বৈশ্বিক মহামারীকালে দর্শন

অ্যান্ড্রু হাছ


[করোনাভাইরাস মহামারীর কালে দর্শনের কাজ নিয়ে বিদ্যায়তনিক পরিসরে বিস্তৃত তর্ক উঠেছে। ইতিপূর্বেই সাইমন ক্রিচলি'র "মরতে জানাই দার্শনিকতা" শিরোনামের প্রাসঙ্গিক লেখাটি অনূদিত হয়েছে। রাশিয়ার মস্কোর Higher School of Economics(HSE) বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক অ্যান্ড্রু হাছ(Andrew Haas)-এর Philosophy in the time of the pandemic লেখাটি এই বিতর্কের অন্যতম সংযোজন। গত ৭ই ডিসেম্বরে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে The Philosophical Salon ওয়েবসাইটে। অ্যান্ড্রু হাছ-এর এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন প্রীথুলা প্রসূন পূজা। প্রীথুলা প্রসূন পূজা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী।]



নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার সময়ে আমি প্লেটোর “ফিডো(Phaedo)” পড়ানো শুরু করেছিলাম। এই ডায়লগ বা সংলাপটি হেমলক পান করে সক্রেটিসের মৃত্যু সহ তাঁর জীবনের শেষ দিনটি বর্ণনা করে। “ফিডো” আমাদের দুইটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রথমত, সক্রেটিস কেন বলেছিলেন যে দর্শন হচ্ছে মৃত্যুর প্রস্তুতি, বা মৃত্যুর জন্য চর্চা? দ্বিতীয়ত, এই মহামারীতে সর্বব্যপী মৃত্যুর ভীড়েও আমরা কিভাবে দর্শন চর্চা করতে পারি যেন তা অন্য সবকিছুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়?



প্রথম প্রশ্ন থেকে একটা জিনিস সহজেই বোঝা যায় যে দর্শন অন্যান্যদের মত একেবারেই একাডেমিক বা বিদ্যায়তনিক শাস্ত্র নয়। যদিও এখনও নানাবিধ বিষয়ে (যেমন, প্রত্যয়/ধারণা, আত্মা বা জ্ঞানবিদ্যা) সম্বন্ধে আমাদের জানার ও বোঝার বাকি রয়ে গেছে, তবুও দর্শন শুধুই জানার বিষয়ও নয়। বরং দর্শন একপ্রকার যাপন, অস্তিত্বশীল হওয়ার বা হয়ে ওঠার এক পথ। এই করোনা মহামারী একদম একটা বিষয় আমাদের সামনে খুব মূর্ত করে তুলেছে মেমেন্ট মোরি(memento mori, যা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়)'র মত; তা হলো, মৃত্যুর সাথে বাঁচা বা মরতে মরতে বাঁচা, এবং প্রতি মুহূর্তে একই সাথে মৃত্যু নিয়ে বাঁচা(living-and-dying)।[এই ব্যাপারটাকে লালন ফকিরের চিন্তায় আমরা যেমনটা পাই “জ্যান্তে মরা”র ধারণা, তার সাথে মিলিয়েও কিছুটা বুঝে নিতে পারি] কারণ, মৃত্যু আগন্তুক নয়, ভবিষ্যতে বয়ে আসার মত কিছু নয়। বরং, মৃত্যু প্রতি মুহূর্তে সাথে থাকে আমাদের, আমরা মৃত্যু বয়ে বেড়াই। আমরা যা-ই করি, যা-ই হই না কেন, মৃত্যু প্রতিনিয়ত আমাদের সকল অস্তিত্বের সাথে সাথেই চলমান।



দর্শন যদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতিই হয়ে থাকে, তাহলে তা মোটেই এমন প্রস্তুতি নয় যে মৃত্যু এসে একটি জীবন অতিক্রম করে যাবে, তা হোক আমাদের অথবা আমাদের কাছের-দূরের, চেনা-অচেনা, বন্ধুজন, প্রিয়জন বা কোনো আগন্তুকের জন্য। উল্টে, কিভাবে বাঁচতে হয়, কিভাবে মরতে মরতেও বেঁচে থাকতে হয় তা দেখিয়ে দেখিয়ে দর্শন আমাদের মৃত্যুর জন্যই প্রস্তুত করে দেয়। কি-করে একই সাথে জীবন-মৃত্যুর উপস্থিতিতেও চিন্তা করতে হয়, কি-করে তা প্রকাশ করতে হয় এবং কাজে প্রয়োগ করতে হয় তা পঠন-পাঠনের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। মূলত দার্শনিক জীবনের অর্থই হলো এমনভাবে চিন্তা ও জবানের যত্ন নেয়া, এমনভাবে ক্রিয়া করা এবং তার মাধ্যমে অস্তিত্বশীল হওয়া যেন আমরা সচেতন হতে পারি কিভাবে প্রতি মুহূর্তে জীবন ও মৃত্যু সহাবস্থান করে। এটা শুধুমাত্র ভালো বা মন্দ থাকা নয়। কারণ, মৃত্যু যেকোন মুহুর্তেই সত্য, অথবা তা কোনো না কোনো ভবিষ্যৎ মুহূর্তের জন্য সত্য, এবং সবার জন্য সত্য। বরং মৃত্যু হলো বর্তমান মুহূর্ত যাপনের এমন এক প্রক্রিয়া যাকে পূর্ণতা দান করবার প্রস্তুতিই দর্শন। এই প্রস্তুতি এমন এক চর্চা, যা ঘটমানতার মধ্যেই নিজের বাস্তবায়ন সম্পন্ন করে; যেমনভাবে পথেই গন্তব্য নিহিত, তেমনি করণের মধ্যেই তা কৃত।



দর্শন চর্চার প্রথম পর্যায়ই হলো দর্শন নিয়ে চিন্তা করা এবং তা প্রকাশ করা। অন্যান্য বিষয়ে দর্শন নিজেই কিছু ভাবতে বা বলতে শুরু করার আগেই আমাদের “যতটা সক্রেটিসকে স্মরণ করতে হয়, তার থেকেও বেশি ভাবতে হয় সত্য নিয়ে”। দর্শন চর্চার জন্য মননে ও কর্মে দার্শনিক হয়ে ওঠা জরুরি, প্রকাশভঙ্গিও হতে হয় দার্শনিকোচিত (এবং তা অবশ্যই অন্যান্য চিন্তা যেমন আশ্রয় বা টিকার খোঁজ, রুগ্নের সেবা বা আদৌ সেবা না-করা, পিপীলিকা-গাধা-নেকড়ে বা মৌমাছির ন্যায় আচরণ করা ইত্যাদিরও পূর্বে)। ঠিক এভাবেই সক্রেটিস তাঁর জীবনের শেষ দিন যাপন করে গেছেন; যেভাবে জীবনের মধ্যে তিনি মৃত্যুর সুর তুলে গেছেন, একইভাবে মৃত্যুর পরেও যেন আরও বেশি জীবন্ত তিনি। এক পুরোদস্তুর দার্শনিক চর্চার ভেতর দিয়ে জীবনকে যাপন করে যাওয়ার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ তিনি। সারা জীবন তিঁনি দর্শনের মধ্যেই বেঁচে থেকেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে, তিনি নতুন কিছু বলেননি, নতুন কিছু চাননি। বরং বেছে নিয়েছিলেন তাঁর সেই পুরোনো যাপন, তাঁর চিন্তা, চিন্তার প্রকাশ, তাঁর ক্রিয়াকলাপ, প্রতিদিনের তাঁর একই সেই বাঁচা-মরার সহাবস্থানকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দর্শনকেই। ঠিক তাই-ই, বর্তমানে আমরা যদি এই মহামারীকালে “নতুন কিছু” চাই তা হোক লকডাউনে বা লকডাউন শেষে, তা নিছক দার্শনিক যাপনের অভ্যাসের অভাবেই। অর্থাৎ, জীবন ও মৃত্যুকে একইসাথে (বিশেষত মৃত্যুকে) যাপন করার যে চর্চা তার অভ্যাসে আমরা ব্যর্থ।



এই স্থানে দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে উত্থাপিত হয়। তা হলো, মহামারীতেও যারা হাজার মৃত্যুর মধ্যেও জীবন ধারণ করে আছেন, অন্যদের সাপেক্ষে তাদের দর্শন কেমন হতে পারে। সক্রেটিসের শেষকথাগুলিও এক্ষেত্রে একটা ক্লু বা ইঙ্গিত। সক্রেটিস তাঁর সঙ্গীদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে যান যে নিরাময়ের দেবতা অ্যাসক্লিপিউসের(asclepius) নিকট এথেন্সপবাসীর একটি মোরগ ঋণ আছে, তারা যেন তা যথাযথভাবে পরিশোধ করে। সক্রেটিস যখন হেমলক পান করেন তখন অসুস্থতাজনিত কারণে প্লেটো সেস্থানে অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সক্রেটিসের বাক্য প্রমাণ করে মৃত্যুমুহূর্তেও তিনি প্লেটোর জীবন নিয়ে যত্নবান ছিলেন। এমনকি ডায়লগের বক্তা হিসেবে প্লেটো এও উল্লেখ করেন (যা সক্রেটিসের পক্ষে সেই মুহূর্তে জানা সম্ভব ছিল না) যে পরবর্তিতে প্লেটো সুস্থ হয়ে ওঠেন বিধায়ই তাদের দেবতার নিকট ঋণ যথার্থ ছিল। অন্যদিকে পুরো ডায়লগে অসুস্থ প্লেটোকে অনুপস্থিত দেখা যায়, তাঁর আবির্ভাব ঘটে সক্রেটিসের মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে। কিন্তু লেখক (প্লেটো) এমনভাবে সক্রেটিসের মুখে শব্দ রোপণ করেছেন যেন তিনি পুরোটা সময় সক্রেটিসের সম্মুখে উপস্থিত ছিলেন। এইভাবেই ডায়লগের শেষ দিকে এসে আমরা বুঝতে পারি উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতিও সহবস্থান করে। যা উপস্থিত তা কোনো না কোনোভাবে অনুপস্থিত; আবার যা অনুপস্থিত, তাও কোনো না কোনো ভাবে উপস্থিত। অর্থাৎ, যারা এখন এখানে আছেন শুধুমাত্র তারাই উপস্থিত নন, অন্যান্যরাও ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উপস্থিত।



যেভাবে জীবনে মৃত্যু অনুপস্থিত নয়—অন্তত যারা দর্শনের চর্চায় ব্রতী—সেই একইভাবে লেখকও তাঁর কর্মের মধ্যে অনুপস্থিত ছিলেন না। প্লেটো একেবারেই আলোচনার বাইরে ছিলেন না। অপর কেবলই আত্ম অপেক্ষা অপর নয়। প্লেটো সম্পূর্ণ আলোচনায় যথাযথভাবেই উপস্থিত, তাঁর অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে। আলোচনায় অংশ না নিয়েও তিনি আলোচনার অংশ, নিরব থেকেও সর্বোচ্চ সরব তিনি। তাই সকল অপর’ই আমি-আমরা, ঠিক যেভাবে সকল আমি-আমরাও অপর। এমনকি মৃত প্লেটোও মৃত নন। ঠিক এই মহামারীর মুহূর্তেও, প্রতি বাড়িতে শুধুমাত্র মৃতরাই অনুপস্থিত নয়, আবার শুধুমাত্র জীবিতরাই উপস্থিত নয়। বরং জীবিত এবং মৃতরা শুধু যার যার স্থানেই নয়, উভয়েই উভয় স্থানে উপস্থিত এবং অনুপস্থিত।



উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত, মৃত হয়েও জীবিত বা জীবিত হয়েও মৃত স্বাভাবিকভাবেই স্ব-বিরোধি বলে মনে হয়। কোনো বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই ভূতে বিশ্বাস করে না। কোনো দার্শনিক চর্চা—এমনকি করোনাভাইরাস মহামারীতেও—সকলকে জীবিত থেকেও মৃত্যু বয়ে নিয়ে চলার চর্চায় অভ্যস্ত করতে পারে না।



সৌভাগ্যবশত ডায়লগের শুরুর দিকে প্লেটো নিজেই এক রাস্তা প্রস্তাব করে গেছেন। ফিডো’কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সক্রেটিসের বিষপানের দিনে তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন নাকি অন্য কারও মুখে শুধু ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন। ফিডো উত্তর দিয়েছিলেন যে, “তিনি নিজেই সেখানে ছিলেন(I was there myself)”। অথবা ফিডো সহজভাবেই বলেছেঃ “স্বয়ং(Myself)”। “আমি সেখানে ছিলাম(I was there)”কে বুঝাতে এটা সম্পূর্ণভাবেই গ্রহণযোগ্য। “[অস্তি বা] হওয়া(to be)” ক্রিয়ার মতই, ফিডোর এই “সেখানে থাকা”কে অনায়াসেই “উপস্থিতি” হিসেবে গ্রহণ করা যায়, যা গ্রীক সহ আরও অন্যান্য ভাষা যেমন—হিব্রু ও রাশিয়ান ভাষায় নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। তবে এই ধরনের বলা শুধুমাত্র বলা-ই নয়, বরং বলা—না’বলা উভয়েই নয়। ঠিক যেমন ফিডো’র উত্তরে প্রকাশ ঘটেছে তাঁর না-অস্তি না-নাস্তি।[বৌদ্ধ যুক্তিবিদ্যার চতুষ্কোটিতে এই অবস্থানটি আমরা দেখতে পাই। চতুষ্কোটি হচ্ছে চার বিকল্পের যুক্তিতত্ত্ব। এই যুক্তিতত্ত্বের “অনুভয়” নামের চতুর্থ বিকল্প এটিকে নির্দেশ করে। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত দেখুন, নীরবতাও যৌক্তিকঃ চতুষ্কোটির একটি পর্যালোচনা – সৈয়দ নিজার।]



নিজের বাক্যাবলির গঠনের মধ্যদিয়ে প্লেটো নির্দেশ করেন কিভাবে না-অস্তি এবং না-নাস্তি’কে একই সাথে সূ্চীত করা যায়। ঠিক একইভাবে মৃতরা যেমন, যেভাবে তাদের সূচীত করা যায়: জীবিতদের জীবনেও সূচীত করা যায়–যদিও না-জীবন্ত না-মৃত। আমরা নিজেরাও পরস্পর পরস্পরের দ্বারা এই একইভাবে সূচীত। পরিশেষে, দর্শন মূলত এক চিন্তার সংশ্লেষ, চিন্তন প্রকাশের এক চর্চা, পরোক্ষভাবে বলা যে কি কৃত এবং কি অ-কৃত(Undone)... এবং শুধুমাত্র এই এক কারণেই আমি মহামারীতে “ফিডো” সম্পর্কে পড়ানোর চেষ্টা করেছি।

___________

৭ই ডিসেম্বর, ২০২০

ছবিঃ মিশেল দ্য মঁতেইন(১৫৩৩-১৫৯২)-এর ভাষ্কর্য

পুনশ্চঃ ফরাসি রেনেসাঁর অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক মিশেল দ্য মঁতেইন(Michel de Montaigne)-এর প্রাসঙ্গিক আরও একটি লেখার অনুবাদও চাইলে দেখে নিতে পারেন। "দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন তথা অনিবার্য মৃত্যুর মোকাবেলা" শিরোনামে ফরাসি দার্শনিক মঁতেইন-এর "THAT TO STUDY PHILOSOPY IS TO LEARN TO DIE" লেখাটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল মোজাফফর হোসেন সম্পাদিত শাশ্বতিকী পত্রিকায়(বর্ষ ৬, সংখ্যা ৯), অনুবাদক মীর ওয়ালীউজ্জামান।



প্রকাশঃ ২৮শে পৌষ, ১৪২৭:::১২ই জানুয়ারি, ২০২