এই প্লেগ, এই জরুরী অবস্থা এখানে ইতোমধ্যেই হাজির ছিল

জর্জিও আগামবেন



[করোনাভাইরাস মহামারী ও উদ্ভূত জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে উদ্ভূত বিতর্কে জর্জিও আগামবেন নিজের দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট ও সুসংহত করতে প্রায় নিয়মিত ছোট ব্লগ লিখছেন। Quodlibet প্রকাশনীর ওয়েবসাইটে গত ২৭ শে মার্চে তিনি Riflessioni sulla peste (প্লেগ প্রসঙ্গে ভাবনা, Reflections on the plague) শীর্ষক আরেকটি লেখা লিখেছেন। অ্যালান ডীনকৃত (Alan Dean) ‘আন-অফিসিয়াল’ ইংরেজি অনুবাদ থেকে আগামবেনের এই লেখাটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন কাব্য কৃত্তিকা। কাব্য কৃত্তিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন।]




প্লেগ প্রসঙ্গে ভাবনা


মহামারী নিয়ে বোঝাপড়ার বিষয়ে এই লেখাতে আলোকপাত না করে, বরং মহামারীর প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে আমরা কি শিখতে পারি তা ব্যক্ত করা হবে। কিভাবে সমগ্র সমাজ প্লেগে আক্রান্ত হবার অনুভূতির মারফতে একত্রিত হয়েছে, এই প্রবন্ধ মূলত সেই অবস্থাকে প্রতিফলিত করবে। সমাজের সকলে গৃহাভ্যন্তরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এবং জীবনের সকল স্বাভাবিক অবস্থাকে— কাজকর্ম, প্রেম, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, এমনকি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসসমূহকে পর্যন্ত রহিত করেছে। এমতাবস্থায়, বিরুদ্ধাচরণ করাই স্বাভাবিক ও নিশ্চিতভাবেই সম্ভব ছিল। কিন্তু এখানে কোন বিক্ষোভ বা প্রতিরোধ দেখা গেল না। এমন কেন ঘটলো? আমার হাইপোথিসিস হচ্ছে, এখানে ইতোমধ্যেই প্লেগ অচেতনভাবে হাজির ছিল। মানবজীবনের অবস্থা প্রামাণিকভাবেই এমন হয়েছিল যে, এই (প্লেগ) অকস্মাৎ চিহ্নটিই এই অসহনীয় অবস্থাকে উপলব্ধিতে পর্যাপ্ত ভূমিকা রেখেছে, যে অসহনীয় অবস্থা মূলত প্লেগের মতনই। বেশকিছু দিক থেকে চিন্তা করলে, বর্তমানের এই অবস্থা থেকে একমাত্র যে ইতিবাচক বিষয় লাভ করা যেতে পারে তা হল: জনগণ পূর্বে যে জীবন যাপন করছিল তার সঠিকতা সম্পর্কে নিজেদের প্রশ্ন করতে পারা সম্ভব হয়েছে।


আমরা আরো আলোকপাত করব ধর্মের(religion) প্রয়োজন নিয়ে এবং এই অবস্থার মধ্যদিয়ে তা আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে। মিডিয়ার ডিসকোর্সে আখেরিবিদ্যা(eschatology, শেষ বিচার) থেকে আগত পরিভাষার দৃশ্যমানতা এটাকেই ইঙ্গিত করছে: সমগ্র আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে “কেয়ামত” (apocalypse) ও পৃথিবীর সমাপ্তির মতো অন্যান্য আহ্বানের অত্যাধিকভাবে ফিরে আসার(obsessive recurrence) মাধ্যমে ধর্মের দৃশ্যমানতা শনাক্ত করা যায়। এটা এমন অবস্থা যখন মনে হয়, ধর্মের প্রয়োজন এখন আর চার্চের ভেতরে পরিপূর্ণতা খুঁজে পাচ্ছে না। এটি হাতড়ে হাতড়ে এমন জায়গা খুঁজতে শুরু করেছে যেখানে সে তার অবস্থান খুঁজে পাবে। শেষমেষ যেখানে ধর্মের প্রয়োজন তার অবস্থান খুঁজে পায় তা হল বিজ্ঞান—যেটা কিনা আমাদের সময়ের ধর্মে পরিণত হয়েছে। অন্যসব ধর্মের মতোই বিজ্ঞান ভয় ও কুসংস্কারের জন্ম দিতে পারে—অথবা অন্ততপক্ষে এগুলো ছড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে। আমরা এর আগে কখনও এমন বিচিত্র, সাংঘর্ষিক মতামত ও ব্যাবস্থাপত্র প্রদানের দৃশ্য—যেমনটা সংকটকালে সাধারণত ধর্মের মধ্যে দেখা যায়—দেখিনি। এই বিচিত্রতা বর্তমান প্রপঞ্চের সিরিয়াসনেসকে(কতিপয় সম্মানিত বিজ্ঞানীর দ্বারা) অস্বীকার করার মত চালুমতের বিরোধী(heretical) প্রান্তিক অবস্থান থেকে শুরু করে বর্তমান অবস্থার সত্যতা নিয়ে আধিপত্যশীল কট্টর অবস্থান পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রায় দেখছি। এদের প্রত্যেকেই কিভাবে পরিস্থিতিকে সামলানো উচিৎ তা নিয়ে চরমভাবে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে সব সবমসময়ই কিছু বিশেষজ্ঞ বা স্ব-খ্যাত লোকজন দেখা যায় যারা শাসকের সুদৃষ্টি লাভ করতে সক্ষম হয়, এখানেও এর কোন ব্যাতিক্রম ঘটে নাই। এরা তারা, যারা ধর্মীয় বিবাদের কালে খিস্টানত্বকে বিভক্ত করেছিল, আর এখন নিজের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে বর্তমান শাসকের পাশে দাড়িয়েছে এবং সেভাবেই পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করছে।


আরেকটি বিষয় হল, যেকোন দৃঢ় বিশ্বাস বা সাধারণ বিশ্বাসের নিশ্চিত পতন ঘটা। কেউ বলতেই পারে যে, মানুষ বর্তমান সময়ে তার জৈবিক অস্তিত্ব ব্যতীত আর কিছুতেই বিশ্বাস করেনা এবং সেই জৈবিক সত্তাকে যেকোন মূল্যেই বাঁচাতে হবে। কিন্তু নিজের জীবন হারানোর আতঙ্কের মাধ্যমে এই ব্যবস্থায় ফলাফল হিসেবে কেবলই অঙ্কিত তরবারি হাতে দানবীয় লেভিয়াথানকে পাওয়া যাবে।


যদি কখনও এই প্লেগ, এই জরুরি অবস্থার শেষ হয়— আমি বিশ্বাস করিনা যে কারও পক্ষে পূর্বের ন্যায় জীবনে ফেরত যাওয়া সম্ভব হবে। অন্তত যে ব্যাক্তি তার জীবনে স্বল্পমাত্রায় হলেও স্বচ্ছতার চর্চা করেছে, তার পক্ষেও অতীত জীবনে ফেরার সম্ভব না। যদিও এমন বলা হয়েছিল যে, “যাদের আর কোনো আশা অবশিষ্ট নেই শুধু তাদের জন্য আশা দেওয়া হয়েছে”*, তবুও সম্ভবত এটাই নিরাশার (despair/ la cosa piu disperant) সর্ববৃহৎ কারণ।

____________

২৭শে মার্চ, ২০২০


* দ্বিপ্রহরের দৈত্য (The Noonday Demon), ওয়াল্টার বেঞ্জামিন।


প্রথম প্রকাশঃ ৮ই এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৮ই এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/380094679788685/