আমরা এখনও নির্বাক প্রাণী, প্রতিদিনের কিয়ামতের মধ্যে তীব্রভাবে সঙ্গ কামনা করছি

মেলানি বেনসন টাইলর


[আমেরিকান উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী ক্যাথরিন অ্যান পোর্টারের Pale Horse, Pale Rider(১৯৩৯) উপন্যাসিকাত্রয়ীকে বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে বুঝতে চেয়েছেন অধ্যাপক মেলানি বেনসন টাইলর। টাইলর ন্যাটিভ আমেরিকান স্টাডিজের অধ্যাপক এবং ন্যাটিভ সাউথ জার্নালের নির্বাহী সম্পাদক। পোর্টারের উপন্যাসিকাত্রয়ী নিয়ে টাইলরের “Katherine Anne Porter’s Pandemic” লেখাটি গত ২১শে মে Los Angeles Review of Books ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। টাইলরের লেখাটি অনুবাদ করেছেন তাহমিদ আলম ফিহাদ। তাহমিদ আলম ফিহাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী।]


ক্যাথরিন আ্যন পোর্টারের বৈশ্বিক মহামারী


১৯১৮-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারী পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষকে সংক্রামিত করছিল এবং এতে মারা গিয়েছিল অন্তত ৫ কোটি মানুষ। এই মহামারীকে উপলক্ষ্য করে সরাসরি প্রায় কোন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রচিত হয়নি। ক্যাথরিন আ্যন পোর্টার-এর চমৎকার উপন্যাসিকাত্রয়ী পেইল হর্স, পেইল রাইডার হচ্ছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রচনা অথচ এই ত্রয়ী খুব কমই পঠিত হয়েছে এবং প্রায়শই হয়েছে ভুলপাঠ।


স্লেট -এর রেবেকা অনিয়ন এটাকে বলেছেন “করোনাভাইরাসের উদ্বেগ উপশমের জন্য মহামারীর একটি ভাল গল্প”। টেক্সাস মান্থলিতে মিশেল আগ্রেস্তা পরামর্শ দিয়েছেন যে কভিড-১৯ সঙ্কটে এটি হয়তো “ক্যাথারসিস” এবং “সান্তনা” দিতে পারে। কিন্তু পোর্টারের গল্প সান্তনা দেয় না। ভার্চুয়াল সংযোগের যুগের অনেক আগে, তিনি ব্যাধির সেই ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করেছেন যা আমাদের মধ্যে ইতোপূর্বে হাজির থাকা বিচ্ছিন্নতাবোধকে উন্মোচিত করে দেয়।


উপন্যাসিকার নাম (পেইল হর্স, পেইল রাইডার)-এর ভিত্তিভূমি অ্যান পোর্টারের ডেনভারে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সময় স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হবার অভিজ্ঞতার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু এটা ওরকম সুনিশ্চিতভাবে টিকে থাকার রোমাঞ্চকর উপন্যাস (survival romance) নয়। এই অভিজ্ঞতা তাঁর গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের কোঁকড়ানো চুলকে সাদায় বদলে দেয়, এবং অনেক বছর পরে সে স্মরণ করে ওই সময় মানসিককভাবে ‘বদলে’ যাওয়ার কথা। এই সঙ্কট “আমার জীবন বিভক্ত করে ফেলেছে, অনায়াসে কেটে চলে গেছে এর মাঝখান দিয়ে। এর পূর্বে আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে তা আমাকে এর জন্যই প্রস্তুত করছিল”


গল্পটি, যা এই অসুস্থতার ২০ বছরেরও বেশি সময় পর, ১৯৩৯ এর আগে প্রকাশিত হয়নি, ধ্বংসাত্মক সুক্ষ্মতার সাথে তুলে ধরে অর্থপূর্ণ সংযোগবিহীন এবং সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন একটি জীবনে ফিরে যাওয়ার আতঙ্ক।


পোর্টারের আত্মজীবনীমূলক প্রতিনিধি, মিরান্ডা গে, তাঁর ফ্লু-এর লক্ষণ সম্পর্কে অবগত হয়ে উঠে এক সৈনিকের সাথে সংক্ষিপ্ত প্রণয় চলাকালে যে কিনা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিন্তু বাঁচতে পারেনা। এখানে কোন সামাজিক দূরত্ব থাকে নাঃ এই দম্পত্তি বেপরোয়াভাবে হাত ধরে, নাচতে যায়। মানুষ মারা যাচ্ছে এবং চারপাশে চলছে দাফন-কাফন, কিন্তু এই ‘নতুন মজার রোগ’ তাঁদের দখলদারি ফ্রন্ট-এর চেয়ে কম প্রভাবিত করে। আ্যডামকে জাহাজে করে যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হবে এবং মিরান্ডা ইতিমধ্যে তাঁর জন্য শোক পালন করছে।


একজন সাংবাদিক হিসেবে পোর্টারের প্রধান চরিত্র এমন এক দুনিয়ায় বাস করে যেখানে মানুষ অনবরত লিখেও কথা বলে, তারপরও দর্শনীয়ভাবে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়। এই অসংযোগ মিরান্ডার কাছে ভাইরাসের মতই স্পষ্ট হয়ে উঠেঃ শব্দে ভরা একটি পৃথিবীতে “আমরা নির্বাক প্রাণী নিজেদের ধ্বংস হতে দিচ্ছি, এবং কেন? আমরা একে অপরকে যা বলি তা কি এখানে কেউ বিশ্বাস করে?”


সত্যিকারের অন্তরঙ্গতার সুযোগ পেয়ে, “সে বলতে চেয়েছিল, ‘আ্যডাম, তোমার স্বপ্ন থেকে বের হয়ে এসে আমার কথা শোনো। […] আমার সারা শরীরে যন্ত্রনা, আর তুমি এমন বিপদে আছো যা আমি ভাবতেও পারি না, আর কেন আমরা একে অপরকে বাঁচাতে পারছি না?’” এর পরিবর্তে তাঁরা শুধু একে অপরকে স্পর্শ করে এবং হাসে, “যেন তাঁরা একটি নতুন ভাষা খুঁজে পেয়েছে।” এই ক্লিশে মানবজাতির সমান পুরনোঃ শারীরিক স্পর্শই সেই ভাষা, যা কাজ করে যখন অন্য আর কিছুই কাজ করেনা।


বিপর্যয়ের মুখে “পেইল রাইডার” রূপে শারীরিক অন্তরঙ্গতা মানুষের সংযোগের ব্যর্থতার সাথে যে নিষ্ঠুর ধাপ্পাবাজি করে, সংক্রমণের হুমকি সেটাকে শুধু বিবর্ধিত করে। স্পর্শ সংক্রমণ ঘটায়; সাহিত্যে, এটি প্রকাশ করতে পারে, একই সাথে, কি সাংঘাতিকভাবে আমাদের ঘনিষ্ঠতার প্রত্যাশা প্রয়োজন এবং কি সাংঘাতিকভাবে তা আমরা নষ্ট করি। এটা পরিষ্কার যে আ্যডাম, যদি সে বাঁচতো, মিরান্ডাকে বাঁচাতো না। মিরান্ডা ইতিমধ্যে আরেকজন প্রেমিক এবং তাঁর পরিবার থেকে লুইজিয়ানা পালিয়ে গেছে, যাদের সে স্মরণ করে “বাজেভাবে ছুড়ে দেয়া বড়শির সুতোর” জট হিসেবে এবং ঘনিষ্ঠতার সংঘর্ষ হতে ক্রমাগত পিছে ফিরে আসে। তার প্রেমিকের সাথে, “একে অপরের দিকে নেয়া প্রতিটি পদক্ষেপ মনে হয়েছে বিপদজনক, একত্রিত করার বদলে দূরে সরিয়ে দেয়।” শুধুমাত্র যুদ্ধ এবং ফ্লু’ই তাঁদের সর্বনাশ করেনা, বরং মনে হয়, মনুষ্যধর্মই।


পোর্টারের সময় থেকে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর বিস্ফোরণ ঘটেছে, অথচ সামাজিক দূরত্ব প্রকাশ করেছে কতটা সামান্য সংযোগ আমরা সত্যিকার অর্থে অর্জন করেছি। স্ক্রিন টাইম-এর এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের হঠাৎ বৃদ্ধি নিশ্চিত করে বেশিরভাগ আমেরিকানই বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও সংযুক্ত থাকার জন্য পছন্দের প্ল্যাটফর্মে ডুব দিয়েছে। যেমনটা আশাবাদী হয়ে প্রযুক্তির সাংবাদিক ন্যাট জেরান ব্যক্তিগত সঙ্গরোধের(quarantine) সময় লিখেছেন, “আমরা এই ধরনের একাকিত্বের জন্য তৈরী হওয়া প্রজন্ম।” একইভাবে, জেন-ওয়েরনার মুলার আমাদের মনে করিয়ে দেন যখন একটি “সার্বজনীন দুর্দশা” আঘাত করে তখন “আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অনুভূতি একটি বিভ্রান্তি”, এবং টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের মত যন্ত্রগুলো মনে হচ্ছে এই বন্ধনগুলো আরও প্রবল করে।


কিন্তু তথ্য ব্যবহারের চূড়ায়ও, এই ধরনের সমাজগুলোতে আমাদের বন্ধন খুবই সঙ্কীর্ণ মনে হয়। যেমনটা সাংবাদিক লরা পেজ্জিনো মিলানের সম্পূর্ণ লকডাউনে একাকী মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় স্বীকার করেছেন, “আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকেও বেশি আমার মানুষ প্রয়োজন,” এবং সে শরীর অর্থে বলেছে, স্ক্রিন[কম্পিউটার বা অন্যান্য যোগাযোগপ্রযুক্তির পর্দায় হাজির] অর্থে না। আমাদের গৃহের প্রাথমিক পরিবেশের বাইরে শারীরিক সংস্পর্শের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে নিরুৎসাহিত করায় ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ জেন গুন্টার স্পষ্টভাবেই বলেছেন, “এটা কোন আবেদনময়ী সময় নয়।”


যারা বাসায় স্বামী/স্ত্রীসহ আটকা পড়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকতে পারে, যদিও কেউ কেউ ধারণা করছেন প্রলম্বিত কোয়ারেন্টিনে সম্ভাবনা থাকে যে, যে পরিমাণ মেয়ে গর্ভধারণ করবে, সেই একই পরিমাণ দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদও হবে। “মানুষ যারা একই খাটে ঘুমায় তাঁদের মধ্যেও সামাজিক দূরত্ব থাকতে পারে,” মেরিল্যাণ্ডের মারলো হাইটসের কৃষ্ণাঙ্গ প্রধান একটি চার্চের যাজক শ্রদ্ধাভাজন টনি লী তা মনে করিয়ে দেন। যারা এটি শেষ হওয়ার জন্য একা একা অপেক্ষা করছেন তাঁদের কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদন শিল্প হয়ে উঠেছে সেই অল্পসংখ্যক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাগুলোর একটি, যেগুলো বলার মত উন্নতি লাভ করেছে (লক্ষণীয়ভাবে, আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদের বিক্রিও বেড়ে গিয়েছে)।


এসবের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ম্য়কর ব্যাপার এটা না যে আমাদের চর্চিত“একাকীত্ব” আমাদের ব্যর্থ করছে, বরং আমরা এর ঘাটতি এবং স্বৈরাচারীতা উভয় দ্বারা বিস্মিত হতে পারি। ইতিমধ্যে আমরা জানি যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, হাস্যকরভাবে আমাদের করেছে আরও কম সামাজিক; দাবিয়ে রাখার বদলে এই জ্ঞানটি আমরা এখন অনুধাবন করতে পারি। নিঃসন্দেহে এটা অস্বাভাবিক সময়, কিন্তু এটা, যেমনটা আমরা বলতে পছন্দ করি, অভূতপূর্ব সময় নয়। অতীত যদি একটা মুখবন্ধ হয়, আমরা পৃষ্ঠাগুলো বাদ দিয়ে চলে যাইনি; সেগুলো সবে মাত্র লেখা হয়েছে। পোর্টার আমাদের যা প্রদান করেছেন তা একই সাথে বিরল এবং দূরদর্শী।


পোর্টারের বর্ণণা শেষ হয়ঃ “আর যুদ্ধ নেই, আর প্লেগ নেই, শুধুমাত্র ভারী আগ্নেয়াস্ত্রগুলো থেমে যাওয়ার পর বিহ্বল নীরবতা; পর্দা টেনে দেয়া নিঃশব্দ বাড়িঘর, শূন্য রাস্তা, আগামীদিনের মৃত শীতল আলো। এখন সবকিছুর জন্যই সময় থাকবে।” অনেকে এই শেষ লাইনটি আশানুরূপভাবেই পড়েছেন, কিন্তু তা অনুযায়ী, “সব কিছু” অভদ্র রকমের প্রাচুর্যতার একটি কোড, এবং মিরান্ডা নিজের বেঁচে থাকাকে একটা“অসহনীয় প্রতারণা” হিসেবে দেখে।


পোর্টারের জন্য, প্লেগটি সত্যিই হয়ে উঠেছিল আধুনিকতার “বিকৃত স্থানচ্যুতির” (grotesque dislocation) একটি জীবনব্যাপী রূপক, এমন একটা যুগ যখন এই অসুস্থতা পৃথিবীকে রুদ্ধশ্বাসে(heaving) রেখে গিয়েছিল বলে তিনি ব্যাখা করেন। আমরা যে পোর্টারের নিজের দুনিয়ার ছায়াতেই বাস করছি এটা টের পাওয়ার জন্য কোন বৈশ্বিক মহামারীর দরকার পড়া উচিৎ না।’ ত্রিশের দশকের শেষে এই গল্পটির প্রকাশের মুহূর্তটি ছিল যুদ্ধ, মন্দাবস্থা, সাম্প্রদায়িকতা, জেনোফোবিয়া দ্বারা বিহ্বল-আধুনিকতার স্তুপাকৃত ভয়াবহতায় ধাক্কায়-ধাক্কায় ছিন্ন হয়ে যায় জাতি এবং ব্যক্তি। পোর্টারের চরিত্রদের মত আমরা এখনও নির্বাক প্রাণী, প্রতিদিনের কিয়ামতের মধ্যে তীব্রভাবে সঙ্গ কামনা করছি।


____________

২১শে মে, ২০২০



প্রথম প্রকাশঃ ২৭ শে মে, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৭শে মে, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/383946516090755/