দার্শনিকদের বিরোধিতায় ধর্ম-উত্তর নীতিবাগিশতায় পরিণত হয়েছে অ্যাক্টিভিজমের চর্চা

গ্রাহাম হারমান


[পশ্চিমা দর্শন চর্চায় সমকালীন স্পেকুলেটিভ রিয়েলিজম (Speculative Realism) মুভমেন্টের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রাহাম হারমান। অবজেক্ট-ওরিয়েন্টেড অন্টোলজি নামে পরিচিত তাঁর দর্শন এবং সেইসাথে কোয়েন্টিন মেয়াসুঁ, লেভি ব্রায়ান্ট ও অন্যান্য তরুণ দার্শনিকদের কাজ ইতিমধ্যেই দার্শনিক পরিমণ্ডলে একটা বাকবদলের দাবি তুলেছে। গ্রাহাম দীর্ঘদিন কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগে পড়িয়েছেন। বর্তমানে SCI-Arc'তে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। গত বছরের মে মাসে তিনি করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি একইসাথে ইংরেজি ও তুর্কি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। Lockdown and the Sense of Threat শিরোনামে এই সাক্ষাৎকারের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রাহাম হারমানের এই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে তর্জমা করেছেন কাজী তাফসিন। তাফসিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।]


কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হবার পরপরই এই পরিস্থিতি নিয়ে জিজেক, বাদিয়্যু ও আগামবেন বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত এই প্রসঙ্গে আপনার কোন লেখা হাতে পাইনি। এর কারণ কি এই প্রসঙ্গে আপনার কিছুই বলার নেই, নাকি আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে কোন ‘দার্শনিক নীরবতা’ পালন করছেন?


যেকোন জরুরী মুহুর্তকে ব্যাখ্যা করার চেয়ে বরং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করাই দর্শনশাস্ত্রের কাজ বলে আমি মনে করি। কোভিডের এই মুহুর্তে আমি বরং ভাইরাস বিশেষজ্ঞ, এপিডেমোলজিস্ট এবং রাজনীতিবিদদের কথাবার্তার দিকেই বেশি মনযোগ দিতে আগ্রহী। চলমান কোন ইস্যু নিয়ে যদি কোন দার্শনিক সাথে সাথেই ব্যাখ্যা করতে বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে খুব সম্ভাবনা আছে তিনি তাঁর নিজের দার্শনিক দূর্বলতার দিকে নজর না দিয়ে বরং বর্তমান ইস্যুকে সমাধান করার কাজেই বেশি মনযোগী। দার্শনিকেরা যখন তাঁদের কাজ ঠিক মতন করে, বেশিরভাগ সময়েই তাঁরা কাজ করে একটা সমগ্র শতাব্দী কিংবা সহস্রাব্দকে মাথায় রেখেঃ যার জন্য আমরা দেখতে পাই, স্বয়ং প্লেটোও সিরাক্যুজের [স্বৈরাচার শাসকের] ব্যাপারে ভুলভাল মন্তব্য করেছিলেন। আর হাইডেগার [-এর নাজিবাদের সমর্থন] নিয়ে আর না-ই বললাম। একইভাবে জিজেক কিংবা বাদিয়্যু’র কোভিড-১৯ নিয়ে লেখাগুলো পড়তেও আমার কোন আপত্তি নাই, কিন্তু তার চেয়ে বরং আমি আরও বেশি আগ্রহী ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর এই মুহূর্তে কোভিড নিয়ে কি বলতে চাইছেন সে ব্যাপারে। দার্শনিকদের যেকোন মন্তব্য তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন তাঁরা যে-সময়ে বসে কথা বলছে তার কিছুকাল-আগের সময় নিয়ে কাজ করে। আমি দার্শনিকদের জনবুদ্ধিজীবী (public intellectuals) হয়ে ওঠার বিরোধিতা করি না, কিন্তু দর্শনশাস্ত্রকে মহামারী কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন বোঝার মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে আমি নারাজ। মোটাদাগে বর্তমান মানব সভ্যতা হিসেবে আমরা সবসময়ই হাই-কালচার আর জনপরিসর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়গুলোর সমালোচনা করি, কিন্তু আদতে দর্শনশাস্ত্র মূলত এই ধরনের লোকজনই চর্চা করে এসেছে।


তাহলে আমরা কি ইতোমধ্যেই একটা তথাকথিত ‘সভ্য দুনিয়ার’ ফাঁদে আটকা পড়েছি—যেখানে কিনা মহামারীর সার্বজনীনতা কিংবা বৈশ্বিকতা বোঝার ক্ষেত্রে আগে থেকেই আমাদের মাথায় ‘সার্বজনীনতা’ বা ‘বৈশ্বিকতার’ একটা পুর্বানূমান আমাদের ওপর আরোপ হয়ে আছে?


এইক্ষেত্রে এই বিষয়টাকে আমার একটা নিরীহ রাজনৈতিক ইস্যু বলেই মনে হয়। আমরা বরং এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছি যেটা আকাশপথে চলাচলের মাধ্যমে বিশ্বায়িত হয়ে পড়েছে এবং যার জন্য এই ভাইরাস আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সমর্থ হয়েছে। ইউরোপে বলতে গেলে মহামারী নিয়ে সকল ব্যবস্থাপনা নিজ নিজ রাষ্ট্রের ওপরেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর এদিকে আমেরিকায় ট্রাম্প যেহেতু নিজস্ব অব্যবস্থাপনার উছিলা হিসেবে অদ্ভূতভাবে রাজ্যসরকারগুলিকে একে অপরের প্রতিযোগী হিসেবে দাড় করাতে চেয়েছিল, তাই দিন শেষে কোভিডের সকল দায়িত্ত্ব ছেড়ে দেয়া হয়েছিল অঙ্গরাজ্যে আর তাদের স্থানীয় সম্মিলিত জোটগুলির ওপর—যেটা করতে গিয়ে আবার ফেডারাল সরকার যোগানের অভাবে পড়ে গিয়েছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই ভাইরাসকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে অনেকেই বৈশ্বিকতা-বিরোধী আচরণ দেখাচ্ছে। এজন্য রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা সামনের দিনলোতে চেষ্টা করবে যেন চীনের সাপ্লাই চেইনের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে আসে। এই পন্থা অবলম্বন হওয়ার পিছে কিছু দায় বর্তাচ্ছে ট্রাম্পের ওপরে, যেগুলোর কিছু কিছু সামনের দিনগুলোতেও চলতে থাকবে।


আধুনিক দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম একটা প্রবণতা হচ্ছে কৃত্রিম যেকোন কিছুকে অকৃত্রিম বিষয়াশয়গুলোর অধীনস্ত বলে মনে করা। আজকাল করোনাভাইরাসের এই সময়ে আবার দেখা যাচ্ছে এই ভাইরাসকে অনেকে জীবিত আর না-জীবিত’র বাইরে অন্য কোনকিছু হিসেবে দেখছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি এমনকি জিজেকও এই ভাইরাসকে ‘জ্যান্তেমরা’ ধাঁচের কিছু একটা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। সেই হিসেবে আধুনিক দর্শনশাস্ত্র যেহেতু এমন একটা কর্তাসত্তার কথা বলে যা কিনা জীবিত বা অকৃত্রিম, সে হিসেবে এই ভাইরাসের আগমন আমাদেরকে কৃত্রিম বিষয়গুলোর অকৃত্রিমের আধীনস্ততার যে দার্শনিক চিন্তার সীমারেখা সেটা থেকে বের হওয়ার একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছে। ‘জীবন’-এর ধারণা নিয়ে আমাদের বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে কৃত্রিম আর অকৃত্রিমের যে সীমারেখা সেটা নিয়ে তাই সবারই আবারও নতুন করে ভাবতে হয়—যতবারই নতুন কোন ‘অবজেক্ট’ আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। আপনিও কি সেরকমই মনে করেন যে, এই ভাইরাস এমন কিছু একটা যেটা কিনা কৃত্রিম আর অকৃত্রিমের বর্গের বাইরে নতুন কোন কিছু?


একটা বড় সময়ব্যাপী জীবনের ধারণা নিয়ে আমাদের পুনর্বার ভাবতে হয়েছে, যেহেতু এটা ১৬০০ শতক থেকেই দর্শনের অন্যতম দূর্বলতা ছিল। আধুনিক দর্শন মূলত এমন একটা শ্রেণীবিন্যাসের চর্চা করে যেখানে মূলত দুই জাতের জিনিস আছেঃ এক, মনুষ্য চিন্তা আর দুই, বাদবাকি সবকিছু। অবশ্যই এটা শুনতে যতটা নির্বোধ শোনায় আসলে ততটাও নির্বুদ্ধিতা নয়। যেহেতু ধরে নেয়া হয় যে, মনুষ্য চিন্তাই একমাত্র বিষয় যেটার মাধ্যমে কিনা কোন কিছু সম্পর্কে চিন্তা করাকে সম্ভবপর করে তোলা যায়, যা বাদবাকি অন্যকিছুর ক্ষেত্রে অসম্ভব। এটা আমাদের সেই পুরনো কার্তেসীয় ঐতিহ্যর কথাই মনে করিয়ে দেয় যেখানে দর্শন শুধুমাত্র কাজ করবে চিন্তা আর জগতের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে, আর বিজ্ঞান কাজ করবে বাদবাকি সবকিছু নিয়ে। আমার কাছে মনে হয় এই কার্তেসীয় ঐতিহ্যে একটা গলদ আছে; যেই গলদটাকে আমরা সামনের দিনের দর্শনশাস্ত্রে অতিক্রম করে আসব। আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড ছিলেন অন্যতম একজন দার্শনিক যিনি এই কার্তেসীয় ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন, যেটা কিনা ব্রুনো লাতুরও করতে পেরেছেন অনেকাংশেই। এখন ফেরত আসি আপনার প্রশ্নে—আধুনিক দর্শন কিন্তু সবসময়ই অস্বস্তিতে ছিল যে প্রানী জগৎ নিয়ে সে কি করবে বা কি ভাববে। দেকার্ত মনে করেছিল প্রাণীরা হচ্ছে স্রেফ চিন্তাশূন্য জীব, কিন্তু কেউ-ই এই কথায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিল না। এর ফলে দেখা গেলো যে পরবর্তীতে আমরা একটা ত্রি-স্তরের কাঠামো বানালাম যেখানে কিনা একপার্শ্বে থাকবে প্রাণহীন বস্তু, অপরপার্শ্বে থাকবে [চিন্তাশীল] মানুষ আর মাঝামাঝি জায়গায় থাকবে প্রাণীজগত।


কিন্তু সবকিছুকে এই তিনটা স্তরে ভাগ করে ফেলার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত খুব একটা সুবিধা করতে পারে নাই। যেমন ১৯২৯-৩০ এর লেকচারে হাইডেগার বলছিলেন যে প্রাণীজগতের দুনিয়ার অভাব আছে।এমনকি কোয়েন্টিন মেয়াসুঁও তাঁর লা’একজিস্টান্স ডিভাইন (L’Inexistence divine) বইতে এই ধরনের ফারাক চর্চা করার কারণ পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আরও অনেকেই আছেন যারা এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেও পারেননি। মানুষ আর প্রানীজগতের এই সাদাসিধা ফারাক টানার অভ্যাস থেকে বের হয়ে এসে আমাদের বরং দরকার প্রানীজগতের ভিন্ন ভিন্ন আদলকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করা। এদিক থেকে ভাইরাসের বিষয়টা আগ্রহোদ্দীপক, কারণ এটা এমন কিছু যেটা জ্যান্ত আর মৃত’র (না-জ্যান্ত অর্থে) ধারণার মধ্যেকার সীমারেখায় বা সীমারেখার কাছাকাছি অবস্থান করছে। অনেকটা গাছের বীজের মত, আবার গাছের বীজের মত না এই অর্থে যে একটা বীজ যেমন প্রাণের শুরু ঘটায় ভাইরাস সেটা না করে বরং রূপকার্থে অনেকগুলো বীজের জন্ম দেয়। যদিও এই ভাইরাসের উৎপত্তি আর জৈবিকতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে, তবুও আমি মনে করি দর্শনশাস্ত্র এটা নিয়ে বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে অনেক কিছুর প্রস্তাব করতে পারে। এইভাবেই প্রাণীজগত নিয়ে দর্শনশাস্ত্র যখন ভিন্ন কোন প্রস্তাব দিতে সমর্থ হবে তখনই এক অর্থে ধরে নেয়া যাবে যে আধুনিক দর্শন থেকে আমাদের একরকম প্রস্থান ঘটে গেছে।