: Something Special :
: Something Special :
Story For Readers : [ Collapse the tab To Read Full Story ! ]
A Retrieved Reformation [Jimmy Valentine] in Bengali
Originally Written By : O. Henry [William Sydney Porter]
জিমি ভ্যালেন্টাইন জেলের জুতো কারখানায় অতি যত্ন সহকারে জুতো সেলাই করতে ব্যস্ত ছিল। এমন সময় হঠাৎ এক জেলের প্রহরী এসে তাকে জেল প্রধান মহাশয় এর অফিসে নিয়ে গেলেন।
সেখানে যেতেই জেল প্রধান মহাশয় তার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে বললেন, "জিমি, তোমার তো ভাগ্য খুলে গেল! আজই গভর্নর মশাইয়ের অফিস থেকে তোমার এই ক্ষমাপ্রার্থীর চিঠিটা এসেছে। কাল সকালেই তোমাকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। এতদিন জেলে তোমার শান্ত সুলভ আচরণ কে লক্ষ্য করে, তোমার শাস্তি মকুব করে দেওয়া হয়েছে।"
একটুও অবাক না হয়েই সাধারণভাবেই জিমি সেই চিঠিটা নিল। তার চার বছর জেল হয়েছে, প্রায় দশ মাস কেটে গেছে। কিন্তু জিমি ভেবেছিল যে খুব বড় জোর হয়তো তিন মাস তাকে জেলে থাকতে হবে। বাইরে জিমির অনেক প্রভাবশালী বন্ধুরা রয়েছে, যারা অনেক চেষ্টা করেছে জিমিকে কোনো-না-কোনোভাবে জেল থেকে বের করার কিন্তু পারেনি।
জেল প্রধান মহাশয় তাকে বললেন, "জিমি তুমি খারাপ মানুষ নও। কাল জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছ... সোজাসাপ্টা জীবন যাপন করো সৎ পথে থাকো। আর অন্যদের সিন্দুক ভাঙ্গার অভ্যাসটা ত্যাগ করো"
জিমি অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, "আমি!... আমি তো জীবনে কোনদিনও কারোর সিন্দুক ভাঙেনি।"
এবার জেল প্রধান একটু হেসে বললেন "সেই তো, তুমি তো কোনোদিনও সিন্দুক ভাঙেইনি! আচ্ছা তাহলে বলতো, তুমি ওই স্প্রিংফিল্ডের কান্ডে কিভাবে জড়িয়ে পড়লে? নাকি তুমি কোনো প্রভাবশালী লোক কে বাঁচাবার জন্য নিজের সাক্ষ্য প্রমাণ করোনি।...নাকি এটা কোন খারাপ জুরির কাজ যে, তোমাকে ইচ্ছে করে এই কেসে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আসলে কি জানোতো, তোমার মত যারাই এইখানে আসে জেল খাটতে তারা সকলেই নিজেকে নিরপরাধী মনে করে। কেউ নিজের দোষ স্বীকার করতে চায় না।"
আবার জিমি সম্পূর্ণভাবে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতেই বললো "কি! আমার মতো? আরে আমি সত্যি বলছি জীবনে কোনদিনও আমি স্প্রিংফিল্ডেই যাইনি।"
যাইহোক জেল প্রধান আর কথা না বাড়িয়ে জেল প্রহরীকে বললেন, "আচ্ছা ক্রোনিন, যাও তুমি এবার একে নিয়ে যাও আর সকাল সাতটার মধ্যে ভালো জামা কাপড় পরিয়ে, আর হাত করাটা খুলে আমার অফিসে নিয়ে আসবে"
-"আচ্ছা ভ্যালেন্টাইন, তুমি কিন্তু আমার উপদেশগুলোর কথা একটু মন দিয়ে ভেবো"
পরের দিন সকাল সাতটা পনেরোর সময় জিমিকে জেল প্রধানের অফিসের বাইরে এনে দাঁড় করানো হলো।
জিমি পড়েছিল একটি রেডিমেড, ঢিলেঢালা জামা, যা তার গায়ে ঠিক মতো ফিট হয়নি। আর পায়ে একজোড়া শক্ত জুতো যা প্রত্যেক কয়েদিকেই দেওয়া হয় যখন তারা জেল থেকে মুক্তি পায়।
ক্লার্ক তার হাতে একটি রেল টিকিট এবং পাঁচ ডলার দিল। যাতে সে নিজের জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করতে পারে এবং জেল প্রধান মহাশয় জিমিকে একটি সিগার ধরিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন।
জিমি জেল থেকে বেরোনোর সময় জেল এর খাতায় লেখা হলো,- "সরকার, ভ্যালেন্টাইন ৯৭৬২ নম্বর কয়েদিকে তার শান্ত সুলভ আচার আচরণের জন্য ক্ষমা করে দিলেন" তারপর শেষমেষ দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর, জিমি জেল থেকে বেরিয়ে সূর্যের আলো দেখতে পেল।
কোনো কয়েদি যখন জেল থেকে মুক্তি পায় তখন সূর্যের আলো, মুক্ত বাতাস, পাখির আওয়াজ এবং ফুলের সুবাসে মন ভরে যায়। তার কিন্তু জিমি ভ্যালেন্টাইন এর কাছে জেলে আসা-যাওয়া নতুন কোন ব্যাপার নয়। তাই এসব কে উপেক্ষা করেই সে সোজা গিয়ে পৌঁছলো একটি রেস্টুরেন্টে। যেখানে সে ব্রএলড চিকেন এবং হোয়াইট ওয়াইন খেয়ে সে তার স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করলো। তারপর সে জেল প্রধানের দেওয়া সিগারের থেকেও ভালো, একটা সিগার কিনে সেটা ধরাল। তারপর সে ওখান থেকে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে ট্রেন ডিপোর কাছে পৌঁছে সেখানে, স্টেশন এর ধারে বসে থাকা একটি ভিক্ষুককে সে কয়েকটি খুচরো পয়সা দান করল। তারপর তিন ঘন্টা ট্রেনে যাত্রা করে সে একটি ছোট শহরে এসে পৌছালো।
সে তারপর ঐ শহরেরই এক বন্ধু মাইক দোলন এর ক্যাফেতে গেল এবং ভেতরে বার কাউন্টারে গিয়ে মাইকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল।
মাইক তাকে দেখে বলল,
"আরে জিমি যে! অনেক চেষ্টা করেছিলাম তোমায় বের করে আনার তবে এর আগে বের করতে পারলাম না। আসলে স্প্রিংফিল্ডের ঘটনায় তুমি ধরা পড়ার পর সরকার অনেক কঠোর হয়ে গেছে। তাই পরিস্থিতি শিথিল করতে অনেকটা সময় লেগে গেল। তা তুমি এখন ঠিক আছ তো নাকি!"
-"হ্যাঁ হ্যাঁ ভালোই আছি। আমার চাবিটা আছে তো?"
তারপর সে তার চাবিটা নিল এবং সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে পেছনের দিকের একটা ঘরের চাবি খুলল। ঘরের ভেতরে সবকিছুই যেমন সে ছেড়ে গেছিলো ঠিক তেমনই আছে। সেখানে এখনও মেঝেতে বেন প্রাইস এর কলারের বাটন পড়ে যেটা জিমি কে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল।
এবার জিমি তার ভাঁজ করা বিছানাটা তুলে নামাল তারপর সে দেওয়ালে লোকানো একটা জায়গা খুলে সেখান থেকে একটা ধুলো জমে যাওয়া সুটকেস বের করলো। তারপর সেটিকে খুলে দেখে নিল যে তার সব অতি প্রিয় দামি ও বাছাই করা ছুরি করার সামগ্রিগুলো ঠিক আছে কিনা যা যে পূর্বদিকের কোন এক জায়গা থেকে বিশেষ ভাবে তৈরি করে এনেছিল। যার সম্পূর্ণ ভর্তি ছিল জং নিরোধক স্টিল দিয়ে তৈরি তুরপুন, ছিদ্র করার যন্ত্র, তুরপুন ঘোরানোর যন্ত্র,ছোট ধাতুর শাবল এবং দুয়েকটি অভিনব যন্ত্রপাতি দিয়ে যা, সে নিজে আবিস্কার করেছে আর যার জন্য সে নিজে খুব গর্ববোধ করে। প্রায় ৯০০ ডলার এরও বেশি টাকা খরচা করে জিমি এই যন্ত্রপাতি গুলো বানিয়েছিলেন যেখানে এই ধরনের জীবিকার জন্য এই ধরনের যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করা হয়।
আধঘণ্টার মধ্যেই জিমি নিচে নেমে আসে, ও সেই ক্যাফেতে প্রবেশ করে। এবার তার পরনে ছিল রুচিসম্মত ও ঠিক ঠাক মাপের পোশাক এবং হাতে ছিল ধুলোঝাড়া পরিস্কার করা সুটকেসটি ।
মাইক দোলান জিমিকে দেখে অত্যন্ত সহৃদয় ভাবে জিজ্ঞেস করলেন “কিগো এবার কি করবে কিছু ভাবলে?”
জিমি আবার একটু অবাক হয়েই বলল “আমি? আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা, আমি ভাবছি ‘নিউ ইয়র্ক অ্যামালগামেটেড বিস্কুট এবং হুইট কোম্পানি’র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করব।”
জিমির এরম মজার উত্তর শুনে মাইক এতটাই আনন্দিত হল যে, জিমিকে মাইক এর সাথে বসে সোডা ও দুধ খেতে হল। যদিও জিমি হার্ডড্রিঙ্ক খেতে খুব একটা পছন্দ করত না। তাও মাইক এর কথা ফেলতে পারল না।
জিমি ভালেনটাইন ৯৭৬২ এর জেলথেকে ছাড়া পাবার ১ সপ্তাহের মধ্যেই ইন্ডিয়ানা প্রদেশ এর রিচমণ্ড নামক জায়গায় একটা অত্যন্ত নিখুঁত সিন্ধুক চুরির ঘটনা ঘটল, যার ক্ষেত্রে চোরের কোনো সুত্র খুঁজে পাওয়া গেলো না। শেষে ওই সিন্ধুক থেকে অতি অল্প মাত্র ৮০০ ডলার পুনউদ্ধার করা গেলো। এবং এই ঘটনার ঠিক দুসপ্তাহ বাদেই লোগানস্পোর্ট এ একটি উন্নতমানের সত্তপ্রাপ্ত চোর প্রতিরোধক সিন্ধুক ভাঙা হল যেন কেউ সিন্ধুক নয় পনির কেটেছে অত্যন্ত মসৃণভাবে। সেখান থেকে নগদ ১৫০০ ডলার চুরি হয়েছে অথচ সঞ্চয়পত্র, দলীল, রুপোয় হাত পড়েনি। এই দুটি চুরি পরপর হওয়ায় পুলিসদের মন এই চোরের প্রতি আকর্ষিত হল। এরপর জেফফেরসন সিটি তে একটি ব্যাঙ্কের পুরনো ধরনের সিন্ধুক থেকে প্রায় ৫০০০ ডলার নগদ টাকা হটাৎ হাওয়া হয়ে যায়। ক্ষতির পরিমান বাড়তে বাড়তে এতটাই বেশি হয়ে গেছিল যে পুরো বিষয়টা এবার বেন প্রাইস এর তত্ত্বাবধান এ আনবার যোগ্য হিসেবে উপনীত হল। এই তিনটি চুরির যাবতীয় তথ্যাদি পরস্পরের সাথে তুলনা করে একটি আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেলো এর চুরি করার পদ্ধতিতে। বেন প্রাইস নিজে প্রত্যেকটি চুরিরস্থল অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করল। এবং তাকে বলতে শোনা গেলো যে,”এটা জিমি ভালেনটাইন এরই কাজ, এত সৌখিন কাজ অন্য কারোর হতেই পারেনা। সে আবার চুরির কাজ শুরু করেছে। এই কমবিনেশন লকটার দিকে দেখ, বৃষ্টি ভেজা মাটি থেকে মুলো ঠিক যেমন ভাবে তোলে ঠিক ওই ভাবেই অতি সহজে সিন্ধুকের দরজাটিকে ঝাকুনি দিয়ে বের করে নেওয়া হয়েছে। একমাত্র জিমির কাছেই এই ধরনের সাঁড়াশি আছে, যেটা দিয়ে এই কমবিনেশন লকটা এত সহজে তোলা সম্ভব। আর দেখ কত মসৃণ ভাবে সিন্ধুকের এই হুকগুলোকে উপড়ে নেওয়া হয়েছে। জিমিকে কখনই সিন্ধুকের দরজায় একটার বেশি ফুটো করতেই হয়না। হ্যাঁ,আমার যা মনে হচ্ছে আমাদের এখন এই মিস্টার ভালেনটাইন কেই ধরতে হবে। এবার যদি একবার ওকে ধরতে পারিনা…তাহলে আর স্বল্পকালের জন্য জেল বা ওকে ক্ষমা করে দেওয়ার বোকামি হতেই দেবনা।
বেন প্রাইস জিমির অভ্যাস গুলো হাড়ে হাড়ে চেনে। স্প্রিংফিল্ডের ঘটনাটা পর্যবেক্ষণের সময় বেন প্রাইস জিমির এই অভ্যাস গুলি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। বড় বড় লাফ দিয়ে চুরির জায়গা থেকে চটপট পালানো, কোন সঙ্গি না রাখা ও সভ্য সমাজে মিশে থাকার রুচিবোধ। জিমির এই বৈশিষ্ট্য গুলই তাকে সাহায্য করে তার যোগ্য শাস্তি গুলিকে অত্যন্ত নিপুন ভাবে এড়িয়ে চলতে। এবার খবর টা চারিদিকে প্রচারিত হল যে, বেন প্রাইস এই চতুর চোরটিকে ধরার দায়িত্ব নিয়েছেন। যার ফলে যাদের বাড়িতে চোর নিরোধক সিন্ধুক ছিল তারা একটু নিশ্চিন্ত হল।
একদিন বিকেলে জিমি ভালেনটাইন তার সুটকেস নিয়ে রেল ষ্টেশন থেকে তাসের জুয়ারিদের দেশ আরকান্সাস প্রদেশের ছোট একটি শহর এলমোর এ ঘোড়ার গাড়ি চেপে এলো। জিমিকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন কলেজ থেকে সদ্য বাড়ি ফেরা একজন ক্রীড়াবিদ তরুন, সে ফুথপাথের একপাশ ধরে এগিয়ে গেলো একটি হোটেল এর দিকে।
ঠিক সেই সময় এক যুবতী রাস্তা পার করে রাস্তার কোণের দিকে একটা বিল্ডিং এর ভেতর ঢুকে গেলেন যার বাইরে একটা সাইনবোর্ড এ লেখা ছিল “দি এলমোর ব্যাংক”। জিমি ওই যুবতী মহিলাটির দিকে তাকাল, এবং সে ভুলে গেলো সে কে! আর সঙ্গে সঙ্গে একটি সম্পূর্ণ অন্য ব্যাক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। মেয়েটিও সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ নামালো ও তার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কারন এলমোর শহরে জিমির মতন হ্যান্ডসাম যুবক খুব কমই দেখা যায়।
জিমি সেই সময় সেই ব্যাঙ্কের সিঁড়ির ওপর উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেরানো একটা ছেলেকে পাকড়াও করল যে হয়ত ওই ব্যাঙ্কের আশেপাশেই থাকে একজন। জিমি তাকে ওই এলমোর শহর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে শুরু করল, এবং তার মাঝে মাঝে সে তাকে কিছু খুচরো পয়সা হাতে দিতে থাকল। অল্পকিছক্ষনের মধ্যেই যুবতীটি বেরিয়ে এল এবং সুটকেস হাতে যুবকটিকে রাজকীয় উপেক্ষা প্রদর্শন করে নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিল।
জিমি অত্যন্ত ছলনাসহকারে সেই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা ভায়া, উনিই কি পলি সিম্পসন?”
ছেলেটি উত্তর দিল, “না, উনি তো আনাবেল অ্যাডামস। এই ব্যাংকটা তো ওনার পিতারই! আচ্ছা আপনি এখানে এলমোর এসছেন কেন? আচ্ছা তোমার ঘড়ির চেনটা কি সোনার? আমার নাহ একটা বুলডগ কেনার খুব ইচ্ছা ! আচ্ছা দাদা যদি আর কিছু খুচরো পয়সা থাকে তো... ”
জিমি এলমোর শহরের প্লান্তার’স হোটেল এর দিকে গেল, সেখানে সে তার নাম রালফ দি স্পেন্সার নামে নথিভুক্ত করল ও একটা ঘর বুক করল। সে সেই হোটেলটার রিসেপশান এ ঝুঁকে হোটেল এর কেরানি কে তার এলমোর শহরে আসার কারনটা ইচ্ছে করেই বলতে লাগলো। সে বলল, সে এলমোর শহরে এসেছে এটা দেখার জন্য যে এখানে বাবস্যার ভালো কোনো সুযোগ আছে কিনা। সে জিজ্ঞেস করল সেই কেরানিটিকে যে, “আচ্ছা এখানে জুতোর বাবস্যার কেমন অবস্থা? আমি ভাবছি একটা জুতোর দোকান খুলবো। কি মনে হয়…চলবে?”
হোটেলের এই কেরানিটাও কিন্তু জিমির পোশাক-আশাক ও ব্যবহার, আচার-আচরন দেখে বেশ মুগ্ধই হয়েছিল। এলমোর শহরে যেকটা কমসংখ্যক যুবককে স্টাইলিশ ফ্যাশানেবেল বলা যায় কেরানিটা নিজেকে তাদের মধ্যেই একজন বলে গণ্য করত কিন্তু এবার জিমি কে দেখে সে তার ত্রুতি গুলি ভাল করে অনুধাবন করতে পারল। জিমি কিভাবে তার টাইটাকে বেঁধেছিল সেটা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতেই কেরানিটি খুব আন্তরিক ভাবে জিমির যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকল।
কেরানিটি আবার বলল, “হ্যাঁ, এই শহরে জুতোর বাবস্যা ভালো চলতে পারে। এই এলমোর শহরে শুধুমাত্র জুতোর দোকান বলতে কোনো দোকান নেই। এখানে মুদিখানা দোকান বা এমনি সাধারণ মালপত্রের দোকান গুলোতেই জুতো বিক্রি করে। সবদিক দিয়ে লক্ষ্য করলে এলমোর শহরে জুতোর বাবস্যা বেশ ভালো চলতে পারে কিন্তু।” তাছাড়া সে এও আশা প্রকাশ করল যে, মিস্টার স্পেন্সার যেন এলমোর শহরে থাকার বিষয়ে বিবেচনা করেন। তিনি আশা করেন মিস্টার স্পেন্সার নিশ্চয়ই এলমোর শহরটিকে মনোরম ও বাবস্যা যোগ্য একটি শহর হিসেবে পাবেন এবং তিনি এও দেখবেন যে এই শহরের সকলে কতটা মিশুকে ও সামাজিক।
মিস্টার স্পেন্সার কেরানিটিকে বললেন, “আমি ভাবছি যে এখানে কিছুদিন থাকব আর এই শহরে বাবস্যা করার বিষয়টা ভালো করে বিবেচনা করে দেখব। আর আপনাদের কাউকে ডাকার দরকার নেই, সুটকেস টা আমি নিজেই তুলে নিয়ে যাচ্ছি আসলে এটা প্রচণ্ড ভারী তো তাই।”
মিস্টার রালফ স্পেন্সার আসলে একটা ফিনিক্স পাখির মত, যিনি এলমোর শহরে এসে নতুন এক প্রেমের অনুভুতিতে পুনরায় জীবিত হয়ে উঠলেন জিমি ভালেনটাইনের ভস্ম থেকে এবং জীবনে উন্নতি করতে থাকলেন। এলমোর শহরে তিনি একটি জুতোর দোকান খোলেন এবং খুব ভালো ভাবে বাবস্যা করতে থাকেন।
সামাজিক দিক দিয়েও তিনি কিন্তু এই শহরে বেশ ভালো সমৃদ্ধি ও নাম করেন, এবং নতুন অনেক বন্ধু বানালেন। এবং ইতিমধ্যে তিনি তার হৃদয়ের ইচ্ছেটিও চরিতার্থ করতে পেরেছিলেন। এতদিনে তার আনাবেল অ্যাডামসের সাথেও দেখা হয়েছে জড়িয়েও পড়েছে তার সাথে এবং ধীরে ধীরে তার চারিত্রিক মাধুর্যে আরও বিধুর হয়ে গেছেন।
যথারীতি একটি বছর কেটে যাওয়ার পর, এলমোর শহরের সমাজে মিস্টার রালফ স্পেন্সার একটি বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যাক্তি হয়ে ওঠেন। তার জুতোর দোকানও বেশ ভালোই চলতে থাকে। এবং দু সপ্তাহের মধ্যেই তার এবং আনাবেল অ্যাডামস এর বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা ঠিক হয়ে যায়। মিস্টার অ্যাডামস, একজন অতি সাধারন ও অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন ব্যাংককর্মী তিনি, মিস্টার স্পেন্সারকে তার জামাই হিসেবে মেনে নেন। এবং আনাবেলও যেমন তাকে খুব ভালবাসত তেমনি তাকে নিয়ে খুব গর্বও করত। ইতিমধ্যেই সে মিস্টার অ্যাডামস এবং আনাবেলের বোনের পরিবারের সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে পরেছিলেন যে তিনি যেন বহুদিন থেকেই ওনাদের পরিবারেরই একজন।
একদিন জিমি তার ঘরে বসে, একটা চিঠি লিখলো এবং পাঠিয়ে দিল সেন্ট.লুইস এর এক পুরনো বন্ধুর নিরাপদ ঠিকানায়।
প্রিয় বন্ধু,
আমি চাই তুমি আগামী বুধবার রাত নটার সময় লিটিল রকের সুলিভানে'র জায়গায় একটু দেখা করো। আমি তোমার সাথে কিছু পুরোনো বিষয় নিয়ে দুজনে সামনাসামনি বসে মিটমাট করে নিতে চাই এবং একইসাথে আমি তোমায় আমার যাবতীয় যন্ত্রপাতি গুলি তোমায় উপহার দিতে চাই। আমি জানি এগুলো তুমি পেলে অত্যন্ত খুশিই হবে, কারণ প্রায় হাজারখানেক ডলার খরচ করেও তুমি ওইগুলোর ডুপ্লিকেট বানাতে পারবে না। আসলে আমি আমার পুরনো ব্যবসা প্রায় এক বছর আগেই ছেড়ে দিয়েছি। আমার এখন একটা সুন্দর জুতোর দোকান আছে। আমি এখন অত্যন্ত সৎ- পথে জীবন যাপন করছি এবং আগামী দু'মাসের মধ্যেই পৃথিবীর সুন্দরতম একটি মেয়েকে আমার জীবন সঙ্গিনী রূপে পেতে চলেছি। আসলে বিলি জানতো, এই হচ্ছে আসল জীবন, সোজা সরল ভাবে বাঁচা।
এখন কেউ আমায় এক মিলিয়ন ডলার দিলেও অন্য কারোর একটি ডলার স্পর্শ করব না অনৈতিকভাবে। তাছাড়া আমি ভেবে রেখেছি, বিয়ের পর ব্যবসা-পত্র সব বেচে দিয়ে পশ্চিমে চলে যাবো যেখানে আমার পুরনো অপরাধের কারণে আমার জীবনে নতুন করে কোনো বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি হতে না পারে। সত্যি বলছি বিলি, সে যেন এক দেবী-অপ্সরীর মতো। সে আমাকে খুব বিশ্বাস করে। তাই সারা পৃথিবী বললেও আমি আর এই জীবনে কোনো খারাপ কাজ করবো না। আশা করি তুমি আমার সাথে সুলিভানের জায়গায় দেখা করবে আমি আমার সাথে আমার পুরনো যন্ত্রপাতি গুলিও নিয়ে আসবো।
-তোমার প্রিয় বন্ধু,
জিমি।
সেই রাতেই বেন প্রাইস সকলের নজর এড়িয়ে, তার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে এলমোর শহরে প্রবেশ করে। সে কদিন খুব ধীরে সুস্থে শান্তিতে শহরের চারিদিকে ঘুরে বেড়ালো। যতক্ষণ না সে জানতে পারল যেটা সে জানতে চাইছিল। রালফ ডি স্পেন্সার ওরফে জিমির জুতোর দোকানের বিপরীতে সে একটি ঔষধ দোকানের ভেতর থেকে খুব মন দিয়ে জিমির জুতোর দোকান টি পর্যবেক্ষণ করল।
তার পর সে সেই দোকান থেকে বেরিয়ে এসে মনে-মনে ব্যঙ্গ করে ভাবল, "জিমি তুমি নাকি এক ব্যাংকারের মেয়েকে বিয়ে করছো!....অন্য কোনো মতলবে নয়তো?....তা দেখা যাক কি হয়।"
পরের দিন সকালে জিমি মিস্টার অ্যাডামসের বাড়িতে তাদের পরিবারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাতরাশ সেরে নিজের বিয়ের জন্য নতুন শুটটা অর্ডার দিতে এবং অ্যানাবেল এর জন্য কিছু গিফট কিনতে লিটিল রকের দিকে রওনা দিলো। এলমোর শহরে আসার পর, এটাই তার প্রথম বার যে সে ওই শহর ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে।
প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে সে তার চুরি ছেড়ে দিয়েছে। তাই এখন জিমি মনে করে যে, সে এখন নিরাপদেই এলমোরের বাইরে যেতে পারে।
ব্রেকফাস্টের পরে সপরিবারে অ্যানাবেল অ্যাডামস ও জিমিরা ডাউনটাউন এর দিকে একটি বড় পার্টিতে গেল। যাদের মধ্যে ছিল মিস্টার অ্যাডামস, অ্যানাবেল, জিমি এবং অ্যানাবেল এর বিবাহিত বোন সাথে তার দুই ছোট ছোট মেয়ে, একজন পাঁচ ও অপরজন নয় বছরে। তারা সেই হোটেলের সামনে এলো যেখানে জিমি তখনও বসবাস করত। তাড়াতাড়ি জিমি দৌড়ে গেল তার ঘরে এবং তার সুটকেসটি নিয়ে নেমে চলে এলো। তারপর সবাই মিলে গেল এলমোর ব্যাংকে। ওখানে ব্যাংকের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল জিমির ঘোড়ার গাড়ি ও তার চালকের ডলফ গিবসন।যে তাকে রেলস্টেশনে ছেড়ে আসবে।
সবাই সেই উঁচু খোদাই-করা ওক গাছের কাঠে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে ব্যাংকে প্রবেশ করল সাথে জিমিও। কারণ সবাই প্রায় জানতো যে, মিস্টার অ্যাডামসের হবু-জামাই জিমিই হবে। ব্যাংকের সমস্ত কেরানীরা কিন্তু ভীষণভাবে প্রসন্ন হয়েছিল এটা জেনে যে, জিমির মতো এক হ্যান্ডসাম,সফল যুবকের সাথে মিস অ্যানাবেল এর বিয়ে হতে চলেছে। জিমি তার স্যুটকেসটা হাত থেকে নামিয়ে রাখল। অ্যানাবেল যার হৃদয়ে তখন প্রাণবন্ত যৌবন এবং খুশি টকবক করে ফুটছিল সে জিমির টুপিটা নিজে পড়ে নিল ও তার স্যুটকেসটা তুলে নিল। অ্যানাবেল জিমিকে মজা করে জিজ্ঞেস করল, "এই আমাকে কি এক সুন্দরী ড্রামার এর মতো লাগছে? উফ, রালফ! কি ভারী এই স্যুটকেসটা মনে হচ্ছে এটা যেন সোনার ইট এ ভর্তি।
জিমি উত্তরে বলল, "না...না আসলে ওর মধ্যে অনেকগুলো নিকেলের শু-হর্ন রয়েছে যেগুলো আমি আজ নিজে ফেরত দিতে যাচ্ছি। ভাবলাম যদি আমি নিজেই ওগুলো ফেরত দিয়ে আসি, তাহলে অনেকটা বহন খরচ বাঁচাতে পারবো। আসলে আমি এখন একটু একটু করে হিসেবী হওয়ার চেষ্টা করছি।
এলমোর ব্যাংকে এই কিছুদিন আগেই একটি নতুন সিন্দুক আলমারি আনা হয়েছে মিস্টার অ্যাডামস তার এই সিন্ধুক নিয়ে বড় গর্ববোধ করেন এবং সবাইকে একটু জোর করেই অনুরোধ করেন তারা যেন ওই সিন্ধুকটা একটু ভালো করে দেখে আসেন। ব্যাংকের সিন্দুকটা ছিল, একটু ছোট কিন্তু তার দরজাটা ছিল একটু নতুন ধরনের ও চুরি নিরাপদ। যার দরজাটা আটকে যেত নিরেট স্টিলের তৈরি তিনটি হুরকো দ্বারা। যেগুলি একসঙ্গে বন্ধ করা যেত বাইরে একটি মাত্র হ্যান্ডেল দিয়েই। এর সাথে একটি টাইম লকও যুক্ত করা ছিল। মিস্টার অ্যাডামস অত্যন্ত উদ্ভাসিত ভাবে সিন্দুকের দরজার কার্যকারিতা মিস্টার স্পেন্সার কে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতে থাকলেন। অথচ মিস্টার স্পেন্সার অ্যাডামসের কাছে এই ব্যাখ্যা শুনে খুব একটা অবাক হলেন না, বরং খুবই ভদ্র এবং বিনয়ীভাবে দেখতে থাকলেন সিন্দুকটিকে। অ্যানাবেল এর বোনের দুই মেয়ে, মে এবং আগাথাও সিন্দুকের চকচকে ধাতুর দরজা এবং মজাদার ঘড়ি তালা দেখে খুবই খুশি হয়েছিল।
যখন তারা কথা বলতে ব্যস্ত ছিল, সেই সময় বেন প্রাইস ধীরে ধীরে ব্যাংকে প্রবেশ করল এবং চুপচাপ ব্যাংকের এক কোণে কনুইয়ে ভর দিয়ে হেলে দাঁড়ালো। তারপর সাধারণভাবেই রেলিং এর মধ্যে দিয়ে ব্যাংকের ভেতরে দিকে তাকালেন। ভেতরে ঢুকতেই ব্যাংকের ক্যাশিয়ার তাকে, "কি প্রয়োজন?" জিজ্ঞেস করাতে, উনি বললেন, "না আমার কিছু প্রয়োজন নেই আসলে আমি শুধু আমার এক পরিচিত ব্যক্তির জন্য এখানে অপেক্ষা করছি।"
ইতিমধ্যে হঠাৎ করে সেই ব্যাংকের ভিতর থেকে দুটি মহিলার সজোরে চিৎকার শোনা গেল এবং তারপরেই ভেতরে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। সবার অলক্ষ্যে ওই নয় বছরের বাচ্চা মেয়েটি মে, তার বোন আগাথা কে খেলার ছলে সিন্দুকের ভেতরে আটকে ফেলেছে। তারপর সে ওই সিন্দুকের হুরকো গুলো আটকে কম্বিনেশন লকটাও ঘুরিয়ে দিয়েছে যেমনটা সে মিস্টার অ্যাডামস কে করতে দেখেছিল।
সেই বৃদ্ধ ব্যাংকার লাফিয়ে গিয়ে, সিন্দুকের হ্যান্ডেলটা ধরে কিছুক্ষণ খুব জোরে টানাটানি করতে লাগলেন। তারপরে যন্ত্রণাকাতর গলায় ঘুমিয়ে বলে উঠলেন, "দরজাটা তো খোলা যাবে না, কারণ ঘড়িতে টাইম সেট করা হয়নি তাই কম্বিনেশন নব-ও সেট হয়নি।"
আগাথার মা অত্যন্ত ভয়ে আতঙ্কে সাথে চিৎকার করে উঠলেন। মিস্টার অ্যাডামস তার কম্পনরত হাত আগাথার মায়ের দিকে তুলে বললো,"এই তোমরা চুপ করো... আমায় একটু ভাবতে দাও"
তারপর তিনি যতটা জোরে চিল্লানো সম্ভব চিল্লিয়ে আগাথার উদ্দেশ্যে বললেন,"মা,একটু শান্ত হয়ে চুপ করে ভেতরে বসো বলছি... আমার কথা শোনো...ভয় পেয় না" তারপরে নিরবতার মুহূর্তে বাইরের সকলে শুনতে পেল অস্পষ্ট মৃদু শীৎকারের আওয়াজ যেটা সেই বাচ্চাটা অন্ধকার সিন্দুকের ভেতরে ভীত অবস্থায় করছে।
আগাথার মা অত্যন্ত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা কাঁদা গলায় বলে উঠলেন, "কিছু একটা করো... দরকার হলে দরজাটা ভেঙে ফেলো নাহলে আমার ছোট্ট মেয়েটা তো ভেতরে আতঙ্কে ভয়েই মারা যাবে... তোমার লোক গুলো কি কিছু করতে পারবে না"
মিস্টার অ্যাডামস অত্যন্ত কাঁপা গলায় বললেন, "লিটল রক এর আশেপাশে এমন কোন লোক নেই যে এসে এই দরজাটা খুলতে পারে... স্পেনসার, কি করা যায় বলোতো! তাছাড়া একটা বাচ্চা কি করে ওই সিন্দুকের মধ্যে এতক্ষন থাকতে পারবে কারণ এই সিন্দুকের ভেতরে যথেষ্ট পরিমান বাতাস নেই। আর এই চূড়ান্ত আতঙ্কে অন্ধকারে তার তো খিঁচুনি চলে আসতে পারে।"
এবার আগাথার মা প্রায় উন্মাদের মতো সিন্দুকের দরজার উপর সজোরে আঘাত করতে লাগলেন। এই সময় পেছন থেকে কেউ একজন অত্যন্ত নির্বোধের মতো বলল, "আচ্ছা, ডায়নামাইট ব্যবহার করা যায় তো?...দরজা ভাঙার জন্য"
অ্যানাবেল জিমি র দিকে বেদনা গ্রস্থ চোখে ফিরে তাকাল কারণ, এখনও সে মনে করে যে সে যাকে ভালবাসে তার কাছে অসাধ্য বলে কিছুই নেই। জিমি কিছু না কিছু একটা উপায় বের করবেই। তারপর জিমিকে বললো, "আচ্ছা রালফ, তুমি কিছু করতে পারবে না! একটু চেষ্টা করো না প্লিজ"
জিমি অ্যানাবেল এর দিকে তাকালো একটু উৎসুক চোখে এবং মুখে এক কোমল হাসি নিয়ে।
তারপর জিমি বললো, "অ্যানাবেল তুমি যে গোলাপটা জামায় লাগিয়ে রেখেছো ওটা কি আমায় একটু দিতে পারবে?"
এনাবেল বিশ্বাসই করতে করতে পারছিল না যে সে ঠিক শুনছে কিনা! সে তার জামা থেকে গোলাপের কুড়ি টা খুলে জিমির হাতে দিলো। জিমি ঐ ফুলটি নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে দিলো। তারপর সে তার সুটকেসটি তুলে নিল এবং নিজের জামার হাত গুটিয়ে ফেলল। এটা করার সাথে সাথে মিস্টার রালফ ডি স্পেনসার এর গল্প সমাপ্ত হল এবং জিমি ভ্যালেন্টাইন তার স্থানে ফিরে এল।
সে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সুরে আদেশ করল, "তোমরা সকলে প্লিজ একটু দরজা থেকে সরে দাঁড়াও।"
তারপর সে তার স্যুটকেসটা খুলে টেবিলে বিছিয়ে রাখলো। এরপর থেকে সে ওই ব্যাংকে উপস্থিত বাকিদের উপস্থিতি উপেক্ষা করে নিজের কাজ করতে শুরু করলো।
সে তার অদ্ভুত চকচকে যন্ত্রপাতিগুলি এক এক করে বিছিয়ে রাখল বেশ দ্রুত এবং সুশৃংখলভাবে। তারপর যেমন ভাবে সে প্রত্যেকবার কাজ করার সময় মৃদুভাবে শিস্ দিতে থাকে তা দিতে থাকলো আপন-মনে। প্রত্যেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকে কাজ করতে দেখে দেখতে থাকলো যেন তারা জাদু বদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
এক মিনিটের মধ্যেই জিমির সেই তুরপুন যন্ত্রটি মসৃণভাবে সিন্দুকের দরজাটা ফুটো করে ফেলল।
দশ মিনিটের মধ্যে সে তার আগের সব চুরির রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সিন্দুকের হুড়কোগুলো খুলে দরজা টাকে খুলে ফেলল।
আগাথা যে কিনা তখন প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিল। জিমি তাকে নিরাপদে তার মায়ের কোলে তুলে দিল।
জিমি ভ্যালেন্টাইন তার কোটটা আবার পড়ে নিয়ে ব্যাংকের সিড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। যখন সে চলে যাচ্ছিল, তার মনে হলো পেছন থেকে অত্যন্ত ধীরগতিতে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে "রালফ...রালফ...দাঁড়াও!" কিন্তু জিমি আর পিছনে দিকে ফিরে তাকালো না। যখন সে বেরিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ এক বড়োসড়ো চেহারার লোক তার সামনে এসে দাড়ালো।
জিমি তার অদ্ভুত হাসি নিয়ে বললো, "হ্যালো বেন শেষ পর্যন্ত দেখা হয়ে গেল। ঠিক আছে চল তাহলে যাওয়া যাক। আমার তো মনে হয় না যে তোমার সাথে যাওয়াটা আর আমার জীবনে নতুন কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে বলে।"
তখন বেন প্রাইস একটু অদ্ভুত ভাবে আচরণ করলেন তিনি বললেন,"মিস্টার স্পেন্সার আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে, আমার তো মনে হয় না আমি আপনাকে চিনি বলে। আপনার ঘোড়ার গাড়িটা বাইরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে তাই না! এরপরে বেন প্রাইস পেছন ফিরে রাস্তা দিয়ে হেটে তার গন্তব্যের দিকে রওনা দিল।
বঙ্গানুবাদ : সৈকত সেনাপতি
©Listeners Choice
Association With ©Barthopion
সকালবেলার ফোনের অ্যালার্ম যখন বেঁচে ওঠে, জানলা দিয়ে একসারি অশ্বত্থ গাছের পাতার পিছনে ডালিম রঙের আকাশ দেখা যায়। দিনটা শুরু হয়ে যায় নিয়মমাফিক।
সকালে স্কুলের জন্য রেডি হতে হতে ওদিকে থেকে রান্না ঘরে থাকা মায়ের আওয়াজ ভেসে আসে রোজকার মতো,
"দীপু লাঞ্চবক্সটা নিতে ভুলিস না, তাড়াতাড়ি কর, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে রে। আজ একটা মিটিং আছে।"
মা এখনও ওর জামা প্যান্ট বেছে দেয়। ওই নিয়ে ঝগড়াও বাধে মাঝে মাঝে। নিজের হাতে ওর মা লাঞ্চবক্স রেডি করে ব্যাগে পুরে দেয় প্রতিদিন।
মায়ের অফিসের পথে ওর স্কুল টা পড়ে। তাই, মায়ের গাড়িতেই ও প্রায়ই স্কুলে যায়। মা সারা রাস্তা অনেক ভালো ভালো কথা বলেন। যার একটাও দিপু মশাইয়ের কানে ভেসে যায় না। মা বাংলা গান চালায় গাড়ির মিউজিক প্লেয়ারে, যদিও সেগুলি বেশিরভাগই তবে তার মধ্যে একটা সুর কানে লেগে থাকে। যেমন আজ স্কুলের করে ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওর মাথায় একটা সুর উঁকি মেরে যাচ্ছে," আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও"
ওর ভালো নাম দীপ্তজিৎ। মা সবসময় বলে সকাল হোক বা সন্ধ্যে দীপের মত আলো দেওয়াই ওর কাজ। রোজ সকালবেলা ও মেঘেঢাকা সূর্যের মত ঘুম থেকে ওঠে, ব্যাগটা টেনে নিয়ে স্কুলের গেটের সামনে এসে নামে। পিছনে মায়ের এক ঝাঁক কথা তারা করে আসে। ও রোজ একদম না মাথা ঘামিয়ে, চলে যায় স্কুলের দিকে। অথচ একটু পরেই ঘুম পালিয়ে গিয়ে ও হাই স্কুলের সিনিয়র দীপ হয়ে উঠবে। মন থেকে বাংলা সুর উবে গিয়ে অন্য সুরের ঢেউ উঠবে তখন।
"হাই দীপ, উইকএন্ড কেমন কাটলো?" হাসি আর কলতান মেশানো একটা রঙিন হিন্দোল ওর সামনে দিয়ে চলে গেল। মেয়েদের একটা দল ক্লাসের দিকে যাচ্ছে।এতক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প করেছিল। তার মধ্যে যে মেয়েটির ফিরে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিত এবং চুলের ঝাপটায় এই মুহূর্তে ওকে বিদ্ধ করে চলে গেল, তার নাম সোনিয়া। সোনিয়া পাঠক। সংক্ষেপে সোনু। সঙ্গে সঙ্গে দীপের সব ঘুম উধাও।
[ও হ্যা, আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, যে একি ছেলেদের স্কুলে মেয়ে কোথা থেকে এল! আসলে দীপু যে স্কুলে পড়েন সেটি কো-এড স্কুল, নাম কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুল।]
-"সোনু, শোন... সোনু"
সোনু দাড়ালো না, কিন্তু ক্লাসে ঢুকে যাওয়ার আগে একবার ফিরে তাকাল। ওর গাঢ় বাদামি চোখের তারায় রহস্য আর কৌতুক মেশানো এক ঝলক হাসির বিদ্যুৎ খেলে গেলো আবার। ওর ঠোঁট নড়ে উঠল, কিন্ত শব্দেরা অনুচ্চারিত। দীপ বুঝতে পারল না ও কি বলল। মাথার মধ্যে আগ্নেওগিরি আর বুকের ভেতর ভূমিকম্প সামলাতে সামলাতে ও নিজের ক্লাসে ঢুকে গেল। গত শুক্রবার বিকেল থেকেই ওর এইরকম দশা। ওরা দুজন আলাদা বাসে বাড়ি যায়। তবে তার আগে কথা বলতে বলতে সোনুকে বাস অবধি এগিয়ে দেয় দীপ। এটা বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছে।
সেদিন সোনুর বাস ছাড়বে ছাড়বে করছে। বাকি ছেলেমেয়েরা সবাই বাসের ভেতর। কি একটা বলতে গিয়েও, ও থমকে গিয়েছিল। তারপর বোমা ফেলার মতো ছুঁড়ে দিলো প্রশ্নটা, "সোনিয়া তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে, তুমি কি আমার গার্লফ্রেন্ড হবে"
অনেকদিন ধরে চেপে রাখা আবেগের বিস্ফোরণ হঠাৎ নাকে সুড়সুড়ি লাগানো বেখাপ্পা হাসির মতো দুম করে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু প্রেম নিবেদন করার জন্য এর চেয়ে খারাপ সময় বোধহয় আর হয় না। একহাতে বিকেলের রোদ্দুর আড়াল করে সোজা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল সোনিয়া। ওর মুখের ভাব যাচ্ছিল দ্রুত। দীপ তখন নার্ভাস হতে হতে প্রায় চোখে অন্ধকার দেখছে।
-বাহ্, খুব ভালো সময় প্রশ্নটা করেছ তো! দেড় মিনিট পর বাস ছাড়ছে, চারিদিকে লোকজন।
-"মানে,... তোমাকে এক্ষুনি কোন উত্তর দিতে হবে না। সোমবার বলো না হয়। পরিস্থিতি সামলে নেবার জন্য শেষবার একটা মরিয়া চেষ্টা করলো দীপ।
-"ওহ্ তাড়া নেই বুঝি? বেশ তাহলে সোমবারই বলবো, বাই!"
আর দাঁড়ায়নি সোনিয়া, ঢেউয়ের মাথায় পালতোলা নৌকার মতো সাবলীল ভঙ্গিতে চলে গেল বাসের দিকে।
দিপু পারলে তখন নিজের গালে থাপ্পর কষিয়ে লাল করে দেয়। তারপর সারা উইকেন্ডে এক গুচ্ছ হোয়াটসঅ্যাপ টেক্সট চলাচলি হয়েছে। তবে সোনুর সেই পিছলে যাওয়া উত্তর," এসব কথা ফোনে বলা যায়না, ভাবছি সোমবার লাঞ্চের সময় বলব।... তুমিই তো বললে তাড়া নেই… তোমার কি মনে হয়? ইত্যাদি…"
যতই রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে সোনিয়া, ততই দীপ নিজেকে বোকার হদ্দ বলে মনে মনে গালাগালি দিয়ে চলেছে। শেষ অব্দি অন্ধকার রাতের বৃষ্টি ঝরে পড়ার মতো অপেক্ষা, আশঙ্কা, প্রতীক্ষা চলে যাচ্ছে ওর মনের গহনে। সারারাত ঘুমোতে পারেনি একদিনও।
অবশেষে আজ সেই ভয়ঙ্কর সোমবার। আর কয়েক ঘন্টা পর লাঞ্চ ব্রেক। কোথায় দেখা করা যায়? ক্যান্টিনে ঢুকে হয়তো দেখবে সোনু অভ্যাসমতো ওর বন্ধুদের সাথে লাঞ্চ করছে। ওই মেয়েদের দলের মাঝে গিয়ে ওদের সামনে সোনুর উত্তরের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে নানা চিন্তা মনে দৌড়াদৌড়ি করে চলেছে।
লাইব্রেরীর এক কোনায় S.N.DEY বইটা নিয়ে অঙ্ক করতে বসল দীপ। অঙ্ক করাতে একটা আরাম আছে। অঙ্ক সোজাসুজি তোমায় চ্যালেঞ্জ করে, তাই সোজাসুজি তার মোকাবিলা করা সম্ভব। আসলে ছেলে হয়ে জন্মানোটাই বড় সমস্যা। অংকের দুনিয়ায় ছেলে-মেয়ের তফাৎ নেই। সেখানে তাই জন্য সব স্পষ্ট ও পরিষ্কার। মানুষ যদি স্যালাম্যান্ডার হত, আর দরকার মতো যদি পারতো ছেলে বা মেয়ে হতে তাহলে পৃথিবীতে কোন সমস্যাই থাকতো না। আচ্ছা সোনু যদি পাত্তা না দেয়! কি এমন ক্ষতি হবে? একদিকে ভালোই হবে। কলেজে গিয়ে ঝাড়া হাত-পা। সেখানে আরো নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গে আলাপ। তার ওপর স্বাধীনভাবে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি, হৈ-হুল্লোড় তো আছেই। কি দরকার পিঠে বেঁধে পুরোনো গার্লফ্রেন্ড বয়ে নিয়ে আসার?
ওদিকে সোনিয়ার পিছনে ওই সায়ক ছেলেটাও লেগে আছে। দীপ যদিও পড়াশুনায় বেশ ভালো, তবে সায়কের লম্বা চওড়া জিম করা বডি, তারপর আবার ফুটবল প্লেয়ার। আবার দুজনেই বেশ ফর্সা, হাজার হোক দীপ যে বাদামি চামড়ার ছেলে।
না... না, কি সব ভাবছে। সোনু মোটেই এইরকম ধরণের ভাবুক মেয়ে নয়। কী ভাবছে না দীপটা,ধুর! মেয়েদের কথা চিন্তা করার মানেই সব নিয়ম, সমীকরণ সব গুবলেট হয়ে যাওয়া। লাইব্রেরির জানালা দিয়ে খেলার মাঠটা দেখা যায়। ঝকঝকে একটা হেমন্তের দিন, কয়েকদিন পরই স্কুলের পালা শেষ হয়ে যাবে। তবে এই স্কুলটাকে সকলেই খুব মিসস করব। এই স্কুলের সুন্দর ক্যাম্পাসটা,সব টিচারদের,সব বন্ধুদেরকে। সোনুকে আর একটু আগে থেকে ডেট করলে ভাল হত। কিন্তু আমার বাবা মা তো ডেটিং এর কথা শুনলেই আঁতকে ওঠেন। সোনুর তো আরও কে কে সব বয়ফ্রেন্ড ছিল।…..তারা এখন কলেজে পড়ে যদিও।
এই আবার সোনুর কথা ভাবছে ও !! আবার, নাহ্ এইভাবে আর পারা যায় না। বইটা বন্ধ করে টেবিলে রেখেই এক ঝটকায় উঠে পড়ল দীপ। জবাবটা এক্ষুনি পাওয়া দরকার। তা সে, যেভাবেই হোক না কেন।
দুর্দাড় করে ক্লাস লাইব্রেরী থেকে বেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। দরজার ঠিক ডানদিকে একটা বেঞ্চে বসে সোনিয়া পা দোলাচ্ছে। ওর গায়ে হেমন্তের পাতার মতো স্প্যাগেটি টপ জামা। আর একটা খাটো জিন্স প্যান্ট।
সোনিয়ার মুখের গঠন খানিকটা ব্রুনেট জাতীয়, ইতালিওদের মতো। ভরাট ওষ্ঠ আর উচু। ঘন পাতার আড়ালে ওর চোখের রং হালকা বাদামি, আর ওর চোখের দৃষ্টি মেঘলা দিনে কানায় কানায় ভরা পুকুরের মত। কালো রঙের চুল গুচ্ছেরা শোভন ছন্দে নেমে এসেছে ওর কাঁধে ও পিঠে। গায়ের রং ফ্যাট - ফ্যাটে সাদার বদলে হালকা তাম্রভ অথচ উজ্জ্বল, সারা শরীরে স্বাস্থ্যও কামনীয়তার এক নিখুঁত সামঞ্জস্যতা আছে। হাতে একটা কালো সানগ্লাস। আজ ও স্কুলে আসেনি, শরীরটা নাকি খারাপ ছিল সকালের দিকে তাই আর আসেনি। তবে ও কি শুধু দীপের জন্য আজ এসেছে! ওর প্রশ্নের উত্তরের জন্য? কি বলবো ও?.....
-"চলো", ছোট্ট একটা কথা বলে এবার হাটা দিয়েছে সোনু।
-"কোথায়", বোকার মত প্রশ্নটা না করেও পারলো না দীপু।
ওদিক থেকে কোন উত্তর নেই। খেলার মাঠের পাশ দিয়ে গিয়ে মাঠ ছাড়িয়ে যে জায়গাটা পড়ে, ওইখানটায় বেশ নিরিবিলি একটা বেঞ্চ আছে। একদিকে নিম গাছের সারি, তার ঝরে যাওয়া লাল ও হলুদ রঙের পাতা ঝরে পড়ছে রাস্তার উপর। এই দুপুরবেলাতেও যেন ঘাসটা ভিজে , খেলার মাঠ সম্পূর্ণ ফাঁকা প্রায়। বাতাসে একটা অতি মৃদু আরামদায়ক ঠান্ডা তার ওপর হেমন্তের মেঘ-রোদ্দুরের উষ্ণতা জড়ানো।
-"আমার মনে হয় তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এই জায়গাটা মন্দ নয়! অন্তত বাস স্টপ বা ক্যানটিন এর চেয়ে ঢের গুনে ভালো। তুমি রেডি? সোনুর চোখে হাসি আর দুষ্টুমি খেলা করছে। দীপের মুখে কথা জগুলো না। ঠোঁট এখন প্রায় মরুভূমির মতো শুকনো।
এই সময় এক পা এগিয়ে এসে সেই শুকনো ঠোঁটের মধ্যে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো সোনু। ওর ঠোঁটের আর্দ্রতায় শিউরে উঠল দ্বীপের মরুভূমি। নিঃশ্বাস ফেলে সাড়া দিয়ে উঠল স্নায়ুগুলো।
-"আই লাভ ইউ সোনু"
-"আমি জানি এতদিন পরে সাহস হল তোমার বোকা ছেলে"
স্কুল বাস গুলো একা একাই স্কুলের পাশের রাস্তা দিয়ে যে যার রুটে চলে গেল। ভাগ্যিস আজ ওর বাসে ওঠার কোনো তাড়া নেই। এমন একটা ঘটনা ঘটার পরেও গাছের ছাড়া কিন্তু দীর্ঘতর হয়েই চলেছে ক্রমশ। ওরা দুইজন মাঠের পাশে বেঞ্চের ওপর পাশাপাশি হাতে হাত রেখে বসে আছে, দুজনেরই দৃষ্টির সামনে দূর বিস্তৃত সূর্যের ক্ষীণ আলোর দিকে।
দীপ একবার তাকিয়ে ঘড়িটা দেখে নিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার খুব রাগ হলো। ইচ্ছে হলো ওটাকে ছুড়ে ফেলে দিতে। চলমান সময়কে ও ডেকে বলতে চাইল, "শোনো,আজকে আমাদের দুজনের কোথাও যাবার নেই বুঝলে! ওহে আদ্দিকালের সময়। এক কাজ করো তুমিও এই সুযোগে বরং একটু জিরিয়ে নাও।"
লিখনে~ সৈকত সেনাপতি
© Bartho Pionদুপুর ১.২০ এর দুরন্ত এক্সপ্রেস এসে থামল যথারীতি এক ঘন্টা লেট করে শিয়ালদহ স্টেশনে।
প্লাটফর্মের লোকজন ভিড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে, আর তাদেরই মাঝে শুভম যাহোক করে একটা ব্যাগ প্যাক আর ট্রলি নামালো বেশ খানিকটা যুদ্ধ করেই।
পাঁচ বছর পর শুভম ফিরে এসেছে কলকাতায়। সেই যে পাঁচ বছর আগে ছেড়ে গিয়েছিল প্রাণের শহরটাকে প্রথমে কোটা, তারপর IIT ক্রাক করে কানপুর। তারপর কত কত কফি দিয়ে ঘুম তাড়িয়ে গোলা-ভাত, হলুদ জল-ডাল, নুনে-পোড়া তরকারি খেয়ে কাটাতে হয়েছে এতগুলো বছর। এখন শেষ পর্যন্ত কলকাতায় একটা চাকরি পেয়ে বাড়ি ফেরা হলো।
বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে প্রায় পাঁচ বছর আগের সেই দিনটার কথা। jee mains এ তিন লাখে রাঙ্কিং করা শুভম অধিকারী কে কোটাতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তার বাবা প্রশান্ত অধিকারীর মত ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হওয়ার জন্য।
সেখানে যেতে চায়না শুভম, জীবনে মাকে ছেড়ে থাকেনি কখনো মায়ের আঁচল চেপে অঝোরে কাঁদছে। ওদিকে ইঞ্জিনিয়ার বাবা ছেলেকেও ইঞ্জিনিয়ার বানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। কোটার বেস্ট কোচিং সেন্টারে ভর্তি করানো হয়ে গেছে, হোস্টেল ঠিক করা হয়ে গেছে, চারদিন পরে ট্রেনের টিকিট।
তারসাথে চলছে ভীতু-গ'হর-গোবিন্দ ছেলের সাথে পাশের পাড়ার চাটুজ্জে বাবুর স্মার্ট ছেলে নিখিলের সাথে কম্পারেটিভ স্টাডি।
আজই বাজারের চাটুজ্জে বাবুর সঙ্গে দেখা। নিখিলের mains এ রাঙ্কিং কত জানিস! 524, তাও কোনো এক্সট্রা গাইডেন্স ছাড়া।
না বাবা ও তো আমার সাথেই কোচিং পড়তো। তারপর জানো বেরিয়ে আবার সিগারেট টানতো, আমি দেখেছি।
সে যাই হোক, রাঙ্কটা তো সে বজায় রেখেছে তাই না! আর তুই? কতবার বললাম, ফাঁকি মারিস না। তুমি নিজেই ফাঁকে পড়বি। কথা না শুনলে কি আর হবে!!
কিন্তু বাবা আমি সত্যিই পড়েছিলাম। তুমি দেখনি। মা দেখেছে, পরীক্ষার আগে সারারাত জেগে পড়তাম। মা কতবার বলতো শুতে যেতে তাও কফি খেয়ে জেগে থাকতাম। সত্যিই অনেক চেষ্টা…
ওরে হারামজাদা শুধু পরীক্ষার আগে পড়লে হয় না রে, সারা বছর পড়তে হয়। দু'বছর শুধু স্কুলের পরীক্ষার পড়াই তো করে গেলি... কম্পিটিটিভ পরীক্ষাগুলোর নম্বর কি উড়ে উড়ে খাতায় এসে বসবে?
কিন্তু বাবা সত্যিই...
কিছু কিন্তু কিন্তু নয়, দুবছর তো গিটার নিয়ে নাচন-কোদন করে কাটিয়েছো। আর স্কুলের বই ছাড়া আরও চারটি ইংরেজি বই পড়ে ইংরেজিতে পন্ডিত হয়ে গেছো। বোর্ডের পরীক্ষাতেও তো একই অবস্থা, সায়েন্স এর সাবজেক্টগুলো তে 80 আর এদিকে ইংরেজিতে 95 বসে আছো।
আজও প্রায় 5 বছর পরেও শুভম এর মনের জ্বলজ্বল করে আছে সেই স্মৃতি; যেদিন ছেড়ে আসতে হয়েছিল সেই ছোটবেলার বাড়িটা, দাদু-দিদা, মা, ছোট বোন তিতলিকে। ভুলে আসতে হয়েছিল সেই উত্তর কলকাতার অলি-গলির বন্ধুত্বগুলো, পাড়ার রবিকাকুর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা, গিটার নিয়ে গান, পুজোর সময় অষ্টমীতে স্নেহার শাড়ি পড়ে আবৃতি আর মায়ের বাজানো হারমোনিয়াম এর সাথে তিতলির কাঁচা গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত।
সেই দিন শৈশবকে ভুলে দাঁড়াতে হয়েছিল 17 বছরের শুভম কে, এই নির্মম পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করার কাঠগোড়ায়।
আজ আবার ফিরে এসেছে ওর সেই ছোটবেলার পাড়ায়, ছোটবেলার বাড়িতে। পাড়ায় বদল এসেছে বেশ খানিকটা কিছু খেলার মাঠে উঠেছে ফ্ল্যাটবাড়ি, কিছু পুরোনো জীর্ণ বাড়ির রং করে নতুন হয়েছে; বাড়ির উলটো দিকে খুলেছে এক মুদি-দোকান তাই মাকে আর মেন-রোড অবধি হেঁটে যেতে হয় না।
দাদু আর নেই। তিনি চলে গেছেন দু'বছর আগে। কিন্তু দিদুনের হাতের পায়েস এর স্বাদ এখনও একই থেকে গেছে। তিতলির কাঁচা কন্ঠে এসেছে সুর। ভোরবেলায় ওর ঘরের খড়খড়ি দেওয়া জানলা পেরিয়ে ভৈরবী রাগ ছড়িয়ে পড়ে সারা পাড়ায়। বাবার দাপটও কিছুটা কমেছে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে বলে কথা।
শেষ পর্যন্ত অনেক ধকল পেরিয়ে পৌছোলাম আমার সেই পুরনো বাড়িতে। বাড়িটাতে এখন খানিকটা হলেও জীর্ণতা যেন এসেছে। পড়েছে প্রবীণের ছাপ।
উঠানে পা রাখতেই তিতলি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, 'দাদা' তারপর চিল্লিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিলো, 'দাদা এসেছে, মা দিদুন কোথায় সবাই...এদিকে এসো'
এটা শোনা মাত্রই আমার মা তার যত কাজ ছিল সব ফেলে, আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বলল, "বাবা এসে পড়েছিস! যাক দুগ্গা দুগ্গা, তা এত দেরি হল যে বাবু! ট্রেন লেট করেছিল বুঝি?"
ওদিক থেকে দিদুন বরি দিতে দিতে বলল, 'কে শুভ এলো বুঝি' মা উত্তরে বললেন, 'হ্যা গো মা, তোমার নাতি এসেছে।'
তা দিদুন কে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরে বললাম, "কতদিন তোমাকে মিস করেছি যেন দিদুন" তারপর মায়ের হাতের একটা লাড্ডু মুখে পুরে বাবার খোঁজে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করলাম। বাবা দেখি সেইমাত্র টিভির সিরিয়ালটা বন্ধ করে, আমার আসার খবর পেয়ে সোফা থেকে উঠতে যাচ্ছিলেন। আমি গিয়ে বাবার পায়ে প্রণাম করতে উনি আমায় আশীর্বাদ করে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, "এইতো এবার বলতে পারব যে বাপকা-ব্যাটা দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার। তারপর মা বললেন,"তাড়াতাড়ি খেতে আয় অনেকক্ষণ কিছু খাসনি তো?
তারপর বহুদিন পর সকলে মিলে একসাথে খেতে বসে আমার সেই পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল।
তারপর নিজের ঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, বিকালে বেরিয়ে পড়লাম শহরের নতুন রূপটার পরিদর্শন করতে।
তবে বেরিয়ে দেখি একটু দূরেই ওই রবি কাকুর দোকানটা এখনো একই জায়গায় আছে। দেখে একটু স্বস্তি পেলাম, রবিদার চায়ের দোকানে দেখি আবার শুরু হয়েছে Paytm। একটু অবাকই হলাম।
তারপর একটা gold-flake ধরিয়ে যেই চায়ে চুমুক দিয়েছি অমনি একটা চেনা আওয়াজ,চেনা গলা ভেসে এলো,
"কাকু একটা সিল্ক-কাট দাও তাড়াতাড়ি!"
ওদিক থেকে রবি কাকু একটু হেসেই বলে উঠলো "বাবা জানেন" সেই চেনা স্বর থেকে উত্তর এলো, "প্রথম স্মোক করাটা যে তুমিই শিখিয়েছিলে, সেটাও কিন্তু জানেননা!"
শুভম চোখ খুলতেই যার দেখা পেল, তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। "স্নেহা", হ্যাঁ সেই স্নেহা, যার জন্য আসতে আসতে ভালবাসতে শিখে ছিল সে। শুধু মেয়েটাকেই নয়, নিজেকেও। নিজের লেখার নেশাটাকেও। ফেলুদা থেকে শেক্সপিয়ার কি-কিনা পড়েছে ওকে ইমপ্রেস করার জন্য।
সেই পাঁচ বছর আগের দুটো বিনুনী করে স্কুলে যাওয়া, স্কুলের প্রোগ্রামের একটা আধুনিক কবিতা সংকলন বই হাতে মেয়েটা আজ আবার নতুন করে ধরা পড়ছে শুভম এর চোখে। পরনে, একটা শর্ট কুর্তি আর জিন্স। চুলটা আলগা করে ক্লিপ দিয়ে বাঁধা আর সেই ছোট্ট কালো টিপ।
[ সমাজ বিধির পথ গেল ভুলে আলাপ শুরু হলো ]
"কেমন আছিস" বলে উঠলো শুভম
আপনাকে তো ঠিক...
ও্! বুঝে যাওয়া তো দূর, চেনাই যাচ্ছে না দেখছি।
না মানে ঠিক...
ওরে পেত্নী, ব্রহ্মদৈত্যকে ভুলে গেলি?
ওরে শুভ তুই? তুই এতদিন পর!
হ্যাঁ আমিই, যাক্ মনে পড়ল তবে। কেমন আছিস?
এইতো চলছে আর কি। আরে কাকু, আমাদের ফরেনার ছেলে ঘরে ফিরেছে জলদি জলদি ওয়েলকাম ড্রিঙ্কটা লাগাও তো।
আবার ওয়েলকাম ড্রিঙ্কটা কি?
হ্যাঁ কাকুর স্পেশাল মশলা চা... আর কাকু, আমার দু-কাপ চাই কিন্তু।
বাহ চা এর নেশাটা তো ছাড়িসনি দেখছি।
নেশা! ওই আর কি, সময়ের সাথে আরও জোরালো হয়ে গেছে।
তা আর কিসের নেশা ধরেছে শুনি?
সে না হয় হবে, আগে বল তুই কেমন আছিস? কি করলি এতদিন?
তুই যেন খবর রাখিসনি আমি কি করছিলাম!
কোথায় ছিলি তা তো জানি মায়ের মুখে শুনেছি। বাবা তো তোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু কি কাণ্ডকীর্তি করেছিস সেই সব তো জানি না। ওগুলো তোর মুখ থেকেই শুনবো না হয়।
ঐতো আইআইটি তারপর মেকানিক্যাল। কি আর কাণ্ডকীর্তি করব।
এ বাবা কানপুরের ফস্টিনস্টি? ওই কানপুরি মহিলার সাথে সেটার কি হল?
হুট, এমনিতেও ওই নিরামিষ মহিলার সাথে আমার পোষাতো না।
ও তার মানে Tried এবং Tested! তা ভালো ভুল করার অভিজ্ঞতা, পরে কাজে লাগে।
তাই না পেত্নী, তোর তো জেলাসি হচ্ছে তাই না?
তোর ওই ভুল চয়েসের উপর আমার আবার জেলাসি... বয়েই গেছে। যাইহোক কোথায় চাকরি করছিস? মানে কোলকাতায় মেয়াদ আপাতত কদিনের?
এইতো তিন বছর জানি। তারপর দেখি... তুই কি করছিস? বললি না তো।
JU, 2nd Year কম্পারেটিভ লিটারেচার এ মাস্টার্স।
আরে বাহ! JU তে তোর তো প্রায় পাঁচ বছর হয়েই গেল। সেকেন্ড হোম বানিয়ে ফেলেছিল দেখছি।
হঠাৎ শুভম এর পাশে রাখা অস্মিম সঙ্গীর নতুন সংকলন টা হাতে নিয়ে স্নেহা।
বাহ্, এখন আপনি থ্রিলার গল্প পড়া শুরু করেছেন বুঝি! তো লাস্ট ক্লাসিকটা কবে পড়া হয়েছিল?
ইয়ে!... মানে এই তো জাস্ট কিছুদিন…
বেশ, বুঝে গেছি। মিথ্যে কথা বলিস না লাভ নেই।
এটাই ছিল স্নেহার সুপারপাওয়ার। যেটা শুভর কাছে এখনো রহস্যের। তার কথা বলার ধরন দেখেই, সে বুঝে যেত তার কোথায় কতটা সত্যি আর কতটা জল-গোলা। যাবার আগে স্নেহার সাথে একবারও দেখা করে যায়নি শুভ। একটু ভয়, একটু ক্যাবলামি, একটু অপ্রস্তুতি সব মিশিয়েই আর সাহসটা আর যোগাতে পারেনি। বিশেষ ভয়টা ছিল স্নেহা যদি শুনে কান্না-কাটি করে। আর তার থেকেও বড় ভয় নিজেই যদি কেঁদে ফেলে ওর সামনে…
এই স্নেহা..
হ্যাঁ বল?
তুই কি কাউকে...
আমি কাউকে কি?
মানে কারো সাথে আছিস...
হ্যাঁ আছি তো,মা-বাবা-দাদু...
আরে মানে...
আরে মানে কি!
ভালোবাসিস কাউকে?
যদি বলি, হ্যাঁ!
না তাহলে আমি... খুশি তোর জন্য
চল ফোট!, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কি বলিউড সিনেমা দেখা তো নাকি?
সিনেমার সাথে কি আছে, তুই ভালো থাকলেই ভালো।
হ্যাঁ রে ব্রহ্মদৈত্য, প্রথমবার দেখছি তো তোকে নাহ্! আমায় মিথ্যে কথা বলার পর পার পাবি ভাবলি?
মিথ্যে আবার কি...
এই এই jealousy নাকি?
ধুর কিরে...
আমি তো বাপু সব জানি, তোর ডায়লগগুলো... ওগুলো না হয় কানপুরের নিরামিষ মেয়েগুলোকে মারিস।
এই স্নেহা,
বলে ফেল।
সত্যিই ভালবাসিস কাউকে?
যদি বলি না!
জানবো...চান্স মারার যেতেই পারে।
হ্যাঁ তুই যা ভীতু, তুই আবার মারবি চান্স, তাহলেই হয়েছে।
আচ্ছা, তাহলে একটা সাহসী ছেলে খুঁজি নাকি?
সে ছিল একজন, কিন্তু যখন আমি বুঝলাম... তখন আমি আর ও...
আমি আরো ও…?
ও ও হো ছেলের কি জানার ইচ্ছে দেখ…!
ইচ্ছে, আবার কি! জিজ্ঞেস করছি এমনি...তোর চেনা জানা কেউ থাকলে বল সেটিং করিয়ে দিতাম।
হ্যাঁ তুই যা সেটিং করাতিস জানা আছে, নিজের তরী মাঝ গঙ্গায় সে আবার আমার সেটিং করাবে...
এই বলে একটা বিদ্রূপ ভরা হাসি হাসলো, স্নেহা তারপর একটা সুখ-টান দিয়ে বলল,
মনে আছে শুভ, এই রবিকাকুর দোকানে সেই কত আড্ডা, তোর গিটার নিয়ে গান…,
হ্যাঁ, সে আর ভুলবো?... এখন তো পাড়ায় তেমন কেউ নেই, হয় কেউ অন্যত্র পড়ছে,নয়তো চাকরীতে ব্যাস্ত।
সেই রে জানিস তোর বাড়ির একতলায় থেকে আমার বাড়ির যে কোন এর জানালাটা দেখা যেত সেটাও গেছে ঢেকে
জানি সামনে ফ্ল্যাট উঠেছে সেই ফটো মুখোশ পড়ে ভয় দেখাতাম তোকে আর ভীতু বলিস আমাকে
তোকে কেন বলি ভাল করেই জানিস শুভ
শুভ জানতো এই প্রসঙ্গটা উঠবেই, তাই এর পরে আর কিছু বলতে পারল না।
স্নেহার পাশ থেকে পালাতে ইচ্ছে হল। কোনো একটা কিছুর তলায় মাথা গুঁজে রাখতে ইচ্ছে করলো, দোকানের উনুনটার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
"স্নেহা আমি…" বলে পাশে ফিরে দেখি স্নেহা কখন উঠে চলে গেছে। পাশে দুটো চা-এর ভাড়ের নিচে চাপা দিয়ে রাখা একটা ফোন নাম্বার নিচে লেখা, কোনদিন সাহস যোগাতে পারলে একটা মেসেজ করিস।
দুদিন দিন কেটে গেছে শুভম ওই নাম্বারটা টাইপ করে... তারপর আবার ব্যাকস্পেস মারে। শেষে একদিন শেষ পর্যন্ত করে দিলো একটা মেসেজ, 'কেমন আছিস... কেমন চলছে সংসার?'
একটু পরেই উত্তর এলো,
"এখনো কবিতার লাইন মেরে ইমপ্রেস করার বৃথা চেষ্টা ছাড়িসনি বল?"
-"চেষ্টা হলেও...বৃথা হবে না জানি এই কবিতাটা তোর খুব পছন্দের ছিল। আমার মনে আছে শেষ যেবার পুজোয় আমি এখানে ছিলাম, পাড়ায় তুই এই কবিতাটা বলে দ্বিতীয় হয়েছিল।
সে তো হবেই তখন যারা 'নীড় ঝড়ের স্বপ্নভঙ্গ' বা 'আফ্রিকা' বলতো, তখনই লোকের কত হাততালি। মানুষের গণনায় তারাই প্রথম হতো। তখন তো বেশি মানুষ জানত না এই কবিতা গুলোর মর্ম। আজ একটা সিনেমায় যখন কোন এক গানে শুনেছে, ব্যাস তখন সবাই ফিদা। সেই কবিতার লাইন তুলে ফেসবুকে ক্যাপশন দিয়ে ন্যাকা মামনিদের পোস্ট শুরু।
তোর কবিতা নিয়ে ঝগড়া করার স্বভাব এখনো যায়নি দেখছি। তা চর্চাটা রেখেছিস তো?
কবিতা পড়ার পথ থেকে লেখার পথেও নেমেছি।
তাই বুঝি, তা কবে পড়তে পারবো তোর লেখা?
চলে আয়...
এখন এত রাতে?
এখনো ভীতু আছিস।
না ভয় নয়...
ভয় তো অবশ্যই তাই বলে আমাকে?
না মা মানে...
বেশ ভয় কাটলে দেখা হবে।
আ-আসছি আমি...
বাহ, হঠাৎ এই নবজাগরণের কারণ শ্রীমান!
আমি ভয় পাইনা আমি ভিতু নই আর।
বাড়ির ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে স্নেহা হাতে একটা সিল্ককাট। একসাথে বসা হলো ছাদের এক কোনায় একজনের হাতের সিল্ককাট আরেকজনের হাতে গোল্ডফ্লেক, সাথে বাবার ঘর থেকে ঝাপা হুইস্কির বোতল।
আমি পালাতে চাইনি স্নেহা।
আমি তো একবারও বলিনি তুই পালিয়েছিস... নিজেই মানছিস তবে?
তখন এত তাড়াতাড়ি সব বদলে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না কি করবো।
আমায় একবার বলতে হতো তো শুভ। আমাদের সম্পর্কটা কি এতটাই দুর্বল ছিল?
সম্পর্ক মানছিস তাহলে।
হ্যাঁ হয়তো...
আমি সত্যিই বড় ভীতু ছিলাম রে, বাবার কোনো কথায় না বলতে পারিনি। বলতে পারিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাই না।
রাতে জেগে আগে খুব কাঁদতাম। জানিস বাবার থেকে চুরি করে গোল্ডফ্লেক খাওয়া শিখেছিলাম
আর নেশাটা?
দূরে গিয়ে তোকে যখন মনে পড়তো।
মনে পড়তো বুঝি...
হ্যাঁ, শুধু ভাবতাম একদিন সার্থক হয়ে ফিরে আসি, তারপর আমাদের সব স্বপ্নগুলো পূরণ করব।
কোন স্বপ্ন!
ওই যে এক নির্জন পাহাড়ের শুয়ে রাতের তারাগুলো গোনার স্বপ্ন।
বাহ মনে আছে এখনো?
ভুলিনি কিছুই...
আমিও
কবিতা কবে থেকে লেখা শুরু করলি?
যেদিন থেকে একা পড়ে গেলাম।
আর নেশা?
একা কাটানো রাতগুলোর একমাত্র সঙ্গী বলতে পারিস।
তোর কোন কবিতায় এই ভিতুর ডিমটাকে জায়গা দিয়েছিস?
নিজে খুঁজে নে - এই বলে একটা নোট বই এগিয়ে দিলো আমার দিকে।
সারা খাতা জুড়ে জটিল কিছু পংক্তি, তাতে মিশে আছে অপেক্ষা, একটু অভিমান, অনেকটা ইচ্ছে।
বেশিরভাগই ফাঁকা, তাও যেন একটা অদ্ভূৎ নেশা জড়ানো, সারারাত এইভাবেই স্নেহার কবিতার শব্দে-ছন্দে ও ওর গায়ের চন্দনের সুগন্ধির সুবাসে, শুভ বিভোর হয়ে রইলো।
খাতাটার কিছু পাতা ভিজে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে শব্দ, হয়তো চোখের জল নয়তো ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে পড়া একটুখানি সূরার ফোঁটা। কিন্তু খাতাটার শেষ কবিতার শেষ কিছু লাইনে শুভম পেয়ে গেল উত্তর। যেন লাইনগুলো স্নেহার নয়, আগের কবিতা গুলোর মতো ফাঁকা ফাঁকা নয়। অন্য লেখক এর লেখা যেন।
তাল মিলিয়ে সাজানো চারটি লাইন হয়তো শুভর উত্তর পাবার জন্যই লেখা হয়েছিল লাইন গুলো...
"কাল করে ফের আসছে আকাশ
চোখের সামনে ঝাপসা হচ্ছে দিন।
ভালবাসাদের দেখা হয়ে যাওয়া স্বপ্ন হয়তো
আবার কোথাও আমরা ভিজবো ঠিক।"
পেত্নীর লেখা প্রেম?
কেন, ব্রহ্মদৈত্যর পৈতে তে কলঙ্ক লাগলো বুঝি!
এই ভীতু ক্যাবলা-কান্তটাকে ভালো বাসবি?
সহস্রা যুগ ধরে হ্যাঁ, কিন্তু প্রতিজ্ঞা কর না বলে পালাবিনা আর। একা একা রাত জেগে কাঁদবিনা।
না, একসাথে কাঁদবো। তোর শরীরের চন্দন এর গন্ধটা দিয়ে আমায় বন্দি করে রাখিস।
শুভ
বল প্রিয়...
আমাদের স্বপ্নগুলো তোর চাকরি জীবন এর মাঝে হারিয়ে যাবে না তো?
না আর না এবার তুইই আমার স্বপ্ন।
ধীরে ধীরে সূর্য উঠেছে, আকাশে সেই পুরনো শহরের বুকে পাখি গুলো উঠেছে জেগে। চারিদিকে বাড়ির দক্ষিণ জানালা হতে বোনের ভৈরবী গানের সুর ছড়িয়ে পড়েছে সারা পাড়া জুড়ে। আর এদিকে,
সকলের আড়ালে ছাদের এক কোনায় দুটি ঠোঁট একে অপরকে চুম্বন করে যাচ্ছে প্রথমবারের নেশায়। হয়তো এই দীর্ঘ দুঃসাহসিক চুম্বনটাই শুরু করছে নতুন গল্প। আবার নতুন করে ভালোবাসার গল্প, ওদের একসাথে বাঁচার গল্প!...
লিখনে : সৈকত সেনাপতি
©Barthopion
"A photograph contains just moment, not all."
কয়েকদিন আগে রবীন্দ্রসদনে একটি ফটোগ্রাফি এক্সিবিশনে গেসলাম। যারা প্রতিবছর যান তারা তো জানেনই ঠিক ক্রিসমাস এর আগে রবীন্দ্রসদনে নানা এক্সিবিশন এর আয়োজন বসেই থাকে,
তো আমি ফটোগ্রাফার হিসেবে ফেমাস না হলেও আমার কয়েকটি ছবির জন্য আমায় সকলে অল্পস্বল্প চেনে। যথারীতি সেখানে আমি ছাড়াও আরও নানান অসামান্য ফটোগ্রাফাররা এসে উপস্থিত হয়েছিলেন আর তাদের ছোট ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য এসে হাজির হয়েছিলেন অনেক সাংবাদিকদের দলও ।
আর আমি ! আমি তো, নতুন নতুন ছবি তোলার কনসেপ্ট কিভাবে আরো ভালো করা যায় তা জানার জন্যই এইসব সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে পারিনা।
তাই আমি সেখানে ঘুরে ঘুরে এক এক করে প্রতিটি ছবিকে পর্যবেক্ষণ করে দেখছিলাম, এই সময় একটি মাঝ-বয়সী মেয়ে এসে হঠাৎ কথা বলতে শুরু করল। তারপর বুঝলাম উনি সাংবাদিক-মন্ডলের একজন। এখানে প্রত্যেক ফটোগ্রাফারের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে ছোট করে ইন্টারভিউ নিয়ে নিচ্ছেন।
কথাবার্তার শুরুতেই বুঝলাম উনি যে প্রশ্নগুলি করছেন তা বেশ সুন্দর করে সাজানো। তবে অনিবার্য প্রশ্নটা করলেন সবার শেষে।
-"আপনি তো আজ পর্যন্ত অনেক স্বরণীয় ছবি তুলেছেন। কিন্তু মাত্র কুড়ি বছর বয়সে এই অসাধারণ ছবিটা কি করে তুলেছিলেন? যদি বলতেন…"
-"...কোন ছবিটা?" বুঝতে পেরেও জিজ্ঞেস করলাম।
-'দ্য এঞ্জেল' আপনার মাস্টারপিস !!
-মুখে কষ্ট করে খানিক হাসি ফুটিয়ে বললাম,
ওই ছবিটাকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। বাই চান্স তুলে ফেলেছিলাম কল্পনাও করিনি ছবিটা এত বিখ্যাত হবে।
-"ওই ছবিটার মধ্যে এমন কিছু আছে…., যা চোখের নয়, মনের গভীরে নাড়া দেয়। ছবির অদ্ভুত প্রাণবন্ত মেয়েটি যেন কল্পলোকের একজন। সামওয়ান আউট অফ দা ওয়ার্ল্ড... যেন প্রেম থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে। এর কি কোন ব্যাখ্যা নেই?"
"সাংবাদিকের স্বরে মুগ্ধতা"
(হেসে বললাম) "সবকিছুর ব্যাখ্যা হয়? থাক না একটু রহস্য!"
এক্সিবিশনটা মিটে যাওয়ার পর মনের গহনে যথারীতি এক নৈতিক উদ্বেগ আর অপরাধবোধের মন্থন। একত্রিশ বছর আগের সেই সপ্তাহটা যেন মনের চোরা পকেট থেকে বেরিয়ে এসে মনটাকে বিধুর করে তুলেছিল ।
সত্যটা আজ অব্দি কাউকে বলিনি, বললেও বোধহয় কেউ বিশ্বাস করবে না!!
অথচ আজ এতদিন পরেও, আমার নিঃসঙ্গ অন্ধকার মুহূর্তগুলোয় দরজায় ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে আসা আলোর মতো ভেসে যাচ্ছে, ওই কয়েকটা দিনের অমিলন স্মৃতিগুলো।
“Life is a Movie,where we acts”
আমি তখন 2nd year এ পড়ি। কলেজ শেষে বাড়ি ফিরে মায়ের মুখে শুনলাম ,মামার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মামা পশ্চিম মেদিনীপুরের ছোট এক গ্রাম সাগরপুর এর পঞ্চায়েত প্রধান। আমার পূর্বপুরুষরা এককালে ওখানকার বিশাল জমিদার ছিলেন। ওখানেই মায়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহন্তে বিয়ে। তার কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার সেমিস্টার,পড়ার ক্ষতি হবে বলে, ঠিক হল মাত্র সাতদিনের জন্যই যাব।
বাবা একটি সংবাদপত্রের ফোটো গ্রাফার ছিলেন। আমারও খুব ছবি তোলার শখ ছিল। তখন তো আর মোবাইল এর যুগ নয়,যে চট করে ফোনেই তোলা যাবে একটা Snap!..... তাই বাবার ক্যামেরায় আমিও দু-একটা ছবি তুলতাম মাঝে মাঝে । শাটার স্পীড, অ্যাপারচার, ফোকাস, ডেপথ অফ স্পীড এসব বাবার কাছেই শেখা ।
অনেকদিন পর মামাবাড়ি যাবার সুযোগ পেলাম, তাও কয়েকদিনের জন্য , তবে তাতেই আনন্দ Adjust করতে হবে। প্রায় দু আড়াই বছর পর যাচ্ছি। সেই H.S. এর আগে একবার এসছিলাম, দিদার শরীর খারাপের সময়। তারপর নানান ব্যাস্ততায় আর যাওয়া হয়নি। ওখানকার গ্রামীণ সৌন্দর্য নৈস্বরগিক। ভেবেছিলাম এবার অসাধারন সব ছবি তুলব।
রওনা হবার দুদিন আগে তার ছন্দপতন । ছুটি না পাওয়ার বাবা যেতে পারবে না। বাবাকে ছাড়া আমার কোথাও ভাল লাগেনা । তাছাড়া বাবা যাবে না মানে, বাবার ক্যামেরাও নেই। হয়ে গেল ! ছবি তোলার সত্যানাশ !
বাবা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল আমার মনের কথা। হাওড়া থেকে ট্রেনে ওঠার দিন ; একটা নতুন ক্যামেরা আর রঙ্গিন ফিল্মের দুটো রিল আমার হাতে দিয়ে বললেন,”অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম তোকে একটা কিনে দেব। যথেষ্ট ভাল ক্যামেরা, ঠিক করে তুলবি। বাড়ি এসে দেখাস ছবি গুলো, দেখব তোর ছবি তোলার দৌড় কতদুর।“
সেদিন দুপুর ২:০০ নাগাদ মামাবাড়ি পৌঁছে দেখি , ইতিমধ্যে দিল্লি থেকে মাসিরা এসে গিয়েছে । মাসতুতো বোন রুপুর সাথে বহুদিন পর দেখা হাওয়ার, খানিক আড্ডা মেরে, স্নান খাওয়া সারতে সারতে বেলা গড়িয়ে গেল। অবেলায় খেয়ে উঠতেই শীতের অবধারিত কাপুনি শুরু হল।
মামাবাড়ি পিছন দিকের, খোলা উঠোনে রোদে গিয়ে একটু দাঁড়ালাম। সামনেই কৃষকদের বিভিন্ন ধানক্ষেত। হ্যাঁ, আমার দাদামশাই ও কৃষক মানুষ ছিলেন। তা সেই দেখে খুব ভালো লাগলো। সেই পুরানো স্মৃতি, ছোটবেলায় দাদুর সাথে একবার আলু জমিতে আলু তুলতে গেসলাম,কি মজাই না হয়েছিল। আহা: আকাশের দিগন্ত সেই সুদূরে মিশে গিয়েছে ধানক্ষেতের গায়ে। আর তার ধারেই অস্তমিত সূর্যের কমলা আভা ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।
ক্যামেরাটা সঙ্গেই ছিল। ভালো সিনারি তোলার প্রচেষ্টায় গোলাপ বাগানের দিকে এগোলাম, দু-একটা ছবি তোলার পর, ভালো পজিশন নেওয়া যায় নাকি দেখার জন্য যেই না বাঁদিকে তাকিয়েছি, নিজেই অবাক হয়ে ফ্রিজ হয়ে গেলাম।
বাঁ পাশে, আমাদের মামারবাড়ির থেকে সামান্য তফাতেই বিকাশ মামার বাড়ি। বিকাশ মামার বোন তপু মাসি, মায়ের প্রানের বন্ধু। ওদের দুজনের বিয়েও হয়েছিল একই বছরে, তবে দুদিকে। মায়ের কলকাতা আর অপু মাসির কাঁথিতে।
তপু মাসিদের বাড়ির খোলা উঠোনটায়, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে শীতের ছেঁড়াছেঁড়া রোদ পড়ছে। সেই মায়াময় আলোছায়ার কোলাজে, এক অপরূপা বেতের ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছে। গায়ে একটা মধুরঙ্গা হাইনেক্ ফুলহাতা সোয়েটার, মাথায় উজ্জ্বল খোলা চুল, চেয়ারের গা বেয়ে অবহেলায় লুটিয়ে আছে।
আমোঘ এক আর্কষনে ক্যামেরাটা ঘোরালাম, অসাধারণ ছবির potrait খুঁজে পাওয়ার আনন্দে।
কিন্তু ছবি তোলার আগেই মেয়েটি টের পেয়ে গেল। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে এক প্রাণঘাতী দৃষ্টিতে ভ্রুকুটি আমায় খুন করে দিয়েই, ঘরে ঢুকে গেল।
এইভাবে না বলে কোন মেয়ের ছবি তোলা ভয়ানক অন্যায় এবং তার জন্য যে ঝামেলায় পড়তে হবে, তার জ্ঞান আমার ছিল। এই ভেবে প্রথম পিঠটান দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মনে হল মেয়েটা কে? ওই বাড়িতে এরকম কেউ তো থাকার কথা নয়। ওদের সকলকেই তো আমি চিনি।
মেয়েটি কিছুক্ষণ পর আবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সঙ্গে তপু মাসি।
তপুমাসি দু বছর আগে কলকাতায় আমাদের বাড়ি এসেছিল একবার। দেখলাম এখন একটু রোগা হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করে বললাম, তোমাদের বাড়িটার ছবি নিচ্ছিলাম। এমন ভাবে বললাম…. যেন মেয়েটাকে দেখিইনি।
-"ওমা! সৈকত না? তোরা এসে গিয়েছিস! তুই, ছবি তুলেছিলি? তুমিও কি বাবার মত ফটোগ্রাফার হয়ে গেলি নাকি? আর রাঈ ভেবেছে…"
আমি অপু মাসির কথা শুনতে-শুনতে মেয়েটির দিকে নজর রাখছিলাম। বেশ হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে মট-মট করছে। মনে মনে বললাম, "দিলাম তো খেলা ঘুরিয়ে, আর কাউকে ডাকবে!"
তপু মাসির দিকে ঘুরে বললাম,"মাও তো জানেনা, যে তুমি এসে গিয়েছ!"
-"তাইতো! যাই গিয়ে দেখা করি…"
তপু মাসী গায়ের শাল ঠিক করতে করতে মামাবাড়ির দিকে চলে গেলেন। আমি একটু মুচকি হেসে মেয়েটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কী অপু মাসীর কেউ হও?"
- "পিসেমশাই হই! আপনার কোনো অসুবিধা?" (চ্যালেঞ্জের সুরের বেশ ঝাঁঝালো গলায় কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে মেয়েটি ঘরে ঢুকে গেলো।)
"I just want to fall in love on you"
পরদিন আইবুড়ো ভাত। বাড়ি ভর্তি লোক। পাড়ার সব পরিবারেরই সেদিন থেকেই নেমতন্ন। স্বাভাবিক ভাবেই ওদের বাড়ির অন্যসকল এর সাথে ঐ মেয়েটিও সারাদিনই এই বাড়িতে। ইতিমধ্যে জেনেছি মেয়েটির নাম রাইমা। তপু মাসী রাইমার জেঠিমা।
রাইমা কাথি কনভেন্ট স্কুলে টুয়েলভ এ পড়ে। বিয়ে উপলক্ষে এসেছে। বউভাতের দিন ওর বাবা, মা আর জেঠু আসবে, আর দুদিন এখানে থেকে একসাথে ফিরে যাবে। ওর ও নাকি সামনেই H.S পরীক্ষা আসছে।
তপু মাসীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এমনিতে খুব কাছের। বিয়ে বাড়ি লেগে যাওয়ার পর কে কোন বাড়ির লোক তা বোঝাই যাচ্ছে না।
বিয়ের নানা আচার-বিচার, গোছ-গাছ সব মা আর তপু মাসী মিলে করছে। মামার বিয়েটার উপলক্ষে দুই বান্ধবী যেনো নিজের ছোটবেলার দিনে ফিরে এসেছে।
রাইমা আর রুপুকে দেখলে বোঝাই যাচ্ছে না। ওদের একজন থাকে কাথি আর একজন দিল্লিতে। দুজনেই কী সব ইশারায় কথা চালাচ্ছে আর অকারনেই হেসে চলেছে।
আমিও গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে মাঞ্জা দিয়ে ঘুরছি।
আমি এমনিতেই তখন নিয়মিত দাড়ি কামাতাম না। তাই গালে অনেকটা দাড়ি নিয়েই কলকাতা থেকে এসেছিলাম। কিন্তু সেদিন, ওই ঠান্ডাতে সাত সকালে গাল কামিয়ে চকচকে হয়েছি। তবে, রাইমা খুব কায়দা করে আমাকে এড়িয়ে চলছে। কথা শুরু করারই সুযোগ দিচ্ছে না। আমাকে দেখলেই, মুচকি হেসে কিছুটা দূরে সরে পড়ছে।
বিয়ে বাড়ির খাওয়া দাওয়া, হই হুল্লোড় আনন্দের মাঝে দু'গাছা হৃদয়তন্ত্রির গিট বাঁধা খেলা চলছিল। অদৃষ্ট ছাড়া কেউ খেয়াল করেনি।
"Sometimes missing is more pricious than being togather because we miss only then whom we never want to miss"
পরদিন বিয়ে। সকালে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে কনে বাড়ি যাওয়া হবে। তাই জন্য একটা ম্যাটাডোর আর অ্যম্বাসাডার ঠিক করা হয়েছিল।
বাড়ির দুজন কাজের লোক তত্ত্বের ট্রেগুলো নিয়ে ম্যাটাডোরে উঠে পড়ল! আমি ম্যাটাডোরর ড্রাইভার বিশু কাকার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম। রাইমা যেতেই চাইছিল না,তবে রূপু ওকে সঙ্গে নিয়েই গাড়িতে উঠল। অ্যম্বাসাডারটায় ওরা দুজন ছাড়া মামার বন্ধু বিকাশ মামা ও ছিল।
কাঁসাই নদীর বাঁধ বরাবর রাস্তা দিয়ে বেশ খানিকটা যাওয়ার পর বাঁদিকে ঘুরে সমতল পিচঢালা রাস্তা। দুপাশে বিস্তীর্ন মাঠ,ক্ষেত ও বনজঙ্গল।
সকাল সকাল বেরোনোর ফলে কেউ কিছু খাইনি বিশেষ,তাই খিদের জ্বালায় রাস্তার ধারে একটা দোকান দেখে ওদের গাড়িটা প্রথমে দাঁড় করালো, তারপর আমরা একে একে নেমে কিছু মুখে দিলাম, আমি কোথাও আমার ক্যামেরাটাকে আনতে ভুলিনা। তাই দেখে রূপু বলল,"ওই দাদা তোর ক্যামেরাটায় এবারে একটা আমাদের গ্রুপ ফটো হয়ে যাক না রে?"
আমি বাবা ভালো মানুষের মতোন বললাম, "সবাই মিলে? অসম্ভব! রাইমা রাজি হবেই না।"
রূপু খানিক অবাক হয়েই বলল,"কেন, ওর কী ছবি তোলায় অ্যালার্জি?"
রাইমা তীক্ষ্ম স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,"নেভার!"
আমি ওমনি সুযোগ পেয়ে বলে উঠি,"আরে,আমি খালি ওর একটা ছবি তুলতে গেসলাম। ও তপু মাসিকে....."
"ছবি তোলার আগে আপনি আমার পারমিশন নিয়েছিলেন?" রাইমা চোখ পাকিয়ে উত্তর দিল।
এইসময় বিকাশ মামা বলে উঠল,"এই তোরা থাম,খালি ঝগড়া,ছবি তুললে তোল তাড়াতাড়ি,দেরি হচ্ছে!"
দোকানের লোকটা আমাদের একটা গ্রুপ ফটো তুলে দিলেন। সেটাই আমার ক্যামেরায় রাইমার প্রথম ছবি!
আবার রওনা দিল। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই আমাদের ম্যাটাডোরটা আচমকা ব্রেক কষে দাড়িয়ে পরল। অ্যম্বাসাডারটাও দাড়িয়ে পরেছে পিছনে।
আসলে সামনে একপাল মোষ রাস্তা পার হচ্ছে, মোষের দলটাও বেশ বড়। বেশকয়েকটি মোষ পেরিয়ে যাওয়ার পর খেয়াল করলাম,দলটার মাঝের মোষ কটা প্রায় আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।ওদের চোখ আমাদের দিকেই।
আতঙ্কের সাথে বুঝলাম, মোষ গুলো বেশ দ্রুত এগিয়ে আসছে ম্যাটাডোরে রাখা ফল,মিষ্টির গন্ধে।
বিপদ বুঝে রূপুদের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে তীব্র বেগে উল্টোদিকে ছুটতে লাগল। আর ম্যাটাডোরটা সামনে থাকায় ঘোরাতে অসুবিধা হচ্ছিল, এদিকে প্রথম মোষ টা প্রায় কাছেই। আর ম্যাটাডোরের ওপরের ওরা তো ভয়েই চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে ।
ওদেরকে ফলের ট্রেগুলো বাইরে ছুড়ে দিতে বলে, বিশুকাকা গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। আর ওরা তখন যে কটা ট্রে পারলো ছুড়ে দিলো। তাতে মোষগুলো একটু থমকালো। আর এদিকে ততক্ষনে আমরা স্পীড বাড়িয়ে পগার পার।
উল্টো পথে অন্তত তিন কিলোমিটার চলার পর আম্বাসাডরটার দেখা মিলল, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওরা দরজা খুলে দৌড়ে এলো। রুপু এসে হাত ধরে বললো, "দাদাভাই তুই ঠিক আছিস তো?"
রুপুকে "হ্যাঁ" বলে ঠিক ওর সাথেই দৌড়ে আসা রাইমার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। আমার ঠিক দু-হাত দূরে দাঁড়িয়ে, মুখটা উত্তেজনায় লাল গোলাপের মতো হয়ে গেছে, চোখের কোনে জলের আভাস।
আমরা আর কনেবাড়ি যাইনি তখন। বিকাশমামা আর বিশুকাকা ম্যাটাডোরে করে অন্য পথে রওনা দিলো আর আমরা আম্বাসাডরটায় ফিরে এসেছিলাম।
ফেরার পথে আমি আবার সামনের সীটে। কিছুটা চুপচাপ যাওয়ার পরই রুপু রাইমাকে টিজ করা শুরু করলো। বললো,"জানিস দাদাভাই আমরা তোদের নিয়ে খুব টেনশন করছিলাম।"
আমি রিয়ার ভিউ মিররে রাইমাকে দেখতে দেখতে বললাম,"তাই?" ওর চোখে উৎকণ্ঠার ভাবটা কেটে গিয়েছে কিন্তু সেই চঞ্চলতা তখনও ফিরে আসেনি।
"হ্যাঁ! আমার খুব টেনশন হচ্ছিল। আর রাইমাতো পারলে গাড়ি থেকে নেমে......উঃ আরে বাবা কি জোরে চিমটি দিলি রে।"
রাইমা মুচকি হেসে বলল,"চুপ কর নাহলে এবারের চেয়ে আরও জোরে দেব।"
রিয়ার ভিউ মিররের মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টিবিনিময় হল। এক শিহরণ খেলে গেল মনে।
''Chic All the Way, But Love Me That's Way''
কনে বাড়ি পৌছে বিকাশমামা ফোন করেছিল। ওরা সঠিক সময়েই অন্য রাস্তা দিয়ে পৌছে গেছে, কোনো অসুবিধা হয়নি।
বরের গাড়ি আর বরযাত্রীর বাস প্রায় দুপুরেই ছেড়ে দেওয়া হল। আমি বরের গাড়িতে চললাম। রুপু আর রাইমা বাসে।
গন্তব্যে পৌছোতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। নতুন মামির বাড়ির পাশের একটা বড় গেষ্ট হাউসেই বরযাত্রীদের থাকার ব্যাবস্থা ছিল। আমি গাড়ি থেকে নেমেই রুপুর খোঁজার ছলে রাইমাকে খুঁজতে লাগলাম।
দোতলায় রুপুর সাথে দেখা হতেই প্রথমেই বলল, "রাইমা তো তোকে খুজছিল রে?"
-"'তাই!"
- "হ্যাঁ রে সত্যি সত্যি!"
তারপর রাইমাকে একসময় একা পেয়ে গিয়ে সোজা জিজ্ঞাসা করলাম,"আমাকে খুজছিলে?"
-"কই,না তো!"
-"রূপ যে বলল !"
-"আপনার বোনকে তো চেনেন না?, সব বানিয়ে বানিয়ে যা পারছে বলে যাচ্ছে।"
-"ওহ্ ! সে যাই হোক,তবু এই অজুহাতে তোমার সাথে কথা বলার সুযোগ তো পেলাম। "
-"তাতে কি হল! আপনি কলেজে পড়েন, অনেক মেয়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই মেশেন । আমাদের ওদিককার সমাজ তো আরও খোলামেলা, আধুনিক। তো আমি বুঝতে পারছি না ,আপনি এরকম কেন করেছেন? মামার বিয়েতে এসে সুন্দরী মেয়ে দেখে…. ! এটা একরকমের টাইম পাস হলে অবশ্যই আমার কিছু বলার নেই "।
রাইমা বেশ ক্যাজুয়ালি হাসতে হাসতে কথা গুলো বলছিল। কিন্তু ওর বাঙ্ময় চোখে গভীরতর একটা জিজ্ঞাসা ছিল। সেটা উপেক্ষা করেই বললাম "তুমি তাহলে নিজেকে নিজেই সুন্দরী বলছ?"
অপ্রতাশিত এই জবাবে রাইমা ভ্রু কুঁচকে বলল, " আমি সুন্দরী কিনা তা নিয়ে আগে একটু সন্দেহ ছিল,তবে আপনার রিঅ্যাকশন দেখে ডাউট ক্লিয়ার হয়ে গেছে"
আমি কি বলব ভাববার আগেই রুপুর আবির্ভাব। বলল, "একি রে তোরা তো বেশ একা একা কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিস এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ওদিকে বিয়ে তো শেষের মুখে। তোরা সিওর কেস খাবি । এদিকে মোষের পাল্লায় পড়েছিস ধরে নিয়ে, রাইমাদি কি করছিল সেটা বিকাশ মামা সবাইকে রশিয়ে বলতে শুরু করেছে, কথাটা তপু মাসির কানে যেতে কতক্ষণ?"
-"কানে গেলে কি হয়েছে ? কারো বিপদ হলে আংজাইটি হবে না?সো ওয়াট?" রাইমা প্রায় তেড়ে এল।
-"ঠিক আছে ঠিক আছে কোয়াইট ন্যাচারাল,এবার চল" বলে রুপু রাইমার হাত ধরে টেনে সুন্দর সাজানো বিবাহ মন্ডপের দিকে নিয়ে গেল ।
যাগযজ্ঞ সহ বিয়ের অনুষ্ঠান মিটতে রাত হল। সকালের আগে বরযাত্রীদের ফেরার উপায় নাই। তাই ভোরে আলো ফুটতেই বরযাত্রীদের বাস রওনা দিল। আমি বিকালে বর কনের সাথে ফিরলাম। পথে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শুধু যেখানে মোষের সাথে পাল্লা হয়েছিল ,সেখান দিয়ে আবার যাওয়ার সময় রাইমার সেই উতকণ্ঠীত জলভরা চোখ দুটো মনে ভেসে এসেছিল। আর আমার মনে এক হালকা ভালোলাগার সাথে হাসি ফুটে উঠল মুখে।
"Everythink is illuminated except you"
পরের দিন বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠান ,প্রচুর কাজ ,তাই আমাকেও হাত লাগাতে হছিলো। এদিকে রাইমা আর রুপু নতুন মামির সঙ্গে ভালোই জমিয়ে নিয়েছে। আর মামার ঘরে সকাল থেকেই বেশ একটা মেয়ে মহল বসে গিয়েছে। আমিও ছবি তোলার অছিলায় ওখানে হাজির হলাম। তবে ফিল্ম এর রীল ফুরিয়ে আসায় আর বেশি ছবি তোলা যাচ্ছিলো না।
এরমধ্যে কাঁথি থেকে রাইমার জেঠু এসে গেছেন। কাঁথি থেকে দীঘা একটুখানি। তাই ওরা আমাকে বললেন, দীঘা গেলে ওদের এখানে যেতে আমি বললাম, "আমার পরীক্ষা শেষ হলে যাব।"
শুনে তপুমাসি আমাকে একবার চোখের কোন দিয়ে দেখে নিল
সন্ধ্যেবেলার রাইমা বেশ সেজেছিল। একবার একটা ছবি তোলা ছাড়া ওই ভিড়ের মাঝে ওর সাথে আর কোন বাকবিলাপই হল না। আনন্দ আর ব্যস্ততার মাঝে দিনটা সুখ-স্বপ্নের মত দ্রুত বয়ে গেল। পরদিন সকালে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যেতেই বিছানায় বসে মন পড়ল, এই যাহ! সেদিন বিকেলেই তো আমাদের ট্রেন। মনটা ভারী হয়ে গেল। কি একটা ভাবতে-ভাবতে উঠে ফ্রেশ হয়ে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যেটুকু রিল আছে তাতে আরও দুটো ছবি হবে।
শীতের সকাল তখনও আড়মোড়া ভাঙ্গেনি। পিছনের উঠোনটা পেরিয়ে যাবার সময় তো তপু মাসিদের দালানের দিকে সেই বেতের চেয়ারএর দিকে দেখলাম। আজও একই জায়গাতেই রাখা। এই কনকনে ভোরে রাইমা নিশ্চয়ই ভিতরের কোন এক ঘরে ঘুমিয়ে। ভোরের সম্মোহনী আলোয় ঘুমন্ত অবস্থায় ওকে কেমন লাগবে, ভাবতে ভাবতে গোলাপ বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বিস্তীর্ণ মাঠে কুয়াশার চাদর তখনও সরেনি। ভেজা মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে মনে হল সামনে এই অপরুপ স্বর্গের একটা ছবি তুলতেই হয়। এই ভেবে একটা ছবি তুললাম। তারপর আবার একটু জুম করে বাঁদিকে হালকা ঘুরে তাকাতেই, আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম আবার। মাঠের ধার দিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে এক ট্রাকস্যুট পরা অবয়ব, রাইমা!
চন্দ্রহতের মত তার দিকে চেয়ে রইলাম। ও আমার সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,"ছবিটা ভালো এসেছে?" ওর মুখে হিরের কুঁচির মত বিন্দু বিন্দু ঘামে ওকে হিমশিশিরে ভেজা গোলাপের মতো লাগছিল।
বললাম "কোন ছবিটা?"
-"আমার ছবি?তোলেন নি?আপনাকে ক্যামেরা তাক করতে দেখে কত কায়দা করে দৌড়ে এলাম।"
পারমিশন ছাড়া তুলি কি করে?
-ন্যাকামো হচ্ছে নাকি?বা-বা!
-তার আগে আমাকে এই আপনি-আজ্ঞে করাটা থামাও।
-ওকে তবে স্ন্যাপ টা নেওয়া উচিত ছিল। -অ্যাকচুয়ালি, আমি তোমাকে দেখে একটু স্টান্ড হয়ে গেছিলাম।
-আমি রোজ বাড়ি থেকে পার্ক ওব্দি সকালে দৌড়োই। এখানে এসে তাই ভাবলাম, যাই একটু জগিং সেরে আসি। শুধু মাঝের তিনদিন হয়ে ওঠেনি।
-... হলতো! পিছনে ঘুরে দেখ, আমার মা। দালানের ধার অবধি এসে গেছে। পারলে, দূরবীন লাগিয়ে দেখত আমি এই সাত সকালে নির্জন গোলাপ বাগানের পাশে তোমার সাথে কি করছি। গেলেই বলবে, "ওই ছেলেটার সাথে এত কি কথা রে?" তার পরে বাবার কাছে যাবে নালিশ। রাইমা, হাতদুটো স্ট্রেচ করতে করতে বলল ।
বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে, ওর মা এর দিকে একবার চেয়ে বললাম, "তোমার মা হয়তো ভাবছেন আমি তোমায় এখানে দেখেই এদিকে এসেছি।"
"সেটা তো সকলেই ভাববে, infact আমিও ভাবছি" - রাইমা হাঁটতে হাঁটতে মুচকি হেসে বলল।
-"তাতেও যখন রাগ না করেই ছুটে এলে, তাহলে আমার আশা আছে বলো?"
-"রাইট অ্যাপ্রোচ, হাল ছেড়োনা বন্ধু, আলওয়েস থিঙ্ক পজেটিভ"।
-"তবে তুমি আজ বাড়িতে বকা খাচ্ছ সিওর।"
-"নতুন করে কিছু খাওয়ার নেই, কাল মা তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।"
-" কি বললে"?
-"বললাম, সামনের বছর কলকাতার কলেজ এ পড়তে হবে তো, তাই কোন কলেজ ওখানে বেটার, এই নিয়েই খোঁজ নিচ্ছিলাম। ব্যাস, মা চুপ। তবে ভ্রুটা কুচকেই আছে।
-"ওটা তো হেরিডিটি "
-"মানে"?
-"মানে প্রথম দিন আমাকে দেখে তোমার ভ্রুটাও ওরমই কুচকে ছিল"
-"তা নয় তো কি? থাকবে না! আমি দেখি একটা পাগল ক্যামেরা তাক করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
- "পাগল?"
- "ইয়েস, পাগল নয়তো কি?ভর দুপুরে, সোয়েটার তার উপর চাদর, মাথায় টুপি, একগাল দাড়ি, হাতে ক্যামেরা। উফ্ মা গো মা!
-"তাতে কি, পরী দেখলে মানুষ একটু পাগল হয়েই যায়"।
- "যাহ!" রাইমার মুখ লাল হয়ে গোলাপী ভাব নিয়েছে মুখে লজ্জার ভাব ফুটেছে পরিষ্কার, এরপর ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, "Beauty lies in the art of the heart"
-" কুড বি ! তবে ছবিটা তুললে সত্যিই অসাধারণ হতো বটে"।
-"তোমার খুব ফটোগ্রাফির এর শখ না?
-" শখ না, প্যাশন, তোমার পছন্দ নয়"?
-"না.... ক্যামেরার স্মৃতি নেই, মন ও নেই। আছে শুধু যান্ত্রিকতা যাতে, সামনের জিনিসের সেই মুহুর্তের বাহ্যিক রূপটাকে ধরে রাখে "।
-"মানে?"
-"মানে,.... আমি বসে বই পড়ছিলাম, তুমি ক্যামেরা দিয়ে মুহূর্তটাকে ধরে রাখতে চাইলে।... আমি উঠে গেলাম।….তুমি পারলে না। কিন্তু তুমি যদি পেইন্টার হতে। তাহলে স্মৃতি থেকে আঁকতে পারতে। আমি যতই উঠে চলে যাই না কেন।"
- "বুঝলাম! তবে আঁকা ছবিতে কি সব ডিটেল ধরা পড়ে?"
-"সেটা নির্ভর করছে তুমি কতটা ভালো আঁকতে পারো। তাছাড়া কামেরাতেও তো সব কিছু ধরা পড়ে না।"
-"কেন?"
-"এই যেমন তুমি এখন আমার ছবি নাও। তাহলে আমি হাসিমুখে পোজ দেবো। কামেরাতে সেটাই বন্দী হবে। কিন্তু আমার মন খারাপের কোনো হদিশ ছবিটায় পাওয়া যাবে না।"
ওর দিকে নরম চোখে তাকিয়ে বললাম,"মনখারাপ?'
-"খারাপ না! আমার মনে যে আজ খুব আনন্দ" ও একেবারে ঘাড় কাত করে আমার দিকে ফেরে। চোখের গভীরে যেনো একটা বিষণ্ণতার ছবি ।
-"আমার ও মনখারাপ লাগছিল তাই এদিকে এসেছিলাম। আজ বিকেলেই ট্রেন। বলার সুযোগ পাবো না। আমি কিন্তু সত্যি তোমাকে......"
-"এই চুপ! এখন না, প্লিজ!" রাইমা চোখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। চোখে এক ভেলকি আলোর রামধনু দেখা গেলো।
-"তবে?"
-"প্লিজ! চুপ কর। মা তখন থেকে একটুও নড়েনি। আমরা প্রায় এসে গেছি। শুনে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।"
আমি ভেজা বেড়ালের মতো মুখ করে ওর মায়ের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। উনি একটাও কথা না বলে সটান নিজের মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন।
" Some stories , never go out of love"
সেদিন দুপুরের ট্রেনেই কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
সেদিন রাতে কলকাতায় পৌঁছে, বাবাকে কামেরার রিল গুলো হাতে তুলে দিয়ে ওয়াশ করে দিতে বলি।
কলেজে গিয়ে আবার ক্লাস। বন্ধুদের সাথে আবার আগের মতো আড্ডা। তবুও একলা হলেই সবটা কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছিল। একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছিলাম।
আর ওই সন্ধ্যেটা আমার পক্ষে কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অভ্যেস মতো দূরদর্শনের খবরটা চালিয়ে বসলাম। দু একটা খবরের পড়ে সংবাদ পাঠকের কয়েকটা বাক্য যেন কানের ভেতরে ফুটন্ত তেল ঢেলে দিল।
-"আজ বিকেলে NH4 রোডে একটি জিপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লরিতে ধাক্কা মারে লরি চালক নিখোঁজ। জিপ টিতে আটজন জন যাত্রী ছিলেন। ঘটনাস্থলেই তাদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন আকাশ মজুমদার (৫৩), লতা মজুমদার (৪৬),তপতী মজুমদার (৪৩) এবং রাইমা মজুমদার (১৮)। বাকিদের অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।"
জলহীন পাতকুয়ো তে কে একটা ভারী পাথর ফেলল কেউ । ধপ ।
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ঠোট , গলা শুকিয়ে আসছিল। মা শুনে প্রায় পাথর হয়ে বসে পড়লেন। বাবা একটা জনসভায় কভার দিতে গিয়েছিলেন। তখন মোবাইলের যুগ নয়। তাই খবরটা পাননি।
বেশ রাতে আমার তোলা ছবিগুলো নিয়ে হৈ হৈ করে বাড়ি এসেছিল। আমি কিছু বলার আগেই জড়িয়ে ধরে বলেছিলো "দারুন ছবি তুলেছিস । আমার মন ভরে দিলি তো !"
ছবির খামটা তারপর বহুদিন খোলাই হয়নি।
কয়েক মাস পর কি এক অমোঘ কৌতুহলে ছবিগুলো দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। এতো রীতিমত অলৌকিক ব্যাপার !
সেই ছবি এখন বিখ্যাত। বহুবার প্রিন্ট নেওয়া হয়েছে। কত প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ হয়েছে। কিন্তু ছবিটা কে আমি যতবার দেখি,ততবার কানে বাজে, "ক্যামেরার স্মৃতি নেই , মন ও নেই......."
আজো আমার ঘটনাটা বিশ্বাস হয়না,কিন্তু আমার শোয়ার ঘরের খাটটার মাথায় ওপরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটাকেই বা কি করে অবিশ্বাস করি, মনখারাপের রোদ মাখা এক অপার্থিব আলো ছায়া নিয়ে,বেতের চেয়ারে,সেই মধুরাঙা সোয়েটারটা পরে, ব্ই হাতে আমার দিকে চেয়ে রাইমা। ঠোটের কোণে রহস্য ভরা হাসি। চোখে কৌতুকের প্রতিচ্ছবি।
আমার আজকের প্রতিষ্ঠা। এত খ্যাতির একটা বড় কারণ। আমার এই না তোলা ছবি," দ্য রিয়েল ক্যানডিড"।
"if its happening it's here"
লিখনে~ সৈকত সেনাপতি
© Bartho Pionরিয়া চৌধুরী। আমাদের কলেজের সেরা মেয়ে বলা যায়। বি. বি.এ ফাইনাল ইয়ার। নামের সঙ্গে একেবারে খাপ-খাওয়ানো চেহারা। ছিপছিপে ফিগার। আগুনের তেজ এর মত হাবভাব ওর। কাটা কাটা চোখ-মুখ, একরাশ বাদামি চুলের পাহাড়ি জলপ্রপাতের উচ্ছলতা কোমর ছুয়েছে। গায়ের রং বেশি ডার্ক। কিন্তু এই রঙেই ওর সৌন্দর্যতা খুলছে আরো বেশি। শুধু ওর ক্লাসমেটরাই নয়, কলেজের সবচেয়ে স্মার্ট আর সাহসী ছেলেটাও ওর সাথে বুঝে শুনে কথা বলে।
সব ভালো এই মেয়ের। রূপে-গুণে, লেখাপড়ায় কোথায় এতোটুকু কমতি নেই। বাহিরে থেকে শক্ত দেখালেও মনটা ভেতরে ভীষন নরম। কারও বিপদে ঝাপিয়ে পড়তে ওর দু'সেকেন্ডও ভাবে না। সত্যি বলতে কি, সব ভালো ওর ! তবে খারাপ কি? আছে !! অদ্ভুত একটা নেশা আছে ওর । প্রেমের নেশা। প্রেম ছাড়া থাকতে পারে না ও ! আর এই প্রেম ভার্চুয়াল প্রেম। ফেসবুক, মেসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপে। ওর কথায় যদি কোন ছেলের সাথে প্রেম করা নাকি, হরিবল থিং ! আজ যাকে ভালো লাগছে,কাল তাকে ভালো নাও লাগতে পারে। কিংবা পরশু তার এমন কোন গুণের কথা হয়তো টের পেলে তারপর, তার সঙ্গে আর এক সেকেন্ডও কথা বলতে ইচ্ছেই করল না। তখন? তখন কি হবে? তখন তাকে বদলানো কিন্তু হ্যাপার কাজ! রিয়ার কথায়, "বিগ থিং"
রিয়ার বেস্টি, দেবযানি আর সুস্মিতা বলে,"তুই একটা আস্ত পাগল রে, রিয়া!"
-"হোয়াই?"ফোঁস করে ওঠে রিয়া।
-"আরে বাবা একটা ডিজাইন ছেলের সঙ্গে যেভাবে তুই ইমোশনালি অ্যাটাচ হতে পারবি, সব সময় পাশে পাবি, তোর ভার্চুয়াল প্রেমিক পারবে তোকে এসব দিতে?"
-"হুম.... খুব পারবে । পড়তে পড়তে খোপরি হ্যাং করে গেলে ওর সঙ্গে মাত্র টেন মিনিটস্ চ্যাট। উফ্...পুরো খোলা হাওয়া রে!
বিন্দাস মুডে আবার পড়তে বসে যাই। আবার যখন ধর,মায়ের কাছে ঝা খেয়ে মুড খিচড়ে থাকে।ওই তো সুদ করে। হয় হয়,সব হয়.... উম।"
- বলে দুই ঠোঁট জুড়ে চোখ পিটিয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গি করল রিয়া।
দেবযানি আর সুস্মিতা প্রায় সমস্বরে বললো,"মানে, উমম কি রে?"
-"লিভ ইট....বুঝবি না তোরা, বেবি গার্লস ! "
দেবযানি কুর্তি টেনে ধরে সুস্মিতা,তারপর ঠোঁট ফুলিয়ে বলে ," অ্যাই চল তঃ, বুঝে কাজ নেই।"
- "আরে মোটা রানী, রাগ করছিস কেন? আই মিন টু সে..... ভার্চুয়াল প্রেম সত্যি ভালো রে। এই যে দেখ না,তোর বয়ফ্রেন্ডকে খুশি রাখতে তোকে কত law and orders মেনে চলতে হয়। ঠ্যাং ব্যাথা করুক বা মাথাই ধরুক, সপ্তাহে atleast তিন- চার দিন মিট তো করতেই হয়।ভালো লাগুক বা না লাগুক , CCD তে কাপুচিনো খেতে ঢুকতেই হবে। তারপর ধর birthday, এই ডে, ওই ডে এটা ওটা গিফট দেওয়া..... " এসব আঙ্গুল দিয়ে গুনে গুনে বলতে থাকে রিয়া।
"হয়েছে মা !! থাকো তুমি তোমার ডিজিটাল প্রেমিক নিয়ে। কিন্তু, বিপদে পড়লে বলতে এসো না যেন" মুখ চোখ পাকিয়ে কথাগুলো বলেই সুস্মিতা উঠে পড়ল।
দেবযানিও সিরিয়াস মুখে বলল,"সুস্মিতা , ঠিকই বলেছে রে রিয়া। তুই বসে বসে সারাদিন ফেসবুক একই প্রেম করিস বলতো?টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স তুই তো অনলাইনে থাকিস দেখি। যা হচ্ছে চারিদিকে আজকাল! Take care রে।"
দেবযানি আর সুস্মিতার ওপরই রিয়ার যত হম্বিতম্বি।অথচ ওদের না হলে,এক মুহুর্ত চলে না ওর। ওদেরও চলে না রিয়াকে ছাড়া। রিয়ার ভাষায় ওরা ওর,' most important persons in life...'এত মিল ওদের তিনজনের।কিন্তু মজার কথা সুস্মিতা বা দেবযানি
কারোরই কিন্তু রিয়ার মতো ডিজিটাল আসক্তি নেই। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে দিনরাত চিপকে থাকে না কেউই।
কি অদ্ভুত মেয়ে মাইরি, রিয়াটা। টিউশন ক্লাসে নোটস নেওয়ার সময়ও 5 মিনিট অন্তর অন্তর ওর চোখ ছুঁয়ে যায় পাশে রাখা স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে। অসহ্য লাগে সুস্মিতার,ভাবে বেশ কিছুদিন কথা বন্ধ করে দিয়ে জব্দ করবে ওকে,পেরে ওঠে না। কেউ কিছু বলতে পারেনা ওকে,কারণ রেজাল্ট বরাবর দূর্দান্ত ওর।
পড়াশোনার কথা উঠলেই বুকে হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে বলে, "পড়াশোনায় ফাঁকি ?no way , that's most important thing for me yarr "
সেদিন ছিল রোববার। হঠাৎই রিয়া সাত সকালে সুস্মিতাকে ফোন করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, 'হারিয়ে গেছে'
ছুটির সকালে ঘুমটা চটকে যাওয়ার ফলে স্বভাবতই বিরক্ত সুস্মিতা চোখ না খুলেই," খুজে দেখ" বলে ফোনটা কেটে দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে।
আবার ভাইব্রেট করে উঠলো ফোনটা। রিসিভ করে কানে ধরতেই রিয়া কাতর সুরে, "কোথায় মোটু? কোথায় খুঁজব বল?"এবার উঠে বসে সুস্মিতা,"কি ব্যাপার? কি হারিয়েছে রে?"
- সুজয়। কোথাও পাচ্ছিনা ওকে এফ-বি তে নেই, মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে কোথাও মেসেজ সিন করছে না, কল রিসিভ করছে না গত দুদিন। তাই আর থাকতে না পেরে তোকে বললাম।
-"ওহ আচ্ছা। তোর ওই মালটা? গিয়েছে তাহলে মর্কটটা! বাঁচা গেছে।"
-"তুই এ কথা বলতে পারলি মোটু? Try to feel my...."
ঝপ করে সিরিয়াস হয়ে যায় সুস্মিতা। কথা থামিয়ে দিয়ে বলে, "রাখ তোর feeling ! শোন রিয়া, ওইসব চুলে লাল রং করা বখাটে টাইপের ছেলেগুলো এই রকমই হয় জেনারেলি। ফেক প্রোফাইল খুলে ওরা মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করে। বোর হয়ে গেলেই কেটে পড়ে টকাস করে। তোকে বলিনি আগে? সাবধান করিনি!"
দুদিন কেটে গিয়েছে।সুস্মিতা ফোন বা মেসেজ কিছুই করেনি রিয়াকে। থাক ! দু-নম্বর ধাক্কাটা একাই সামলাক ও। এর আগেও এমন হয়েছিল একবার। তাও শোধরায়নি ও। হোয়াটসঅ্যাপ এ মেসেজ করেছিল একবার। তাও দেখেনি সুস্মিতা। বুধবার সাড়ে এগারোটা নাগাদ হাজির হলো সুস্মিতা ওর বাড়িতে।
-" অ্যাই রিয়া,জলদি, get ready. বেরোবো"
-"আরে কোথায়?"
-"বলছি পরে। আগে বেরোই চল৷"
-"না, মুড অফ'...i won't go"
- "শোন রিয়া,এরকম মুড অফ করে কেউ বসে থাকে?just no way ... চাল রেডি হ babe"
রেডি হবে কি, মুখখানা বাংলার পাঁচের মত করে বসে রইল রিয়া।
ওর কানের কাছে মুখ এনে সুস্মিতা বলল, "আরে আমার রজত দা জব পেয়ে নতুন গাড়ি কিনেছে আমরা ট্রিট চেয়েছি। আজ অফিসের লিভ নিয়ে ও আমাদের একটা দারুণ জায়গায় নিয়ে যাবে।"
-রজতদা মানে তোর পিসির ছেলে তাই তো?
- "হুমম, তো পাড়ার ছেলে।"
সুস্মিতার পিসি বাড়ি রিয়ার পাড়াতেই তারপর ওরা স্কুলের বন্ধু, তাই সুস্মিতা আর রিয়ার মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের একটা কারণ এটাও বলা যায়।
রজতদার নাম শুনে নাক সিঁটকে চোখ ঘুরিয়ে রিয়া টেনে টেনে বলল,"ইস... ওই রজত!.... আর মুখে সবসময় একখানা আজব টাইপের হাসি।"
-"শাট আপ, রি। He is enough smart at all, রজত তার মত অ্যাচিভার ছেলে কটা আছে বলতো আই এম টপার। এই বয়সে এত বড় চাকরি-ঝাক্কাস গাড়ি-আর কি চাই?"
রিয়ার তবু মুখ ভার, ঠোঁট ফুলে আছে বিরক্তিতে ভুরু কুচকে আছে।এদিকে সাই সাই করে ছুটছে রজত দার চকচকে নতুন লাল রংয়ের আই টোয়েন্টি। ইকোপার্কের ঠিক উল্টোদিকে দুর্দান্ত একটা ক্যাফেটেরিয়া কাম রেস্তোরা আছে পাঁচতলার ওপর সেখানে, সারাদিন হৈ হৈ করে কাটাল ওরা। অদ্ভুত সুন্দর জায়গাটা লম্বা করিডোর জুড়ে বেতের চেয়ার টেবিল সাজানো, সারি দিয়ে রাশিরাশি ফুলের টব তাতে ফুটেছে লাল টুকটুকে গোলাপ থেকে শুরু করে মন ভালো করা নানা রঙের ফুল।
সন্ধ্যা নেমেছে সবে উল্টোদিকে ইকো-পার্কের বাজি প্রদর্শনীশুরু হয়েছে। নানা রকম নকশার আলোর ফুলকি ভেসে আসছে আকাশের বুকে,পরক্ষনেই আবার ভোরের বকুলের মতো ঝরে যাচ্ছে।
ওরা চারজন খোলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। খেয়ালই করেনি রিয়া, যে সুস্মিতা আর দেবযানি কখন যেন একটু দূরে সরে গেছে ওর থেকে। পাঁচ তলার উপর থেকে নিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে অসংখ্য চলমান আলোকবিন্দু গুলোকে গুনছিল রিয়া, মন দিয়ে। অদ্ভুত এক মন ভালো করা হাওয়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওকে। হঠাৎ চমকে উঠলো রজতের এক কথায়,"কি গুনছো রিয়া?"
-'আলো' এই প্রথম রজতের দিকে তাকিয়ে হাসলো ও।
- "আলো! দারুন তো"পাল্টা হাসি মুখ নিয়ে রিয়ার দিকে একবার তাকাল রজত।
কি অদ্ভুত দৃষ্টি এই ছেলের, তাকাতে পারলো না রিয়া। চোখ নামিয়ে নিল মনে মনে বলল, অসহ্য! এর চেয়ে ফেসবুকে ছেলেগুলো মাচ বেটার এমন হা করে মেয়েদের দিকে তাকায় না ওরা!"
রজত কি ওর মনের কথা পড়তে পারল? তক্ষুনি বলল,"বাই দ্যা ওয়ে রিয়া শুনেছি,তুমি নাকি জলজ্যান্ত বন্ধুর চেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধুই বেশি পছন্দ করো?"
" তোমার কি বাপু , আমার যা খুশি আমি তাই করি। আর কথার কি ছিরি, জলজ্যান্ত বন্ধু ! তুমি একটা জলজ্যন্ত আকাট।"মনে মনে বলে দাঁত কটমট করে রজত দার দিকে তাকালো রিয়া। দেখে মনে হচ্ছে, এক্ষুনি ভস্ম করে দেবে যেন !
রজত কিন্তু থামে না বলতে থাকে, 'বেশ ইন্টারেস্টিং', কিন্তু অচেনা-অজানা লোকজন... বাস্তবে যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই.... বা আজ আছে কাল নেই।
-"Stop it please!! I am happy with them"
-"ওহো, তবে তো আজ আমাদের সঙ্গে তোমার খুব দুঃখে কাটলো নাকি"- কথাগুলো বলে হাসি হাসি চোখে রিয়ার দিকে তাকালো রজত।
কি যে হল রিয়ার! চোখ জ্বালা করে উঠল ওর। ঘাড় বেকিয়ে তাকালো রজতের চোখের দিকে। নাখ ফুলিয়ে খুব রাগ দেখিয়ে বলল,"হ্যাঁ কাটলো দুঃখের
.....হল?"
হাসছে ঐ আকাটটা ! রাগে গা জ্বলে উঠলো রিয়ার,ওই ছেলেটা এত গায়ে পড়া কেন? অসহ্য! এক্ষুনি সাংঘাতিক কিছু একটা না করলে চলছে না রিয়ার, একটু সরে গেল, তারপর সোজা চলে গেল সিঁড়ির দিকে,তারপর হুড়মুড় করে নামতে লাগল নিচের দিকে। রজত,দেবযানি,সুস্মিতা ও লিফটে করে নিচে নেমে গেল তখনই লিফটের গেটের ভেতর থেকেই ওরা দেখতে পেল, রিয়া দৌড়ে গিয়ে অটোতে উঠে পরল। অটোটা স্পিডে বেরিয়ে গেল।
এরপর কেটে গেছে পুরো পাঁচ টা দিন। পাঁচ দিনের মাথায় রিয়াকে ফোন করলো সুস্মিতা বেশ কয়েকবার সুইচ অফ বলল প্রতিবারই। এবার একটু চিন্তা হলো ওর। সেদিনের পর থেকে কোন যোগাযোগ নেই রিয়ার সাথে। কলেজ,টিউশন কোথায় তো আসছে না ও।
বিকেলে রিয়ার মাকে ফোন করল সুস্মিতা উনি জানালেন, রিয়ার শরীরটা ভালো নেই।
টিউশন থেকে সোজা রিয়ার বাড়িতে হাজির হল সুস্মিতা,' আয়' বলে মিষ্টি করে হেসে সুস্মিতাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল রিয়া।
সমুদ্র নীল টি-শার্ট আর হোয়াইট শর্টস এ কি যে মিষ্টি লাগছিলো রিয়াকে, পরী একদম! বনরানির মত এলোমেলো চুলের রাশি ঘিরে আছে ওর মুখখানা। শুধু একটু শুকনো যেন।
সুস্মিতা ওর গালটা টিপে দিয়ে বলল,"মাই কিউটি!"
"উম...ম" নাক মুখ কুঁচকে,মুখে আদুরে আওয়াজ করলো রিয়া তারপর দুজনে মুখোমুখি বসলো বিছানার ওপর। সুস্মিতা জিজ্ঞেস করলো,"কিরে?কি হয়েছে তোর?ফোন সুইচ অফ?"
-"হুমম!"
-"কেনো?"
-" ডিজিটাল ডিটক্স..."
-" মানে!"
-"মানে, try to stay part from the mobile"
-"really?"মিষ্টি করে হেসে বলল রিয়া। আজকের এই রিয়াকে কেমন যেনো আলাদা রকম লাগছে সুস্মিতার। দীপশিখার মতই উজ্জ্বল, শুধু একটু যেনো শান্ত স্থির।
ট্রে তে করে গরমাগরম কফি আর চপ নিয়ে এলেন রিয়ার মা। রিয়া ও সুস্মিতা দুজনেরই খুব favourite।সেগুলোকে শেষ করে আরও ১০মিনিট বাদে যাওয়ার জন্য উঠল সুস্মিতা। যাবার আগে রিয়াকে বলল," শোন, ফোনটা যদি অন করিস, হোয়াটসঅ্যাপটা চেক করিস একবার । একটা ভিডিও পাঠিয়েছি...মুড হলে দেখিস।"
আজ নিয়ে পুরো পাঁচ দিন মোবাইল ব্যতীত কাটিয়েছে রিয়া। বুঝতে পেরেছে এই ডিজিটাল আসক্তি কাটানোর দরকার ওর জন্য।
রাত্রিবেলা ডিনারের পর মোবাইলটা ড্রয়ার থেকে বের করল রিয়া। ও সুইচ অন করে মোবাইল ডাটা অন করল।ফেসবুক, মেসেঞ্জার সহ আরো অনেক অ্যাপই আগেই আনইন্সটল করে দিয়েছে কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপটা রয়ে গেছে।
হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে সুস্মিতার পাঠানো ভিডিওটা ডাউনলোড করলো প্লে করতেই বেজে উঠলো,
"All i knew it.... it's a rhythm divine...last in the music, your heart will be mine " - এটা রিয়ার খুব পছন্দের গান। সুস্মিতার রজত দা গিটার বাজিয়ে গাইছে, স্টেজে... কোন প্রোগ্রামে বোধহয়....তারই রেকর্ড।
ফোনটা বুকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুনছিল।নতুন ধরনের আশ্চর্য এক ভালোলাগায় ভরে উঠেছিল ওর ইন্দ্রিয়। খুব ভালো লাগা কি কষ্ট দেয় মানুষকে? জানতো না রিয়া কারণ ছাড়াই দু চোখের পাতা ভিজে উঠলো ওর টপ-টপ করে দু'ফোঁটা জল ঝরে পড়লো মোবাইলের স্ক্রিনে ভিজিয়ে দিল রজতকে....
"ভালোবাসা ফোনের স্ক্রিনে না, মনের হৃদয়ে থাকে…."
লিখনে~ সৈকত সেনাপতি
© Bartho Pion১৯শে অক্টোবর : (দশমী)
ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল পিয়ালীর, নবমীর রাতে বন্ধুদের সঙ্গে দারুন হইহল্লা হয়েছে। এবার তাদের অবসান, টিভির চ্যানেল ও রং এর কোম্পানি মিলিয়ে প্রায় ছয়টা প্রাইজ পেয়েছে আমাদের পাড়া।
প্রতিদিনই মাথায় ফুল গুজে, বেনারসী পরে তারাও পাল্লা দিয়ে সেজেছে। কিন্তু পিয়ালীর মন ভালো নেই। কাল থেকে রনো তাকে একটা ফোন করেনি, এমনকি SMS ও না। নিশ্চয়ই রাগ হয়েছে, পিয়ালীর ভাবতে ও ভালো লাগে, যে রনো তার ওপর রাগ করেছে। কিন্তু বাস্তবে তেমন হয়েছে কী কখনও? সপ্তমীর সকালে যখন দেখা হয়েছিল, তখনই পিয়ালী বারবার বলেছিল, "আবাসন ছেড়ে বেরোতে
পারব না, তুমি এসো। বিকালে না পারলে সকালে"। যদিও সে জানতো রনো কখনই এত হট্টোগোল এর মাঝে আসবে না। কিন্তু তাই বলে একটা ফোন বা SMS করবে না?
রনো দাড়ি রাখছে বলে মুখটা অন্যরকম লাগছিল। পিয়ালী বলেছিল, "চেহারা র সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবটা ও যেন বদলে যাচ্ছে। চারিদিকে কেমন ফেস্টিভ মুড, আর তুমি শুধু পেঁচার মতো মুখ করে বসে আছো।"
রনো বরাবরের মতো পিয়ালীর অজস্র কথার উত্তরে একটা মুচকি হেসেছিল শুধু। পিয়ালী তার মসৃণ কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তা করেছিল যে সে রণোর ওপর রাগ করবে কী করবে না ! কারণ রণো তার রাগ ভাঙাবে, এতটা আশা করাই যায় না।
আজ "বিজয়া দশমী"
তাই ঢাকের আওয়াজটাও বদলে গেছে। বলছে,"আসছে বছর আবার হবে।"
পিয়ালী মোবাইলে বড় বড় অক্ষরে লিখল " শুভ বিজয়া"। তারপর পাঠিয়ে দিল রনোর মোবাইলে। ডাইনিং টেবিলে রাখা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে বাবার ঘরে এল পিয়ালী। বাবা কাগজ পড়ছেন মন দিয়ে। পিয়ালীকে দেখে বললেন, "কীরে মুখটা ওরকম কেন? পূজো শেষ বলে মন খারাপ?" পিয়ালীর কর্মকান্ড বাবার ভালো না লাগলেও ব্যবহারে কোনও তারতম্য ঘটে না। কিন্তু মা একেবারে উল্টো। পিয়ালীর স্বাধীনতায় বাবা কখনোই হস্তক্ষেপ করে না। পিয়ালীর বিয়ে না করাটা কোনও ভাবেই মেনে নিচ্ছিল না, মা শুরুতে। কিন্তু যেদিন থেকে রনোর কথা জেনেছেন, স্বাভাবিকভাবেই কোনো কথা বলেনি।
-"মা কোথায়?" জিজ্ঞাসা করলো পিয়ালী
-'আবার কোথায়? মন্ডপে। শেষ নতুন শাড়িটা পরতে হবে না!'
-"শেষ কোথায়? এখনও লক্ষীপূজো, কালী পূজো, যীশুপূজো সবই তো বাকি!"
পিয়ালী চোরা দৃষ্টি দিল মোবাইলে। নাহ্ তৈরী হয়ে মন্ডপে যাওয়াই ভালো। অকারণ বিষণ্ণতা মুছে স্নান সেরে ঘাস রঙের ওপর সাদা রঙের নতুন সিল্কের শাড়িটা পড়ল। খয়েরি স্ট্রিক করা রেশমি চুলগুলো ফণা তুলে রইল কাঁধের ওপর। নতুন শাড়ি, সুগন্ধি, ম্যাচিং জুয়েলারী জাদুকাঠির মতো ছুঁয়ে দিল পিয়ালীকে। বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলে সবুজ প্রজাপতির মতো উড়ে গেল সে পাড়ার এক ঝাঁক বন্ধুদের মাঝে। যাওয়া মাত্রই কোলাহল, এ ওকে কমপ্লিমেন্ট, রেস্তোরাঁর খাবার প্ল্যান হয়ে গেল। ওখানে রাজু বলল, "দারুণ দেখাচ্ছে তোকে, রনো মিস করল। অত বুড়ো হলে এই হয়, এনার্জি নেই।"
রনো সম্পর্কে বুড়ো শব্দটা শোনা পিয়ালির এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। বিয়ে করার কথা ওরা কেউ ভাবে না। অথচ গায়ে গায়ে লেগে আছে আজ প্রায় তিন বছর। মা প্রথমের দিকে প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন, বাবা গম্ভীর হয়ে থেকেছেন। তারপর সময়ের সাথে সেসব চাপাও পড়ে গেছে। পিয়ালি মা বাবার একমাত্র সন্তান। স্বাস্থ্যবতী, নিজের বাড়ি, সরকারী কর্মচারী। সে নিজেই দু-দুখানা স্বামী পুষতে পারে। এমন মেয়ের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে আর কতদিনই বা টানা হেঁচড়া করা যায়। রনোর কথা উঠতেই মোবাইলে চোখ গেল পিয়ালীর। কত SMS তো আসছে। কিন্তু যারটা চাই, তারই পাত্তা নেই। যাক গে, পিয়ালীও আর ভাববে না। থাকুক যে যার মতো।
ঠাকুর বিসর্জন যাবে আর একটু পরে। তার আগে মায়ের প্রতিমার বরণ করছে সবাই। প্রতিমার পায়ে সিঁদুর ঠেকিয়ে, সেটা পরিয়ে দিল একে অন্যকে। পিয়ালীদের দলটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল সেসব। রাজু গম্ভীর মুখ করে পিয়ালীকে বলল,"পরেরবার ওই সিঁদুর খেলার দলে তুইও থাকবি তো ?" রাজু পিয়ালীর খুব ছোটবেলার বন্ধু। এখনও মাঝে মাঝে এই জাতীয় ঠাট্টা করে। যদিও তার ও রনোর সম্পর্ক নিয়ে বাকি সবাই নীরব।
চারিদিকে আলো উৎসবের মাঝে আর একজন পিয়ালী একটু দুরে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে, একা। যতই সে চেষ্টা করছে বিষণ্ণতাকে ঝেড়ে ফেলতে, সেটা পায়ে পায়ে পোষা কুকুরের মতো আবার জড়িয়ে ধরছে। আসলে পিয়ালীর যে কোথায় লাগছে, সে নিজেও ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। মা বাবা, কর্মক্ষেত্রের বন্ধু-বান্ধব…কিছু জায়গায় পিয়ালী যথেষ্ট শক্ত হতে পারে, অথচ এই একটা জায়গায় কী কারণে যে সে পরিষ্কার নয়। রনো কি সত্যিই তার সেই কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ? আবার ভাবে হয়তো তার উদাসীন গা আলগা ভাবটাই পিয়ালীকে আরাম দেয় বেশী, পিয়ালীরও বিয়েতে অনীহা, সেইজন্যই কি ? বিয়ে করে স্বামী-ছেলেপুলের কথা ভাবতে তার গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। রনোর আগে পিয়ালীর দু-তিনজনের সাথে সম্পর্ক ছিল। তবে রনোর জীবনে সে একমাত্র নারী। এই মানুষটা তাকে ছাড়া আর কাউকে কোনদিন স্পর্শ করেনি, এটা ভাবলে এখনও পিয়ালীর লোম শিরশির করে ওঠে। বাইরের পৃথিবী নিয়ে তার খুব একটা আগ্রহ নেই, এইরকম একটা লোক যখন তাকে গভীর আলিঙ্গন করে, অন্তরঙ্গতার চরমে পৌছায়, তখন পিয়ালীর মনে মিলনের তৃপ্তির সঙ্গে নতুন একটা অহঙ্কার ও মিশে যায়।
সব কাজ সেরে পিয়ালি যখন মায়ের সঙ্গে ফ্ল্যাটে ঢুকল তখন প্রায় দশটা বাজে। মোবাইলে কোনও মেসেজ আসেনি, পিয়ালী আর থাকতে পারল না। রনোর এহেন ব্যবহারের অর্থ কী ? জামাকাপড় না ছেড়েই সে ডায়াল করল রনোর নম্বর। কয়েক মুহূর্ত পরে এক ধাতব নারীকণ্ঠ বলে উঠল, “দ্য নম্বর ইউ আর ডায়ালিং ইজ প্রেজেন্টলি সুইচড অফ।” রনো নিশ্চয়ই তাকে এড়ানোর জন্য ফোন বন্ধ রেখেছে। টান মেরে শাড়িটা খুলে, বিছানায় শুয়ে আলো নিভিয়ে দিল। মোবাইলটাও বন্ধ করে দিল। কাউকে আর দরকার নেই ওর।
২১ শে অক্টোবর : (দ্বাদশী)
একাদশী চলে গেল রাগ, দুঃখ অভিমান সব এক সঙ্গে নিয়ে দ্বাদশীর দিন পিয়ালীর সহ্যের বাঁধ ভাঙতে লাগলো একটু একটু করে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কারও ফোন বন্ধ থাকে? আচ্ছা জ্বর হয়নি তো? বা অন্য কোনও বিপদ? এটা মনে হওয়ামাত্র কূলহারা জলস্রোতের মতো উদ্বেগ তাকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল। কী স্বার্থপরের মতো সে ! শুধু নিজের মান অভিমান, রনোর জীবনে তার গুরুত্ব কতটা, এসব অর্থহীন চিন্তায় কত সময় নষ্ট করেছে। খুব সাংঘাতিক কিছু নিশ্চয় ঘটেছে
হয়তো তিনদিন হয়ে গেল একবারও যোগাযোগ করলনা! এমন তো কোনও দিনও হয়নি। কাকা, কাকিমা বুড়ো মানুষ নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে উঠেছেন।
পিয়ালীর অফিসের ছুটি হওয়া পর্যন্তও আর অপেক্ষা করলনা লাঞ্চব্রেক এর পরেই দেওদার স্ট্রিট-এ রনোদের বাড়ির সামনে এসে বেল বাজাবার আগে খানিক্ষন অপেক্ষা করল পিয়ালী, লাল রঙের বাড়িটার কাছে যখনই আসে, তখনই এই বেল বাজাবার আগে নিজের বুকে হাজার ঘন্টা বাজে। প্রতিবার মনে হয় দরজা খুললেই বদলে যাবে জীবন।
অক্টোবর মাসে রোদের ঝাঁজটা বেশ কড়া। তা সত্ত্বেও পিয়ালী সানগ্লাসটা খুলে ব্যাগে রেখে দিয়ে বেলে হাত ছিল। কেন জানা নেই, তার বুক ঢিপঢিপ করছে। মনে হচ্ছে, কোনও খারাপ খবর কি তার জন্য অপেক্ষা করছে? রনোদের বাড়িতে একতলায় সপরিবারে থাকে অভয়দের পরিবার অনেক কাল আগে থেকেই। সে দরজা খুলে পিয়ালিকে দেখে একটু অবাক হলেও মুখে প্রকাশ করল না।
বলল "আসুন,"
পিয়ালী অভয়ের মুখে ভরসা পেল,পুরোনো বাড়ির শীতল মেঝে,ছায়া ছায়া দেওয়াল পেরিয়ে যেতে যেতে পিয়ালী অভয় কে জিজ্ঞাসা করল, "দাদাবাবু কোথায়? ঘরে?" অভয় এবার আশ্চর্য হয়ে বলল, "এ-কী? আপনিও জানেন না? দাদাবাবু তো কলকাতার বাইরে গিয়েছেন। অষ্টমীর ভোরে।"
-"কবে কিরবেন বলেননি?"
-"মনে হয় লক্ষীপুজোর পর। ওই সময় অফিস খুলবে, তাই না?"
অভয় ঠিক সেই অর্থে কাজের লোক নয়। তাকে পরিবারের সদস্য বলেই জানে সকলে। পিয়ালীর সাথে রনোর সম্পর্ক তার অজানা নয়। সেই জন্যই পিয়ালীর বিস্মিত মুখ দেখে সে বলল, "হঠাৎ ঠিক হয়েছে মনে হয়। ছোট মা জানবেন ভাল করে"
রনো কখনই নিজের ছোটবেলা-মা-বাবা এসব নিয়ে গল্প করে না, খুব স্বাভাবিক। বলার মতো কী-ই বা থাকতে পারে, মা-বাবা হারানো একটা ছেলের? পিয়ালীও ওই স্পর্শকাতর জায়গাগুলো এড়িয়ে যায়। ঠাকুমা,কাকা-কাকিমার কাছেই মানুষ রনো। রনোর ঠাকুমাকে পিয়ালী দেখেনি। তবে রনোর কাছে গল্প শুনেছে ও ছবি দেখেছে।
কাকার ঘরে দেওয়ালের মাথায় পরিবারের মৃত সদস্যদের ছবি, ছবি গুলোর ধোঁয়া ও ধুলোর ঝাপসা। ঘরে টিভি চলছে। কাকা চেয়ারে বসে আছেন। বড় বড় দুপাল্লার জানালা দিয়ে ঘরের লাল মেঝেতে আলো এসে পড়ছে। পিয়ালীকে দেখে দুজনেই যেন হাতে চাঁদ পেলেন। কাকা বললেন,"এই তো পিয়ালী এসেছে। ওর কাছে যদি না খবর থাকে তো আমি এখনই, যার থানায়"
কাকিমা বিপণ্নমুখে বললেন, "দেখতো, কী বিপদে যে পড়েছি, তুই ঠিক মনের কথাটি বুঝে এসে পড়েছিস। দুদিন ধরে তোর কাকার কাছে বকুনি খাচ্ছি, তোর ফোন নম্বর নিয়ে রাখিনি বলে। তোকে ফোন করেছে রনো?"
-"কোত্থেকে ফোন করবে? আমি তো জানিইনা না যে ও বাইরে গিয়েছে। যখনই ফোন করেছি তখনই ফোন বন্ধ। ভাবলাম গিয়েই দেখি। অভয়ের কাছে শুনলাম ও কলকাতায় নেই। কবে গেল?"
-" অষ্টমীর দিন ভোর বেলায়"
পিয়ালী জানে, রনো একটু অন্যরকম। হয়তো এই অন্যধরনটার জন্যই তার এই অসহায় সমর্পণ। কিন্তু তা বলে এত অদ্ভুত ব্যবহার! অভিমান ভোলার জন্য এই পিয়ালী জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল,"এই দেখো ! বিজয়ের পর এলাম আর তোমাদের প্রণাম করতে ভুলে গিয়েছি।"
কাকিমা বললেন, " আরে ঠিক আছে ঠিক আছে...দাঁড়া ভুলে যাবার আগে তোর ফোন নম্বরটা লিখে নিই। "
কাকা মুখে অসন্তোষ স্থায়ী ছাপ ফেলে রেখেছে, পিয়ালীকে বললেন, " ও বলল কদিনের জন্য ঘুরে আসছি, ভাবলাম গোপাল নিশ্চয়ই সঙ্গে আছে। এই কদিনের মধ্যে কোন খবর না পেয়ে দুজনের ফোনে ফোন করছি দেখি সুইচড অফ। অভয় কে পাঠালাম গোপালের বাড়িতে শুনলাম সে দেশের বাড়ি গিয়েছে কালী পুজোর পর আসবে। তোমার ফোন নম্বর ছিল না। কি দুশ্চিন্তায় যে পড়েছে কি বলবো!"
এবার পিয়ালীও উদ্বিগ্ন হয়। রনোর কোনো বিপদ হয়নি তো? নিঃসন্তান কাকা-কাকীমার কাছে রনো যে কতখানি প্রিয়, সে তা জানে। কাকিমা মিষ্টির প্লেটটা রাখলেন তার সামনে। পিয়ালী দেখলো, কাকিমার হাতের তৈরি খিরের গজা যা তার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু আজ একদম ইচ্ছে করলো না। সে একটা নিতে হয় বলে নিল। অন্য সময় হলে কাকিমাও চাপাচাপি করতেন কিন্তু এখন কিছু বললেন না।
কাকা পিয়ালী কে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার কি মনে হয় না ব্যাপারটা খুব এ্যাবনরমাল? যেখানেই যাক! একটা ফোন তো করবে।"
কাকিমা উদ্বেগের সীমায় পৌঁছে গিয়েছেন। বললেন, "তোর কাকা তো অস্থির হয়ে পুলিশে খবর দেবে বলছে!"
এই কথাটা পিয়ালিরও মনে উকিঝুকি মারছিল। কিন্তু রনো যদি আচমকা কালই এসে পড়ে? রনোর এই অনুপস্থিতি কে নিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পিয়ালীর ঠিক সাহস হচ্ছে না। সে সবদিকে বাঁচিয়ে বলল,"অভয়ের কাছে শুনলাম লক্ষ্মী পুজোর পরে আসবে!"
-" আন্দাজে বলছে আমাদেরই বলেনি কোথায় যাচ্ছে আর কবেই বা ফিরবে! লক্ষ্মীপূজো অব্দি অফিস বন্ধ তাই ও ধরে নিয়েছে। "
-" আর দুটো দিন দেখলে হয় না? এর মধ্যে যদি না ফোন করে তবে শেষ পর্যন্ত পুলিসেই যেতে হবে.. "
কাকা বললেন, "নাহ, আর একদিনও অপেক্ষা করবো না। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, আমি আসছি। "
রনো তার গোয়ার্তুমি টা পারিবারিক সূত্রেই লাভ করেছে। এখন যতক্ষণ না থানায় যাওয়া হবে কাকা শান্তি পাবেন না। এটা পিয়ালী আগেও দেখেছে এদের সিদ্ধান্তের নড়চড় হয় না। রনো আর কাকার মাঝে পড়ে বেশি ভুগতে হয় কাকিমাকেই।
সেই কোন ছোটবেলায় খেতে বসে রন আলু ভাজা খেতে চাওয়ায় কাকিমা বলেছিলেন এখনই পারবেন না, কাল করে দেবেন। রনো তারপর রাগ করে ১ মাস শুধু সাদা ভাত খেয়েছে।
পিয়ালীও এক মেয়ে। যথেষ্ট আদর সেও পেয়েছে তবে রনোর তুলনায় সেটা কিছুই না। কাকিমাকে সে কথা বললেই উনি বলেন, " বুঝিস না কেন ও ছাড়া আমাদের আর আছেই বা কে? ওকে নিয়েই তো জীবন"
থমথমে পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য পিয়ালী বলে উঠলো, " ডাইরি করলেই দেখবে এসে পড়বে আর কিরকম চোটপাট চালাবে!"
কাকা গম্ভীর হয়ে বললেন,"করুক চোটপাট,দুশ্চিন্তা করার কষ্ট ও কি জানবে!" পিয়ালীর আর ভালো লাগছিল না, সে উঠে পড়ল।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় হালকা অন্ধকারে চাদর জড়িয়ে নিয়েছে শহরটা। শীত আসতে এখনও দেরী আছে। তবু গা টা শির শির করে উঠল ওর। দোপাট্টা ভালো করে জড়িয়ে প্রতিদিনের অভ্যেসমতো রণো দের লাল-সাদা-সবুজ রঙের বাড়িটাকে দেখল পিছন ফিরে। এখন বাড়ি ফেরার পথে দরজার প্রেমে রনো নেই। এর আগে কখনও এরম হয়নি। রনো-হীন বাড়িটাকে তার মনে হচ্ছে সিমেন্ট-বালি-ইট-কাঠের স্তূপ। চার বছর আগেও সে চিনত না রনোকে। কোনো পুরুষ মানুষকেই বেশি গুরুত্ব দিতে সে প্রস্তুত ছিল না। পিয়ালীর অফিসের কলিগ, সামন্তবাবুর বউ মারা যেতে পিয়ালী গিয়েছিল সৌজন্য সাক্ষাতে। সমস্যার গভীরতা নিয়ে ভাববার কোনও ইচ্ছে তার ছিল না। সেখানেই দেখে রনো কে। সামন্তর ছেলে দুটোকে যাতে ভালো রাখা যায় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সামন্ত রনোর পার্টনার এর প্রতিবেশী। অনাত্মীয় এর জন্য এমন নিঃস্বার্থ কাজ দেখে পিয়ালী আপ্লুত হয়েছিল। তারপর কখন যেন সে, ধীরে ধীরে জড়িয়ে গেছে রনোর জীবনের সাথে। আজ শূণ্য দরজার দিকে তাকিয়ে তার হঠাৎ মনে হলো, যেনো রনোর সঙ্গে তাঁর আর কোনওদিন দেখা যাবে না।
পরদিন ও পিয়ালী অফিস ফেরত দেওদার স্ট্রীটে এলো। প্রতিবারই তার লাল বাড়িটাকে আর একটু বিবর্ণ আর একটু পুরনো মনে হতো। থানায় ডায়রি করার পরও একদিন কেটে গেল। এখনও রনোর কোনও পাত্তা নেই। কাকিমা এখন গুনগুন করে কাঁদেন সব সময়। পিয়ালিরও বুকটা ভারী হয়ে থাকে। তার মনে হয়, সে যেন একটা গভীর খাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু ঠেলা মারলেই পরে যাবে।
দোতলায় উঠে পিয়ালী সেই একই পরিচিত দৃশ্য দেখতে পায়। টিভির সামনে দুজন বসে আছে। ক্লান্ত, দুঃখী দুজন মানুষ। এই দুদিন পিয়ালী এসে অন্য দু চারটে কথা বলে গুমোট কাটানোর চেষ্টা করে। তিন জনের সামনে দিয়েই ভেসে যাচ্ছে চলমান ছবি। আওয়াজ কমানো বলে মনে হয় 'নির্বাক ছবি'। কাকা নিজের মনেই বকবক করেন,"কত নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কথা শুনি। কখনও কখনও নিজেদের ছেলের এমন হবে, ভাবিনি।"
পিয়ালীর হঠাৎ মনে হলো, একবার রনোর ঘরটা ভালো করে খুঁজে দেখলে হয় না? যদি কোনও সূত্র মেলে। কাকাকে সে কথা বলতেই জলে ডোবা মানুষের মতো আঁকড়ে ধরা গলায় বললেন, "তাই তো? এটা তো আমাদের মনেই হয়নি।"
যদিও পিয়ালী সব সময় রনোও র ঘরে একলা যাতায়াত করে, তবু সে কাকিমা কে বললো, "চলো তো আমার সঙ্গে।"
রনোর ঘরে সিঙ্গেল এর চেয়ে একটু বড় অথচ ডবল নয়, এইরকম একটা খাট, একপাশে কম্পিউটার। দেওয়াল ঘেঁষে একই রকম দুটো কালো পালিশ করা চেয়ার। তার পাশে মিউজিক সিস্টেম। বিছানার পাশে ছোট নিচু টেবিলে ফোন, ঘড়ি আর দু-তিনটে বই রাখা। এই ঘরটায় রনো আর পিয়ালী সম্পূর্ণ একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আরামে কাটিয়ে দিত। আজ ঘরটায় সেই উষ্ণতা নেই।
পিয়ালী বই গুলো উল্টে পাল্টে দেখলো।এত উদ্বেগের মধ্যেও হঠাৎ তার হাসি পেলো। সে যেন সব গল্পের ডিটেকটিভ এর মতো রনোর বইতে কোনো লুকানো চিরকুট খুঁজেছে। দুটো বই-ই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস এর। আলমারির হাতল ধরে টানলো সে,চাবি দেওয়া। চাবিটা হয়তো কাকিমার কাছে আছে, পরে দেখলেই হবে। একটা ড্রয়ারে গুচ্ছের গানের সিডি আর একটাতে অফিসের ফাইল, কোনটা ইনভেসমেন্ট, কোনটা ইন্স্যুরেন্সের। ঘরটা স্বভাবতই গোছানো। ঘরের প্রতিটা ইঞ্চিতে রয়ে আছে রনোর চাপ। পিয়ালী প্রতিটা পা ফেলতে ফেলতে ভাবনা-চিন্তা করে, কোথায় যেতে পারে মানুষটা!
খাটের পাশের নিচের ড্রয়ারটা এবার খুলল পিয়ালী। রনোর সঙ্গে বিপুল অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও, সে কখনোই রনোর ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে এভাবে হাত দেয়নি। কি অদ্ভুত লাগছে পিয়ালীর যেন, রনোর নয় অন্য কোনও অচেনা মানুষের গোপন রহস্য খুঁজছে। ড্রয়ারে একটা মাঝারি আকারের ডায়েরি রাখা। প্রথম তিন পাতা সাদা তারপর বাচ্চারা যেভাবে হাতের লেখা অভ্যাস করে সেভাবে উপর থেকে নিচ অবধি লেখা - "আমি বাবাকে ভালবাসি" আবার দু-তিন পাতা পর লেখা ইংরেজিতে, "আই এম প্রাউড অফ মাই ফাদার্স" এটা রনোরই হাতের লেখা? না অন্য কারোর? সত্যি কথা বলতে, রনোর সই ছাড়া পিয়ালী তার হাতের লেখা কোনদিন দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না। আজকাল কেই বা চিঠি পড়ে বা লেখে? এসএমএস বা ফোন যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট। ডায়রিটা রেখে দিলো পিয়ালী। বেশ কতগুলো ভ্রমণ পত্রিকাও রাখা ছিল। রনোর তো বেড়ানোর শখ ছিল না। ম্যাগাজিন পরেই শখ মেটাত বোধহয়। রান্নাঘরের বেসিনে খালি কাপ টা রেখে, দুটি বিষণ্ণ, ক্লান্ত মানুষকে পেছনে ফেলে পিয়ালী রাস্তায় পা দিল।
25 শে অক্টোবর, কলকাতা : [কত অজানারে]
অফিসের বাথরুম থেকে বেরিয়ে পিয়ালী মোবাইল ফোনে চারটে মিসড্ কল দেখল। চারটেই এক নম্বর থেকে। পিয়ালী সাড়া দেবার কোন তাগিদই বোধ করলো না। রনোর কাকিমা অসুস্থ, কাকা তাকে ফোন করেছেন যাওয়ার জন্য। কাল অফিসে এতবার ফোন করেছেন যে পিয়ালী বাধ্য হয়ে আগেই বেরিয়ে ওদের বাড়ি গিয়েছিল। প্রতিদিন তা সম্ভব নয়। তাছাড়া যে রোগের চিকিৎসা তার জানা নেই, তার জন্য স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ নষ্ট করে দৌড়ে যাওয়ার কোন টান অনুভব করছে না।
রনো নেই আজ আট দিন হয়ে গেল। 'নেই' বলেই পিয়ালি যেন এই প্রথম অনুভব করল যে, রনো আসলে কোনোদিনও ছিলই না। পিয়ালির জন্যই এতদূর এগিয়েছে এই সম্পর্ক। কেন পরিনিতিহীন এই সম্পর্ক সে গত তিন বছর ধরে টেনে চলেছে? কেন মা-বাবাকে দুঃখ দিয়েছে? সেকি সবার চেয়ে আলাদা, বেপরোয়া এটা প্রমাণের জন্য ? পিয়ালির এখন মনে হয় রনোকে সে কতটুকুই বা চেনে! ছুটির দিনে পিয়ালীই গিয়েছে বারবার রনোর বাড়িতে সেই নির্জন ঘরে, প্রবল ভালোবাসা-বাসির টানেই হয়তো সে যেতো। কিন্তু রনো নিজে কখনোই আসেনি পিয়ালীর অফিসে বা বাড়িতে। রনো বেশি মাখামাখি এড়িয়ে যেত। সামাজিকতায় তার ঘোর আপত্তি। কাকিমা রোজ রনোর এই স্বভাবের জন্য বলতো, "মা-বাবা মরা তো সেই জন্যই এরকম, একটু মানিয়ে নিস।"
পিয়ালী প্রথম প্রথম রনোকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছে এইরকম অনেকেরই হয়, তুলনায় রনো তো অনেক ভাগ্যবান। ঠাকুমা, কাকু-কাকিমার খুব আদরে মানুষ কিন্তু রনোর স্পর্শকাতরতা দেখে সেই প্রসঙ্গ আর বেশি এগোয়নি।
রনো যে কেন এত অন্যরকম কে জানে? রনোর প্রতি আকর্ষণটাকে সে জোর করে ভীষণ বিতৃষ্ণায় পরিণত করতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠে না। অফিসে মোবাইলটা সাইলেন্ট করা থাকে। হঠাৎ থরথর করে কেপে উঠতে পিয়ালী দেখে রনোদের বাড়ির নাম্বার। বিবর্ণ পুরনো বাড়িটার সোঁদা গন্ধমাখা হাওয়া, ঠান্ডা ঠান্ডা দেওয়াল এর কথা মনে করে প্রবল বিরাগ নিয়ে চেয়ে থাকে সেই মোবাইলের দিকে। ফোনটা নিরুপায় হয়ে থেমে যায় একসময়। পিয়ালীও যেন অপেক্ষা করছিল এই সময়টার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোনটা তুলে বন্ধ করে রেখে দেয় ব্যাগের মধ্যে।
[ফিরেছ কি ফিরো নাই] ,২৭ শে অক্টোবর
বিবেক দংশন সত্বেও, পিয়ালির বাড়িতে যেতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। কাকিমার ফোন না ধরার মতো অসভ্যতা অবশ্য সে করেনি। আর প্রতিবারই বলেছে, অফিসে ভীষণ কাজ হাতটা খালি হলেই যাবে। কাল ছুটি থাকা সত্বেও বাড়িতে কাজ আছে বলে কাটিয়েছে। কাকিমা কি ভাবলেন তা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি পিয়ালী মনে মনে ঠিক করেছিল রনোর সাথে একটা বোঝাপড়া না করে সে ওদের বাড়ি ঢুকবে না। এটা ভাবতে গিয়ে তার বুকে হঠাৎ কাপুনি লাগে, যদি রনো আর না ফেরে? প্রশ্ন, রাগ, অভিমান, আশা, ইচ্ছে সব তাল গোল পাকিয়ে যায়। রনো ছাড়া কেমন হবে তার জীবন? অফিস, বাড়ি,বন্ধুবান্ধব, শপিং, সিনেমা সব চলবে অথচ পারিবারিক জীবনের কোথাও থাকবে না রনো ! নিঝুম রাতে আর প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিরবে ওরা অজস্র কথা বলাবলি করে, সেটা আর হবেনা।
অথচ পিয়ালী খুশি। কারণ সে মাকে খুশি করতে পারবে। ছুটির দিনে বেরোতে গিয়ে 'যাচ্ছি' বলার সময় মায়ের নাকের পাশে গভীর দাগ দেখতে হবে না। এবার মার সঙ্গে কতদিন বাদে হাতে হাত মিলিয়ে লক্ষ্মী পূজোর কাজে সাহায্য করেছে। গত তিন বছর চলে গিয়েছিল, রনোদের বাড়িতে। মা এবার একটু অবাক হয়েছে। খুশি হলেও, সেটা বুঝতে দেয়নি। আচ্ছা মাকে একটা ট্রিট দিলে কেমন হয়? শাড়ি, সিনেমা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া! উফ্ মার সঙ্গে মনে মনে খুনসুটি করতে করতে পিয়ালীর বুকের ফাটলগুলো জুড়ে যাচ্ছিল এক এক করে। কিন্তু এই সময়ে ফোনটা বাজল, পর্দায় নামটা দেখে পিয়ালীর হাত পা অবশ হয়ে গেলে। "রনো!"
আর নিজেকে বিশ্বাস নেই যদি নিজেকে সামলাতে না পারে! চারপাশের কৌতুহলী দৃষ্টিতে এড়াতে অফিসের টেবিল থেকে উঠে চলে গেলো বাথরুমে। রনো বললো, "খুব রেগে আছ?" পিয়ালী কোন কথা বলল। রনোর গলা শুনে তাঁর আনন্দের চেয়ে অবাক লাগছে বেশি। সে যেন ধরেই নিয়েছিল রনো আর ফিরবেনা। উদ্বেগ, ভয়, দুশ্চিন্তা, রাগ সব মিলিয়ে গালের ওপর অসহায় জলের ধারা। "কোথায় ছিলে এতদিন? খবর দাও কেন? কোথায় ছিলে? ফিরলে কখন?"
- ফোনে এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়! লম্বা গল্প, অফিস কাট মেরে চলে এসো এক্ষুনি।
-সব তোমার কথা মত হয়না, এখন যেতে পারবো না।
-"না বললে তো হবে না। আমি জানি, এখনই তুমি শরীর খারাপ, বাড়ি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়বে।"
রাগের চোটে পিয়ালী ফোন কাটার বোতাম টিপে দিলো। সুইচড অফও করলো। কিন্তু ব্যাগের মধ্যে পড়ে থাকা ফোনটা পিয়ালীকে কিছুতেই কাজে মন বসাতে দিল না। ফোনটাই যেন রনোর হয়ে কথা বলতে লাগল তার সঙ্গে।
রনদের লাল বাড়িটার দরজার দাঁড়িয়ে পিয়ালী যখন ঘন্টায় হাত দিলো, তখন সূর্যের যথেষ্ট তেজ। ভেতরে ঢুকে রনোর ঘরে যেতেই রনো তাকে জড়িয়ে ধরলো। রনোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পিয়ালী তার অজস্র প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতেই রনো বললো, "এখন কোন কথা নয়, লেট মি লাভ" আবারো চাপা পড়ে যায় কথা। ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে ঘরের মধ্যে। পিয়ালীর কল্পনার হাসিখুশি প্রেমিক রনো আজ কী ভীষণ বাস্তব ! গত কয়েকদিনের দুঃস্বপ্ন এখন যোজন দূরে।
পিয়ালী বলল, "তোমাকে এখন অনেক ভালো দেখাচ্ছে। দাড়ি একদম সুট করছিল না"
-তোমার সঙ্গে যেদিন লাস্ট দেখা হলো সপ্তমীতে, সেইদিনই কেটে ফেলেছি। এবার তুমি যা বলবে তাই করব। সেই জন্য একবার ইন্ডিপেন্ডেন্স সেলিব্রেট করে নিলাম শেষবারের মতো। খুশি তো? কাকা-কাকিমা-তুমি কারোর মনে কোন অভিযোগ রাখবো না। কবে আসবে বাড়িতে পার্মানেন্টলি?
পিয়ালির যতটা খুশি হবার কথা ছিল, ততটা হলো না দেখে নিজেই অবাক হল। কেন যে এত অন্যরকম মনে হচ্ছে কে জানে রনোর কথার উত্তর না দিয়ে পিয়ালী বলল, "আগে বলো কোথায় ছিলে?"
-বর্ধমান-বিষ্ণুপুর-মুর্শিদাবাদ-বোলপুর ঘুরে বেড়ালাম। খুব অদ্ভুত লাগছিল আমি আগাপাশতলা শহুরে, গ্রামের পুজো যে কি দারুন হতে পারে জানতাম না। নেক্সট টাইম তোমাকে নিয়ে যাব।
-তুমি ওই দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছ আর আমরা দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে থানায় ডায়েরি করলাম। এরকম পাগলামী করলে কি করে! তোমরা কাল রাতে ফিরে কাকাতে নিয়ে থানায় গেলাম।
-"এরকম বোকামি করে কেউ? যদি কোনো বিপদ ঘটত? ফোন করনি কেন?"
-মোবাইল বাড়িতেই ফেলে গেছিলাম। বুথ থেকে কয়েকবার ট্রাই করেছিলাম পাইনি।
-কে বিশ্বাস করবে তোমার কথা।
রনোর গলা নরম হয়ে এল। পিয়ালীর কোমর ধরে কাছে টানল সে। তখনই পিয়ালীর মনে পড়ল, সে মাকে বলেছিল, আজ তাড়াতাড়ি ফিরে নতুন শপিংমলটায় নিয়ে যাবে। মা আশা করে থাকবে। নিজের ওপরই তার রাগ হয়ে গেল। এখন আর সময় নেই। তা সত্বেও এখনই বাড়িতে পৌঁছানোর ইচ্ছেটা হঠাৎ প্রবল হয়ে উঠেছিল। পিয়ালী একটু পিছিয়ে যেতেই, রনো হাত বাড়িয়ে পিয়ালীকে আবার ধরার চেষ্টা করতেই পিয়ালী হাত সরিয়ে রনোর সামনে দাড়ালো। রনোর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পারলে ডুবুরি হয়ে নেমে যায় তার মনেৱ মধ্যে।
রনো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "এমন করছ কেন? কি হয়েছে?" তুমি রাগ কৱেছ নাকি? বলতে বলতে সে মুখ ঘষে পিয়ালীর কাধে। পিয়ালী স্থির থেকে তাকে শান্ত হবার সময় দেয়। তারপর আস্তে করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,"কাকিমার সাথে দেখা না করেই ওপরে উঠে চলে এসেছি। চলো নীচে যাই ।"
নিজের শান্ত স্বাভাবিক ভাবটা দেখে পিয়ালী নিজেই অবাক হয়ে গেল। কাকিমা কিছু খেয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করছিল, পিয়ালী শরীর ভালো নেই বলে উঠে পড়ল। প্রানপনে শুকনো ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো, "রনো চলো আমাকে এগিয়ে দেবে" রনোও উঠে পড়লো তার সঙ্গে। বিদায়ের ঠিক আগের কয়েক মুহূর্তের জন্য এই নির্জনতা কয়েকদিন আগেও কতটা উপভোগ্য ছিল। আজ জাফরিকাটা রেলিং দিয়ে দেওয়া সিঁড়ি ধরে নামতে নামতে পিয়ালী মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে ও যেন এমনি করে আসছে। এইটুকু রাস্তা যেন কত দীর্ঘ... এ কখনো শেষই হবে না।
সিড়ির নিচে আবছায়ায় রনো বরাবরের মতো তাকে জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। রনোর হাত আমার কোমরে খেলা করছে, তার ঠোঁট আমার গলা ভিজিয়ে চলেছে যা চেপে বসে প্রায় দম বন্ধ করে দিচ্ছে।
হঠাৎ রন তাকে ছেড়ে দিয়ে সদর দরজাটা খুলে দিল। আচমকা উজ্জ্বল আলোয় পিয়ালির চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ফুটপাতে পা দিয়ে পিয়ালী বুকভর্তি বাতাস টানলো। রনো দাঁড়িয়ে আছে 100 বছরের পুরনো সেগুন কাঠের দরজার ফ্রেমের। শেষবারের মতো ঘুরে দেখল পিয়ালী। তারপর ঘুরে ধীরে ধীরে মিশে গেল বাড়ি ফেরা হাজারো লোকজনের মাঝে।…
লিখনে : সৈকত সেনাপতি
©Barthopion
টানা লকডাউন। আজ প্রায় তিনমাস টানা বাড়িতে বসে পার্থিব। ওদিকে শিলিগুড়িতে বাবা-মা, দাদা-বৌদি, ভাইপো, বোন। এদিকে একা পার্থিব। কলকাতা ছেড়ে যে, পালাবে তারও উপায় নেই।এখানে আপন বলতে পার্থিবর কেউই নেই। চাকরিসূত্রে থাকা।
অবশ্য কেউ নেই বললে ভুল বলা হবে। জয়িতা। পার্থিব যে বাড়িতে ভাড়া নিয়ে আছে,তার থেকে সিকি কিলোমিটার দূরে বনরানি আবাসন, সেখানেই জয়িতাদের ফ্ল্যাট।কিন্তু ওই লকডাউন এ জয়িতা থেকেও নেই। টানা একমাস জয়িতা আসেনি। আসতে পারেনি। এমন নয় যে এলাকায় খুব কড়াকড়ি, দোকান বাজার সব বন্ধ! সেসব কিছুই তেমন হচ্ছে না। রাস্তায় লোকজন ঘুরছে। দোকান বাজারও খোলা । শুধু জয়িতাই আসতে পারছে না। তার পেছনে অবশ্য লকডাউন পরিস্থিতি নয়, রয়েছে ওর স্বামী সায়ন।
এমনিতেই সায়ন খুবই ব্যস্ত মানুষ। স্ত্রী-ছেলেকে বিশেষ সময় দিতে পারেনা। চাঁদনীতে সায়নের অফিস। তবে সায়ন চাকরি করে না। ব্যাবসা। সেই ব্যবসার কাজে সায়ন সকাল নটা তে অফিস বেরোয়। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। তারপরও ল্যাপটপ নিয়ে চলে আরেকপ্রস্থ কাজ। এমনকি ছুটির দিনেও সায়নের ছুটি থাকে না, সেদিনও চলে নানা ফোন, এটা-ওটা কাজ। তাই সায়নের প্রসঙ্গ উঠলেই জয়িতার চোখ-মুখ পাল্টে যায়। ওর নরম মুখে তখন কঠোর প্রলেপ পড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে জয়িতা অনেকদিন বলেছে, "নির্ঘাত বাইরে কারো সঙ্গে লাইন আছে, আজ কাল রাতেও কাছে আসতে চায় না।"
কিন্তু এখন সেই সায়ন ঠায় ফ্ল্যাটে আটকা। লকডাউনে অফিস বন্ধ-ব্যবসা বন্ধ। সায়নের পাগল-পাগল অবস্থা। সারাদিন ফোন এবং ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে। থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। জয়িতাকে বোঝাচ্ছে, কি বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল ওর। জয়িতাও ওকে সান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু টানা এতদিন সায়ন বাড়ি থাকায়, ভিতরে ভিতরে জয়িতাও হাঁপিয়ে উঠেছে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ছেলেটাও দু' কামরার ফ্লাটে আটক থাকতে চাইছে না। কিন্তু উপায় নেই, এখন নড়াচড়া করা যাবে না। এইসব এর মধ্যে জয়িতা লকডাউন পূর্বে একদিন আসতে পেরেছিল। সেদিন জিনিসপত্র কেনার ছুতোয় জয়িতা বেরিয়ে ছিল। তখনও অবশ্য লকডাউনের বেশিদিন হয়নি। সবাই ভেবেছিল, এক সপ্তাহ পরেই সব আবার আগের মত হয়ে যাবে। তাই জয়িতাকে বেরোতে দেখে সায়ন বাধা দেয়নি। তবে সেদিন ও ঘরে এলেও বেশিক্ষণ থাকেনি পাছে সায়নের সন্দেহ হয়। অনেকদিন পর জয়িতাকে পেয়ে পার্থিব সেদিন নিজেকে সামলাতে পারেনি। কিন্তু আটকে দিয়েছিল, ও বলেছিল," কষ্ট কি একা তোমার? আমার হচ্ছেনা? কিন্তু কি করবো বলো এখন বেশি এলে কিংবা ফোন করলেই ধরা পড়ে যাব। সায়ন এমনিতে খুব বেশি আর কয়েকটা দিন এভাবে থাকবে লকডাউনে উঠলে ও বেরোবে, বেরোবে! তখন আমি আবার আসবো, আগের মত।"
পার্থিব আর জোরাজুরি করেনি। জয়িতা ভুল বলছে না। তাছাড়া তখনও পার্থিব নিশ্চিত ছিল, লকডাউন বেশিদিন চলবে। না সব আবার আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলনা, লকডাউন শুরু হতে পার্থিবও বাড়িতে আটকা পড়ে গেল। অফিস তার আগেই ওদের হাতে ল্যাপটপ ধরিয়ে দিয়েছিল, লকডাউনে শুরু হলো 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'। দুর্বল ইন্টারনেট কানেকশনের ভরসায়, প্রতিদিন বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করা। যে কাজ অফিসে হয় এক ঘন্টায় হতো, সেটাই এখন বাড়তে বাড়তে আড়াই ঘণ্টায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই কাজ করতেই হবে। এদিকে নিউজ চ্যানেল কিংবা নিউজ ওয়েবসাইটগুলো যা বলছে তাতে ভয়াবহ দুর্দিন আরো আসতে চলেছে। চাকরি থাকবে কিনা তাও সন্দেহ। বিশেষ করে ওদের মত আইটি সেক্টরের ছেলেমেয়েদের।
কোভিড-১৯ ও তেমনি। প্রতিদিনই টিভি খুললে দেখা যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে।
এই এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। মাছ,মাংস,সবজি ঠাসা। রান্না ঘরের চাল,ডাল,আটা,নুন,তেল মজুদ করা কিন্তু রান্নার লোক থেকে কাজের লোক সব ছুটি নিয়েছে অতএব রান্না করতে হচ্ছে পার্থিবকেই। শুধু কি তাই ঘর মোছা থেকে কাপড় কাচা সবই করতে হচ্ছে। তার ওপর অফিসের কাজ। টিভি খুললেই বিভৎস ঘটনার ছবি এবং ধারাভাষ্য। আক্রান্তের সংখ্যা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বজুড়ে। দেশের লোকেরা আতঙ্কিত। শ্রমিকরা মাইলের পর মাইল হাঁটছে। লকডাউন মানছে না। মানুষ,কুকুর,বিড়াল,চিড়িয়াখানা থেকে সার্কাসের জন্তু খাবার জুটছে না অনেকেরই। খবরে দেখাচ্ছে অনাহারক্লিষ্ট মুখ। কচু পাতা খেয়ে থাকার ঘটনা। তারপর সেলিব্রিটিদের রান্নাঘর। জীবনযাপন। দেখেশুনে ঘরে বসে দম আটকে আসছে পার্থিবর।
এই বাড়িটা যখন পেয়েছিল, নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। একতলা বাড়ি। বাড়িওয়ালা ঋষিকেশ বাবু থাকেন রেল লাইনের ওপারে। সোজা কথায় কিছু টাকা মাসে মাসে ধরিয়ে দিলেই এই বাড়ির অধীশ্বর পার্থিব ও একাই। ঋষিকেশবাবু মানুষটাও ভালো। বোধ হয় ওর মত পরিযায়ী চাকুরেদের কেবল ভাড়া দেন। কোন পরিবারকে চট করে বিশ্বাস করতে চান না। যদি বাড়ি ছাড়তে না চায়। তাছাড়া পাড়াটাও ছিমছাম। ফাঁকা ফাঁকা। অনেক বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। কিছু বাড়ি সদ্য হাতবদল হয়েছে। এখনো পড়েনি। তাই জনশূন্য। অতএব ওর ঘরে যখন জয়িতা আসে সেটা কেউ দেখে না। দেখলে মাথা ঘামায় না।
কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে পার্থিবর মনে হল, এতদিন শুধু বাড়িটার একটা দিক নিয়ে সে ভেবে এসেছে। অন্য দিকটা দেখা হয়নি। সেটা এখন দেখতে হচ্ছে, ও যদি এই ঘরে মরে পরে থাকে, আগামী মাসে ঋষিকেশ বাবু ভাড়া নিতে আসার আগে কেউ জানতে পারবে না। এতটা নির্জনে থাকা ভালো নয়। এই পরিস্থিতিতে চুরি-ছিনতাই হতে পারে। খেতে না পাওয়া লোকেদের বিশ্বাস নেই। ওরা সবই পারে। আর একবার যদি ওরা এসে হামলা চালায়, হাক পারলেও এই পাড়ার লোকদের পাওয়া যাবে না। আজ বিকেল থেকে আবহাওয়া গুমোট। ঘরেও থাকতে ইচ্ছে করছেনা পার্থিবর। ও সেইসঙ্গে মনও খুব খারাপ। দুপুরে মা ভিডিও কল করেছিলেন। ওকে অনেকদিন দেখতে পাচ্ছেন না তাই কান্নাকাটি শুরু করে করেছিলেন বোন এবং বাবা মিলে অনেক কষ্টে মাকে সামলেছেন। কিন্তু মায়ের কান্না কান্না চোখ মুখ দেখার পর থেকে আর কিছুই ভালো লাগছে না। মন খারাপ কাটাতে বিকেলে জয়িতাকে ফোন করেছিল। কিন্তু জয়িতার ফোন বেজে গিয়েছে। পার্থিবর নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। একটু আগে মাইকে করে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচার করা হচ্ছিল। সেই প্রচারে বলা হচ্ছিল, কেউ যেন বাড়ি থেকে অপ্রয়োজনে না বেরোয়। এলাকার দোকান বাজার এবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হবে। কিন্তু তার পার্থিব আর বাড়িতে থাকতে চাইছিল না। নিদেনপক্ষে যদি জয়িতাদের আবাসনের সামনে গিয়ে ওকে একবার দেখতেও পেত। তাহলেও মনটা শান্ত হতো। কিন্তু তারও উপায় নেই। তাছাড়া ব্যাপারটা খুব ছেলেমানুষী হয়ে যাবে। এখন কি ও আর ক্লাস নাইন-টেনের পার্থিব আছে যে,মধুজাদের ফ্ল্যাটের সামনে রাত দশটায় দাঁড়িয়ে থাকবে যদি এক ঝলক মধুজার সাথে দেখা হয়ে যায়, এই কথা ভেবে!
শুধু মনের জ্বালা তা তো নয়। জ্বালা আরো আছে, আজ মা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, "কতদিন ধরে তোকে বলছি এবার বিয়ে কর, তোর পছন্দ করে রাখা কেউ থাকলে বল না হলে আমি মেয়ে দেখি। কিছুতেই রাজি হচ্ছে না আজ যদি তোর বউ থাকতো আমার কি এত চিন্তা হতো। নাকি তোকেও হাত পুড়িয়ে খেতে হতো এই অবস্থায়? বাড়িতে তোকে তো কোনদিনও এক গ্লাস জল গড়িয়েও খেতে দিইনি। মায়ের অভিযোগও ভুল নয়। সত্যিই দেড় বছর ধরে মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন, "আর কিছুদিন যাক" বলে এড়িয়ে যাচ্ছে পার্থিব। ততদিনে তো জয়িতা এসে গিয়েছে ওর জীবনে। শুধু এসে গিয়েছে নয়, ওর জীবন জড়িয়েও গেছে জয়িতার সঙ্গে।
সেই আসাটা ছিল ভারী নাটকীয়। অনেকদিন ধরে একটা আঠা কিনবে বলে ভুলে যাচ্ছে পার্থিব। সেদিন এক রবিবারের সকালে ও সংকল্প নিয়ে বেরিয়েছিল সেই দিন ও কিনবেই। কিন্তু এমন অবস্থা, যে কোন দোকানে আঠা নেই তিনটে-চারটে দোকান করার পর, বাবলু স্টোরে গিয়ে আঠা পেল। কিন্তু কিনতে যাবে, তখনই একজন ভদ্রমহিলা হুড়মুড় করে দোকানে এসে বললো আঠা আছে?
দোকানদার ছেলেটা হেসে বলল," ছিল এক্ষুনি, কিন্তু সেটা উনি কিনে নিচ্ছেন।"
ভদ্রমহিলা হতাশ গলায় বললো, আমার ছেলের স্কুলের খাতার মলাট দিতে হবে। কোথাও পাচ্ছি না।
পার্থিব ভাল করে তাকাল ভদ্রমহিলার দিকে। বয়স সাতাশ আটাশ বছর। লম্বা। ছিপছিপে ফিগার। চোখ-নাক কাটা কাটা। মাথা ভর্তি চুল। গায়ের রং ফর্সা। রাস্তাঘাটে চট করে এত সুন্দরী চোখে পড়ে না। সেই রুপেরই হোক কিংবা অসহায়তায়, পার্থিবর হাতে ধরা টিউবটা ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, "নিন। আমার পরে হলেও চলবে।"
"কিন্তু…" ভদ্রমহিলা ইতস্তত করল।
"নিন," পার্থিব হাসলো, "আমারটা তত এসেন্সিয়াল নয়"
ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে নিল। আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে গেল। তারপর ভদ্রমহিলা বলল, কিন্তু দামটা!
পার্থিব হেসে ফেললো। বলল, "লাগবে না। ওটা আর কি দেবেন"
" তবু", ভদ্রমহিলার অস্বস্তি যাচ্ছিল না।
পার্থিব এবার ভদ্রমহিলাকে সহজ করার জন্য বলল," আপনার ছেলেকে গিয়ে বলবেন, একটা কাকুর সঙ্গে দেখা হল। সেই কাকু দিয়েছে।" এবার হেসে ফেলল ভদ্রমহিলা। দুজনে বাবলু স্টোর থেকে বেরোলো। ভদ্রমহিলা জানতে চাইল," আপনি কি এখানেই থাকেন?"
"আপাতত। চাকরি করি সল্টলেকে। এখান থেকে যাতায়াতের সুবিধা, অটো পাওয়া যায়। আমার নাম পার্থিব চ্যাটার্জি। আপনি?"
"আমাদের কিছুদিন হলো এখানে ফ্ল্যাট কিনে এসেছি। আমার নাম জয়িতা বসু দাশগুপ্ত।" সেদিন পার্থিব ভাবতেও পারেনি ওই আঠা জুড়ে দেবে দুজনকে। এরপর আর-একদিন বাজারে দেখা হয়েছিল। তখন জয়িতার সঙ্গে ওর পাঁচ বছরের ছেলেও ছিল। সেদিন জয়িতাই ডেকে কথা বলেছিল পার্থিবর সঙ্গে। ধীরে-ধীরে রাস্তায় দেখা বেড়েছে। কথাও বেড়েছে। ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হয়েছে। এবং পার্থিব জেনেছে জয়িতার অসুখী দাম্পত্যের কথা। এত সুন্দরী মেয়ে অসুখী! গোড়ায় অবাক হয়ে গিয়ে পার্থিব। তারপর জয়িতাদের ফাকা বাড়িতে আসা- যাওয়া বাড়ার পর পার্থিব বুঝেছে, এমন মেয়েকেই যেন ও সারাজীবন খুঁজে এসেছে।
এখন তো জয়িতাকে ছেড়ে নতুন কোনও মেয়ের সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকা ওর পক্ষে অসম্ভব। যদি কোনোদিন সায়নকে ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে জয়িতা কাছে এসে দাঁড়ায়, তাহলে ওকে গ্রহণ করতে পার্থিব এক মুহূর্ত ভাববে না। মুশকিল হল, জয়িতা খুব ভয় পায় সায়নকে।
এই অসুখী সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল পার্থিব। কিন্তু জয়িতা রাজি হয়নি। বলেছিল,"তুমি জানো না, ওর হাত কত লম্বা। বিজনেসম্যান তো! পলিটিকাল কানেকশন প্রচুর। তোমার বিপদ হয়ে যাবে। তার চেয়ে এই ভালো।"
কিন্তু এতদিন জয়িতাকে ছাড়া থাকতে-থাকতে পার্থিব অনুভব করেছিল, দীর্ঘদিন ধরে জয়িতা একটা নেশা ধরিয়ে দিয়েছে ওকে। নারীসঙ্গের নেশা। ফাঁকা বাড়িতে সেই নেশা আরো তীব্র হয়ে যাচ্ছে। চারপাশের দমচাপা পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচতে একবার যদি জয়িতাকে ঘন্টাখানেকের জন্য পেত, নিজেকে সামলে নিতে পারত পার্থিব। সেই উদ্দেশ্য ও ফোন করেছিল মেয়েটাকে। কিন্তু জয়িতা ফোন ধরলো না। সায়ন কি সামনে ছিল? নিশ্চয়ই তাই। এছাড়া অন্য কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে না।
পায়ে পায়ে ছাদে উঠল পার্থিব। গরম কালের সন্ধে। আলো নিভে যাওয়ার পরেও আকাশে কিছু রেশ রেখে যায়। অন্ধকারের গায়ে সেই আলোটুকু এখনো লেগে। পার্থিব চারপাশ দেখল। কেউ নেই কোথাও। মাথার ওপর পুরনো বাড়ির দেওয়ালের মত আকাশ। সেই আকাশে রঙের মতো তারারা ফুটে। হঠাৎ বড় একা লাগলো পার্থিবর। মানুষ নানা কাজ দিয়ে, অন্যদের সঙ্গে থেকে নিজের একাকিত্বকে ঢেকে রাখে।
কোভিড-১৯ যেন প্রলেপ খসিয়ে সেই একাকিত্বকে টেনে এনে ওর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই সময় জয়িতাকে বড় দরকার পার্থিবর। আবার জয়িতার নম্বর ডায়াল করল। ফোনটা বাজতে লাগলো। বেজেই যেতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত এক সময় থেমে গেল গেল। রোখ চেপে গেল পার্থিবর। ও আবার ফোন করল। কিন্তু এবার ফোন বেজে উঠতেই জয়িতা লাইন কেটে দিল। হকচকিয়ে গেল পার্থিব। কিন্তু দমে না গিয়ে ও আবার ফোন করল। কিন্তু তৃতীয় বার ফোন আর বাজলো না। এবার শুধু যান্ত্রিক কলা জানাতে লাগলো জয়িতা পরিষেবার সীমার বাইরে চলে গিয়েছে।
হঠাৎ খুব রাগ হতে লাগলো পার্থিব ওর। রাগ ও ছটফটানি। জয়িতা কি পারত না একবার ফোন ধরে কথা বলতে? এতবার ফোন করেছে ও। হতেও তো পারে পার্থিবর কোনো বিপদ হয়েছে! সেই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আকুল হয়ে যোগাযোগ করতে চাইছে জয়িতার সঙ্গে। তাহলে ওর বিপদে কি জয়িতাকে কোনদিনও পাওয়া যাবে না? না পেলে কিসের এত ভালোবাসা? এত অপেক্ষা?
ছাদ থেকে নেমে এলো পার্থিব। শরীর মনে আগুন জ্বলছে। ঘরে থাকলে দম আটকে আসছে। ঘড়িতে সবে সাড়ে সাতটা। এখনো একটা আস্ত রাত বাকি। যে- রাতে ওকে একা থাকতে হবে এই চার দেওয়ালের ভিতরে। তারপর আরো আরো দিন আসবে, আরো আরো রাত। লকডাউন চলবেই। চারদেয়ালে নিজের ইচ্ছে,ভালোলাগা,ভালোবাসা নিয়ে থেকে যেতে হবে পার্থিবকে। একদিন হয়তো লকডাউন উঠবে। কিন্তু ততদিন কি মনে মনে বেঁচে থাকবে পার্থিব? ওই ভালবাসা, ওই ইচ্ছে গুলো কি আর আগের মত থাকবে?
দরজা প্রায় খোলা রেখেই পাড়ায় বেরিয়ে এলো পার্থিব। চারপাশে নিঝুম ভাব। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। রাস্তায় সব আলো জ্বলছে না। সেই অল্প আলোয় ভাঙ্গা বাড়ি, সদ্য ওঠা ফ্ল্যাটগুলো,ফাঁকা বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে চলতে-চলতে পার্থিবর হঠাৎ মনে হল,এক নতুন জগতে এসে পড়েছে ও। যে পাড়ার মধ্যে দিয়ে ও হাঁটছে, চারপাশের যেসব বাড়িঘর, কোন কিছুই আর আগের মত নেই। যে পৃথিবী আর কোনদিন আগের পৃথিবীতে ফিরে যাবে না।
আনমনে হাঁটছিল ও। হঠাৎ দেখতে পেল একটা ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে একজন নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে। প্রথমে থমকে গিয়েছিল পার্থিব। একটা ভয় বুকের ভেতর লাফ দিল।আচমকা ওর খেয়াল হলো দরজা আটকানো হয়নি। তার ওপর পাড়া শুনশান। রাস্তায় ও একা। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে খানিক নিশ্চিন্ত হল। একটা মেয়েমানুষ। বছর তিরিশেক বয়স। কালো। ময়লা শাড়ি পরা। চেহারায় উস্কো-খুস্কো ভাব । গালের হনু দুটো উচু।
পার্থিব চাপা গলায় ডাকল,"কে?"
মেয়েটা কোনও কথা বলল না। একটু-একটু করে বেরিয়ে এল। আলোর সামনে এসে দাঁড়াল। "ওখানে কি করছিলে?" প্রশ্ন করে পার্থিব চারপাশে চোখ বোলালো। মেয়েটার পেছনে কিংবা আশেপাশে আরও লোকজন নেই তো!
মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। বলল," দু'দিন কিছু খাইনি বাড়িতে তিনটে বাচ্চা। ওদেরও খাওয়া হয়নি। তাই…."
"তাই?"পার্থিব মেয়েটার থেমে যাওয়া কথাটাকেই প্রশ্নের সামনে ফেলে দিল। আর দিয়ে বুঝতে পারল মেয়েটা কি বলতে চাইছে। কারণ, বাকি কথাটুকু মেয়েটার চোখ বলে দিচ্ছে।
"তোমার স্বামী?"
"ছেড়ে চলে গিয়েছে... 3 বছর... একটা কারখানায় কাজ করতাম... সেটাও বন্ধ…"
শরীরে অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি খেয়ে গেল পার্থিবর । জয়িতার মুখটা একবার মনে পড়লো। মনে পড়লো সেই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরও। তারপর পার্থিব আশ্চর্য হয়ে দেখল ওর মুখ ভিতর থেকে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে এলো, "কত নেবে?"
মেয়েটা মাথা নাড়লো বলল, "টাকা চাই না। চাল-ডাল... বাচ্চাগুলো আসলে…"
"আছে। এসো," তারপর একই ভাবে উত্তর দিলো। এবং উত্তরটা দিয়ে বুঝল, নতুন পৃথিবীতে ওর ভেতর থেকে অন্য পার্থিব বেরিয়ে এসেছে। যে পার্থিব একমাস জয়িতাকে না পেয়ে ছটফট করছে।
মেয়েটা একবার তাকাল ওর দিকে। চোখের সংশয়। বোধহয় কিছু ভাবছে। পার্থিব ও নিজেকে দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু বুঝতে পেরেছিল, আয়নার সামনে যে মানুষটাকে ও রোজ দেখে সেই মানুষ আর এই মানুষ এক নয়। এই মানুষ উপোসী। এই মানুষ বেপরোয়া।
হন হন করে পার্থিব নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। পায়ের শব্দ পেয়ে বুঝল মেয়েটাও পিছু-পিছু আসছে। হাঁটতে হাঁটতে যেন নিজের সঙ্গেই ধ্বস্তাধ্বস্তি করছিল পার্থিব। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? ঝোঁক কেটে গেলে কি হবে? জয়িতা হয়তো রাতের দিকে ফোন করবে। বলবে, সায়ন কাল বেরোবে। অতএব কালই ও আসছে। কিন্তু প্রবৃত্তির জোর যুক্তির চেয়ে বেশি। পার্থিব নিজের মধ্যেই লড়াই করছিল। কিন্তু মেয়েটাকে আসতে বাধা দিচ্ছিল না। দিলেও কি মেয়েটা এখন শুনবে? বাড়িতে তিনটে ছেলেমেয়ে। তাদের কারও খাওয়া হয়নি দু'দিন। মেয়েটাও সমান বেপরোয়া।
ঘরের ভেতর ঢুকে পার্থিব হাঁপাতে লাগলো। কোনদিন ভাবেনি এভাবে একটা মেয়েকে চাল-ডালের লোভ দেখিয়ে ঘরে আনবে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করল পার্থিব। এসব ফালতু চিন্তার কোন মানে হয় না। কেউ দেখছে না। কেউ জানতে পারছে না। অতএব কারো কিছু বলার নেই। হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দ, চোখ খুলতেই পার্থিব দেখল মেয়েটা দরজা আটকে এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মাঝামাঝি। এবার মেয়েটাকে ভাল করে দেখল পার্থিব। সত্যি মেয়েটার আঁটোসাঁটো শরীর। এমন শরীর জয়িতার মতো মেয়েদের থাকে না। এর শরীর অনেক শক্ত, অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে পারে। পার্থিব মেয়েটার দিকে হাত বাড়ালো।
কিন্তু মেয়েটা পিছিয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে বলল, "জিনিস দেবে তো, গতকাল একজন দেয়নি।"
পার্থিব আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মেয়েটার শরীর যেন মিকেলেঞ্জেলোর ভাস্কর্য। ও মাথা নেড়ে বললো "সব দেবো, এসো।"
"না", মেয়েটা তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিল," আগে জিনিস দেখাও। রাখো সামনে।"
পার্থিব ওর মাথা গরম হয়ে গেল এবার মেয়েটা শুধু নিজের দিকটা দেখছে কিন্তু ও কি জানে না একমাস জয়িতা আসেনি এই বাড়িতে একমাস হলো পার্থিবর ভিতরে যে-পার্থিব, সে এবার হাত বাড়িয়ে মেয়েটার শাড়ি ধরল।
আর তখনই মেয়েটা খুব জোরে একটা ঘুষি মারল পার্থিবর মুখে। আচমকা। ঘুসি সোজা পার্থিবর নাকে গিয়ে লাগল। নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। যন্ত্রণায় দু'হাতে মুখ চেপে কুকড়ে গেল পার্থিব । সেই সুযোগে মেয়েটা ওকে জোরে ধাক্কা মারলো। টাল সামলাতে পারল না পার্থিব। ও ঘরে একধারে ছিটকে পড়ল। মেয়েটা এবার সোজা দৌড় লাগালো রান্নাঘরের দিকে।
রান্নাঘরে মেয়েটাকে যেতে দেখে পার্থিব কোনমতে উঠে দাঁড়ালো। শরীরে যন্ত্রণা কিন্তু ওর মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে। এই আগুন অন্য আগুন। দরজার পাশে একটা খিল রাখা। মাঝের দরজা আটকানোর জন্য। সেই খিল্টা ও তুলে নিল। মেয়েটাকে পেতে হলে, ওকে আগে কাবু করা দরকার। ওই মেয়ের সঙ্গে পার্থিব গায়ের জোরে এঁটে উঠতে পারবে না।
মেয়েটা ততক্ষনে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছে। নিচু হয়ে বোধহয় চালের টিন খুঁজছে। কিন্তু পার্থিব আর সময় নষ্ট করল না। সপাটে একটা খিলের বাড়ি বসিয়ে দিল মেয়েটার পিঠে। চাল ডালের টিনগুলোর পাশে পড়লো মেয়েটা। খিলের বাড়িটা বেশ জোরদার হয়েছে। মেয়েটা পড়ে থাকল। সহজে সোজা হয়ে উঠতে পারল না। পার্থিব হিসেব কষছিল, মেয়েটা সোজা হলে সপাটে আবার চালাবে। না খেতে পাওয়া মানুষজনেরা বেশিক্ষণ লড়তে পারে না, এটা ও জানে।
কিন্তু পার্থিব যেমন ভেবেছিল, তেমন হলো না । মেয়েটা যেখানে পড়েছিল তার পাশেই রাখা শিলনোড়া। পড়ে থাকতে থাকতেই মেয়েটা পাথরের নোড়াটা তুলে নিল। তারপর কেতরে কেতরে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালো। চোখে জলন্ত দৃষ্টি ।
পার্থিবও তৈরি ছিল। কিন্তু মেয়েটার চাওনি দেখে বুঝল, অত সহজে মেয়েটাকে ঘায়েল করা যাবে না। ওর কড়া জান। তার চেয়ে বড় কথা হাতের নোড়াটা যদি নির্ভুল নিশানায় ছুড়ে পার্থিবর মাথায় মারে, ও মরেও যেতে পারে। এখানে মরে পড়ে থাকলে…. মেয়েটা কোন কথা বলছে না, শুধু হিংস্র শ্বাপদের মত পার্থিবকে আক্রমণ করার সুযোগ খুঁজছে। পার্থিবও খিল বাগিয়ে। একবারও মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরায়নি। ও জানে একবার অসতর্ক হলে, মেয়েটা ওকে শেষ করে ফেলব। তাই মেয়েটা আক্রমণ করার আগে ওকে আক্রমণ করতে হবে। এমন মুহুর্তেই ঠোঁটে রক্তের স্বাদ পেল। ওর নাক দিয়ে সমানে রক্ত গড়াচ্ছে। সেই রক্ত এসে লেগেছে জিভে। নিজের রক্তের স্বাদ ওকে চনমনে করে তুলল। মেয়েটাকে অত সহজে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ছেড়া ব্লাউজ ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে মেয়েটার সুঢৌল স্তন। এত অনাহারেও মেয়েটার শরীর কিন্তু অটুট। এবার যদি মেয়েটাকে বাগে পায়, তা হলে শেষ করে দেবে।
ওদিকে মেয়েটাও খর চোখে ওকে জরিপ করছে। চাল-ডালের টি, আর ওর মাঝখানে শুধু একটাই বাধা, পার্থিব। একবার সেই বাধা সরিয়ে দিতে পারলেই যা খাবার পাবে, তাতে আপাতত ওর আর ওর তিন ছেলেমেয়ের চলে যাবে ।
রান্নাঘরের ছোট পরিসরে দুজন ঘুরতে লাগলো পরস্পরকে মাপতে মাপতে। ঘুরতে ঘুরতে পার্থিব বুঝতে পারছিল রান্নাঘর আর রান্নাঘরে নেই।
চারপাশের চেনা জগৎ পাল্টে যাচ্ছে। এক নতুন পৃথিবীর জন্ম নিচ্ছে, সেই পৃথিবীতে দুই নারী-পুরুষ পরস্পরকে হিংস্রভাবে শিকারের সুযোগ খুঁজছে। দুজনের হাতেই আদিম অস্ত্র শরীরে খিদে। আপতত আর কিছু নেই, কোথাও নেই।
লিখনে~ সৈকত সেনাপতি
© Bartho PionUmm Movie is Little bit As Usual previous one. But As always, Branagh has an amazing knack for bringing such creativity and beauty to Christie’s novels.
Death On The Nile is a good, “Who Done It?” mystery that once again reminds me of a good game of clue. Detective, Hercule Poirot is back for another mystery but One question just kept popping up on head that,"Every time When our detective goes around, someone is killed in (train or Cruise)!" The Detective, Kenneth Branagh Is Awesome in His Character. You are just gonna Falling love with Emma's Beauty. Death On The Nile is visually stunning and his ability to keep viewers in their seats as he navigates this winding Nile river view & Egypt's Beauty is outstanding. Also Satisfied to watch Ali Fazal in Hollywood Film. The Ending Twist is Good Enough as Agatha Christie’s novels.
• Personal Rating : 6.8/10
• Review (Spoiler Free) By Saikat
©Barthopion
According to its First Season :
It Feels That it is one of the Best teen Webshow In An Other Level...With a Context of Drugs, Depression, Love, Brutality, affair, Sex, Mistakes, jealousy, Crime...and many more. Which is Perfectly Mixed With Labrinth's Awesome Music Score.Its One of the Best Acting Performance of Zendaya...
And Also Nothing to Say,about its Artisic & Asthetic Vibes in Cinematography just Speechless.
• Our Rating : ৪.6/10
(According to Its Cinematography, Acting Performance, Music Score, & Artistic Touch .)
• This Is Available In Disney+ Hostar.
You Should Have to Watch This Webshow Once if you want to change your Taste.
Review by Saikat (Spoiler Free)
©Barthopion.
Our Music Video Edits : [ Tap The Button To Watch Now ! ]