ব্যতিক্রম অবস্থা ও জরুরী অবস্থা

জর্জিও আগামবেন



[করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে ধারাবাহিকভাবে লিখে চলা ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের Stato di eccezione e stato di emergenza (State of exception and state of emergency) লেখাটি গত বছরের ৩০শে জুলাই Quodlibet-এ প্রকাশিত হয়। আগামবেনের এই লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন খান মুনতাসির আরমান। আরমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।]



একজন আইনজ্ঞ একটি প্রান্তিক পত্রিকায় সদ্য প্রকাশিত এক নিবন্ধে যুক্তি দিয়ে ন্যায্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন—যা আরও একবার সরকার ঘোষিত ব্যতিক্রম অবস্থাকে আইনসম্মত বলতে চেয়েছে। তাঁর ব্যাপারে আমার একদা উচ্চধারণা ছিল। প্রতিনিধিমূলক একনায়কতন্ত্র (যার লক্ষ্য বর্তমান সংবিধান রক্ষা করা বা পুনরুদ্ধার করা) এবং সার্বভৌম একনায়কতন্ত্র (যার লক্ষ্য প্রথমোক্তের পরিবর্তে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা)—এই দুইয়ের মধ্যে স্মিটীয় পার্থক্য আরও একবার স্বীকার না করেই গ্রহণ করে উক্ত আইনজ্ঞ জরুরী এবং ব্যতিক্রমের (বা আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, জরুরী অবস্থা এবং ব্যতিক্রম অবস্থার মধ্যে) মধ্যে পার্থক্য করেছেন। যুক্তিটির আসলে আইনি কোনও ভিত্তি নেই। কেননা কোনও সংবিধান তার বৈধ পরাভবের(subversion, ক্ষমতা হানি) পূর্বাভাস দিতে পারে না। এই কারণেই, ‘রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব(Political Theology)’ সম্পর্কে তাঁর লেখায় যথাযথ যুক্তিতে (যেখানে সার্বভৌমের বিখ্যাত সংজ্ঞা রয়েছেঃ “যিনি ব্যতিক্রম অবস্থার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন” হিসাবে) স্মিট সম্পূর্ণভাবে Ausnahmezustand(“ব্যতিক্রমের অবস্থা”)-এর ব্যাপারেই বলেছেন। এটা জার্মান ডকট্রিনে এবং এর বাইরেও নিজেকে পারিভাষিক শব্দ হিসাবে আরোপ করেছে, বিচার বিভাগীয় আদেশ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আইন ও তার স্থগিতাদেশের মধ্যে কারোরই সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র নয় তা সংজ্ঞায়িত করার জন্য।


প্রথম স্মিটীয় পার্থক্য শনাক্ত করে, উক্ত আইনজ্ঞ এ কথাটি নিশ্চিত করেছেন যে জরুরী বলতে সংরক্ষণপ্রবণ(conservative) বোঝায়, যদিও ব্যতিক্রমটি উদ্ভাবনী(innovative)। “জরুরি অবস্থা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার জন্য ব্যবহৃত হয়, ব্যতিক্রমটি নিয়ম ভঙ্গ করতে ও একটি নতুন আদেশ আরোপের জন্য ব্যবহৃত হয়”। জরুরী অবস্থা “একটি ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা অনুমান করে”; “ব্যতিক্রম এর উল্টোতে রয়েছে, এটার আনডু করা(undoing, ফিরিয়ে আনা) যা একটি ভিন্ন ব্যবস্থার পথ উন্মুক্ত করে”।


পার্থক্যটি (সমস্ত প্রমাণ অনুসারে) রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার কার্যাবলীর বিষয়ে, স্থিতিশীলতা বা তার বিশৃঙ্খলার বিষয়ে এবং যারা আইনের একটি স্থগিতাদেশ আদেশ জারি করার ক্ষমতা রাখে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যক্তিগত মূল্যায়নের রায়কে বোঝায়। যা কিনা আইনী দৃষ্টিকোণ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে অভিন্ন, কারণ উভয় ক্ষেত্রেই এটি সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতিগুলোর শর্তহীন এবং সম্পূর্ণ স্থগিতাদেশে নির্ণীত হয়েছে। এটার উদ্দেশ্যগুলি যাই হোক না কেন, যা কেউ সুনিশ্চিতভাবে দাবী করতে পারে না। ব্যতিক্রমের অবস্থা কেবলমাত্র একটি এবং একবার ঘোষণা করা হয়, এমন কোনও উদাহরণ কল্পনা করা হয়না যা তার দ্বারা নির্ধারিত শর্তগুলির বাস্তবতা বা গভীরিতা যাচাই করার ক্ষমতা রাখে। এটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয় যে উক্ত আইনজ্ঞকে কোনও এক পর্যায়ে লিখতে হয়েছে : “আজ আমরা একটি স্বাস্থ্য [সংক্রান্ত] জরুরী অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি তা আমার কাছে অনিবার্য বলে মনে হয়।” একটি ব্যক্তিসাপেক্ষ(subjective) রায়, কৌতূহলবশত এমন কারও দ্বারা জারি করা হয়েছে যে কোনও চিকিৎসা কর্তৃত্বের দাবি করতে পারে না। একারণে অন্যদের দ্বারা এর বিরোধিতা করা সম্ভব যাদের নিশ্চিতভাবে আরও অধিক কর্তৃত্ব রয়েছে। বিশেষত যেহেতু তিনি স্বীকার করেছেন যে “বৈষম্যমূলক কন্ঠস্বর বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় থেকে এসেছে”, ফলে শেষ পর্যন্ত যাদের জরুরী অবস্থা জারি করার ক্ষমতা আছে তাদেরকে অনুরোধ করা হয় সিদ্ধান্ত নিতে। জরুরী অবস্থাকে তিনি অব্যাহত রেখেছেন ব্যতিক্রমের বিপরীতে এবং যার মধ্যে অনির্দিষ্ট ক্ষমতা রয়েছে, “কেবলমাত্র স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করে এমন ক্ষমতাগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে”। তবুও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে স্বীকার করেছেন, এই ধরনের ক্ষমতাগুলি “আগেই নির্দিষ্ট করা যায় না”। এটিকে উপলব্ধি করার জন্য একটি দুর্দান্ত আইনী সংস্কৃতি প্রয়োজন হয় না।


আইনজ্ঞের যুক্তি দ্বিগুণভাবে স্পষ্ট করে বলা যায়, কারণ এটি কেবল আইনশাস্ত্রকে এমন একটি পার্থক্য হিসাবে পরিচয় দেয়না যা এই জাতীয় নয়। সেইসাথে যেকোনও মূল্যে সরকার কর্তৃক ঘোষিত ব্যতিক্রমের অবস্থার ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য, তিনি তাঁর দক্ষতা-অতিক্রমকারী বাস্তব ও প্রশ্নবিদ্ধ যুক্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হন। এটি আরও অবাক করা বিষয়, যেহেতু তাঁর জানা উচিত যে তাঁর জন্য যা কেবলই জরুরি অবস্থা, সাংবিধানিক অধিকার এবং প্রতিশ্রুতি স্থগিত করা হয়েছে এবং লঙ্ঘিত হয়েছে যা কখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি (এমনকি দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়ও নয়)। এবং ফ্যাসিবাদ; এবং এটি কোনও অস্থায়ী পরিস্থিতি নয় যা শাসকরা (যারা ভাইরাসটি কেবল অদৃশ্য হয়ে যায়নি এবং যে কোনও মুহুর্তে পুনরায় প্রদর্শিত হতে পারে বলে পুনরাবৃত্তি করতেও ক্লান্ত হন না) দৃঢ়তার সাথে নিশ্চিত করেছেন।


সম্ভবত, এটি বৌদ্ধিক সততার একটি অবশিষ্টাংশের বাইরে, যে, নিবন্ধের শেষে আইনজ্ঞ তাদের মতামতের উল্লেখ করেছেন যারা “যথাযথ যুক্তি ছাড়াই, বজায় রাখেন যে (ভাইরাস নির্বিশেষে) পুরো বিশ্ব এখনও অস্তিত্বশীল আছে কমবেশি স্থায়ী ব্যতিক্রম অবস্থায়” এবং “পুঁজিবাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা” আইনের শাসনের যন্ত্রপাতি দিয়ে সংকট মোকাবেলা করতে অক্ষম। এই দৃষ্টিকোণে তিনি স্বীকার করেছেন যে, “ভাইরাসের মহামারী সংক্রমণ যা সম্পূর্ণ সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখে তা একটি কাকতালীয় ঘটনা এবং একটি অপ্রত্যাশিত সুযোগ, আজ্ঞাবহ জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য”। তিনি যে সমাজে থাকেন তার অবস্থা সম্পর্কে আরও সাবধানতার সাথে ভাববার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো বৈধ। মনে রাখা দরকার আইনজ্ঞরাই কেবল একা নন, দুর্ভাগ্যক্রমে তারা এখন কিছু সময়ের জন্য রয়েছে।


____________

৩০শে জুলাই, ২০২০


প্রকাশঃ ১৮ই জানুয়ারি, ২০২১