বাইরে নয়, শত্রু রয়েছে আমাদের নিজেদের ভিতরেই

জর্জিও আগামবেন


[করোনা মহামারি ও এর সাপেক্ষে জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের Lo stato d’eccezione provocato da un’emergenza immotivata শিরোনামের লেখাটা il manifesto’তে প্রকাশিত হলে দার্শনিক ও অন্যান্যদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের সূচনা হয়। বিতর্কের সাপেক্ষে পরবর্তীতে Contagio (Contagion) এবং Chiarimenti (Clarifications) শিরোনামের আগামবেনের আরও দুটি লেখা প্রকাশিত হয়। এই দুটি লেখায় তিনি তাঁর অবস্থানকে সুসংহত ও পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। আগামবেনের এই Chiarimenti শিরোনামের লেখাটির অনুবাদ করেছেন নিসর্গ নিলয়। নিলয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।]


জনৈক ইতালীয় সাংবাদিক সর্বোত্তম পেশাগত দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে আমার বক্তব্যকে বিকৃত করতে ও অসত্য প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। চলমান মহামারী [করোনা মহামারী] আমাদের যে বিভ্রান্তির মাঝে ছুঁড়ে দিচ্ছে বারবার এবং এর কারণে উদ্ভুত নৈতিক বিভ্রান্তিকে বিবেচনায় রেখে আমি আমার বক্তব্য লিখেছিলাম। এ এমন এক অবস্থা যেখানে মৃতের প্রতি সম্মান দেখাবার জায়গাটাও আর নেই। একইসূত্রে, সেই ব্যক্তির (নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি না) প্রত্যাশিত অপকৌশলের ত্রুটি ধরিয়ে দেবারও প্রয়োজন নেই। যদি কেউ স্বেচ্ছায় তা করতে চান তবে আমার ‘সংক্রমণ’ শিরোনামের লেখাটি পড়তে পারেন, লেখাটি Quodlibet প্রকাশনীর ওয়েবসাইটে আছে। এই লেখায় বরং আমি আমার ভাবনার আরও কিছু প্রতিফলন নিয়ে আলোচনা করব যাদের স্বচ্ছতা থাকা সত্ত্বেও, ভুল প্রমাণিত করবার (falsify) চেষ্টার সম্ভাবনা বিদ্যমান।


ভয়-ভীতি জীবনের শিক্ষক বা পরামর্শক হিসেবে তেমন সুবিধার নয়, তবে তা এমন কিছু বিষয় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যা আমরা সচরাচর না দেখার ভান করতাম। চলমান মহামারীর ব্যাপকতা নিয়ে মতামত দেওয়া তেমন কোন ব্যাপার নয়; সমস্যাটা তৈরি হয় যখন এর নৈতিক (ethical) ও রাজনৈতিক পরিণতি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা জাগে। প্রথমত, যে ভীতির জোয়ার আমাদের সমাজকে স্থবির করে ফেলেছে তা স্পষ্টতই দেখিয়ে দেয়, আমরা একদম ন্যাংটো জীবন(naked life)ভয়-ভীতি জীবনের শিক্ষক বা পরামর্শক হিসেবে তেমন সুবিধার নয়, তবে তা এমন কিছু বিষয় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যা আমরা সচরাচর না দেখার ভান করতাম। চলমান মহামারীর ব্যাপকতা নিয়ে মতামত দেওয়া তেমন কোন ব্যাপার নয়; সমস্যাটা তৈরি হয় যখন এর নৈতিক (ethical) ও রাজনৈতিক পরিণতি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা জাগে। প্রথমত, যে ভীতির জোয়ার আমাদের সমাজকে স্থবির করে ফেলেছে তা স্পষ্টতই দেখিয়ে দেয়, আমরা একদম ন্যাংটো জীবন(naked life)ভয়-ভীতি জীবনের শিক্ষক বা পরামর্শক হিসেবে তেমন সুবিধার নয়, তবে তা এমন কিছু বিষয় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যা আমরা সচরাচর না দেখার ভান করতাম। চলমান মহামারীর ব্যাপকতা নিয়ে মতামত দেওয়া তেমন কোন ব্যাপার নয়; সমস্যাটা তৈরি হয় যখন এর নৈতিক (ethical) ও রাজনৈতিক পরিণতি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা জাগে। প্রথমত, যে ভীতির জোয়ার আমাদের সমাজকে স্থবির করে ফেলেছে তা স্পষ্টতই দেখিয়ে দেয়, আমরা একদম ন্যাংটো জীবন(naked life)[i] ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস করি না। ইতালীয়রা সংক্রমিত ও অসুস্থ হবার বিপদ থেকে বাঁচতে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক সম্পর্ক, কাজকর্ম, এমনকি বন্ধুত্ব, প্রেম, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস – সবই ত্যাগ করতে প্রস্তুত। ন্যাংটো জীবন ও তা হারাবার ভয় মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে না, বরং অন্ধ করে, বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আলেসান্দ্রো মানজোনির উপন্যাসে প্লেগের বর্ণনায় যেমন পাওয়া যায়, তেমনিভাবে অপর (other) মানুষেরা এখন কেবলই সন্দেহজনক রোগের বাহক। তাদেরকে যে কোন মূল্যে এড়িয়ে চলতে হবে, অথবা তাদের সাথে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। মৃতরা, আমাদের মৃতরা, মৃত্যুর পরে সৎকার পাবার অধিকারটুকুও আর পাচ্ছে না। আমাদের প্রিয়জনদের মৃতদেহের কী হবে সেটাও আমরা জানি না। আমাদের আশপাশের মানুষেরা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। কোন এক অদ্ভুত কারণে চার্চ এসব ব্যাপারে পুরোপুরি নীরব। জানি না কতদিন আমাদের এভাবে জীবনযাপন করতে হবে। এ দেশের মানবিক সম্পর্কগুলো কেমন হয়ে দাঁড়াবে ততদিনে?


কেমন সেই সমাজ, যেখানে শুধু টিকে থাকা বাদে আর সবকিছু মূল্যহীন?


দ্বিতীয় বিষয়টা প্রথমটার থেকে কম গোলমেলে নয়। সরকার দীর্ঘদিন ধরে যে ‘ব্যতিক্রমী অবস্থা’য়দ্বিতীয় বিষয়টা প্রথমটার থেকে কম গোলমেলে নয়। সরকার দীর্ঘদিন ধরে যে ‘ব্যতিক্রমী অবস্থা’য়দ্বিতীয় বিষয়টা প্রথমটার থেকে কম গোলমেলে নয়। সরকার দীর্ঘদিন ধরে যে ‘ব্যতিক্রমী অবস্থা’য়[ii](state of exception) আমাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে তা এখন নিতান্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছে। এর থেকেও অনেক ভয়াবহ মহামারী পূর্বে এসেছিল, কিন্তু আমাদের চলাফেরাকেও নিষিদ্ধ করা হবে এমন জরুরি অবস্থা আগে কখনো জারি করা হয় নি। একটা স্থায়ী সংকটের মধ্যে বাস করতে করতে মানুষ আর বুঝতেই পারছে না যে তার জীবন পুরোপুরি জৈবিক একটা অবস্থায় সংকুচিত হয়ে এসেছে। এই জীবনের কোন সামাজিক-রাজনৈতিক মাত্রা নেই। শুধু তা-ই নয়, নেই কোন আবেগীয় ও সহানুভূতিশীল মাত্রাও। যে সমাজ একটা স্থায়ী জরুরি অবস্থার মধ্যে বাস করছে তা কোনভাবেই মুক্ত সমাজ হতে পারে না। আমরা সফলভাবে এমন এক সমাজের মধ্যে বাস করছি যেটি তথাকথিত ‘নিরাপত্তাজনিত কারণ’ দেখিয়ে স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়েছে। ফলস্বরূপ, আমরা নিরন্তর অনিরাপত্তা ও ভীতির জীবনে দণ্ডিত হয়েছি।


ভাইরাসের সময়কে যুদ্ধের সময়ের সাথে মিলিয়ে ফেলা আশ্চর্য কিছু নয়। সঙ্কটকালের বিধান দক্ষভাবে আমাদের কারফিউয়ের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য করে। কিন্তু যেকোন মানুষের মাঝে লুকানো এক অদৃশ্য শত্রুর সাথে যে যুদ্ধ চলছে তা যেকোন যুদ্ধের চেয়ে কিম্ভুত (absurd)। সত্যি বলতে গেলে যেন এক গৃহযুদ্ধ চলছে; শত্রু আমাদের বাইরে নয়, শত্রু রয়েছে নিজেদের ভিতরেই।


কেবল বর্তমানটাই দুশ্চিন্তার বিষয় নয়, আরও চিন্তার বিষয় হল এর পরিণাম। যুদ্ধ শেষ হবার পরেও শান্তির সময়ে যেমন কাঁটাতারের বেড়া, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির মত বিভীষিকাময় চিহ্ন রেখে যায়, এই স্বাস্থ্যজনিত সংকট শেষ হবার পরেও সরকারব্যবস্থা আমাদের নিয়ে তেমনি কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করবে— যেগুলো সে আগে কখনও সেভাবে করতে পারেনি। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চলবে; সকল ধরনের সভা-আড্ডা বন্ধ হয়ে যাবে, কোন রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সমাবেশ চলবে না— কেবল ডিজিটাল মেসেজিং চলবে, যেখানে যেখানে সম্ভব সব জায়গাতে যন্ত্র প্রতিস্থাপন করবে মানুষ-মানুষের সম্পর্ক নামক ‘সংক্রমণ’কে।

______________

১৭ই মার্চ, ২০২০


অনুবাদকের টীকাঃ


[i] আগামবেন ন্যাংটো জীবন বা (naked life) ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন তাঁর Homo Sacer বইয়ে। ন্যাংটো জীবন বলতে এমন এক অবস্থাকে বুঝানো হয় যেখানে মানুষের সকল অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাকে মোটাদাগে একটি মানবিক অধিকারহীন জৈবিক প্রাণীতে পরিণত করা হয়। এখানে আগামবেন বলতে চাচ্ছেন, করোনা মহামারীর কারণে ইতালিতে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মানুষের জীবন এমন অবস্থাতেই রূপান্তরিত হয়েছে। হোমো সাকের, বা এমন মানুষ যাকে যেকোন অবস্থায় হত্যা করা যায় কিন্তু কোন ধর্মীয় বা পবিত্র কাজে উৎসর্গ করা যায় না, মহামারীর কালে অপর(other) মানুষ তেমন একটা রূপ নিয়েই ধরা দিচ্ছে, যেখানে মানুষের জীবন অনেকটা বিকিয়ে দেবার মতই, সরাসরি হত্যা করা না হলেও তাকে অধিকারহীন এবং নিতান্ত জৈবিক সত্তার জীবন যাপন করতে হচ্ছে, যেখানে শুধু বেঁচে থাকাটাই আসল। এই ন্যাংটো জীবন আসলে রোমান হোমো সাকেরেরই একটি সেক্যুলার আদল। ড্যানিশ লেখক লারস ওটস্মান একে এক ধরনের জৈবিক-রাজনীতি বা বায়োপলিটিক্স বলেও আখ্যা দিচ্ছেন (ওটস্মান, ২০১২)।


[ii]ব্যতিক্রমী অবস্থা (State of Exception) শিরোনামে আগামবেন একটি বই-ই লিখেছেন। মোটাদাগে বলতে গেলে, আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষের কিছু অধিকার থাকে যা রাষ্ট্র আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়েও খর্ব করতে পারে না। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে সরকার সাংবিধানিকভাবেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, যেখানে এইসব অধিকার বাতিল করা হয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেখা যায়, সরকার সবসময়েই এক ধরনের অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি রাখে এবং মানুষের অধিকার খর্ব করে, এবং প্রচার করা হয় যে মানুষের ভালোর জন্যই এ কাজ করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এর মাধ্যমে সরকার তার বিরোধী মতাবলম্বীদের দমন করে, তাদের অধিকার কেড়ে নেয় এবং কিছু অবস্থায় তাদের জীবন হোমো সাকেরের ন্যাংটো জীবনে পরিণত হয়। করোনা মহামারীর সময়েও আমরা একই বিষয় দেখতে পাচ্ছি, যেখানে এমনকি আমাদের চলাফেরাকেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, কীভাবে আমরা আমাদের সামাজিক জীবন কাটাবো তাও বলে দিচ্ছে ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’। এমনকি আনুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থা না থাকলেও বা তার ঘোষণা উঠে গেলেও আমাদের জীবন সেরকম এক ব্যতিক্রমী অবস্থার মধ্যে দিয়েই নিয়তই যাচ্ছে, এবং আমাদের মানবিক সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়ছে।


ইংরেজি অনুবাদের হদিস- https://www.journal-psychoanalysis.eu/coronavirus-and-philosophers/


প্রথম প্রকাশঃ ২রা এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২রা এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/380763829724897/