করোনাভাইরাসের দুটি ভয়ানক দিক

পিটার সিঙ্গার পাওলা কাভালিয়েরি



[করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে দার্শনিক পিটার সিঙ্গার ও পাওলা কাভালিয়েরি'র The Two Dark Sides of COVID-19 লেখাটি গত ২রা মার্চে প্রজেক্ট সিণ্ডিকেট ওয়েবসাইটে। অস্ট্রেলীয় দার্শনিক পিটার সিঙ্গার বিংশ শতাব্দীর পশ্চিমা নীতিদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় সুপরিচিত। তাঁর ব্যবহারিক নীতিবিদ্যা(১৯৭৯) গ্রন্থটি সমকালীন নীতিদর্শনের সমস্যাবলী নিয়ে আলোকপাত করে এবং তাঁর উদারনৈতিক উপযোগবাদী মত দারুণভাবে সমালোচিত। পিটার সিঙ্গার ও পাওলা কাভালিয়েরি'র এই যৌথ লেখাটি অনুবাদ করেছেন প্রীথুলা প্রসূন পূজা। প্রীথুলা প্রসূন পূজা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী।]




পৃথিবীতে কোভিড-১৯ মহামারীর মত বিপদজনক ও দুঃখজনক অধ্যায়গুলো নানান সময়ে নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করেছে এবং তা ঐতিহাসিকভাবেই পর্যবেক্ষণযোগ্য। বর্তমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাব্য উৎস চীনের উহান প্রদেশের একটি কাঁচা বাজার, যেখানে জীবিত মাছ/মাংস বিক্রয় করা হয়। এমনকি সেখানে ক্রেতার চোখের সামনে মাছ সহ অন্যান্য প্রাণী (যেগুলো খাওয়া হয়ে থাকে) বিক্রিবাট্টা ও কাটা হয়ে থাকে। এই সমস্ত বাজার বন্ধ হওয়া উচিত। সমগ্র বিশ্বেই তা বন্ধ হওয়া দরকার, শুধু চীনেই নয়।


লকডাউন চলাকালীন উহানের রহস্য-উন্মোচক দৃশ্যাবলি আমাদের সকলের নিকটে পৌঁছেছে। ভাইরাসটির অতিসংক্রমণে পুরো বিশ্ব যেন রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় রয়েছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এমন সব কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে যা সাধারণ কল্যাণ রক্ষার প্রয়োজনে অচিরেই ব্যক্তি-অধিকার ও স্বাধীনতাকে ব্যাহত করছে।


সংক্রমণের শুরু থেকেই চীন তার সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে এক ধরনের অস্বচ্ছ ধারণা দিয়েছে গোটা বিশ্বকে, যে কারণে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক বলেন, বিশ্বে আরও অনেক ভয়ানক সংক্রামক রোগ রয়েছে। প্রতিনিয়তই এসব রোগে প্রচুর মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। কিন্তু করোনাভাইরাস নিয়ে অতি-সচেতনতা বা অতি-আলোড়ন আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের ঘোর তৈরী করে রেখছে। এটা এক প্রকার “জাতিগত মস্তিষ্ক বিকৃতি”( “the racist paranoia”)। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মনে করেন, করোনাভাইরাস একটি জৈবাস্ত্র যা চীন তার অর্থনীতিকে মাথায় রেখে উৎপাদন করেছে। সরাসরি বিরোধীতা না করলেও অনেকেই চীনের অর্থনীতি ভাবনাকেই এই মহামারীর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।


২০০৩ সালে এই চীন থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল সার্স ভাইরাস (SARS: Severe Acute Respiratory Syndrome)। কোভিড-১৯ ও সার্স। উভয়েই চীনের কাঁচা বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো খোলা বাজার, এখানে পশুপাখিগুলো জীবিত নিয়ে আসা হয় এবং ক্রেতার পছন্দ মত তাদের চোখের সামনেই হত্যা করে কেটে দেয়া হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পূর্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের প্রত্যেকেরই উহানের এই হুয়ানেন(Huanan) মাছবাজারের সাথে কোন না কোন প্রকারে সংযোগ ঘটেছিল।


চীনের এইসব কাঁচাবাজারে খাওয়ার উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন ধরনের প্রাণী বিক্রয় এবং হত্যা করা হয়। যেমন, নেকড়ে শাবক, সাপ, কচ্ছপ, গিনিপিগ, ইঁদুর, ভোঁদড়, গর্তবাসী কুকুর, গন্ধগোকুল (খাটাশ) ইত্যাদি। এশিয়ার কিছু কিছু দেশেও এই একই ধরনের বাজার দেখা যায়, যেমন, জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ইত্যাদি।


পৃথিবীর গ্রীষ্মমল্ডলীয় বা প্রায় গ্রীষ্মমল্ডলীয় অংশসমূহের কাঁচাবাজারে স্তন্যপায়ী, পোল্ট্রি, মাছ, সরীসৃপ ইত্যাদি বিক্রয় করা হয়। বিক্রয়ের জন্য এদের ঠাসাঠাসি করে রাখার ফলে এদের শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্ত, মল-মূত্র ইত্যাদির সংস্পর্শে আসতে হয় সকলকে। জেসন বেইবীন নামক যুক্তরাষ্ট্রের একজন জাতীয় রেডিও সাংবাদিক নিজের রিপোর্টে বলেনঃ “জীবন্ত মাছগুলো জলভর্তি পাত্রে রাখার ফলে তারা জল ছিটিয়ে আশেপাশের ফ্লোর/মেঝে ভিজিয়ে ফেলে। দোকানের কাউন্টার টপ গুলো মাছের রক্তে লাল হয়ে থাকে, কারণ ক্রেতার উপস্থিতিতে মাছের পেট কেটে নাড়ি-ভুড়ি-কাঁটা সব পরিষ্কার করা হয়। বাক্সের ভেতরে জীবিত কচ্ছপ, কাঁকড়া, চিংড়ি, লবস্টার, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি একে অপরের উপর দিয়ে চলাচল করতে থাকে। বরফ গলা জল গড়িয়ে মেঝেতে কাদার পরিমাণ বাড়তে থাকে। চারপাশে প্রচুর পরিমানে জল, কাদা, রক্ত, মল-মূত্র, মাছের আঁশ-কাঁটা, মুরগীর বর্জ্য ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।“ আর এই হল কাঁচা বাজারের প্রকৃত চেহারা।


বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন ধরনের পশুপাখিকে দীর্ঘদিন একই সাথে ঘনিষ্ঠভাবে রাখা এবং তারা মানুষের আসার ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের উদ্ভব ঘটে। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশই ভাইরাসের পরিব্যক্তি বা বিস্তার লাভের সম্ভাব্য কারণ যা মানুষকে আক্রান্ত করার জন্য করোনাভাইরাসকে উপযোগী করে তোলে। মূলত, এই ধরনের পরিবেশে দীর্ঘদিন যেসব প্রাণী একই সাথে থাকে, তাদের কেউ কেউ করোনাভাইরাসের বাহক হয়ে থাকতে পারে। ফলে করোনাভাইরাসটি ঘন ঘন পোষকের শরীর বদলের মাধ্যমে দ্রুত পরিব্যক্ত ও বিস্তৃত হবার সুযোগ পায়। একের পর এক অমানব পোষক বদলের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তারা এমন রিসেপ্টর বা গ্রাহক কোষ গঠনের সক্ষমতা লাভ করে যা মানব পোষক গ্রহণে উপযোগী। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে মানবশরীর পোষক হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে মানুষকে আক্রান্ত করতে থাকে।


এই সমস্ত তথ্য-প্রমাণ চীনকে প্রভাবিত করার ফলে জানুয়ারির ২৬ তারিখে চীন সরকার বন্য প্রাণীসংক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ঘোষণা করে। মহামারী নিয়ন্ত্রণে এই ধরনের পদক্ষেপ হিসেবে এইটিই প্রথম নয়। সার্সের প্রাদুর্ভাব এড়াতেও চীন গন্ধগোকুল সহ আরও কিছু বন্যপ্রাণীর প্রজনন, পরিবহণ, ও বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তবে মাত্র ৬ মাস পরেই এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।


বর্তমানে অনেকেই বন্যপ্রাণী বাজারজাতকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধকরণে আওয়াজ তুলছেন। চীনের “জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ (বায়োডাইভার্সিটি কনজার্ভেশন)” ও “গ্রীন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন” এর প্রধান ঝোউ জিনফেং (Zhou Jinfeng) বলেন যে অবৈধ উপায়ে বন্যপ্রাণী বিকিকিনি অনিশ্চিতভাবে বন্ধ রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে প্রতিপালিত বা সংরক্ষিত প্রজাতির প্রাণীদের নিয়ে ব্যবসাকে আইনত অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা করছে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস। তবে সংরক্ষিত বা প্রতিপালিত প্রজাতির উপর দৃষ্টি নিবন্ধন করার পেছনে একটি অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হলো, কাঁচাবাজারে প্রাণীগুলোর পক্ষে বেঁচে থাকা বা মৃত্যুবরণ করার আতঙ্ককর পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষের যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে তার গতিমুখ বদলে দিয়ে বরং এমনটাই ভাবানো যে, পৃথিবীতে এখন বাস্তবিকই এই ধরনের বাজারগুলো নিষিদ্ধ হওয়া বিশেষ জরুরি।


উল্লেখিত প্রাণীদের জন্য এইসব কাঁচাবাজারসমূহ যেন পৃথিবীর বুকেই এক একটি নরক। হাজার হাজার সংবেদনশীল প্রাণী ঘন্টার পর ঘন্টা পাশবিক যন্ত্রণা সহ্য করে এবং মৃত্যুর পূর্বে নৃশংস অত্যাচার সয়ে সন্তাপ করতে থাকে। কিন্তু প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ফার্মে, পরীক্ষাগারে, অথবা বিনোদন শিল্পে যতপ্রকারে প্রাণীদের উপরে মানুষেরা অত্যাচার করে চলেছে, এগুলো তার তুলনায় একেবারেই নগন্য।


আমরা যদি আমাদের কর্মকান্ডের উপর আলোকপাত করা বন্ধ করে দেই, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা তা-ই করি, তবে তার অর্থ এই যে আমরা স্ব-প্রজাতিকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে উপভোগ করছি, ঠিক যেভাবে শ্বেতাঙ্গরা নিজেদেরকে উচ্চতর বলে দাবি করে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর করা সকল অত্যাচারকে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু এই মুহূর্তে যখন মৌলিকভাবেই মানব স্বার্থের পাশাপাশি অমানব প্রাণীর স্বার্থ সমান্তরালভাবে প্রাধান্য পাওয়ার দাবিদার, তখন অমানব প্রাণীর প্রতি হওয়া অত্যাচার নির্যাতনের ন্যূন পরিমাণ উল্লেখকরণ অমানব প্রাণীকূলের সদস্যদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সুযোগকেই ইঙ্গিত করে।


কাঁচাবাজারের নামে এই ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনকে বন্ধের ঘোষণা কার্যকর করতে হলে বেশ কিছু পক্ষপাতদুষ্ট আচারিক দৃষ্টিভঙ্গিকে জয় করতে হবে। এমনকি যারা এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখপূর্বক কিছু আপত্তি থাকতে পারে এই ঘোষণার বিরুদ্ধে। এই ধরনের প্রতিবন্ধকতাকেও জয় করতে হবে। অমানব প্রাণীদের যতটুকু নৈতিক মর্যাদা প্রাপ্য সেটুকুও মানুষের কাছে বিবেচ্য নয়। অথচ এইসব স্থানীয় ও আচারিক ধ্যান-ধারণা যেভাবে আমাদের উদ্বিগ্ন করে রেখেছে, তা পৃথিবীব্যাপী মহামারীগুলো কি ধরনের বিপদকজনক প্রভাব ফেলতে পারে সেই বিষয়ক চিন্তার গুরুত্ব বা প্রভাবকেও অতিক্রম করে ফেলে।


পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, হংকং-এর একজন লেখক, মার্টিন উইলিয়ামস যথার্থই বলেছেনঃ “যতদিন এই ধরনের বাজারগুলো চলমান থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে এভাবে নানা ধরনের ভাইরাস সংক্রামণের সম্ভাবনাও বাড়তে থাকবে। এইসব বাজার বন্ধ করার চীনের জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। ফলে তা যেমন একইসাথে প্রাণী অধিকার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে ভালো অবদান রাখতে পারবে, তেমনি চীনে উৎপাদিত রোগ দ্বারা পৃথিবীব্যাপী মানুষের সংক্রামিত হওয়ার পরবর্তী ঝুঁকিসমুহও হ্রাস করবে।“


তবে আমাদের আরও ভাববার আছে। ইতিহাস বলে, মহামারী সর্বদাই পৃথিবীব্যাপী কোনো না কোনো পরিবর্তনের সূচনা করেছেই। দীর্ঘদিন যাবত জীবিত প্রাণী আটকে রেখে ক্রেতার উপস্থিতিতে হত্যা করা এইসব কাঁচা বাজারসমূহ এবারে সত্যিই বন্ধ হওয়া উচিত এবং তা শুধু চীনেই নয়, সারা পৃথিবীতে।

______________

০২ মার্চ, ২০২০



হদিস- https://www.project-syndicate.org/commentary/wet-markets-breeding-ground-for-new-coronavirus-by-peter-singer-and-paola-cavalieri-2020-03?barrier=accesspaylog

প্রকাশঃ ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২০