নিরাময়’ই যদি খোদ মহামারী অপেক্ষা বিপজ্জনক হয়ে যায়?

পিটার সিঙ্গার ও মাইকেল প্ল্যান্ট



[করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে দার্শনিক পিটার সিঙ্গার ও মাইকেল প্লান্টের যৌথভাবে When Will the Pandemic Cure Be Worse Than the Disease? শীর্ষক লেখাটি এপ্রিলের ৬ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে প্রজেক্ট সিণ্ডিকেট ওয়েবসাইটে। অস্ট্রেলীয় দার্শনিক পিটার সিঙ্গার বিংশ শতাব্দীর পশ্চিমা নীতিদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় সুপরিচিত। তাঁর ব্যবহারিক নীতিবিদ্যা(১৯৭৯) গ্রন্থটি সমকালীন নীতিদর্শনের সমস্যাবলী নিয়ে আলোকপাত করে এবং তাঁর উদারনৈতিক উপযোগবাদী মত দারুণভাবে সমালোচিত। মাইকেল প্লান্ট Happier Lives Institute এর পরিচালক ও অক্সফোর্ডের পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো। পিটার সিঙ্গার ও মাইকেল প্লান্টের এই যৌথ লেখাটি অনুবাদ করেছেন প্রীথুলা প্রসূন পূজা। প্রীথুলা প্রসূন পূজা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী।]



বৈশ্বিক জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার ফলে আক্রান্ত দেশগুলোর সরকার সেই সমস্ত দেশে লকডাউন জারি করেছে। ফলে অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগের মতই এ রোগে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু সংখ্যাকে হয়তো নূন্যতম সীমায় আটকে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বেকারত্ব, এবং সর্বব্যাপী দেউলিয়াকরণের মত বেশ কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাও তৈরী হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জীবন রক্ষার মূল্য হিসেবে জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয়টি কি আপোষযোগ্য?


মেলবোর্ন/অক্সফোর্ডের মতে, আজ(৬ই এপ্রিল, ২০২০)পর্যন্ত, বিশ্বজনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই সরকার ঘোষিত লকডাউনের নামে বন্দী জীবনযাপন করছে, যাদের সংখ্যা প্রায় চার’শ কোটি। উদ্দেশ্য কোভিড-১৯ নামক অতি সংক্রমিত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ।


কিন্তু এই বন্দীদশা শেষ হবে কবে? আমরা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের উত্তরকে গ্রহণ করতে পারি। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, লকডাউন ততদিন অব্যাহত থাকবে যতদিন না আমরা করোনাভাইরাসকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিহত করতে পারব। সেই সুনির্দিষ্ট দিনটিই বা আসবে কবে? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ অন্তত একবার করে আক্রান্ত হবার পর?তা হয়ত নাও হতে পারে। তবে কি উপযুক্ত টীকা বা চিকিৎসা প্রকরণ উদ্ভাবন না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে এই বন্দীদশা? তাও তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, হয়তো এক বছর বা আরও বেশি! এই দীর্ঘসময় ধরে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরবন্দী থাকবে মানুষ? স্কুল, কলেজ, অফিস, রেস্তোরা- সব কি এমন তালাবদ্ধ হয়েই পড়ে রইবে?


যুক্তরাষ্ট্র প্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিকই বলেছেন যে “আমরা প্রতিষেধককে মহামারী অপেক্ষা বিপজ্জনক স্তরে নিয়ে যেতে পারিনা।” এ কথা মানতে অস্বস্তি হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। লকডাউনের স্বাস্থ্যকর দিক রয়েছে। এর ফলে সত্যিই হয়তো (অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগের মতই) মৃতের সংখ্যা কমে আসবে অনেকটা। কিন্তু তার জন্য চুকাতে হচ্ছে চড়ামূল্য। উল্লেখ্য তিনটি প্রধানতম (সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বেকারত্ব, এবং সর্বব্যাপী দেউলিয়াকরণ) সমস্যার মতই তৈরী হচ্ছে আরও নানা ধরনের সামাজিক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি। যাদের কোনটিই আপাত সমস্যা বলে মনে হবার মত বিষয় নয়, বরং তা সুনিশ্চিত এবং শীঘ্রই দৃশ্যত হয়ে উঠবে।


কিছু মানুষ বলতে চান, এখানে জীবন এবং জীবিকা রক্ষার মধ্যে আপস-মীমাংসা করবার কোন বিষয়ই নেই। জীবন রক্ষার মতই অর্থনীতির জন্যও লকডাউন একটি উপযোগী ব্যবস্থা। এ ধরনের চিন্তা নিতান্তই বহুল আকাঙ্ক্ষিত। সম্ভবত এই শ্রেণীর মানুষের ধারণা, লকডাউন অতি শীঘ্রই শেষ হতে চলেছে। এবং আমরা যদি ভাইরাসটির পুরোপুরি নিষ্ক্রীয়করণের আগেই লকডাউন তুলে দেই, তাতে হয়ত খুব অল্পসংখ্যক মানুষই মারা যাবে, যারা এমনিতেও যেকোনভাবেই মারা যেতে পারতেন। তবে, জীবন ও জীবিকা, এই দুইয়ের মধ্যে আপসরফার প্রশ্ন এত সহজেই নাকচ করে দেয়া যায়না, তা সম্ভবও নয়।


খুব সঠিক করে বলতে চাইলে এমন বলাই যেতে পারে যে লকডাউন শেষ হবার সঠিক সময় আজ হতে আগামী দশ বছরের মধ্যেই। এমনটা বলা হয়ত নিরাপদও, কিন্তু তা উপযোগহীন। একটি ব্যবহারযোগ্য উত্তরের খোঁজ করতে হলে অবশ্যই জানতে হবে কি করে আপসরফা করা যায়!


কি করে রফা করা যায়?


প্রথমত, কোনভাবেই করোনা ভাইরাস থেকে যাওয়ার ক্ষতির মূল্যকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। নৈতিক মনস্তত্বের নানান গবেষণা “identified victim effect”(আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিহ্ণিতকরণের প্রভাব) এর কথা বলে। মানুষ একই সাহায্য অপরিচিত বা অস্পষ্টভাবে বর্ণিত একদল মানুষের জন্য প্রসারিত করার চেয়ে বরং একজন নির্দিষ্ট ও পরিচিত আক্রান্ত/ভূক্তভোগীকে দিতে পছন্দ করে বেশি। আমরা এধরনের চিহ্নিতকরণের প্রভাবসমূহকে সাধারণত নৈতিক ভুল বলে মনে করি। আমাদের উচিৎ আরও উদার হয়ে যতটা সম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া, এমনকি কে উপকৃত হচ্ছে/হবে তা না জেনেও।


প্রায় একই ধরনের আরেকটি বিষয় হচ্ছে “identified cause effect”(চিহ্নিত কার্যকরণ), যা কোভিড-১৯ সম্পর্কে আমাদের সামগ্রীক চিন্তাকে সংকীর্ণ করে ফেলে। কারা ভুক্তভোগী তা না জেনেই আমরা শুধু ভোগান্তির একটি উৎসকেই বিবেচনা করছি। এমনকি অন্যদের সমস্যা সম্পর্কেও আমরা জানতে পারিনা। কারণ, হাসপাতাল আঙিনা বা অস্থায়ী চিকিৎসা তাঁবুতে স্ট্রেচারে বহন করা প্রচুর লাশ দেখতে দেখতে আমরা সম্মোহিত হয়ে আছি। মৃত্যুদৃশ্য আমাদের অন্ধ করে রেখেছে। মৃত্যুকে রোধ করতঃ আমরা সমাজের কি কি বিপদ ডেকে আনছি তা অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে নাকি?


দ্বিতীয়ত, আপোষ করতে হলে বিভিন্ন ধরনের ফলাফলকে একটি সুনির্দিষ্ট এককে মূল্যায়িত করতে হবে। বর্তমান সমস্যা (জীবন রক্ষার্থে অর্থনৈতিক সুস্থিরতাকে নাকচ করা যায় কিনা) সমাধানের পথে বড় বাধা এখানেই যে, আমরা “রক্ষিত জীবন” আর “হারানো জিডিপি”-এর মধ্যে সরাসরি কোন তুলনা করতে পারিনা। কিন্তু এদের একটি সাধারণ এককে রূপান্তর আবশ্যক।


দীর্ঘদিন লকডাউন অব্যহত থাকার ফলাফলস্বরূপ আমাদের অর্থনীতির চাকা ধীর হয়ে যাবে। এই দুর্বল অর্থনীতির পক্ষে হয়ত খুব অল্পসংখ্যক ডাক্তার, নার্স, বা ওষুধের ব্যয় বহন করা সক্ষম। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এর হিসাব মতে, গুণগত জীবন যাপন নিশ্চিত করতে গেলে একজন ব্যক্তির এক বছরের খরচ হতে পারে প্রায় ত্রিশ হাজার ডলার। অর্থাৎ, একজন রোগীকে বাড়তি একবছর স্বাস্থ্যকর উপায়ে বাঁচিয়ে রাখার বিনিময়ে গুণতে হবে এই পরিমাণ অর্থ।


আমরা আমাদের অর্থনীতির নিরিখে লকডাউনের আর্থিক মূল্য হিসাব করতে পারি। আবার ভাইরাসযুক্ত অবস্থায় স্বাস্থ্যকর উপায়ে আমরা জীবনে কয়টি বছর পেতে পারি তাও হিসাব করা সম্ভব। একইভাবে এই দুইয়ের তুলনা থেকে আমরা এও গণনা করতে পারি, লকডাউনজনিত কারণে অর্থনীতি যে ক্ষীণ রূপ পরিগ্রহ করছে তাতে স্বাস্থ্যকর জীবন থেকে ঠিক কতগুলো বছর আমরা হারাচ্ছি!


কিন্তু এ ধরণের কোন সুস্পষ্ট পদক্ষেপ আমরা এখনো দেখতে পাই না। অর্থনীতিবিদ পল ফ্রেজার “back-of-the-envelope analysis”-এর প্রস্তাব করেন। খামের উল্টো পিঠের এই বিশ্লেষণে একটি চমকপ্রদ ফলাফল পাওয়া যায়ঃ লকডাউনের কবলে পড়ে স্বাস্থ্যকর জীবনের যতটা সময়(বছর) আমাদের হারাতে হবে তা না হওয়াই অধিকতর ভালো।


এর পেছনের কারণগুলির মধ্যে একটি হলো বয়স্ক এবং বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা। ফ্রেজার কিছু পূর্বানুমান করেন যা প্রশ্নাতীত নয়। তিনি সব ধরনের অর্থনৈতিক মন্দাকেই শুধুমাত্র সরকারী কার্যক্রমের সাথে যুক্ততার প্রতি আরোপ করেছেন। অথচ কোভিড-১৯ যেকোনক্রমেই অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ভাঙন আনতে সক্ষম। এমনকি মৃত্যুহার গণনা করতে গিয়ে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করেছেন। আমাদের হাসপাতালগুলোর ইন্টেন্সিভ কেয়ার বা জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ইউনিটগুলো অতিরিক্ত চাপের ফলে যখন রোগীদের স্থান সংকুলানে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখনও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেতে পারে।


অর্থাৎ, শুধুমাত্র “গুণগত উপায়ে জীবন ধারণের সময়ের হিসাব” খুবই সংকীর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ। স্বাস্থ্যই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের অর্থনীতি এবং সামগ্রীক স্বচ্ছলতা সাপেক্ষে বিভিন্ন কর্মপন্থার ফলাফল সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ এবং তুলনামূলক আলোচনা এখন সত্যিই জরুরি।


বিশেষজ্ঞজন প্রবর্তিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট কার্যকর করা এই কাজের জন্য একটি উপযুক্ত পদ্ধতি হতে পারে। এতে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের জীবন নিয়ে কতটা সুখী এবং কতটা সন্তুষ্ট তার হিসাব নেয়া হয়। ফলে আমরা হয়তো নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে একটি গণনা/হিসাব করতে পারব। এছাড়া কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিভিন্ন কর্মপন্থা/বিবেচনার মধ্যকার তুলনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন হয়ে পড়বে।


বৈশ্বিক মহামারী চলাকালীন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে চাকরিচ্যুত হওয়া। গত দুই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে, যার সিংহভাগই মহামারী বা লকডাউনজনিত কারণে। ভারতে অভিবাসী কর্মীদের জন্য লকডাউন বিধ্বস্ত হয়ে উঠেছে, কারণ এদের অধিকাংশেরই আয়ের দ্বিতীয় কোন পথ নেই। বেকারত্বকে আমরা সকলেই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অমঙ্গলজনক হিসেবে মানি। তবুও বেকারত্ব নিরসনের স্বার্থে জীবনের স্বাস্থ্যকর সময়ের(বছর) অপচয়কে আমরা আবশ্যক বলতে পারি কি?


সরাসরিভাবে স্বচ্ছলতার চিন্তা করলে আমাদের সামনে এই দুইয়ের তুলনা উপস্থিত হতেই পারে। স্বচ্ছলতার উপর বেকারত্বের ভয়ানক প্রভাব আছে। বেকারত্ব ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যক্তির শতকরা ২০ ভাগ সন্তুষ্টি নষ্ট করে। এই তথ্য থেকে আমরা দীর্ঘ জীবন এবং তার স্বচ্ছলতা নিয়ে সন্তুষ্টির সাথে লকডাউনের মানবিক মূল্যের তুলনা করতে পারি। একটু বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করতে গেলেই দেখা যাবে এর সাথে যুক্ত হবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং বিবিধ উদ্বেগসহ আরও কিছু বিষয়। এইসব বিষয়কে সমন্বয় করে এমন একটি সামগ্রিক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন যা বলে দিতে পারে কখন লকডাউন শেষ হওয়া উচিৎ।


পৃথিবীতে মানুষের পাশাপাশি করোনাভাইরাস হয়তো আরও কিছুদিন থাকবে। মাসের পর মাস সরকার আরোপিত এই বন্দীকরণই কি শুধুমাত্র সঠিক করণীয়? হয়ত আমরা সেসব জানিনা। এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা নীতি-দার্শনিক সেজে নিজেদের ইচ্ছেমত কিছু বলতে পারিনা। এ ধরনের সমস্যার মুখে বিভিন্ন কর্মপন্থার নানামুখী প্রভাবের সঠিক পরিসংখ্যান এবং তুলনামূলক সম্পর্ক নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করা উচিৎ ভূয়োদর্শনলব্ধ গবেষকদের। তবে সেই তুলনা কখনোই স্বাস্থ্য বা সম্পদের হিসাবে হওয়া উচিৎ নয়। হতে হবে মঙ্গলের(well-being) নিরীখে এবং এটিই চল ব্যবস্থার চূড়ান্ত একক।


______________

৬ই এপ্রিল, ২০২০


প্রথম প্রকাশঃ ২রা জুন, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২রা জুন, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/386685432469819/