সংহতি বিশ্বায়নের উৎপাদন, এমন একটা কিছুর মহা-আখ্যান (meta-narrative) (অথবা এমনকি অধিবিদ্যাও [metaphysics]) যা অনেক আগেই নিজের ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে।


সত্যিকারের কো-ইমিউনিটি কোন বিমূর্ত সংহতি নয়। বরং এটি শুরু হয় একটি মূর্ত সংহতি থেকে যার কো-ইমিউনিটি পরবর্তী বিশ্বায়নের (যদি তা থেকে থাকে) ভিত্তি হওয়া উচিৎ। এই বৈশ্বিক মহামারী শুরুর পর থেকে সত্যিকারের সংহতির অনেক উদাহরণ দেখা গেছে যখন কিনা—যদি আপনি সুপারমার্কেটে যেতে না পারেন তবে কে আপনার বাজার এনে দিবে, যখন আপনার হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন তখন কে আপনাকে মাস্ক দিবে, অথবা জীবন বাঁচানোর জন্য কে আপনাকে রেস্পিরেটর [কৃত্রিমভাবে শ্বাস চালু রাখার যন্ত্র] দিবে— এবং এই ধরনের অন্যান্য বিষয়গুলো খুবই গুরত্বপূর্ণ। চিকিৎসাবিদ্যার গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সত্যিকারের সংহতি দেখা গেছে যারা টিকা তৈরির জন্য একে অপরের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করছে। গিলবার্ট সিমন্ডন (Gilbert Simondon) মূর্ত আর বিমূর্তের মধ্যে পার্থক্য করেছেন কারিগরি বস্তু (technical object) দ্বারাঃ বিমূর্ত কারিগরি বস্তু হচ্ছে যেগুলো বহনযোগ্য/অস্থাবর (mobile) এবং অপসারণ করা যায়, যেমন আঠারো শতকের জ্ঞানকোষ-লেখকদের (encyclopedist) দ্বারা গৃহীত বিষয়গুলো, যা প্রগতির সম্ভাবনার ব্যাপারে আশাবাদী (আজকের দিনেও) হওয়ার প্রেরণা দেয়। আর মূর্ত কারিগরি বস্তু হচ্ছে সেগুলো, যাদের ভিত্তি স্থাপিত (সম্ভবত আক্ষরিকর্থেই) রয়েছে প্রাকৃতিক দুনিয়া এবং মানুষের দুনিয়া দুটোতেই। একটি সাইবারনেটিক যন্ত্র একটি ঘড়ির চেয়ে বেশি মূর্ত, আবার একটা ঘড়ি একটা সাধারণ যন্ত্রের চেয়ে। তাহলে কি এভাবে আমরা মূর্ত সংহতির এমন একটি ধারণা তৈরি করতে পারি যা জাতি-রাষ্ট্র এবং বিমূর্ত সংহতি ভিত্তিক রোগ-প্রতিরোধবিদ্যার অচল অবস্থাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে? তথ্যবলয়কে কি আমরা এমন একটি সুযোগ হিসেবে দেখতে পারি যা এই ধরনের রোগ-প্রতিরোধবিদ্যার দিকে নির্দেশ করে?


আমাদের সম্ভবত তথ্যবলয়ের ধারণাটি দুইভাবে বিস্তৃত করতে হবে। প্রথমত, তথ্যবলয় তৈরির ব্যাপারটিকে প্রযুক্তিগত-বৈচিত্র্য গড়ে তোলার পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যার উদ্দেশ্য মনো-টেকনোলজিক্যাল সংস্কৃতিকে ভিতর থেকে ভেঙ্গে ফেলা এবং এর “বিরূপ অন্তহীনতা” (Bad Infinity) থেকে বের হয়ে আসা। এই প্রযুক্তিগত বৈচিত্র্যতা জীবনযাত্রার প্রণালী, সহাবস্থানের রূপ (forms of coexistence), অর্থনীতি এবং এ জাতীয় বিষয়গুলোরও বৈচিত্র্যতার আভাসও দেয়, যেহেতু প্রযুক্তি— যতক্ষণ পর্যন্ত এটি কসমোটেকনিকস*— এটি না-মানুষ (nonhuman) এবং বৃহত্তর জগতের সাথে ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে। এই প্রযুক্তিগত বৈচিত্র্য কোন নৈতিক কাঠামোর ইঙ্গিত করে না যা প্রযুক্তির উপর আরোপ করে হবে, যেহেতু এটি সবসময়ই অনেক দেরীতে আসে এবং প্রায়শই লঙ্ঘন করার জন্য তৈরি হয়। আমাদের প্রযুক্তি এবং মনোভাব পরিবর্তন না করলে আমরা জীববৈচিত্র্যতার টিকে থাকা নিশ্চিত করতে পারবো না, একে বজায় রাখতে পারব শুধুমাত্র একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে। এক কথায়, প্রযুক্তি-বৈচিত্র্য (techno-diversity) ছাড়া জীববৈচিত্র্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। করোনাভাইরাস প্রকৃতির কোন প্রতিশোধ নয়, বরং একটি মনো-টেকনোলজিক্যাল সংস্কৃতির ফলাফল যেখানে প্রযুক্তি নিজেই ক্রমাগত নিজের ভিত্তি হারায় এবং অন্য সকল কিছুর ভিত্তি হয়ে উঠতে চায়। যে মনো-টেকনোলজিসমে আমরা এখন বাস করি তা সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে এবং পৃথিবীকে শুধুমাত্র একটি স্ট্যান্ডিং রিজার্ভ (standing reserve) হিসেবে দেখতে থাকে। একটা ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতে টিকিয়ে রেখে এটি শুধু আরও বিপর্যয়েরই সৃষ্টি করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, পৃথিবী নামক মহাযানটি নিঃশেষ এবং ধ্বংস করার পর আমরা হয়তো মঙ্গলগ্রহ নামক মহাযানটিও সেই একইভাবে নিঃশেষ এবং ধ্বংস করবো শুধু।


দ্বিতীয়ত, তথ্যবলয়কে বিবেচনা করা যেতে পারে মূর্ত সংহতি হিসেবে যা সীমান্তের বাইরে বিস্তৃত হবে এমন একটি রোগ-প্রতিরোধবিদ্যা হিসেবে যার শুরু আর জাতি-রাষ্ট্র থেকে হবে না, যে জাতি-রাষ্ট্রের অধীনে থাকে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো(যেগুলো কিনা কার্যকরীভাবে বিশ্বশক্তিগুলোর পুতুল)। এ ধরনের মূর্ত সংহতির উত্থানের জন্য আমাদের প্রয়োজন প্রযুক্তি-বৈচিত্র্য যা তৈরি করবে বিকল্প প্রযুক্তি যেমন নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সহযোগিতামূলক সরঞ্জাম, এবং ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, যেগুলো বৈশ্বিক সহযোগীতার ভিত্তি তৈরি করবে। ডিজিটাল গণমাধ্যমের একটি সুদীর্ঘ সামাজিক ইতিহাস ইতিমধ্যেই আছে, যদিও এর যে রূপগুলো সিলিকন ভ্যালিতে রয়েছে (এবং চীনে উইচ্যাট [WeChat]) তার বাইরে খুব কমই সারা বিশ্বে প্রসারিত হতে পেরেছে। এর কারণ মূলত উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটি দার্শনিক ঐতিহ্য—যেখানে প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি উভয়কে প্রযুক্তির বিপরীত ভাবা হয়— যা প্রযুক্তির বহুত্ব যে অর্জন করা সম্ভব তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। প্রযুক্তিপ্রীতি (technophilia) এবং প্রযুক্তি-আতঙ্ক (technophobia) হয়ে উঠে মনো-টেকনোলজিক্যাল সংস্কৃতির একটি লক্ষণ। হ্যাকার-সংস্কৃতি, বিনামূল্যে সফটওয়্যার, মুক্ত-উৎস গোষ্ঠীসমূহের (open-source community) সাথে আমরা ইতিমধ্যে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু তারপরও বিকল্প কার্যক্রম পদ্ধতি, সহযোগিতা, এবং যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—জ্ঞানতত্ব, এগুলো তৈরি করার বদলে আধিপত্যবাদী প্রযুক্তির বিকল্প তৈরির দিকেই মনযোগ দেয়া হচ্ছে।


করোনাভাইরাসের ঘটনাটির ফলে ডাটা ইকোনমিরকরোনাভাইরাসের ঘটনাটির ফলে ডাটা ইকোনমির (data economydata economy)[v] দ্বারা ডিজিটালাইজেশন এবং সাবসাম্পশন (subsumption) প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে, যেহেতু করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে এটাই ছিল আমাদের হাতে থাকা সবচেয়ে কার্যকরী সরঞ্জাম। যেমনটা আমরা দেখেছি যে অনেক দেশই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত করতে মোবাইল ডাটা্র (mobile data) ব্যবহারের পক্ষ নিয়েছেন যারা অন্যথায় গোপনীয়তা সমর্থন করে। আমরা হয়তো এখন থামতে পারি এবং জিজ্ঞেস করতে পারি, এই ত্বরান্বিত ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াকে কি সুযোগ হিসেবে নেয়া যায় কিনা—একটি উপযুক্ত মূহুর্ত (kairos) যা বর্তমান বৈশ্বিক সঙ্কটের নিচে লুকিয়ে আছে। একটি বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার আহ্বান সকলকে একই নৌকায় নিয়ে এসেছে এবং “স্বাভাবিক জীবন”-এ ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যটি কোন সঠিক জবাব নয়। করোনাভাইরাসের কারণে, বিশ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে এই প্রথম সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ অনলাইন ক্লাসে পড়ানোর প্রস্তাব করেছে। ডিজিটাল শিক্ষায় বাধা দেয়ার অনেক কারণ রয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ কারণই ক্ষুদ্র এবং অনেকসময় অযৌক্তিক (যে সকল প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত, তারা এখনো হয়তো মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য শারীরিক উপস্থিতিকে প্রয়োজনীয় মনে করতে পারে)। অনলাইন শিক্ষা শারীরিক উপস্থিতিকে হয়তো সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপিত করবে না, কিন্তু এটি আমূলে জ্ঞানচর্চার পথ খুলে দেয় এবং আমাদেরকে শিক্ষার প্রশ্নে ফিরিয়ে আনে এমন একটি সময়ে যখন বিশ্ববিদ্যায়গুলোর তহবিল কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের স্বাভাবিক জীবন যে স্থগিত হয়ে গেল, তা কি আমাদের এই অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করার সুযোগ করে দিবে? উদাহরণস্বরূপ, সামনের মাসগুলোকে (এবং হয়তো সামনের বছরগুলোকেও) আমরা কি অভূতপূর্ব মাত্রায় সত্যিকারের ডিজিটাল প্রতিষ্ঠান তৈরির সুযোগ হিসেবে দেখতে পারি, যে সময়টায় বিশ্বের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষা ব্যবহার করবে? একটি বৈশ্বিক রোগ-প্রতিরোধবিদ্যা এই ধরনের আমূল পুনর্গঠন দাবী করে।


এই প্রবন্ধটির শুরুর উক্তিটি ফ্রেডরিখ নীটশের অসমাপ্ত “Philosophy in the Tragic Age of the Greeks” থেকে নেয়া, লিখা হয়েছিল ১৮৭৩ সালের দিকে। নীটশে প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংস্কার লক্ষ্য করেন যারা বিজ্ঞান এবং মিথ, আবেগ এবং যৌক্তিকতার পুনর্মিলন ঘটাতে চেয়েছিল। আমরা এখন আর সেই ট্র্যাজিক যুগে নেই, কিন্তু এমন এক বিপর্যস্ত সময়ে আছে যখন শুধুমাত্র ট্র্যাজিস্ট চিন্তা কিংবা তাওবাদী (Daoist) চিন্তা একা আমাদের পালানোর সুযোগ দিতে পারবে না। বিশ্ব সংস্কৃতির যে অসুস্থতা, তার প্রেক্ষিতে আমাদের জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার প্রয়োজন যা পরিচালিত হবে নতুন চিন্তা এবং নতুন অবকাঠামো দ্বারা এবং যা কিনা আমাদের (দর্শন যা আরোপ করেছে এবং উপেক্ষা করেছে তা থেকে) নিজেদের মুক্ত করতে সাহায্য করবে। করোনাভাইরাস অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিবে যা ইতিমধ্যেই ডিজিটাল প্রযুক্তি দ্বারা হুমকির সম্মুখীন। এটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে এবং সেইসাথে সন্ত্রাসবাদ ও জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির বিরূদ্ধেও নজরদারি এবং অন্যান্য রোগপ্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করবে। এটি এমনও একটি মূহূর্ত যখন আমাদের দরকার হবে শক্তিশালি মূর্ত, ডিজিটাল সংহতি। ডিজিটাল সংহতি মানে আরও বেশি করে ফেসবুক, টুইটার বা উইচ্যাট ব্যবহারের আহবান নয়। বরং মনো-টেকনোলজিক্যাল সংস্কৃতির এই ভয়াবহ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে আসা, যার উদ্দেশ্য বিকল্প প্রযুক্তিসমূহ এবং সেগুলোর অনুরূপ জীবন বিন্যাস(forms of life, জীবনের ধরন) এবং গ্রহ ও ব্রহ্মাণ্ডে তাদের বসবাস পদ্ধতি—এগুলোর মাধ্যমে প্রযুক্তি-বৈচিত্র্য তৈরি করা। এই অধিবিদ্যা-উত্তর দুনিয়ায় হয়তো কোন অধিবিদ্যক বৈশ্বিক মহামারীর প্রয়োজন নেই। আমাদের হয়তো কোন ভাইরাস-ভিত্তিক সত্ত্বাতত্ত্বেরও প্রয়োজন নেই। যা আমাদের সত্যিই প্রয়োজন তা হচ্ছে একটি মূর্ত সংহতি যা ভিন্নতা এবং বৈচিত্র্যতা স্বীকার করবে এবং তা প্রয়োজন আঁধার ঘনাবার পূর্বেই।

____________

এপ্রিল, ২০২০


অনুবাদকের টীকা


[i] টেকনোথিসম (technotheism) হচ্ছে প্রযুক্তিকে ঈশ্বরের মত পূজা করার প্রবণতা।


[ii] ট্রান্সহিম্যানিজম একটি দার্শনিক চিন্তাধারা যা উন্নত এবং জটিল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন এবং সেগুলোর ব্যাপকমাত্রায় বৃদ্ধির পক্ষপাতী। ট্রান্সহিউম্যানিস্টরা বিশ্বাস করে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি দ্বারা মানুষ তার বর্তমান শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারবে।


[iii] তথ্যবলয় এমন একট ক্ষেত্র যা তথ্য এবং ইনফোর্গ (তথ্য দ্বারা তৈরি সত্তা) এর সমন্বয়ে গঠিত। তথ্যবলয় শুধুমাত্র সাইবারস্পেসেই সীমাবদ্ধ নয়।


[iv] কসমোটেকনিক্স (cosmothechnics) হচ্ছে প্রযুক্তি, জগৎ এবং দর্শনের সমন্বয়কারী রাজনৈতিক দর্শন।


[v] ডাটা ইকোনমি হচ্ছে একটি ডিজিটাল বাস্তসংস্থান যেখানে ডাটা সংগ্রহ, সুসংগঠিত এবং আদান প্রদান করা হয়।


*Deconstruction-এর বাংলা ‘বিনির্মাণ’ হতে পারে না কারণ নির্মাণ ও বিনির্মাণের অর্থ একই। অধিকাংশ বাংলা শব্দে ‘বি’ উপসর্গ যোগে সেটা বিপরীত বা নঙর্থক হয় না যেমন বিনির্ণয়, বিনিশ্চিত, বিক্ষুদ্ধ, বিনিয়োগ, বিমুগ্ধ ইত্যাদি শব্দের অর্থ একই। সুতরাং গায়ত্রী স্পিভাক বা অন্যান্যেরা যারা ‘অবিনির্মাণ’ শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁরাই ঠিক। ওটাই ব্যাকরণসম্মত।-অমল বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রথম প্রকাশঃ ২৭শে জুন, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৭শে জুন, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/368379874357228/