অচ্ছুৎ সম্প্রদায়: আগামবেন ও ন্যান্সির ভাবনার প্রত্যুত্তর

সাজ মোহন ও দিব্যা দ্বিবেদী


[করোনা মহামারী ও এর সাপেক্ষে জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে গত ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে অকারণ জরুরতের ডেকে আনা জরুরী অবস্থা নামে আগামবেনের লেখা প্রকাশিত হয়। জরুরী বা ব্যতিক্রম অবস্থার স্বাভাবিকীকরণকে প্রসারিত করার ছুতা হিসেবে তিনি সাব্যস্ত করেন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় রাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে। আগামবেনের সমালোচনা করে পরদিনই দার্শনিক জঁ-লুক ন্যান্সি ভাইরাসজনিত ব্যতিক্রম বা জরুরী অবস্থা নামে প্রত্যুত্তর লেখেন। পরে এই বিতর্কে অন্যান্য দার্শনিক, মনসমীক্ষক, ভাইরোলজিস্ট ও রাজনীতিবিশ্লেষক অন্যান্যরাও যুক্ত হয়ে পড়েন। আগামবেন নিজেও তাঁর অবস্থানকে স্পষ্ট ও সুসংহত করতে নিয়মিত লিখে চলেছেন। European Journal of Psychoanalysis- এ ‘করোনাভাইরাস ও দার্শনিকেরা’ শিরোনামের অধীনে এই বিতর্কের বেশকিছু লেখা প্রকাশ করেছে। সাজ মোহন ও দিব্যা দ্বিবেদী’র The Community of the Forsaken: A Response to Agamben and Nancy শিরোনামের লেখাটিও এখানে প্রকাশিত হয়েছে। সাজ মোহন ও দিব্যা দ্বিবেদী উভয়েই ভারতীয় লেখক ও দার্শনিক। দ্বিবেদী দিল্লীর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র মানবিক এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে পড়ান । মোহন ও দ্বিবেদী’র এই লেখাটি অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় শিক্ষক, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান।]



আদিকাল থেকে ব্যতিক্রমধর্মী মানুষে ভরপুর ভারত। ‘ব্যতিক্রম (বা জরুরী) অবস্থা’ অথবা এটাকে ‘প্রসারিত করা’র ভাবনাকে এরা নিরর্থক বানিয়ে ছেড়েছে। এই দেশের ব্রাহ্মণরা বেশ সুবিধাপ্রাপ্ত জাত। এর কারণ হল, যে সকল আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা সমাজসংসার চলে, ঐ সকল কিছু তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। আর পাছে ব্রাহ্মণ্যের জাত যায় এই ভয়ে নিচুজাতের লোকেরা তাদের (চাওয়া দূরে থাক) ছুঁতেও পারে না। এই আধুনিক সময়েও, অনেক জায়গায় আলাদা গণশৌচাগার নির্মাণ করতে হয় এদের জন্য। একজন উঁচুজাতের কারও পক্ষেও দলিত বা নিচুজাতের কাউকে (কামনা করা দুরে থাক) ছোয়াও নিষেধ। কারণ একটাই; তারা সবচাইতে নিচু এবং সবকিছু ‘কলুষিত’ করে। বোঝাই যায়, ব্রাহ্মণদের ব্যতিক্রম বা আলাদা থাকা (exception, মানে ওদের কেউ ছুঁতে না পারার ব্যাপারটা) আর দলিতদের আলাদা রাখা (exclusion, বাদ দেয়া) এক নয়। হানা আরেন্ড জলন্ত উদাহরণ হিশেবে তুলে ধরেছেন ‘পারিয়াহ’ নামের দক্ষিণ ভারতের এক দলিত সম্প্রদায়ের কথা, একে এক ‘প্যারাডাইমে’ রূপ দিয়েছেন। বর্ণনায় দেখা যায় তাদের জ্বালা-যন্ত্রণার এক নগ্নচিত্র। ১৮৯৬ সালে মহামারী আকারে বোম্বেতে প্লেগ প্রবেশ করার পর ১৮৯৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন এর মোকাবেলায় এপিডেমিক ডিজিস অ্যাক্ট জারি করে। কিন্তু বর্ণপ্রথার ছুতো ধরে উঁচুবর্ণের মানুষেরা দাবী করে বসে আলাদা হাসপাতাল ব্যাবস্থাপনা। নিচুজাতের হাসপাতালকর্মীদেরও সেবা নিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা; ফলে সারাভারতে মৃতের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যায়।


বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই, এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসবর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই, এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস; সরকারি হিসেবে আক্রান্ত হয়েছে একলক্ষেরও বেশি মানুষ। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের যোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন — ভাবা যেতেই পারে, নিজেদের বাঁচানো যাবে কি? গেলেও, কিভাবে? একদিকে চলছে ‘জৈব-মারণাস্ত্র’(biowepeons) সংক্রান্ত কন্সপিরেসি থিওরিসমূহ আর শরনার্থী কমিয়ে আনার বৈশ্বিক প্রকল্পের গল্প। আরেকদিকে উদ্ভট যত ভুল বোঝাবুঝি যেমন, কোভিড-১৯ আসলে মেক্সিকোর ‘করোনা’ নামক বিয়ার(beer) থেকে ছড়ানোর গল্প কিংবা চীনাদের ব্যাপারে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য। আমাদের মনে হয়, মন্ত্রদেবতার মৃত্যু আর যন্ত্রদেবতার জন্মের এই সন্ধিক্ষণে, মানুষের ‘যোগ্যতার’ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিচার করা উচিৎ। পুরো ব্যাপারটি জলবায়ু সঙ্কট, ‘অবাধ’ প্রযুক্তি আর করোনাভাইরাসের প্রেক্ষিতে ভাবা যেতে পারে।


আগে মানুষের শক্তির উৎস ছিল ধর্মতত্ত্বীয়-কৃৎকৌশল (theo-technology)। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, “সত্তার” (being) মতন প্রাকসিদ্ধ ব্যাপারে মীমাংসা ছিল স্রষ্টা-সৃষ্টির তত্ত্ব। এর মধ্যে প্রথমোক্তকে কল্পনা করা হতো অসীম আর শেষোক্তকে সসীম । ঘুরিয়ে বললে দেবতা হল অসীম মানুষ, আর মানুষ হল সসীম দেবতা । ইতিমধ্যে অসীম মানুষের নামে সসীম দেবতা’রা নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছে। আজকাল আবার মেশিনের উপর আমাদের এমন আস্থা যে এই পুরো চক্করটাকে কৃৎকৌশল-ধর্মতত্ত্ব (techno-theology) বললে বাড়িয়ে বলা হয়না।


এই অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে, জর্জিও আগামবেন বলেছেন, কোডিভ-১৯ এর বিরুদ্ধে এই সতর্কতা ও পদক্ষেপগুলো সরকারের জন্য এক ‘ব্যতিক্রম’ সুযোগ। এই ‘ব্যতিক্রম'’ শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাকে প্রসারিত করতে অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং চরমভাবে আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। চিন্তা করে দেখুন, অনেক দেশ ভালোই দেরিতে ভাইরাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং যার ফলে মারা যেতে পারে নিদেনপক্ষে দেশের জনসংখ্যার একশভাগের এক ভাগ; আর এতেই বোঝা যায় পরবর্তী পর্যায়ের কোন ‘ব্যতিক্রম’ ব্যাপারটা ঘটানো হবে। আগামবেন আমাদের স্বাভাবিক আর ‘ব্যতিক্রমের’ মাঝে যেকোন একটা বেছে নিতে বলেন, তবে তিনি মনে করেন, ব্যতিক্রমের স্বাভাবিকীকরণ হতে চলেছেএই অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে, জর্জিও আগামবেন বলেছেন, কোডিভ-১৯ এর বিরুদ্ধে এই সতর্কতা ও পদক্ষেপগুলো সরকারের জন্য এক ‘ব্যতিক্রম’ সুযোগ। এই ‘ব্যতিক্রম'’ শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাকে প্রসারিত করতে অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং চরমভাবে আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। চিন্তা করে দেখুন, অনেক দেশ ভালোই দেরিতে ভাইরাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং যার ফলে মারা যেতে পারে নিদেনপক্ষে দেশের জনসংখ্যার একশভাগের এক ভাগ; আর এতেই বোঝা যায় পরবর্তী পর্যায়ের কোন ‘ব্যতিক্রম’ ব্যাপারটা ঘটানো হবে। আগামবেন আমাদের স্বাভাবিক আর ‘ব্যতিক্রমের’ মাঝে যেকোন একটা বেছে নিতে বলেন, তবে তিনি মনে করেন, ব্যতিক্রমের স্বাভাবিকীকরণ হতে চলেছে। জঁ-লুক ন্যান্সি কিন্তু মনে করেন না যে, ব্যতিক্রম স্বাভাবিক হতে চলেছে। তাঁর মতে, ব্যতিক্রম শুধু ইদানীং হচ্ছে। তার মানে, এতদিন আমরা যা স্বাভাবিক ভাবতাম তা ভেঙে পড়ছে।। জঁ-লুক ন্যান্সি কিন্তু মনে করেন না যে, ব্যতিক্রম স্বাভাবিক হতে চলেছে। তাঁর মতে, ব্যতিক্রম শুধু ইদানীং হচ্ছে। তার মানে, এতদিন আমরা যা স্বাভাবিক ভাবতাম তা ভেঙে পড়ছে। শেষ রচনায় দার্শনিক জিল দেল্যুজ তাকেই ‘জীবন’ শেষ রচনায় দার্শনিক জিল দেল্যুজ তাকেই ‘জীবন’ বলেছেন যা আমাদের সকল নিয়মানুবর্তিতা এবং ব্যতিক্রমের সমন্বয়, যা মৃত্যু দিয়ে ঘেরা আর দায়িত্বের ভারে ভারাক্রান্ত। তিনি আরও বলেন, “মৃত্যু আর দায়িত্ব হাত ধরাধরি করে চলে।”


এবার, ব্যতিক্রমের অ-ব্যতিক্রম কিছু দেখা যাক। ১৮০০ সালের শেষের দিক অব্দি, গর্ভবতী যেসব মহিলা হাসপাতালে ভর্তি হত তাদের অধিকাংশই হয় সন্তান জন্ম দেয়ার সময় বা পরে সংক্রমণ জটিলতায় মারা যেত। কোন এক মুহুর্তেই ইগনাজ সেমেলভাইজ(Ignaz Semmelweis) নামের এক অস্ট্রীয় চিকিৎসক বুঝতে পারলেন, হাসপাতালের কর্মীরা এর জন্য দায়ী। তাদের হাতেই জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে এক রোগী হতে আরেক রোগীতে আর ঘটাচ্ছে মৃত্যু। যাই হোক, সমাধান ডাক্তার সাহেবই দিয়েছিলেন: প্রতিটা রোগীর কাছে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যকর্মীদের ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে বলেছিলেন তিনি। উনার এই ব্যতিক্রমী পরামর্শের জন্য অবশ্য স্বাস্থ্যকর্মী পরিষদ উনাকে পুরস্কৃত করতে ভুলেনি: উনাকে হাসপাতাল হতে বের করে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে উনার মৃত্যু হয়েছিল এক উম্মাদ-আশ্রমে, সম্ভবত আশ্রমের দারোয়ানের পিঠুনিতে। বলা হয় রক্তপ্রদাহ(septicemia) রোগেও ভুগছিলেন তিনি। সত্যিই, ব্যতিক্রমের হাজারও ব্যাখা করা সম্ভব। সেমেলভাইজের ক্ষেত্রে জীবাণুর বিরুদ্ধে অন্যভাবে যুদ্ধ করতে বলাটাই ছিল ‘ব্যতিক্রম’। পলিটিক্স গ্রন্থে এরিস্টটল ব্যতিক্রম মানুষের উদাহরণ টেনেছেন এই বলে যে, কোরাস দলে অতি ভালো কেউ গাইলে তাকে মানুষের মাঝে দেবতার আগমন এই ছুতায় আলাদা করে দেয়া হয়।


ব্যতিক্রম ব্যাপারটা ছকে বাঁধা নয়। উদাহরণ হিশেবে অণুজীবের কথা ভাবা যায়। এক রোগের অণুজীবের চলার ধরন আরেকটি হতে ভিন্ন। ধরা যাক, স্টেফাইলোকোকসি(stephylococci) নামের ব্যাকটেরিয়ার কথা, যারা মানবশরীরে কোন ঝামেলা না করেই বেঁচে থাকে। কিন্তু শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা "অতিমাত্রায়" বেড়ে গেলে এরাই আবার সংক্রমন ছড়িয়ে দেয়। পুরোপুরি রোগতত্ত্বের বাইরে এসে চিন্তা করলে গাছের কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট আর আমাদের শরীরের কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া নিয়ে ভাবা যায়। দুটোই প্রাচীন এবং দুটোই দৃঢ়ভাবে সহাবস্থানে আছে ভিন্ন দুটি প্রজাতির মাঝে। সর্বোপরি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ‘চায় না’ তাদের আশ্রয়দাতাকে হত্যা করতে, কেননা এটি তাদের ‘স্বার্থ’ ব্যতিক্রম ব্যাপারটা ছকে বাঁধা নয়। উদাহরণ হিশেবে অণুজীবের কথা ভাবা যায়। এক রোগের অণুজীবের চলার ধরন আরেকটি হতে ভিন্ন। ধরা যাক, স্টেফাইলোকোকসি(stephylococci) নামের ব্যাকটেরিয়ার কথা, যারা মানবশরীরে কোন ঝামেলা না করেই বেঁচে থাকে। কিন্তু শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা "অতিমাত্রায়" বেড়ে গেলে এরাই আবার সংক্রমন ছড়িয়ে দেয়। পুরোপুরি রোগতত্ত্বের বাইরে এসে চিন্তা করলে গাছের কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট আর আমাদের শরীরের কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া নিয়ে ভাবা যায়। দুটোই প্রাচীন এবং দুটোই দৃঢ়ভাবে সহাবস্থানে আছে ভিন্ন দুটি প্রজাতির মাঝে। সর্বোপরি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ‘চায় না’ তাদের আশ্রয়দাতাকে হত্যা করতে, কেননা এটি তাদের ‘স্বার্থ’ (৫) পরিপন্থী। দীর্ঘসময় ধরে— মানে প্রকৃতির লক্ষ বছরের হিসেব ধরেই দীর্ঘ– “সবকিছুই একে অন্যের সাথে বেঁচে থাকতে শিখে”, কিংবা অন্তত একে অন্যের সাথে দীর্ঘদিন সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলে। জীববিজ্ঞানীদের মতে প্রকৃতি টিকে আছে এই কারণেই।


ইদানিং, গবেষণার ফলে, (ল্যাব কালচার ধরে নেয়া ভালো) পূর্বে বিভক্ত থাকা মাইক্রো-অর্গানিজম একসাথে হয়ে নিজেদের মাঝে জিনের অংশ—এমনকি মাঝে মাঝে DNA কিংবা RNA-এর ভগ্নাংশও—আদানপ্রদানের সূযোগ পেয়ে গেছে। আর যখন, এই অর্গানিজমগুলো মানুষের দিকে ‘ঝাপিয়ে’ পড়ার সুযোগ পেয়েছে, আমাদের জন্যে বিপদই হয়েছে বটে। এই নব্য আগুন্তুকের সাথে যুদ্ধ করতে আমাদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যাবস্থাপনাকে রীতিমতো সকল শক্তি সঞ্চয় করে প্রদাহ(inflammation) আর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে হয়, ফলশ্রুতিতে বাড়ে জ্বর যা অনুজীব এবং আমাদেরও হত্যা করে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, ‘ভাইরাস’ আমাদেরও হত্যা করে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, ‘ভাইরাস’ ৬ বিষের সাথে সম্পর্কিত। একে বিষ বলা যাবে ততক্ষন পর্যন্ত যতক্ষণ মানবশরীর এর সাথে যুদ্ধ করে পেরে উঠেনা। মানে, প্রকৃতির দীর্ঘসময়ের প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে চিন্তা করলে সব কিছুকে ‘ফার্মাকন’ বিষের সাথে সম্পর্কিত। একে বিষ বলা যাবে ততক্ষন পর্যন্ত যতক্ষণ মানবশরীর এর সাথে যুদ্ধ করে পেরে উঠেনা। মানে, প্রকৃতির দীর্ঘসময়ের প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে চিন্তা করলে সব কিছুকে ‘ফার্মাকন’[i] (pharmakon, যা একইসাথে বিষ এবং নিরাময়) হিসেবে ভাবা যায়। যাই হোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঔষধ এবং বিষ এই দুইয়ের পার্থক্য বুঝতে হয়, মানুষ নামের এই অপার্থিব প্রাণীর (সল্প)সময়ের মাপকাঠিতে (প্রকৃতির দীর্ঘ সময়ের মাপকাঠিতে নয়)। জৈব-রাজনীতির(biopolitics) ধারণা দাড়িয়ে আছে মূলত প্রকৃতির (দীর্ঘ)সময়ের ধারণার উপর ভিত্তি করে। আর তাই আমাদের দায়িত্ব ভারাক্রান্ত ‘এক জীবনের’ (মানে স্বল্প সময়ের) স্বার্থের বিপরীত কোনো বিপর্যয়কে এটি আমল দেয় না, অগ্রাহ্য করে। এই বিপর্যয়ে, ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রত্যেকেরই আছে।


সমস্যার গিট্টু এইখানেই : স্বাভাবিকের মাঝে ব্যতিক্রম স্হাপন করে আমরা বুঝে গেছি আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার ‘চাহিদা’ কি? সেই ব্যতিক্রমের উদাহরণ হলো, সেমেলভাইজের হাত ধোয়ার মত পদ্ধতি কিংবা টিকা নেয়ার মতো ব্যাপার। আমাদের মতো প্রাণীদের আবার এত দীর্ঘ জৈবিকজীবন নেই যে, নিজেদের সুবিধা মতো বাইরের যেকোন আক্রমনের সাথে খাপ খাইয়ে নিব। তাই প্রকৃতির মতো আমরাও যেকোন সংকটাপন্ন অবস্হায় নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী কোডিং এরর এবং মিউটেশন করে থাকি। ন্যান্সি উল্লেখ করেন, সফোক্লিস যখন হতে মানুষের জয়গান গাইছেন তখন হতে এযাবত পর্যন্ত মানুষ নিজেই নিজের কাছে অচেনা। আর এর কারণ হলো সে কৌশলে ব্যতিক্রম নির্মাণ করতে জানে। প্রকৃতির সময়ের বিপরীতে, মানুষ করে থাকি। ন্যান্সি উল্লেখ করেন, সফোক্লিস যখন হতে মানুষের জয়গান গাইছেন তখন হতে এযাবত পর্যন্ত মানুষ নিজেই নিজের কাছে অচেনা। আর এর কারণ হলো সে কৌশলে ব্যতিক্রম নির্মাণ করতে জানে। প্রকৃতির সময়ের বিপরীতে, মানুষ এই মুহূর্ত [ii] নিয়ে ভাবিত। এই ভাবনা জন্ম দেয় এক বোধের : মানুষ আজ অচ্ছুৎ। সে আজ অভিশপ্ত, কেননা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পরিত্রাণের উপায় খুঁজে না পেয়ে সে ‘কেন’ এই প্রশ্ন করতে পারে। ন্যান্সি তাঁর ব্যাক্তিগত চিঠিতে লিখেছেন, ব্যাপারটি হলো, "forsaken by nothing" [অনুবাদ করলে দাড়ায়, “কারণ ছাড়াই অচ্ছুৎ” হয়ে যাওয়া]। এই ‘অচ্ছ্যুৎ অবস্থা’ (forsakenness) কিন্তু পরিত্যাগ করার মতো কোন ব্যাপার নয়। পরিত্যাগ করা বলতে আসলে একের কাছ হতে আরেকের অনুপস্থিতিকে বোঝায়। দেল্যুজে আমরা দেখেছি, এই অচ্ছুৎ হওয়া দাবি করে যেন আমরা প্রতিটি জীবন প্রিয় হিসেবে যাপন করি। এও জানি, অচ্ছুৎদের সমাজের মধ্যে থেকেই আহ্বান করতে পারি অচ্ছুৎ পৃথগাত্মা জীবনের। এই জীবন যাপন করতে হবে একাকী। অন্যত্র, অচ্ছুৎ থাকার এই আহ্বানের অভিজ্ঞতা এবং অধিবিদ্যা ও hypophysics-এর বাইরে এটার সমাজের সম্ভাব্য উত্থানকে আমরা বলতে পারি ‘পুনরূত্থান’।[অনুবাদ করলে দাড়ায়, “কারণ ছাড়াই অচ্ছুৎ” হয়ে যাওয়া]। এই ‘অচ্ছ্যুৎ অবস্থা’ (forsakenness) কিন্তু পরিত্যাগ করার মতো কোন ব্যাপার নয়। পরিত্যাগ করা বলতে আসলে একের কাছ হতে আরেকের অনুপস্থিতিকে বোঝায়। দেল্যুজে আমরা দেখেছি, এই অচ্ছুৎ হওয়া দাবি করে যেন আমরা প্রতিটি জীবন প্রিয় হিসেবে যাপন করি। এও জানি, অচ্ছুৎদের সমাজের মধ্যে থেকেই আহ্বান করতে পারি অচ্ছুৎ পৃথগাত্মা জীবনের। এই জীবন যাপন করতে হবে একাকী। অন্যত্র, অচ্ছুৎ থাকার এই আহ্বানের অভিজ্ঞতা এবং অধিবিদ্যা ও hypophysics-এর বাইরে এটার সমাজের সম্ভাব্য উত্থানকে আমরা বলতে পারি ‘পুনরূত্থান’।৭

____________

৮ই মার্চ, ২০২০


টীকা


ঘটনাক্রমে, করোনা(corona) নামের অর্থ হলো মুকুট(crown) যা সার্বভৌমত্বের প্রতীক (আরো শুদ্ধভাবে বললে, বলতে হবে 'লক্ষনা' যাকে ইংরেজিতে metonymy বলে)।


সন্ত্রাসবাদের দোহাই দিয়ে সকল সামাজিক সম্পর্ক নজরদারির উদ্দেশ্যে ২০০১ সাল হতে প্রায় সব সরকার নন-চয়েস সুযোগ হিসেবে এটি নিয়েছে। যে প্রবনতাটি এইক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তা হল, রাস্ট্রের সুরক্ষাকরণ মানে রাস্ট্রের সকল কার্যাবলীকে কর্পোরেটে পরিণত করা, বাণিজ্যিকীকরণ করা।


জঁ-লুক ন্যান্সি, L’ Intrus (প্যারিস, Galilée, ২০০০)


জিল দেল্যুজ, “L’immanence: une vie”(Immanence: A Life), in Philosophie 47 (১৯৯৫)


অনুজীবের চাওয়া না-চাওয়া নিয়ে কথা বলা হাস্যকর আর পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে গেলে স্হান সংকুলান হবে না। এছাড়া, আজকাল "মানুষের চাওয়া" যে কি, তা বুঝে উঠা মুশকিল।


মনে রাখা ভালো, ভাইরাস একই সাথে জীব আর জড়।


সাজ মোহন ও দিব্যা দ্বিবেদী, Gandhi and Philosophy: On Theological Anti-Politics, foreword by Jean-Luc Nancy (London: Bloomsbury Academic, ২০১৯)


অনুবাদকের টীকা


[i]ফার্মাকন (pharmakon)— জ্যাক দেরিদার দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘প্লেটোর আয়ুর্বেদভাবনা’য় (La Pharmacie de Platon) আমরা ফার্মাকনের দুই অর্থ—বিষ ও ঔষধ—নিয়ে প্রথম বিশদ আলোচনা পাই।


[ii] এই মুহূর্ত (this moment)—ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের jetztzeit [now-time, এই মুহূর্তে, বর্তমান কিম্বা ‘ওয়াক্ত’(পারভেজ আলম অনূদিত)] অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরঞ্চ এক ইউটিউব ভিডিওতে লেখকদ্বয়ের দ্বিতীয়জন zeitgeist (spirit of the age) শব্দের ব্যবহার করেছেন এবং একে আমরা সেই অর্থেই বুঝতে পারি।



প্রথম প্রকাশঃ ১৯ শে এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১৯শে এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/345556763191060/