জীবনের ভার

মানব জীবনের অর্থনীতি


আশিল এমবেম্বে


[আশিল এমবেম্বে(Achille Mbembe) ক্যামেরুনীয় দার্শনিক। জৈব-রাজনীতি (biopolitics) প্যারাডাইমের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে এবং ‘মারণ-রাজনীতি’ (necropolitics) ধারণা হাজির করে এই চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে দার্শনিক মহলে নিজের জায়গা পোক্ত করেছেন। উত্তর-উপনিবেশিক তত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে এমবেম্বের The weight of life: On the economy of human lives শিরোনামের লেখাটি Eurozine পোর্টালে (Isabelle Chaizeৃত ইংরেজি অনুবাদ) গত বছরের ৬ই জুলাইতে প্রকাশিত হয়। এমবেম্বের এই লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন রায়হান রহমান। রায়হান রহমানের প্রকাশিত বই (হাসান আল জায়েদের সাথে যৌথভাবে অনূদিত): নীরদ সি চৌধুরীর মনইসলাম, সাম্রাজ্য ও হারানোর বেদনা (২০২০)। ইয়ান অ্যালমন্ডের এই বইটির অনুবাদ প্রকাশ করেছে ইউপিএল।]



কোভিড-১৯ সৃষ্ট মন্দার প্রভাব সীমিত করার তাড়ায় কেউ কেউ জীবন বাঁচানোর চেয়ে অর্থনীতি বাঁচানোকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু দেহ ও সম্পদের অনিশ্চিত নিঃশেষকরণই সম্বৃদ্ধি নয়। মৌলিক প্রয়োজন মেটানো দিয়েই কেবল আমরা সকলের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারি।


কিছু কিছু অনুমান যেগুলো গত অর্ধ-শতাব্দী ধরে অনেকবার উঠে আসা সত্ত্বেও উপেক্ষিত হয়েছে, কোভিড-১৯ সেগুলোকে নিশ্চিত করেছে। এই অনুমানগুলোর একটি মহাবিশ্বের বিশালতার মাঝে মানব প্রজাতির মর্যাদা ও অবস্থান নিয়ে চিন্তিত। আমরা পৃথিবীর একমাত্র বাসিন্দা নই, নই অন্য সকল প্রাণীর উপরে। আমরা অণুজীব (microbe) ও ভাইরাস এবং সকল ধরনের ভেষজ, খনিজ ও জৈব প্রভাবের সাথে অপরিহার্য মিথষ্ক্রিয়ার ছেদবিন্দুতে অবস্থান করি। আরও সঠিকভাবে বললে আমরা অংশত এসব ‘অন্য প্রাণ’ দিয়ে গঠিত। তবে এরা আমাদের ক্ষয় ও পুনর্গঠনও করে। এরা আমাদের গড়ে তোলে আবার ভেঙে ফেলে, আমাদের দেহ থেকে শুরু করে আমাদের পরিবেশ ও আমাদের যাপন-প্রণালি, সবই।


এই অতিমারী কেবল মানব সভ্যতার কাঠামোর ও আধেয়’র জটিলতা ও ভঙ্গুরতাই উন্মোচন করেনি, এর সকল নৈরাজ্য ও বৈচিত্র্যসহ খোদ জীবনের অসহায়ত্বকেই চোখের সামনে নিয়ে এসেছে— যে দেহ এই জীবনকে ধারণ করে ও যে দম সে ছাড়ে থেকে সেটা থেকে শুরু করে যে পুষ্টি ছাড়া এটা নির্জীব হয়ে যাবে সেই পর্যন্ত। এই মৌলিক অসহায়ত্বই মানবতার সার। কিন্তু নানান মাত্রায় প্রতিটা জীবনই এই গ্রহের অংশীদার। দানবীয় শক্তিগুলি এই গ্রহকেই অধিংকাশ জীবিত প্রাণীর জন্য বসবাসের অনুপযোগী (যদি বাসের-অযোগ্য না হয়ে থাকে) বানিয়ে ফেলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।

Bessengue Douala. La passerelle (the small bridge) by Alioum Moussa. Photo by Sandrine Dole from Wikimedia Commons.




একটি প্লানেটারি (planetary)পারম্পর্য


যে বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও অবিচার এই বিশ্বের কাঠামো হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, এই অতিমারী তাদেরকেও উন্মোচন করেছে। বিচ্ছিন্ন প্রগতি সত্ত্বেও যে ‘চিরন্তন শান্তি’ ইমানুয়েল কান্ট আশা করেছিলেন, তা এখনো অধিকাংশ মানুষের কাছে মরীচিকা হয়েই রয়ে গেছে। যেকোন সময়ের মত এখনো অসংখ্য জাতির সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা শেষপর্যন্ত যুদ্ধ দিয়েই রক্ষা ও নিশ্চিত করা হয়। অন্যভাবে বললে: বাছবিচারহীন রক্তপাতের সম্ভাবনায়। এটারই গালভরা নাম—‘ক্ষমতার ভারসাম্য’। এমন একটি ক্ষমতা কাঠামোর উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংহতির একটি ব্যবস্থা যা জাতীয় সার্বভৌমত্বকে অতিক্রম করে, তা এখনো অনেক দূরে। একই সাথে, স্বশাসিত সাম্রাজ্যের ধারণায় ফিরে যাওয়া একটি ফ্যান্টাসির বেশি কিছু না।


এরই মাঝে, বিভিন্ন শক্তির একটা বিশাল সমাবেশ যেগুলো যতটা ভৌত বা প্রাকৃতিক ততটাই জৈবিক বা যান্ত্রিক—প্রযুক্তি, গণমাধ্যম এবং পুঁজিবাজারসহ—সবাই বিশ্বের বিভিন্ন অংশের মাঝে ফাটলের জাল বুনতে ব্যস্ত।


একটি প্লানেটারি পারম্পর্য ইদানীং আকার ও শক্তি লাভ করছে যা রাষ্ট্রীয় সীমানাকে উপেক্ষা করে (এবং স্ববিরোধীভাবে এর উপর নির্ভরও করে) এবং প্রাতিষ্ঠানিক কার্টোগ্রাফির সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। আন্তঃনির্ভরতা ও আন্তঃসম্পর্ক দিয়ে গঠিত, এটি ঠিক বিশ্বায়নের (globalization) মত নয়; অন্তত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে শব্দটির যে অর্থ সেটা মাথায় রেখে। এটি বরং একটি বিস্ফোরিত সমগ্রতা: নেটওয়ার্ক, প্রবাহ ও সার্কিট যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল গতিতে বিলীন হচ্ছে এবং বহুবিধ মাত্রায় পুনর্গঠিত হচ্ছে। এই সমগ্রতার উদ্ভব বিভিন্ন ধরনের জট থেকে, অন্তত বসতি এলাকা এবং বন্যতা ও তাদের নিজ নিজ সীমানার মধ্য থেকে নয়। এই পৃথিবীর বুনন অসংখ্য চরমতা এবং বহু বড় ও ছোট কেন্দ্র দিয়ে গঠিত। কোন কিছুই এর বাইরে না। সবকিছুই কোন না কোন সময় সবধরনের প্রবাহের দ্রুত সঞ্চালনের রিলে হিসেবে কাজ করে।


অবশ্যই, সবকিছু একই ছন্দে চলে না। তবে এর প্লানেটারি অস্তিত্বের সব ধরনের প্রকাশ (স্থলে, সমুদ্রে, বাতাসে, কক্ষপথে, ফাইবার-অপটিকে) এখন গতি ও বেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। শুধুমাত্র যে পুঁজির প্রবাহ চলাফেরা করে তা নয়। মানুষ, পশু-পাখি, জীবাণু ও বস্তু সবকিছুই চলনশীল, যেমনটা সবধরনের পণ্য ও তথ্য-উপাত্ত। কাঁচামাল এক স্থান থেকে নিষ্কাশন করা হয় আর পরিশোধিত হয় আরেক স্থানে। আবার উপাংশগুলোকে পণ্যে একত্রিত করা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি স্থানে।


এগুলো যতই বিচ্ছিন্ন মনে হোক না কেন, যে রাস্তা এগুলো অনুসরণ করে তা অনেকটাই একই, স্থুলতম বাস্তবতা থেকে অতিসূক্ষ্ম বিমূর্ততা পর্যন্ত। আমরা এমন প্লানেটারি যৌগিকতার ক্রমশ উন্নতি প্রত্যক্ষ করছি যা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এবং নেটওয়ার্ক জুড়ে কাজ করলেও অল্পবিস্তর স্থানিকভাবে খন্ডিত।



নিষিদ্ধ রক্ত


কোভিড-১৯ যে কোন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ট্রাজিক ভিত্তিগুলোর একটিকে উন্মোচন করে দিয়েছে, এবং নিঃসন্দেহে এমন একটিকে যেটি ভুলে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু কোন জীবন? কার দ্বারা, কখন, কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে উৎসর্গীকৃত?


এমন কোন মানব সম্প্রদায় নেই যার ভিত্তিমূলে ‘নিষিদ্ধ রক্তের’ (যে রক্ত কেবল কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে ঝরানো যাবে) ধারণা নেই। উৎস, ধর্ম বা জাতি, যার মাধ্যমেই ঐক্যবদ্ধ থাকুক না কেন, সব সম্প্রদায়ই গভীরভাবে বিসদৃশ মানুষদের সম্ভার। রক্তপাতের নিষেধাজ্ঞা যেন অন্তর্কলহের বিপরীতে রক্ষাকবচের মত। এটি একই সম্প্রদায়ের মানুষদের খুনোখুনি না করেই সহাবস্থানের সুযোগ দেয়।


শেষ বিচারে, কিভাবে একটি সম্প্রদায় অস্তিত্বের প্রতি হুমকি মোকাবিলা করে সেটিই একটি সম্প্রদায়কে আরেকটি সম্প্রদায় থেকে আলাদা করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, সম্প্রদায়কে প্রাণে বাঁচাতে কোন জীবনগুলো ছুঁড়ে ফেলা যায়— এই জটিলতাকে কিভাবে সম্প্রদায়টি সুরাহা করে। এধরনের বলিদান কার্যকর করার এমন কোন উপায় কি আছে যা কোন না কোনভাবে অন্তর্কলহকে উসকে দেয়ার বা সামাজিক বন্ধনের ভেঙে যাওয়া বা রাজনৈতিক এককটিকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার দিকে নিয়ে যায় না?


খুব বেশি আগের কথা নয়, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ এই দোটানাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম সিদ্ধান্ত হিসেবে নির্মাণ করে। যুদ্ধ ছিল এসব ঐতিহাসিক ঘটনার আর্কিটাইপ যার কিছু জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন ছিল যেন অন্যরা বেঁচে থাকবে বা এমনকি সম্বৃদ্ধ হতে পারবে। বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বিবাদগুলো নির্মম বলপ্রয়োগ দাবি করতো। লক্ষ্য ছিল সম্প্রদায়ের চলমান অস্তিত্বের হুমকি সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত শত্রুকে খুন করা। কিন্তু যুদ্ধের মানে হচ্ছে এটা একটি সার্বজনীন মৃত্যুর বিনিময় এবং শত্রুর পিছনে ছোটা মানে এর বিপরীতে আক্রমণের মুখে পড়ার ঝুঁকি।



যে জীবন নিঃশেষের


উনিশ শতক থেকেই, জীবনের শুমারী ও মাপাজোঁকা— এবং এর ফলস্বরূপ বলিসংক্রান্ত সম্ভাবনাগুলোর পুনর্বন্টন— মূলত অর্থনীতির বিষয় ছিল। কার্ল পলান্যি মন্তব্য করেন যে, অর্থনীতি—বিশেষ করে বাণিজ্য—সবসময় শান্তির সাথে জড়িত ছিল না। অতীতে, তাঁর ব্যাখ্যায়, ‘বাণিজ্যের সংগঠন সবসময় সামরিক ও যুদ্ধ সংক্রান্ত ছিল; এটা ছিলো দস্যু, যাযাবর, সশস্ত্র কাফেলা, শিকারি, তরোয়াল-ধারী বণিক, শহরের অস্ত্রধারী প্রশাসক, অভিযাত্রী ও অনুসন্ধানকারী, উপনিবেশবাদী ও দিগ্বিজয়ী, মানুষ শিকারি ও দাস-ব্যবসায়ী, নিবন্ধিত কোম্পানির ঔপনিবেশিক সৈন্যের এক সংযোজন’। [i]


ইদানীং, জীবনকে আর সমাজে ব্যক্তির অবস্থানের নৈতিক বাধ্যবাধকতার আনুষঙ্গিকতার বিপরীতে আর মাপা হয় না। তাদের মাপা হয় হিসাবনিকাশের পরম্পরা অনুসারে। এসব হিসাবনিকাশ সবই একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস ও নির্দিষ্ট ধর্ম অনুসরণ করে। সমাজের এরকম সার্বভৌমত্ব আর নেই। এটা এখন কেবলই বাজারের একটা উপাঙ্গে পরিণত হয়েছে।


এটা বর্তমান সময়ের প্রধান মতবাদ (dogma) ও একই সাথে প্রধান বাজি। এই বাজির শর্তানুযায়ী, বাণিজ্যের মাধ্যমে (বা মাঝেমাঝে দখলদারির মাধ্যমে) অর্জিত মুনাফা সবসময় অন্য সকল মানবীয় অভিপ্রায়কে খর্ব করে। কিছু পণ্য বিক্রি করে পাওয়া লাভ ব্যতীত আর কোন লাভ নেই। জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় বাজারমূল্য দিয়ে।


প্রতিটি মানব জীবনই একটি সম্ভাব্যতা, এবং জীবনের হিসাব নিকাশ সম্ভাব্যতার হিসাব-নিকাশেরই অনুরূপ। এই হিসাব-নিকাশে একটিমাত্র যে বিষয়টির মূল্য আছে তা হলো দক্ষতা। যেখানে জীবনকে ব্যয় করা যাবে, সে পর্যন্তই জীবনের ব্যাপ্তি। অনেকের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে আমাদের অবশ্যই কিছু জীবন পরিত্যাগ করতে সম্মত হতে হবে।


যেহেতু অ্যানথ্রোপোসিন (anthropocene) আমাদের নতুন একটি ভাইরাস ও রোগজীবাণুর যুগে প্রবেশকে নির্দেশ করে, এখন কোন শরীরগুলো সম্প্রদায়কে সংক্রমিত করবে এবং অনেকের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে কোন জীবনগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে সেটা চিহ্নিত করার প্রশ্ন অদূর ভবিষত্যের প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে উঠতে প্রস্তুত।

Alioum Moussa’s performance during UD Salon Urbain de Douala 2010. Photo by Sandrine Dole from Wikimedia Commons.



ভবিষ্যতের অধিকার


এসময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো মানব নিঃসৃত গ্রীনহাউজ গ্যাসসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা। গ্রীনহাউজ গ্যাসগুলো হলো কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেনের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব; এছাড়াও আছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধুলিকণা, বিষাক্ত গ্যাসের নির্গমন, অদৃশ্য পদার্থসহ সবধরনের সূক্ষ্ম কণা। শীঘ্রই বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অক্সিজেনকে ছাড়িয়ে যাবে। আফ্রিকায় সবচেয়ে চিন্তার বিষয়টি হলো জলাধারে মাছের মজুত কমে যাওয়া, ম্যানগ্রোভ বন ও জলার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, নাইট্রেট দূষণের বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতি। আর পাশাপাশি বনাঞ্চলের বাণিজ্যিক ব্যবহার, কৃষি-রাসায়নিক দ্রবের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, প্রাকৃতিক ভূমির বেদখল, বিরল প্রজাতির বিলুপ্তি— সংক্ষেপে, জীবমণ্ডলের (biosphere) বিনাশ।


এর কোনকিছুই দৈবঘটনার ফল নয়। বরং এটা পৃথিবীর সম্পদের নিষ্কাশন ও অপচয়ের অনিবার্য পরিণাম, এমন একটি দৃষ্টান্ত বা প্যারাডাইম যা কেবলমাত্র গ্রহব্যাপী প্রযুক্তিগত ও শিল্প নেটওয়ার্কে জীবাশ্ম জ্বালানীর নিত্য এবং নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার দ্বারা বজায় রাখা হয়েছে। মানব সভ্যতা টিকবে না, যদি আমরা এভাবে পৃথিবীর গভীর থেকে গভীরতর স্তর থেকে তুলে আনা শক্তির ব্যবহারের উপর নির্ভর করতে থাকি।


পৃথিবীর বর্তমান দশা থেকে বোঝা যায় কোভিড-১৯ এর মত ঘটনা নিকট ভবিষ্যতে আবার ঘটবে। মাংস বাজারের শিল্পায়ন, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যকার সংস্পর্শ বৃদ্ধি, এক-ফসলী চাষ ও জলবায়ু বিপর্যয়ের বিস্তার এসবের কারণে আমরা এখন নতুন অনেক মহামারীর অনিবার্য ঝুঁকির মুখে রয়েছি। এবং এর যে কোন একটি আমাদের পতনের কারণ হতে পারে, এবং প্রত্যেকটিই তীব্র আতঙ্ক উসকে দিবে যার সঙ্গী হবে পাগলামির (irrationality) বিস্ফোরণ। টিকে থাকার অধিকার, শ্বাস নেয়ার অধিকার এবং ভবিষ্যতের অধিকারের প্রশ্ন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।



অস্ত্বিত্বের অধিকার


অস্তিত্বের অধিকার ক্রমাগতই [অস্তিত্বের] এর বিপরীতের সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যাবে: সংক্রামক জীবাণুর বাহকদের নির্মূল করা— অর্থাৎ, অন্য সবার বেঁচে থাকার জন্য কাদের উৎসর্গ করতে হবে সেটি চিহ্নিত করা। বড় বিপদটি হলো, এসব আপাত স্বাস্থ্যবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো শেষ পর্যন্ত অবাঞ্ছিতদের জীবনকে বিপন্ন করবে। এখন উদ্ভূত হওয়া নতুন অর্থনৈতিক ধরন এবং মহামারীর দ্বারা সম্ভব হওয়া শাসনের নতুন কলা-কৌশল, উভয়ের মধ্যেই এই ঝুঁকিটি অন্তর্নিহিত আছে।


যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, সংকটের সময় মোতায়েন করা প্রযুক্তি নিজে থেকে বিপদ দূর করতে পারে না। বরং স্বাস্থ্যগত কারণগুলি সামনে এনে জৈবিক ঝুঁকি বলে মনে করা যে কোনও মানুষের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহারকে ন্যায়সঙ্গত করা অনেক সহজ হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থা দ্বারা সঠিকভাবে সম্পাদিত অনেকগুলি সার্বভৌম কার্য ইতিমধ্যে আউটসোর্স করা হচ্ছে, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম সায়েন্স, হাইপারসোনিক গতি এবং স্থানীয়করণ, ক্যাপচার ও ট্রেসিং প্রযুক্তির খাতে কাজ করা বিরাট কর্পোরেশন এবং প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে।


অন্তত মুহূর্তের জন্য হলেও কোনও সন্তোষজনক উত্তর না দিয়ে বিষয়টি বরং অসংখ্য প্রশ্ন উত্থাপন করে। যদি বাস্তবতাকে এখন কেবল সংখ্যা এবং বিমূর্ত কোড ব্যবহার করে বর্ণনা বা উপস্থাপন করা যায় এবং কোড ও সংখ্যাগুলি যদি ক্রমশ একটি মহাবৈশ্বিক মাত্রা হয়ে ওঠে, তবে আমরা কীভাবে নিশ্চিত করতে পারি যে জীবনের গণনা ও ওজন করার পিছনের যুক্তিটি জীবনকে নির্মূলকরণ এবং মুছে ফেলার যুক্তি হয়ে উঠছে না?


সীমাহীন হিসাবনিকাশের এই যুগে আমরা কি নিখুঁত নিশ্চয়তা বা সম্ভাবনাগুলি এবং এ সংক্রান্ত বাজি নিয়ে কাজ করছি? ঝুঁকির মাপজোঁক করা আর দৈবঘটনাকে পরিমাণে নির্ণয় করা যদি একই হয়, তবে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার অর্থ কি দাঁড়ায়? একটি রাষ্ট্রের "সমাজ রক্ষার" পরিবর্তে তার নিজস্ব জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর লক্ষণগুলিকে আমরা কিভাবে চিনতে পারি?


প্রথম বিচারে, করোনার লকডাউনটি ছিল জীবন বাঁচানো এবং অযথা যে কাউকে বলিদান দেওয়া থেকে এড়ানো বিষয়ক। তবে বাস্তবে, সবসময়েই মূল্য দেয়ার মত কিছু একটা ছিলো, ব্যক্তি ও সামষ্টিক দুই স্তরেই। অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের গতি সামগ্রিকভাবে কমেছে তবে অগণিত সোয়েটশপগুলিএখনও চলছে। গুদামঘর, ডেটা সেন্টার, শিল্প খামার, মাংস প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র এবং ডিজিটাল পুঁজিবাদের অন্যান্য যন্ত্রপাতি সবই খোলা রয়েছে।


অনেক মানুষ চাকরি, জীবিকা, এমনকি তাদের জীবনও হারিয়েছে। সরকারী কোষাগার ফাঁকা হচ্ছে। মন্দা ঘোষণা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণ বহন করা হচ্ছে এবং আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যত বন্ধক রেখে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের দরিদ্রতম অঞ্চলে, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার অস্থায়ী বা টেকসই সময়কালে বীমা বা সহায়তার অভাব বেঁচে থাকার প্রতিদিনের সংগ্রামের কাঠামোগত উপাদান।



শ্বাস নেয়ার অধিকার


এমনকি সাধারণ সময়েও মৃত্যুর আগে সমতা একটি পৌরাণিক কাহিনী। অস্তিত্বের অধিকার অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়, যদি না এর সাথে জড়িত থাকে বেঁচে থাকার অধিকার। খাদ্য জোটানো যেতে পারে কেবল বাড়ি ছেড়ে এবং প্রায়শই অনেক ব্যয় করে (অনির্ভরযোগ্য পরিবহন, পায়ে হেঁটে লম্বা ভ্রমণ, সকল প্রকারের অনুমতি এবং অনুমোদন) দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে। খাদ্যের সন্ধান হল হাঁটাহাঁটি, ছোটাছুটি, দরাদরি, কষাকষি, এগিয়ে যাওয়া, সম্ভাব্য সমস্ত উপায়— এমনকি অবৈধ উপায়— ব্যবহার করার অন্তহীন চক্র।


অবাধে চলাফেরা এবং ঘুরে বেড়ানোর সক্ষমতা খাদ্য এবং অন্যান্য রসদে অধিকারের পূর্বশর্ত। সামাজিক সংহতির নেটওয়ার্কগুলিতে যুক্ত হতে পারার, আনুগত্য ও সংযুক্তি সঞ্চয় করার, অস্থায়ী ব্যবস্থাগুলোকে স্থায়ী সম্পদে পরিণত করার সক্ষমতাও তাই। শারীরিক সংঘর্ষ, কাছাকাছি লোকের সমবেত হওয়া, অন্য মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ, এমনকি উপচে পড়া ভিড়—এগুলি ছাড়া বাঁচার জন্য প্রতিদিনের এই লড়াইটিতে লড়াই শুরু হওয়ার আগেই হেরে যেত মানুষ। বিচ্ছিন্নভাবে নয়, বরং মানুষ একত্রিত হলেই জিততে পারে এই লড়াইয়ে।


এই পরিস্থিতিতে, জোরপূর্বক নিশ্চলতা কেবল শাস্তির এক প্রকার নয়। জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ারও এটি একটি উপায়। সমাজের দরিদ্রতম সদস্য (যাদের কোন সুরক্ষা কবচ নেই এবং তাদের দেখভাল করারও কেউ নেই), তারা এখন আর নিজের দেখভালও করতে পারবে না। লকডাউনের অধীনে, সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিরা আরও বেশি নাটকীয় নির্বাচনের মুখোমুখি: বাড়িতে থাকার নির্দেশ মেনে চলুন, আইনকে সম্মান করুন এবং অনাহারে মারা যান; অথবা আইন অমান্য করুন, বাইরে যান এবং রোগ বাধানোর ঝুঁকিতে পড়ুন।

Located in the heart of a roundabout in New Bell of Douala, La Colonne Pascale consisted of pots in Vitreous enamel, which were used in the past by the housewives to protect the food and the drinks. Pascale Marthine Tayou, La Colonne Pascale, Douala, 2010. Produced for the SUD Salon Urbain de Douala 2010 / Photo by Lard Buurman Courtesy doual’art / Wikimedia Commons.



বাজার ক্যালকুলাস


লকডাউন একবার উঠিয়ে নেওয়া হলে দ্বন্দ্বটি যদিও আর ভাইরাস এবং অনাহারের মধ্যে নয়, তবে এক্ষেত্রে দ্বিধাও কম তীব্র না। বাজার শক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, অর্থনীতি আবার চালু করতে হবে, এমনকি কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়েই। ক্যালকুলাসটি এমন: মহামারীর ফলে মোট জনসংখ্যার কেবলমাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ মারা যাবে। এই ব্যক্তিরা, যারা মূলত বেকার বা নিয়োগ-অযোগ্য, খুব তাড়াতাড়ি বা পরে যেকোনভাবে ভাইরাস বা অন্যান্য কো-মরবিডিটির (comorbidity)কারণে মারা যেতেন। তাদেরকে যেকোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা কেবল ব্যয়বহুলই নয়। আরও অনেক জীবনের বিনাশ তাদের বেঁচে থাকার মূল্য। অর্থনৈতিক ধ্বংসযজ্ঞ সামাজিক ভাঙ্গনের দিকে নিয়ে যায়; খরচটা তাই অগ্রহণযোগ্য। সে হিসাবে তাদের অবিলম্বে মরতে দেওয়া উচিত।


বাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে, অস্তিত্বের অধিকার এবং টিকে থাকার অধিকার সম্পূর্ণরূপে আর্থিক জল্পনা এবং এর ওঠানামার উপর নির্ভরশীল। খাবারের মতোই জীবিকা অর্জন করতে হয় এবং অলস হয়ে কেউ উপার্জন করতে পারে না। জীবিকা নির্বাহের একটি উপায় বেতনের জন্য কাজ করা। বাস্তবে, জীবনের অধিকার তাদের জন্য সংরক্ষিত যারা বেতন, চাকরি বা কাজের মাধ্যমে এটি অধিকার করে। বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক লোকই বেতনভোগের চাকরি ঠিক খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের রুটিরুজিকে বিপদ এবং অনিশ্চয়তার পরিস্থিতির সাথে একত্রে আবদ্ধ করতে হবে।


কোভিড-১৯ এভাবে বিভিন্ন ধরনের মানবিক ও সামাজিক অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক পরাধীনতাকে উন্মোচন করেছে। ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে, বিক্রির জন্য অর্পিত শ্রম শক্তি যে কেনা হবে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। এখনো কাজের বাজার মূল্য রয়েছে। তবে বেতনভোগী কর্মসংস্থান ক্রমশই কমছে।


সত্যটি হলো, ভাইরাস সেই সমাজগুলোর উপরে প্রভাব ফেলছে যা ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ভাঙনের প্রক্রিয়ায় ছিল বা স্বৈরাচারের জোয়ালের তলে ভুগছিলো। বিশ্বের এসব অঞ্চলে, অবহেলা ও ফাঁকিজুকির সরকারই একটা নিয়ম। এরা জীবন এবং জীবনহীনতার ছেদবিন্দুতে সবচেয়ে নিষ্ঠুর পরীক্ষা-নিরীক্ষার (চিকিৎসা সহ) উর্বরভূমি। এসব অঞ্চলে বাজারের অর্থনীতি ব্যয়, অপচয় এবং অপাত্রে ঢালার উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই অনুষঙ্গে বলিদান বলতে ঠিক অকারণ হত্যা বোঝায় না। এটি দৈব কোন অনুগ্রহ লাভ করার উদ্দেশ্যে নয়। এটি মানুষকে নিজেদের গণনার জন্য, ট্যালি বানানোর জন্য, মাপার জন্য জীবনের ওজন করার উপস্থাপন করায়—তাদের সাথে যাদেরকে ঠিক প্রত্যাখ্যাত বলে গণ্য করা হয় না।


নিষ্পত্তির এই নীতিগুলি স্বাভাবিক ব্যবস্থার অংশ বলে মনে হয়, এতটাই স্বতঃস্ফুর্ত ও স্বতঃসিদ্ধ যে এ নিয়ে আর কোন চিন্তার প্রয়োজন হয় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সিদ্ধান্ত কখন নেওয়া হবে।


আমরা কখন সিদ্ধান্ত নেব যে, এজাতীয় বলিদান সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য? কখন আমরা এই ধারণায় ফিরে আসব যে, জীবন অমূল্য এবং আদতে যেকোন ধরনের পরিমাপের আওতার বাইরে? জীবনকে গণনা বা ওজন করা যায় না। এটা পুরোপুরিই অগণনীয়।



করণীয় কি?


এই মুহুর্তে, আমাদেরকে একটু থামতে হবে, আমাদের চোখগুলো খুলতে হবে, নিজেদেরকে আলোড়িত হতে দিতে হবে এবং তারপরে একপা পিছাতে হবে। আগামীকাল কেবলই গতকালের পুনরাবৃত্তি হতে পারে না। আফ্রিকার যা দরকার তা হল একটি 'দুর্দান্ত উত্তরণ'।


আমাদের অবশ্যই প্রাকৃতিক সম্পদ নিষ্কাশন ও লুটপাটের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলে আঘাত করতে হবে। সমৃদ্ধি বলতে মানবদেহ এবং ভৌত সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় বোঝায় না। এটির সাথে জড়িত সামাজিক সম্পর্কের গুণমান সম্পর্কে, সংযম এবং সরলতা। আমাদের যা প্রয়োজন, তা হলো গতির লাগাম টেনে ধরা এবং একটু পিছিয়ে আসা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনীতিকে পুনরায় স্থানীয়করণের জন্য আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। কেননা মৌলিক প্রয়োজনগুলি মেটানোর মাধ্যমেই আমরা সকলের মর্যাদা ফিরিয়ে আনব। স্থানিকতার পুনর্বাসনের অর্থ সে ধরনের স্থান-ভিত্তিক সহনশীলতাকে সমর্থন করা যা আফ্রিকাকে ইতিমধ্যে পূর্ণ করে ফেলছে।

Photo via Piqsels.



বিশেষ করে উনিশ শতক থেকেই আফ্রিকা উৎপাদন এবং বাণিজ্যে সংকর ধরনের প্রতিষ্ঠান বিকশিত করেছে। এটি কোন দুর্বলতা নয়, বরং একটি শক্তি। মহাদেশটি বহুলাংশে পুঁজি ও রাষ্ট্রের—দুটি শক্তিশালী আধুনিক প্রতিষ্ঠান যা মহাদেশটির জন্য সবসময়েই বিপদের কারণ ছিল—একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে রক্ষা পেয়েছে। আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এবং তাদের প্রতিষ্ঠান, তাদের স্মৃতি এবং জ্ঞান, তাদের সামষ্টিক বুদ্ধিমত্তার দিকে ফিরে যেতে হবে। বিশেষ করে, তারা কীভাবে মানব স্ব-প্রজননের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থানগুলি ব্যবহার করতো, এবং এখনও করে থাকে সেটি অবশ্যই আমাদের শিখতে হবে।


প্রাতিষ্ঠানিক সমাজের এবং এর অভ্যন্তরীণ শ্রেণিবিন্যাসের পাশাপাশি সবসময়েই পিয়ার সোসাইটি (peer societies) বলে কিছু রয়েছে। সাধারণের ও ভাগাভাগি করা (in-common) সকল স্পেস— এ সম্পদের ব্যবস্থাপনা অংশগ্রহণমূলকভাবে উন্মুক্ত ও অবদানমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে হয়ে থাকে যা কর আওতার বাইরে। এই পিয়ার সোসাইটিগুলি পারস্পরিকতা এবং সামাজিক আলোচনার দ্বৈত নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। জনকল্যাণ সমিতিগুলো এর একটি উদাহরণ মাত্র। ‘ইনফর্মাল (বা অনানুষ্ঠানিক) অর্থনীতি’ প্রমাণ করে যে অনেক সামাজিক এজেন্ট এমন কিছু তৈরি করার তাড়না বোধ করে যা অন্যান্য অবদানকারীদের জন্য সরাসরি উপকারী হতে পারে। তারা বাজারের জন্য ‘অতিরিক্ত মূল্য’ উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে। বিনিময়ের বাইরে, এধরনের উৎপাদনশীল সম্প্রদায়ের বিকাশকে উৎসাহ দেয়া উচিৎ।



দুর্দান্ত উত্তরণ (transition)


আফ্রিকাকে অবশ্যই নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে একটি ‘দুর্দান্ত উত্তরণ’ শুরু করতে হবে। এই উত্তরণের লক্ষ্যটি হবে সামাজিক শক্তিবৃদ্ধি এবং সামাজিক বিনিয়োগের শর্ত তৈরি করা। পারস্পরিকতা জোরদার করার জন্য বাজার ও রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যকার ভারসাম্যের সামঞ্জস্য করা দরকার। অনেকদিন ধরে রাষ্ট্রে এমন শিকারিদের আধিপত্য ছিল যারা তাদের ব্যক্তিগত লাভ সর্বাধিক করে তোলার জন্য আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে। পরিস্থিতিটা যা দাঁড়িয়েছে, রাষ্ট্র এই সম্প্রদায়গুলোর সৃজনী সক্ষমতা বজায় রাখতে বাড়াতে প্রায় কিছুই বিনিয়োগ করে না।


আমাদের অবশ্যই রাষ্ট্রের সাথে এমন এক সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যেতে হবে যা কেবলমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ নিষ্কাশন ও লুটপাটের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। বরং এর পরিবর্তে এমন একটি সম্পর্ক কল্পনা করতে হবে উৎপাদনশীল এবং সামাজিকভাবে উপকারী। পাল্লাটা অবশ্যই সমাজের উৎপাদনশীল শ্রেণির পক্ষে যাওয়া উচিৎ, আমলাতন্ত্র বা সশস্ত্র বাহিনীর (রাষ্ট্রীয় বা ভাড়াটে) পক্ষে নয়। নতুন সব প্রযুক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষমতাকে সম্ভবপর করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ডিজিটাল মাধ্যম আলোচনামূলক দক্ষতা বিকাশ করতে, নিজস্ব-সংগঠনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং মূল্য তৈরি ও পুনরায় বিতরণের সক্ষমতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়, ততক্ষণ এই ক্ষমতাটি উৎপাদনশীল শ্রেণীর সুবিধার জন্য এবং ভাড়া-সন্ধানকারীদের অপকারের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।



সার্বভৌমত্বের পুনরাবিষ্কার


অবশেষে অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোই যথেষ্ট হবে না। আমাদের অবশ্যই গণতন্ত্রকে নতুন করে কল্পনা করতে হবে। শাসনকাজের অর্থ কেবল সংকট এবং সকল প্রকারের ঝুঁকির বিরুদ্ধে সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করা নয়। এর অর্থ এটিও নিশ্চিত করা যে আমাদের পরিবেশে সমস্ত জীবন্ত সত্তার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া যতটা সম্ভব ঐকতানিক করা। একে অবশ্যই সেই বুনিয়াদ হতে হবে যার ভিত্তিতে আমরা একটি নতুন সামাজিক চুক্তি স্থাপন করবো, যেটি এই গ্রহের সমস্ত না-মানব বাসিন্দার—এককভাবে এবং প্রজাতি হিসেবে—অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে।


সার্বভৌমত্বের ধারণাটি পুনরায় নতুন করে ভাবতে হবে। ভবিষ্যতে, চূড়ান্ত সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ অবশ্যই বাস্তুতন্ত্রকে হতে হবে। উপনিবেশ-পূর্ব আফ্রিকান সমাজগুলিতে এটি ছিল, যেখানে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় নিয়ত যত্নের বিষয়টি মানবশাসনের সাথে জড়িত ছিল। সত্যই মানবসমাজগুলো এমন সমাজ ছিল যারা অন্যান্য পরিবেশ এবং প্রজাতকে আলিঙ্গন করতে জানতো।


____________

৬ই জুলাই, ২০২০



দোহাই

[i] [কার্ল পলান্যি] K. Polányi, The Great Transformation: The Political and Economic Origins of Our Time, Boston, Beacon Press, 2001 [1944], p. 15-16.



টীকা

[১] প্লানেটারি (planetary): গ্রহীয় বা গ্রহের এককে। এক্ষেত্রে মাত্রা হচ্ছে গ্রহ।

[২] অ্যান্থ্রোপোসিন (anthropocene): অ্যান্থ্রোপসিন বলতে মনুষ্যকেন্দ্রিক এমন এক ভূতাত্ত্বিক কালপর্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয় যখন মানুষ তার সংখ্যা, ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার অর্থাৎ মানুষী ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পৃথিবীর সার্বিক স-জীব ও অ-জীব উপাদান, পরিবেশ প্রতিবেশ ও জলবায়ুর ভয়াবহ বিপন্নতার সম্ভাবনা তৈরি তথা খোদ একটি গ্রহের চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম এক ভূতাত্ত্বিক ক্ষমতা (geological agent) হয়ে উঠেছে। অ্যান্থ্রোপসিন এমন এক যুগ যখন মানুষই পৃথিবী নামক এই গ্রহের একমাত্র ভূতাত্ত্বিক শক্তি।

[৩] সোয়েটশপগুলি (sweatshops): সোয়েটশপ হচ্ছে একটা ফ্যাক্টরি বা কারখানা— বিশেষভাবে বললে পোশাক কারখানা— যেখানে কায়িক শ্রমিকদেরকে খুবই কম মজুরিতে নাজুক পরিবেশ আর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে দীর্ঘ সময় কাজে ব্যস্ত রাখা হয়।

[৪] কো-মরবিডিটি (comorbidity): এটি একটি বিশেষ চিকিৎসাবিদ্যক পরিভাষা। শরীরে একাধিক অসুখ ও জটিলতা থাকাকে কো-মরবিডিটি বলে। অসুস্থ ব্যক্তির গুরুতর সক্রিয় কোন অসুখের সমান্তরালে যদি অন্য কোন অসুখ আগের থেকে থাকে তাহলে সেই রোগী কো-মর্বিড l আর যদি আগের কোন অসুখের জন্য—বর্তমানের কোন চিকিৎসাধীন অসুখের প্রকোপে নয় — মৃত্যু হয়, তবে তা "কো-মোর্বিড " কারণে মৃত্যু বলে মনে করা হয় l

[৫] পিয়ার সোসাইটি (peer societies): সম স্বার্থ, বয়স, সামাজিক মর্যাদার লোকেদের গোষ্ঠী এবং একই সাথে এটা একটি সামাজিক গোষ্ঠীও।

[৬] en-commune (in-common): এমবেম্বে তাঁর Bodies and Borders নামক আলোচনায় জানাচ্ছেন, সীমানা নির্ধারিত হয় মূলত এক জনগোষ্ঠীর সাথে আরেক জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধের অমিলের সূত্র ধরে। মানে ঐ ভূখন্ড তৈরীর সময় ঐ এলাকার মানুষের নিজেদের মাঝে এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক থাকে, যাকে এমবেম্বে in-common বলছেন।


প্রকাশঃ ১২ই চৈত্র, ১৪২৭:::২৬শে মার্চ, ২০২১