ইভান ইলিচের নজর দিয়ে চলমান মারী সম্পর্কিত কয়েকটি জিজ্ঞাসা


ডেভিড কেইলি



[ইভান ইলিচ অস্ট্রীয় দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ ও রোমান ক্যাথলিক যাজক। ইতালীয় প্রখ্যাত দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের কাজের সূত্র ধরে অনায়াসেই এই চিন্তকের সাথে পরিচিতি ঘটা সম্ভব। করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে আগামবেনের লেখাজোখায় ইলিচের প্রকট উপস্থিতি যেকারও নজরে পড়বে। ১৯৭১ সনে প্রকাশিত Deschooling Society গ্রন্থটি ইলিচ'কে প্রথম জনপরিসরে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। বিশ শতকের এই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকের কাজের ডক্যুমেন্টেশনের কাজটি করে চলেছেন টরেন্টোভিত্তিক কানাডীয় বুদ্ধিজীবী, লেখক ও রেডিও সম্প্রচারক ডেভিড কেইলি(David Cayley)। ইতিমধ্যে ইভান ইলিচকে নিয়ে তাঁর লেখা দুটি বই Ivan Illich in Conversation (১৯৯২) The Rivers North of the Future (২০০৫) প্রকাশিত হয়েছে। Penn State Press থেকে আগামী বছরে ইলিচের বায়োগ্রাফি বের করতে চলেছেন। পশ্চিমা ঔষধশাস্ত্রকে তীব্র ও বিস্তৃত মোকাবিলায় লেখা ইভান ইলিচের Medical Nemesis(১৯৭৫) ও তাঁর অপরাপর কাজের উপর ভিত্তি করে চলমান করোনা মহামারী প্রসঙ্গে ডেভিড কেইলি'র Questions about the current pandemic from the point of view of Ivan Illich লেখাটি গত ৩রা মার্চে প্রকাশিত হয়েছে। ডেভিড কেইলি'র এই লেখাটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ শাহিন। শাহিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]




চলমান মহামারী নিয়ে গত সপ্তাহে আমি একখানা প্রবন্ধ রচনা শুরু করি। মহামারীটি যে মৌলিক-প্রশ্ন আমাদের সামনে নিয়ে আসে বলে আমি মনে করি, তা সেখানে আলোকপাত করার চেষ্টা করি: ভাইরাসটির ক্ষয়ক্ষতির বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণে যে এতসব বৃহদাকার ও ব্যয়বহুল তাবলাতি করা হচ্ছে, শুধু সেটাই কি আমাদের হাতে আখেরি তরিকা? সবচেয়ে নাজুক লোকদের বাঁচাতে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেটা দূরদর্শিতার সংশয়াতীত ও অনিবার্য পরীক্ষা থেকে বেশি কিছু নয় কি? অথবা যেটা নিশ্চিতভাবে হাতের বাইরে সেটার উপর নিয়ন্ত্রণ সমুন্নত রাখা কি কোনো সর্বনাশা প্রচেষ্টা, এমন প্রচেষ্টা যেটা এই রোগের ফলে সাধিত ক্ষয়ক্ষতির সাথে অদূর ভবিষ্যতে যেসব নতুন ঝায়-ঝামেলা উত্থিত হবে সেগুলোর সংমিশ্রণ ঘটাবে? অনেকদিন যাবত আমি লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম যদ্দিন না আমি আবিষ্কার করেছিলাম যে, আমার চারপাশে যেসব ধ্যান-ধারণা নিয়ে মাতামাতি হচ্ছিল আর আমার ধারণাগুলোরযেগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলামমধ্যে বিস্তর তফাৎ বিদ্যমান। আমি যেসব বিষয়ে আলোকপাত করেছি সেগুলো মূলত ইভান ইলিচের কাজকর্ম নিয়ে দীর্ঘ বোঝাপড়ার ফসল। এটা আমাদের কী প্রস্তাবনা দেয়, আমাদের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার আগে, আমি প্রথমেই স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও কল্যাণ (well-being) নিয়ে ইভান ইলিচের ভাবনার ছক তুলে ধরব, যেসব বিষয়বস্তুর বিকাশ ইলিচ তাঁর জীবদ্দশায় করে গেছেন। সে অনুসারে, সামনের আলোচনায় যা আসবে, আমি জৈব-চিকিৎসা নিয়ে ইলিচের করা সমালোচনার বিকাশের সংক্ষিপ্ত ধারাপাত দিয়ে শুরু করব এবং সেইসাথে যেসব প্রশ্নের উপর আমি কেবল আলো ফেলেছি সেগুলোর জবাব খোঁজার চেষ্টা করব।


সমকালীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুসৃত প্রথাগত উন্নয়নের গতিধারা সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন ইলিচ তা নিয়ে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তাঁর Tools of Conviviality বইয়ের শুরুতে আলোচনা করেন, যেখানে তিনি চিকিৎসাকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি জানান, চিকিৎসাবিজ্ঞানের গতিপথ 'দুইটা সীমারেখা'র মধ্য দিয়ে গিয়েছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সেটার প্রথম পর্যায় অতিক্রম করেছে, যখন স্পষ্টভাবেই মেডিকেল চিকিৎসা [রোগ-বালাইয়ের বিপক্ষে] কার্যকর হয় এবং তার সুফল মোটাদাগে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে শুরু করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক ইতিহাসবিদদের কাছে এটাই একমাত্র যৌক্তিক নির্দেশক, যাদের ধারণা এই পর্যায় থেকে অগ্রগতি অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে থাকবে এবং সেখান থেকে হ্রাস পেয়ে উল্টো পথ ধরলেও, নীতিগতভাবে এমন কোনো পর্যায় আসবে না যেখানে এই অগ্রগতি থেমে যাবে। ইলিচের ক্ষেত্রে বিষয়টা সেরকম ছিল না। তিনি দ্বিতীয় সীমারেখার ধারণা অবতারণা করেন, যে-সীমারেখা তিনি মনে করতেন ইতোমধ্যে অতিক্রম করা হয়ে গেছে এবং এমনকি যখন তিনি লিখছেন সেই সময়ে মধ্যেই সেটা ঘটে গেছে। দ্বিতীয় এই সীমারেখার বাইরেও তিনি মনে করতেন, তিনি যেটাকে প্রতি-উৎপাদন (Counterproductivity) বলেন, সেটা শুরু হয়ে গেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদ্ভাবন তার নিজের উদ্দেশ্যকেই পিছনে ফেলে সুফলের থেকে বেশি কুফল বয়ে আনবে। তিনি দাবি করেন, যেকোন প্রতিষ্ঠান, দ্রব্য বা সেবার চরিত্র এটাই এমন একটা পর্যায় চিহ্নিত করা যায় যেখানে সেটার উপযোগিতা যথেষ্ট এবং যেটার পর তারা বাড়াবাড়ি হয়ে দাঁড়াবে। Tools for Conviviality সেসব 'স্বাভাবিক মাপকাঠিগুলো' চিহ্নিত করার একটা প্রয়াস ছিল প্রযুক্তির দর্শন তালাশে এরকম সর্বজনীন এবং প্রকল্পভিত্তিক একমাত্র কাজ, যেটা ইলিচ করে গেছেন।


দু'বছর পর Medical Nemesis গ্রন্থে, পরে সেটার সর্বশেষ ও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংস্করণে Limits to Medicine নামকরণ করা হয়, ইলিচ চিকিৎসাব্যবস্থা যেসব সুফল এবং কুফল বয়ে আনছে সেগুলোর বিস্তারিত ফিরিস্তি দেয়ার চেষ্টা চালান। তিনি সাধারণত গণস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বড়-আকারে [জনসাধারণের কল্যাণে] উদ্ভাবনের পক্ষপাতি ছিলেন, যা আমাদের সুষম খাদ্য, নিরাপদ পানি, সুস্থ বাতাস এবং আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদি দিয়েছে। বেশিরভাগ নাগরিকের আজীবন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে এমন বিলাসী পণ্য তৈরির দিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ঠেলে না দিয়ে, বরং সব নাগরিকের জন্য যাতে তা সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হয় সেজন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ঔষধ প্রস্তুত-প্রণালীর নির্দেশনা সম্বলিত তালিকা (Pharmacopeia) প্রতিষ্ঠায় চীন ও চিলি কর্মযজ্ঞ চালায়। তিনি সেটার প্রশংসাও করেন। তথাপি গ্রন্থটির মূল লক্ষ্য ছিল প্রতি-উৎপাদনের প্রভাব চিহ্নিত করা এবং তা আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা, যা তখন প্রতীয়মান হওয়া শুরু করেছিল বলে তিনি বোধ করেছিলেন। কেননা চিকিৎসাবিজ্ঞান তার দ্বিতীয় সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছে। অতিরিক্ত ঔষধের ফলে বিপর্যয়কে তিনি চিকিৎসা-জনিত-ক্ষতি (iatrogenesis) হিসেবে উল্লেখ করেন এবং সেগুলোকে তিনটি শিরোনামে ভাগ করে আলোচনা করেন। যথা: চিকিৎসা কেন্দ্রিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক। প্রথমটা এখন সবারই বুঝে আসে আপনি যদি ভুল চিকিৎসা, ভুল ঔষধ এবং ভুল অপারেশন পান, আপনি হাসপাতালে অসুস্থ হবেন, এসব আরকি। এসব ক্ষয়ক্ষতি একেবারে মামুলি না। ২০১২ সালের এপ্রিলে রেচাল জিস(Rachel Giese) The Warlus নামক কানাডীয় একটি ম্যাগাজিনে "The Errors of Their Ways" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানের হিসেব মতে, প্রতিবছর কানাডার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া বাসিন্দাদের ৭.৫ শতাংশ লোক ন্যুনতম হলেও একটি 'ক্ষতিকর [শারীরিক] ঘটনা'র সম্মুখীন হন এবং চিকিৎসায় ভুলের কারণে ২৪,০০০ জন লোক মারা যান। এই বছরেরই কাছাকাছি সময়ে Harper's Magazine -এ এসম্পর্কে লিখতে গিয়ে রাল্ফ নেডার জানান যে, নিরাময়যোগ্য চিকিৎসার ভুলের কারণে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে যে সংখ্যক লোক মারা যান সেটা চার লাখের আশেপাশে। যদি অতিরঞ্জিত করা হয়েও থাকে, তবুও সংখ্যাটা পিলে চমকে দেয়ার মত। নেডারের হিসাব The Warlus -এর থেকে মাথাপিছু হিসেবে দ্বিগুণ বেশি। কিন্তু এই দূর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতি কোনোভাবেই ইলিচের আলোচ্য ছিল না। মূলত যে বিষয়টি তাঁকে নাড়া দিয়েছিল সেটা হচ্ছে- মাত্রাতিরিক্ত মেডিকেল চিকিৎসা [নির্ভরতা] যেভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মৌলিক প্রবণতাগুলোকে নাজুক করে দিচ্ছে। তিনি যেটাকে চিকিৎসা-জনিত সামাজিক ক্ষতি বলেন তার উদাহরণ হিসেবে, যে-পন্থায় চিকিৎসাব্যবস্থার কলা-কৌশল (art of medicine) প্রবাহিত হয় সেটা তুলে ধরা যেতে পারে। যেখানে চিকিৎসক নিরাময়ক, দ্রষ্টা এবং পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন, চিকিৎসার বিজ্ঞানের পথ সুগম করেন যেখানে ডাক্তার নিশ্চিতভাবে যথাযথ অর্থেই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর রোগীকে একটি গবেষণার বস্তু হিসেবে দেখা বৈ স্বতন্ত্র কোনো বিষয় হিসেবে দেখেন না। পরিশেষে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের চুড়ান্ত আঘাত সামনে আসেঃ চিকিৎসা-জনিত সাংস্কৃতিক ক্ষতি। ইলিচ জানান, এটা ঘটে যখন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গড়ে ওঠা ও বয়ে আসা সাংস্কৃতিক সক্ষমতাগুলোর ভিত প্রথমে দূর্বল করে দেয়া হয় এবং এরপর একইসাথে যখন ধীরে ধীরে সে জায়গা [নতুন উপাদান দিয়ে] দখল করে নেয়া হয়। মোটের উপর, কারও নিজস্ব বাস্তবতার পীড়া সওয়া এবং বইবার সাগ্রহ ইচ্ছা এবং কারও নিজের মওত গ্রহণ করার ক্ষমতা সেসব [সাংস্কৃতিক] সক্ষমতার মধ্যে পড়ে। তিনি যুক্তি দেখান, পীড়া সওয়ার সংস্কৃতি (art of suffering)-কে ঢেকে রাখা হয়েছে এই ভাবনা থেকে যে, সবধরনের অসুখবিসুখ রাতারাতি নিরামিয় করা যায় এবং এমনটাই হওয়া উচিৎ। এটা এমন একটা মানসিকতা যা আদতে পীড়া দূর করে না বরং সেটাকে নিছক একটি দূর্ঘটনা বা প্রায়োগিক ভুল হিসেবে দেখিয়ে [খোদ পীড়াকে] অন্তসারশূন্য করে তোলে। সবশেষে মওতকে একটি একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনা, এমনকিছু যা প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ঘটে, থেকে অর্থহীন একটা পরাজয়ে রূপান্তরিত করেছে, যার মানে চিকিৎসার নিছক থেমে যাওয়া বা যেমনটা কেউ একজন নির্দয়ভাবে বলেছিলেন: "সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া"। ইলিচের যুক্তির পেছনে বুনিয়াদি খ্রিস্ট্রীয় ধ্যানধারণা আছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পীড়া এবং মওত সহজাতভাবেই মানবিক অবস্থায় (the human condition) বিদ্যমান, সেগুলো তার 'মানুষ' হয়ে ওঠার উপকরণের অংশ। একইসাথে তিনি দাবি করেন, এই মানব-অবস্থার (the human condition) হারিয়ে যাওয়াটা আমাদের ইতিহাস এবং আমাদের স্বকীয় সৃজনশীলতার এক সর্বনাশা হরণ ঘটাবে। তিনি বলেন, মানব সমাজের [পীড়া] কমানো এবং উৎকর্ষ সাধন মঙ্গলকর। তথাপি সেটা [মানব-অবস্থা] খুইয়ে ফেলা মানে মানে সর্বনাশ হওয়া। কেননা আমরা ঈশ্বর হয়ে ইশ্বরকে মালুম করতে পারব না, যে নিজের ভাগ্যের দেখনেওয়ালা নিজেই। বরং স্রেফ সৃষ্টি, ভেঙে বললে সৃষ্ট অথবা প্রদত্ত সত্ত, হিসেবেই তাঁকে মালুম করতে পারি।


Medical Nemesis গ্রন্থখানা পেশাদারি ক্ষমতা সম্পর্কিত আলাপ নিয়ে রচিত চলমান সময়ে যখন গণস্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে অভূতপূর্ব ক্ষমতা চর্চার হিড়িক চলছে তখন এই দিকটা নিয়ে একটুক্ষণ ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। ইলিচের মতে, সর্বকালেই সমসাময়িক চিকিৎসাব্যবস্থা রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করে, যদিও এই চরিত্রটি ঢেকে রাখা হতে পারে এই বলে যা-ই করা হচ্ছে তা সেবার জন্য। ওন্টারি প্রদেশে, যেখানে আমি থাকি, সাম্প্রতিককালে 'গণস্বাস্থ্য' খাত সরকারি বাজেটের ৪০ শতাংশের বেশি জায়গা দখল করে রাখে, যা উল্লেখিত বিষয়টা যথেষ্টভাবে পরিষ্কার করার কথা। তথাপি প্রতিদিনকার [চর্চিত] এই ক্ষমতা যা খোদ সেটার মতই গুরুতর আরও বিস্তৃত হতে পারে,, যেটাকে ইলিচ 'সংকটের আচারে-পরিণত-করণ' (the ritualization of crisis) বলছেন। এই প্রবণতা চিকিৎসাব্যবস্থাকে 'এমন এক অনুমতি' প্রদান করে 'যা সাধারণত সামরিক শক্তি কেবল আরোপ করতে পারে'। তিনি আরও বলেন,


“সংকটকালীন চাপের মুহূর্তে যেসব পেশাদারদেরকে কাণ্ডারী বলে ধরা হয় তাঁরা ন্যায় এবং শিষ্টাচারের সাধারণ নিয়ম-নীতির ফাঁক-ফোঁকর থেকে সহজেই রেহাই পেয়ে যায়। মওতের [সংখ্যা বৃদ্ধির] উপর নিয়ন্ত্রণে যাকে নিয়োগ করা হয় তাঁকে আম মানুষ হিসেবে ধরা হয়। কেননা তাঁরা রঙচঙে মোড়া এমন এক সীমারেখা টেনে দেয় যা এই দুনিয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ। সেই সময়-ব্যাপ্তি ও সমাজ-আয়তন জুড়ে চিকিৎসা সম্পর্কিত যেসকল উদ্যোগ দখল করে আছে, সেগুলো তাঁদের ধর্মীয় ও সামরিক প্রতিরূপের মতোই পরম-পবিত্র।“


এই অনুচ্ছেদেরই পাদটীকায় ইলিচ যোগ করেন, “যে [চিকিৎসক] নির্দ্বিধায় কোন সংকটকালে ক্ষমতা খাটাতে পারে, সে মানবিক বিবর্তনকে ছুড়ে ফেলতে এবং ধ্বংস করে দিতে পারে। [সাধারণ] ব্যক্তির সংকটগুলো [অসুখ-বিসুখ] মূল্যায়ন ও চিকিৎসা করতে চিকিৎসকের একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর গোঁ ধরার মনোভাব প্রতীকীভাবে তাঁকে হোয়াইট হাউজের কুটুমগোছের লোকে পরিণত করে।“ Political Theology নামক গ্রন্থে জার্মান আইনজ্ঞ কার্ল স্মিটের প্রস্তাবনার সাথে এখানে এক আকর্ষিক সাদৃশ্য চোখে পড়ে। যেখানে তিনি বলেন, 'ব্যতিক্রমী মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার' ক্ষমতা-ই প্রকৃত সার্বভৌমত্বের পরিচায়ক। স্মিটের কথা হচ্ছে যে, সার্বভৌমত্বের বাস আইনের উপরে। কেননা যেকোন সংকটকালীন মুহূর্তে সার্বভৌমত্ব, [অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে] ব্যতিক্রম জারি করে, আইনের ছুটি করে দিতে পারে এবং সেই জায়গায় বসে আইনের সূতিকাগার হিসেবে শাসন চালিয়ে যেতে পারে। ইলিচ যেটা বলেন, 'কোন সংকটকালে (চিকিৎসকের)... [ক্ষমতা] খাটানো'র ব্যাপারটা, সত্যিকারভাবেই সেটা ক্ষমতার রূপ। ব্যতিক্রমী পরিপ্রেক্ষিত 'গতানুগতিক নিয়মকানুন' থেকে তাঁকে 'অনাক্রম্য' (immune) করে তোলে এবং সেই বাস্তবতার মাস্তুল ধরে নতুন নিয়মাকানুন পয়দার ক্ষমতা দিয়ে দেয়৷ কিন্তু স্মিট ও ইলিচের মধ্যে একটা কৌতূহলোদ্দীপক ও জোরালো তফাৎ আমার চোখে পড়ে। যেটাকে স্মিট 'রাজনৈতিক(political)' বলছেন সেখানের আশেপাশেই তিনি অনড় রয়ে গেছেন। ইলিচ লক্ষ্য করেন, স্মিট যেটাকে সার্বভৌমত্ব বলেন সেটার বেশিরভাগই অনুপস্থিত বা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে সেটাকে উৎখাত করা হয়েছে এবং নানান কিসিমের পেশাদারি হেজিমনি বা নেতৃত্বগুলোতে সেটার পুনঃস্থাপন ঘটেছে।


Medical Nemesis প্রকাশিত হওয়ার একদশক পর ইলিচ তাঁর প্রস্তাবনাগুলো আবার বিবেচনায় নেন এবং সংশোধন আনেন। পূর্বে যা লিখেছেন তা কোনভাবেই তিনি খারিজ করেননি। উপরন্তু তিনি সেগুলোর সাথে নাটকীয়ভাবে আরও [বক্তব্য] যোগ করেন। এবার তাঁর বইটিতে বলছেন, 'চিকিৎসাজনিত ক্ষতির যা খোদ শরীরের চিকিৎসাজনিত ক্ষতি অনেক বেশি প্রতীকী প্রভাবের প্রতি গভীরভাবে অন্ধ' ছিলেন। তিনি 'সেই মাত্রা উপেক্ষা করে' গেছেন, "যে মাত্রায়, [বিশ] শতকের মধ্যবর্তী সময়ে, 'আমাদের শরীর এবং আমাদের স্বীয় স্বত্তা' চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ব ও সেবার ফল হিসেবে দাঁড়িয়েছে।“ অন্যভাবে বললে, Medical Nemisis-এ তিনি এমন লিখেন, যেন কোন স্বাভাবিক শরীরের অস্তিত্ব ছিল, যা প্রযুক্তির তরঙ্গের বাইরে বিদ্যমান, যেটা দ্বারা তার [শরীরের] আত্মসচেতনতা অবিনির্মিত। কিন্তু এখন তিনি সেরকম অস্তিত্বের দেখা পান না। তিনি আরও লেখেন, 'প্রতিটা ঐতিহাসিক কালকে-ই একটি নির্দিষ্ট-যুগের কায়ায় বিমূর্তরূপ দেয়া হয়'। চিকিৎসাবিজ্ঞান কেবল পূর্ব-বিদ্যমান প্রেক্ষিতেই প্রভাব রাখে না, বরঞ্চ সেই জমি তৈয়ার করতেও নিজে লাঙল ধরে।


এই উন্মোচন ইলিচের দিক থেকে তাঁর নতুন অবস্থানের শুরু মাত্র। Medical Nemesis এমন এক নাগরিক-সম্প্রদায়ের কথা তুলে আনে, যাদের সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, তাঁরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের হস্তক্ষেপ বিস্তার সীমিত রাখতে সক্ষম থাকবে। এবার তিনি সেইসব মানুষদের আলাপ পাড়েন যাদের স্বীয়-স্বত্তা জৈব-চিকিৎসার দ্বারাই চালিত। Medical Nemesis তার শুরুর বাক্যেই দাবি করে যে, 'চিকিৎসার প্রাতিষ্ঠানিকতা [স্বয়ং] স্বাস্থ্যের জন্য প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।' তিনি এবার পর্যবেক্ষণ করেন যে, খোদ স্বাস্থ্যের পেছনে ছুটা[র প্রবণতা]-ই স্বাস্থ্যের জন্য প্রধান হুমকি। এরইমধ্যে যুগ-পরিবর্তনের মত ঘটনা ঘটে গেছে, এরকম চিন্তাই তাঁর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পেছনের কারণ। ১৯৮৮ সালে তিনি আমাকে বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি যে, [মানুষের] মনস্তাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে একটা পরিবর্তন চলে আসছে যেখানটায় অনেক মানুষ জীবন-যাপন করে। আমরা যেভাবে চৈতন্যের উপলব্ধির মধ্যে বাস করি, সেটা আমার লেখালেখির উপজীব্য হয়ে আসছে, এবং এক্ষেত্রে আমার অভিমত হচ্ছে, এই মুহূর্তে একটা সীমারেখা (watershed) অতিক্রম করছি। আমি আশা করিনি আমার জীবনকালে এই পর্যায় অবলোকন করব।' ইলিচ 'বিষয়গুলো দেখার নতুন পথটি'কে, তিনি যেটাকে বলেছেন 'সিস্টেমের আমল' বা 'সিস্টেমের তত্ত্ববিদ্যা' তার আবির্ভাব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যে আমলটাকে তিনি শেষ হিসেবে দেখেছেন সেখানে আধিপত্য যান্ত্রিকতার ধারণার যে ধারণা হচ্ছে, স্বাস্থ্যের মত কোন উপকারী কিছু বা নিরাময়ের জন্য ঔষধপত্রের মত যান্ত্রিক উপায়ের ব্যবহার। এই আমলের চরিত্রে বিষয় ও উদ্দেশ্যের, উপায় ও নিরাময়ের এবং যন্ত্র ও ব্যবহারকারীর মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপিত। সিস্টেমের আমলে, তিনি জানান, এই পার্থক্যগুলো ধ্বসে পড়েছে। একটা সিস্টেম হচ্ছে, যেটাকে সাইবারনেটিক্যালি কল্পনা করা হয়, পুরো পরিবেষ্টিত এটার কোন বাহির নেই। কোন হাতিয়ার ব্যবহারকারী হাতিয়ারখানা হাতে নেন যাতে কিছু নিরাময় ঘটাতে পারেন। যেহেতু চালানেওয়ালার সাথে সিস্টেম তার অবস্থা মানিয়ে নেয়, তাই সিস্টেম চালানেওয়ালা সিস্টেমের গর্ভে অবস্থান করে প্রতিনিয়ত সিস্টেমের সাথে নিজের অস্তিত্বের সমঝোতায় যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত মঙ্গলের পেছনে ছুটন্ত [সিস্টেম দ্বারা] নিয়ন্ত্রিত কোনো ব্যক্তি অনাক্রমনীয় সিস্টেমের পথকে সুগম করেন, যা প্রতিনিয়তই পারিপার্শ্বিক [বিদ্যমান] সিস্টেমের সাথে তার বহুরন্ধ্রীয় চৌহদ্দির শক্তির বারবার পরিমাপ করে।


এই নতুন "সিস্টেম বিশ্লেষণ সংক্রান্ত ডিসকোর্স"-এর মধ্যে, যেরকমটা ইলিচ নামকরণ করেন, মানুষের বৈশিষ্ট্যগত অবস্থা হচ্ছে বিমূর্তায়ন। এটা অবশ্যই একটা প্যারাডক্স, কেননা ইলিচ যেটাকে বলেছেন, "স্বাস্থ্যের রোগজনিত অনুবৃত্তি" সেটা যে কারও শারীরিক অবস্থার সাথে তাঁকে এক গভীর, অনবরত এবং কার্যত আত্মরতিমূলক তন্ময়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ইলিচ কেন এটাকে বিমূর্তায়ন হিসেবে ধারণা করেছেন সেটা সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে "ঝুঁকি সচেতনতা"-এর উদাহরণ আনা যেতে পারে, যেটাকে তিনি "আজকের দিনে ধর্মীয়ভাবে অনুসৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ" হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, "ঝুঁকি বিমূর্তায়িত হচ্ছে কেননা এটা যথার্থভাবে একটি গাণিতিক ধারণা"। এটা ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রাখে না, বরং সম্পর্ক রাখে সমষ্টির সাথে অমুক বা তমুক ব্যক্তির সাথে কী ঘটবে তা কেউ জানে, কিন্তু এরকম ব্যক্তির সমষ্টির সাথে কী ঘটবে তা সম্ভাবনারূপে বলে দেয়া যায়। ইলিচ জানান, এই কিসিমের পরিসংখ্যানিক ভূয়া জরিপ দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করা মানে নিজেকে "নিবিড় গাণিতিক সমীকরণে (self-algorithmization)"-এ জড়ানো।


এই "ধর্মীয়ভাবে অনুসৃত মতবাদ"-এর সাথে তাঁর সবচেয়ে পীড়াদায়ক দ্বন্দ্ব ঘটে গর্ভাবস্থায় জেনেটিক পরীক্ষার বেলায়। তিনি এটার সাথে পরিচিত হন তাঁর বান্ধবী ও সহকর্মী সিলিয়া সেমারেস্কি-এর মাধ্যমে। সিলিয়া জার্মানিতে হওয়া জেনেটিক পরীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে জেনেটিক পরামর্শ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন, যেটা কিনা গর্ভবতী নারীর জন্য বাধ্যতামূলক এমন একটা বিষয় পরবর্তীতে যেটা সম্পর্কে The Decision Trap (Imprint-Academic, 2015) নামক একখানা গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। যে বাচ্চাটাকে আশা করা হচ্ছে গর্ভাবস্থায় জেনেটিক পরীক্ষা সে বাচ্চাটি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছুই প্রকাশ করতে পারে না । যা-ই সেটা সনাক্ত করে না কেন সেগুলো [ইশারাসূচক] সূত্রাবলীমাত্র (markers), যেগুলোর অস্পষ্ট অর্থ কেবল সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে বলা যায় একটা সম্ভাবনা যেটা, যাকে পরীক্ষা করা হয়, তাঁর বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, নৃতাত্ত্বিকতা ইত্যাদি তালাশের মাধ্যমে সে যে সমাজের অংশভুক্ত তা যোগ-বিয়োগ কষে আবিষ্কার করা। উদাহরণস্বরূপ, যখন তাঁকে [গর্ভবতীকে] বলা হয় যে, ৩০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে যে, তাঁর বাচ্চার অমুক কিসিমের বা তমুক কিসিমের উপসর্গ থাকবে, তখন তাঁকে তাঁর নিজের সম্পর্কে বা তাঁর গর্ভের ফসল সম্পর্কে কিছুই জানানো হয় না। তাঁর মত অন্য একজনা [বাচ্চাটি]-এর সাথে কী ঘটতে পারে কেবল তা-ই জানানো হয়। তাঁর প্রত্যাশা, বাসনা এবং প্রতিষ্ঠান [চিকিৎসাবিজ্ঞান] তাঁর কাছে যা মেলে ধরে, তা থেকে বেশি কিছু তিনি তাঁর বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে জানেন না, অন্যদিকে তাঁর পরিসংখ্যানগত সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে ঝুঁকির যে চিত্র নিরূপিত করা হয়েছে তা একটা সিদ্ধান্ত দাবি করে। নির্বাচনটা অস্তিত্ব-সম্পর্কিত; তথ্যগুলো যেটার উপর ভিত্তি করে তুলে আনা সেটা ঐ সম্ভাবনা রেখা নির্বাচনকারী যে চৌহদ্দির মধ্যে পরিবেষ্টিত। ইলিচ এটাকে সম্পূর্ণ ভয়াবহ একটা অবস্থা হিসেবে দেখছেন। এমনটা না যে তিনি বুঝেন না, মানুষের সব [উদ্ভাবনী] কাজকর্ম অন্ধকারে ঢিল মারার মত অদেখা-অজানার সম্পর্কে বিবেচনাসূচক হিসেবনিকেশ। তাঁর ভয়ের জায়গাটা সেখানে যখন তিনি দেখেন মানুষজন পরিসংখ্যানগত তথ্যের নির্মিত আয়নায় দেখে নিজেদের [স্বীয় স্বত্তাকে] পুনঃকল্পনা করে নেয়। তাঁর কাছে, এই প্রবণতা সমষ্টির দ্বারা ব্যক্তির বিলীন হওয়া; অকল্পনীয় কিছুকে প্রকাশ করা থেকে ভবিষ্যতেকে বাঁধা দেয়ার একটা অপচেষ্টা; এবং ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার জায়গায় বৈজ্ঞানিক আদর্শের এক প্রতিস্থাপন। সেইসাথে এটা শুধুমাত্র, ইলিচ বুঝতে পেরেছিলেন, গর্ভাবস্থায় জেনেটিক পরীক্ষার সাথে সম্পর্কিত ছিল না, উপরন্তু কম-বেশি পুরো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জুড়েই বিদ্যমান ছিল। মানুষজন ক্রমবর্ধমানহারে তাঁদের ঝুঁকি মোতাবেক প্রত্যাশা ও সম্ভাব্যতা-নির্ভর আচরণ করে যাচ্ছিলেন। তাঁরা, যেরকমটা একবার কানাডীয় স্বাস্থ্য গবেষক অ্যালান ক্যাসেল মজার ছলে বলেছিলেন, "প্রাক-অসুস্থ" (pre-diseased) হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁদেরই মত যে কোন কেউ আক্রান্ত হতে পারে ভেবে অসুখের বিরুদ্ধে সদা সতর্ক ও সক্রিয় থাকা। স্বতন্ত্র রোগীদের স্বতন্ত্র পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা না করে বরং ক্রমবর্ধমানভাবে [সাধারণীকরণের মাধ্যমে] সাধারণ রোগী হিসেবে, [চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায়] কোনো বিভাগ বা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছিল। একইসাথে চিকিৎসকরা ঘনিষ্ঠ পরামর্শক,যিনি [রোগীদের] সুনির্দিষ্ট পার্থক্য ও ব্যক্তিগত পরিভাষা সম্পর্কে সজাগ থাকবে, তা না হয়ে বরঞ্চ ক্রমবর্ধমানহারে এই সম্ভাব্যতার রাজ্যে যন্ত্র-দাস (servo-mechanism) হয়ে ছিলেন। "গাণিতিক সমীকরণে স্বীয়কে" জড়ানো (self-algorithmization) বা বিমূর্তায়ন বলতে ইলিচ এই প্রবণতার কথাই বুঝিয়েছেন।