তিক্ত নিরাময়
রবার্তো এসপজিতো
[ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের Lo stato d’eccezione provocato da un’emergenza immotivata শিরোনামের লেখাটা il manifesto তে ২৬শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তে প্রকাশিত হলে দার্শনিকদের মধ্যে বিতর্কের সূচনা হয়। লেখাটার সমালোচনা করে বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক জঁ-লুক ন্যান্সি “Antinomie” তে Viral Exception নামে একটি রচনা লেখেন। ন্যান্সির লেখাটি জর্জিও আগামবেনের লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরদিনই অর্থাৎ ২৭শে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। ন্যান্সির লেখা প্রকাশের পরদিন অর্থাৎ ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তে ইতালীয় দার্শনিক রবার্তো এসপজিতো এই বিতর্কে ঢুকে পরেন, ন্যান্সির সমালোচনা করে ও এই বিতর্কে নিজের অবস্থান জানিয়ে ‘’Antinomie’’ তে ইতালীয় ভাষায় প্রকাশিত হয় তাঁর Curati a oltranza (Cured to the Bitter End) লেখা। বায়োপলিটিক্সে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য এসপজিতো খ্যাত।]
জঁ-লুক ন্যান্সিকে সমসময়ই চিত্রায়িত করে এমন সব বিশেষ বৈশিষ্ট্যকেই আমি খুঁজে পেয়েছি ন্যান্সির লেখাটাতে — বিশেষভাবে বললে এক বুদ্ধিবৃত্তিক ঔদার্যের কথা বলতে হয় যা দিয়ে অতীতে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম, অপার প্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলাম তাঁর চিন্তায়। বিশেষভাবে সম্প্রদায়(communities)নিয়ে আমার কাজে প্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলাম। বায়োপলিটিক্স প্যারাডাইমে ন্যান্সির প্রবল বিরোধিতায় এসে আমাদের আলাপ থমকে দাঁড়াত। এই প্যারাডাইমের বেলায় তিনি সর্বদাই বিরোধিতা করতেন, এই লেখায়ও তেমনটাই ঘটেছে। বায়োপলিটিক্স প্যারাডাইম আর প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি—এই দুই বস্তু যেন আবশ্যিকভাবে বিপরীত গোছের এমনটাই তাঁর কথাতে মনে হয়। যেখানে 'ভাইরাল'(Viral) প্রত্যয়টা নিজেই ইঙ্গিত দেয় একই প্রতিরোধ লক্ষণের(Immune Syndrome) দ্বারা সংযুক্ত বিভিন্ন ভাষার—রাজনৈতিক, সামাজিক, মেডিক্যাল ও প্রযুক্তিগত—মধ্যকার এক বায়োপলিটিক্যাল সংমিশ্রণের। একই প্রতিরোধ লক্ষণ বলতে বুঝায় এক প্রান্তিকতা যা কমিউনিটাসের শব্দকোষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্থবিদ্যাগতভাবে। যদিও দেরিদা নিজেই ইমিউনাইজেশনের বর্গ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে, বায়োপলিটিক্সের প্যারাডাইমের সাথে নিজের মোকাবিলাতে ন্যান্সি'র অস্বীকৃতি সম্ভবত ফুকোর প্রতি ডিসটোনিয়া'র কারণেই ঘটে যা তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে দেরিদার থেকে লাভ করেছিলেন। যা-ই ঘটুক না কেন, আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন আমরা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমকালীন তিন দার্শনিককে নিয়ে কথা বলছি।
দেখার চোখ যাদের আছে তাঁরা বায়োপলিটিক্সের প্রতিনিয়ত প্রয়োগের ঘটনাকে অগ্রাহ্য করতে পারেনা। এককালে কেবলই প্রাকৃতিক বলে বিবেচিত জন্ম-মৃত্যুর মত বিষয়ের পরিসরে জৈবপ্রযুক্তির উদ্ভাবন হতে আরম্ভ করে, অভিবাসী ও কমবেশি গুরুতর মহামারীগুলোর নিয়ন্ত্রণের জৈবসন্ত্রাসবাদ অব্দি আজকালকার সকল রাজনৈতিক বিবাদের মজ্জাতে রাজনীতি ও জৈবিক জীবনের মধ্যকার সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ফুকো'র নিজের সূত্র আমাদেরকে বায়োপলিটিক্যাল ফেনোমেনার ঐতিহাসিকভাবে পৃথকীকৃত চরিত্রের দিক থেকে নজর সরিয়ে ফেলতে পরিচালিত করবে না। একটা দাবি হচ্ছে, ফুকো যেমনটা করেছেন, গত আড়াই শতকে রাজনীতি ও জীববিদ্যার মধ্যে ক্রমবর্ধমান এক নিয়ত আটোসাটো বন্ধন গড়ে উঠেছে। সমস্যাজনক এবং মাঝেমধ্যেই বিয়োগান্তক ফলাফলের মধ্যদিয়ে এই বন্ধন গড়ে উঠেছে, গিট্টু বেঁধেছে। অন্য দাবিটা হচ্ছে তুলনা করা যায় না এমন ঘটনা ও অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে, সদৃশ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত জেলখানা ও ইতালির উত্তরদেশীয় নিম্নভূমির দুই সপ্তার কোয়ারেন্টিনের মধ্যে কোনো প্রকারের তুলনা করা থেকে নিজেকে আমি বিরত রাখতে চাইব। আইনী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অবশ্যই জরুরী অবস্থা জারি এই জাতীয় মামলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। এই জরুরী অবস্থা জারী রাজনীতিকে ব্যতিক্রম দশার—যা পরিণামে নির্বাহী বিভাগের পক্ষে থেকে ক্ষমতার ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে— কার্যপ্রণালীর দিকে ঢেলে দেয়। কিন্তু এইক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ঝুঁকি নিয়ে আলাপ করাটা আমার কাছে বলতে গেলে অতিরঞ্জিতই মনে হয়েছে। আমি মনে করি যে, আমাদের অবশ্যই স্তরগুলোকে আলাদা করা এবং দীর্ঘদিনের-চালু প্রক্রিয়া ও সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্যে পার্থক্য টানার চেষ্টা করতে হবে। পূর্বতন অর্থাৎ দীর্ঘদিনের-চালু প্রক্রিয়া অনুসারে, কমপক্ষে তিন শতক ধরে রাজনীতি ও মেডিসিন পারস্পরিক প্রয়োগে বাঁধা পড়েছে। এবং কিছু একটা পরিণামে উভয়কেই রূপান্তরিত করেছে। একদিকে এটা রাজনীতির মেডিক্যালাইজেশনের প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে গেছে, যেটা আপাতদৃষ্টিতে যেকোন ভাবাদর্শিক সীমাবদ্ধতার ভার ঝেড়ে ফেলে এবং ঝুঁকি থেকে নিজের নাগরিকদের "নিরাময়ে" আরও অধিক নিবেদিত হিসেবে নিজেকে হাজির করে। এটা প্রায়শই অধিক গুরুত্ব তৈরী করার জন্য দায়ী। অন্যদিকে, আমরা মেডিসিনের রাজনীতিকীকরণের সাক্ষী হই। মেডিসিন খাটানো হয় সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাজে যা অবশ্য মেডিসিনে থাকে না। এই কাজ করোনা ভাইরাসের প্রকৃতি ও গুরুত্ব প্রসঙ্গে ভাইরোলজিস্টদের চরমভাবে ভিন্নধর্মী মূল্যায়নকে ব্যাখ্যা করে। এই উভয় প্রবণতাই রাজনীতিকে তার ধ্রুপদী চরিত্র থেকে বিকৃত করে। আর একারণে তার লক্ষ্য একক ব্যক্তি বা সামাজিক শ্রেণী থাকে না, সে ধারণ করতে পারে না। ধারণ করতে পারে বরং স্বাস্থ্য, বয়স, লিঙ্গ বা এমনকি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে পৃথক করা জনগণের ভাগগুলোকে। কিন্তু একেবারে নায্য উদ্বেগকে মেনেই আবারও বলতে চাই, আমাদের ঐকতানের বোধকে এই সময়ে হারিয়ে না ফেলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
আমার কাছে মনে হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা এবং অতিঅবশ্যই জাতীয় ও আঞ্চলিক বিশেষায়িত ক্ষমতার উদ্ভটভাবে পরস্পরকে ছাপিয়ে যাওয়া ইতালিতে এইকালে যা ঘটছে তা এক নাটকীয় সর্বগ্রাসী কব্জাকরণের চেয়ে বরং গণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের ভাঙনের চিহ্ন বলা চলে।
____________
২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০
প্রথম প্রকাশঃ ৩০শে মার্চ, ২০২০
সর্বশেষ সংশোধনঃ ৩০শে মার্চ, ২০২০
লিঙ্কঃ shorturl.at/einB1